৩
তাঁরা ময়মনসিংহ এসে পৌঁছলেন ভোর রাতে। তখনো চারদিক অন্ধকার। কিছুই দেখার উপায় নেই। মিসির আলির মনে হল, বিশাল একটি রাজপ্রাসাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। গাছগাছালিতে চারদিক ঢাকা। বারান্দায় অল্প পাওয়ারের একটি বাতি জ্বলছে। তাতে চারদিকের অন্ধকার আরো গাঢ় হয়েছে। মিসির আলি বললেন, ‘রাজবাড়ি বলে মনে হচ্ছে।
বরকত সাহেব শীতল গলায় বললেন, ‘এক সময় ছিল। সুসং দুর্গাপুরের মহারাজার বাড়ি। আমি কিনে নিয়েছি।’
দারোয়ান গেট খোলামাত্র ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেল। অনেক লোকজন বেরিয়ে এল। সবাই ভৃত্যশ্রেণীর। আজকালকার যুগেও যে এত জন কাজের লোক থাকতে পারে, তা মিসির আলি ধারণা করেন নি। তিনি লক্ষ করলেন, এরা কেউ তিন্নি মেয়েটির উল্লেখ করছে না। মেয়ের বাবাও মেয়ে সম্পর্কে কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। অথচ জিজ্ঞেস করাটাই স্বাভাবিক ছিল।
বরকত সাহেব বললেন, ‘আপনি যান, বিশ্রাম করুন। সকালবেলা আপনার সঙ্গে কথা হবে।’
কালোমতো লম্বা একটি ছেলে তাঁর ঘর দেখিয়ে দিল।
একতলার একটি কামরা, পুরোনো দিনের কামরাগুলি যেমন হয় – দৈর্ঘ্যে-প্রস্থে বিশাল। বিরাট দক্ষিণমুখী জানালা। ঘরের আসবাবপত্র সবই দামী ও আধুনিক। খাটে ছ’ ইঞ্চি ফোমের তোষক। রকিং-চেয়ার। মেঝেতে দামি স্যাগ কার্পেট। মফস্বল শহরে এসব জিনিস ঠিক আশা করা যায় না।
বাথরুমে ঢুকে মিসির আলি আরো অবাক হলেন। ওয়াটার হিটারের ব্যবস্থা আছে। চমৎকার বাথটাব। মিসির আলির মনে হল, অনেক দিন এ ঘরে বা বাথরুমে কেউ আসে নি। এমন চমৎকার একটি গেস্টরুম এরা শুধু শুধু বানিয়ে রেখেছে।
প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। কিন্তু গরম পানির ব্যবস্থা যখন আছে, তখন একটা হট শাওয়ার নেয়া যেতে পারে। মিসির আলি দীর্ঘ সময় নিয়ে গোসল সারলেন। শরীর ঝরঝরে লাগছে। এক কাপ গরম চা পেলে বেশ হত।
বাথরুম থেকে বের হয়েই দেখলেন টেবিলে চায়ের আয়োজন। পট- ভর্তি চা, প্লেটে নোনতা বিস্কিট, কুচিকুচি করে কাটা পনির। ভৃত্যশ্রেণীর এক জন যুবক তাঁকে ঢুকতে দেখেই চা ঢালতে শুরু করল। তিনি লক্ষ করলেন, লোকটি আড়চোখে তাঁর দিকে বারবার তাকাচ্ছে। চোখে চোখ পড়ামাত্র চট করে মাথা নামিয়ে নিচ্ছে।
‘তোমার নাম কি?’
‘নাজিম।’
‘শুধু নাজিম?’
‘নাজিমুদ্দিন।’
কত দিন ধরে এ বাড়িতে আছ?’
‘জ্বি অনেক দিন।’
‘অনেক দিন মানে কত দিন?’
‘পাঁচ বছর।’
‘এ বাড়িতে ক’জন মানুষ থাকে?’
নাজিম জবাব দিল না। চায়ের কাপে চিনি ঢেলে এগিয়ে দিল। তার ভাবভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে, সে এখন চলে যাবে। মিসির আলি দ্বিতীয়বার জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাড়িতে ক’জন মানুষ থাকে?’
‘স্যার, আমি কিছু জানি না।’
‘আমি কিছু জানি না মানে? তুমি পাঁচ বছর এ বাড়িতে আছ, অথচ জান না এ বাড়িতে ক’জন মানুষ থাকে?’
‘জ্বি না স্যার, আমি জানি না।’
‘বরকত সাহেব এবং তার মেয়ে—এই দু’জন ছাড়া আর ক’জন মানুষ থাকে?’
‘আমি স্যার কিছুই জানি না।’
মিসির আলি বড়ই অবাক হলেন। আর কোনো প্রশ্ন করলেন না। চায়ে চুমুক দিলেন। সিগারেট ধরালেন। তিনি সিগারেট ছেড়ে দেবার চেষ্টা করছেন, সেটা মনে রইল না। এই লোকটি কোনো কিছু বলতে চাচ্ছে না কেন? বাধা কোথায়?
নাজিম মৃদুস্বরে বলল, ‘স্যার, বিছানায় শুয়ে বেশ্রাম নিবেন?’
‘না, আমি অসময়ে ঘুমুব না।’
‘সকালের নাশতা দেওয়া হবে সাড়ে সাতটায়।’
‘ঠিক আছে।’
‘আসি স্যার, পাশের ঘরেই আছি। দরকার হলে কলিং-বেল টেপবেন। দরজার কাছে কলিংবেল আছে।’
তিনি মাথা নাড়লেন। কিছু বললেন না। ঘড়িতে বাজছে পাঁচটা পঁয়তাল্লিশ। আকাশ ফরসা হতে শুরু করেছে। তিনি বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। ব্রহ্মপুত্র নদী নিশ্চয়ই খুব কাছে। ভোরবেলা নদীর পাড় ধরে হাঁটতে ভালো লাগবে। এই শহরে এর আগে তিনি আসেন নি। অপরিচিত শহরে ঘুরে বেড়াতে চমৎকার লাগে।
গেট বন্ধ। গেটের পাশের খুপড়ি ঘরটায় দারোয়ান নিশ্চয়ই ঘুমুচ্ছে। মিসির আলি উঁচু গলায় ডাকলেন, ‘দারোয়ান, দারোয়ান, গেট খুলে দাও।’
দারোয়ান বেরিয়ে এল, কিন্তু গেট খুলল না। যেন সে কথা বুঝতে পারছে না।
‘গেট খুলে দাও, আমি বাইরে যাব।’
‘গেট খোলা যাবে না।’
‘খোলা যাবে না মানে? কেন যাবে না?’
‘বড় সাহেবের হুকুম ছাড়া খোলা যাবে না।’
‘তার মানে? কী বলছ তুমি? এটা কি জেলখানা নাকি?’
দারোয়ান কোনো উত্তর না দিয়ে নিজের ঘরে ঢুকে গেল। যেন মিসির আলির সঙ্গে কথাবার্তা চালিয়ে যাবার ব্যাপারে তার কোনো আগ্রহ নেই।
তিনি দাঁড়িয়ে রইলেন একা-একা। তাঁর সামনে ভারি লোহার গেট। সমস্ত বাড়িটিকে যে পাঁচিল ঘিরে রেখেছে, তাও অনেকখানি উঁচু। সত্যি সত্যি জেলখানা-জেলখানা ভাব। মিসির আলি আবার ডাকলেন, ‘দারোয়ান- দারোয়ান। কেউ বেরিয়ে এল না। ভোর সাতটা পর্যন্ত মিসির আলি বাড়ির সামনের বাগানে চিন্তিত মুখে ঘুরে বেড়ালেন। এই সময়ের মধ্যে তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার করলেন। এই বাড়িটি গাছগাছালিতে ভর্তি। কিন্তু কোনো গাছে পাখি ডাকছে না। শুধু যে ডাকছে না তাই নয়, কোনো গাছে পাখি বসে পর্যন্ত নেই! অথচ ভোরবেলার এই সময়টায় পাখির কিচিরমিচিরে কান ঝালাপালা হবার কথা। অথচ চারদিক কেমন নীরব, থমথমে।
‘স্যার, আপনার নাশতা দেয়া হয়েছে।’
‘কোথায়?’
‘দোতলায়।’
‘চল যাই।’
‘আমি যাব না, স্যার। আপনি একা যান। ঐ যে সিঁড়ি।’
সিঁড়িতে পা রেখেই মিসির আলি থমকে দাঁড়ালেন। সিঁড়ির মাথায় একটি বালিকা দাঁড়িয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটি দারুণ রূপসী। মাথাভর্তি কোঁকড়ানো চুল। টানা টানা চোখ। দেবীমূর্তির মতো কাটা কাটা নাক-মুখ। মেয়েটি দাঁড়িয়েও আছে মূর্তির মতো। একটুও নড়ছে না। চোখের দৃষ্টিও ফিরিয়ে নিচ্ছে না। মিসির আলি বললেন, ‘কেমন আছ, তিন্নি?’
মেয়েটি মিষ্টি করে হেসে বলল, ‘ভালো আছি। আপনি ভালো আছেন?’
‘হ্যাঁ, ভালোই আছি।’
‘আপনাকে গেট খুলে দেয় নি, তাই না?’
মিসির আলি উপরে উঠতে উঠতে বললেন, ‘দারোয়ান ব্যাটা বেশি সুবিধার না। কিছুতেই গেট খুলল না।’
‘দারোয়ান ভালোই। বাবার জন্যে খোলে নি। বাবা গেট খুলতে নিষেধ করেছেন।’
‘তাই নাকি?’
‘হ্যাঁ। বাবার ধারণা, গেট খুললেই আমি চলে যাব।’
তুমি বুঝি শুধু চলে যেতে চাও?’
‘না, চাই না। কিন্তু বাবার ধারণা আমি চলে যেতে চাই।’
মেয়েটি আবার মাথা দুলিয়ে হাসল। মেয়েটি এই দারুণ শীতেও পাতলা একটা জামা গায়ে দিয়ে আছে। খালি পা। মনে হচ্ছে সে শীতে অল্প অল্প কাঁপছে।
‘তিন্নি, তোমার শীত লাগছে না?’
‘না।’
বল কী! এই প্রচণ্ড শীতে তোমার ঠাণ্ডা লাগছে না?’
‘না। আপনি নাশতা খেতে যান। বাবা আপনার জন্যে অপেক্ষা করছে। দেরি হচ্ছে দেখে মনে মনে রেগে যাচ্ছে।’
‘তাই বুঝি?’
‘হ্যাঁ তাই।’
মেয়েটি হাঁটতে শুরু করল। ধবধবে সাদা রঙের ফ্রকে তাকে দেবশিশুর মতো লাগছে। মিসির আলি মেয়েটির প্রতি গাঢ় মমতা বোধ করলেন। তাঁর ইচ্ছে করল মেয়েটিকে কোলে তুলে নিতে। কিন্তু এ মেয়ে হয়তো এসব পছন্দ করবে না। একে দেখেই মনে হচ্ছে এর পছন্দ-অপছন্দ খুব তীব্র।
নাশতার আয়োজন প্রচুর।
রুটি মাখন থেকে শুরু করে চিকেন ফ্রাই, ফিশ ফ্রাই সবই আছে। বিলেতি কায়দায় দু’জনের সামনেই এক বাটি সালাদ। লম্বা লম্বা গ্লাসে কমলালেবুর রস। রাজকীয় ব্যাপার। শুধু-খাবার-দাবার এগিয়ে দেবার জন্যে কেউ নেই। বরকত সাহেব ঠাণ্ডা গলায় বললেন, ‘বসে আছেন কেন? শুরু করুন।’
‘তিন্নির জন্যে অপেক্ষা করছি।’
‘ও আসবে না।’
‘আসবে না কেন?’
‘খেয়ে নিয়েছে। আমার মেয়ের সঙ্গে কি আপনার কথা হয়েছে?’
‘হ্যাঁ।’
‘কেমন দেখলেন আমার মেয়েকে?’
‘ভালো।’
বরকত সাহেব তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন খানিকক্ষণ! নিচু গলায় বললেন, ‘ওর মধ্যে কি কোনো অস্বাভাবিকতা আপনার নজরে পড়েছে?’
‘না।’
‘ভালো করে ভেবে বলুন।’
‘ভেবেই বলছি। তবে পারিপার্শ্বিক কিছু অস্বাভাবিক ব্যাপার লক্ষ করছি।’
‘যেমন?’
‘যেমন আপনার গাছগুলিতে কোনো পাখি নেই। একটি পাখিও আমার চোখে পড়ে নি।’
বরকত সাহেব চমকালেন না। তার মানে তিনি ব্যাপারটি আগেই লক্ষ করেছেন। আগে লক্ষ না করলে নিশ্চয়ই চমকাতেন। অর্থাৎ মানুষটির পর্যবেক্ষণ শক্তি ভালো। এই জিনিসটি চট করে কারোর চোখে পড়বে না। মিসির আলি বললেন, ‘এ ছাড়াও অন্য একটি ব্যাপার লক্ষ করেছি।’
‘বলুন শুনি।’
‘আপনার বাড়ির কাজের লোকটি, যার নাম নাজিম, সে অত্যন্ত ভীত ও শঙ্কিত।’
‘এটা এমন কিছু অস্বাভাবিক ব্যাপার নয়। এ বাড়ির সবাই আমাকে ভয় করে।’
‘কেন?’
‘পৃথিবীর নিয়মই হচ্ছে ক্ষমতাবানকে ভয় করা। আমি ক্ষমতাবান।’
‘ক্ষমতাটা কিসের?’
‘অর্থের। অর্থের ক্ষমতাই সবচেয়ে বড় ক্ষমতা।’
‘আপনার ধারণা, যেহেতু আপনার প্রচুর টাকা, সেহেতু সবাই আপনাকে ভয় করে?’
‘অন্য কারণও আছে, আমি বেশ বদমেজাজি।’
‘আপনার মেয়ে তিন্নি, সেও কি বদমেজাজি?’
বরকত সাহেবের ভ্রু কুঁচকে উঠল। তিনি জবাব দিতে গিয়েও দিলেন না। হালকা স্বরে বললেন, ‘চা নিন। নাকি কফি খেতে চান?’
‘চা খাব। আপনি বলেছিলেন ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন। এখন করেন কী? ‘কিছুই করি না। এখন আমি ঘরেই থাকি।
‘এবং কাউকে ঘর থেকে বেরুতে দেন না।’
‘এ কথা বলছেন কেন?’
‘কারণ দারোয়ান আমাকে বেরুতে দেয় নি।’
‘ওকে বলে দিয়েছি যেন গেট না খোলে। ‘কেন বলেছেন?’
‘তিন্নির জন্যে বলেছি। আমার ভয়, গেট খোলা পেলেই সে চলে যাবে। আমি আর কোনোদিন তাকে ফিরে পাব না।’
‘সে কি এর আগে কখনো গিয়েছে?’
‘না।’
‘তাহলে কী করে আপনার ধারণা হল, গেট খোলা পেলে সে চলে যাবে?’
‘আমাকে আপনি এত প্রশ্ন করছেন কেন? আমাকে প্রশ্ন করবার জন্যে তো আপনাকে আনি নি। আপনাকে আনা হয়েছে আমার মেয়ের জন্যে।’
‘আনা হয়েছে বলাটা বোধ হয় ঠিক হচ্ছে না। আমি নিজ থেকে এসেছি।’
বরকত সাহেব ক্লান্ত গলায় বললেন, ‘আপনি দয়া করে আমার মেয়ের ঘরে চলে যান। ওর সঙ্গে কথা বলুন।’
‘ও কি তার ঘরে একা থাকে?’
‘হ্যাঁ, একাই থাকে।’
মিসির আলি উঠে দাঁড়াতেই বরকত সাহেব বললেন, ‘প্লিজ, একটি কথা মন দিয়ে শুনুন। এমন কিছুই করবেন না, যাতে আমার মেয়ে রেগে যায়।’
‘এ কথা বলছেন কেন?’
‘ও রেগে গেলে মানুষকে কষ্ট দেয়।’
‘কীভাবে কষ্ট দেয়?’
‘নিজেই বুঝবেন, আমার বলার দরকার হবে না।’
.
তিন্নির ঘরটি বিরাট বড়। এক পাশে ছোট্ট একটি কালো রঙের খাটে সুন্দর একটি বিছানা পাতা। নানান ধরনের খেলনায় ঘর ভর্তি। বেশির ভাগ খেলনাই হচ্ছে তুলার তৈরি জীবজন্তু। শিশুদের ঘর যেমন অগোছালো থাকে, এ ঘরটি সে রকম নয়। বেশ গোছানো ঘর। মিসির আলি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ তিন্নিকে দেখলেন। মেয়েটি গভীর মনোযোগে ছবি আঁকছে। একবারও তাকাচ্ছে না তাঁর দিকে। মিসির আলি বললেন, ‘তিন্নি, ভেতরে আসব?
তিন্নি ছবি থেকে মুখ না তুলেই বলল, ‘আসতে ইচ্ছে হলে আসুন।’
‘ইচ্ছে না হলে আসব না?’
তিন্নি কিছু বলল না। মিসির আলি ভেতরে ঢুকলেন, হাসিমুখে বললেন, ‘বসব কিছুক্ষণ তোমার ঘরে?’
‘বসার ইচ্ছে হলে বসুন।
তিনি বসলেন। হাসিমুখে বললেন, ‘কিসের ছবি আঁকছ?’
‘গাছের।’
‘দেখি কেমন ছবি?
‘দেখতে ইচ্ছে হলে দেখুন।
তিন্নি তার ছবি এগিয়ে দিল। মিসির আলি অবাক হয়ে দেখলেন, অদ্ভুত সব গাছের ছবি আঁকা হয়েছে। গাছগুলিতে কোনো পাতা নেই। অসংখ্য ডাল। ডালগুলি লতানো। কিছু কিছু লতা আবার চুলের বেণীর মতো পাকানো।
‘সুন্দর হয়েছে তো গাছের ছবি!’
‘আপনার ভালো লাগছে?’
‘হ্যাঁ।’
‘এ রকম গাছ কি আপনি এর আগে কখনো দেখেছেন?’
‘না, দেখি নি।’
‘তাহলে আপনি কেন জিজ্ঞেস করলেন না কি করে আমি না দেখে এমন সুন্দর গাছের ছবি আঁকলাম।’
‘শিশুরা মন থেকে অনেক জিনিস আঁকে।
তিন্নি হাসল। তিনি প্রথম মেয়েটির মুখে হাসি দেখলেন। তিন্নি হাসতে হাসতে ভেঙে পড়ছে। মিসির আলি বললেন, ‘তুমি এত হাসছ কেন?
‘হাসতে ভালো লাগছে তাই হাসছি।’
তিনি নিজেও হাসলেন। হাসতে হাসতেই বললেন, ‘আমি শুনেছি তুমি সব প্রশ্নের উত্তর জান।’
‘কে বলেছে? বাবা?
‘হ্যাঁ। তুমি কি সত্যি সত্যি জান?’
‘জানি। পরীক্ষা করতে চান?’
‘হ্যাঁ চাই। বল তো নয়-এর বর্গমূল কত?’
‘তিন।’
‘পাঁচের বর্গমূল কত সেটা জান?’
তিন্নি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘আমি জানি না।
‘আচ্ছা দেখি এটা পার কি না। পেনিসিলিন যিনি আবিষ্কার করেছেন,
তাঁর নাম কি?’
‘স্যার আলেকজান্ডার ফ্লেমিং।’
‘হ্যাঁ হয়েছে। এখন বল দেখি তাঁর স্ত্রীর নাম কি?’
‘আমি জানি না।’
‘সত্যি জান না?’
‘না, আমি জানি না।’
‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কত সালে নবেল প্রাইজ পেয়েছেন জান?’
‘জানি। উনিশ ‘শ তেরো সালে।’
‘রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোট মেয়ের নাম জান?’
‘জানি না।’
মিসির আলি হাসতে লাগলেন। তিন্নি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইল। গম্ভীর স্বরে বলল, ‘আপনি হাসছেন কেন?’
‘আমি হাসছি, কারণ তুমি কীভাবে সব প্রশ্নের জবাব দাও তা বুঝতে পারছি।’
‘তাহলে বলুন, কীভাবে সব প্রশ্নের জবাব দিই।’
‘আমি লক্ষ করলাম, যে সব প্রশ্নের উত্তর আমি জানি, শুধু সেসব প্রশ্নের উত্তরই তুমি জান। যেমন আমি জানি নয়ের বর্গমূল তিন। কাজেই তুমি বললে তিন। কিন্তু পাঁচের বর্গমূল কত তা তুমি বলতে পারলে না, কারণ আমি নিজেও তা জানি না। আলেকজান্ডার ফ্লেমিংয়ের স্ত্রীর নাম তুমি বলতে পারলে না, কারণ আমি তাঁর স্ত্রীর নাম জানি না। ঠিক এইভাবে—।’
‘থাক, আর বলতে হবে না।’
তিন্নি তাকিয়ে আছে। তার মুখে কোনো হাসি নেই! সমস্ত চেহারায় কেমন একটা কঠিন ভাব চলে এসেছে, যা এত অল্পবয়সী একটি বাচ্চার চেহারার সঙ্গে ঠিক মিশ খাচ্ছে না। মিসির আলি সহজ স্বরে বললেন, ‘তুমি মানুষের মনের কথা টের পাও। টের পাও বলেই জানা প্রশ্নগুলির উত্তর দিতে পার। এটা এক ধরনের টেলিপ্যাথিক ক্ষমতা। কেউ কেউ এ ধরনের ক্ষমতা নিয়ে জন্মায়।’
তিন্নি শীতল গলায় বলল, ‘আপনি খুব বুদ্ধিমান।’
মিসির আলি বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি বুদ্ধিমান।’
‘আপনি বুদ্ধিমান এবং অহংকারী।
‘যারা বুদ্ধিমান, তারা সাধারণত অহংকারী হয়। এটা দোষের নয়। যে জিনিস তোমার নেই, তা নিয়ে তুমি যখন অহংকার কর, সেটা হয় দোষের।’
‘আপনি এখানে কেন এসেছেন?’
‘তোমাকে সাহায্য করবার জন্যে এসেছি।’
‘কিসের সাহায্য?’
‘আমি এখনো ঠিক জানি না। সেটাই দেখতে এসেছি। হয়তো তোমার কোনো সাহায্যের প্রয়োজন নেই। তোমার বাবা শুধু শুধু ভয় পাচ্ছেন।’
‘আমি ডাক্তার পছন্দ করি না।’
‘আমি ডাক্তার নই।’
‘আপনি এখন আমার ঘর থেকে চলে যান। আমার আর আপনাকে ভালো লাগছে না।’
‘আমার কিন্তু তোমাকে ভালো লাগছে। খুব ভালো লাগছে।’
‘আপনি এখন যান।’
মিসির আলি উঠে দাঁড়ালেন। তিন্নি বলল, ‘দাঁড়িয়ে আছেন কেন? চলে যান।’
তিন্নি কথা ক’টি বলার সঙ্গে সঙ্গে মিসির আলি তাঁর মাথার ঠিক মাঝখানে এক ধরনের যন্ত্রণা বোধ করলেন। হঠাৎ মাথাটা ঘুরে উঠল, বমিবমি ভাব হল, আর সেই সঙ্গে তীব্র ও তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা। যেন কেউ একটি ধারাল ব্লেড দিয়ে আচমকা মাথাটা দু’ফাঁক করে ফেলেছে। মিসির আলি বুঝতে পারছেন তিনি জ্ঞান হারাচ্ছেন। পৃথিবী তাঁর কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। চোখের সামনে দেখছেন সাবানের বুদবুদের মতো বুদবুদ। জ্ঞান হারাবার ঠিক আগমুহূর্তে ব্যথাটা কমে গেল। সমস্ত শরীরে এক ধরনের অবসাদ। ঘুমে চোখ জড়িয়ে যাচ্ছে। মিসির আলি তাকালেন তিন্নির দিকে। মেয়েটির ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি। সহজ হাসি নয়, উপহাসের হাসি। মিসির আলি দীর্ঘ সময় চুপ থেকে বললেন, ‘এটা তো তুমি ভালোই দেখালে।’
তিন্নি বলল, ‘এর চেয়েও ভালো দেখাতে পারি।’
‘তা পার। নিশ্চয়ই পার। তুমি কি রাগ হলেই এ রকম কর?’
‘হ্যাঁ করি।’
‘আমি তোমাকে রাগাতে চাই না।’
‘কেউ চায় না।’
‘সবাই তোমাকে খুশি রাখতে চায়?’
‘হ্যাঁ।’
‘কিন্তু তবু তুমি প্রায়ই রেগে যাও, তাই না?’
‘হ্যাঁ যাই।’
‘রাগটা সাধারণত কতক্ষণ থাকে?’
‘ঠিক নেই। কখনো অনেক বেশি সময় থাকে।’
‘আচ্ছা তিন্নি, মনে কর এখানে দু’জন মানুষ আছে। তুমি রাগ করলে এক জনের উপর, তাহলে ব্যথাটা কি সেই জনই পাবে। না দু’জন একত্রে পাবে?’
‘যার উপর রাগ করেছি সে-ই পাবে, অন্যে পাবে কেন? অন্য জনের উপর তো আমি রাগ করি নি।’
‘তাও তো ঠিক। এখন কি আমার উপর তোমার রাগ কমেছে?’
‘হ্যাঁ কমেছে।
‘তাহলে আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাস তো, যাতে আমি বুঝতে পারি তোমার রাগ সত্যি সত্যি কমেছে!
তিন্নি হাসল। মিসির আলি বললেন, ‘আমি কি আরো খানিকক্ষণ বসব?’
‘বসার ইচ্ছা হলে বসুন!
মিসির আলি বসলেন। একটি সিগারেট ধরালেন। মেয়েটি নিজের মনে ছবি আঁকছে। সেই গাছের ছবি, লতানো ডাল, পত্রহীন বিশাল বৃক্ষ। মিসির আলি ঠিক করলেন, তিনি একটি পরীক্ষা করবেন। এই মেয়েটি যেভাবেই হোক মস্তিষ্কের কোষে সরাসরি চাপ প্রয়োগ করতে পারে। উচ্চ পর্যায়ের একটি টেলিপ্যাথিক ক্ষমতা। ছোট্ট একটি মেয়ে, অথচ কত সহজে মানুষের মাথায় ঢুকে যাচ্ছে। এটাকে বাধা দেবার একমাত্র উপায় সম্ভবত মেয়েটিকে মাথার ভেতর ঢুকতে না দেয়া। সেটা করা যাবে তখনই, যখন নিজেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন করে ফেলা যাবে। সমস্ত চিন্তা ও ভাবনা কেন্দ্রীভূত করা হবে একটি বিন্দুতে।
মিসির আলি ডাকলেন, ‘তিন্নি।’
তিন্নি মুখ না তুলেই বলল, ‘কি?’
‘তুমি আমার মাথার ব্যথাটা আবার তৈরি কর তো।’
‘কেন?’
‘আমি একটা ছোট্ট পরীক্ষা করব।’
‘কী পরীক্ষা?’
‘আমি দেখতে চাই এই ব্যথার হাত থেকে বাঁচার কোনো উপায় আছে কি না।’
‘উপায় নেই।’
‘সে টাই দেখব। তবে তিন্নি একটি কথা, ব্যথাটা তুমি তৈরি করবে খুব ধীরে এবং যখনই আমি হাত তুলব, তুমি ব্যথাটা কমিয়ে ফেলবে।’
‘আপনি খুব অদ্ভুত মানুষ।’
‘আমি মোটেই অদ্ভুত মানুষ নই। আমি এক জন যুক্তিবাদী মানুষ আমি এসেছি তোমাকে সাহায্য করতে।’
‘আমার কোনো সাহায্য লাগবে না।’
‘হয়তো লাগবে না। তবু আমি তোমার ব্যাপারটা পুরোপুরি বুঝতে চাই। এখন তুমি ব্যথা তৈরি কর তো। খুব ধীরে ধীরে।’
তিন্নি মাথা তুলে সোজা হয়ে বসল। তার দৃষ্টি তীক্ষ্ণ থেকে তীক্ষ্ণতর হচ্ছে। ঠোঁট বেঁকে যাচ্ছে। বাঁকা ঠোঁট খুব হালকাভাবে কাঁপছে।
মিসির আলি চোখ বন্ধ করে বসে আছেন। তিনি তাঁর সমস্ত মন-প্রাণ একটি ব্যাপারে কেন্দ্রীভূত করে ফেললেন। খুব ছোটবেলায় তিনি একটি সাপের মুখোমুখি হয়েছিলেন। এখন তিনি ভাবছেন সেই সাপটির কথা। সাপটির হলুদ গা ছিল চক্রকাটা। বুকে ভর দিয়ে এঁকেবেঁকে এগিয়ে আসছিল। তাঁকে দেখেই সে থমকে গেল। ঘনঘন তার চেরা জিব বের করতে লাগল। মিসির আলি এখন আর কিছুই ভাবছেন না। পৃথিবীতে ঠিক এই মুহূর্তে সাপের চেরা জিব ছাড়া অন্য কিছুই নেই। তিনি জীবিত কি মৃত, সেই বোধও তাঁর নেই। তিনি কল্পনায় দেখছেন হলুদ রঙের কুৎসিত সাপের চেরা জিব বাতাসে কাঁপছে।
মিসির আলির চোখের দৃষ্টি ঘোলা হয়ে আসছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। তিনি ঘনঘন নিঃশ্বাস ফেলছেন। তিন্নি অবাক হয়ে মিসির আলিকে দেখছে। আশ্চর্য ব্যাপার, এই মানুষটিকে সে কিছু করতে পারছে না! এতক্ষণে ব্যথায় তাঁর ছটফট করা উচিত ছিল, কিন্তু লোকটি এখনো হাত তুলছে না। এর মানে কি এই যে, সে ব্যথা পাচ্ছে না। তা কী করে সম্ভব! তিন্নি ব্যথার পরিমাণ অনেক দূর বাড়িয়ে দিল। তার নিজের মাথাই এখন ঝিমঝিম করছে। মিসির আলি হাত তুললেন। তিনি পরীক্ষায় পাশ করেছেন। মিসির আলি দুর্বল গলায় বললেন, ‘তিন্নি, আমি এখন যাই। তোমার সঙ্গে পরে কথা হবে।
তিন্নি জবাব দিল না। অবাক চোখে তাঁকে দেখতে লাগল।
মিসির আলি বললেন, ‘তিন্নি, আমি কি তোমার আঁকা ছবিগুলি নিয়ে যেতে পারি?’
‘কেন?’
‘আমি নিজের ঘরে বসে সময় নিয়ে ছবিগুলি দেখব।’
‘তাতে কি হবে?’
‘তোমাকে বুঝতে সুবিধা হবে।’
তিন্নি তাঁর হাতে একগাদা ছবি তুলে দিল। মিসির আলি সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলেন। ক্লান্তিতে তাঁর পা ভেঙে আসছে। ঘুমে চোখ জড়িয়ে আসছে। তিনি পেছনে ফিরলেন। তিন্নি ছাদে উঠে গেছে। তার মাথার উপর চক্রাকারে কয়েকটি পাখি উড়ছে।
আশেপাশে পাখি নেই। কিন্তু এই মেয়েটির মাথার উপর পাখি উড়ছে কেন? শালিক পাখি। কিচমিচ শব্দ করছে। মেয়েটিকে দেখে মনে হল, সেও কিছু বলছে পাখিদের। এত রহস্য কেন? মিসির আলি নিজের ঘরের দিকে এগুলেন। তাঁর মন ভারাক্রান্ত। তিনি নিজের ভিতর এক ধরনের অস্থিরতা বোধ করলেন।