সপ্তদশ অধ্যায়
জয় জয় শ্রীচৈতন্য জয় সীতানাথ।
জয় নিত্যানন্দ রাম ভক্তগণ সাথ।।
তবে মহাপ্রভু শ্রীপ্রয়াগ-ধামে আইলা।
এক দ্বিজ বৈষ্ণবের ঘরে বাসা কৈলা।।
ত্রিবেণীতে স্নান করি মাধব দর্শন।
শুষ্ক প্রেমানন্দে করে নর্ত্তন কীৰ্ত্তন।।
শত অষ্ট-অঙ্গ কৈলা মহা ভাবাবেশে।
বহু স্তবন কৈলা নাহি তার শেষে।।
তঁহি শ্রীচৈতন্য প্রেম নাম বিস্তারিলা।
যার কোটি ভাগ্য সেই বৈষ্ণব হইলা।।
এক দিন শ্রীরূপগোসাঞি সুপন্ডিত।
শ্রীপ্রয়াগ তীর্থে আসি হৈল উপনীত।।
রামকেলীবাসি যিহোঁ রাজমন্ত্রী ছিলা।
চৈতন্য কৃপায় বিষ বিষয় ছাড়িলা।।
তাঁর সঙ্গে আইলা তাঁর ভাই অনুপম।
পরম উদার তিহোঁ ভাগবতোত্তম।।
তাঁহা শ্রীগৌরাঙ্গ সহ রূপের মিলনে।
যে আনন্দ হৈল তাহা না যায় বর্ণনে।।
শ্রীগৌরাঙ্গ দেখি রূপ প্রেমার্দ্র হইলা।
শত অষ্ট-অঙ্গ করি বহু স্তব কৈলা।।
গৌরে দেখি অনুপমের প্রেমোদ্গম হৈল।
গলে বস্তু বান্ধি দণ্ডবত স্তুতি কৈল।।
শ্রীচৈতন্য দুহুঁ জনে কৈলা আলিঙ্গন।
দোঁহে কহে মোরা হঙ অস্পৃশ্য অধম।।
গোরা কহে কৃষ্ণভক্ত সৰ্ব্ব-শ্রেষ্ঠ হয়।
ভক্তি-রস যোগে নীচ দ্বিজত্ব লভয়।।
ব্রাহ্মণের দ্বাদশ গুণ আছে শাস্ত্রে উক্তি।
সেই সভ গুণ ভক্তির আনুসঙ্গিক বৃত্তি।।
যৈছে প্রভু গমনে তাহার ভৃত্যগণ।
আনুসঙ্গিক রূপে তারা করয়ে গমন।।
শ্রীরূপ গোপাঞি কহে এই সত্য হয়।
কাঁহা ভক্তি পাইবাঙ কহ সুনিশ্চয়।।
শ্রীঅচ্যূত কহে ভক্তি মন্দাকিনী তীরে।[১]
বাস করি কোন জন পিপাসায় মরে।।
রূপ কহে চাতকের সে ভাগ্য বা কতি।
কৃষ্ণ দয়া মেঘ বিনা নাহি তৃপ্তি।।
মহাপ্রভু কহে ভক্তি অমূল্য রতন।
সাধু কৃপায় লভ্য হয় কহে শ্রুতিগণ।।
ভাগ্যে তোঁহে হৈল কোন সাধু জনের দয়া।
তাহাতে তেজিলা ভোগ্য সংসারের মায়া।।
ভক্তিদেবীর আবির্ভাবে মায়ার অন্তর্দ্ধান।
সিংহ সমাগমে যৈছে হস্তীর প্রস্থান।।
শ্রীরূপ কহয়ে মুঞি সাধু নাহি চিনি।
তুয়া আকর্ষণে আইনু এই মাত্র জানি।।
লৌহ যৈছে অয়স্কান্তের শক্তি নাহি জানি।
গমন করয়ে মাত্র আকর্ষণ গুণে।।
মহাপ্রভু কহে কাহে কর দৈন্যপণা।
কোন সম্ভাব হৈল তুয়া হৃদয়ে ধারণা।।
তোরা কৃষ্ণের নিত্য পরিকর অনুমানি।
তাহার লক্ষণ সর্ব্ব সাধু মুখে শুনি।।
জীবে দয়া সাধু-সঙ্গ আত্ম-দৈন্য উক্তি।
এই তিন কৃষ্ণদাসের স্বাভাবিক বৃত্তি।।
তবে সনাতনের বাৰ্ত্তা পুছে ব্যগ্র হঞা।
শ্রীরূপ কহয়ে তাঁরে রাখিলা বান্ধিয়া।।
দয়া করি নিজ জনে খন্ডাহ বন্ধন।
তুয়া পদে কৈবের্রা মোর আত্ম-সমর্পণ।।
গোরা কহে কৃষ্ণ-ভক্তের নাহিক বন্ধন।
ঝাট তব সঙ্গে তার হইব মিলন।।
রূপ কহে তব বাক্য অমোঘ নিশ্চয়।
শ্রীঅচ্যূত কহে সেই মহাবেদ হয়।।
তবে গোরা রূপ অনুপম দুই জনে।
সাধ্য সাধন শিখাইলা ভক্তানুসন্ধানে।।
শ্রীরূপ-গোসঞি ছিলা মহা কবিবর।
চৈতন্য কৃপায় হৈলা ভক্তি-রত্নাকর।।
এক দিন গোরা কহে রূপ অনুপমে।
বৃন্দাবন ধামে দোঁহে করহ পয়ানে।।
করযোড়ে রূপ কহে শুন গৌরচন্দ্র।
তোমা ছাড়ি ব্রজে যাইতে না পাঙ আনন্দ।।
গোরা কহে ব্রজ হয় চিদানন্দ ধাম।
স্বয়ং ভগবানের তাঁহা নিত্যলীলা স্থান।।
কালক্রমে সেই স্থল হৈল লুপ্তকার।
সাধুর কর্তব্য-কার্য্য তাহার উদ্ধার।।
ভক্তির প্রচার ভক্তি শাস্ত্রের গ্রহণ।
লুপ্ত তীর্থ উদ্ধার তিন মুখ প্ৰয়োজন।।
ইহা লাগি যাহ ঝাট শ্রীবৃন্দাবনে।
কৃষ্ণ কৃপায় হৈব তব অভীষ্ঠ পূরণে।।
রূপ কহে তব দিব্য ভঙ্গী বুঝা ভার।
মুঞি ক্ষুদ্রতমে কৈলা আজ্ঞা গুরুতর।।
সকলি সম্ভবে তোমার দয়া মহাবলে।
কুকুর মৃগেন্দ্র হৈতে পারে অবহেলে।।
এত কহি শ্ৰীকৃষ্ণ চৈতন্যে প্রণমিয়া।
রূপ অনুপম ব্রজে চলে মৌন হঞা।।
তবে প্রয়াগ হৈতে গৌর বারানসী গেলা।
চন্দ্রশেখর তাঁরে দেখি নিজ ঘরে নিলা।।
চন্দ্রশেখর কহে আজি মহাভাগ্য গুণে।
স্বপ্নে তুহুঁ দয়া করি দিলা দরশনে।।
গোরা কহে কৃষ্ণভক্তের অচিন্ত্য মহত্ব।
ভাবাবেশে জানে তারা ত্রিকালের তত্ত্ব।।
চন্দ্রশেখর কহে মুঞি হঙ নরাধম।
শ্রীচৈতন্য কহে তুহুঁ সাধক উত্তম।।
তাঁহা হৈল তপন মিশ্র সহ সম্মিলন।
সবান্ধবে মিশ্র করে গৌরাঙ্গ সেবন।।
দিন কত কাশীধামে শ্ৰীকৃষ্ণ-চৈতন্য।
নাম বিতরিয়া বহু জনে কৈলা ধন্য।।
এক দিন তহি মণিকণিকার তীর্থে।
দিগম্বর এক ন্যাসী গেলা স্নান অর্থে।।
হেন কালে শ্রীঅচ্যুত গঙ্গাস্নান করি।
তীরে উঠে শ্রীকৃষ্ণ চৈতন্য নামোচ্চরি।।
তাঁরে দেখি ন্যাসী কহে তব ঘর বঙ্গে।
ভ্রম জ্ঞানে ঈশ্বরত্বে স্থাপহ গৌরাঙ্গে।।
সত্য করিয়াছে তিঁহ সন্ন্যাস গ্রহণ।
ন্যাসী ধর্ম্ম ছাড়ি করে হরি-সংকীর্ত্তন।।
শুনিয়াছে তিহঁ ইন্দ্রজাল বিদ্যাগুণে।
ভুলাইলা উড়িষ্যার জ্ঞানী সাৰ্ব্বভৌমে।।
বেদের বিরুদ্ধ কার্য্য করে সর্বক্ষণ।
যবন সংসর্গে নাহি মানয়ে দূষণ।।
ছলে তেহ ম্লেচ্ছ যদি কহে হরিনাম।
তারে আলিঙ্গিতে নাহি করে ধর্মজ্ঞান।।
এত ভ্রষ্টাচারে লোক তার বশ্য হয়।
ইন্দ্রজাল বিনা ইহা মূল কি আছয়।।
শ্রীচৈতন্যের নিন্দাবাদ শুনি শ্রীঅচ্যুত।
মৃদু ভাবে কহে মনে হইয়া ব্যথিত।।
অহে দিগম্বর ন্যাসী শুন মোর বাণী।
ঈশ্বর লক্ষণ যাহে তারে ঈশ্বর মানি।।
বত্রিশ লক্ষণ মহাপুরুষের হয়।
সেই সব গৌরের আনুষঙ্গিক গণয়।।
স্বয়ং ভগবত্বে স্বাভাবিক গুণ চিহ্ন।
শ্রীকৃষ্ণ-চৈতন্যে তাহা আছে পরিপূর্ণ।।
সেই সব গুণ চিহ্ন ভক্তি-নেত্রে স্ফুলে।
কোটী পূণ্যে তাহা জীব দেখিতে না পারে।।
ন্যাসী কহে পরব্রহ্ম হয় নিরাকার।
সাকার কল্পনা মাত্র সাধু ব্যবহার।।
শ্রীঅচ্যূত কহে সেই কল্পিত অসত্যে।
ভজি কৈছে লভ্য হৈব পরব্রহ্ম সত্যে।।
ন্যাসী কহে সৰ্ব্বরূপে নিত্য ব্রহ্মের সত্তা।
তদেকাত্ম-জ্ঞানে মুক্তির নাহিক অন্যথা।।
শ্রীঅচ্যুত কহে বিশ্বে ব্রহ্মে কিবা ভেদ।
ন্যাসী কহে জগৎ সৰ্ব্ব ব্রহ্মেতে অভেদ।।
শ্রীঅচ্যূত কহে তবে ব্রহ্মৈকাংশ বিশ্ব।
ন্যাসী কহে সত্য সেই সর্ব্ব রূপে দৃশ্য।।
শ্রীঅচ্যূত কহে ব্ৰহ্ম আত্মা ভগবান।
সচ্চিৎ আনন্দময় বেদেতে প্রমাণ।।
স্বেচ্ছা শক্তি দ্বারে তিঁহ হয় বহু রূপী।
নিত্য এক রূপ তাঁর তেজ সর্বব্যাপী।।
আব্রহ্ম স্তব পৰ্য্যন্ত যত চরাচর।
সমস্ত জানিহ ঈশ্বরাংশ অবতার।।
অংশে অবতরে পরিপূর্ণ কৈছে বাধা।
সৰ্ব্ব শক্তিমানে কিছু না করিতে দ্বিধা।।
যাঁহার অবিদ্যা শক্তি কটাক্ষের দ্বারে।
জলৌকার শক্তি দেহ সঙ্কোচ বিস্তারে।।
সেই ষড়ৈশ্বর্য-পূর্ণ ভগবদ্ধিগ্রহে।
ব্যাপ্য ব্যাপকতা শক্তির নাহিক সন্দেহে।।
ধৰ্ম্ম সংস্থাপন লাগি স্বয়ং ভগবান।
স্বয়ং প্রকটিয়া করে জীবের কল্যাণ।।
ইত্যাদি অনেক যুক্তি শাস্ত্রের প্রমাণে।
ন্যাসীর কুতর্ক বাদ করিলা খণ্ডনে।।
বিস্ময় হঞা ন্যাসী কহে করিনু স্বীকার।
জীব হিত লাগি ঈশ্বর করে অবতার।।
কলিতে ঈশ্বরের অবতার কি প্রমাণে।
শ্রীঅচ্যূত কহে তবে শুন সাবধানে।।
ভগবানের অবতার অসংখ্যেয় হয়।
বেদ পুরাণ্যদি শাস্ত্রে ফুকারিয়া কয়।।
চারি যুগে হয় কৃষ্ণ চারি অবতার।
শুক্ল রক্ত কৃষ্ণ পীত রূপে পরচার।।
কলিতে ভকত রূপে হৈলা অবতীর্ণ।
সেই পীতবর্ণ এই শ্রীকৃষ্ণ-চৈতন্য।।
দয়া করি নবদ্বীপে হৈলা শুভোদয়।
স্বয়ং ধৰ্ম্ম আচরিয়া জীবেরে শিক্ষায়।।
মায়াধীনে জীব সম দেখয়ে অভক্ত।
পিত্ত দুষিত নেত্রে যৈছে শঙ্খে দেখে পীত।।
ন্যাসী কহে সেই এই ইথে কি প্রমাণ।
শ্রীঅচ্যূত কহে সাক্ষী রূপ গুণ নাম।।
গৌরাঙ্গ গৌরাঙ্গ বলি ডাক এক বার।
রোমাঞ্চ হইবে দেহে অতি চমৎকার।।
শুনি ন্যাসী শ্রীগৌরাঙ্গ নাম উচ্চারিলা।
ভক্ত বাক্যে গৌর কৃপা-জ্যোৎস্না বিস্তারিলা।।
কৃষ্ণ-ভক্তের সঙ্গালাপের অবিচিন্ত্য গুণে।
পুলক ধরিলা তেঁহ কদম্বের সমে।।
আশ্চৰ্য্য মানিয়া ন্যাসী ফুকারিয়া কয়।
শ্রীচৈতন্য অপ্রাকৃত নাহিক সংশয়।।
শ্রীগৌরাঙ্গ নাম শুদ্ধ-প্রেম রসময়।
সিদ্ধ হরি নামাপেক্ষা মাধুৰ্য্যাতিশয়।।
এবে কাঁহা রহে গোরা তাঁহা মুঞি যাঙ।
তানে দেখি দেহ মন পরাণ জুড়াঙ।।
শ্রীঅচ্যূত কহে তুহুঁ চল মোর সঙ্গে।
জীবন সফল কর দেখি শ্রীগৌরাঙ্গে।
কিন্তু তোঁহে দিগম্বর দেখি গৌরচন্দ্র।
লজ্জিত হইব বড় আর নিরানন্দ।
ন্যাসী কহে অযাচকে কেবা বস্ত্ৰ দিব।
শ্রীঅচ্যূত কহে মোর স্থানে লভ্য হৈব।
এত কহি অৰ্দ্ধ-বস্ত্ৰ ছিণ্ডি দিলা তারে।।
ন্যাসী তাহা পরিলা সজ্জন ব্যবহারে।
তারা দোঁহে শ্রীচৈতন্য-পাশে গেলা।
শ্রীঅচ্যুত গৌর পদে দণ্ডবত কৈলা।।
ন্যাসী এক দৃষ্টে চাহে গৌরাঙ্গের পানে।
গোরা অঙ্গে বিশ্বরূপ দেখে ভাগ্যে ক্রমে।।
অত্যন্ত অদ্ভুত দিব্য মহিমা দর্শনে।
প্রেম-গঙ্গা-ধারা ন্যাসীর বহে দুনয়নে।।
করযোড়ে শ্রীচৈতন্য করয়ে স্তবন।
তুহুঁ সর্ব্বেশ্বর সাক্ষাৎ ব্রজেন্দ্ৰ-নন্দন।।
লোক শিক্ষাইতে আইলা ভক্তরূপ ধরি।
তোঁহার নিৰ্ম্মল দয়ায় যাঙ বলিহারি।।
মুঞি নরাধম তুয়া না জানি মহত্ব।
অনেক নিন্দিনু অহঙ্কারে হঞা মত্ত।।
দয়া করি অপরাধ করহ মার্জ্জন।
তব শ্রীচরণে মুঞি লইনু শরণ।।
ইত্যাদি অনেক দৈন্য স্তবন করিয়া।
গৌর-পদে পড়ে ন্যাসী দণ্ডবত হঞা।।
নমো নারায়ণ বলি গোরা তাঁরে ছুইলা।
স্পর্শ ছলে তাহে আত্মশক্তি সঞ্চালিলা।।
গৌর স্পর্শমণির স্পর্শে প্রেম উপজিল।
উর্দ্ধবাহু হঞা ন্যাসী নাচিতে লাগিল।।
হুঙ্কার গর্জ্জন করে লোকে ভয়ঙ্কর।
শ্রীচৈতন্য সর্ব্বেশ্বর বোলে বারে বার।।
শ্রীঅচ্যূত নাচে আর নাচে ভক্তগণ।
ধন্য কলিযুগ বলি করয়ে কীৰ্ত্তন।।
সাধু কৃপায় ন্যাসীবর হইলা উদ্ধার।
সাধুর চরণে মোর কোটি নমস্কার।।
সাধুর চরিত্র সব নারিনু লিখিতে।
যে কিছু লিখিনু শ্রীবৈষ্ণব পরসাদে।।
কাশী পূর্ণ হৈল গোরার প্রভাব-সম্বন্ধে।
অনেক বৈষ্ণব হৈলা সেই অনুবন্ধে।।
তথি শ্রীপ্রবোধানন্দ সরস্বতী খ্যাতি।
সন্ন্যাসীর মধ্যে যিহঁ বুদ্ধ্যে বৃহস্পতি।।
বহু শাস্ত্রবেত্তা পণ্ডিতের শিখামণি।
গৌরাঙ্গ নিন্দিয়ে তিঁহ হঞা অভিমানী।।
দয়াসিন্ধু শ্রীচৈতন্য দয়া প্ৰকাশিলা।
বহু শাস্ত্রযুক্ত্যে তারে স্বমতে আনিলা।।
শ্রীপ্রবোধানন্দের সব খণ্ডিল সংশয়।
গৌরাঙ্গে ঈশ্বর বলি করিলা নিশ্চয়।।
শ্রীপ্রবোধানন্দে গোরা বড় দয়া কৈলা।
শক্তি সঞ্চারিয়া তারে প্রেম-ভক্তি দিলা।।
পরম বৈষ্ণব হৈল শ্রীপ্রবোধানন্দ।
খণ্ডিল কুতর্ক বাদ পাইল প্রেমানন্দ।।
সরস্বতী হৈলা গৌরের ভকত প্রবীণ।
কৃত পীত রূপে প্রকট রহে রাত্রি দিন।।
সংকীর্ত্তনে অশ্রুধারা বহে দু নয়নে।
কভু গড়াগড়ি যায় নাহি স্থানাস্থানে।।
কভু নৃত্য করে প্রেমে ঊর্দ্ধবাহু হঞা।
আপনারে নিন্দি কভু কান্দে ফুকারিয়া।।
শ্রীগৌরাঙ্গে স্তব করে পদ্য বিরচিয়া।
অদ্ভুত বর্ণনে জীব উঠে শিহরিয়া।।
তার ছাত্র আদি যত পণ্ডিতের গণ।
গৌরাঙ্গ পদারবিন্দে লইলা শরণ।।
গোরাচাঁদের দিব্যাদ্ভূত লীলার নাহি অন্ত।
মুঞি ছার কি করিমু না পারে অনন্ত।।
শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য শুদ্ধ দয়ার ভাণ্ডার।
সনাতনে শিক্ষাইলা ভক্তি তত্ত্বসার।।
গোরা সহ সনাতনের কাশীতে মিলন।
মহাপ্রভুর আজ্ঞায় তিঁহ গেলা বৃন্দাবন।।
শ্রীমান সনাতন হয় সৰ্ব্বশাস্ত্র জ্ঞাতা।
পরম বৈরাগ্যে শ্রীরূপের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা।।
ব্রজে শ্রীগোবিন্দ মূর্ত্তি শ্রীরূপ স্থাপিলা।
সনাতন মদনগোপালে প্রকাশিলা।।
এই দুই ভাই মহা সাধু দয়াবান্।
ভক্তি-শাস্ত্র প্রকাশিয়া ভক্তে কৈলা দান।।
এই দোঁহার ভ্রাতুষ্পুত্র শ্রীজীব গোসাঞি।
ভক্তি-শাস্ত্র সুসিদ্ধান্তে তার সম নাঞি।।
শ্রীগোপাল ভট্ট শ্রীমান ভট্ট রঘুনাথ।
পরম পণ্ডিত আর দাস রঘুনাথ।।
এই সব নির্ম্মৎসর ভক্তি-শাস্ত্রে নেতা।
লুপ্ততীর্থ-প্রকাশক গোস্বামী আখ্যাতা।।
মহাপ্রভু আর দুই প্রভুর সম্মতে।
ভক্তিশাস্ত্র ভক্তিবর্ম করিলা বিদিতে।।
মোর প্রভু এই ছয়ের গুণ প্রসংশয়।
কৃষ্ণ নিত্যা সখীর মঞ্জরী বলি কয়।।
মহাপ্রভু এক মাত্র শ্রীচৈতন্য হয়।
নিত্যানন্দাদ্বৈত দোঁহে প্রভুতে গণয়।।
গদাধর পণ্ডিত শ্রীবাসে কহে তত্ত্ব।
দ্বাদশ গোপাল আর চৌষট্টি মহান্ত।।
তাহা লিখি যাহা মুঞি সাধু-মুখে শুনি।
অসংখ্য গৌরাঙ্গগণের মহিমা না জানি।।
তবে মহাপ্রভু বারাণসী ধাম হৈতে।
পুন ঝারিখন্ডের পথে আইলা শ্রীক্ষেত্রে।।
মহাপ্রভুর দরশনে যত ভক্তগণ।
প্রেমাবেশে আনন্দাশ্রু কৈলা বরিষণ।
রায় রামানন্দ আদি দন্ডবৎ কৈলা।
বাহু পশারিয়া গোরা সভে আলিঙ্গিলা।।
শ্রীকৃষ্ণ-চৈতন্য দ্বিজরাজের জ্যোৎস্নায়।
সংকীর্ত্তন-সুধা সিন্ধুর তরঙ্গ বাঢ়য়।।
সর্ব্বভক্ত মেলি করে মহা সংকীর্ত্তন।
মনুষ্য কি ছার দেবে করে আকর্ষণ।।
শ্রীচৈতন্য শ্রীঅদ্বৈত পদে যার আশ।
নাগর ঈশান কহে অদ্বৈত-প্ৰকাশ।।
ইতি শ্রীঅদ্বৈত-প্রকাশে সপ্তদশোহধ্যায়ঃ।
—-
১. বৃন্দাবন-প্রয়াগ সহ উত্তর ভারতে মহাপ্রভুর সঙ্গে অচ্যুতের সাহচর্য বিশেষ উল্লেখের যাথার্থ দাবি করা অমূলক নয়।