অন্য ভুবন – ১

দুপুরবেলা কাজের মেয়েটি মিসির আলিকে ডেকে তুলল। কে নাকি দেখা করতে এসেছে। খুব জরুরি দরকার।

মিসির আলির রাগে গা কাঁপতে লাগল। কাজের মেয়েটিকে বলে দেয়া ছিল কিছুতেই যেন তাঁকে তিনটার আগে ডেকে তোলা না হয়। এখন ঘড়িতে বাজছে দু’টা দশ। যত জরুরি কাজই থাকুক, এই সময় তাঁকে ডেকে তোলার কথা নয়। মিসির আলি রাগ কমাবার জন্যে উল্টো দিকে দশ থেকে এক পর্যন্ত গুনলেন। গুন-গুন করে মনে মনে গাইলেন—আজি এ বসন্তে এত ফুল ফোটে এত পাখি গায়—। এই গানটি গাইলে তাঁর রাগ আপনাতেই কিছুটা নেমে যায়। কিন্তু আজ নামছে না। কাজের মেয়েটির ভাবলেশহীন মুখ দেখে তা আরো বেড়ে যাচ্ছে। তিনি গম্ভীর গলায় ডাকলেন, ‘রেবা।’

‘জ্বি।’

‘আর কোনো দিন তুমি আমাকে তিনটার আগে ডেকে তুলবে না।’

‘জ্বি আইচ্ছা।’

‘দুটো থেকে তিনটা এই এক ঘণ্টা আমি প্রতি দিন দুপুরে ঘুমিয়ে থাকি। এর নাম হচ্ছে সিয়াস্তা। বুঝলে?’

‘জ্বি।’

‘ঘড়ি দেখতে জান?’

‘জ্বি না।’

মিসির আলির রাগ দপ করে নিভে গেল। যে মেয়ে ঘড়ি দেখতে জানে না, সে তাকে তিনটার সময় ডেকে তুলবে কীভাবে? রেবা মেয়েটি নতুন কাজে এসেছে। তাকে শিখিয়ে-পড়িয়ে নিতে হবে।

‘রেবা।’

‘জ্বি।’

‘আজ সন্ধার পর তোমাকে ঘড়ি দেখা শেখাব। এক থেকে বার পর্যন্ত সংখ্যা প্রথম শিখতে হবে। ঠিক আছে?’

‘জ্বি ঠিক আছে।’

‘এখন বল, যে লোকটি দেখা করতে এসেছে, সে কেমন?’

রেবা অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। মানুষ মানুষের মতোই, আবার কেমন হবে। তার এই সাহেব কী সব অদ্ভুত কথাবার্তা যে বলে! পাগলা ধরনের কথাবার্তা

‘বল বল, চুপ করে আছ কেন?’

মিসির আলি বিরক্ত হলেন। এই মেয়েকে কাজ শেখাতে সময় লাগবে। তিনি গম্ভীর মুখে বললেন, ‘মানুষকে দেখতে হবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, বুঝতে পারছ?’

মেয়েটি মাথা নাড়ল। মাথা নাড়ার ভঙ্গি থেকেই বলে দেয়া যায়, সে কিছুই বোঝে নি। বোঝার চেষ্টাও করে নি। সে শুধু ভাবছে, এই লোকটির মাথায় দোষ আছে। তবে দোষ থাকলেও লোকটা ভালো। বেশ ভালো। রেবা এ পর্যন্ত দু’টি গ্লাস, একটা পিরিচ এবং একটা প্লেট ভেঙেছে। একটা কাপের বোঁটা আলগা করে ফেলেছে। সে তাকে কিছুই বলে নি। একটা ধমক পর্যন্ত দেয় নি। ভালো মানুষগুলি একটু পাগল—পাগলই হয়ে থাকে।

মিসির আলি হাত বাড়িয়ে সিগারেটের প্যাকেট নিলেন। একটি সিগারেট বের করে হাত দিয়ে গুঁড়ো করে ফেললেন। তিনি সিগারেট ছাড়বার চেষ্টা করছেন। যখনই খুব খেতে ইচ্ছা করে তিনি একটি সিগারেট বের করে গুঁড়ো করে ফেলেন, এবং ভাবতে চেষ্টা করেন একটি সিগারেট টানা হল। এতে কোনো লাভ হচ্ছে না, শুধু মেজাজ তিরিক্ষি হয়ে যাচ্ছে।

‘রেবা।’

‘জ্বি?’

‘এখন আমি তোমাকে কিছু প্রশ্ন করব। তুমি উত্তর দেবে। তোমার উত্তর থেকে আমি ধারণা করতে পারব, যে লোকটি এসেছে সে কি রকম।’

‘প্রথম প্রশ্ন, যে লোকটি এসেছে সে গ্রামে থাকে না শহরে?

‘গেরামে।’

‘লোকটি বুড়ো না জোয়ান?’

‘জোয়ান।’

‘রোগা না মোটা?’

‘রোগা।’

‘কী কাপড় পরে এসেছে?’

‘মনে নাই।’

‘কাপড় পরিষ্কার না ময়লা?’

‘ময়লা।’

‘হাতে কী আছে? ব্যাগ বা ছাতা, এসব কিছু আছে?’

‘না।’

‘চোখে চশমা আছে?’

‘না।’

মিসির আলি থেমে থেমে বললেন, ‘তোমাকে যে প্রশ্নগুলি করলাম, সেগুলি মনে রাখবে। কেউ আমার কাছে এলে, আমি এইগুলি জানতে চাই। বুঝতে পারছ?’

‘জ্বি।’

‘এখনও যাও, আমার জন্য এক কাপ চমৎকার চা বানাও। দুধ চিনি কিচ্ছু দেবে না। শুধু লিকার। বানান হয়ে গেলে চায়ের কাপে এক দানা লবণ ফেলে দেবে।’

‘লবণ?’

‘হ্যাঁ লবণ।’

মিসির আলি উঠে দাঁড়ালেন। বসার ঘরে যে লোকটি এসেছে তাকে দেখা দরকার। রেবার কথামতো লোকটি হবে গ্রামের, ময়লা কাপড় পরে এসেছে। জোয়ান বয়স। হাতে কিছুই নেই। এই ধরনের একজন লোকের তাঁর কাছে কী প্রয়োজন থাকতে পারে?

.

বসার ঘরে যে লোকটি বসে ছিল, সে রোগা নয়। পরনে গ্যাভার্ডিনের স্যুট। হাতে চামড়ার একটি ব্যাগ। বয়স পঞ্চাশের উপরে। চোখে চশমা। মিসির আলি মনে মনে একটি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললেন। রেবা মেয়েটির পর্যবেক্ষণ শক্তি মোটেই নেই। একে বেশি দিন রাখা যাবে না। মিসির আলি বসে থাকা লোকটিকে তীক্ষ্ণ চোখে দেখতে লাগলেন।

তিনি ঘরে ঢোকার সময় লোকটি উঠে দাঁড়ায় নি। দাঁড়াবার মতো ভঙ্গি করেছে। বসে থাকার মধ্যেও একটা স্পর্ধার ভাব আছে। লোকটি তাকিয়ে আছে সরু চোখে। যেন সে কিছু একটা যাচাই করে নিচ্ছে। মিসির আলি বললেন, ‘ভাই আপনার নাম?’

‘আমার নাম বরকতউল্লাহ। আমি ময়মনসিংহ থেকে এসেছি।’

‘কোনো কাজে এসেছেন কি?’

‘হ্যাঁ, কাজেই এসেছি। আমি অকাজে ঘোরাঘুরি করি না।’

‘আপনার কাছে না এলে, আপনার ঘরে বসে আছি কেন?’

‘আমার কাছে এসেছেন?’

‘ভালোই বলেছেন। এখন বলুন, কী ব্যাপার। অল্প কথায় বলুন।’

বরকতউল্লাহ সাহেব থমথমে গলায় বললেন, ‘আমি কথা কম বলি। আপনাকে বেশিক্ষণ বিরক্ত করব না।’

তিনি লক্ষ করলেন, লোকটি আহত হয়েছে। তার চোখ-মুখ লাল। মিসির আলি খুশি হলেন। লোকটি বড় বেশি স্পর্ধা দেখাচ্ছে।

‘বরকতউল্লাহ সাহবে, চা খাবেন?’

‘জ্বি না, আমি চা খাই না। আমার যা বলার তা আমি খুব অল্প কথায় বলে চলে যাব।’

মিসির আলি হাসতে হাসতে বললেন, ‘অল্প কথায় কিছু বলতে পারবেন বলে আমার বিশ্বাস হচ্ছে না। আপনার অভ্যাস হচ্ছে বেশি কথা বলা। আপনি চা খাবেন কি না, তার জবাব দিতে গিয়ে একটি দীর্ঘ বাক্য বলেছেন। আপনি বলেছেন—জ্বি না, আমি চা খাই না। আমার যা বলার তা আমি খুব অল্প কথায় বলে চলে যাব। এই বাক্যটিতে সতেরোটি শব্দ আছে।’

বরকতউল্লাহ সাহেব অবাক হয়ে তাকালেন। তাঁর ভ্রু কুঞ্চিত হল। মিসির আলি মনে মনে হাসলেন। কাউকে বুদ্ধির খেলায় হারাতে পারলে তাঁর খুব আনন্দ হয়।

‘বরকতউল্লাহ সাহেব, আপনি কী চান?’

‘আপনার সাহায্য চাই। তার জন্যে আমি আপনাকে যথাযথ সম্মানী দেব। আমি ধনাঢ্য ব্যক্তি না হলেও দরিদ্র নই! আমি চেকবই নিয়ে এসেছি।’

ভদ্রলোক কোটের পকেটে হাত দিলেন। মিসির আলির খানিকটা মন খারাপ হয়ে গেল। ধনবান ব্যক্তিরা দরিদ্রের কাছে প্রথমেই নিজেদের অর্থের কথা বলে কেন ভাবতে লাগলেন।

বরকতউল্লাহ বললেন, ‘আমি কি আমার সমস্যাটার কথা আপনাকে বলব?’

মিসির আলি বললেন, ‘তার আগে জানতে চাই, আপনি আমার নাম জানলেন কী করে? অমি এমন কোনো বিখ্যাত ব্যক্তি নই যে, ময়মনসিংহের একজন লোক আমার নাম জানবে।’

বরকতউল্লাহ নিচু স্বরে বললেন, ‘আমি খুঁজছি এক জন ভালো সাইকিয়াট্রিস্ট, যাঁর কাছে আমি অকপটে আমার কথা বলতে পারব। যে আমার কথায় লাফিয়ে উঠবে না, আবার অবিশ্বাসের হাসিও হাসবে না। আমি জানি আপনি সে রকম এক জন মানুষ। কী করে জানি, তা তেমন জরুরি নয়।’

মিসির আলির মনে হল লোকটা বেশ বুদ্ধিমান, গুছিয়ে কথা বলতে জানে। যার মানে হচ্ছে, গুছিয়ে কথা বলার অভ্যেস তার আছে। লোকটি সম্ভবত এক জন ব্যবসায়ী। সফল ব্যবসায়ীদের নানান ধরনের লোকজনের সঙ্গে খুব গুছিয়ে কথা বলতে হয়।

‘বরকতউল্লাহ সাহেব, আপনি এক জন ব্যবসায়ী?’

‘হ্যাঁ, আমি এক জন ব্যবসায়ী।’

কত দিন ধরে ব্যবসা করছেন?’

‘প্রায় দশ বছর। এখন করছি না।’

‘কিসের ব্যবসা?’

আপনি আমাকে জেরা করছেন কেন বুঝতে পারছি না।’

‘আপনার সমস্যা নিয়ে আমি মাথা ঘামাব কি না, তা জানার জন্যে জেরা করছি। যদি আপনাকে আমার পছন্দ হয়, তবেই আপনার কথা শুনব। সবার সমস্যা নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না।’

‘যথেষ্ট পরিমাণ টাকা পেলেও না?’

‘না! আমার সম্পর্কে ভালোরকম খোঁজ খবর আপনি নেন নি। যদি নিতেন, তাহলে জানতেন যে আমি টাকা নিই না।’

বরকতউল্লাহ সাহেব দীর্ঘ সময় চুপ করে রইলেন। তিনি তাঁর সামনে বসে থাকা রোগা ও বেঁটে লোকটিকে ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না। কথাবার্তা বলছে অহংকারী মানুষের মতো, কিন্তু বলার ভঙ্গিটা সহজ ও স্বাভাবিক।

‘আপনি টাকা নেন না কেন, জানতে পারি কি?’

‘নিশ্চয়ই পারেন। টাকা নিলেই এক ধরনের বাধ্যবাধকতা এসে পড়ে। আমি তার মধ্যে যেতে চাই না। অন্যের সমস্যা নিয়ে চিন্তা করা আমার পেশা নয়, শখ। শখের ব্যাপারে কোনো রকম বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত নয়। কি বলেন?’

‘ঠিকই বলছেন। আমি আপনার সব প্রশ্নের জবাব দেব। কী জানতে চান বলুন?’

‘আপনার পড়াশোনা কত দূর?’

‘এমএ পাশ করেছি। পলিটিক্যাল সায়েন্স।’

‘আপনি বলছেন ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন, কেন?’

‘এই প্রশ্নের জবাব আপনাকে পরে দেব। অন্য প্রশ্ন করুন।’

‘আপনি বিবাহিত?’

‘হ্যাঁ। আমার ন’ বছর বয়েসী একটি মেয়ে আছে।’

‘আপনার সমস্যা এই মেয়েকে নিয়েই, নয় কি?’

‘জ্বি হ্যাঁ। কী করে বুঝলেন?’

‘মেয়ের কথা বলার সময় আপনার গলার স্বর পাল্টে গেল, তা থেকেই আন্দাজ করছি। আপনার স্ত্রী মারা গেছেন কত দিন হল?

‘প্রায় নয় বছর হল। স্ত্রী মারা গেছেন, সেটা কী করে বলতে পারলেন?’

‘বাচ্চাদের কোনো সমস্যা হলে মা নিজে আসেন। এক্ষেত্রে আসেন নি দেখে সন্দেহ হয়েছিল। তাছাড়া বিপত্মীক মানুষদের দেখলেই চেনা যায়।’

‘আমি কি এবার আমার ব্যাপারটা বলব?’

‘বলুন।’

‘সংক্ষেপে বলতে হবে?’

‘না, সংক্ষেপে বলার দরকার নেই। চা দিতে বলি?’

‘জ্বি না, আমি চা খাই না। এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানি দিতে বলুন, খুব ঠাণ্ডা তৃষ্ণা হচ্ছে।’

‘আমার ঘরে ফ্রিজ নেই। পানি খুব ঠাণ্ডা হবে না।’

ভদ্রলোক তৃষ্ণার্তের মতোই পানির গ্লাস শেষ করে দ্বিতীয় গ্লাস

চাইলেন। মিসির আলি বললেন, ‘আরেক গ্লাস দেব?’

‘আর লাগবে না।’

‘আপনি তাহলে শুরু করুন। আপনার মেয়ের নাম কি?’

‘তিন্নি।’

‘বলুন তিন্নির কথা।’

ভদ্রলোক কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। সম্ভবত মনে মনে গুছিয়ে নিচ্ছেন। কিংবা বুঝে উঠতে পারছেন না, ঠিক কোন জায়গা থেকে শুরু করবেন। মিসির আলি লক্ষ করলেন, ভদ্রলোকের কপালে সূক্ষ্ম ঘামের কণা জমতে শুরু করেছে। মিসির আলি ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না, ন’ বছর বয়সী একটি মেয়ের এমন কি সমস্যা থাকতে পারে যা বলতে গিয়ে এমন অস্বস্তির মধ্যে পড়তে হয়।

‘বলুন, আপনার মেয়ের কথা বলুন।’

ভদ্রলোক বলতে শুরু করলেন।

.

‘আমার মেয়ের নাম তিন্নি।

‘ওর বয়স ন’ বছর। মেয়ের জন্মের সময় ওর মা মারা যায়। মেয়েটিকে আমি নিজেই মানুষ করি। আমি মোটামুটিভাবে একজন স্বচ্ছল মানুষ। কাজেই আমার পক্ষে বেশ কিছু কাজের লোকজন রাখা কোনো সমস্যা ছিল না। তিন্নিকে দেখাশোনার জন্যে অনেকেই ছিল। কিন্তু তবু মেয়েটির বেশির ভাগ দায়িত্ব আমিই পালন করেছি। দুধ বানানো, খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো—সবই আমি করতাম। বুঝতেই পারছেন, মেয়েটি আমার খুবই আদরের। সব বাবার কাছেই তাদের ছেলেমেয়ের আদর থাকে, কিন্তু আমার মধ্যে বাড়াবাড়ি রকমের ছিল।’

মিসির আলি বললেন, ‘আপনি কি বলতে চাচ্ছেন, এখন নেই?’

ভদ্রলোক এই প্রশ্নের জবাব দিলেন না। তাঁর মেয়ের কথা বলে যেতে লাগলেন। তিনি এমন একটি ভঙ্গি করলেন, যেন প্রশ্নটি শুনতে পান নি।

‘তিন্নির বয়স যখন এক বছর, তখন লক্ষ করলাম, ও অন্যান্য শিশুদের মতো নয়। সাধারণত এক বৎসর বয়সেই শিশুরা কথা বলতে শুরু করে। তিন্নির বেলা তা হল না। সে কথা বলা শিখল না। বড় বড় ডাক্তাররা সবাই দেখলেন। তাঁরাও কোনো কারণ বের করতে পারলেন না। মেয়েটি কানে শুনতে পায়। তার ভোকাল কর্ড আছে। কিন্তু কথা বলে না! কেউ কিছু বললে মন দিয়ে শোনে—এই পর্যন্তই।

‘ইএনটি স্পেশালিস্ট প্রফেসর আলম বললেন, অনেক বাচ্চাই দেরিতে কথা শেখে। এর বেলাও তাই হচ্ছে। দেরি হচ্ছে। আপনি আপনার মেয়ের সঙ্গে দিন-রাত কথা বলবেন। ও শুনে শুনে শিখবে।

‘আমি প্রফেসর আলমের পরামর্শমতো প্রচুর কথা বলতাম। গল্প পড়ে শোনাতাম। সিনেমায় নিয়ে যেতাম। কিন্তু কোনো লাভ হল না। মেয়েটি একটি কথাও বলল না।

‘ওর যখন ছ’ বছর বয়স তখন একটা অদ্ভুত ব্যাপার হল। দিনটি আমার পরিষ্কার মনে আছে—জুলাই মাসের তিন তারিখ, শুক্রবার। আমি দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার পর ঘুমুচ্ছি। শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না। জ্বর জ্বর ভাব। হঠাৎ তিন্নি আমাকে ধাক্কা দিয়ে ঘুম থেকে জাগাল, এবং পরিষ্কার গলায় বলল, বাবা অসময়ে ঘুমুচ্ছ কেন?

আপনি বুঝতেই পারছেন আমি স্তম্ভিত হয়ে তাকিয়ে রইলাম। প্রথমে ভাবলাম স্বপ্ন দেখছি। তিন্নি কথা বলেছে। একটি দুটি শব্দ নয়, পুরো বাক্য বলেছে। অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বলেছে। কোনোরকম জড়তা নয়, অস্পষ্টতা নয়। বিস্ময় সামলাতে আমার দীর্ঘ সময় লাগল। আমি এক সময় বললাম, তুই কথা বলা জানিস?

‘তিন্নি হাসি মুখে বলল, হ্যাঁ। কেন জানব না?’

‘এত দিন কথা বলিস নি কেন?’

‘তিন্নি তার জবাব দিল না। ঠোঁট টিপে হাসতে লাগল, যেন সে খুব মজা পাচ্ছে। এটা যেন চমৎকার একটা রসিকতা, কথা না বলে বাবাকে বোকা বানানো।

‘মিসির আলি সাহেব, আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, নতুন এই পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে উঠতে আমার সময় লাগল। তবে আমি ঠাণ্ডা ধরনের মানুষ। আমি কোনো কিছু নিয়েই হৈচৈ শুরু করি না। প্রথমে নিজে বুঝতে চেষ্টা করি। কিন্তু তিন্নির ব্যাপারটা আমি কিছুই বুঝলাম না। হঠাৎ করে কথা বলা শুরু করা ছাড়াও তার মধ্যে অনেক বড় ধরনের অস্বাভাবিকতা ছিল।’

এই পর্যন্ত বলেই বরকতউল্লাহ সাহেব থামলেন। পানি খেতে চাইলেন। মিসির আলি তাকিয়ে রইলেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। বরকতউল্লাহ সাহেব নিচু গলায় আবার কথা শুরু করলেন।

‘আমি লক্ষ করলাম, তিন্নি সব প্রশ্নের জবাব জানে।’

মিসির আলি বললেন, ‘আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না। সব প্রশ্নের জবাব জানে মানে?’

‘আপনাকে উদাহরণ দিলে ভালো বুঝবেন। ধরুন আমি তিন্নিকে জিজ্ঞেস করলাম, ষোলোর বর্গমূল কত? সে এক মুহূর্ত ইতস্তত না করে বলবে ‘চার’। যদিও সে অঙ্কের কিছুই জানে না। যে মেয়ে কথা বলতে পারে না, তাকে অঙ্ক শেখানোর প্রশ্নই ওঠে না।

‘আপনাকে আরেকটি উদাহরণ দিই। এক দিন বাসায় ফিরে তিন্নিকে জিজ্ঞেস করলাম ‘বল তো মা আজ নয়াবাজারে কার সঙ্গে দেখা হয়েছে?’ সে সঙ্গে সঙ্গে বলল, হালিম সাহেবের সঙ্গে।

‘হালিম আমার বাল্যবন্ধু। তিন্নি তাকে চেনে না। তার সঙ্গে আমার মেয়ের কোনো দিন দেখা হয় নি। হালিমের সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে, এটা তিন্নির জানার কোনো কারণ নেই। মিসির আলি সাহেব, বুঝতেই পারছেন, আমি খুব চিন্তিত হয়ে পড়লাম। তার কিছুদিন পর আরেকটি অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল।

‘রাতের বেলা তিন্নিকে নিয়ে খেতে বসেছি। হঠাৎ ইলেকট্রিসিটি চলে গেল। আমি হারিকেন জ্বালানোর জন্যে বললাম। কেউ হারিকেন খুঁজে পেল না। প্রয়োজনের সময় কিছুই খুঁজে পাওয়া যায় না। টর্চ আনতে বললাম- তাও কেউ পাচ্ছে না। আমি বিরক্ত হয়ে ধমকাধমকি করছি। তখন তিন্নি বলল, ‘বাতি চলে গেলে সবাই এত হৈচৈ করে কেন?’

আমি বললাম, ‘অন্ধকার হয়ে যায়, তাই।’

‘অন্ধকার হলে কী অসুবিধা?’

‘অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না, সেটাই অসুবিধা।’

‘তুমি দেখতে পাও না?’

‘শুধু আমি কেন, কেউই পায় না। আলো ছাড়া কিছুই দেখা যায় না, মা।’

‘তিন্নি খুবই অবাক হল, বিস্মিত গলায় বলল, ‘কিন্তু আমি তো অন্ধকারেও দেখতে পাই। আমি তো সব কিছু দেখছি!’

‘প্রথম ভাবলাম সে ঠাট্টা করেছে। কিন্তু না, ঠাট্টা নয়। সে সত্যি কথাই বলছিল। সে অন্ধকারে দেখে। খুব পরিষ্কার দেখে।’

‘বরকতউল্লাহ সাহেব থামলেন। রুমাল বের করে চশমার কাচ পরিষ্কার করতে লাগলেন। মিসির আলি বললেন, ‘আপনার মেয়ের প্রসঙ্গে আরো কিছু কি বলবেন?’ তিনি না-সূচক মাথা নাড়লেন।

‘আর কিছুই বলার নেই?’

‘আছে। কিন্তু এখন আপনাকে বলতে চাই না।’

‘কখন বলবেন?’

‘প্রথম আপনি আমার মেয়েকে দেখবেন। ওর সঙ্গে কথা বলবেন। তারপর আপনাকে বলব।’

‘ঠিক আছে। আপনার মেয়ের এখন বয়স হচ্ছে নয়। মেয়ের অস্বাভাবিকতাগুলি তো আপনার অনেক আগেই চোখে পড়েছে। কোনো ডাক্তারের সঙ্গে কথা বলেছেন?’

‘না। ডাক্তার এর কী করবে?’

‘কোনো সাইকিয়াট্রিস্ট?’

‘না। আপনিই প্রথম ব্যক্তি, যাঁর কাছে আমি এসেছি।’

‘মেয়ের এই ব্যাপারগুলি আপনি মনে হচ্ছে লুকিয়ে রাখতে চান।’

‘হ্যাঁ চাই। কেন চাই, তা আপনি আমার মেয়ের সঙ্গে কথা বললেই বুঝবেন।’

‘আপনি মেয়ের মা সম্পর্কে কিছু বলুন।’

‘কি জানতে চান?’

‘জানতে চাই তিনি কেমন মহিলা ছিলেন। তাঁর মধ্যে কোনোরকম অস্বাভাবিকতা ছিল কি না।

‘না, ছিল না। তিনি খুবই স্বাভাবিক মহিলা ছিলেন।’

‘আপনি ভালোমতো জানেন?’

‘হ্যাঁ, ভালোমতোই জানি। আমি এগারো বছর আমার স্ত্রীর সঙ্গে কাটিয়েছি। তিন্নি আমাদের শেষ বয়সের সন্তান। এগারো বছরে একজন মানুষকে ভালোমতো জানা যায়।’

‘তা জানা যায়। আচ্ছা, আপনার মেয়ের এই ব্যাপারগুলি কি বাইরের অন্য কাউকে বলেছেন?’

‘না, কাউকেই বলি নি। আপনি বুঝতেই পারছেন, এটা জানাজানি হওয়ামাত্রই একটা হৈচৈ শুরু হবে। পত্রিকার লোক আসবে, টিভির লোক আসবে। আমি ভাবলাম, কিছুতেই এটা করতে দেয়া উচিত হবে না। এখন মিসির আলি সাহেব, দয়া করে বলুন—-আপনি কি আমার মেয়েটাকে দেখবেন?’

‘হ্যাঁ দেখব।’

‘কবে যাবেন ময়মনসিংহ?’

‘আপনি কবে যাবেন?’

‘আমি আগামীকাল রাতে যাব। রাত দশটায় একটা ট্রেন আছে—নৰ্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেস।’

মিসির আলি সহজ স্বরে বললেন, ‘আমি আপনার সঙ্গেই যাব।’ বরকতউল্লাহ সাহেব অবাক হয়ে বললেন, ‘আমার সঙ্গে যাবেন!’

‘হ্যাঁ, আপনার সঙ্গে যাব। কোনো অসুবিধে হবে?’

বরকতউল্লাহ সাহেব মাথা নাড়লেন। কোনো অসুবিধা হবে না। এই লোকটিকে তিনি ঠিক বুঝতে পারছেন না। যে প্রথমে তাঁর কথাই শুনতে চায় নি, সে এখন—। কত বিচিত্র স্বভাবের মানুষ আছে এই পৃথিবীতে!