পনেরো
মেয়ে দুটি কুতকুতে চোখে ফটোটা দেখছে।
‘তোমার ক্যামেরাটা এমন কেন, মু-মু?’ ববি জিজ্ঞেস করল। ‘রঙ একেবারে লেপ্টে গেছে।’
‘খাইছে, আমার ক্যামেরা?’ চেঁচিয়ে বললাম। ‘ছবিটা রয় তুলেছে-‘
‘তোমার ক্যামেরা দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে!’ বলল এমা। ঠিক তোমার মতই, মু-মু!’
‘আমার কী দোষ?’ বললাম। ‘আমি তো তোমাদের ছবি-’ কিন্তু ববি ছবিটা আমার মুখের সামনে ধরল। রয় আর আমি একদৃষ্টে চেয়ে রইলাম ওটার দিকে।
ফটোতে দেখা যাচ্ছে, দুটি মেয়েরই মুখ আর বাহু সবুজ এবং ওদের গায়ের চামড়া ফাটা আর দাগযুক্ত অ্যালিগেটরের চামড়ার মতন!
চমকে গেলাম।
ববি আর এমার কপালে কি এটাই ঘটতে চলেছে?
ক’মিনিটের মধ্যেই কি অ্যালিগেটরের সবুজ চামড়া দেখব ওদের গায়ে?
সারা শরীর শিউরে উঠল আমার। আরেকটু হলেই বমি হয়ে যেত।
ছবি তুলেছে রয়। কিন্তু ওরা আমাকে দায়ী করছে। আমার ক্যামেরাটাকে দুষছে। রয়কে নয়।
খাইছে, ছবিটা যদি কোনভাবে সত্যি হয়ে যায়…
আবারও কাঁপুনি দিল শরীরে।
আমার কারও সাহায্য পেতে হবে। কিন্তু কে করবে সাহায্য? বাবা-মা এমন আজগুবী কাহিনী বিশ্বাস করবে না।
ক্যামেরাটা ছোঁ মেরে কেড়ে নিলাম রয়ের হাত থেকে। তারপর আইল ধরে দৌড়ে এক্সিটের দিকে চললাম।
কানে এল মেয়ে দুটো আমার ক্যামেরাটা নিয়ে ঠাট্টা-মস্করা করছে। এবার সহসাই থেমে গেল সব।
অডিটোরিয়ামের দরজাগুলোর কাছে পৌঁছেছি। একটা দরজা যেই ঠেলে খুলতে গেছি, অমনি আতঙ্কিত চিল চিৎকার শুনলাম মঞ্চ থেকে।
ঘুরে না দাঁড়ালেও চলে। কী দেখব জানিই তো।
হাঁটুজোড়ায় জোর পাচ্ছি না। দরজার হাতল চেপে ধরে কোনমতে পতন ঠেকালাম। কাঁপ দিয়ে উঠল সারা শরীর।
ধীরেসুস্থে উল্টো ঘুরলাম-এবং দেখলাম ববি আর এমা তারস্বরে চেঁচাচ্ছে আর নিজেদের মুখের চামড়া ধরে টানাটানি করছে।
এমনকী অডিটোরিয়ামের পেছন থেকেও, ওদের শুকনো সবুজ ত্বক দেখতে পাচ্ছি। ফেটে, দাগ পড়ে, ফুলে উঠেছে।
খাইছে, ঢোক গিললাম। অতিকষ্টে শ্বাস নিলাম।
ববি আমার উদ্দেশে মুঠো নাচাল।
‘সব তোমার দোষ!’ কর্কশ শোনাল ওর কণ্ঠস্বর। ‘তুমি একটা কালো জাদুকর!’
‘আমাদের প্রতি তোমার কীসের এত রাগ, এত ঘৃণা?’ হাহাকারের মত শোনাল এমার কথাগুলো।
পিয়ানো থেকে লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালেন মিসেস হুপার। কোমরে দু’হাত রেখে অগ্নিদৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন আমার দিকে।
অডিটোরিয়ামের সবার চোখ এখন আমার ওপর স্থির।
ববি আর এমা আর্তনাদ করছে, চেঁচাচ্ছে, গালের সবুজ চামড়া ধরে প্রাণপণে টানছে।
‘তুমি কিশোরের কী হাল করেছ জানি আমরা!’ বাজখাঁই কণ্ঠে চেঁচাল এমা।
‘আমরা তোমার পরিবারের নামে মামলা করব!’ গর্জাল ববি। ‘তোমাদেরকে জেলে ঢোকাব। সবাই জানবে তোমরা কালো জাদুর চর্চা করো!’
‘আমি-আমি-’ তোতলাচ্ছি। কথা ফুটছে না মুখে।
আমার ভীতিটা নিমেষে ক্রোধে রূপ নিল। এই অপয়া ক্যামেরাটা আমার জীবন বরবাদ করে দিচ্ছে!
ওটাকে উঁচিয়ে ধরে সজোরে ঠুকলাম পেছনের দেয়ালে। আবার। বারবার।
দম নিতে বেগ পাচ্ছি রীতিমত, বাহু টাটাচ্ছে, পরখ করার জন্য তুলে ধরলাম ক্যামেরাটা।
কিছুই হয়নি ওটার। এমনকী সামান্য টাল পর্যন্ত খায়নি। চরম ক্ষোভে আর্তচিৎকার করতে মুখ খুললাম। তারপর এক ধাক্কায় দরজাটা খুলে দৌড়ে অডিটোরিয়াম ছাড়লাম।
সামনের এক্সিটের দিকে চলেছি, মাঝপথে সেল ফোন বাজল। ব্যাগ হাতড়ে বের করলাম ওটা।
‘মা!’
‘অ্যাই, মুসা। ভাবলাম-’
‘মা, আমার কথা শোনো!’ কাঁপা গলায় বললাম। ‘আ-আমি কী করব বুঝতে পারছি না।’
দেয়ালে পিঠ দিয়ে কানে চেপে ধরলাম ফোনটা। সব খুলে বললাম মাকে। শুরু করলাম কিশোরকে দিয়ে। তারপর সারা আর ওর ভাঙা হাতের কথা জানালাম। কিছুই বাদ রাখলাম না।
নিঃশব্দে শুনে গেল মা।
শেষ করলাম ববি আর এমার কী অবস্থা হয়েছে সে কথা বলে। এ-ও জানালাম ওরা আমার ওপর দায় চাপাচ্ছে এবং আমাকে কালো জাদুকর বলছে।
‘আচ্ছা,’ নিচু স্বরে আওড়াল মা, ‘আচ্ছা।’
‘আমি এখন কী করব, মা?’ চেঁচালাম। ‘আমাকে বলে দাও!’
‘মুসা,’ বলল মা, ‘তোকে কী করতে হবে বলছি। ঘাবড়াস না।’