অনুরন গোলক

অনুরন গোলক

উত্তরের এক জনাকীর্ণ শহর থেকে পাঁচ জন তরুণ–তরুণী দক্ষিণের এক উষ্ণ অরণ্যাঞ্চলে বেড়াতে এসেছে। তারা হ্রদের শীতল পানিতে পা ডুবিয়ে বড় বড় পাথরের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসেছিল। উত্তরের যে জনাকীর্ণ শহর থেকে তারা এসেছে সেই শহরে এখন। তুষারভেজা হিমেল বাতাস বইছে হু–হুঁ করে, সেখানে মানুষজন দীর্ঘদিন থেকে শক্ত কংক্রিট ঘরের নিরাপদ উষ্ণতায় বন্দি হয়ে আছে। খোলা আকাশের নিচে হ্রদের পানিতে পা ডুবিয়ে বসে এই পাঁচ জন তরুণ–তরুণী এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না তারা প্রকৃতির হিমশীতল, ছোবল থেকে এই কোমল উষ্ণতায় সরে এসেছে।

পাঁচ জন তরুণ–তরুণীর মাঝে যে মেয়েটি সবচেয়ে সুন্দরী এবং সে সম্পর্কে সবসময় সচেতন তার নাম রিফা। সে পা দিয়ে পানি ছিটিয়ে বলল, কী সুন্দর জায়গাটা দেখেছ? মনে হচ্ছে ধরে কচকচ করে খেয়ে ফেলি।

ক্রিক নামের সবচেয়ে হাসিখুশি ছেলেটি হেসে বলল, রিফা, তোমার সবকিছুতেই একটা খাওয়ার কথা থাকে লক্ষ করেছ?

ক্রিকের কথা শুনে সবাই অকারণে উচ্চৈঃস্বরে হাসতে থাকে, রিফার গলা উঠল সবার ওপরে। স্বল্পভাষী স্না মাথা নেড়ে বলল, একটা জিনিসকে সত্যিকার অর্থে ভালবাসলে সেটাকে খাওয়ার সাথে তুলনা করতে হয়। খাওয়া হচ্ছে মানুষের আদি আর অকৃত্রিম ভালবাসা।  

শু নামের কোমল চেহারার দ্বিতীয় মেয়েটি বলল, তাহলে বলতেই হবে রিফার এই জায়গাটি খুব পছন্দ হয়েছে।

রিফা পা দিয়ে আবার পানি ছিটিয়ে আদুরে গলায় বলল, অবশ্যি পছন্দ হয়েছে। তোমার পছন্দ হয় নি?

শু মাথা নেড়ে নরম গলায় বলল, হয়েছে। তোমার মতো কচকচ করে খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে কি না জানি না কিন্তু জায়গাটা অপূর্ব। কী নিরিবিলি দেখেছ?

ক্রিক বলল, আমরা সবাই মিলে যেভাবে চিৎকার করছি জায়গাটা কি আর নিরিবিলি আছে?

শু বলল, তা নেই, কিন্তু এই বিশাল প্রকৃতিকে আমরা কয়েকজন চিৎকার করে কি আর জাগাতে পারব? এ রকম একটা জায়গায় এলে এমনিতেই মন ভালো হয়ে যায়।

শুয়ের গলার স্বরে কিছু একটা ছিল বা এমনিতেই কোনো কারণে হঠাৎ সবাই চুপ করে যায়। শীতল পানিতে পা ডুবিয়ে সবাই চুপচাপ বসে থাকে, হ্রদের তীরে পাইনগাছে বাতাসের সরূসর শব্দ হতে থাকে, পাখির কিচমিচ ডাক কানে আসে এবং মৃদু বাতাসে হ্রদের পানি ছলাৎ ছলাৎ করে পাথরে এসে আছড়ে পড়তে থাকে।

দীর্ঘ সময় সবাই চুপ করে থাকে এবং এক সময় রিফা নিশ্বাস ফেলে বলল, আমার কী মনে হচ্ছে জান?

শু জিজ্ঞেস করল, কী?

রিফা বলল, আমার মনে হচ্ছে আমরা সবাই বুঝি সেই প্রাচীন যুগের মানুষ হয়ে গেছি। প্রাচীন যুগের মানুষ যেরকম প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকত আমরা বুঝি সেভাবে বেঁচে আছি।

রিফার কথা শুনে স্না হঠাৎ নিচু স্বরে হেসে উঠল। রিফা বলল, কী হল, তুমি হাসছ কেন?

তোমার কথা শুনে হাসছি।

কেন? আমি হাসির কথা কী বলেছি?

তুমি হাসির কথা বল নি? তুমি বলেছ যে তুমি প্রাচীনকালের মানুষের মতো প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে আছ! প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করার মানে কী তুমি জান?

রিফা সরল মুখে জিজ্ঞেস করল, কী?

প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করা মানে–ঝড় এসে ঘরবাড়ি উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া, বন্যা এসে সবকিছু ভাসিয়ে নেয়া, ভূমিকম্পে বিশাল জনপদ ধ্বংস হয়ে যাওয়া। আমাদের কখনো সেরকম কিছু হয় না, এই শতাব্দীতে আমরা প্রকৃতিকে বশ করে আছি। ঝড় ভূমিকম্প বন্যা রিজার্ড আমাদের স্পর্শও করতে পারে না। শুধু তাই না, আকাশ থেকে একটা উল্কাও পৃথিবীতে পৌঁছাতে পারে না, মহাকাশেই সেটাকে ধ্বংস করে দেয়া হয়।

ক্রিক বলল, শুধু কি তাই? এই যে আমরা এক গভীর অরণ্যে হ্রদের পানিতে পা ডুবিয়ে বসে আছি, আমরা কি ভয়ে ভয়ে আছি যে গভীর জঙ্গল থেকে একটা বুনো পশু এসে আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে? একটা বিষাক্ত সাপ এসে আমাদের ছোবল দেবে? না, আমাদের মোটেও সেই ভয় নেই! আমাদের ক্যাম্পে যে সনোট্রনটা রয়েছে সেটা প্রতিমুহূর্তে আলট্রাসনিক শব্দ দিয়ে যাবতীয় পশুপাখি জন্তু–জানোয়ারকে দূরে সরিয়ে রাখছে। আমাদের সবার কাছে যে যোগাযোগ মডিউলটা রয়েছে সেটা উপগ্রহের সাথে যোগাযোগ রাখছে, আমাদের যে–কোনো বিপদে এক ডজন হেলিকপ্টার দুই ডজন বাই ভার্বাল শ দুয়েক রবোট ছুটে আসবে। কাজেই রিফা, হ্রদের পানিতে পা ডুবিয়ে বসে থাকা আর প্রাচীন মানুষের মতো প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করার মাঝে বিশাল পার্থক্য।

রিফা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, কিন্তু আমার মাঝে মাঝে জানতে ইচ্ছে করে প্রাচীনকালের মানুষদের বেঁচে থাকতে কেমন লাগত।

ক্রিক সরল মুখে হেসে বলল, আমি দুঃখিত রিফা, তুমি সেটা কখনই জানতে পারবে না।

দলের পঞ্চম সদস্য লন সারাক্ষণ চুপ করে বসেছিল। সে স্বল্পভাষী মানুষ নয় কিন্তু বিশাল এক জনাকীর্ণ শহর থেকে হঠাৎ করে প্রকৃতির এত কাছাকাছি এসে সে এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করছে। বিশাল প্রকৃতি কখন কাকে কীভাবে প্রভাবিত করে বোঝা খুব। মুশকিল। সে এতক্ষণ খুব মনোযোগ দিয়ে সবার কথা শুনছিল, এবারে একটা নিশ্বাস ফেলে। বলল, আমি একটা কথা বলি?

ক্রিক জিজ্ঞেস করল, কী কথা?

রিফা যেরকম বলছে প্রাচীনকালের মানুষ কেমন করে বেঁচে থাকত তার জানতে খুব ইচ্ছে করে, আমারও সেরকম ইচ্ছে করে। ব্যাপারটি সহজ নয় কিন্তু একেবারে অসম্ভবও তো নয়।

রিফা ঘুরে তাকাল লনের দিকে, চোখ বড় বড় করে বলল, কীভাবে?

লন আঙুল দিয়ে দূর পাহাড়ের একটা চুড়োর দিকে দেখিয়ে বলল, ওই যে চুড়োটা

দেখছ সেটা এখান থেকে প্রায় ষাট কিলোমিটার দূরে। চুড়োটার নিচে একটা চমৎকার উপত্যকা রয়েছে। আমরা যদি এখান থেকে ওদিকে যেতে শুরু করি, মনে হয় দুদিনে পৌঁছে যাব। বনে জঙ্গলে পাহাড়ে পর্বতে আমাদের হেঁটে অভ্যাস নেই তাইনা হয় অনেক আগে পৌঁছে যেতাম।

ক্রিক ভুরু কুঁচকে বলল, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না তুমি কী বলতে চাইছ।

লন একটু হাসার মতো ভঙ্গি করে বলল, আমি বলছি চল আমরা সবাই মিলে পাহাড়ের নিচে সেই উপত্যকাটায় যাই।

ক্রিক মাথা নেড়ে বলল, আমি এখনো ঠিক বুঝতে পারছি না। আমরা যদি উপত্যকাটায় যাই তাহলে কেন সেটা প্রাচীনকালের মানুষের মতো যাওয়া হবে? আমাদের পায়ের জুতো লেভিটেটিং প্রয়োজনে আমাদের ভাসিয়ে নিতে পারে, আমাদের জামাকাপড় নিও পলিমারের, তার মাঝে হাই জি সেন্সর রয়েছে, হঠাৎ করে পড়ে গেলে নিজে থেকে রক্ষা করে, আমাদের হেলমেটে-

 লন বাধা দিয়ে বলল, আমরা সে সবকিছু রেখে যাব। সাধারণ একজোড়া জুতো পরে, সাধারণ কাপড়ে হেঁটে হেঁটে যাব। সাথে থাকবে কিছু খাবার আর স্লিপিং ব্যাগ। আর কিছু না।

কেউ কোনো কথা না বলে বিস্তারিত চোখে লনের দিকে তাকিয়ে রইল। রিফা খানিকক্ষণ চেষ্টা করে বলল, আর কিছু না?

না। সবার কাছে প্রাচীন কোনো অস্ত্র থাকতে পারে। একটা ছোরা বা কুড়াল, এর বেশি কিছু নয়।

যদি বুনো পশু আমাদের আক্রমণ করে?

করার কথা নয়। তবু যদি করে আমরা আমাদের অস্ত্র দিয়ে নিজেদের রক্ষা করব।

যদি পা হড়কে পড়ে যাই? গভীর ধাদের মাঝে পড়ে যাই?

তাহলে মরে যাব।

রিফা শিউরে উঠে বলল, মরে যাব?

হ্যাঁ। তাই চেষ্টা করব যেন পা হড়কে পড়ে না যাই। খুব সাবধানে আমরা যাব, একে অন্যকে রক্ষা করে।

যদি কোনো জরুরি প্রয়োজন হয়? আমাদের কমিউনিকেশান মডিউল–

না, আমাদের কাছে কমিউনিকেশান মডিউলও থাকবে না। এখানে ফিরে না আসা পর্যন্ত আমরা কারো সাথে যোগাযোগ করতে পারব না। যদি জরুরি কোনো প্রয়োজন হয় আমাদের নিজেদের সেই প্রয়োজন মেটাতে হবে। প্রাচীনকালের মানুষেরা যেভাবে মেটাত।

সবাই চুপ করে লনের দিকে তাকিয়ে রইল, কেউ বেশ খানিকক্ষণ কোনো কথা বলল। শেষ পর্যন্ত শু বলল, লন যেটা বলেছে সেটা স্রেফ পাগলামি, এর ভিতরে কোনো যুক্তি নেই এবং কাজটা হবে পরিষ্কার গোয়ার্তুমি। আমাদের ভিতরে যে–কেউ মারা পড়তে পারে এবং আমি নিশ্চিত কাজটা বেআইনি। একে অপরের জীবনের ঝুঁকি নেয়ার জন্যে আমাদের জবাবদিহি করতে হবে। কিন্তু আমাকে স্বীকার করতেই হবে আমি তবু এটা করতে চাই। আমি সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে শুধুমাত্র একটা প্রাচীন অস্ত্র হাতে নিয়ে ওই পাহাড়ের পাদদেশে যেতে চাই।

রিফা ভয় পাওয়া চোখে শুয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি যেতে চাও?

হ্যাঁ।

যদি– যদি কোনো বিপদ হয়?

সেটা দেখার জন্যেই যাওয়া।

রিফা কী একটা বলতে চাইছিল, তাকে বাধা দিয়ে ক্রিক বলল, আমিও যেতে চাই।

রিফা ঘুরে তাকাল ক্রিকের দিকে, তুমিও যেতে চাও?

হ্যাঁ। ক্রিক একটু হাসার মতো ভঙ্গি করে বলল, কাজটা সম্পূর্ণ বেআইনি কিন্তু আমি তবু করে দেখতে চাই। এই যুগে আমাদের জীবন খুব বেশি ছকে বাঁধা–একটা বড়ধরনের বৈচিত্র্য মনে হয় মন্দ হবে না।

স্না পানিতে তার পা নাড়িয়ে বলল, আমিও করে দেখতে চাই। আর তোমরা এটাকে যেটুকু বিপজ্জনক বা বেআইনি ভাবছ এটা সেরকম বিপজ্জনক বা বেআইনি নয়। আমরা যে এটা করছি সেটা কেউ না জানলেই হল।

লন মাথা নাড়ল, তা ঠিক।

আর আমরা সবাই যদি কাছাকাছি থাকি তাহলে কোনো বড় ধরনের ঝামেলা হওয়ার কথা নয়। আমাদের হয়তো কষ্ট হবে, শারীরিক পরিশ্রম হবে কিন্তু বিপদ হবে না।

লন মাথা নাড়ল, স্না ঠিকই বলেছে।

শু এবার ঘুরে তাকাল রিফার দিকে, রিফা, তুমি ছাড়া আর সবাই রাজি।

রিফা শুকনো মুখে বলল, আমার এখনো ভয় ভয় করছে। কিন্তু তোমরা সবাই যদি রাজি থাক তাহলে আমিও যাব। অবশ্যি যাব।

সাথে সাথে দলের অন্য সবাই একসাথে আনন্দধ্বনি করে ওঠে।

.

পুরো দলটি ঘণ্টাখানেকের মাঝে প্রস্তুত হয়ে নেয়। নিরাপত্তার আধুনিক সকল সরঞ্জাম রেখে দিয়ে তারা প্রাচীনকালের মানুষের মতো অল্প কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে রওনা হয়। তাদের পিঠের ব্যাকপেকে থাকে–খাবর, স্লিপিং ব্যাগ আর কিছু কাপড়। তাদের হাতে থাকে প্রাচীন অস্ত্র, একটি কুড়াল, কয়েকটি ছোরা এবং কিছু বড় লাঠি। ছোট দলটি হ্রদের তীর ধরে হেঁটে হেঁটে উপরে উঠে যেতে থাকে। প্রথমে তাদের বুকের মাঝে জমে থাকে এক ধরনের আতঙ্ক, খুব ধীরে ধীরে তাদের সেই আতঙ্ক সরে গিয়ে সেখানে এক ধরনের আত্মবিশ্বাস এসে ভর করে। তারা হ্রদটিকে ঘিরে গভীর অরণ্যে প্রবেশ করে, লতাগুল কেটে কেটে অরণ্যের গভীরে যেতে থাকে। যখন রাতের অন্ধকার নেমে আসে, একটা খোলা জায়গায় শুকনো গাছের ডাল লতা পাতা জড়ো করে সেখানে আগ্রুন ধরিয়ে দেয়। বিশাল। অগ্নিকুণ্ডের দিকে তাকিয়ে সবাই গোল হয়ে বসে থাকে, ব্যাকপেক থেকে খাবার বের করে আগুনে ঝলসে ঝলসে খেতে থাকে। তাদের চেহারায় এক ধরনের ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট হয়ে আসে কিন্তু তাদের চোখ উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করতে থাকে। তারা কথা বলে নিচু স্বরে এবং ক্রমাগত চকিত দৃষ্টিতে এদিক–সেদিক তাকাতে থাকে। গভীর জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে নিশাচর পশুর ডাক শুনতে শুনতে তারা নিজেদের বুকের ভিতরে রহস্য এবং আতঙ্কের এক বিচিত্র অনুভূতি অনুভব করতে থাকে। রাত্রিবেলা তারা পালা করে ঘুমায় এবং কেউই সত্যিকার অর্থে ঘুমাতে পারে না এবং একটু পরে পরে তারা চমকে চমকে ঘুম থেকে জেগে ওঠে।

ভোরবেলা সূর্যের প্রথম আলোকে পুরো দলটির মাঝে এক ধরনের উৎসাহের সঞ্চার হয়, তারা কোনোরকম সাহায্য ছাড়া একা একা গভীর অরণ্যে রাত কাটিয়েছে ব্যাপারটি অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি। পরের দিনের পথ ছিল আরো দুর্গম কিন্তু কোনো একটি অজ্ঞাত কারণে পুরো দলটির কাছে সেটি আর দুর্গম বলে মনে হয় না। প্রবল আত্মবিশ্বাসে তারা নিজেদের টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যেতে থাকে, ঝোঁপঝাড়ে লেগে তাদের শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে আসে, অসহনীয় পরিশ্রমে তাদের দেহ অবশ হয়ে আসে তবুও তারা কোনো একটি অজ্ঞাত শক্তির প্রেরণায় হেঁটে যেতে থাকে।

তারা যখন তাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছাল তখন বেলা ডুবে গেছে। ক্লান্তিতে তখন আর কেউ দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। কোনোভাবে একটা আগ্রুন জ্বালিয়ে সবাই জড়াজড়ি করে বসে থাকে। খানিকক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে এবং অল্প কিছু খেয়ে যখন তাদের মাঝে খানিকটা শক্তি ফিরে এল তখন আবার তারা কথাবার্তা বলতে শুরু করে। গরম একটা পানীয় চুমুক দিয়ে খেতে খেতে রিফা বলল, আমরা সত্যিই তাহলে করেছি!

ক্রিক মাথা নাড়ল, হা, করেছি

কোনরকম সাহায্য ছাড়া আমরা গত দুদিন থেকে হাঁটছি। একেবারে প্রাচীনকালের মানুষের মতো!

শু রিফার দিকে তাকিয়ে হাসল, বলল, একেবারে প্রাচীনকালের মানুষের মতো! শরীরের শক্তিই হচ্ছে সবকিছু।

ক্রিক মাথা নাড়ল, হ্যাঁ, কোনো যন্ত্রপাতি নেই, কোনো প্রযুক্তি নেই, শুধুমাত্র আমাদের শক্তি! আমাদের সাহস।

রিফা তার গরম পানীয়টিতে চুমুক দিয়ে বলল, ব্যাপারটা আসলে খারাপ নয়। আমার তো মনে হচ্ছে বেশ চমৎকার একটা ব্যাপার। যন্ত্রপাতি থেকে কোনো সাহায্য পাওয়া যায় না বলে একে অন্যকে সাহায্য করতে হয়, নিজেদের মাঝে কী সুন্দর একটা পরিবার পরিবার সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

স্বল্পভাষী স্না মাথা নাড়ল, বলল, ঠিকই বলেছ। প্রাচীনকালের সমাজের খুঁটি সেজন্যে খুব শক্ত ছিল। এখন সেরকম পাওয়া খুব সহজ নয়।

রিফা সামনের বিশাল আগুনের কুণ্ডলীটাতে এক টুকরা শুকনো কাঠ ছুঁড়ে দিয়ে বলল, এখানে এসে আমার যে কী ভালো লাগছে তোমাদের বোঝাতে পারব না। মনে হচ্ছে সবকিছু কচকচ করে খেয়ে ফেলি!

দলের অন্য সবাই এক ধরনের স্নেহের চোখে রিফার দিকে তাকাল, মেয়েটির মাঝে এক ধরনের নির্দোষ সারল্য আছে যেটা প্রায় সময়েই খুব স্পষ্টভাবে প্রকাশ পেয়ে যায়।

.

গভীর রাতে যখন সবাই ঘুমানোর আয়োজন করছে তখন হঠাৎ লন সবার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, আমার হঠাৎ একটা কথা মনে হয়েছে।

ক্রিক কৌতূহলী চোখে বলল, কী কথা?

আমরা বলাবলি করছি যে আমরা গত দুদিন প্রাচীনকালের মানুষের মতো বেঁচে আছি।

হ্যাঁ। কী হয়েছে তাতে?

কথাটা সত্যি নয়।

সত্যি নয়? কেন?

আমাদের সবার কাছে একটা জিনিস রয়েছে যেটা প্রাচীনকালের মানুষের কাছে ছিল না।

কী?

অনুরন গোলক।

রিফা ভুরু কুঁচকে বলল, অনুরন গোলকের সাথে এর কী সম্পর্ক?

আছে, সম্পর্ক আছে। অবশ্যি আছে।

কীভাবে আছে?

বলছি শোন। লন আগুনের পাশে দাঁড়িয়ে বলল, আমাদের গত দুদিনের কথা চিন্তা কর, আমরা কী করেছি?

হেঁটে হেঁটে এসেছি।

হ্যাঁ। লন মাথা নেড়ে বলল, অত্যন্ত দুর্গম একটা পথ দিয়ে হেঁটে হেঁটে এসেছি। যখন রিফা খুব ক্লান্ত হয়ে গেছে তখন আমরা কী করেছি?

রিফার মালপত্র অন্যেরা ভাগাভাগি করে এনেছি।

হ্যাঁ। আমরা কেউ কি রিফার ওপরে বিরক্ত হয়েছি?

শু একটু অবাক হয়ে বলল, বিরক্ত কেন হব?

হওয়ার কথা। প্রাচীনকালের মানুষ হলে বিরক্ত হত। রাগ হত। যে দুর্বল তাকে সবাই ত্যাগ করে যেত। যারা সবল তারা একে অন্যের সাথে নেতৃত্ব নিয়ে যুদ্ধ করত। প্রয়োজনে তারা স্বার্থপর হত। কিন্তু আমরা হই না। জন্মের পরই আমাদের মস্তিষ্ক স্ক্যান করে আমাদের সবার শরীরে প্রয়োজনমাফিক নির্দিষ্ট অনুরন গোলক ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। আমরা তাই অন্যরকম মানুষ। আমাদের মাঝে রাগ নেই, হিংসা নেই, আমাদের মাঝে লোভ নেই। আমরা একে অন্যকে সাহায্য করি। একজন মানুষ এমনিতে যেটুকু ভালো হওয়ার কথা, আমরা তার থেকে অনেক বেশি ভালো। গত শতাব্দীকে পৃথিবীতে মানুষ যুদ্ধ করে নি, একে অন্যকে শোষণ করে নি–তার কারণ হচ্ছে অনুরন গোলক। মানুষের মাঝে যেটুকু সীমাবদ্ধতা আছে সব সরিয়ে নিয়েছে এই অনুরন গোলক।

ক্রিক তীক্ষ্ণ চোখে লনের দিকে তাকিয়ে বলল, তার মানে তুমি বলছ আমরা এখনো প্রাচীনকালের মানুষের অনুভূতির খোঁজ পাই নি?

না। ব্যাপারটা সেই বিংশ শতাব্দী থেকে শুরু হয়েছে, যখন মানুষ আবিষ্কার করেছে একজন মানুষের ব্যক্তিত্ব আসলে তার মস্তিষ্কের জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়া বিশেষ ওষুধ দিয়ে সেই বিক্রিয়ার পরিবর্তন করা যায়, যেই মানুষ বদ্ধ উন্মাদ তাকে সুস্থ করে দেয়া যায়, যেই মানুষ বিষণ্ণতায় ভুগছে তাকে উৎফুল্ল করে দেয়া যায়, তখন থেকে মানুষের ব্যক্তিত্বকে পাল্টে দেয়া শুরু হয়েছে। মানুষের সব সীমাবদ্ধতা সরিয়ে নেয়া শুরু হয়েছে। আমরা প্রাচীনকালের মানুষ থেকে অনেক ভিন্ন, অনেক যত্ন করে আমাদের প্রস্তুত করা হয়। এই শতাব্দীতে কোনো উন্মাদ নেই, খুনে নেই, খ্যাপা নেই, স্কৃতজোফ্রেনিয়া রোগী নেই—

রিফা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তার মানে আমাদের এই কষ্ট এই পরিশ্রম সব অর্থহীন? আসলে আমরা জানি না প্রাচীনকালের মানুষের অনুভূতি কী রকম?

লন একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, তুমি ঠিকই বলেছ রিফা। আমরা জানি না প্রাচীনকালের মানুষের অনুভূতি কী রকম। আমাদের জায়গায় তারা থাকলে এতক্ষণে হয়তো ঝগড়া করত, খাবার নিয়ে কাড়াকাড়ি করত, নিষ্ঠুরতা করত–তোমাকে নিয়ে মারামারি করত–

আমাকে নিয়ে?

হ্যাঁ। প্রাচীনকালে সুন্দরী নারী নিয়ে অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে!

রিফা একটু হতচকিতভাবে লনের দিকে তাকাল এবং অন্য সবাই শব্দ করে হেসে উঠল।

হাসির শব্দ থেমে আসতেই মা একটু এগিয়ে এসে বলল, আমি একটা কথা বলি?

কী কথা?

আমরা গত দুদিন একটা অস্বাভাবিক কাজ করছি। ঠিক প্রাচীনকালের মানুষের মতো আধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্য ছাড়া প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে বেঁচে আছি। এই কাজটা কি আরো একটু এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি?

রিফা চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে বলল, কীভাবে?

আমাদের শরীরে যে অনুরন গোলক রয়েছে সেটা বের করে ফেলি।

স্নার কথা শুনে সবাই চমকে উঠে তার দিকে তাকাল, স্নার মুখ পাথরের মতো শক্ত। সে ব্যাপারটা নিয়ে ঠাট্টা করছে না, সত্যিই বলছে।

রিফা এক ধরনের আতঙ্কিত মুখে বলল, কী বলছ?

ঠিকই বলছি। এই আমাদের সুযোগ। বিশাল এক পাহাড়ের আড়ালে আমরা একত্র হয়েছি। মানুষজন সভ্যতা থেকে বহুদূরে! এখন আমরা আমাদের শরীর থেকে অনুরন গোলক বের করে সত্যি সত্যি প্রাচীনকালের মানুষ হয়ে যেতে পারি। যখন আমাদের মস্তিষ্কে অনুরন গোলক থেকে জৈব রসায়ন যাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে তখন আমরা আস্তে আস্তে আমাদের সত্যিকারের ব্যক্তিত্ব ফিরে পাব! কেউ হয়তো বের হব হিংসুটে, কেউ রাগী, কেউ অসৎ

রিফা এক ধরনের আহত দৃষ্টি নিয়ে সবার দিকে তাকিয়ে বলল, কিন্তু কেন আমরা আমাদের ভিতরের খারাপ দিকটা বের করে আনব?

স্না মাথা নেড়ে বলল, খারাপ দিকটা বের করে আনব না রিফা, সত্যিকারের ব্যক্তিত্বটা বের করে আন। আর সেটা যে খারাপই হবে কে বলেছে? হয়তো দেখা যাবে কেউ একজন সামান্য একটু গোমড়ামুখী, কেউ একজন একটু বেশি লাজুক, কেউ একজন বেশি কথা বলে! এর বেশি কিছু নয়।

ক্রিক একটু এগিয়ে এসে বলল, কিন্তু তুমি শরীর থেকে অনুরন গোলক বের করবে কেমন করে? সেটা তো অত্যন্ত সূক্ষ্ম একটা গোলক, শরীরের মাঝে ঢুকিয়ে দেয়া হয়!

স্না একটু হেসে বলল, আমি হাসপাতালে কাজ করি, একজন শিশু জন্মানোর পর তার শরীরে প্রথম অনুরন গোলকটি আমি প্রবেশ করিয়ে থাকি। আমি জানি হাতের কনুইয়ের কাছে এটা স্থির হয়। ছোট একটা চাকু থাকলে আমি দুই মিনিটে অনুরন গোলকটা শরীর থেকে বের করে আনতে পারি।

সত্যি?

সত্যি। দেখতে চাও?

কেউ কোনো কথা না বলে চুপ করে স্থির দৃষ্টিতে স্নার দিকে তাকিয়ে থাকে। স্না আবার বলল, আমরা এটা তো পাকাঁপাকিভাবে করছি না, যখন লোকালয়ে ফিরে যাব তখন আবার আমরা ঠিক ঠিক অনুরন গোলক শরীরে প্রবেশ করিয়ে নেব, আবার আমরা আগের মতো। হয়ে যাব।

শু একটু এগিয়ে এসে বলল, এটা পাগলামি এবং গোয়ার্তুমি। এর মাঝে বিন্দুমাত্র যুক্তি নেই। আমার ধারণা ব্যাপারটার মাঝে বেশ খানিকটা বিপদ রয়েছে। কিন্তু সত্যি কথা বলতে কী, আমি মানুষটা আসলে কী রকম আমার খুব জানার কৌতূহল হচ্ছে! তোমরা কে কী করবে জানি না, আমি আমার অনুরন গোলক বের করে নিয়ে আসছি।

শু এক পা এগিয়ে তার হাতটা মার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, ব্যথা লাগবে না তো?

স্না পকেট থেকে চাকুটা বের করে বলল, তোমার চামড়াটা একটু কেটে ভিতর থেকে

গোলকটা বের করতে হবে, দুই ফোঁটা রক্ত বের হবে, একটু ব্যথা তো লাগবেই। মাটিতে বসে শুয়ের হাতটা চেপে ধরে কনুইয়ের কাছাকাছি একটা জায়গা হাত দিয়ে অনুভব করে অনুরন গোলকটির অবস্থানটা বের করে নেয়, তারপর চাকুর ধারালো ফলাটি দিয়ে খুব সাবধানে একটুখানি চিরে ফেলে, শু যন্ত্রণায় একটা শব্দ করে দাঁতে দাঁত কামড়ে ধরল। স্না সাবধানে হাত দিয়ে জায়গাটা অনুভব করে কোথায় চাপ দিতেই টুক করে ক্ষুদ্র একটা গোলক বের হয়ে আসে। গোলকটি ছোট বালুর কণার মতো, স্না সেটাকে হাতের তালুতে নিয়ে শু’কে দেখিয়ে বলল, এই দেখ তোমার অনুরন গোলক।

শু তার কাটা জায়গায় হাত বুলাতে বুলাতে হঠাৎ খিলখিল করে হাসতে শুরু করে। সবাই একটু অবাক হয়ে তার দিকে তাকাল, ক্রিক বলল, কী হল? হাসছ কেন?

শু হাসতে হাসতে কোনোমতে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, জানি না হঠাৎ কেন জানি হাসি পেয়ে গেল। এইটুকু একটা জিনিস নিয়ে এত হইচই, হাসি পাবে না?

শু হঠাৎ আবার খিলখিল করে হাসতে থাকে।

স্না হাতের তালুর মাঝে রাখা অনুরন গোলকটির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, মনে হয় শুয়ের ব্যক্তিত্ব পাল্টে যাচ্ছে। সে মোটামুটি জ্ঞানগম্ভীর মহিলা থেকে তরলমতি বালিকায় পরিণত হয়ে যাচ্ছে।

শু হাসি থামিয়ে চোখ বড় বড় করে বলল, সত্যি?

তাই তো মনে হচ্ছে!

তুমি মনে হয় ঠিকই বলছ। আমার কেন জানি সবকিছুকেই মজার জিনিস বলে মনে হচ্ছে।

ক্রিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে শুয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কি তোমার ভিতরে কোনো ধরনের পরিবর্তন অনুভব করছ শু?

করছি! মনে হচ্ছে তোমরা সব বুড়ো মানুষের মতো গম্ভীর! মনে হচ্ছে তোমরা সবকিছু নিয়ে বাড়াবাড়ি করছ, কোনোকিছু সহজভাবে নিতে পারছ না! মনে হচ্ছে জীবনটা এত গুরুত্ব দিয়ে নেয়ার কোনো প্রয়োজন নেই! জীবনটা হচ্ছে স্ফূর্তি করার জন্যে!

সবাই শুয়ের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে তার ব্যক্তিত্বের পরিবর্তনটি অত্যন্ত স্পষ্ট, হঠাৎ করে সে একটি ছেলেমানুষ চপলমতি বালিকায় পাল্টে গেছে। তাকে দেখে সবার এক ধরনের হিংসে হতে থাকে। ক্রিক এগিয়ে গিয়ে বলল, স্না, এবারে আমার অনুরন গোলকটি বের করে দাও!

শু ক্রিকের কথা শুনে আনন্দে খিলখিল করে হাসতে হাসতে ছেলেমানুষের মতো তার পিঠ চাপড়ে বলল, এই তো চাই! দেখি তোমার ভিতরে কী লুকিয়ে আছে। একটি তেজস্বী সিংহ নাকি একটা ধূর্ত ইঁদুর।

স্না ঠিক আগের মতো যত্ন করে ক্রিকের কনুইয়ের কাছের চামড়াটি চিরে অনুরন গোলকটি বের করে আনে। সাবধানে সেটি ক্রিকের হাতের তালুতে দিয়ে জিজ্ঞেস করল, তোমার কেমন লাগছে ক্রিক?

সবাই ঝুঁকে পড়ে ক্রিকের দিকে তাকিয়ে রইল। ক্রিক শুকনো মুখে বলল, একটু ভয় ভয় লাগছে!

ভয়?

হ্যাঁ।

ঠিক তখন তাদের মাথার উপর দিয়ে একটা নিশাচর পাখি উড়ে গেল, ক্রিক চমকে উঠে স্নাকে জড়িয়ে ধরে ফ্যাকাশে মুখে বলল, কী ওটা? কী?

শু খিলখিল করে হাসতে হাসতে বলল, আমাদের ক্রিক মূষিক শাবকে পাল্টে গেছে। মূষিক শাবক!

ক্রিক ফ্যাকাশে মুখে বলল, সত্যিই আমার ভয়টা হঠাৎ বেড়ে গেছে। কেন জানি শুধু ভয় ভয় করছে।

স্না সাবধানে ক্রিকের শরীর থেকে বের করা অনুরন গোলকটি হাতে নিয়ে বলল, তোমার কি বেশি ভয় করছে? তাহলে এটা আবার তোমার শরীরে ঢুকিয়ে দিতে পারি।

ক্রিক মাথা নাড়ল, না, থাক! এটা আমার জন্যে সম্পূর্ণ নতুন একটা অনুভূতি। আমি একটু দেখতে চাই। তোমরা শুধু আমার কাছাকাছি থেকো, একটু শব্দ হলেই কেন জানি আঁতকে উঠছি।

ক্রিকের পর লনের শরীর থেকে তার অনুরন গোলকটি বের করা হল। লন এমনিতে চুপচাপ ভালো মানুষ কিন্তু অনুরন গোলকটি বের করার সাথে সাথে সে কেমন জানি তিরিক্ষে মেজাজের হয়ে গেল। যদিও সে নিজেই সবাইকে এখানে নিয়ে আসার পরিকল্পনাটি দিয়েছে কিন্তু সে এখন এই ব্যাপারটি নিয়েই অসম্ভব বিরক্ত হয়ে উঠে অত্যন্ত রূঢ় ভাষায় সবাইকে উত্ত্যক্ত করতে শুরু করে। অনুরন গোলকের কারণে মানুষের মাঝে থেকে রূঢ় ব্যবহার মোটামুটিভাবে উঠে গেছে। ব্যাপারটি সবার কাছে এত বিচিত্র মনে হতে থাকে যে লনের রূঢ় ব্যবহারে কেউ কিছু মনে করে না, বরং বলা যেতে পারে সবাই ব্যাপারটি উপভোগ করতে শুরু করে!

রিফা তার অনুরন গোলক বের করতে রাজি হল না, হাতের এক চিলতে চামড়া কেটে শরীরের ভিতর থেকে গোলকটি বের করার কথা চিন্তা করতেই তার নাকি শরীর কাঁটা দিয়ে উঠছে। স্নার পক্ষে তার নিজের অনুরন গোলকটি বের করা দুঃসাধ্য ব্যাপার, কাজেই তাকে অন্যেরা সাহায্য করল। অভিজ্ঞতার অভাব বলে তার হাতের ক্ষতটি হল একটু গভীর এবং রক্তপাত বন্ধ করতে বেশ বেগ পেতে হল।

স্নার ভিতরে পরিবর্তনটি হল অত্যন্ত সূক্ষ্ম। তার ভিতরে এক ধরনের বিষণ্ণতা এসে ভর করল। সে এমনিতেই স্বল্পভাষী, অনুরন গোলকটি বের করার পর সে আরো স্বল্পভাষী হয়ে। গেল। সে বিষণ্ণ চোখে আগুনের দিকে তাকিয়ে থেকে চুপচাপ বসে রইল। শু খানিকক্ষণ স্নাকে হাসিখুশি করার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দিয়ে রিফার দিকে মনোযোগ দিল। তাকে বলল, রিফা, আমরা সবাই আমাদের অনুরন গোলক বের করেছি। তোমাকেও বের করতে হবে।

আমার ভয় করে। রক্ত দেখলে আমার খুব ভয় করে।

দু ফোঁটা রক্ত দেখে ভয় পাবার কী আছে? আর যদি ভয় করে তাহলে চোখ বন্ধ করে থেকো।

রিফা জোরে জোরে মাথা নাড়ে, বলে, না, না, আমাকে ছেড়ে দাও!

লন খানিকক্ষণ রুষ্ট দৃষ্টিতে শু এবং রিফার দিকে তাকিয়েছিল, এবার মুখ বিকৃত করে ধমকে উঠে বলল, রিফা, তুমি পেয়েছটা কী? সবাই যদি তাদের অনুরন গোলক বের করতে পারে, তুমি পারবে না কেন?

ক্রিক নরম গলায় বলল,, রিফা, তুমিও বের কর, আমাদের খুব দেখার ইচ্ছে করছে আসলে তুমি কী রকম।

স্না কোনো কথা না বলে রিফার দিকে তাকিয়ে রইল। শু বলল, রিফা, রাজি হয়ে যাও। তোমার অনুভূতি যদি ভালো না লাগে সাথে সাথে অনুরন গোলকটি শরীরে ঢুকিয়ে দেব!

রিফা একটা নিশ্বাস ফেলে তার হাতটা এগিয়ে দিয়ে বলল, ঠিক আছে, বের কর। ব্যথা দিও না কিন্তু আমাকে।

স্না মাথা নেড়ে বলল, চিমটির মতো একটু ব্যথা পাবে তুমি। কিছু বোঝার আগেই তোমার অনুরন গোলক বের হয়ে আসবে।

স্না তার ধারালো চাকু দিয়ে সাবধানে এক চিলতে চামড়া চিরে রিফার গোলকটি বের করে আনে। রিফা দাতে দাঁত চেপে বসেছিল, এবারে সাবধানে বুকের ভিতর থেকে একটা নিশ্বাস বের করে দেয়। স্না জিজ্ঞেস করল, তোমার কেমন লাগছে রিফা।

বিফা মুখ তুলে তাকাল, বলল, একটু অন্যরকম লাগছে কিন্তু কী রকম বুঝতে পারছি।

রাগ? দুঃখ? আনন্দ?

না সেসব কিছু না। রিফা মাথা নাড়ল, একটু অন্যরকম।

কী রকম?

রিফা মুখ তুলে তাকিয়ে দুর্বলভাবে হাসার চেষ্টা করে বলল, খুব সুন্দর একটা গান শুনলে বুকের মাঝে যেরকম কাপুনি হয় সেরকম একটা কাঁপুনি হচ্ছে। এক রকমের উত্তেজনা!

উত্তেজনা?

হ্যাঁ। মনে হচ্ছে কিছু একটা কচকচ করে খেয়ে ফেলি!

শু আবার খিলখিল করে হেসে উঠে বলল, সব সময় তোমার কচকচ করে কিছু একটা খেতে ইচ্ছে করে। খাওয়া ছাড়াও যে পৃথিবীর অন্য কিছু থাকতে পারে তুমি জান?

রিফা লজ্জা পেয়ে একটু হাসল, বলল, কিছু একটা ভালো লাগলেই আমার কচকচ করে খেতে ইচ্ছে করে!

স্না রিফার অনুরন গোলকটি হাতের তালুতে ধরে রেখেছিল, এবারে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, রিফা, তোমার গোলকটি কি বাইরে রাখবে নাকি আবার তোমার শরীরে ঢুকিয়ে দেব?

থাকুক। বাইরে থাকুক। একটা রাত আমরা কাটাই অনুরন গোলক ছাড়া।

ক্রিক মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ কাল ভোরে আবার আমরা আগের মানুষ হয়ে যাব। ভয়ে ভয়ে থাকতে আমার বেশি ভালো লাগছে না।

শু ক্রিকের কথা শুনে আবার খিলখিল করে হাসতে শুরু করে।

.

পাঁচ জনের ছোট দলটি আগুনকে ঘিরে বসে নিচু গলায় গল্প করতে থাকে। প্রত্যেকটা মানুষের মাঝে একটা পরিবর্তন হয়েছে। তারা কেউ আর আগের মানুষ নেই, সবারই যেন একটা নতুন ব্যক্তিত্ব! কথা বলতে বলতে তারা হঠাৎ হঠাৎ চমকে উঠছিল, একে অন্যের দিকে অবাক হয়ে তাকাচ্ছিল! নিজেদের ভিতরেও তারা বিচিত্র সব অনুভূতির খোঁজ পেতে থাকে যেগুলোর অস্তিত্ব সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণাই ছিল না।

ছোট দলটির সবাই খুব ক্লান্ত–তবুও তাদের ঘুমোতে দেরি হয়। দীর্ঘ সময় তারা তাদের স্লিপিং ব্যাগে শুয়ে ছটফট করে একে একে সবাই ঘুমিয়ে পড়ে।

গভীর রাতে হঠাৎ রিফার ঘুম ভেঙে গেল, কিছু একটা নিয়ে তার মন বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। কিছু একটা তার করার ইচ্ছে করছে কিন্তু ঠিক বুঝতে পারছে না সেটা কী। রিফা দীর্ঘ সময় আগুনের দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর সে স্লিপিং ব্যাগ থেকে বের হয়ে আসে। আগুনের পাশে গুটিসুটি মেরে সবাই ঘুমোচ্ছে, সে তার মাঝে ইতস্তত হাঁটতে থাকে। এক পাশে তাদের ব্যাকপেকগুলো রাখা আছে, তাদের জামাকাপড় জুতো খাবারদাবার ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। তার পাশে তাদের অস্ত্রগুলো একটা কুড়াল, কয়েকটা ছোরা। হঠাৎ রিফার সমস্ত শরীরে এক ধরনের শিহরন বয়ে গেল। কী করতে চাইছে হঠাৎ করে সে বুঝতে পেরেছে। কোনো সন্দেহ নেই আর—সে জানে, তার সমস্ত ইন্দ্রিয় সমস্ত চেতনা সমস্ত অনুভূতি হঠাৎ করে কেন্দ্রীভূত হয়ে গেছে পায়ে পায়ে হেঁটে সে ধারালো কুড়ালটি হাতে তুলে নেয়। সে জানে ঘুমন্ত চার মানুষের বুক কেটে তাদের হৃৎপিণ্ড বের করে আনতে হবে। কচকচ করে কী খেতে হবে হঠাৎ করে মনে পড়েছে তার। অনুরন গোলক এতদিন তার চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল, হঠাৎ করে তার চেতনা উন্মুক্ত হয়ে গেছে। এখন আর তার কোনো দ্বিধা নেই। কোনো শঙ্কা নেই।

রিফা দু হাতে শক্ত করে কুড়ালটি ধরে ঘুমন্ত মানুষগুলোর দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। আগুনের আভায় তার অপূর্ব সুন্দর মুখটি চকচক করতে থাকে। সেখানে বিচিত্র একটা হাসি খেলা করছে।