পঞ্চম অধ্যায়
জয় জয় শ্রীচৈতন্য জয় সীতানাথ।
জয় নিত্যানন্দ রাম ভক্তগণ সাথ।।
একদিন পুরীরাজ শ্রীমন্মাধবেন্দ্র।
শান্তিপুরে উদয় হইলা ভক্তি-চন্দ্ৰ।।
মুখে কৃষ্ণ রব দেহে প্রেমে মহাভাব।
তিহ স্বয়ং ব্রজ-কল্পতরুর আবির্ভাব।।
পরম বৈরাগ্য পুরীর বাহ্যাপেক্ষা নাঞি।
তথাপি প্রভুর স্নেহে আইলা তাঁর ঠাঞি।।
পুরীর দর্শনে প্রভু প্রেমাবিষ্ট হৈলা।
গলে বস্ত্র বান্ধি তাঁরে দণ্ডবৎ কৈলা।।
পুরী তাঁকে আলিঙ্গয়া কুশল পুছিলা।
প্রভু কহে মদনগোপাল দয়া কৈলা।।
পুরী কহে কৃষ্ণসেবার অলৌকিক শক্তি।
তাহে জীব পায় নিত্য ভাগবতী গতি।।
দরশন করি হৈলা মহা প্রেমাবিষ্ট।।
ক্ষণে হাসে ক্ষণে কান্দে ক্ষণে করে নৃত্য।
মহাভাগবত পুরীর কেবা জানে তত্ত্ব।।
কতক্ষণে পুরীরাজের বাহ্য স্ফূৰ্ত্তি হৈলা।
তবে কৃষ্ণ প্রাপ্ত্যের সহজ উপায় কহিলা।।
পুরী কহে বাঁছা তুচ্ছ শুষ্ক প্রেমবান্।
শ্রীরাধিকার চিত্রপট করহ নিৰ্ম্মাণ।।
রাধাকৃষ্ণ দর্শনে হয় গোপীভাবোদয়।
অতএব যুগল সেবা সৰ্ব্বশ্ৰেষ্ঠ হয়।।
আর এক কথা কহি শুন মন দিয়া।
কৃষ্ণার্থ সংসার কর বিবাহ করিয়া।।
কৃষ্ণ কৃপায় হৈবে তোহার বহুত সন্তান।
জীব নিস্তারিবে সভে দিয়া কৃষ্ণনাম।।
প্রভু কহে শ্রীবিগ্ৰহসেবাতে মঙ্গল।
অপরাধ হৈলে বংশ যায় রসাতল।।
পুরী কহে দয়াসিন্ধু-কৃষ্ণ তোর বশ।
অপরাধ না লৈব পুরুষ চতুৰ্দ্দশ।।
গুরু আজ্ঞায় মোর প্রভু প্রেমাবিষ্ট মনে।
শ্রীরাধিকার চিত্রপট করিলা নির্মাণে।।
এই দুই সিদ্ধ মূর্ত্তি দরশন কৈলে।
অনায়াসে রাধা কৃষ্ণের প্রেমধন মিলে।।
তবে শ্রীরাধিকা শ্রীমন্মদনগোপালে।
অভিষেক কৈলা পুরী মহা কুতূহলে।।
নানাবিধ মিষ্ট অন্ন ভোগ লাগাইলা।
আচমনী দিয়া কর্পূর তাম্বুল অর্পিলা।।
অপূৰ্ব্ব যুগলমূৰ্ত্তি দেখি লোক সব।
দন্ডবত করি কৈল নানাবিধ স্তব।।
মহাপ্রসাদের দিব্য-সৌরভাকর্ষণে।
ভক্তিভাবে কৃষ্ণোচ্ছিষ্ট পাইলা সৰ্ব্বজনে।।
তবে লোক শিক্ষাইতে প্রভু সযতনে।
কৃষ্ণমন্ত্র-রাজ লৈল পুরীরাজ স্থানে।।
দিন কত পরে পুরী বিদায় মাগিলা।
বহুত আগ্রহ করি প্রভু নিষেধিলা।।
পুরী কহে যাঙ মুঞি শ্রীপুরুষোত্তমে।
গোপাল আদেশ কৈলা চন্দনাহরণে।।
প্রভু করে কেনে গোপাল মাগয়ে চন্দন।
তাহা শুনিবারে মোর উৎকণ্ঠিত মন।।
পুরী কহে শ্রীগোপাল স্বতন্ত্র ঈশ্বর।
মো অধমে দয়া করি হইলা গোচর।।
তবে শ্রীগোপাল মোরে স্বপনে কহিল।
পুরী মোর অঙ্গে বড় তাপ উপজিল।।
মলয় চন্দন আন যাই নীলাচলে।
জুড়াবাঙ সেই গন্ধ অঙ্গে বিলেপিলে।।
গোপালের দৃঢ় আজ্ঞা লঙ্ঘে কোন জনে।
তেঁই এই দেশে আইলু চন্দন সাধনে।।
কৃষ্ণ-ভক্তি-সূর্য্য তোর সদ্ধাঞ্চাকর্ষণে।
শান্তিপুর শান্তিপুরে আইনু তব স্থানে।।
পুরী মুখে শুনি কৃষ্ণের দয়ার তাৎপর্য্য।
প্রেমাবিষ্ট হঞা হুঙ্কার করেন আচার্য্য।।
প্রভু করে কৃষ্ণচন্দ্র বড় দয়াময়।
ভক্তবৎসলতা মহাশক্তির আশ্রয়।।
ভক্তের সদ্গুণগণ বাঢ়ায় নিরন্তর।
ভক্তার্থ প্রকটে নাহি কালের বিচারে।।
এত কহি প্রভুবর স্তম্ভিত হইলা।
পুরী তাঁরে সুস্থ করি বিদায় মাগিলা।।
প্রভু পুরীরাজে অষ্ট অঙ্গে প্ৰণমিলা।
পুরী তারে অলিঙ্গিয়া আশীৰ্ব্বাদ কৈলা।।
তবে মাধবেন্দ্র চলে মহা প্রেমাবেশে।
রেমুণাতে গোপীনাথ যাঁহা পরকাশে।।
তথি যাই গোপীনাথ করি দরশন।
উর্দ্ববাস্তু হঞা করে নৰ্ত্তন কীৰ্ত্তন।।
কতক্ষণে পুরীরাজের বাহ্যস্ফূৰ্ত্তি হৈল।
তবে অষ্ট অঙ্গে গোপীনাথে প্রণমিল।।
নাম করে পুরী জগমোহনে বসিয়া।
হেনকালে পুছে এক দ্বিজেরে দেখিয়া।।
অহে বৃদ্ধ দ্বিজবর এই শ্রীবিগ্রহ।
নিৰ্ম্মাইলা কোন ভাগ্যবানে তাহা কহ।।
দ্বিজ কহে শুন সাধু পূৰ্ব্বে বিজ্ঞ জনে।
মোরে যে কহিলা তাহা কহি তব স্থানে।।
ত্রেতাযুগে পূর্ণব্রহ্ম রাম যোগীবেশে।
পিতৃ সত্যে সীতাসহ গেলা বনবাসে।।
একদিন চমরী গোবৎসগণ লঞা।
পালে পালে বনমধ্যে বেড়ায় চরিঞা।।
তাহা দেখি রামচন্দ্র ঈষৎ হাসিলা।
সীতাদেবী সেই হাস্যের কারণ পুছিলা।।
রাম কহে তাহা শুনি নাহি প্রয়োজনে।
সীতা বলে কহ প্রভু ধরোঁ শ্রীচরণে।।
ভক্তবৎসল ভগবান্ নিত্য ভক্তাধীন।
ভক্তে প্রেমানন্দ দান করে চিরদিন।।
শ্রীসীতা হ্লাদিনী শক্তি ভক্তি শিরোমণি।
তাঁহার পিরীত লাগি কহে রঘুমণি।।
শুনহ জানকী ভাবী দ্বাপরের শেষে।
ব্রজে কৃষ্ণরূপে লীলা, করিবাঙ প্রকাশে।।
তাঁহা শ্রীগোপাল নাম গো-পালন ধৰ্ম্ম।
গোপ গোপী সহ মোর হয় নিত্যকর্ম্ম।।
শ্রীজানকী কহে কৈছে সেইরূপ হয়।
অবশ্য দেখাও মোরে তুহু দয়াময়।।
তবে সাক্ষাৎ ভগবান জগতের পতি।
দিব্য মণি দিয়া স্বয়ং নিৰ্ম্মিলা শ্ৰীমূৰ্ত্তি।।
সে কৃষ্ণ বিগ্রহ দেখি সীতার আশ্চর্য্য।
কহে ঐছে নাহি দেখি রূপের মাধুর্য্য।।
জগচ্চিত্তাকর্ষী এই সর্ব্বরস কূপ।
নব জলধর কান্তি অলৌকিক রূপ।।
তবে মহা ভক্তিভাবে সীতা ধৰ্ম্মশীলা।
নানা ফল ফুলে সেহি বিগ্রহ পূজিলা।।
গোপীনাথ নাম ইহার সর্ব্বলোকে খ্যাতি।
ইহাঁরে দেখিলে পায় শুদ্ধ কৃষ্ণ ভক্তি।
সক্ষেপে কহিনু এই পূর্ব্ব বিবরণ।
যেই শুনে তার হয় অভীষ্ট পূরণ।।
শুনিয়া অপূৰ্ব্ব গোপীনাথ বিবরণ।
প্রেমাবেশে পুরীরাজ করয়ে অর্চ্চন।।
গোপীনাথ দয়া কর বলে বারে বার।
তান প্রেম দেখি সবে হৈলা চমৎকার।।
তবে আরাত্রিক দেখি করিলা প্রস্থান।
বৃক্ষতলে বসি পুরী জপে হরিনাম।।
দ্বিতীয় প্রহর যবে হইল সৰ্ব্বরী।
ক্ষীরভান্ড হাতে করি আইলা পূজারী।।
কাঁহা মাধবেন্দ্র ডাকয়ে সঘনে।
পুরী কহে মুঞি ছার আছোঁ এই স্থানে।।
দ্বিজ কহে তব ভাগ্য-সিন্ধু উথলিলা।
তুয়া লাগি গোপীনাথ ক্ষীর চুরি কৈলা।।
স্বপ্নে গোপীনাথ মোরে করিলা আদেশে।
তেঁই ক্ষীর লঞা মুঞি আইনু তোমা পাশে।।
এত বলি পুরীরাজে ক্ষীর সমর্পিলা।
নমস্কার করি দ্বিজ নিজ গৃহে গেলা।।
আশ্চৰ্য্য অচিন্ত্য কৃপা কৃষ্ণ কৈলা মোরে।
এত কহি প্রেমে পুরীর বাহু নাহি রে।।
বহু অশ্রুপাত করি মনঃস্থির কৈলা।
তবে ভক্তি করি সেই ক্ষীর প্রসাদ পাইলা।।
মহাপ্রসাদ পাঞা পুন প্রেম উপজিল।
উৰ্দ্ধবাহু হঞা বহু নর্তন করিল।।
সেই পুরী পদে মোর কোটি পরণাম।
যার ভক্ত্যে গোপীনাথের ক্ষীরচোরা নাম।।
তবে চলি চলি পুরী আইলা নীলাচলে।
জগন্নাথ দেখি নাচে কুতূহলে।।
দন্ডবৎ করি কৈলা বহুত স্তবন।
প্রেমাবেশে করে উচ্চ নাম সংকীৰ্ত্তন।।
দিনকত তাঁহা পুরী করিয়া বিশ্রাম উত্তম চন্দন লঞা করিলা প্রস্থান।।
পুন রেমুণাতে তিঁহো উদয় হইল।
গোপীনাথে প্রণমিয়া স্তব পাঠ কৈল।।
রাত্রে স্বপ্নাবশে তাঁরে শ্রীগোপাল কহে।
শুন শুন পুরীরাজ না কর সন্দেহে।।
গোপীনাথে গন্ধ লেপ করিয়া বিশ্বাস।
তাহে মোর অঙ্গ তাপ খণ্ডিবে নিজ্জাস।।
স্বপ্ন দেখি পুরী প্রেমে হইয়া বিহ্বল।
কহে কী আশ্চৰ্য্য আজ্ঞা কৈলা শ্রীগোপাল।।
অচিন্ত্য ঈশ্বরের ইচ্ছা কে জানে তার স্থৈর্য্য।
যেই তার আজ্ঞা হয় সেই মোর ধার্য্য।।
তবে গোপীনাথে সব চন্দন অর্পিলা।
দিন কত পুরী তাহা বিশ্রাম করিলা।।
তবে পুরী প্রেমে কভু নীলাচলে যায়।
প্রেমাকিষ্ট হঞা কভু আইসে রেমুণায়।।
ঐছন শ্রীপুরী বহু কৈলা যাতায়াত শেষে গোপীনাথ পদে হইলা সিদ্ধি প্রাপ্ত।।
পুরীরাজের গুণ লীলা সাগরের সম।
শ্রীমুখে অদ্বৈত প্রভু করিলা বর্ণন।।
মুঞি ছার তার এক বিন্দু নাই ছুঁইনু।
প্রভুর আজ্ঞায় সূত্র মাত্র সে লিখিনু।।
শ্রীচৈতন্য শ্রীঅদ্বৈত পদে যার আশ।
নাগর ঈশান কহে অদ্বৈত-প্ৰকাশ।
ইতি শ্রীঅদ্বৈত-প্রকাশে পঞ্চমোহধায়ঃ।।