অন্ধ প্রজাপতি
কর্নেস নীলাদ্রি সরকার ইলিয়ট রোডে অবস্থিত ‘সানি লজ’ নামে তিনতলা। বাড়িটির ছাদে তার প্ল্যান্টওয়ার্ল্ডে’ একটি ফুলবতী অর্কিডের দিকে মুগ্ধ দৃষ্টে তাকিয়ে ছিলেন। কদিন বৃষ্টির পর আজ সকাল থেকে আকাশ পরিষ্কার। সবে সূর্য উঠেছে। শরতকালের সকালের রোদ কলকাতায় স্বরূপ হারিয়ে ফেলে, আবহমণ্ডলের যা দুরবস্থা! কর্নেল ভাবছিলেন এই নীল-লাল অর্কিডফুল আগুনের মতো দেখাত। মনে পড়ছিল, গত শরতে ভীমগোলা জঙ্গলে এই অর্কিডের ফুল দেখেছিলেন–যেন জঙ্গল দাউদাউ জ্বলছে মনে হচ্ছিল। কলকাতা কী যে হয়ে … গেল দিনে দিনে!
ভৃত্য ষষ্ঠীচরণ সিঁড়ির মাথায় মুখ বের করে বলল, “বাবামশাই! এক ভদ্রলোক এয়েছেন।”
কর্নেল তার দিকে না ঘুরেই বললেন, “ধুতি-পাঞ্জাবি-জহর-কোট। কাঁধে কাপড়ের থলে। চোখে কালো চশমা। মুখে দাড়ি।”
ষষ্ঠীর দাঁত বেরিয়ে গেল। “আজ্ঞে, আজ্ঞে!”
“মাথায় বড় বড় চুল। ফর্সা রঙ। খাড়া নাক।” বলে কর্নেল ঘুরলেন তার দিকে।
এবার ষষ্ঠী হাঁ করে ফেলেছে। তার চোখ বড়ো হয়ে গেছে। কর্নেল হাতের খুরপিটা রেখে গ্লাভস খুলে সিঁড়ির দিকে এগিয়ে গেলেন। মুচকি হেসে বললেন, “আমার চোখের দৃষ্টি দেয়াল-কংক্রিট সব ফুড়ে চলে যায়। কাজেই ষষ্ঠী, সাবধান! তাছাড়া তুই একটু আগে আবার প্রজাপতিটাকে ধরে পরীক্ষা করে দেখছিলি যে আমার কথা সত্যি কি না- তার মানে প্রজাপতিটা সত্যিই কানা কি না।”
এ পর্যন্ত শুনে ষষ্ঠী জিভ কেটে বলল, “না, না। শুধু একটুখানি ছুঁয়েছিলাম। দেখতে বড় ভাল লাগে না বাবামশাই? কিন্তু আপনি কথাটা আন্দাজেই বলছেন। কেমন করে জানলেন, আগে শুনি?”
মাঝেমাঝে ষষ্ঠী কর্নেলকে চ্যালেঞ্জ করে বসে। কর্নেল হাসতে হাসতে বললেন, “ওরে হতভাগা! তোর আঙুলে প্রজাপতিটার ডানার রঙ মেখে আছে-ওই দ্যাখ!”
“ওঃ হো!” ষষ্ঠী তার আঙুল দেখে লাফিয়ে উঠল। একগাল হেসে বলল, “আপনার নজর আছে বটে বাবামশাই! কিন্তু ওই ভদ্রলোককে দেখতে পেলেন কী করে?”
কর্নেল মৃদু হেসে চাপা গলায় বললেন, “একটু আগে ওই নিমগাছ থেকে একঝাঁক কাক এসেছিল। তাড়াতে গিয়ে দেখলুম, নিচের রাস্তায় এক ভদ্রলোক বাড়ির দিকে তাকিয়ে উল্টোদিকের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে আছে। ছাদের কার্নিশে আমাকে দেখতে পেয়েই রাস্তা পেরিয়ে আসতে থাকলেন হন্তদন্তভাবে। কাজেই…”
ষষ্ঠী তারিফ করে বলল, “ওরে বাবা! আপনার সবদিকেই চোখ!..”
একটু পরে কর্নেল গার্ডেনিং-সুট ছেড়ে বাথরুম থেকে বেরিয়ে ড্রইংরুমে ঢুকে নমস্কার করে বলে উঠলেন, “আশা করি, কানাজোল রাজবাড়ির ছোট কুমারবাহাদুরকে দেখছি।”
আগন্তুক বিজয় ভীষণ অবাক হয়ে বলল, “আশ্চর্য তো!”
কর্নেল একটু হেসে বললেন, “কিছু নয় কুমারবাহাদুর। এযুগে খবরের কাগজে দূরকে কাছে আর অচেনাকে চেনা করে দেয়।”
বিজয় বলল, “হ্যাকাগজে খবর বেরিয়েছিল বটে! কিন্তু যে ছবিটা ছাপা হয়েছিল, তাতে তো আমি ছিলাম না। আমার দাদা জয়ের ছবি ছিল, চিতাবাঘটার খাঁচার পাশে দাঁড়ানো। আমার অবাক লাগছে এই ভেবে যে, দাদাকে দেখে আমাকে চেনা তত কঠিনই। কারণ আমার মুখে দাড়ি আছে। আমরা যমজ ভাই হলেও
কর্নেল তাকে থামিয়ে নিজের শাদা দাড়িতে হাত বুলিয়ে বললেন, “আমাকে অহংকারী ভাববেন না কুমারবাহাদুর! প্রকৃতি কোনো দুর্বোধ্য কারণে আমার ইন্দ্রিয়গুলোকে সাধারণ মানুষের চেয়ে তীক্ষ্ণ করে দিয়েছেন। কোনো মানুষের মুখতা সে ছবিতেই হোক, আর বাস্তবে, যদি কোনো কারণে আমার লক্ষ্যবস্তু হয়, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে সেই মুখের একটা পৃথক ফিচার বলুন বা বৈশিষ্ট্য বলুন, আমার দৃষ্টির ফিল্টারে হেঁকে তার নিখুঁত নিজস্বতা নিয়ে স্মৃতিতে ঢুকে যায়। আপনার দাদার মুখের সেই পৃথক নিজস্বতা স্মৃতিতে এখনও টাটকা বলেই আপনাকে দেখামাত্র সনাক্ত করে ফেলেছি। তাছাড়া খবরসহ কাগজে বেরিয়েছে মাত্র গত সপ্তাহে। ছবিতে বড় কুমারবাহাদুরের মুখে দাড়ি ছিল না। দ্বিতীয়ত, যিনি চিতাবাঘ বা জন্তুজানোয়ার পোষেন, যিনি শিকারী এবং স্বাস্থ্যচর্চাও করেন, তিনি ধুতি-পাঞ্জাবি-জহরকোট পরে অমায়িকভাবে সোফায় বসে থাকবেন বলে বিশ্বাস করা যায় না। যাই হোক, এবার বলুন কুমারবাহাদুর, আপনার জন্য কী করতে পারি?”
বিজয় সপ্রশংস চোখে তাকিয়ে বলল, “দয়া করে আমাকে কুমারবাহাদুর বলবেন না। বিজয় বলে ডাকলে খুশি হবো। আমাকে তুমি বললে আরও ভাল লাগবে।”
ষষ্ঠী কফি ও স্ন্যাকসের প্লেট রেখে অভ্যাসমতো আগন্তুককে আড়চোখে দেখতে দেখতে ভেতরে চলে গেল এবং অভ্যাসমতোই পর্দার ফাঁকে একটা চোখ রেখে দাঁড়িয়ে রইল ডাইনিং ঘরের দরজার ওপাশে।
কর্নেল এটা জানেন। তাই চোখ কটমটিয়ে সেদিকে তাকালে ষষ্ঠি সরে গেল। কর্নেল বিজয়ের হাতে কফির পেয়ালা তুলে দিয়ে মৃদুস্বরে বললেন, “মর্গের রিপোর্টে তো বলেছে চিতার নখের আঘাতেই মৃত্যু। খবরের কাগজে পড়ে যেটুকু জেনেছি, তাতে মনে হচ্ছে, সেটাই সম্ভব। তাছাড়া তোমার ভগ্নীপতি শরদিন্দুবাবুর পেটে নাকি অ্যালকোহলও পাওয়া গেছে। মাতাল অবস্থায় রাত দুপুরে গিয়ে চিতার খাঁচা খুলে দিয়েছিলেন নাকি। তাহলে আর সন্দেহ কিসের?”
বিজয় কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, “জয়া বিশ্বাস করে না। জয়া–আমাদের একমাত্র বোন।”
“কাগজে তোমাদের পারিবারিক পরিচয় বেরিয়েছিল। পড়েছি।”
“হ্যাঁ স্ক্যান্ডাল রটানোর সুযোগ পেলে আজকাল খবরের কাগজ মেতে? ওঠে।” বিজয় দুঃখিত হয়ে বলল।…”জয়া-শরদিন্দুর ব্যাপারটা নিয়ে কেচ্ছার চূড়ান্ত করেছে। শরদিন্দু ব্যাংকের টাকা চুরি করে জেল খেটেছিল, তাও লিখেছে। লজ্জায় আমাদের মাথা হেঁট হয়ে গেছে।”
“জয়া কেন বিশ্বাস করে না যে স্বামীর মৃত্যু চিতার আক্রমণে–”
বাধা দিয়ে বিজয় বলল, “জয়া খুব জেদী। তার মাথায় একটা কিছু ঢুকলে তাই নিয়ে চূড়ান্ত করে ছাড়ে।”
কর্নেল মুচকি হেসে বললেন, “মাথায় তোমারও সম্ভবত কিছু ঢুকে থাকবে। তা নাহলে তুমি ছুটে আসতে না।”
বিজয়কে একটু চঞ্চল ও উত্তেজিত দেখাল। চাপা স্বরে বলল, “শরদিন্দুর মৃত্যু নিয়ে আমারও সন্দেহ আছে। তবে আমি আরও এসেছি দাদার ব্যাপারে।”
কর্নেল সোফায় হেলান দিয়ে চোখ বুজে বললেন, “হু–বলো!”
“দাদা কিছু দিন যাবৎ মনমরা হয়ে গেছে। জিগ্যেস করলে বলে, বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করে না। তার নাকি সবসময় মনে হচ্ছে, সুইসাইড করে ফেলবে।”
“তোমাকে তাই বলছে বুঝি?”
“হ্যাঁ। কিছু জিগ্যেস করলে পরিষ্কার কোনো জবাব দেয় না। খালি বলে, দেখবি বিজয়, কখন আমি সুইসাইড করে বসেছি।”
“জয়া জানে এ কথা?”
“না। জয়া দাদার সঙ্গে কথা বলে না। কারণ দাদা চিতাটাকে মেরে ফেলতে চায়নি।”
“তুমি ছাড়া আর কাউকে বলেছে সে?”
“না। আর কাউকে বলতে নিষেধও করেছে।”
কর্নেল হাসলেন। কিন্তু আমি তো সাইকিয়াট্রিস্ট ডাক্তার নই। আমার কাছে, কেন এসেছ?”
বিজয় আরও চাপা স্বরে বলল, “পরশু অনেক রাতে একবার বেরিয়েছিলুম ঘর থেকে। আমি রাত দুটো অব্দি জেগে লেখাপড়া করি। কবিতা লেখার নেশা আছে। তবে কোনো কাগজে ছাপতে পাঠাই না। নেশায় লিখি। তো একটা লাইন লিখে পরের লাইনটা কিছুতেই মাথায় আসছিল না। তাই ভাবলুম, একবার গিয়ে খোলামেলায় দাঁড়াই। রাতের আকাশ দেখে যদি পরের লাইনটা মাথায় আসে। সিঁড়িতে নামার মুখে দাদার ঘরের জানালায় আলো দেখে একটু অবাক হলুম। দাদা রাত্রে মদ খায়। তারপর নেশার ঘোরে ঘুমিয়ে পড়ে। অবশ্য মাতলামি করে না কখনও। কিন্তু দাদার ঘরে আলো দেখে তারপরই আমার আতঙ্ক হল, সুইসাইড করে ফেলল নাকি–তা না হলে আলো কেন এখনও?? দরজার কাছে যেতেই কানে এল, দাদা কার সঙ্গে যেন চাপাগলায় কথা বলছে। ভীষণ অবাক হয়ে দরজার কড়া নেড়ে ডাকলুম ওকে। অমনি ঘরের আলো নিভে গেল। অনেকক্ষণ ডাকাডাকি করে আর সাড়াই পেলুম না। আমার ডাকাডাকিতে জয়া তার ঘর থেকে বেরিয়ে জানতে চাইল, কী হয়েছে। ব্যাপারটা বললে সে বলল, “ছেড়ে দাও। শুয়ে পড়ো গে।” কিন্তু আমি তো ভুল শুনিনি। যাই হোক, দক্ষিণের বাগানে দাঁড়িয়ে আছি, সবে শুক্লপক্ষের চঁদটা উঠেছে, সেই ফিকে জ্যোৎস্নায় দেখলুম, দাদার ঘরের ও পাশের ব্যালকনির লাগোয়া ঘোরানো লোহার সিঁড়ি দিয়ে কেউ নেমে যাচ্ছে। ওদিকটায় গিয়ে চেঁচিয়ে বললুম “জয় নাকি?” লোকটা জবাব না দিয়ে জোরে নামতে থাকল। তারপর বাগানের দিকে দৌড়ে চলে গেল। তখন আচমকা মনে পড়ল, দাদার ম্যাস্টিক কুকুরটা এই ব্যালকনিতে বাঁধা থাকে। সে কেন চুপচাপ আছে? যাই হোক, সকালে দাদাকে ব্যাপারটা জিগ্যাস করলে বলল, “কই! আমি তো কিছু জানি না। ছপেগ হুইস্কি টেনে বেঘোরে ঘুমোচ্ছিলুম”… তাহলে দেখুন কর্নেল, ব্যাপারটা বড় রহস্যময় কি না।”
শুনতে শুনতে কর্নেল অভ্যাসমতো পর্যায়ক্রমে টাক ও দাড়িতে হাত বুলোচ্ছিলেন এবং চোখদুটি ছিল বন্ধ। হঠাৎ উঠে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ডানপাশে একটা র্যাকের মাথায় টবে রাখা একটা ফুলন্ত সিন্থেসিয়া লতার ওপর। তারপর কী একটা ধরে ফেললেন খপ করে। গর্জন করে ডাকলেন, “ষষ্ঠী! অ্যাই হতচ্ছাড়া!”
বিজয় হকচকিয়ে গিয়েছিল কাণ্ড দেখে। চোখ বড় করে তাকিয়ে রইল। ষষ্ঠীর সাড়া পাওয়া গেল না। কর্নেল গজগজ করছিলেন, “তখনই আমার বোঝা উচিত ছিল, ব্যাটাচ্ছেলে একটা গণ্ডগোল বাধিয়েছে। ওতে আঙুলে ছোপ দেখেও তলিয়ে ভাবিনি। আসলে আমার মন তখন বিজয়ের সঙ্গে আলাপের জন্য ব্যগ্র! হতভাগা বাঁদর! উল্লুক!”
বিজয় বলল, “কী হয়েছে কর্নেল?”
কর্নেল তার হাতে ধরা একটা প্রজাপতি দেখিয়ে বললেন, “ভাগ্যিস এসব প্রজাপতি জন্মান্ধ। আর ফুলের টবটা এখানে ছিল। নইলে দেওয়াল হাতড়ে হাতড়ে ঠিক জানালার খোঁজ পেত আর উড়ে চলে যেত। ষষ্ঠী নিশ্চয় কাঁচের খাঁচার ঢাকনা খুলেছিল। রোস, দেখাচ্ছি মজা!”
বিজয় বলল, “কর্নেল! প্রজাপতিটা পালিয়ে গেলেও ক্ষতি ছিল না। কানাজোলে গঙ্গার ধারে টিলাপাহাড়ের ঝোপে অবিকল এইসব প্রজাপতি প্রচুর দেখেছি। তবে ওরা অন্ধ, তা জানি না।”
কর্নেল কোনার দিকে সচ্ছিদ্র কাঁচের খাঁচায় প্রজাপতিটা ঢুকিয়ে রেখে এসে বললেন, “এই প্রজাপতি প্রকৃতির এক বিস্ময়। চোখ নামে কোনো ইন্দ্রিয় এদের নেই। শুড় দিয়েই ঘ্রাণের সাহায্যে এরা উড়ে বেড়াতে পারে। কানাজোলে এসব– প্রজাপতি, সত্যিই কি তুমি দেখেছ?”
“মনে হচ্ছে। ডানার ওপরটা লাল, তলাটা কালো আর হলুদ, শুড়গুলো লম্বাটে–”
কর্নেল হাত তুলে তাকে থামিয়ে বললেন, “তাহলে তোমার সঙ্গেই বেরিয়ে পড়ব। তোমার দাদার রহস্যের চেয়ে প্রজাপতিগুলোর রহস্য আমার কাছে। অনেক বেশি জোরালো। তবে যাবার আগে যষ্ঠী হনুমানটাকে উচিত শিক্ষা দিয়ে যাব।”
এতক্ষণে ষষ্ঠী নেপথ্য থেকে কঁদো কাদো গলায় বলল, “মরার মতো পড়ে আছে দেখে রেকজামিং করতে গিয়েছিলুম। আমার কী? এরপর কেউ মরে পড়ে থাকলে তাকিয়েও দেখব না। তখন যেন বলবেন না, কেন খবর দিসনি? কেনই বা রেকজামিং করিসনি?–, তখন আর বলতে আসবেন না যেন।”
কর্নেল হো হো করে হেসে উঠলেন। “না, না। রেকজামিং করবি বৈকি। তবে ঢাকনা খুলবিনে। সাবধান!”
বিজয় অবাক হয়ে বলল, “কর্নেল, রেকজামিং জিনিসটা কী?”
কর্নেল, আরও হেসে বললেন, “বুঝলে না? ওটা আমার ষষ্ঠীর ইংলিশ। একজামিন-পরীক্ষা-ষষ্ঠীর এমন অজস্র ইংলিশ আছে।”…