তৃতীয় অধ্যায়
জয় জয় শ্রীচৈতন্য জয় সীতানাথ।
জয় নিত্যানন্দ রাম ভক্তগণ সাথ।।
একদিন প্রভু এক পত্রিকা লিখিয়া।
শ্রীলাউর ধামে লোক দিলা পাঠাইয়া।।
এথা শ্রীকুবেরচার্য্য অতি দুঃখ মনে।
পুত্র অদর্শনে বহু কৈলা অন্বেষণে।।
খুঁজিয়া না পাঞা চক্ষে বহে অশ্রুধার।
হা গোপাল কি করিলা কহে বার বার।।
তবে কৃষ্ণ কৃপায় তিহোঁ কিছু সুস্থ হৈলা।
দুঃখিত হইয়া নিজ গৃহে চলি গেলা।।
পুত্র অদর্শনে লাভা হাহাকার করি।
ইতি উতি ধায় ক্ষণেক যায় গড়াগড়ি।।
অবিশ্রান্ত অশ্রুধারা বহে দুনয়নে।
উন্মাদিনী সম অসম্বন্ধ প্রশ্ন ভণে।।
জড়ীভাব হঞা ক্ষণে হয় মৃতকার।
আচাৰ্য্য সান্ত্বনা কৈলা বিবিধ প্রকার।।
কুবের কহে ভগবানে নাহি অবিচার।
যার সত্ত্বের বস্তু তারে দেয় পুনর্ব্বার।।
হরি পাদপদ্মে মতি সেই সৰ্ব্বোত্তম।
মায়িক দেহে আত্মবুদ্ধি সেই নরাধম।।
সাংসারিক সুখে আছে দুঃখের ভাণ্ডার।
যৈছে সুখস্পর্শ সৰ্প কালকুটাধার।।
শ্রীহরিভজন ক্লেশে নিত্যানন্দের খনি।
মহৌষধির শক্তি যৈছে আনন্দদায়িনী।।
হেনমতে বহু উপদেশ বাক্য শুনি।
কিঞ্চিৎ সুস্থির হৈলা লাভা ঠাকুরাণী।।
তবে দুঃখে নিশাকালে বিষ্ণুগৃহে গিয়া।
অনাহারে শ্রীকুবের রহিলা শুতিয়া।।
প্রত্যুষে গোপাল তাঁরে স্বপনে কহিলা।
কুশলী তোমার পুত্র গঙ্গাতীরে গেলা।।
কমলাক্ষ নর নহে ভক্ত অবতার।
দিন কত পর তার আসিবে কিঙ্কর।।
লাভারে কহিলা দ্বিজ স্বপ্ন বিবরণ।
প্রভুর ভবিষ্যৎ বাক্যে সুস্থ কৈলা মন।।
একদিন কমলাক্ষের পত্রিকা পাইলা।
আচার্য্য আর লাভা দোঁহে আনন্দিত হৈলা।।
কুবের কহে হেথা থাকি কিবা আর ফল।
গঙ্গাতীরে যাঙ যাঁহা পাঙ মোক্ষফল।।
লাভা কহে মোহর মনের ঐছে সে ভাব।
তাঁহাঞি করিমু বাস যাবৎ মোরা জীব।।
দম্পতি চলিলা তবে তরি আরোহিয়া।
শান্তিপুর ধামে আইলা আনন্দিত হৈয়া।।
পিতামাতা দেখি প্রভু ধাঞা চলি আইলা।
ভক্তি করি দোঁহার চরণে প্রণমিলা।।
প্রভুরে ধরিয়া দোঁহে কৈল আলিঙ্গন।
মস্তক চুম্বিয়া বৈল আশীষ বচন।।
লাভা কহে বাছারে তো বিনু মোর প্রাণ।
জীবস্মৃত জলহীন মীনের সমান।।
কুবের কহে বাছা কিবা করিলা পঠন।
প্রভু কহে ষড়দর্শন সমাপ্তোপক্ৰম।।
কুবের কহে পড় এবে বেদ চারিখান।
অবশ্য পাইবা তাহে ব্ৰহ্মানুসন্ধান।।
প্রভু কহে পড়িতে যাইব পূর্ণবাটী।
বেদান্ত বাগীশ শান্ত দ্বিজবরের বাটী।।
আচাৰ্য্য কহেন বিদ্যা নহে বশীভূত।
শ্রমানুসারিণী বিদ্যা সতযুক্তি সঙ্গত।।
তুরিতে তাহাঞি যাহ লিখিও কুশল।
অবাধে করিহ পাঠ হইব মঙ্গল।।
তবে প্রভু পিতামাতার পদে প্রণমিয়া।
চলিলা শ্রীহরি স্মরি পুঁথি সঙ্গে লৈয়া।।
পূর্ণবাটীগ্রামে শীঘ্রগতি উত্তরিলা।
শান্তমূর্ত্তি শান্ত দ্বিজবরে প্রণমিলা।।
প্রভুর সৌন্দর্য্য দেখি দ্বিজের বিস্ময়।
আশীর্ব্বাদ করি তবে লৈল পরিচয়।।
তাঁর সহ দ্বিজবর শান্ত আলাপিয়া।
প্রশংসা করিয়া বহু হরষিত হৈয়া।।
দ্বিজ কহে পড় বাছা যাহা লয় মনে।
তাঁর ঠাঞি প্রভু বেদ কৈলা অধ্যয়ণে।।
মনুষ্য লীলাতে প্রভু শ্রুতিধর হয়।
বর্ষ দ্বয়ে বেদশাস্ত্র পড়ে সমুদয়।।
একদিন শুন এক অদ্ভুত কথন।
স্নানে গেলা শান্ত দ্বিজ লঞা ছাত্রগণ।
গঙ্গাসহ লগ্ন আছে বড় এক বিল।
কন্টকাদি হয় তঁহি অগাধ সলিল।।
তার মাঝে এক পদ্ম দেখিতে সুন্দর।
তাহার সদ্গন্ধে পূর্ণ দিগ দিগন্তর।।
কালসর্পগণ তাঁহা করয়ে বিহার।
সেই পদ্ম আনিবারে শকতি কাহার।।
বেদান্ত বাগীশ হাসি কহে ছাত্রগণে।
কেবা শক্তি ধরে এই কমল চয়নে।।
পড়ুয়াগণে কহে আনিবারে সাধ্য নাঞি।
প্রভু কহে আজ্ঞা পাইলে মুই না ডরাঞি।।
দ্বিজ কহে কন্টক ইথে আর আছে সর্প।
এই সুদুর্গমে যাইতে না করিহ দর্প।।
এত শুনি প্রভু মনে ঈষদ হাসিয়া।
পদ্মে পদ্মে পদ দিয়া চলিলা ধাঞিয়া।।
সেই প্রফুল্লিত পদ্ম করিয়া চয়ন।
ভক্তি করি গুরুদেবে করিলা অর্পণ।।
ভোজবিদ্যা কহে দেখিয়া আশ্চৰ্য্য।
দ্বিজ ভাবে ধন্য মুঞি ইহার আচার্য্য।।
নির্জ্জনে প্রভুরে কহে শান্ত দ্বিজরাজ।
কৈছে বাপু কৈলা এই অলৌকিক কাজ।।
বিদ্যার প্রভাবে কিবা কৈলা দৈববলে।
কিবা তুহু কোন দেব আইলা ভূতলে।।
নিত্য করি কহ মুঞি হঙ গুরুজন।
প্রভু কহে হরির অংশ এ তিন ভুবন।।
শুদ্ধ চিত্তে যেইজন কৃষ্ণগত হয়।
অষ্টসিদ্ধি আসি তার লয় পদাশ্রয়।।
তবে শান্ত বেদান্ত বাগীশ দ্বিজমণি।
প্রভু মুখে সুসিদ্ধান্ত গুহ্যতত্ত্ব শুনি।।
জীব শক্তির সাধ্যায়ত্ত নহে সে ব্যাখ্যান।
প্রভুরে ঈশ্বর বলি কৈলা অনুমান।।
একদিন কমলাক্ষ কহে আচার্যেরে।
তুষ্ট হঞা আজ্ঞা কর যাঙ নিজ ঘরে।।
শান্ত কহে তোমার নাম বেদ পঞ্চানন।
তোরে বিদায় দিতে হয় চিত্ত উচাটন।।
একান্তই যদি যাইবে এই ভিক্ষা চাঙ।
ইচ্ছামাত্র তোরে যেন দেখিবারে পাঙ।।
প্রভু তবে আচার্য্যেরে দন্ডবৎ কৈলা।
আচার্য্য তাহারে ধরি কান্দিতে লাগিল।।
ছাত্রগণ কান্দে আর কান্দে আচার্য্যাণী।
প্রভু সবে প্রবোধিয়া কহে মিষ্টবাণী।।
মোহর কারণে সবে খেদ না করিহ।
ফিরি ফিরি দেখা হৈবে ভুলিও না স্নেহ।।
এত কহি প্রভু হইলেন অন্তৰ্দ্ধান।
সবে ইতি উতি ধাঞা না পাইল সন্ধান।
প্রভু আসি জননী জনক প্ৰণমিঞা।
বহু স্বস্তি কৈলা গাঢ় ভক্তি প্রকাশিঞা।।
পুত্ৰ দেখি দোঁহে মহা আনন্দিত হৈলা।
শিরে চুম্ব দিয়া বহু আশীৰ্ব্বাদ টেকলা।।
শ্রীগৌরাঙ্গ শ্রীঅদ্বৈত পদে যার আশ।
নাগর ঈশান কহে অদ্বৈত প্রকাশ।।
ইতি শ্রীঅদ্বৈত-প্রকাশে তৃতীয়োধ্যায়ঃ।