ত্রয়োদশ অধ্যায়
জয় জয় শ্রীচৈতন্য জয় সীতানাথ।
জয় নিত্যানন্দ-রাম ভক্তগণ সাথ।।
এবে শুন কহি এক অপূৰ্ব্ব আখ্যান।
নবদ্বীপে আইলা ঈশ্বরপুরী সর্ব্ব জান।।
শ্রীউজ্জ্বল রস-রূপ প্রভু যারে কয়।
যাহার দর্শনে প্রেমভক্তি উপজয়।।
পরম বৈষ্ণব পুরী বিরক্ত উদাস।
আদ্যে উত্তরিলা প্রভু অদ্বৈতের বাস।।
তেজস্বী সন্ন্যাসী বড় দেখি সীতানাথ।
নমো নারায়ণ বলি কৈলা দণ্ডবৎ।।
শ্রীঅদ্বৈত দেখি পুরী মনে কৈলা ধার্য্য।’[১]
ইহো বুঝি কৃষ্ণ প্রকটের মূলাচার্য্য।।
শ্রীমাধবেন্দ্রের শিষ্য শ্রীঈশ্বরপুরী। [২]
পরিচয় পাঞা প্রভুর ঝোরে প্রেম-বারি।।
তবে দোহার কৃষ্ণকথার তরঙ্গ বাঢ়িল।
ক্রমে দোঁহে প্রেমামৃত সাগরে ডুবিল।।
ক্ষণে কান্দে ক্ষণে হাসে ক্ষণে মূৰ্চ্ছা হৈল।
সীতানাথ পুরীরাজে ভিক্ষা করাইল।।
তবে পুরী নবদ্বীপে করয়ে ভ্রমণ।
শুভক্ষণে শ্রীগৌরাঙ্গ পাইলা দর্শন।।
গৌরচন্দ্রের অঙ্গকান্তি কোটি সূৰ্য্যসম।
দেখি পুরীর হৈল মহাভাবের উদ্গম।।
পুরী ভাবে ইহোঁ সত্য স্বয়ংভগবান।
গৌররূপে নবদ্বীপে হৈলা অধিষ্ঠান।।
জ্যোতির্ম্ময় পুরীরাজ দেখি বিশ্বম্ভর।
ভাবে ইহোঁ মহাভাগবত ন্যাসীবর।।
আশু গিয়া গৌর তানে কৈলা পরণাম।
পুরী কহে সিদ্ধ হৈব তোর মনস্কাম।।
দোঁহার প্রসঙ্গে দোঁহার হৈল পরিচয়।
দোঁহে শাস্ত্রালাপ করি আনন্দে ভাষয়।।
তবে গৌর পুরীরাজে আগ্রহ করিয়া।
ভিক্ষা করাইলা তানে নানা দ্রব্য দিয়া।।
দিন কত পুরী তাঁহা বিশ্রাম করিলা।
গৌর প্রকাশের গৌণ দেখি তীর্থে গেলা।।
এক দিন শ্রীগৌরাঙ্গ কহে শচী পাশে।
শিষ্যগণ লঞা মাগো যাঙ পূৰ্ব্বদেশে।।[৩]
ফিরি আসিবাঙ ঝাট প্রবাস করিয়া।
মো বিপদ চিন্তা না করিহ দুঃখী হঞা।।
ঘরে বসি কর মাগো কৃষ্ণ আরাধনা।
প্রেমানন্দে রহিলে না ঘটিবে যন্ত্রণা।।
এত কহি শচী পদে কৈলা নমস্কারে।
মাতা আশীৰ্ব্বাদে কৈলা ব্যথিত অন্তরে।।
তবে গৌরচন্দ্র পূর্ব্ব দিগেরে চলয়।
পদ্মনাভের ঘরে যাঞা হইলা উদয়।।
মহাপ্রভুর সঙ্গী লোকনাথ চক্রবর্ত্তী।
পিতারে ফুকারি কহে হও অগ্রবর্ত্তী।।
পদ্মনাভ চক্রবর্ত্তী পরম পবিত্র।
যেহোঁ শ্রীঅদ্বৈতচন্দ্রের হন কৃপাপাত্র।।
নবদ্বীপে কৃষ্ণ গৌররূপী স্বপ্রকাশ।
প্রভুর কৃপাবলে তিহোঁ জানে তদাভাস।।
পূৰ্ব্বোঞি জানিলা তেহোঁ ভাবের আবেশে।
গৌররূপ স্বয়ং কৃষ্ণ আইলা মোর বাসে।।
আগুলিয়া আইলা দ্বিজ বস্ত্ৰ বান্ধি গলে।
গৌরাঙ্গে দেখিয়া তিহোঁ চিনে অবহেলে।।
দন্ডবৎ হঞা পড়ে মহাপ্রভুর আগে।
বিষ্ণু বিষ্ণু বলি গৌর যায় অন্য দিগে।।
পদ্মনাভ কহে গৌর না ভান্ডিহ মোরে।
তোর গূঢ় তত্ত্ব স্থিতি ভক্তের অন্তরে।।
তুমিহ সাক্ষাৎ কৃষ্ণ সর্ব্ব রস-পূর্ণ।
জীব নিস্তারিতে স্বয়ং হৈলা অবতীর্ণ।।
এত কহি দিব্যাসন করিলা প্রদান।
বিষ্ণু স্মরি গৌর তাহে কৈলা অধিষ্ঠান।।
পদ্মনাভ তারে সৎকার কৈলা বিধিমত।
মহাপ্রভু তথি বাস কৈলা দিন কত।।
নিমাঞি পন্ডিত আইলা হৈল মহাধ্বনি।
পন্ডিতের গণ আইলা আর যত জ্ঞানী।।
দেখিতে আইলা শত শত ধনী মানী।
আবাল বৃদ্ধ যুবা আর যতেক রমণী।।
মহা কোলাহাল হৈলা গৌর দেখিবারে।
যুক্তি করি গোরা উঠে অট্টালিকা পরে।।
অতি সমুজ্জ্বল হেম-কান্তি গৌররূপ।
আজানুলম্বিত বাহু রসামৃত কুপ।।
চঞ্চল নয়ন মুখ পর প্রফুল্লিত।
বাম ভুজে অচ্যুতের কন্ঠ আলিঙ্গিত।।
অপূর্ব্ব রূপ গঙ্গামৃতে সভে স্নান কৈলা।
কেহ ভাগ্যে তাহা পিয়া উনমত্ত হৈলা।।
কেহ বহু অশ্রুপাত কৈলা প্রেমাবেশে।
কেহ ঊৰ্দ্ধবাহু হঞা নাচয়ে হরিষে।।
রাত্রে মহাসভা কৈলা মিলি বিজ্ঞ জন।
চতুৰ্দ্দিকে দীপ জলে যৈছে মণিগণ।।
শিষ্যগণ লঞা গৌর সভাতে আইলা।
দেখি সভে সসম্ভ্রমে গাত্রোখান কৈলা।।
সভা মাঝে গৌরচন্দ্র বৈসে চন্দ্র সম।
তানে বেরি বৈসে সুধী যৈছে তারাগণ।
তাহে এক সুধী বিপ্র তর্ক-চূড়ামণি।।
শাস্ত্রে সুনিপুণ পণ্ডিতের শিরোমণি।
তর্ক শাস্ত্রের প্রশ্ন এক কৈলা উত্থাপন।
শুনি মাত্র শ্রীগৌরাঙ্গ করিলা খণ্ডন।।
সেই দ্বিজ পুনঃ পুনঃ করহে স্থাপন।
অবহেলে মহাপ্রভু করয়ে খণ্ডন।।
পূৰ্ব্ব পক্ষ উড়ি গেল স্থাপিতে নারিলা।
তবে পন্ডিতের গণ পরাস্ত মানিলা।।
সভে কহে নিমাঞি বিদ্যাসাগরের নাম।
শুনিছিলু দৈব্য বিদ্যা হৈল সপ্রমাণ।।
এক দিন বিষ্ণুভক্ত এক দ্বিজবর।
কর জোড়ে কহে মহাপ্রভুর গোচর।।
কলি ঘোর পাপাচ্ছন্ন নিরখি সংসার।
কহ কৈছে জীবগণ হইব নিস্তার।।
শুনি মহাপ্রভু কহে হরিনাম সার।
শ্রবণ গ্রহণে জীব হইল উদ্ধার।।
হরিনাম বিনে জীবের নাঞি অন্য গতি।
নামে সৰ্ব্ব পাপ খণ্ডে পায় শুদ্ধ ভক্তি।।
তাহা শুনি দ্বিজবরের হৈল প্রেমোল্লাস।
হরি বলি নাচে কান্দে নাহি বাহ্যাভ্যাস।।
তাহা দেখি হাসে যত পাষণ্ডীর গণ।
মহা সুখী হৈল কৃষ্ণ বৈষ্ণবের মন।।
পদ্মনাভ চক্রবর্ত্তীর অতি ভাগোদর।
তার ঘরে শ্রীচৈতন্যের হইল বিজয়।।
তবে গৌর ক্রমে আইলা পদ্মাবতী তীরে।
পদ্মা দেখি গোরা কহে আনন্দ অন্তরে।।
এই পদ্মাবতী লক্ষ্মীর দ্বিতীয় শরীর।
ইথে স্নানে পাপ ক্ষয় হইবেক স্থির।।
তবে সেই পূণ্য-পদ্মাবতী নদী তীরে।
রম্য স্থানে রহি গোরা আনন্দে বিহরে।
গৌরাঙ্গ সদগঙ্গ চতুর্দিগে বিস্তারিল।
পরস্পরে সাধুগণ কহিতে লাগিল।।
গঙ্গার পূর্ব্ব তটে নবদ্বীপ সুধী স্থল।
তাঁহা হইতে আইলা এক পন্ডিত প্রবল।।
বিদ্যাসাগর উপাধিক নিমাঞি পণ্ডিত।
বিদ্যাসাগর নামে টীকা যাঁহার রচিত।।
শব্দ শুনি বহু বিজ্ঞগণ তথি আইলা।
গৌরাঙ্গ দর্শনালাপে পবিত্র হইলা।।
অধ্যাপকগণ আইলা নানা দ্রব্য লঞা।
আনন্দিত হৈলা গৌর সহ আলাপিঞা।।
শাস্ত্রজ্ঞ বহুত ছাত্র আইলা পড়িবারে।
তান স্থানে অল্প পড়ি উপাধিক ধরে।।
হেথা শ্রীগৌরাঙ্গ-বিচ্ছেদ ভূজঙ্গ দংশনে।
নবদ্বীপে লক্ষ্মীদেবী হৈলা অন্তৰ্দ্ধানে।।[৪]
কিছু দিন পরে শ্রীমান্ শচীর নন্দন।
নিজধামে যাইবারে করিলা মনন।।
হেনকালে এক দ্বিজ ধাৰ্ম্মিক প্রবর।
স্বপ্ন দেখি আইলা মহাপ্রভুর গোচর।।
অষ্ট অঙ্গে গৌর পাদপদ্মে প্রণমিলা।
গোপনে স্বপন তত্ত্ব সভ প্রকাশিলা।।
গৌর কহে এই কথা রাখিহ গোপনে।
এবে কাশীধামে তহিঁ করহ প্রস্থানে।।
আমা সহ তহিঁ কালে সাক্ষাত হইবে।
তব মন অভিলাষ অবশ্য পুরিবে।।
তপন মিশ্র নাম তার সরল হৃদয়।
কাশীধামে গেলা মহাপ্রভুর আজ্ঞায়।।
ঐছে পূৰ্ব্ব বঙ্গদেশ কৃতার্থ করিয়া।
দেশে চলে বিশ্বন্তর বহু অর্থ লঞা।।
তবে শ্রীগৌরাঙ্গ নবদ্বীপে উত্তরিলা।
লক্ষ্মীর তিরোভাব শুনি দুঃখ প্রকাশিলা।।
শ্রীশচী মাতাকে দেখি অতি শোকমনা।
নানা যোগ কহি তানে করিল সান্ত্বনা।।
তবে গৌরের ভক্ত আর প্রিয় বন্ধুগণ।
গৌরাঙ্গের বিবাহ তথি কৈলা সংঘটন।।
রাজপন্ডিত সনাতন মিশ্র দ্বিজরায়।
শ্রীসত্রাজিতাবির্ভাব প্রভু যাঁরে কয়।।
তান কন্যা বিষ্ণুপ্রিয়া সাধ্বী শিরোমণি।
সৰ্ব্ব সদ্গুণ সম্পর্ণা রূপামৃতের খনি।।
শ্রীসত্যাহ্লাদিনী লক্ষ্মী প্রভু যারে কয়।
তাঁহারে শ্রীগৌরচন্দ্র কৈলা পরিণয়।।
তাহে মহোৎসব হৈল শচীর মন্দিরে।
পুত্রবধূ পাঞা শচী আনন্দে বিহরে।।
শ্রীঅচ্যূত কহে মোরে এই শুভাখ্যান।
তার সূত্র সব মাত্র করিনু ব্যাখ্যান।।
শ্রীচৈতন্য শ্রীঅদ্বৈত পদে যার আশ।
নাগর ঈশান কহে অদ্বৈত প্রকাশ।।
ইতি শ্রীঅদ্বৈত প্রকাশে ত্রয়োদশোধ্যায়ঃ।
—
১. ‘পুরী’ পদবিধারী সন্ন্যাসীদের নিয়ে ইতোপূর্বে আলোচিত হয়েছে। প্রসঙ্গত সুপ্রিম কোর্ট একটি গুরুত্বপূর্ণ রায় দিয়েছেন ২৪ নভেম্বর, ১২৬৪। গুরু-শিষ্য পরম্পরার (গদি/মোহন্ত) আইনগত ভাবেও সিদ্ধ।
২. দশনামী সম্প্রদায় নিম্নরূপ : তীর্থ, আশ্রম, বন, অরণ্য, গিরি, পর্বত, সাগর, সরস্বতী, ভারতী ও পুরী।
৩. ঈশানের বিবরণ (শ্রীহট্টে) বিশদ। নীলাম্বর শচী পাঠিয়েছিলেন না বিশ্বন্তর নিজে প্রস্তাব করেছিলেন মতান্তর আছে। আহট্টে এই আগমন পরমানন্দে স্মরণ হয়।
৪. লক্ষ্মীদেবীর আকস্মিক লোকান্তর, ‘বিরহ-ভুতঙ্গ দংশন’, সর্বোপরি সব জীবনচরিতে দায়সারা বিবরণ আমাদের বিস্মিত করে।