একাদশ অধ্যায়
জয় জয় শ্রীচৈতন্য জয় সীতানাথ।
জয় নিত্যানন্দ-রাম ভক্তগণ সাধ।।
শ্রীঅদ্বৈত কল্পবৃক্ষের মুখ্য শাখাগণ।
সংক্ষেপে কহিমু তা সভার বিবরম।।
শুভক্ষণে সীতা-মাতার গর্ভাধান হৈল।
শুনি সৰ্ব্ব ভক্ত মনে আনন্দ বাড়িল।।
চৌদ শত চৌদ্দ শকের বৈশাখি পূর্ণিমা।
দেব-পৰ্ব্ব মধ্যে বড় যাহার মহিমা।।
সেই দিন সীতাদেবী পুত্র প্রসবিলা।
শিশুর অপূর্ব্ব রূপে সকলে মোহিলা।।
সভে কহে ঐছে রূপ নাহি দেখি আর।
বুঝি কোন দেব আসি হৈলা অবতার।।
জ্যোতির্বিদ আসি কহে করিয়া গণন।
ব্রজ্রধামের গোপী এক লভিলা জনম।।
পুরুষ আকৃতি হৈলা লোক শিক্ষাইতে।
আকৌমার বৈরাগ্য হৈব জানিহ নিশ্চিতে।।
ইহা শুনি ভক্তবৃন্দ প্ৰেমাবিষ্ট হৈলা।
সভে মিলি নাম-সংকীর্ত্তন আরম্ভিলা।।
কেহ নাচে কেহ কান্দে প্রেমের স্বভাবে।
হুঙ্কার করহে প্রভু হরিবোল রবে।।
অদ্বৈতের হুঙ্কার যৈছে মেঘ গরজন।
গৌরাঙ্গ জানিলা প্রিয় ভক্ত প্রকটন।।
তবে প্রভু পুত্রের নাম-করণ কারণ।
যথাকালে আমন্ত্রিলা যাজক ব্রাহ্মণ।।
পুরোহিত আসি কহে করিয়া গণন।
এই আচার্য্যের পুত্র নহে সাধারণ।।
কৃষ্ণে ইহার মন প্রাণ কৃষ্ণেই আনন্দ।
অতএব নাম রাখিলঁ শ্রীঅচ্যুতানন্দ।।
নাম শুনি ভক্তগণ করে হরিধ্বনি।
হর্ষে হলুধ্বনি করে যতেক রমণী।।
শ্রীঅচ্যুতের কৃষ্ণপ্রেম ব্ৰজগোপী সমে।
শ্রীঅচূত্যা সখী তারে কহে সাধুগণে।।
কিছু দিন অন্তে প্রভু দেখি শুভক্ষণ।
সমারোহে অচ্যুতের কৈলা অন্নাশন।।
মদন গোপালের আগে ভোগ লাগাইলা।
পুত্র মুখে অন্ন দিতে মহোৎসব কৈলা।।
ব্রাহ্মণ বৈষ্ণব আদি খাঞা পরসাদ।
বস্ত্র কৌড়ি পাঞা পুত্রে কৈলা আশীৰ্ব্বাদ।।
ক্রমে শ্রীঅচ্যূত পাঁচ বৎসরের হৈলা।
শুভক্ষণে প্রভু তার হাতে খড়ি দিলা।।
যেই দিন শ্রীঅচ্যুত বিদ্যারম্ভ কৈলা।
সেই দিন মোর মাতা শান্তিপুরে আইলা।।[১]
শ্রীঅদ্বৈত পদে আসি লইলা শরণ।
পঞ্চম বৎসর মোর বয়স তখন।।
প্রভু দয়া করি মায়ে দিলা কৃষ্ণ-মন্ত্ৰ।
মোরে হরিনাম দিঞা করিলা পবিত্র।।
মোরে পাঞা সীতা দেবী স্নেহ প্রকাশিলা।
আপন তনয় সম পোষণ করিলা।।
শ্রীগুরুর আজ্ঞাবহা ছিলা মোর মাতা।
কিছু কিছু মোর মনে পড়ে সেই কথা।।
প্রভু কহে ঈশানের মাতা পুণ্যবতী।
পরকালে হৈবে ইহার বৈকুণ্ঠে বসতি।।
তবে শুন আর এক অপূৰ্ব্ব আখ্যান।
যৈছে হৈলে সীতামাতার দ্বিতীয় সন্তান।।
চৌদ্দশত অষ্টাদশ শক অবশেষে।
মধুমাসে কৃষ্ণা ত্রয়োদশী নিশি শেষে।।[২]
প্রসবিলা সীতাদেবী অপূর্ব্ব কুমার
অলৌকিক রূপ যৈছে দেব অবতার।।
হেন কালে শুন এক দৈবের ঘটন।
শ্রীশ্রীঠাকুরাণীর এক হইল নন্দন।।
জন্মমাত্র বালকের হইল মরণ।
তাহা দেখি শ্রীজননী করয়ে রোদন।।
সীতামাতা কান্দি কহে অদ্বৈতাবস্থানে।
ভগিনীর দুঃখ মোর নাহি সহে প্রাণে।।
যদি বা হইল এক পুত্ৰ এত দিনে।
বিধি ধাম হঞা তাহা কৈলা সংগোপনে।
তোমার পাইলে আজ্ঞা মোর মনে করে।
মোর এই পুত্র সমর্পিমু ভগিনীরে।।
প্রভু কহে ভাল ভাল ইচ্ছা যে তোমার।
শ্রীর দুঃখ সন্তায়িতে এই যুক্তি সার।।
তবে সীতা কহে অশ্রু করিয়া মার্জ্জন।
না কান্দ না কান্দ ভগ্নি স্থির কর মন।।
মোর এই পুত্র সমর্পিলাঁ সত্য তোরে।
এই পুত্র তোর বলি ঘুষিব সংসারে।।
এত কহি সেই পুত্র স্ত্রীর কোলে দিলা।
শোক ছাড়ি শ্রীমা পুত্রে স্তন পিয়াইলা।।
এ সভ রহস্য কথা অন্যে নাহি জানে।
জানয়ে আমার মাতা আর তিন জনে।। [৩]
পদ্মনাভ চক্রবর্ত্তী প্রভুর কৃপা পাত্র।
প্রভুর কৃপায় তোঁহা জানে সব তত্ত্ব।।
তবে প্রাতঃকালে আসি দৈবজ্ঞ ব্রাহ্মণ।
মৃদু মৃদু ভাসে কহে করিয়া গণন।।
এই যে অদ্বৈত চন্দ্রের দ্বিতীয় নন্দন।
কৃষ্ণভক্তি রক্ষার্থ ইহার প্রকটন।।
দেবলোক রক্ষার্থ যেঞি দেবসেনাপতি।
সেই ষড়ানন এবে অদ্বৈত সন্ততি।।
ইহা শুনি ভক্তগণ আনন্দে মাতিল।
হরি হরি বুলি সভে নাচিতে লাগিল।।
তবে যথাকালে প্রভু আনি পুরোহিত।
নামকরণ করাইলা হঞা হরষিত।।
জ্যোতির্বিদ পুরোহিত কহয়ে গণিঞা।
ইহো সুপন্ডিত হৈব সকলে জিনিঞা।।
কৃষ্ণ বৈষ্ণব সেবায় রত হইব উদাস।
অতএব ইহার নাম থুইনু কৃষ্ণদাস।।
তাহা শুনি ভক্তগণের আনন্দ বাঢ়িল।
হরিসংকীর্তনানন্দে দিন গোঙাইল।।
কিছুদিন পরে প্রভু দেখি শুভক্ষণ।
শ্রীকৃষ্ণদাসের কৈলা শুভ অন্নাশন।।
শ্রীমদন গোপালে ভোগ লাগাইলা।
মহাপ্রসাদ দিয়া পুত্রের অন্নাশন কৈল।।
ভক্তি করি ব্রাহ্মণে বৈষ্ণবে ভুঞ্জাইলা।
অন্ধ অকিঞ্চনে বহু অন্ন দান কৈলা।।
বস্ত্র কৌড়ি দান করি সভে সম্ভাসিলা।
আশীষ করিয়া তারা যথা স্থানে গেলা।।
তবে শ্রীঅদ্বৈত শুভ সময়ানুসারে।
বিদ্যারম্ভ করাইলা শ্রীকৃষ্ণ দাসেরে।।
আর এক অপূর্ব কথা শুন সৰ্ব্বজন।
যৈছে প্ৰকট হৈলা প্রভুর তৃতীয় নন্দন।।
চৌদ্দ শত বাইশ শকের কাত্তিকেতে।
সীতা প্রসবিলা শুক্লা দ্বাদশীতে।।
জন্মমাত্র বালকের দেখ চমৎকার।
নয়ন মুদিয়া রৈল যৈছে মৃতাকার।।
তাহা দেখি মোর প্রভু গৌরহরি বলি।
হুঙ্কার ছাড়য়ে যৈছে সিংহ মহাবলী।।
গৌর হরি নাম শিশুর কর্ণেতে পশিল।
প্রেমে অশ্রু বিমোচিয়া নয়ন মেলিল।।
দেখি সভে প্রেমানন্দে দেয় হরিধ্বনি।
হুলুধ্বনি করে যত কুলের কামিনী।।
হেনকালে জ্যোতিষী ব্রাহ্মণ তাঁহা আইলা।
জাত বালকের তত্ত্ব গণিয়া কহিলা।।
এই অদ্বৈতচন্দ্রের তৃতায় সন্তান।
স্বয়ং শ্রীগণেশ ইহো হৈলা অধিষ্ঠান।।
পৃথী-বিঘ্ন বিনাশিতে কৈলা আগমন।
ইহাঁর দর্শনে জীব পাইব ভক্তিধন।।
তাহা শুনি ভক্তবৃন্দের আনন্দ বাঢ়িল।
হরি সংকীৰ্ত্তন করি দিন গোঙাইল।।
তবে প্রভু পুরোহিত আনি নিমন্ত্রিয়া।
পুত্রের নাম করণ করাইলা তাঁরে দিয়া।।
দ্বিজ কহে হৈব ইহেঁ শ্রীকৃষ্ণের দাস।
অতএব নাম থুইনু শ্রীগোপাল দাস।।
এবে শুন গোপালের অমানুষী বৃত্তি।
যাহার শ্রবণে জীব পায় কৃষ্ণভক্তি।।
ভক্তগণ যবে করে নাম সংকীৰ্ত্তন।
দুগ্ধপান ছাড়ি গোপাল করয়ে শ্রবণ।।
অশ্রুপাত করে আর হাসে খল খল।
চক্ষু ঘুরায় পুন পুন যৈছে মাতোয়াল।।
সংকীৰ্ত্তন বিরামে সে ভাব দুরে যায়।
উচ্চস্বরে কান্দি শেষে মাতৃ দুগ্ধ খায়।।
নিত্য কৃষ্ণদাসের এই স্বাভাবিকী হয়।
বিজ্ঞের গোচর ইহা অজ্ঞে না জানয়।।
প্রভুর এই তিন কোঙরের জন্মাখ্যানে।
সুত্রমাত্র কহিলাঙ জীবের কল্যাণে।।
শ্রীচৈতন্য শ্রীঅদ্বৈতপদে যার আশ।
নাগর ঈশান কহে অদ্বৈত-প্ৰকাশ।।
ইতি শ্রীঅদ্বৈত-প্ৰকাশে একাদশোহধ্যায়ঃ।