সপ্তম অধ্যায়
জয় জয় শ্রীচৈতন্য জয় সীতানাথ।
জয় নিত্যানন্দরাম ভক্তগণ সাথ।।
এবে শুন ব্রহ্ম হরিদাসের বিবরণ।
সংক্ষেপেতে কিছু মুই করিমু বর্ণন।।
শ্রীধাম বৃন্দাবনে কৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান।
নরলীলা কৈলা করি গোপ অভিমান।।
একদিন গোষ্ঠলীলায় শ্রীনন্দনন্দন।
গোপাল উচ্ছিষ্ট ফল করিলা ভোজন।।
চতুর্মুখ ব্রহ্মা দেখি সেই ব্যবহার।
মনে ভাবে ইহো নহে বিশ্বমূলাধার।।
ইহার প্রকৃতি দেখি মনুষ্য আকার।
ঈশ্বর হইলে কাহে হৈবে ভ্রষ্টাচার।।
এত চিন্তি ধ্যানযোগে দেখে দিব্য নেত্রে।
স্বয়ং কৃষ্ণচন্দ্র বিরাজিত ব্রজক্ষেত্রে।।
পুন দেখে কৃষ্ণ করে উচ্ছিষ্ট ভোজন।
ভাবে ইহোঁ কৃষ্ণ নহে অন্য কোনজন।।
কৃষ্ণ মায়ায় মোহ হঞা শ্রীচতুরানন।
মায়াতে গোপাল বৎসে করিলা হরণ।
মূল নারায়ণ জ্ঞাত হঞা ব্রহ্মার কার্য্য।
করিলা অপূর্ব্ব লীলা রামের আশ্চর্য্য।।
আত্মশক্তি বিস্তারিয়া কৃষ্ণ বহুরূপে।
গোবৎস গোপাল হৈলা পূৰ্ব্ব অনুরূপে।।
পূৰ্ব্বমতে লীলা কৈলা যোগী অগোচর।
ক্রমেতে মনুষ্যমানের হৈল সম্বৎসর।।
ইতিমধ্যে ব্রহ্মা আসি অপূৰ্ব্ব দেখিলা।
পূর্ব্বমত করে কৃষ্ণ গোচারণ লীলা।।
ব্রহ্মাভাবে বৎস বালক পাইল কোথায়।
মুঞিয়া রাখিয়াছিনু আছয়ে তথায়।।
তবে জ্ঞাননেত্রে দেখে শ্রীচতুরানন।
বৎস গোপালরূপ কৃষ্ণ করিলা ধারণ।।
ব্রহ্মা ভাবে মুঞি মূঢ় কৃষ্ণ ন চিনি।
গোবৎসাদি চুরি করি পাতকে ডুবিনু।।
অপরাধ ক্ষমা করাইমু স্তব করি।
এত চিন্তি আইলা বিধি যাঁহা স্বয়ং হরি।।
কৃষ্ণ আত্ম তত্ত্ব জানাইতে বিধাতারে।
অলৌকিক পুরি সৃষ্টি কৈলা যারা দ্বারে।।
দিব্য সিংহাসনে বসি করিলা স্মরণ।
ব্রহ্মাবিষ্ণু পঞ্চানন আইলা অগণন।।
মহাবিষ্ণুর গণ আইলা অনন্ত বদন।
সভে আসি কৃষ্ণপদে লইলা স্মরণ।।
চতুর্মুখ প্রথম দ্বারেতে উপনীত।
সেই দ্বার অষ্টানন ব্রহ্মা সুরক্ষিত।।
চতুর্মুখে দেখি হাসি করে অষ্টানন।
কে তুমি যাইবা কতি কহ বিবরণ।।
চতুর্মুখ কহে মুঞি ব্ৰহ্মা নাম ধরি।
গোপরূপী কৃষ্ণে দেখিবারে বাঞ্ছা করি।।
তাঁহা শুনি উচ্চ হাসি কহে অষ্টানন।
চতুর্মুখ ব্ৰহ্মা আছে না শুনি কখন।।
স্বয়ং নারায়ণের সৃষ্টির নাহি ওর।
মুঞি ক্ষুদ্র ব্রহ্মা জ্ঞান আজি গেল মোর।।
আশ্চৰ্য্য শুনিয়া চতুর্মুখ ভাবে মনে।
অষ্টমুখ ব্ৰহ্মা আছে কেবা ইহা জানে।।
তবে ব্রহ্মা শুষ্ক মুখে কহে করযোড়ে।
কৃষ্ণ দর্শন করাইয়া ধন্য কর মোরে।।
অষ্টমুখ কহে মুঞি হঙ ক্ষুদ্ৰ ব্ৰহ্মা।
আর বহুদ্বারে আছে মহৎ বিশ্বকৰ্ম্মা।।
দ্বার ছাড়ি দিতে তুহুঁ করিছ মিনতি।
কৃষ্ণ আজ্ঞা বিনু কাহার নাহিক শকতি।।
যাইতে কৃষ্ণান্তঃপুরে দ্বিজের বাধা নাঞি।
আসিব সন্দেশ সহ রহ এই ঠাঞি।।
কহিতে কহিতে আইলা অনন্ত বদন।
কৃষ্ণের মহিমা সদা করয়ে কীৰ্ত্তন।।
তান অলৌকিক রূপ দেখি কমলজ।
দন্ডবত করি লৈলা চরণের রজ।।
শ্রীঅনন্তদেব কহে তুহুঁ কোন জন।
বিধি কহে মুঞি ব্ৰহ্মা চতুর আনন।।
আসিআছি করিতে শ্রীকৃষ্ণ দরশন।
মো অধীনে লঞা যাহ করি কৃপেক্ষণ।।
শ্রীঅনন্ত কহে তুমি দেহ পরিচয়।
চতুর্মুখ ব্রহ্মার সংখ্যা কে করে নির্ণয়।।
বিধি ভাবে কিমাশ্চৰ্য্য বিধাতাই অসংখ্যা।
মুঞি ক্ষুদ্র করিতে চাঙ কৃষ্ণতত্ত্বের সংখ্যা।।
এবে কিবা পরিচয়ে পাঙ পরিত্রাণ।
ভাবিতে ভাবিতে ব্ৰহ্মা হৈলা হতজ্ঞান।।
কৃষ্ণ কৃপাবলে ব্রহ্মা পাইয়া চেতন।
কহে সনৎ কুমারাদি মোর পুত্রগণ।।
শ্রীঅনন্ত কহে ভাল চিনিনু বিশেষ।
শ্রীগোলোকে দেখি আছে শুদ্ধ যোগী বেশ।।
চতুর্মুর্খ ভাবে মুঞি মহা ভাগ্যবান্।
কোটি পুণ্যে লভ্য হৈল এহেন সন্তান।।
যৈছে সাগর হৈতে হৈল শুধাংশু উৎপন্ন।
তৈছে আমা হৈতে ঋষিগণ অবতীর্ণ।
কৃষ্ণদাসের অবিচিন্ত্য শক্তির প্রভাবে।
মৃত্যুসম লজ্জা হৈতে মুক্ত হৈনু এবে।।
তবে দুই কর যুড়ি কহে চতুর্মুখ।
কৃপা করি দেখাহ দুর্লভ চন্দ্ৰমুখ।
শ্রীঅনন্ত কহে শ্রীমুখের আজ্ঞা বিনে।
কার সাধ্য আছে যাইব কৃষ্ণলীলা স্থানে।।
এত কহি তেঁহো যাঞা শ্রীগোবিন্দ পাশে।
কহে সনৎকুমার পিতা আছে দ্বারদেশে।।
শ্রীগোবিন্দ কহেন আনহ তবে হেথা।
এই ক্ষুদ্র ব্রহ্মান্ডের সেই হয় ধাতা।।
শ্রীঅনন্ত ভাবে কৃষ্ণদাসের পিতা ধন্য।
সাধুপুত্র প্রভাবে বিরিঞ্চি হৈলা মান্য।।
তবে শ্রীঅনন্ত পুন ঝাট তাঁহা আইলা।
দ্বিতীয় দ্বারেতে ব্রহ্মায় সঙ্গে করি গেলা।।
তাহে দ্বারী হয় ব্রহ্মা ষোড়শ আনন।
দেখি চতুর্মুখ কহে এই কোন জন।।
সঙ্কর্ষণ কহে ইহোঁ হয় এক ব্ৰহ্মা।
মহাভাগবত কৃষ্ণের দ্বারী বিশ্বকৰ্ম্মা।।
এই মত আছে আর দ্বার শত শত।
ক্রমে বহুমুখী ব্রহ্মা দ্বারিকে নিযুক্ত।।
মূল শ্রীমন্নারায়ণের সৃষ্টির নাহি পার।
মো হঁতে প্রধান কত তাঁর পরিকর।।
কহিতে শুনিতে বহু দ্বার উত্তরিলা।
গোবিন্দ-চিন্ময়ী সভায় উপনীত হৈলা।।
সভা মধ্যে দেখে ব্রহ্মা শিব অগণন।
কত বিঘ্নরাজ বিষ্ণু মহাবিষ্ণুগণ।।
দেবর্ষি গন্ধৰ্ব্ব কত শত ষড়ানন।
শতাব্বুদ ইন্দ্র আর শ্রীঅনন্তগণ।।
কোটি কোটি চন্দ্র সূর্য্য কে করে গণন।
মূর্ত্তিমান বেদবৃন্দ করয়ে স্তবন।।
অলৌকিক কৃষ্ণতেজ অতি চমৎকার।
কোটি কোটি সূর্য্যপ্রভা করয়ে ধিক্কার।।
নবীন নীরদবর্ণ পদ্ম সূর্য্যাকার।
কৃষ্ণতেজে লক্ষ নাহি হয় কৃষ্ণাকার।।
কোটি কোটি মহা মরকত মণিশৈল।
সমুদিতে নহে কৃষ্ণতেজ সমতুল।।
পরমাহ্লাদিনী শক্তি কৃষ্ণ-বামপাশে।
অলৌকিক তেজ তাঁর ত্রিলোক প্রকাশে।।
শত কোটি স্বর্ণপদ্ম চন্দ্ৰতেজ হৈতে।
উজ্জ্বল রাধাঙ্গ তেজে কৃষ্ণ মন মাতে।।
কত শত নব গোরোচনা শৈলযূতি।
ধিক্কার করিয়া শোভে রাধা অঙ্গ ভাতি।।
ললিতাদি সখীগণ চৌদিগেতে ঘেরা।
দুহো প্রেম আস্বাদয়ে হঞা সেবাপরা।।
সভা দেখি কম্পিত হইয়া চতুৰ্বত্ৰ।
রাধাকৃষ্ণ নাহি দেখে দিব্য তেজ মাত্র।।
শ্রীঅনন্তে স্তব করি কহে পিতামহ।
কাঁহা শ্রীগোবিন্দ মোরে দর্শন করাহ।।
শেষ কহে হৈলা কৃষ্ণ-দর্শনে বঞ্চিত।
গোবৎস চৌর্য্যাপরাধ নহে অকিঞ্চিত।।
শুনি বিধি মহা অপরাধ স্বীকারিয়া।
কৃষ্ণে বহু স্তুতি কৈলা অশ্রুমুখ হঞা।।
ভক্ত প্রিয় শ্রীমাধব দয়ার সাগর।
তুষ্ট হৈলা শুনি ব্ৰহ্ম-স্তুতি বহুতর।।
তবে ব্রহ্মায় দেখাইয়া নিজ নিত্যমূৰ্ত্তি।
করে গো-হরণ পাপ তোহেঁ হৈল স্ফূৰ্ত্তি।।
কলিযুগে যবনত্ব হইবে তোমার।
শ্ৰীকৃষ্ণচৈতন্য দেখি পাইবা নিস্তার।।
কৃষ্ণরূপ দেখি ব্রহ্মা চমৎকার হৈলা।
আজ্ঞা শুনি প্রেমানন্দ-সাগরে ডুবিলা।।
রাধা শ্যামে শতক অষ্ট অঙ্গে প্রণমিয়া।
নিজ ধামে গেলা বিধি কৃষ্ণ আজ্ঞা পাঞা।।
তবে কলিযুগাগত দেখি পদ্মযোনি।
অবনীতে অবতীর্ণ হইলা আপনি।।
ত্রয়োদশ শত দ্বিসপ্ততি শকমিতে।
প্রকট হইলা ব্রহ্মা বুড়ন গ্রামেতে।।
কেহ কহে হরিদাসে প্রহ্লাদাবতার।
প্রভু কহে দোঁহে মিলি হয় একাকার।।
জীব নিস্তারিতে মুখ্য তান পরকাশ।
খিয়াতি যবন মাত্র নহে তদাভাস।।
যবন পালিত বিভু দুগ্ধ মাত্ৰ খায়।
দিনে দিনে বৃদ্ধি হয় কোটি ইন্দু প্রায়।।
ব্রহ্ম হরিদাস লোকে জাতিস্মর হয়।
পুরব সংস্কারে সদা হরিনাম লয়।।
পঞ্চম বৎসরে শিশু গৃহত্যাগ কৈলা।
বহুস্থান ভ্ৰমিয়া শ্ৰীশান্তিপুরে আইলা।।
শ্রীঅদ্বৈত স্থানে আসি হৈলা উদয়।
অজানুলম্বিত বাহু তেজঃপুঞ্জ কায়।
শ্রীঅদ্বৈত প্রভু হয় সৰ্ব্ব জ্ঞান খনি।
দেখি সেই নরাকৃতি বিধাতারে চিনি।।
নরলীলা অনুসারে কহে হরিদাসে।
তুমি কোন জাতি ইহা আইলা কিবা আশে।।
ব্রহ্ম হরিদাস কহে মুঞি ম্লেচ্ছাধম।
আসিআছো তুয়া পদ করিতে দর্শন।।
প্রভু করে ইহা রহি করহ বিশ্রাম।
ধৰ্ম্ম শাস্ত্র পড় সিদ্ধ হৈব মনস্কাম।।
হরিদাস কহে ভাগ্যে দয়াসিন্ধু পাইনু।
ইহার হিল্লোলে মন প্রাণ জুড়াইমু।।
তবে হরিদাস প্রভু অদ্বৈতের স্থানে।
ব্যাকরণ সাহিত্যাদি পড়িলা যতনে।।
ক্রমে দর্শনাদি পড়ি হইল ব্যুৎপত্তি।
শ্রীমদ্ভাগবত পড়ি পাইলা শুদ্ধ ভক্তি।।
শ্রুতিধর হরিদাসের মহিমা অপার।
শ্লোক অর্থ কৈল তার কন্ঠ মণিহার।।
এক দিন হরিদাস বিরলে বসিয়া।
প্ৰভু স্থানে কহে ভক্তি বিনয় করিয়া।।
জানিলাঙ তুহু সাক্ষাৎ ঈশ্বরাবতার।
তোমা বিনু অধম তারণ কেবা আর।।
শ্রীঅদ্বৈতচন্দ্র তার দৈন্য উক্তি শুনি।
কহে শুন বৎস ধৰ্ম্মশাস্ত্রসিদ্ধ বাণী।।
কেবা ছোট কেবা বড় ধৈর্য্য নাহি জানি।
সাধু আচরণ যার তারে শ্রেষ্ঠ মানি।।
অষ্টবিধ ভক্তি যদি ম্লেচ্ছে উপজয়।
সেই জাতি লোপ হঞা দ্বিজাদেশ হয়।।
যেই কৃষ্ণ ভজে সেই হয় সৰ্ব্বোত্তম।
কৃষ্ণ বহির্মুখ যেই সেই নরাধম।।
গোপী ভাব বিনু না পায় শ্রীকৃষ্ণ চরণ।
সেই ভাবে পায় প্রেম অমূল্য রতন।।
হরিদাস কহে অবিচিন্ত্য গোপীভাব।
কোটি জন্মের পুণ্যে জীবে না হয় আবির্ভাব।।
সহজ উপায় প্রভু কহ প্রকাশিয়া।
কৈছে কৃষ্ণ প্রাপ্তি হই মায়া পার হঞা।।
প্রভু কহে তোর কিছু নাহি অগোচর।
তথাপি করিলা মোরে আচার্য্য স্বীকার।।
ধর্ম্ম প্রবর্ত্তন হেতু লহ হরিনাম।
নাম ব্রহ্ম প্রচারিয়া জীবে কর ত্রাণ।।
যৈছে ভগবানের শক্তি অনন্ত চিন্ময়।
তৈছে নাম ব্রহ্মের শক্তি নিত্য সিদ্ধ হয়।।
নামাভাসে জীব মাত্রের ত্রিতাপ না রয়।
নাম উচ্চারণে মায়া বন্ধন খণ্ডয়।।
নাম চিন্তামণি কৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান্।
ব্রহ্মান্ডে সদ্বস্তু নাঞি নামের সমান।
নামে নিষ্ঠা হৈলে হয় প্রেম উদ্দীপন।
অবিশ্রান্ত নাম জপে পায় প্রেম ধন।
প্রেম কল্প বৃক্ষের ফল স্বয়ং ভগবান।
বৃক্ষ স্থায়ী হৈলে ফল হয় বিদ্যমান।।
নামী হৈতে নাম বড় কৃষ্ণ উক্তি হয়।
সর্ব্ব অপরাধ নাম গ্রহণে খণ্ডয়।।
অতএব নাম ব্রহ্ম গ্রহণ উত্তম।
নামে রুচি হৈলে হয় অভীষ্ট পূরণ।।
শ্রীবৈষ্ণব গুরু উপদেশ নাহি যার।
কোটি যুগে কৃষ্ণ সিদ্ধি নাহি হয় তার।।
শ্রীবৈষ্ণব ধৰ্ম্ম হয় সর্ব ধর্ম সার।
তার মধ্যে নিরাশ্রমীর মহিমা অপার।।
ভিক্ষুক আশ্রমে সৰ্ব্বত্যাগের লক্ষণ।
ডোর কৌপীনাদি ধরিবেক দ্বিজগণ।।
আনে যদি হয় ঐছে বৈরাগ্যের উদয়।
তাহে যদি ভাগ্যে কৃষ্ণ ভক্তি উপজয়।।
তবে সেহ করিবেক তকরণ।
অযত্নতা বেশ মধ্যে তাহার গণন।।
এ হেন বিশুদ্ধ চিহ্ন যে জন ধরিবে।
রাধা কৃষ্ণ পদ সেই অবশ্য পাইবে।।
এত কহি তার মস্তকাদি মুণ্ডাইয়া।
তিলক তুলসী মালা দিল পরাইয়া।।
কটিতে কৌপীন ডোর দিলেন বান্ধিয়া।
নাম দিলা প্রভু শক্তি সঞ্চারিয়া।।
গঙ্গার গহ্বরে পাঞা নাম চিন্তামণি।
প্রেমেতে মাতিলা শ্রীবৈষ্ণব চূড়ামণি।।
সংজ্ঞা পাঞা অষ্টঅঙ্গে দন্ডবৎ কৈলা।
কৃষ্ণ প্রাপ্তিরস্তু বলি প্রভু বর দিলা।।
প্রভু কহে তোর নাম ব্রহ্মহরিদাস।
হরিদাস কহে মুঞি হঙ তব দাস।।
তবে তিহোঁ দৈন্য বেশ করিয়া ধারণ।
তিন লক্ষ নাম জপের করিলা নিয়ম।
নাম সমাপিয়া করে ধর্ম্মের প্রচার।
অলৌকিক কার্য্য তাঁর লোকে চমৎকার।।
এক দিন শুন এক আশ্চর্য কথন।
ব্রহ্মহরিদাস করে নাম সংকীৰ্ত্তন।।
হেন কালে আসি এক তর্কচূড়ামণি।
কহে এই বেটা বাউল হৈল অনুমানি।।
তাহা শুনি কহে সুপন্ডিত কৃষ্ণদাস।
নাম প্রেমোন্মত্ত ইহার নাহি দুঃখাভাস।।
সচিন্ময়ী সরস্বতী ইহার জিহ্বায়।
অবিশ্রান্ত হরিনাম স্ফুরণ করায়।।
ইহাঁর হৃদয়ে সর্ব্বশাস্ত্র অধিষ্ঠান।
গুরু আজ্ঞাক্রমে ব্রহ্মহরিদাস নাম।।
হেনকালে হরিদাসের নাম পূর্ণ হৈল।
সগৰ্ব্বেতে চূড়ামণি তারে প্রশ্ন কৈল।।
ব্রহ্মের সাকার আর নিরাকার কয়।
ইথে সত্য অনাদি কারণ কেবা হয়।।
সৃষ্টি কাহে করে সেই ব্রহ্ম পরাৎপর।
সেই সৃষ্ট হয় আবার বহুত প্রকার।।
সুখ দুঃখ তারতম্য জীবে দেখি কাছে।
ঈশ্বরের কর্তৃত্ব হেতু দোষ ব্যাপে তাহে।।
শুনি হরিদাস দৈন্যে কহে মিষ্টবাণী।
কহিবারে চাঙ কিছু মুঞি ক্ষুদ্রপ্রাণী।।
কৃষ্ণদাস পন্ডিত জীউ রহ মধ্যবর্তী।
দয়া করি শুনহ ভূসুর চক্রবর্ত্তী।।
সম্বিৎ আনন্দ ব্রহ্ম অনাদি ঈশ্বর।
নিত্য সিদ্ধ সাকার তিহোঁ শাস্ত্রে পরচার।।
তান অঙ্গ কান্তি সর্ব্বব্যাপী নিরাকার।
যৈছে এক সূর্য তেজ ব্যাপী চরাচর।।
পরব্রহ্মের নিত্যরূপ জ্ঞানী নাহি জানে।
তেঞি তদঙ্গ কান্তিতে ব্রহ্মা বলি মানে।।
ভাগ্যে ভক্তজনে দেখে নিত্য সিদ্ধ মূৰ্ত্তি।
শুদ্ধভক্তি বেদ্য সেরূপ আনে নাহি স্ফূর্ত্তি।।
যৈছে সৰ্ব্বশক্তিমান ব্ৰহ্ম নিত্য যায়।
সৃষ্টির নিত্বত্ত্ব তৈছে সর্বশাস্ত্রে কয়।।
প্রকটাপ্রকট তার কালেতে ঘটয়।
ঈশ্বরের নিয়ম ইহা নিত্যসিদ্ধ হয়।।
মহাপ্রলয়ান্তে যৈছে সৃষ্টির পতন।
সংক্ষেপে তাহার সূত্র করি বিজ্ঞাপন।।
নিত্যানন্দ আস্বাদন করে শ্রীচৈতন্য।
সর্ব্ব কারণের কারণ সেই অগ্রগণ্য।।
জ্ঞান আলোচনা মাত্র যাহা পাঞা জ্ঞান।
সৃষ্টি করে বহুবিধা বেদেতে প্ৰমাণ।।
স্বতন্ত্র্য অবিদ্যা করে স্বেচ্ছামত কার্য্য।
সেই হেতু নিব্বিকার ব্রহ্ম বেদে ধার্য্য।।
মায়াবৃত জীব আত্মকৰ্ম্ম অনুসারে।
নানা যোনি ভ্রমি সুখ দুঃখ ভোগ করে।।
ইথে পরব্রহ্মে না হয় বিষমতা দোষ।
বিচারিয়া দেখ সত্য না করিও রোষ।।
এ সত্য সিদ্ধান্ত শুনি দ্বিজ চমৎকার।
শ্রীঅদ্বৈত আইলা তাঁহা কোটি সূর্য্যাকার।।
তেজঃপুত্র কলেবর দেখি দ্বিজবর।
প্রভুকে প্রণাম কৈলা করি যোড় কর।।
প্রভু কহে কাহে দৈন্য কর মহাশয়।
দ্বিজ কহে প্রভু তব পাইনু পরিচয়।।
প্রভু কহে মুঞি দীন নাহি কিছু শক্তি।
দ্বিজ কহে তুহুঁ পাপহন্তা বিশ্বপতি।।
দয়ামৃতসিন্ধু প্রভুর দয়া উপজিল।
শক্তি সঞ্চারিয়া তারে কৃষ্ণমন্ত্র দিল।।
অষ্ট অঙ্গে প্রণমিলা শ্ৰীযদুনন্দন।
প্রভু কহে লভ্য হউ কৃষ্ণ প্রেমধন।।
শ্রীযদুনন্দনাচার্য্য প্রভুর এক শাখা।
তর্কচূড়ামণি আখ্যা সৰ্ব্বস্থানে ব্যাখ্যা।।
সঙ্গীতে গন্ধৰ্ব্ব সম যার অধিকার।
প্রভুর কৃপায় পাইলা ভক্তিতত্ত্ব সার।।
ব্রহ্মহরিদাস স্বামীর অলৌকিক শক্তি।
হরিনাম জপি পাইলা শুদ্ধ প্রেমভক্তি।।
প্রতিদিন তিন লক্ষ হরিনাম করে।
মননে জিহ্বায় জপে আর উচ্চৈঃস্বরে।।
তবে শ্রীমহাপ্রসাদ করিলা গ্রহণ।
প্রভু মুখে কৃষ্ণতত্ত্ব করে আস্বাদন।।
হরিদাসের সদাচারের সদা স্মৃতি যার।
অবশ্য কৃষ্ণ ভজনে মতি হয় তার।।
ব্রহ্ম হরিদাস ঠাকুর দয়ার ভাণ্ডার।
তাঁহার চরণে মোর কোটি নমস্কার।।
শ্রীচৈতন্য শ্রীঅদ্বৈত পদে যার আশ।
নাগর ঈশান কহে অদ্বৈত-প্ৰকাশ।।
ইতি শ্রীঅদ্বৈত প্রকাশে সপ্তমোহধ্যায়ঃ।