অন্য ভুবন – ২

তিন্নি অবেলায় ঘুমিয়ে পড়েছিল।

ঘুম ভাঙল সন্ধ্যার আগে আগে। আঁধার হয়ে আসছে। চারদিকে সুনসান নীরবতা। দোতলায় কেউ নেই। কেউ থাকে না কখনো। এ বাড়ির সব মানুষজন থাকে একতলায়। তিন্নি যখন কাউকে ডাকে, তখনি সে আসে, তার আগে কেউ আসে না। তিন্নির কাউকে ডাকতে ইচ্ছা করছে না। সে জানালার পাশে গিয়ে বসল। এখান থেকে রাস্তা দেখা যায়। রাস্তা দিয়ে লোকজন যাওয়া-আসা করছে, নানান ধরনের মানুষ। কারোর সঙ্গে কারোর কোনো মিল নেই। কত মজার মজার কথা একেক জন ভাবছে। কিন্তু ওরা কেউ জানে না, তিন্নি সব বুঝতে পারছে। এই তো এক জন মোটা লোক যাচ্ছে। তার হাতে একটা ছাতা। শীতের সময় কেউ ছাতা নিয়ে বের হয়? ছাতাটা কেমন অদ্ভুতভাবে দোলাচ্ছে লোকটা, এবং মনে মনে ভাবছে বাড়ি পৌঁছেই গরম পানি দিয়ে গোসল করে ঘুমুবে। শীতের দিনের সন্ধ্যাবেলায় কেউ ঘুমায়? লোকটার মনে খুব আনন্দ। কারণ সে হঠাৎ করে অনেক টাকা পেয়েছে। কেউ দিয়েছে তাকে। যে দিয়েছে তার নাম রহমত মিয়া।

বুড়ো লোকটি চলে যেতে রোগা একটা মানুষকে দেখা গেল। সে খুব রেগে আছে। কাকে যেন খুব গাল দিচ্ছে। এমন বাজে গাল যে শুনলে খুব রাগ লাগে। তিন্নি জানালা বন্ধ করে দিল।

ঘরটা এখন অন্ধকার। অন্ধকারে কেউ কিচ্ছু দেখতে পায় না, কিন্তু সে পায়। কেউ অন্ধকারে দেখতে পায় না, সে পায় কেন? সে কেন অন্য মানুষদের মতো নয়? কেন সবাই তাকে ভয় পায়? এই যে সন্ধ্যা হয়ে গেছে, কিন্তু কেউ তার কাছে আসছে না। যতক্ষণ সে না ডাকবে, ততক্ষণ আসবে না। এলেও খুব ভয়ে ভয়ে আসবে। দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলবে—’তিন্নি আপা, তিন্নি আপা।’ এমন রাগ লাগে! রাগ হলে তিন্নির সবাইকে কষ্ট দিতে ইচ্ছা করে। তখন তার কপালের বাঁ পাশে চিনচিনে ব্যথা হয়। ব্যথা হলেই রাগ আরো বেড়ে যায়। রাগ বাড়লে ব্যথা বাড়ে। কী কষ্ট! কী কষ্ট!!

তিন্নি দরজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়াল এবং রিনরিনে গলায় ডাকল – ‘নাজিম, নাজিম।’ নাজিমের পায়ের শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। সে ভয়ে ভয়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছে। তিন্নি তাকে দেখতে পাচ্ছে না। দোতলায় ওঠার সিঁড়ি পেছনের দিকে। কিন্তু তবু তিন্নি পরিষ্কার বুঝতে পারছে, নাজিম রেলিং ধরে ধরে উপরে আসছে, তার হাতে এক গ্লাস দুধ। নাজিম তার জন্যে দুধ আনছে। কী বিশ্রী ব্যাপার! সে দুধ চায় নি, তবু আনছে। এমন গাধা কেন লোকটা?

‘তিন্নি আপা।’

তিন্নি তাকাল না। নাজিম সিঁড়ির মাথায় দাঁড়িয়ে আছে। ভয় পাচ্ছে খুব। ভয়ে তার পা কাঁপছে।

‘দুধ এনেছেন কেন? দুধ খাব না।’

‘অন্য কিছু খাবেন, আপা?’

‘না, কিচ্ছু খাব না।’

‘জ্বি আচ্ছা।’

‘বাবা কবে আসবে আপনি জানেন?’

‘জানি না, আপা।’

‘বাবা কাল সকালে আসবে। একা আসবে না, একটা লোককে নিয়ে আসবে।’ নাজিম কিছু বলল না। তিন্নি কাটা কাটা গলায় বলল, ‘আপনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না, তাই না?’

‘করছি আপা।’

‘আমি সব কিছু বুঝতে পারি।’

‘আমি জানি, আপা।’

‘আপনি আমাকে ভয় করেন কেন?’

‘আমি ভয় করি না, আপা।’

‘না, করেন। আপনারা সবাই আমাকে ভয় করেন। আপনি করেন, আবুর মা করে, দারোয়ান করে, সবাই ভয় করে। যান, আপনি চলে যান।’

‘দুধ খাবেন না?’

‘না, খাব না। কিচ্ছু খাব না।’

‘বাতি জ্বালিয়ে দিই?’

‘না, বাতি জ্বালাতে হবে না।’

‘জ্বি আচ্ছা, আমি যাই আপা?’

‘না, আপনি যেতে পারবেন না। আপনি দাঁড়িয়ে থাকুন।’

নাজিম দাঁড়িয়ে রইল। তিন্নি তার ঘরে ঢুকে ছবি আঁকতে বসল। ঘর এখন নিকষ অন্ধকার, কিন্তু তাতে তার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। অন্ধকারেই বরং রঙগুলি পরিষ্কার দেখা যায়। তিন্নি অতি দ্রুত ব্রাশ চালাচ্ছে। ভালো লাগছে না। কিচ্ছু ভালো লাগছে না। কান্না পাচ্ছে। সে তার রঙগুলি দূরে সরিয়ে কাঁদতে শুরু করল।

নাজিম ভীত গলায় বলল, ‘কি হয়েছে তিন্নি আপা?’

তিন্নি তীক্ষ্ণ স্বরে বলল, ‘কিচ্ছু হয় নি, আপনি চলে যান।’

নাজিম অতি দ্রুত সিঁড়ি থেকে নেমে গেল। যেন সে পালিয়ে বেঁচেছে।