দ্বিতীয় অধ্যায়
জয় জয় শ্রীচৈতন্য জয় সীতানাথ।
জয় নিত্যানন্দরাম ভক্তগণ সাথ।।
শ্রীলাউড়ধাম কারণরত্নাকর হয়।
যাঁহা শ্রীঅদ্বৈত প্রভুর বাল্যলীলোদয়।।
একদিন শুন এক অপূৰ্ব্ব আখ্যান।
পুত্র কোলে করি লাভা করিলা শয়ান।।
রাত্রি শেষে স্বপ্ন দেখে অতি চমৎকার।
নিজকোলে পুত্র যেই সেই শিবাধার।।
চতুর্ভুজ শঙ্খ পদ্ম চক্র গদা ধর।
শুক্ল বর্ণ মহাবিষ্ণু দেব অগোচর।।
শরচ্ছন্দ্র প্রভা সম তাঁর অঙ্গ কান্তি।
দেখিলে ত্রিতাপ হরে লভ্য হয় শাস্তি।।
সেই অলৌকিক মূৰ্ত্তি দেখি লাভা সতী।
অষ্টঅঙ্গে দণ্ডবৎ করিয়া প্রণতি।।
করপুটে ভক্তিভাবে নানা স্তুতি করে।
প্রভু কহে কিবা লাগি স্তুতি কর মোরে।।
লাভা কহে দেহ তুয়া শ্রীচরণোদক।
প্রভু কহে গুরু হয় জননী জনক।।
লাভা কহে তুহুঁ জগৎগুরু সদাশিব।
ঘটে ঘটে আছ নিত্য হঞা বহু জীব।।
তুমি জগতের মূল কেবা তব মাতা।
স্বয়ং মহাবিষ্ণু তুহুঁ জগতের পিতা।।
কোটী কোটী তীর্থ আছে তব রাঙ্গা পায়।
তুয়া পদামৃত পানে জীব মোক্ষপায়।।
অতএব পাদোদক দেহ প্রভু মোরে।
প্রভু কহে ঐছে বাত না কহ পুনৰ্ব্বারে।।
কহ যদি আনি দিব সৰ্ব্ব তীর্থগণ।
স্নান পান করি কর ধর্ম্ম-প্রবর্ত্তন।।
এ হেন অদ্ভুত স্বপ্ন করি দরশন।
জাগিয়া বসিলা লাভা স্মরি নারায়ণ।।
কহে কি আশ্চৰ্য্য আজি দেখিনু স্বপনে।
প্রভাতে স্বপন সত্য জ্যোতিষ প্রমাণে।।
প্রভু উঠি কহে মাতা কিবা কহ তুমি।
লাভা কহে স্বপ্ন এক দেখিয়াছি অমি।।
প্রভু কহে সত্য করি বলহ স্বপন।
না কহিলে না করিমু নৰ্ত্তন কীৰ্ত্তন।।
লাভা কহে বাছারে তুই অবোধ বালক।
সে কথা শুনিলে তোর কি ফল দায়ক।।
এত কহি অপরূপ স্বপ্ন বিবরণ।
আদ্যোপান্তে করি কৈলা অশ্রু বিসর্জ্জন।।
প্রভু কহে মাতা মুই করিলঁ এই পণ।
সৰ্ব্বতীর্থ আসি হেথায় করিমু স্থাপন।।
শুনি শিহরিয়া কহে লাভা ঠাকুরাণী।
তা হইলে বাছা স্বপ্ন সত্য করি মানি।।
প্রভু কহে আজি নিশায় আসিব সৰ্ব্ব তীর্থ।
কালি স্নান করি সিদ্ধ করিহ সর্ব্বার্থ।।
লাভা কহে এই কথা কে করে প্রত্যয়।
প্রভু কহে এই কথা সত্য সত্য হয়।।
তবে নিশাকালে প্রভু করিয়া মনন।
যোগে সৰ্ব্ব তীর্থগণে কৈলা আকর্ষণ।।
যৈছে লৌহগতি অয়স্কান্ত আকর্ষণে।
তৈছে তীর্থগণ আইলা ঈশ্বর স্মরণে।।
মূৰ্ত্তিমতী শ্রীযমুনা গঙ্গা আদি তীৰ্থ।
প্রভূরে পূজিয়া সবে হইলা কৃতাৰ্থ।।
তেঁহো তীর্থগণে করি বিধেয় সংস্কার।
শ্রীযমুনা পাদপদ্মে কৈলা নমস্কার।।
তীর্থগণ কহে প্রভু বোলাইলা কেনে।
প্রভু কহে এই শৈলে কর অবস্থানে।।
তীর্থগণ কহে ইহা যদি করি বাস।
বহুপূণ্য স্থানের মহিমা হয় নাশ।।
প্রভু কহে মোর বাক্য না হৈব অন্যথা।
আসিবা বৎসরে এক দিন সবে হেথা।।
তীর্থগণ কহে প্রভু করহ নির্ণয়।
কোন দিন এ পৰ্ব্বতে হইব উদয়।।
প্রভু কৈল মধুকৃষ্ণা-ত্ৰয়োদশী যোগে।
সকলে আসিবা পণ কর মোর আগে।।
তীর্থগণ কহে মোরা সত্য কৈলঁ পণ।
তব শ্রীমুখের আজ্ঞা না হব লঙ্ঘন।।
তদবধি পুণ্যতীর্থ হৈল তার নাম।
পানাবগাহনে সিদ্ধ হয় মনস্কাম।।
প্রভু কহে তীর্থগণ যাহ শৈলোপরে।
ঝরণা রূপে রহ মোর বাক্য অনুসারে।।
তীর্থগণ প্রভু আজ্ঞা করিঞা স্বীকার।
পৰ্ব্বত উপরে যাঞা করিলা বিহার।।
প্রভাতে অদ্বৈতচন্দ্ৰ কহে জননীরে।
সর্ব্ব তীর্থের আবির্ভাব হৈল শৈলোপরে।।
লাভা কহে কৈছে মুঞি করিমু প্রত্যয়।
প্রভু কহে অত্যাশ্চাৰ্য্য দেখিবা নিশ্চয়।।
এত বলি জননীরে সঙ্গে করি গেলা।
পর্ব্বতের পাশে শঙ্খ ঘন্টা বাজাইলা।।
উচ্চৈঃস্বরে হরিধ্বনি করিবা মাত্রেতে।
ঝর ঝর তীর্থ জল লাগিল ঝরিতে।।
প্রভু কহে দেখ মাতা সদা জল ঝরে।
শঙ্খ আদি ধ্বনি কৈলে বহু জল পড়ে।।
ঐ দেখহ শ্রীযমুনা শ্যামরসামৃতে।
মেঘ সম তুয়া অঙ্গ হৈল আচ্ছাদিতে।।
উলটি ঐ দেখ গঙ্গা স্ফটিক নিন্দিয়া।
পুণ্যামৃত জলে তোঁহে ফেলিল ঢাকিয়া।।
পুন দেখ রক্ত পীত আদি পূণ্যজল।
তব শিরে পড়িতেছে করি কল কল।।
আশ্চৰ্য্য দেখিয়া লাভা নমস্কার কৈলা।
ভক্তি করি স্নান দানাদিক সমাপিলা।।
তদবধি পণ্যতীর্থ হইল বিখ্যাত।
বারুণী যোগেতে স্নান বহু ফলপ্রদ।।
তবে কমলাক্ষে শ্রীকুবের অতি রঙ্গে।
পড়িবারে দিলা রাজকুঙরের সঙ্গে।।
শ্রুতিধর প্রভু পড়ে কল্যপ ব্যাকরণ।
দৃষ্টিমাত্র শিখে সূত্র অর্থ বিবরণ।।
তিন বৎসরেতে গ্রন্থ সমাপ্ত করিলা।
সবে কহে দৈব বিদ্যা কমলাক্ষ পাইলা।।
এ হেন সময়ে শুন এক চমৎকার।
কমলাক্ষ সহ দিব্যসিংহের কুমার।।
শিলাময়ী কালিকার মণ্ডপেতে গেলা।
ভক্তি করি দেবীর আগে প্রণাম করিলা।।
প্রভুপাদ দেখে কালী মূর্ত্তির মাধুর্য্য।
রাজপুত্র কহে প্রণাম করহ আচার্য্য।।
প্রভু তাহা নাহি শুনে রহে দাঁড়াইঞা।
রাজপুত্র নিন্দে তাঁরে কোপ প্রকাশিঞা।।
প্রভু রজঃ স্বীকারিয়া হুঙ্কার করিলা।
রাজসূত মূৰ্চ্ছা হই ভূমিতে পড়িলা।।
হায় হায় করি সব রাজদূত ধায়।
শিঘ্রগতি দিব্যসিংহ রাজারে জানায়।।
অকস্মাৎ শুনিয়া রাজা সাংঘাতিক কথা।
মন্ত্রিবর্গ সহ গেলা পুত্ৰ আছে যথা।।
এথা প্রভু কমলাক্ষ লোক ব্যবহারে।
পলাইয়া রহিলা উই-পোতার মাঝারে।।
মৃত সুত দেখি রাজা করে হায় হায়।
কমলাক্ষে চাহিতে কুবের উঠি ধায়।।
বহু অন্বেষিয়া তবে প্রভুকে পাইলা।
দেবীর বাটীতে আসি উপনীত হৈলা।।
রাজা কহে কমলাক্ষ তুমি দ্বিজরাজ।
কি লাগি কৈলা এই সাংঘাতিক কাজ।।
লজ্জা পাঞা প্রভু কৈল ইহ মরে নাই।
আছয়ে মুর্ছিত হঞা এখনি জীয়াই।।
এত কহি নারায়ণের শ্রীচরণামৃতে।
অভিষিক্ত করি জীগাইলা রাজসুতে।।
শ্রীহরির পদামৃতের অলৌকিক শক্তি।
মাহাত্মা না জানে তার ব্রহ্মা উমাপতি।।
তীর্থ স্নান দর্শনেতে যেই ফলোদয়।
বিষ্ণু পাদোদক স্মৃতি মাত্রে তাহা পায়।।
সজীব দেখিয়া পুত্রে রাজা হর্ষমনে।
তুষিলা দরিদ্রে আর দ্বিজে বহুধনে।।
সবে কহে মঙ্গল হইল ভাল ভাল।
শ্রীকুবের ভাবে গেল মহত জঞ্জাল।।
তবে কুবের তর্কপঞ্চানন জ্ঞানবান।
শুভদিনে পুত্রে কৈলা যজ্ঞসূত্র দান।।
পৌগণ্ড বয়সে হৈল দ্বি জাতি সংস্কার।
প্রভুর শ্রীমূৰ্ত্তি হৈল অতি চমৎকার।।
শ্রীঅদ্বৈত পড়ে তবে সাহিত্যাভিধান।
অলঙ্কার জ্যোতিষাদি কৈল সমাধান।।
এক দিন শুন এক অদ্ভুত বৃত্তান্ত।
দীপান্বিতা দিনে হৈল উৎসব একান্ত।
দেশের সকল লোক ভদ্র নীচ যত।
দেবীর বাটীতে আসি হৈল উপনীত।।
নানা নৃত্যগীত হৈল পূর্ব্বব্যবহারে।
প্রভু বসিলেন আসি সভার ভিতরে।।
রাজা কহে কমলাক্ষ এ কি ব্যবহার।
কালিকা না প্রণমিলা কি ভাব তোমার।।
প্রভু কহে পরংব্রহ্ম স্বয়ং ভগবান্।
তিহোঁ মোর সাধ্য বস্তু নহে কেহ আন।।
নানামতে যে ধেয়ায় তার বিড়ম্বনা।
বিজ্ঞজনে এক ইষ্ট করয়ে ভাবনা।।
পুত্রের কবিত্ব শুনি তর্কপঞ্চানন।
রাজপক্ষ হঞা কৈলা বিচার পত্তন।।
অহে কমলাক্ষ তুমি না পাইলা অন্ত।
এক ব্রহ্মের নানারূপ বেদের সিদ্ধান্ত।।
দেবদেবী দ্বেষ সেহি মহাপপকর।
পূজিবে দেবতা সবে হইয়া তৎপর।
ত্রেতা যুগে রামচন্দ্র সাক্ষান্নারায়ণ।
সীতা উদ্ধারিতে কৈলা দেবীর পূজন।।
জগন্মাতা ভগবতী অতি দয়াবতী।
তাঁরে ভক্তি মুক্তি পায় যত জ্ঞানী ব্রতী।।
অতএব কালীমায়ে করহ প্রণাম।
না রহিবে বিপদ সিদ্ধ হবে মনস্কাম।।
প্রভু করে শুন পিতা না করিও রোষ।
এক নিষ্ঠ না হইলে হয় বহু দোষ।।
যৈছে বৃক্ষমূলে জল করিলে সেচন।
শাখাপল্লবান্তে হয় তৃপ্তির সাধন।।
তৈছে সর্ব্ব দেব দেবীর মূল নারায়ণে।
পূজিলে সকল পূজা হয় সমাধানে।।
বিষ্ণুমায়া ভগবতী বহিরঙ্গা বলে।
যাঁহার মায়াতে জীব তত্ত্বজ্ঞান ভুলে।।
প্রাণিহিংসা যজ্ঞে যেই হয় উল্লাসিত।
সে দেবীর উপাসনা না হয় উচিত।।
তেঁহো যদি জগন্মাতা জগৎ তাঁর পুত্র।
সন্তান বধিতে কিবা আছে যুক্তি শাস্ত্র।।
কুবের কহে কুতর্ক বাদেতে কিবা ফল।
দেবীর নিন্দনে ফল হয় অমঙ্গল।।
যৈছে রাজা বিচারিয়া পাপীর শাস্তি করে।
সাধুগণে সুখ দেয় ধৰ্ম্ম অনুসারে।।
তৈছে দেবী সাধকেরে মুক্তিদান করে।
সাধারণ জীবে ডুবায় মায়া-রত্নাকরে।।
যজ্ঞার্থে পশুর বধ সেই নহে হিংসা।
মুক্ত হঞা স্বর্গে যায় পাইয়া প্ৰশংসা।।
প্রভু বৈল অনায়াস সিদ্ধোপায় সত্ত্বে।
কেনে কষ্ট পায় পিতৃ মাতৃ উদ্ধারিতে।।
হেন মতে পিতাপুত্রে বহু তৰ্ক হৈল।
সভাসহ সমস্ত লোক বিস্ময় মানিল।।
সর্ব্বরাধ্য মহাগুরু পিতৃদেব হন।
তাঁর সম্মান লাগি প্রভু হৈলা নিৰ্ব্বচন।।
প্রভু কহে পিতা মম অপরাধ ক্ষম।
এখনি দেবীরে মুঞি করিমু প্রণাম।।
এত কহি দেবীর আগে কৈলা নমস্কার।
হেন কালে হৈল এক অতি চমৎকার।।
দেবী অন্তৰ্দ্ধানে সেই প্রতিমা ফাটিল।
তাহা দেখি লোক সব বিস্মিত হইল।।
ইহার কারণ সেই প্রতিমা চেতনা।
নিজ প্রভু দেখি ঐছে করিলা ঘটনা।।
রাজা আর মন্ত্রীবর্গ কুবের আচার্য্য।
শুদ্ধ হৈলা হঠাৎ দেখি পরম আশ্চর্য্য।।
তবে প্রভু কমলাক্ষ হরি হর রূপী।
অন্তর্হিত হইলেন গৌরলীলা জপি।।
দ্বাদশ বর্ষ বয়ঃক্রমে শান্তিপুরে গেলা।
ষড়দর্শন শাস্ত্র ক্রমে পড়িতে লাগিলা।।
শ্রীগৌরাঙ্গ শ্রীঅদ্বৈত পদে যার আশ।
নাগর ঈশান কহে অদ্বৈত প্রকাশ।।৭ ॥
ইতি শ্রীঅদ্বৈত প্রকাশে দ্বিতীয়োহধ্যায়ঃ।।