অন্তঃসার
জীবন যেন একটা বহতা নদী আর আমরা শিল্পীরা যেন তাতে ডুব দিয়ে যে যার গাগরি ভরিয়ে ঘরে ফিরি। যে যার গাগরি উপুড় করে বলি, আমার কিছু দেবার ছিল, যা একান্ত আমারই। কথাটা মিথ্যা নয়, কেননা ডুব তো আমি সত্যই দিয়েছি, গাগরি আমি সত্যই ভরিয়েছি। অথচ যাতে ডুব দিয়েছি, যার জল দিয়ে গাগরি ভরিয়েছি তা আমার নয়, তা নিখিলবিশ্বের নিত্য প্রবাহিত জীবন-যমুনা। যে রস আমি দিয়ে যাচ্ছি সেও কি আমার! হায়! আমার বলতে ওই গাগরিটি। ওই মানবহৃদয়টি।
শিল্পীর হৃদয় ভরে রয়েছে জীবনের কাছে পাওয়া কটুতিক্ত অম্লমধুর নানা অব্যক্ত অভিজ্ঞতায়। তার লেখনী বা তুলি বা সেতার দিয়ে সেব্যক্ত করতে চাইছে সেই বিচিত্র অভিজ্ঞতা। ব্যক্ত করতে পারলেই হালকা হয় তার হৃদয়। তারপর তার হৃদয়ের রস হয় অপরের, হয় সকলের। ব্যক্ত করতে করতে ছড়িয়ে দিতে দিতে যা একের অন্তর হতে অন্যের অন্তরে উপনীত হয় আর্টের অন্তঃসার সেই জীবন-যমুনার জল, সেই হৃদয়গাগরির রস। যার নাম জীবনের সত্য সেই হয় হৃদয়ের সত্য। সেই সত্যই ব্যক্ত হতে হতে রূপান্তরিত হয়ে যায়, তখন তাকে বলি আর্টের সত্য। জীবন থেকে হৃদয়ে, হৃদয় থেকে হৃদয়ান্তরে তার যাত্রা। এই যাত্রা যেখানে শেষ হয়েছে আর্ট সেখানে অস্তিত্ব পেয়েছে।
জীবনের সত্য কি আর্টের সত্য? হ্যাঁ এবং না। ‘হ্যাঁ’ এইজন্যে যে গোড়ায় ওটা একই বস্তু। ‘না’ এইজন্যে যে মাঝখানে আছে মানবহৃদয়। হৃদয়ের ভিতর দিয়ে না গেলে জীবনের সত্য আর্টের সত্য হয় না। হতে পারে বিজ্ঞানের সত্য, দর্শনের সত্য, কিন্তু আর্টের সত্য হৃদয়নিরপেক্ষ নয়। ওই যে গাগরিটি ওটি না থাকলে নাগরী হয় না। জীবন-যমুনার জল আনতে হয় নাগরীকে গাগরি ভরিয়ে। শিল্পীকে হৃদয় ভরিয়ে। হৃদয় না থাকলে শিল্পী হয় না।
হৃদয় যেন মধুচক্র। সেখানে সঞ্চিত হয় নানা ফুলের মধু। কিন্তু তোমার সঞ্চিত মধুর আস্বাদ যদি আর কেউ না পায় তা হলে তোমার মধুসঞ্চয় কোনোদিন আর্টের পর্যায়ে উঠবে না। হৃদয় না থাকলে শিল্পী হয় না। কিন্তু হৃদয় থাকলেও শিল্পী হয় না, যদি-না তার সঙ্গে থাকে উজাড় করে বিলিয়ে দেবার ইচ্ছা, ক্ষমতা ও কৌশল। যাতে শিল্পীর সঞ্চয় রসিকের উপভোগ্য হয়। রসের সঙ্গে রূপ যোগ করতে পারলে তবেই রসিকজন উপভোগ করেন, রূপভোগ করেন।
রস যখন রূপান্বিত হয়, রূপান্তরিত হয় তখনই তা আস্বাদনযোগ্য হয়। তখনই তা হয় বাক্য বা সংগীত, চিত্র বা অভিনয়। রস বলতে বুঝি হৃদয়রস, কিন্তু তার পূর্বে সেটা জীবন-যমুনার জল। হৃদয়রস যদি হয় মানবহৃদয়ের অভিজ্ঞতা তবে জীবন-যমুনার জল হবে রিয়্যালিটি, মানবহৃদয়কে যে ভরে দিচ্ছে অভিজ্ঞতায়। অভিজ্ঞতার পূর্বে সেটা রিয়্যালিটির খন্ড। শিল্পের মূল রিয়্যালিটি, মাঝখানে রিয়্যালিটির অভিজ্ঞতা, উপরের দিকে অভিজ্ঞতার রূপান্বয় বা রূপান্তর। ফুল সকলে দেখতে পায়, কিন্তু মূল দেখতে যায় কজন! আর কান্ড, তাই-বা কজন দেখতে চায়! শিল্প শেখানোর জন্যে যেসব স্কুল কলেজ হয়েছে সেখানে রিয়্যালিটির খোঁজখবর কেউ রাখে না, মানবহৃদয়ের নাড়িনক্ষত্র জানে না, কলাবিদ্যাই সেখানকার একমাত্র পাঠ। সেখান থেকে উতরে আসা রীতিনিপুণদের কাছে বিশ্বরহস্য বা হৃদয়রহস্য একটা কথার কথা। একমাত্র সত্য হচ্ছে রূপ।
কিন্তু কীসের রূপ? রূপের পশ্চাতে কী আছে? অভ্যন্তরে কী আছে? এর উত্তরে কেউ বলবে কিছুই নেই, না থাকলেও চলে। কেউ বলবে আছে একটা বিষয়, কিন্তু সেটা ইন্দ্রিয়ের গোচর, তার সঙ্গে হৃদয়ের কী সম্পর্ক তা জানিনে। চোখ দিয়ে দেখেছি, হৃদয় দিয়ে দেখিনি, কান দিয়ে শুনেছি, প্রাণ দিয়ে শুনিনি, হাত দিয়ে ছুঁয়েছি, চেতনা দিয়ে ছুঁইনি। দরকার আছে বলে মনে হয়নি।
রূপভোগ যে কেন রসভোগ নয় তার কারণ নিহিত রয়েছে এই উত্তরে। আর্ট বলে সাধারণত যার পরিচয় তার রূপ আছে, কিন্তু সৌন্দর্য নেই। সৌন্দর্য অনেক গভীর স্তরের ব্যাপার। মানবহৃদয়ের গাগরি কাঁখে নিয়ে জীবন-যমুনার সলিলে অবতরণ করলে, নিমগ্ন হলে তবেই তুমি তার সন্ধান পাবে। আগে সন্ধান পেলে পরে সন্ধান দেবে। তখন তোমার রূপসৃষ্টি হবে সৌন্দর্যসৃষ্টি। সত্যই সৌন্দর্য, সৌন্দর্যই সত্য, কবি কিটসের এই আপ্তবাক্য তখন অর্থবান হবে।
আর্টের অন্তঃসার তা হলে জীবনের সত্য, জীবনের সৌন্দর্য। তোমার অন্তরের অন্তঃসার হয়েই তা আর্টের অন্তঃসার। আর্টের প্রতিষ্ঠা সত্যের শৈলের উপরে। অতি কঠোর ভিত্তি। অতি সুদৃঢ় ভিত্তি। তবে মানবহৃদয়ের নরম মাটি ও কচি ঘাসপাতা দিয়ে ঢাকা। সত্যিকারের আর্ট কখনো অসত্য হতে পারে না। তবে মানুষের সুখ-দুঃখ তাকে রসালো করে। তারপর সেই রসালো সত্যকে রূপান্তরিত করে কলাবিদের কলাবিদ্যা, মায়াবীর মায়াদন্ড। সত্যের অঙ্গে মায়া মাখানো হয়। তখন তাকে মায়া বলে ভ্রম জন্মায়। তবু আসলে সেসত্যই। সত্যই আর্টের অন্তঃসার। আর্ট দাঁড়িয়ে থাকে সত্যের জোরে। এবং সত্যের জোর হচ্ছে সৌন্দর্যের শক্তি। সত্যই সৌন্দর্য, সৌন্দর্যই সত্য। এখানে যে সৌন্দর্যের কথা হচ্ছে তা শিল্পীর সৃষ্ট নয়, তা শিল্পীর দৃষ্ট।
কিন্তু একথাও ঠিক যে সত্যকে বা সৌন্দর্যকে আমরা শিল্পীরা যেমনটি দেখি তেমনটি দেখাইনে। কারণ আমরা তো কেবল দ্রষ্টা নই, আমরা স্রষ্টা। স্রষ্টা মাত্রেরই অধিকার আছে সৃষ্টিকে তার মনোমতো করবার। মনোমতো না হলে ভেঙে চুরমার করবার। বিশ্বস্রষ্টা প্রতিনিয়ত এই কর্ম করছেন। আমরাও করে থাকি। একটি গল্প বা একখানি উপন্যাস শেষপর্যন্ত যে আকার নেয় তা আমাদের নিজেদেরই স্বপ্নাতীত। জানার সঙ্গে অজানাকে মিলিয়ে ঘটনার সঙ্গে কল্পনাকে জুড়ে, কত বাদসাদ দিয়ে, কত অদলবদল করে অবশেষে যা গড়ে তুলি তা জীবনের মতো নয়, তা মনের মতো। হয়তো মনের মতোও নয়, নিজের মতো। গল্প তার নিজের নিয়মে চলে, লেখকের শাসন মানে না, এমনও তো দেখেছি। সেই অবাধ্য ঘোড়ার পিঠে চড়লে সেযেকোনো তেপান্তরের মাঠে নিয়ে যায়, কোন খালে বিলে কন্দরে, তা সে-ই জানে। স্রষ্টার অধিকার খাটাতে গিয়ে দেখি সৃষ্টির স্বকীয় একটা অধিকার আছে, বেশি রাশ টানতে পারিনে। বিশ্বস্রষ্টার দশাটাও বোধ করি আমাদেরই মতো।
মোটের উপর যা হয়ে ওঠে তার সমস্ত স্খলন পতন সত্ত্বেও স্থিতি সত্যের উপর। সত্যের অভিজ্ঞতার উপর। সেইজন্যে সেবিশ্বসৃষ্টির সঙ্গে তুলনীয়। শুধু তাই নয়, সেবিশ্বসৃষ্টির অঙ্গ। তাকে ছেড়ে বিশ্বসৃষ্টি নয়। আমরা যখন সত্যিকারের শিল্পসৃষ্টি করি তখন বিধাতার সঙ্গে যোগ দিয়ে বিশ্বসৃষ্টি করি। বিধাতার সৃষ্টি যদি নিরর্থক না হয় আমাদের সৃষ্টিও নিরর্থক নয়। এর সার্থকতা এর অন্তর্গূঢ় সত্যে। সত্যের সাক্ষাৎকার যদি না পেয়ে থাকি তবে অবশ্য অন্য কথা। তা হলে ব্যর্থতা ঢাকবার উপায় নেই। কানা চোখ, চশমায় ঢাকলে কী হবে! হলেই-বা সোনার চশমা! সৃষ্টি সেখানে অনাসৃষ্টি। কারণ অন্তঃসারশূন্য। আর্টের চরম বিচার তার অন্তঃসার দিয়ে। রূপ বা রীতি দিয়ে নয়। আর্ট যেন একপ্রকার সাক্ষ্য। যদি সত্য না হয় তবে বিচারক তাকে নাকচ করেন।
কিন্তু আমাদের সত্য আদালতের সত্য নয়। জীবনের তথা হৃদয়ের সত্য। এর বয়ানের ধারাও একরকম নয়। এর প্রতি অঙ্গে মায়া-মাখানো, সেইজন্যে একে মিথ্যা বলে মনে হতে পারে। শিল্পীকে সামাজিক কাঠগড়ায় দাঁড় করালে তার মুখ দিয়ে যা বেরিয়ে আসে তা নিরেট বাস্তব সত্য নয়, মায়াময় রসালো সত্য। সংসারী লোকের মুখে শুনে ধাঁধা লাগে। তারা বুঝতে না পেরে মাথা নাড়ে আর বলে, রবিঠাকুর হেঁয়ালি লিখেছেন।
সত্যের বিচার ওভাবে হয় না। হয় সহজ বোধ দিয়ে। ঘণ্টা যেমন বাজে সত্যও তেমনি। কথাটা কি সত্যের মতো বাজছে? যদি সত্যের মতো বাজে তাহলেও ওটা সত্যই। গল্পটা কি সত্যের মতো বাজছে? না, বাজছে না। তা হলে ওটা সত্য নয়। অনেক জাগতিক ঘটনা সত্যের মতো বাজে না, যদিও লোকের চোখে দেখা। আবার কাল্পনিক ঘটনাও সত্যের মতো বাজে। যদিও কেউ চোখে দেখেনি। মানুষের চোখের আড়ালেও কত কী ঘটছে, ভিতরে ভিতরে মন দেওয়া-নেওয়া হয়ে যাচ্ছে, একজন আরেক জনকে টানছে, কিংবা ঠেলছে, দূরে সরে যাচ্ছে বা সরিয়ে দিচ্ছে, এসবের সত্যতা কি চোখে দেখা ঘটনার চেয়ে কম? লোকে হয়তো বোঝে না, সরল করে বোঝানোও যায় না, পাঠকের ও লেখকের উভয়ের অক্ষমতার দরুন সত্যের প্রতি সংশয় জাগে।
সত্যকে উপলব্ধি করতে হয়। যে লিখবে সেও উপলব্ধি করবে। যে পড়বে সেও। উপলব্ধির অভাব আর কিছু দিয়ে ভরে না। এর জন্যে ডুব দিতে হয় জীবন-যমুনায়। সেটা একটা কাটা খাল নয় যে তোমার ইচ্ছা খাটবে তার উপর। কোথায় যে তার আদি তা কেউ বলতে পারে না, কোথায় যে তার অন্ত তাও কেউ জানে না। কবিত্ব করে যমুনা বলেছি বটে, কিন্তু জীবনের দিকে তাকাতে ভয় করে। ডুব দিতে গিয়ে কত লোক তলিয়ে গেছে অতলে। জীবন একেবারেই সহজ ব্যাপার নয়, তার পদে পদে দুঃখ দৈন্য দ্বন্দ্ব। পদে পদে স্নেহ প্রীতি করুণাও আছে। নইলে চলা কবে থেমে যেত। মানুষের চলার কথা বলছি। জীবনের চলা কি থামতে পারে! জীবন নিত্য চলমান। মানুষ না থাকলেও সেচলত, না থাকলেও চলবে। মানুষকে বাদ দিয়ে ভাবলে দুঃখ দৈন্য স্নেহ প্রীতি ইত্যাদির অর্থ হয় না। মানুষিক ভাবনার ঊর্ধ্বে উঠলে এ সকলের প্রকৃত অর্থ জানা যায়। কিন্তু এ কাজ শিল্পীর নয়, দার্শনিকের। তবে যিনি শিল্পী তিনি দার্শনিকও হতে পারেন, তাঁর শিল্পসৃষ্টির সঙ্গে তাঁর বিশ্বসৃষ্টি একাকার হতে পারে। বড়ো বড়ো কবির বেলা এরকম ঘটেছে। দান্তে, গ্যেটে, রবীন্দ্রনাথের বেলা।