অন্য গ্যালাক্সিসমূহ
মেসিয়রের তালিকার অনেক বস্তুই আমাদের গ্যালাক্সির বাহিরে রয়েছে। এদের মধ্যে একটি হল অ্যান্ড্রোমিডা নীহারিকা (৩.১ নম্বর চিত্র দ্রষ্টব্য)। এই অ্যান্ড্রোমিডা নীহারিকাকে পরিষ্কার রাতের আকাশে খালি চোখে অস্পষ্ট কালো দাগের মত দেখা যায়। অ্যান্ড্রোমিডা মণ্ডলে এর অবস্থান। ৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে পারস্যের জ্যোতির্বিদ আবদুর রহমান আল সুফি তাঁর Book of the fixed stars বইটিতে এই নীহারিকাকে একটি ছোট্ট মেঘ বলে অভিহিত করেছিলেন। পরবর্তীকালে দেখা গেল অ্যান্ড্রোমিডা আমাদের গ্যালাক্সির মতই একটি সর্পিল গ্যালাক্সি। এটি আমাদের গ্যালাক্সির কাছের প্রতিবেশী গ্যালাক্সি। উনিশ শতকের শুরুর দিকে মেসিয়ের, ডেয়্যার এবং হাশেলদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত নীহারিকাদের প্রকৃতি নিয়ে এক বিরাট মতানৈক্যের সৃষ্টি হয়েছিল। একদল চিন্তাশীল এ মত পোষণ করেছিলেন যে, কিছু সংখ্যক নীহারিকা আমাদের গ্যালাক্সির বাইরের কোনও আস্থায় বিরাজমান অর্থাৎ এরা ‘এক্সট্রাগ্যালাটিক’। জার্মান দার্শনিক ইম্যানুয়েল ক্যান্ট (১৭২৪-১৮০৪) তাই মনে করেছিলেন। রাইটের মিল্কিওয়ের তত্ত্বের সাহায্যে ইম্যানুয়েল ১৭৫৫ সালে তাঁর ‘Universal natural history and theory of the heavens’ – এ উত্থাপন করেন যে, কিছু নীহারিকা গোলাকার চাকতির আকৃতির কিছুটা আমাদের গ্যালাক্সির মতই। তিনি এও বলেছিলেন, এরা অনেক দূরে অবস্থিত থাকায় এদেরকে অনুজ্জ্বল দেখায়।
মূলত আমেরিকার জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডুইন পোয়েল হাবল বিংশ শতাব্দীর বিশ ও ত্রিশের দশকে মাঝামাঝি এ মতানৈক্যে অবসান ঘটান। তিনি এমনভাবে প্ৰমাণ করেছিলেন যে, বাস্তবিকই অধিকাংশ নীহারিকা আমাদের গ্যালাক্সির বাহিরে যা নিয়ে আর কোনও সন্দেহ ছিল না। বস্তুগুলোর তথাকথিত লোহিত সরণ পর্যবেক্ষণ করে এই মতানৈক্যের অবসান ঘটিয়েছিলেন। এই লোহিত সরণ পদ্ধতি পরবর্তী অধ্যায়ে আলোচনা করা হবে। শত ইঞ্চি টেলিস্কোপের পরিপূর্ণতা প্রাপ্তির পর প্রথম বিজ্ঞানী হাবল ১৯২৩ সালে লস এঞ্জেলেসের কাছে মাউন্ট উলসন থেকে অ্যান্ড্রোমিডার প্রকৃতি নির্ণয় করেছিলেন। তিনি সাব্যস্ত করেছিলেন যে, অ্যান্ড্রোমিডায় পৃথক পৃথক নক্ষত্র রয়েছে। তিনি এই নীহারিকায় একটি সর্পিল আকৃতি খুঁজে পেয়েছিলেন কিন্তু তখনও আমাদের গ্যালাক্সির আকৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তিনি নীহারিকাটির সর্পিল বাহুতে কিছু বিষম নক্ষত্র শনাক্ত করেছিলেন।
চিত্র-৩.১ : অ্যান্ড্রোমিডা গ্যালাক্সির কেন্দ্রীয় অঞ্চল
একটি নির্দিষ্ট সময় পরপর এসব নক্ষত্রের উজ্জ্বলতা নিয়মিতভাবে পরিবর্তিত হয়। এরকম নক্ষত্র আমাদের গ্যালাক্সিতে তার আগেই আবিষ্কৃত হয়েছিল। এই নক্ষত্ররা সেফেইড বিষম নক্ষত্র নামে পরিচিত হয়। যদি কেউ এদের উজ্জ্বলতা পরিবর্তনের লেখচিত্র তৈরি করেন তবে অনেকটা ৩.২ নম্বর চিত্রের আকৃতি তৈরি হবে। আমেরিকান দুজন জ্যোতির্বিদ হেনবিয়েটা সোয়ান লেভিট ও হ্যালো শ্যাপলি সেফেইড নক্ষত্রদের দৃশ্যমান উজ্জ্বলতার পর্যায়কালসমূহের এবং এদের প্রকৃত উজ্জ্বলতার মধ্যে একটি পারস্পরিক সম্পর্ক খুঁজে পান। প্রকৃত উজ্জ্বলতা বলতে বস্তু প্রকৃতপক্ষেই কতখানি উজ্জ্বল এবং আমাদের কাছে কতটুকু উজ্জ্বল বা অনুজ্জ্বল হয়ে দৃশ্যমান হয়ে। বিজ্ঞানের ভাষায় স্বকীয় এই উজ্জ্বলতাকে ‘পরম উজ্জ্বলতা’ বলে। অন্যভাবে, একটি নাক্ষত্রিক বস্তু চতুর্দিকে যে মোট পরিমাণ আলো’ বিকিরণ করে তাই ‘পরম উজ্জ্বলতা’।
চিত্র-৩.২ একটা নির্দিষ্ট সময় অন্তর অন্তর নিয়মিতভাবে বিষম নক্ষত্রের উজ্জ্বলতার পরিবর্তন হয় এই চিত্রে তাই দেখানো হল। এসব নক্ষত্র ক্রমান্বয়ে অনুজ্জ্বল হয়ে আবার ক্ষিপ্রগতিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
একটি নাক্ষত্রিক বস্তু কতখানি উজ্জ্বল ভাবে আমাদের কাছে দৃশ্যমান হয় উজ্জ্বলতার সে পরিমাণকে কৌশলগত ভাবে দৃশ্যমান উজ্জ্বলতা বলা হয়। অর্থাৎ আমাদের দুরবিনের প্রতি একক ক্ষেত্রফলে যে পরিমাণ আলো গৃহীত হয় তাই দৃশ্যমান বা আপাত উজ্জ্বলতা। লেভিট ও শ্যাপলি প্রকৃত উজ্জ্বলতা ও পর্যায়কালের মধ্যে যে সম্পর্ক খুঁজে পান তা ৩.৩ নম্বর লেখচিত্রের মাধ্যমে প্রকাশ করা যেতে পারে। লেখচিত্রটি থেকে এটি পরিষ্কার যে, কেউ যদি একটি বিষম নক্ষত্রের উজ্জ্বলতার পর্যায়কাল সম্পর্কে জানতে পারেন তাহলে তিনি এই বিষম নক্ষত্রের প্রকৃত উজ্জ্বলতা বের করে নিতে পারবেন। এই পদ্ধতিটি লেভিট-শ্যাপলি সম্পর্ক নামে পরিচিত। জ্যোতির্বিজ্ঞানী হাবল এই ‘লেভিট শ্যাপলি সম্পর্ক’ ব্যবহার করে অ্যান্ড্রোমিডা নীহারিকার বিষম নক্ষত্রদের পরম উজ্জ্বলতা শনাক্ত করতে পেরেছিলেন।
চিত্র-৩. ৩ : একটি বিষম নক্ষত্রের উজ্জ্বলতা বনাম পর্যায়কালের লেখচিত্র। এখানে P হচ্ছে পর্যায়কাল এবং L-হচ্ছে নক্ষত্রের উজ্জ্বলতা।
এখন নাক্ষত্রিক কোনও বস্তুর প্রকৃত উজ্জ্বলতা ও আপাত বা দৃশ্যমান উজ্জ্বলতা সম্পর্কে জানা গেলে ওই বস্তুটির দূরত্ব নির্ণয় করা যাবে। কারণ বস্তুর আপাত উজ্জ্বলতা নির্ভর করে তার দূরত্বের ওপর। পৃথিবী থেকে বস্তু যত দূরে হবে বস্তুর উজ্জ্বলতা তত কম হবে। বিজ্ঞানী হাবল এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে, অ্যান্ড্রোমিডা নীহারিকা নয় লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে অবস্থিত। দেখা যায় আমাদের গ্যালাক্সিতে সবচেয়ে দূরে অবস্থিত যে বস্তুটি তার চেয়েও অ্যান্ড্রোমিডা ১০ গুণ দূরে রয়েছে। সুতরাং অ্যান্ড্রোমিডার অবস্থান নিশ্চিতভাবে আমাদের গ্যালাক্সির বাহিরে। পরবর্তীকালে বিংশ শতাব্দীর চল্লিশের দশকের শেষ দিকে এবং পঞ্চাশের দশকের শুরুর দিকে জার্মান বংশোদ্ভূত আমেরিকান জ্যোতির্বিদ ওয়াল্টার বা’ডে (১৮৯৩- ১৯৫০) এবং অন্য বিজ্ঞানীগণ দেখিয়েছিলেন যে, সেফেইড বিষম নক্ষত্র প্রকৃতপক্ষে দুই প্রকার। এডউন হাবলের পর্যবেক্ষণকৃত বিষম নক্ষত্র এবং সোয়ান লেভিটের পর্যবেক্ষণকৃত বিষম নক্ষত্রের প্রকৃতি ভিন্ন ছিল। এক্ষেত্রে হাবল পর্যায়কাল ও উজ্জ্বলতার ভুল সম্পর্ক প্রয়োগ করেছিলেন। হাবলের হিসাব অনুযায়ী অ্যান্ড্রোমিডা নীহারিকার দূরত্ব ছিল নয় লক্ষ আলোকবর্ষ। পরবর্তীকালে দেখা যায় যে, অ্যান্ড্রোমিডার দূরত্ব প্রকৃতপক্ষে দুই মিলিয়ন আলোকবর্ষের কিছু বেশি।