নদীতে আর সমুদ্রে যতরকম মাছ পাওয়া যায় তাহার মধ্যে অদ্ভুত মাছের কোন অভাব নাই। কাহারও চেহারা অদ্ভুত, কাহারও চালচলন অদ্ভুত, কাহারও আহার বিহার বাসাবাড়ি সবই অদ্ভুত। বাস্তবিক ইহার মধ্যে কোন্টার কথা যে বলিব আর কোন্টা যে বাদ দিব তাহা ঠিক করাই কঠিন।
প্রথমে চারিচক্ষু মাছের কথা বলি। মাকড়সার নাকি আট দশটা চোখ থাকে কিন্তু পোকামাকড় ছাড়া আর কোন প্রাণীর যে দুইটার বেশি চোখ হয় একথা আর শুনিয়াছ কি? কোন কোন জানোয়ারের দেখা যায় কপালের কাছে একটা করিয়া চোখের মতো থাকে— কিন্তু ‘চোখের মতো’ হইলেও সেটা চোখ নয়, তাহাতে দেখার কাজ চলে না। কিন্তু এই মাছের যে দু-জোড়া চোখ, তাহার প্রত্যেকটিই সত্যিকারের চোখ। দুই দুইটা চোখ একসঙ্গে উপর-নীচ করিয়া বসান; মাছ যখন জলে ভাসে তখন উপরের একজোড়া চোখ থাকে জলের বাহিরে, আর নীচের জোড়া জলের তলায়। যে জোড়া জলের উপরে থাকে তাহার গঠন ঠিক সাধারণ মাছের মতো নয়— তাহাতে জলের নীচে দেখিবার সুবিধা হয় না। আর নীচের জোড়া ঠিক সাধারণমত চোখ, তাহাতেও জলের বাহিরের কোন জিনিস স্পষ্ট দেখা যায় না। জলের ভিতর ও বাহির একসঙ্গে দেখিবার বিশেষ কোন দরকার ইহার ছিল কিনা জানি না, কিন্তু ব্যবস্থাটায় যে কাজের কতকটা সুবিধা হয় তাহা বেশ বুঝিতে পারা যায়। একরকম চশমা আছে তাহাকে ‘বাইফোক্যাল্’ বলে— সেই চশমার উপরের আধখানা কাচ, তাহাতে দূরের জিনিস দেখিবার সুবিধা হয়, আর নীচের আধখানা আরেকরকম— তাহাতে পড়াশুনার কাজ চলে। এই মাছের চোখটা ঠিক যেন ‘বাইফোক্যাল’ চোখ।
চোখের কথা বলিতে গেলে আরেকটি মাছের কথাও বলিতে হয়। সে মাছের একদিকে দুইটা চোখ, আর একদিকে চোখ নাই। এরকম একদিক কানা হইবার অর্থ কি জান? মাছটার স্বভাব এই যে সে কাদার মধ্যে কাৎ হইয়া শুইয়া থাকে। যেদিকটা কাদার মধ্যে অন্ধকারে পড়িয়া থাকে, সেদিকটায় চোখ থাকা না থাকা সমান কথা— তাই তাহার দুইটা চোখই থাকে মুখের একপাশে— যে পাশটা আকাশের দিকে ফিরান সেই পাশে।
আফ্রিকার নীল নদীতে একরকম মাছ আছে সে চিৎ হইয়া চলে। চলার এরকম অদ্ভুত ভঙ্গী হইবার একমাত্র কারণ যাহা দেখা যায় তাহা এই যে ইহাদের পেটের চাইতে পিঠের রংটা অনেক বেশি সাদা। সাদা পিঠটা আলোর দিকে থাকিলে চক্চক্ করে— তাহাতে মাছটার গা-ঢাকা দিয়া থাকিবার সুবিধা হয় না। তাই সে কালো পেটটাকে উপর দিকে ধরিয়া আপনাকে জলের মধ্যে বেশ বেমালুম করিয়া রাখে।
জানোয়ারের মধ্যে মানুষ ক্যাঙারু প্রভৃতি জন্তু যেমন খাড়া হইয়া চলে, মাছেদের মধ্যেও এমন এক একজন আছেন যাঁহারা মানুষের মতো খাড়া হইয়া চলেন। বিশেষত একজন আছেন, তিনি সমুদ্রে থাকেন, তিনি কেবল খাড়া হইয়া থাকিয়াই সন্তুষ্ট হন না— তাঁহার মাথাটি আবার নীচের দিকে রাখা চাই। এই মাছের চেহারিটও অদ্ভুত ছুঁচাল রকমের, তাই ইংরাজিতে ইহার নাম Needle fish বা ছুঁচ মাছ। সমুদ্রে একরকম চাঁদা মাছ আছে, তাহারা রাগিলে বা ভয় পাইলে পেটটাকে ফুটবলের মতো ফুলাইয়া হঠাৎ চিৎ হইয়া জলের উপর ভাসিয়া উঠে। তখন ফোলা পেটটি জলের উপর বাহির হইয়া ভারি অদ্ভুত দেখায়। কোন কোন চাঁদা মাছের গায়ে আঁশের বদলে কাঁটা বসান থাকে— রাগের সময় সেগুলি শজারুর কাঁটার মতো খাড়া হইয়া উঠে।
চেহারার কথা যদি বল, মাছের চেহারা যে কত অদ্ভুতরকমের হইতে পারে তাহার কিছু কিছু নমুনা দেওয়া হইতেছে। ‘থলে-গলা চাবুক-লেজ’ মাছের গলায় লম্বা থলি আর ল্যাজটি চাবুকের মতো; বঁড়শিবাজ মাছের নাকের উপর ছড়ি, তাহার আগায় টোপের মতো নোলক, আর যার যত বড় গা তত বড় হাঁ; শয়তান মাছের চেহারাটা মুখোশপরা সঙের মতো। আমেরিকার রাক্ষুসে মাছের সাংঘাতিক দাঁতের কামড়ে গোরু ঘোড়া পর্যন্ত প্রাণ হারায়— তাহারও চেহারাটি নেহাৎ ভদ্রমতন নয়।
কিন্তু বাস্তবিক উদ্ভট বিদ্ঘুটে মাছের খোঁজ করিতে হইলে সমুদ্রের গভীর জলে যেসব মাছ থাকে, তাহাদের সংবাদ লইতে হয়। সেদিন এইরূপ কতকগুলি মাছের চমৎকার বর্ণনা পড়িয়াছি! তাহার দু-একটি নমুনা শুন। একটি মাছ, তাহার কপালের উপর দুইটা শিং— সেই শিঙের আগায় তাহার চোখ। শিং দুটাকে সে ইচ্ছামত এদিক ওদিক ফিরাইতে পারে। তাহার গায়ে আবার সারি সারি আলো বসান— গভীর অন্ধকার সমুদ্রে সেগুলি আপনা হইতে জ্বলিতে থাকে। আর একটা মাছ, তাহার মুখে লম্বা দাড়ি— দেখিতে অনেকটা গাছের পাতার মতো; তাহার উপর মুখভরা বড় বড় গজালের মতো দাঁত। অন্ধকারে সমস্তটা দাড়ি জ্বলিতে থাকে। আরেকটি মাছ তাহার চোখ দুইটা ঠোঁটের কোণায়, মনে হয় হাঁ করিলেই চোখ দুইটা গিলিয়া যাইবে। ইহার নাকটা জুতার গোড়ালির মতো উঁচু আর হাঁ করিলেই মুখের ভিতরে আলো জ্বলিয়া উঠে— শিকার ধরিবার ভারি সুবিধা। আর একটি মাছ আছে, তাহার সমস্ত শরীরটি লাল-কালো চিত্রবিচিত্র করা। তাহার চোখ দুইটা এত বড় যে হঠাৎ দেখিলে মনে হয় যে সমস্ত মাথাভরাই চোখ।
ইহারা সকলেই প্রায় শিকারী মাছ। নিজেদের বাতি দিয়া ইহারা শিকার খোঁজে। কেহ কেহ সমুদ্রের নীচে বাতি জ্বালাইয়া চুপচাপ বসিয়া থাকে; সেই বাতি দেখিয়া যেসব শিকার তামাসা দেখিতে আসে, তাহাদের খপ্ করিয়া গিলিয়া খায়। কোন কোন মাছ আছে, তাহারা শিকারকে বাগাইবার জন্য নানারকম অস্ত্রকৌশল খাটাইয়া থাকে। কাহারও বিষাক্ত ল্যাজ চাবুকের মতো শিকারের ঘাড়ে আসিয়া পড়ে, কেহ বিদ্যুৎ চালাইয়া শিকারকে আড়ষ্ট করিয়া ফেলে, কেহ জোঁকের মতো তাহার রক্ত চুষিয়া ধরে আর কেহ পিচকারি মারিয়া ডাঙার শিকারকে জলে পাড়িয়া আনে। টিকটিকির শিকার ধরা দেখিয়াছ? কোন কোন মাছ আছে তাহারাও ঠিক সেইরকম কায়দায় শিকার ধরে। আস্তে আস্তে চুপি চুপি শিকারের পিছনে গিয়া হঠাৎ, টিকটিকির জিভের মতো, তাহাদের মুখটা সরু লম্বা হইয়া শিকারের ঘাড়ে ছুটিয়া পড়ে।
এইবারে একটা মাছের কথা বলিব আমরা তাহার নাম দিয়াছি গেছো মাছ। কোন কোন মাছ আছে, তাহারা জলের বাহিরে আসিয়াও অনেকক্ষণ পর্যন্ত বাঁচিতে পারে। কই মাছ যে অনেকদূর পর্যন্ত মাটির উপর ‘কাতরাইয়া’ চলিতে পারে, তাহা বোধহয় সকলেই দেখিয়াছি। কিন্তু মাছ যে আবার সখ করিয়া জল ছাড়িয়া ডাঙ্গায় ওঠে আর রীতিমত গাছে চড়িতে পারে, ইহা চোখে না দেখিলে বিশ্বাস করা কঠিন। এই মাছ আফ্রিকাতেই বেশি পাওয়া যায়। ইহার দুপাশের ডানা দুইটি দেখিতে কতকটা আঙুল-জোড়া পায়ের মতো। সেই ডানার উপর ভর করিয়া মাছগুলি অনায়াসে ডাঙায় উঠিয়া গাছে চড়িয়া বসে। ইহাদের মুখ প্রায়ই ব্যাঙের মতো কদাকার হয়— চোখ দুটিও সেইরকম ড্যাব্ডেবে। এ মাছ খাইতে এমন বিস্বাদ যে মানুষ ত দূরের কথা— ডাঙার কোন জন্তু বা আকাশের পাখিরা পর্যন্ত ইহাকে ছোঁয় না। কিন্তু জলের বড় বড় মাছগুলি ইহাদের দেখিলে টপাটপ্ খাইয়া ফেলে। সেইজন্য ইহারা জল ছাড়িয়া ডাঙায় উঠিবার জন্য এক-এক সময়ে এমন ব্যস্ত হইয়া উঠে।
মাছের বিদ্যার কথা অনেক বলা হইল— এইবার আরেকটি বিদ্যার কথা বলিয়াই শেষ করি। সেটি আর কিছু নয়— সংগীতবিদ্যা! অবশ্য সংগীত বলিতে মনে করিও না যে তাহারা রীতিমত সা-রে-গা-মা সুর করিয়া রাগ-রাগিণীর চর্চা করে। কোন কোন মাছ আছে তাহারা একটু আধটু শব্দ করিতে জানে। কেহ ইঁদুরের মতো কুট্কুট্ শব্দ করে, কেহ অদ্ভুতরকম ঘঁৎ ঘঁৎ শব্দ করে, আর কেহ বা ডুর্ ডুর্ করিয়া ঢাকের মতো আওয়াজ করে। কিন্তু সকলের চাইতে ওস্তাদ যে মাছ, সে দলেবলে সমুদ্রের তীরে পড়িয়া মোটা কান্নার মতো একরকম অদ্ভুত সুর করিতে থাকে। খানিক দূর হইতে শুনিলে হঠাৎ মনে হয় যেন মানুষের কোলাহলের সুর।