উনিশ
রোদ ঝলমল করছে। মেঘহীন সুনীল আকাশ। মৃদু হাওয়ায় স্কুলের সামনের পতাকাটা পতপত করে উড়ছে, গাছেরা কানাকানি করছে।
ফুটবল মাঠটি ঘুরে পাশের নতুন পুলটার কাছে গেলাম। দালানটা লম্বা, নিচু আর সাদা। চওড়া কাঁচের দরজাগুলোয় রোদ পড়ে সোনার মত চকচক করছে।
একটা দরজা টেনে খুলতেই এক ঝলক গরম হাওয়া স্বাগত জানাল আমাকে। টালির সাদা দেয়ালগুলোয় প্রতিধ্বনিত হচ্ছে চড়া কণ্ঠস্বর আর হাসির শব্দ।
শিক্ষক-শিক্ষিকারা ইতোমধ্যেই তাঁদের ছাত্র-ছাত্রীদের তাড়িয়ে নিয়ে চলেছেন ফাঁকা সুইমিং পুলটির দিকে। ছেলে- মেয়েদের ফুর্তির সীমা নেই।
দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আজ আমার জন্য আনন্দের কোন দিন নয়। উঁচু ডাইভিং বোর্ডটা চোখ তুলে এক নজর দেখে নিলাম। কেঁপে উঠল অন্তরাত্মা।
ধাতব এক মই বেয়ে উঠতে হবে ওপরের নীল পাটাতনটিতে। ধাপগুলো সরু আর খাড়া। মঞ্চটা আমি যা ভেবেছিলাম তার চাইতে অনেক উঁচু।
কল্পনায় দেখলাম মাথা হেঁট করে পড়ে যাচ্ছি ডাইভিং বোর্ডটা থেকে। রাতে হাজারবার মানসপটে এ ছবি ভেসে উঠেছে আমার। কিন্তু এখন কাল্পনিক দৃশ্যটাকে অনেক বেশি বাস্তব মনে হচ্ছে।
কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছি, গলায় স্ট্র্যাপ থেকে ঝুলছে দুটো ক্যামেরা। পুল থেকে বাচ্চাদের কিচিরমিচির ভেসে আসছে।
আচমকা কে যেন আমার হাত চেপে ধরতেই আঁতকে উঠলাম।
‘খাইছে, স্যর, আপনি!’ মি. লয়েডকে দেখে বললাম।
‘সবাই তোমার অপেক্ষায়, মুসা,’ জানালেন তিনি। ‘তুমি প্রতিযোগিতায় জেতায় আবারও অভিনন্দন। আমি জানি চমৎকার ছবি নেবে তুমি ওখান থেকে।’
উঁচু পাটাতনটির দিকে মুখ তুলে চাইলাম দু’জনেই।
খাইছে, স্যর যদি জানতেন আমাকে কত বড় বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছেন!
মি. লয়েড মৃদু হেসে, তর্জনী দেখিয়ে মইয়ের কাছে যেতে বললেন। এবার বুড়ো আঙুল ঝাঁকালেন আমার উদ্দেশে।
‘ব্রেক আ লেগ!’
খাইছে, ব্রেক আ লেগ? শুধু পা নয়, আমার শরীরের প্রতিটা হাড়ই হয়তো ভাঙবে আজ!
উল্টো ঘুরে ব্যস্তসমস্ত হয়ে মইটার কাছে চলে এলাম। পুল থেকে ক’জন সহপাঠী চেঁচাল আমার উদ্দেশে।
‘মুসা, তুমি ডাইভ দেবে নাকি?’
‘আমি তোমাকে লুফব!’
‘এখনই আমার ছবি নিয়ে নাও! যদি ওখানে ওঠার আগেই পা পিছলে পড়ে যাও!’
হা-হা।
রয় বেরিয়ে এল মইয়ের পেছন থেকে। ওর গলায় স্ট্র্যাপে বাঁধা তিনটে ক্যামেরা।
তীব্র দৃষ্টিতে চেয়ে রইল ও আমার দিকে। উদ্বেগের ছাপ ওর মুখে।
‘মুসা, সত্যিই তুমি চাও কাজটা আমি করি?’ বলল ও।
মাথা ঝাঁকালাম।
‘কাল রাতেই তো বলেছি তোমাকে, রয়, আমার উচ্চতাভীতি আছে।’
‘কিন্তু…প্রতিযোগিতাটায় জিততে তুমি এত পরিশ্রম করেছ,’ বলল ও। ‘এখন শেষ মুহূর্তে এসে…’
‘তাতে কী,’ বললাম। মইয়ের দিকে আলতো হাতে ঠেলে দিলাম ওকে। ‘যাও, ছবিটা তোলো। নো চিন্তা ডু ফুর্তি।’
এবার পিছিয়ে গিয়ে চেয়ে রইলাম। রয় রেইলিং আঁকড়ে ধরে মই বেয়ে উঠতে লাগল।