ষষ্ঠ অধ্যায়
জয় জয় শ্রীচৈতন্য জয় সীতানাথ।
জয় নিত্যানন্দরাম ভক্তগণ সাথ।।
এবে কহি শুনহ অপূর্ব্ব বিবরণ।
শ্রীঅদ্বৈত নাম প্রভুর হৈল যে কারণ।।
এক দ্বিজ দিগ্বিজয়ী বহু দেশ জিনি।
শান্তিপুরে উপনীত হইলা আপনি।।
বেদ-পঞ্চানন আখ্যা প্রভুর শুনিঞা।
তাঁহার নিকটে গেলা অতি হর্ষ হঞা।।
প্রভুপাদ শ্রীতুলসী বেদির সমীপে।
যোগাসনে বসি শ্রীগোপালমন্ত্র জপে।।
হেনকালে দিগ্বিজয়ী প্রভুর আগে যাঞা।
তুলসী মহিমা বর্ণে কবিত্ব করিঞা।।
পুষ্কর প্রভাস কুরুক্ষেত্র আদি তীৰ্থ।
শ্রীযমুনা গঙ্গা আদি পুণ্যতমা যত।।
ব্রহ্মা বিষ্ণু শিব আদি দেবতা সকলে।
বসতি করয়ে সদা তুলসীর দলে।।
দর্শিতা তুলসী দেবী পাপসংঘ মৰ্দ্দিনী।
স্পর্শিতা তুলসীরাণী সৰ্ব্বদেহ পাবনী।।
বন্দিতা তুলসীদেবী রোগবৃন্দনাশিনী।
স্থাপিতা তুলসীকৃষ্ণ শক্তিকালদংশিনী।।
রোপিতা তুলসীদেবী কৃষ্ণ-সঙ্গ অর্পিণী।
অর্পিতা তুলসী কৃষ্ণে জীবন্মুক্তিদায়িনী।।
এই শ্রীতুলসী পদে মোর নমস্কার।
তুলসী বিহীন দ্রব্য বিষ্ণু না করে আহার।।
হেন মতে নানা শাস্ত্রের মত উঠাইয়া।
তুলসী মহিমা দ্বিজ বৰ্ণি বিনাইয়া।।
ভাগীরথী মহিমা কহিতে আরম্ভিলা।
শুনি প্রভু নয়নাজ উন্মীলন কৈলা।।
দিগ্বিজয়ী কহে গঙ্গার মহিমা অপার।
বিষ্ণুপদে জম্মি বিষ্ণুপদী নাম তাঁর।।
মহাদেবের জটায় যাঁর সর্ব্বদা বিহার।
ব্রহ্মা যাঁরে পূজে দিয়া নানা উপহার।।
ইন্দ্ৰ আদি দেবগণে করিয়া নিস্তার।
মন্দাকিনী হৈলা ধরার কন্ঠ-মণিহার।।
জহ্নুমুনি ধ্যানে জানি গঙ্গাতত্ত্বসার।
আচমন ছলে গঙ্গায় করিলা আহার।।
জীবের হিত লাগি পরে করিয়া বিচার।
গঙ্গা দিলা নিজ জানু করিয়া বিদার।।
গঙ্গা বিষ্ণুভক্তসমা ধরি জলাকার।
জীব উদ্ধারিতে কৈল শক্তির সঞ্চার।।
শ্রীজাহুবী মাতা দয়াগুণের আধার।
স্নাত জন মাত্রের করে ত্রিতাপ সংহার।।
জীবে যদি পান করে গঙ্গা এক ধার।
নিশ্চয় দেহ অন্তে দিব্য গতি হয় তার।।
হেন গঙ্গাপদে মোর শত নমস্কার।
আসিলোঁ তোহার সহ করিতে বিচার।।
তাহা শুনি কমলাক্ষ বেদপঞ্চানন।
ঈষদ্ হাসিয়া কহে মধুর বচন।।
অহে কবিচূড়ামণি তুহুঁ বহুদর্শী।
তব যশ-তরু-চূড়া হৈল স্বৰ্গ স্পৰ্শী।।
শ্রীতুলসী গঙ্গার দিব্য মহিমা শুনিয়া।
প্রীতি রসে আবর্তিত হৈল মোর হিয়া।।
কিন্তু গঙ্গার বস্তু তত্ত্বে হৈল তুয়া ভ্ৰম।
দ্রব ব্রহ্মে কহ তুমি বিষ্ণু ভক্ত সম।।
স্বয়ং ভগবান জীব উদ্ধার কারণে।
দ্রব হঞা গঙ্গানাম করিলা ধারণে।।
একদিন নারায়ণ-পঞ্চাননের গানে।
দ্রব হঞা ছিলা তাহা পুরাণে বাখ্যানে।।
সুর তরঙ্গিণী গঙ্গা সাক্ষাৎ দ্রব ব্ৰহ্ম।
যার নাম স্মৃতিমাত্রে জীবের নাহি জন্ম।।
ভগবৎ স্বরূপা শক্তি গঙ্গারূপ ধরে।
শিব মৃত্যুঞ্জয় হৈলা গঙ্গা হরি শিরে।।
গঙ্গা বিনু কোন কাৰ্য্য না হয় সফল।
ব্রহ্মা দ্বারে পুজি পায় নিজাভীষ্ট ফল।।
সৰ্ব্বজলে গঙ্গাজ্ঞান করি অরোপণ।
আপো নারায়ণঃ স্বয়ং কহে শ্রুতিগণ।।
একবর্ষ পরে গঙ্গাজল জীর্ণ পায়।
তাহে মৈলে জীবমাত্র শ্রীবৈকুণ্ঠে যায়।।
গঙ্গায় তুলসীর দল দেয় কৃষ্ণোদ্দেশে।
শ্রীকৃষ্ণ বিক্রীত হয় সে জনের পাশে।।
প্রভুর সিদ্ধান্ত শুনি ভাবে শ্যামদাস।
দিগ্বিজয়ী নাম মোর হইল বিনাশ।।
যে উক্তি পুছিয়ে ব্রহ্মেশ্বর নিরূপণ।
কিবা শাস্ত্র যুক্ত্যে করে সাকার স্থাপন।।
এত চিন্তি কহে শুন বেদপঞ্চানন।
সৰ্ব্বব্যাপী ব্ৰহ্মা ইহা বেদের লিখন।।
অতীন্দ্রিয় বস্তু সেই নির্গুণ নিরাকার।
নিষ্ক্রিয় পরম ব্রহ্মে নাহিক বিকার।।
তারে তুহুঁ সাকার কল্পনা কৈছে কর।
সাকার পদার্থ হয় ইন্দ্রিয় গোচর।।
প্রভু কহে পরংব্রহ্ম নহে নিরাকার।
শ্রীসচ্চিদানন্দময় অনাদি সাকার।।
সর্ব্ব শক্তিমান তাঁর পরিপূর্ণতম।
সৃষ্ট্যাদির সেই সর্ব্বকারণ কারণ।।
অপ্রাকৃত দেহ তাঁর অপ্রাকৃত মন।
অপ্রাকৃত নেত্র তাঁর অপ্রাকৃত গুণ।।
প্রাকৃতিক গুণের তাহে নাহিক সম্বন্ধ।
তেঞি তারে নির্গুণ কহয়ে শাস্ত্র বৃন্দ।।
অতীন্দ্রিয় বস্তু সেই নাহিক সংশয়।
প্রাকৃত ইন্দ্ৰিয় বেদ্য কভু তিঁহো নয়।।
যৈছে ফল সাকার তার রস নিরাকার।
তৈছে ব্রহ্মের অঙ্গকান্তির নাহিক আকার।।
অপ্রাকৃত ব্ৰহ্ম কৃষ্ণ স্বয়ং ভগবান।
নিত্য বৃন্দাবনে সদা তাঁর অবস্থান।।
নব কৈশোর নিত্য সর্ব্ব-রসামৃত মুর্ত্তি।
মহাভাব অন্তরঙ্গাশক্তির বশবর্ত্তী।।
অপ্রাকৃত জীব হয় কৃষ্ণ ভক্তগণ।
ভক্তি নেত্রে ঐছে রূপ করয়ে দর্শন।।
পরম দয়ালু হরি ভক্ত তান প্ৰাণ।
তেঁই ভক্তজনে করে শুদ্ধ ভক্তিদান।।
শুষ্ক জ্ঞান পথে কৃষ্ণ প্রাপ্তি সুদুর্লভ।
ভক্তিপথে কৃষ্ণপ্রাপ্তি অতীব সুলভ।।
ঐছে বহু সুসিদ্ধান্ত করিলা আচার্য্য।
তাহা শুনি দিগ্বিজয়ী মানিলা আশ্চৰ্য্য।।
এই শ্যামদাস পূর্ব্বে কাশীধামে গেলা।
বিদ্যার্থী হইয়া শিবের আরাধনা কৈলা।।
বহুদিন তপস্যাতে শিব তুষ্ট হঞা।
রাত্রিশেষে শ্যামদাসে কহিলা হাসিয়া।।
দ্বিজ তোর তপোবৃক্ষ হৈল ফলবান।
তব জিহ্বায় সরস্বতী কৈলা অধিষ্ঠান।।
আমা বিনে সুধীগণে হঞা সত্যজয়ী।
ভূতারতে নাম তোর হৈবে দিগ্বিজয়ী।।
তবে দ্বিজ সর্ব্বদেশ জিনি শিবের বরে।
অবশেষে আইলা শ্রীপাট শান্তিপুরে।।
মোর প্রভু সুসিদ্ধান্তে পরাস্ত মানিয়া।
মনে ভাবে শিবের বর গেল পণ্ড হঞা।।
হেন কালে আকাশে হইল দৈববাণী।
অহে দ্বিজ শুনহ বিচার ক্ষান্ত মানি।।
সাক্ষাৎ হরি হর এই কমলাক্ষাচাৰ্য্য।
তেঞি ইহার শ্রীঅদ্বৈত নাম হৈল ধাৰ্য্য।।
দিগ্বিজয়ী শুনি দিব্য বাক্য অপরূপ।
ঊর্দ্ধদিগে দৃষ্টি করি নাহি দেখে রূপ।।
দ্বিজ ভাবে ইহোঁ সত্য স্বয়ং হরিহর।
ইহার সহিত তর্ক মহাপাপ কর।।
এতভাবে দ্বিজ কহে সভক্তি অন্তরে।
কহে শ্রীঅদ্বৈত প্রভু দয়া কর মোরে।।
শ্রীঅদ্বৈতচন্দ্রের হৈল দয়ার সঞ্চার।
সিদ্ধমূৰ্ত্তি দেখাইলা অতি চমৎকার।।
দেখি শ্যামদাস হৈল প্রেমে কম্পবান।
কান্দে হাসে নাচে গায় হরেকৃষ্ণ নাম।
হাসে শ্রীঅদ্বৈত দেখি দ্বিজের বৈরাগ্য।
কহে তুহু ধন্য তোর পরম সৌভাগ্য।।
যে হেতু অনন্ত শক্তি যুক্ত হরি নাম।
কহিতে গাহিতে তোর নাহিক বিশ্রাম।।
আজি মোর সুপ্রভাত শুভ প্ৰতিক্ষণ।
হরি নাম শুনি জুড়াইলো প্ৰাণ মন।।
কহিতেই হৈলা প্ৰভু প্রেমেতে বিহ্বল।
কহে শ্ৰীকৃষ্ণচৈতন্য নিত্যানন্দ বোল।।
কথোক্ষণে তাঁর বাহ্যেন্দ্ৰিয় স্ফূৰ্ত্তি হৈল।
প্রভুর মনের ভাব প্রভুই বুঝিল।।
অলৌকিক বস্তু প্রভু তাঁর দিব্য কার্য্য।
অলৌকিক বিদ্যা অলৌকিক যশোবীৰ্য্য।।
এই সব দেখি শুনি কবি চূড়ামণি।
যত্নে প্রভুস্থানে মগ্ন লইলা আপনি।।
কৃষ্ণমন্ত্ৰ পাঞা তিহো প্রেমাবিষ্ট হৈলা।
প্রভু পদে দন্ডবত করি স্তুতি কৈলা।।
অহে প্রভু তোঁহার মহতী কৃপাবলে।
কৰ্ম্মবন্ধ হৈত মুক্ত হৈনু অবহেলে।।
তবে দ্বিজ কৃষ্ণাচনের প্রণালী শুনিলা।
শ্রীমদ্ভাগবত পড়ি প্রেমে মগ্ন হৈলা।
প্রভু কহে তোর নাম ভাগবতাচাৰ্য্য।
শ্যামদাস কহে তব আজ্ঞা শিরোধার্য্য।।
দিন কত পরে প্রভু আদেশ লইয়া।
দেশে গেল দ্বিজ প্রভুপদে প্রণমিয়া।
একদিন শ্রীঅদ্বৈত ভক্ত অবতার।
মনে ভাবে কৈছে জীব হইবে উদ্ধার।।
অদ্যাপি না হৈলা প্রকট স্বয়ং ভগবান।
কেবা জীবে প্রেমভক্তি করিবে প্রদান।।
ভাবিতে আছেন প্রভু এ হেন কালেতে।
দিব্যসিংহ রাজা আইলা শ্রীলাউর হৈতে।।
পূর্ব্বে প্রভুর হিল্লোলে তার ভ্রম দূরে গেল।
বৈষ্ণব হঞা সেই রাজা প্রভুস্থানে আইল।।
তানে দেখি শ্রীঅদ্বৈত কৈলা গাত্রোত্থান।
রাজা কহে প্রভু মোরে কর ভৃত্য জ্ঞান।।
এত কহি প্ৰভু পদে দন্ডবৎ হঞা।
দৈন্যস্তুতি কৈলা প্রভুর তত্ত্ব উঘারিয়া।।
প্রভু কহে উঠ-উঠ তুহুঁ কৃষ্ণদাস।
সেই হৈতে রাজার নাম হৈল কৃষ্ণদাস।।
দশ বৎসর ভক্তি শাস্ত্র পড়ি কৃষ্ণদাস।
কৃষ্ণ সৰ্ব্বেশ্বর বলি হৈল সুবিশ্বাস।।
শক্তি মন্ত্ৰ ছাড়ি গ্রহণ কৈলা বিষ্ণু মনু।
প্রভু কহে আজি তোর হৈল বিষ্ণু তনু।।
কৃষ্ণদাস কহে তুহুঁ দয়ার সাগর।
মো পাষান্ডে উদ্ধারিলা বড় চমৎকার।।
এবে আজ্ঞা কর মোরে বিরলেতে যাঙ।
কৃষ্ণনাম জপি সদা পরাণ জুড়াঙ।।
এত কহি সুরধনী তীরে উত্তরিয়া।
কিছু দিন বাস কৈলা ঝুপড়ী বান্ধিয়া।।
বহু পুষ্পোদ্যানে সুশোভিত কৈলা বাটী।
তদবধি গ্রামের নাম হৈল ফুল্লবাটী।।
ভক্তিবলে হৈলা তিহোঁ প্রভুর কৃপাপাত্র।
সংস্কৃতে রচিলা প্রভুর বাল্যলীলা সূত্র।।
শেষাবস্থায় কৃষ্ণদাস ব্রজধামে গেলা।
ভক্তিনেত্রে কৃষ্ণ দেখি সিদ্ধি প্রাপ্ত হৈলা।।
শ্ৰীচৈতন্য শ্রীঅদ্বৈত পদে যার আশ।
নাগর ঈশান কহে অদ্বৈত-প্ৰকাশ।।
ইতি—শ্রীঅদ্বৈত-প্ৰকাশ ষষ্ঠোহধ্যায়ঃ।