দশম অধ্যায়
জয় জয় শ্রীগৌরাঙ্গ জয় সীতানাথ।
জয় নিত্যানন্দরাম ভক্তগণ সাথ।।
এক দিন শ্রীঅদ্বৈত গঙ্গাস্নান করি।
হুঙ্কার করয়ে ঘন বলি হরি হরি।।
মনে ভাবে কবে উদয় হইবে গৌরাঙ্গ।
দেহ প্রাণ জুড়াইবাঙ পাঞা তার সঙ্গ।।
তবে গাঢ় নিষ্ঠায় পুষ্প তুলসীর দল।
কৃষ্ণ পদোদ্দেশে দিলা আর গঙ্গাজল।।
আচার্য্য হুঙ্কারে কৃষ্ণের উৎকণ্ঠিত মন।
এক পুষ্পাঞ্জলি ইচ্ছায় কৈলা আকর্ষণ।।
পুষ্পাঞ্জলি উজাইতে দেখি সীতানাথ।
কৃষ্ণকৃপা মানি ধাঞা চলে তার সাথ।।
হরিনাম স্মরি হরিদাস পিছে ধায়।
পুষ্পাঞ্জলি উপনীত হৈল নদীয়ায়।।
প্রভু কহে শুন অরে প্রিয় হরিদাস।
এই গ্রামে কৃষ্ণচন্দ্র হইব প্ৰকাশ।।
শ্রীঅনন্ত সংহিতায় যেই সিদ্ধ বাক্য।
তাহার সত্যতা আজি হইল প্রত্যক্ষ।
হেনকালে জগন্নাথ মিশ্রের গৃহিণী।
শ্রীযশোদারূপা নাম শচী ঠাকুরাণী।।
গঙ্গাস্নানে আইলা তিহো ছিল গর্ভবতী।
সেই পুষ্পাঞ্জলি তান অঙ্গে হৈলা স্থিতি।।
শচী ভাবে আজু কিবা অমঙ্গল হৈল।
ঠেলিতেই পুষ্প আসি অঙ্গেতে উঠিল।।
তবে শচী ঝাট স্নান করি তটে আইলা।
প্রভু ভাবাবেশে কৃষ্ণ মাতারে চিনিলা।।
গর্ভলক্ষণ দেখি তান প্রভু মনে ভাবে।
এই গর্ভে কৃষ্ণচন্দ্রের প্রকট সম্ভবে।।
তার পরীক্ষার্থ গর্ভে দন্ডবৎ কৈলা।
সাধারণ গর্ভ হেতু গর্ভপাত হইলা।।
সুদুঃখিতা হঞা শচী গর্ভ পরিহরি।
নিজ ঘরে গেলা ঝাট গঙ্গাস্নান করি।।
গৃহিণীরে ম্লান দেখি কহে মিশ্ররায়।।
কাহে আজি সকাতরা দেখিগো তোমায়।।
শচী করে কাঁহা হৈতে বৃদ্ধ ব্ৰাহ্মণ আইলা।
দন্ডবৎ মাত্রে মোর গর্ভপাত কৈলা।।
জগন্নাথ কহয়ে নিমিত্ত মাত্র নর।
বস্তুতঃ সকল কার্য্যের কারণ ঈশ্বর।।
শোক ছাড়ি নারায়ণে করহ স্মরণ।
যাঁহা হৈতে হয় সর্ব্ব বিঘ্নের দমন।।
হেথা শ্রীঅদ্বৈতাচাৰ্য্য মনে বিচারিয়া।
নবদ্বীপে টোল কৈলা গৌরাঙ্গ লাগিয়া।।
সেই নদীয়ায় যত পন্ডিত সজ্জন।
প্রভুরে প্রধান বলি করিলা গমন।।
পন্ডিত শ্রীবাসঠাকুর নারদাবতার।
প্রভু সঙ্গে হৈল তান আনন্দ অপার।।
দিনে প্রভু ছাত্র পড়ায় গীতা ভাগবত।
কভু বেদ স্মৃতি পড়ায় ছাত্রের ইচ্ছামত।।
রাত্রে হরিদাস সঙ্গে করিয়া মিলন।
উচ্চস্বরে করে হরির নাম সংকীর্ত্তন।।
শ্রীঅদ্বৈত প্রভুর দেখি অলৌকিক কাৰ্য্য।
তাঁর স্থানে মন্ত্র লৈলা বিষ্ণুদাসাচাৰ্য্য।।
শ্ৰীমদ্ভাগবত তিহোঁ পড়ে প্রভুর স্থানে।
অনেক বৈষ্ণব আইলা সে পাঠ শ্রবণে।।
নন্দনী প্রভৃতি শ্ৰীমান্ বাসুদেবদত্ত।
প্ৰভু স্থানে মন্ত্র লঞা হইলা কৃতাৰ্থ।।
বহু শিষ্য লঞা প্রভু করে কৃষ্ণালাপ।
কভু প্রেমোন্মত্ত হঞা কহয়ে প্রলাপ।
জগন্নাথমিশ্র পত্নী শচীর গর্ভ গণ।
অদ্বৈতের প্রণামে ক্রমে হইল পতন।।
ক্রমে অষ্টম গর্ভ পাতে সুদুঃখিত হঞা।
শচী জগন্নাথমিশ্রে কহয়ে কান্দিয়া।।
সৰ্ব্বনাশ হৈল অদ্বৈতের পরণামে।
কি মতে রহিব বংশ করহ বিধানে।।
তাহা শুনি শান্ত শুদ্ধ মিশ্র দ্বিজবর।
ব্যগ্র হঞা আইলা যাঁহা অদ্বৈত ঈশ্বর।।
প্রভুকে প্রণাম করি নানা স্তব কৈলা।
প্রভু আশীষ করিয়া মিশ্রে বসাইলা।।
প্রভু কহে কি লাগিয়া আইলে মোর পাশে।
মিশ্রবর জোড় করে কহে মৃদু ভাষে।।
তুয়া শ্রীচরণে মুঞি লইনু শরণ।
অপরাধ থাকে যদি করহ মার্জ্জন।।
দয়া করি প্রভু মোরে দেহ এই ভিক্ষা।
মো হেন অভাগার হয় যৈছে বংশ রক্ষা।।
প্রভু কহে এবে তুহুঁ যাহ নিজ ঘরে।
যে হয় বিধান মুঞি কহিনু তোঁহারে।।
প্রভু আজ্ঞা পাঞা মিশ্র নিজ গৃহে গেলা।
প্রভুর আশ্বাস বাক্য শচীরে কহিলা।।
পরদিন মোর প্রভু প্রাতঃকৃত্য সারি।
জগন্নাথমিশ্র গৃহে গেলা ত্বরা করি।।
প্রভুর আগমন দেখি মিশ্র দ্বিজবর।
দন্তে তৃণ করি গেলা তাহান গোচর।।
দন্ডবৎ করি দিলা বসিতে আসন।
পাদ্য অর্ঘ্য দিয়া তানে করিলা পূজন।।
তবে শচীদেবী আসি করিলা প্রণতি।
প্রভু কহে বাছা তুমি হও পুত্রবতী।।
শুনি মহানন্দে কহে মিশ্র দ্বিজরাজ।
যাহে তুয়া বাক্য রহে কর সেই কাজ।।
প্রভু কহে এক মন্ত্ৰ পাইনু স্বপনে।
ভক্তি করি সেই মন্ত্র লহ দুহুঁ জনে।।
সৰ্ব্ব অমঙ্গল তবে অবশ্য খণ্ডিবে।
পরম পন্ডিত দিব্য তনয় লভিবে।।
আজ্ঞা শুনি আইলা দোঁহে করিয়া সিনানে।
তবে প্রভু যথাবিধি পূজি নারায়ণে।।
দোঁহাকারে মন্ত্র দিলা শ্রীঅদ্বৈতচন্দ্ৰ।
চতুরাক্ষর শ্রীগৌর-গোপাল মহামন্ত্র।।
মন্ত্র পাঞা দোঁহাকার হৈল ভবোদগমন।
প্রভুরে প্রণমি করে সদৈন্য স্তবন।।
“কৃষ্ণে মতিরস্তু” বলি প্রভু বর দিলা।
ভোজন করিয়া তবে নিজস্থানে গেলা।।
দিন কত পরে শচীর হৈল গর্ভাধান।
তাহে প্রকটিল বিশ্বরূপ গুণ ধাম।।
মহাসঙ্কর্ষণ বলি প্রভু যাঁরে কয়।
তাহান মহিমা চতুর্মুখ না জানয়।।
আজন্ম বৈরাগ্য তান লোকে চমৎকার।
আচার্য্যের সঙ্গে কৈলা ধর্ম্মের প্রচার।।
এবে কহি মহাপ্রভু চৈতন্যাবতীর্ণ।
যাহা শ্রবণ মাত্রে জীব হয় মহাধন্য।।
শ্রীঅদ্বৈতচন্দ্ৰ নিতি কৃষ্ণ পূজান্তরে।
আইস গৌরহরি বলি করয়ে হুঙ্কারে।।
অদ্বৈতের হুঙ্কার কৃষ্ণাকর্ষি মহামন্ত্র।
তাহে কৃষ্ণের মন চঞ্চল হইল একান্ত।।
পূর্ব্ব সত্য স্বীকারিয়া নদীয়া নগরে।
অবতীৰ্ণ হৈলা কৃষ্ণ সদয় অন্তরে।।
শচীগর্ভ দুগ্ধার্ণবে গৌরচন্দ্রোদয়।
বুঝিলা আচার্য্য শচীর শ্রীঅঙ্গ ছটায়।।
এক দিন প্রভু বসি গঙ্গার গহ্বরে।
তুলসী চন্দন পুষ্পে কৃষ্ণে পূজা করে।।
গঙ্গাতে কৃষ্ণের মূর্ত্তি আরোপ করিয়া।
তিন পুষ্পাঞ্জলি গঙ্গায় দিলা ভাসাইয়া।।
কৃষ্ণেচ্ছায়ে পুষ্পাঞ্জলি যায় দ্রুতগতি।
পূর্ব্ব মতে শচীদেবীর অঙ্গে কৈলা স্থিতি।।
দেখি চমকিয়া শচী ভাবে দুঃখমনে।
পুন কে ফুল পাঠইলা করিয়া গেয়ানে।।
তবে ঝাট তুলসী কুসুম ঠেলি ফেলি।
তীরে উঠে রাম নারায়ণ হরি বুলি।।
তাহা দেখি হৈল প্রভুর দিবা প্রোমোঙ্গার।
গৌরহরি বলি ঘন ছাড়য়ে হুঙ্কার।।
শ্রীশচী মাতারে তবে প্রভু সীতানাথ।
প্রদক্ষিণ করি গর্ভে কৈলা দন্ডবৎ।।
শচী কহে রহ রহ আচার্য্য ঠাকুর।
ইথে মোর অপরাধ হইল প্রচুর।।
পূৰ্ব্বে প্রণমিয়া গর্ভগণ বিনাশিলা।
কহ প্রভু পুন কাহে শিষ্যে প্রণমিলা।।
এত কহি শচী তানে দণ্ডবৎ কৈলা।
আশীষ করিয়া প্রভু শচীরে কহিলা।।
আর ভয় নাঞি মা গো এ সত্য বচন।
এই গর্ভে কৃষ্ণ সম হইবে নন্দন।।
তাহা শুনি মহানন্দে শচী ঘরে গেলা।
প্রভু প্রেমোন্মত্ত হঞা হরিধ্বনি কৈলা।।
তবে শচীদেবীর পূর্ণ হৈল দশ মাস।
তথাপি শ্রীকৃষ্ণচন্দ্রের নহিল প্রকাশ।।
ক্রমেতে দ্বাদশ মাস অতীত হইল।
জগন্নাথমিশ্র আদি মহাত্ৰাস পাইল।।
শচীর জনক নীলাম্বর চক্রবর্ত্তী।
জ্যোতিষ শাস্ত্রেতে তেহোঁ সাক্ষাৎ গৰ্গমূৰ্ত্তি।।
গণনা করিয়া তিহো কহে সভা মাঝে।
এই গর্ভে এক মহাপুরুষ বিরাজে।।
ত্রয়োদশ মাসে সেই লভিবে জনম।
যবে একত্ৰিত হৈব সৰ্ব্ব শুভক্ষণ।।
ইহার প্রকটে জীবের হৈব সুমঙ্গল।
তাহা শুনি সৰ্ব্বজন আনন্দে ভাসিল।।
স্ফটিকের স্তম্ভে নৃসিংহাবিভাব যৈছে।
শচীগর্ভে শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব তৈছে।।
স্বয়ং ভগবান নাহি মায়ার সম্বন্ধ।
যিহোঁ প্রেমরত্নাকর শ্রীসচ্চিদানন্দ।।
যাহাঁ তান বাসস্থান তাঁহা বৃন্দাবন।
জীব নিস্তারিতে তনু করে প্রকটন।।
তাঁর মাতা পিতা আদি বান্ধব চিন্ময়।
ধামাদি চিন্ময় সবে সদানন্দ ময়।।
জীবধর্ম্মে হয় তান ভার দুঃখাভাস।
কৃষ্ণ প্রকট কারণে সভার প্রকাশ।।
তিন বাঞ্ছা মনে করি শ্রীনন্দনন্দন।
শ্রীরাধার ভাব কান্তি করিয়া গ্রহণ।।
স্বয়ং গৌররূপে নদীয়ায় অবতীর্ণ।
শুদ্ধপ্রেম বিতরিয়া বিশ্ব কৈলা ধন্য।।
চৌদ্ধশত সাত শকের ফাল্গুনী পূর্ণিমা।
সেই দিনে রাহু আসি গ্রাসিল চন্দ্ৰমা।।
সিংহ রাশি সিংহ লগ্নে সৰ্ব্ব শুভ যোগে।
পৃথ্বী পুলকিত হৈলা কৃষ্ণ অনুরাগে।।
সন্ধ্যায় চিন্ময় হরি-নাম বলাইঞা।
শ্রীকৃষ্ণ প্রকট হৈলা গৌরাঙ্গ হইঞা।।
একে কৃষ্ণের দোলোৎসবে জগতে আনন্দ।
তাহে চন্দ্রগ্রহণে হইল মহানন্দ।।
কেহ করে দানধ্যান হঞা শুদ্ধাচারী।
কেহ নাচে কেহ গায় বলি হরি হরি।।
মহাপ্রভুর আবির্ভাবে প্ৰভু নিত্যানন্দ।
রাঢ়ে রহি প্রেমে গৰ্জ্জে যৈছে মেঘবৃন্দ।।
শ্রীগৌরাঙ্গ অঙ্গ আভা স্বর্ণ ইন্দু তুল।
পীতবর্ণ জোৎস্নায় সুতিগৃহ হৈলা আলো।।
আজানুলম্বিত ভুজ কমললোচন।
সেই রূপের সব মুঞি বর্ণিতে অক্ষম।।
অলৌকিক রূপ দেখি শচী মোহ হৈলা।
জগন্নাথ বিষ্ণুবুদ্ধ্যে স্তব আরম্ভিলা।।
তাহা দেখি গৌরচন্দ্র মায়া বিস্তারিল।
তাহে দোঁহকার পুত্র বুদ্ধি উপজিল।।
কৃষ্ণ আবির্ভাবে জীবের হইল আনন্দ।
প্রেমানন্দে ডুবিলা শ্রীভাগবত বৃন্দ।।
শ্রীঅদ্বৈত জানি কৃষ্ণ চৈতন্যাবতীর্ণ।
হুঙ্কার ছাড়য়ে আপনারে মানি ধন্য।।
হরিদাস আদি করে নাম সংকীৰ্ত্তন।
কেহ নাচে প্রেমে কেহ হৈলা অচেতন।।
শ্রীগৌরাঙ্গ জন্মমাত্রে মহাযোগী প্রায়।
নয়ন মুদিয়া রৈল দুগ্ধ নাহি খায়।।
তাহা দেখি শচীদেবী কান্দিতে লাগিলা।
জগন্নাথমিশ্র আদি মহাদুঃখী হৈলা।।
হেনকালে মোর প্রভু আচার্যাগোসাঞি।
নিজ প্রভু দেখিবারে আইলা সেই ঠাঞি।।
প্রভুরে দেখিয়া মিশ্র দন্ডবৎ কৈলা।
শোকের কারণ প্রভু তাহানে পুছিলা।।
মিশ্র কহে প্রভুবর তুহুঁ সৰ্ব্ব জান।
পুত্রধন দেখাইয়া পুন কৈলা আন।।
প্রভু কহে মিশ্রবর খেদ না করিহ।
ভাল হৈব শিশু সত্য না কর সন্দেহ।।
এত কহি প্ৰভু সুতিগৃহান্তিকে গেলা।
প্রভুপদ ধরি শচী কান্দিতে লাগিলা।।
আচাৰ্য্য কহেন মাগো না কর ক্রন্দন।
দূরে যাও ভাল হৈব তোমার নন্দন।।
গুরু আজ্ঞায় শচীমাতা কিছু দূরে গেলা।
প্রভুপদ ধরি শচী কান্দিতে লাগিলা।।
আচাৰ্য্য কহেন মাগো না কর ক্রন্দন।
দূরে যাও ভাল হৈব তোমার নন্দন।।
গুরু আজ্ঞায় শচীমাতা কিছু দুরে গেলা।
প্রভু মহাপ্রভু স্থানে উপনীত হৈলা।।
প্রেমে ডগমগ অঙ্গ অদ্বৈত দেখিয়া।
গৌররূপী শ্রীগোবিন্দ উঠিলা হাসিয়া।।
স্বয়ং রূপে অবতীর্ণ কৃষ্ণে নিরখিয়া।
আচার্য্য বিশুদ্ধপ্রেমে রহিলা ডুবিয়া।।
কতোক্ষণে শ্রীঅদ্বৈতের বাহ্য স্ফুর্ত্তি হৈল।
দন্ডবৎ করি কর-পুটে নিবেদিল।।
অহে বিভু আজি দ্বিপঞ্চাশ বৰ্ষ হৈল।
তুয়া লাগি ধরাধামে এ দাস আইল।।
কলুষ দর তিমির পুরিত-সংসার।
ঐছন নেহারি ভেল ভয়ের সঞ্চার।।
তেঞি ভয় ভঞ্জন তোমারি দরশনে।
উৎকণ্ঠিত হঞা ছাড়ি নিজ নিকেতনে।।
দেশে দেশে তোমা চাহি চাহি বেড়াইনু।
মোহর করম দোষে দেখা না পাইনু।।
এতদিনে মোর মনের অভীষ্ট পুরিল।
গোকুলচাঁদ নবদ্বীপে উদয় হইল।।
গৌর কহে মুঞি ভক্ত-বশ্য চিরদিন।
মোর প্রকটাপ্রকট ভক্তের অধীন।।
শ্রীঅদ্বৈত কহে যদি আইলা ভুবনে।
কৈছে দুগ্ধ নাহি খাও কহ মোর স্থানে।।
মহাপ্রভু কহেন শুনহ পঞ্চানন।
অনুরাগে মাতি বিধি হৈলা বিস্মরণ।।
মন্ত্র প্রদানের অগ্রে হরিনাম দিবে।
কর্ণশুদ্ধি হয় সিদ্ধ নামের প্রভাবে।।
অশুদ্ধ কর্ণেতে যদি মহামন্ত্ৰ লয়।
অসংপূর্ণ দীক্ষা সেই জানিহ নিশ্চয়।
মাতা দীক্ষা হৈলা না শুনিলা হরিনাম।
তেঞি তান দুগ্ধ মুঞি নাহি কৈলোঁ পান।।
প্রভু কহে কহ হরি নামের বিধান।
মহাপ্রভু কহে নিত্য সিদ্ধ ষোল নাম।।
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।
যদ্যপি আচাৰ্য্য এই ষোল নাম জ্ঞাত।
গৌর মুখচ্যুৎ শুনি হৈলা প্রেমোন্মত্ত।।
তবে প্রভু ভাগ্য মানি গৌরে লঞা কোলে।
ধরি ধীরি চলি গেলা নিন্ধ তরু তলে।।
তাঁহা গৌরে শোয়াইয়া বোলে হরি হরি।
গৌর পদ স্পর্শে সেই বৃক্ষ গেল ভরি।।
শচীরে বোলাঞা প্রভু হরিনাম দিলা।
পূর্ব্বদত্ত মন্ত্র পুন স্মৃতি করাইলা।।
তবে প্রভু গৌরে আনি শচীর কোলে দিলা।
মহাপ্রভু মাতৃ দুগ্ধামৃত পান কৈলা।।
তাহা দেখি শচীমাতা আনন্দে ডুবিলা।
মিশ্র আদি সভে হর্ষে হরিধ্বনি কৈলা।।
দ্বিজ দ্বিজপত্নীগণ আশীৰ্ব্বাদ কৈল।
প্রভু কহে ইহার নাম নিমাঞি রহিল।।
তবে হরি হরি হুঙ্কার ছাড়ি সীতানাথ।
সভে কহে এই বুড়া স্বয়ং বৈদ্যনাথ।।
প্রভু কহে মিছা মোরে প্রশংসহ কেনে।
এই শিশু ভাল হইলা নিম্ববৃক্ষ গুণে।।
নিম্ব বৃক্ষের যত গুণ কে কহিতে পারে।
যাহার ছায়াতে জীবের সর্ব্বব্যাধি হরে।।
যাহার গন্ধেতে পালায় ডাকিনী শাকিনী।
যার মুলে বিরাজিত দেবচক্রপাণি।।
এত কহি সীতানাথ লঞা ভক্তগণ।
নিশি গোঙাইলা করি নামসংকীর্ত্তন।।
এই লীলা দেখে ভাগ্যে ভাগবতোত্তম।
দেখিবারে বাঞ্ছা যায় সেই ধন্য তম।।
এই লীলাঙ্কুরে কৃষ্ণ কৃপা চক্ষু দ্বারে।
কোটি জন্মের পুণ্যে ইহা দেখিতে না পারে।।
নিত্যসিদ্ধা পৌর্ণমাসী সাক্ষাৎ যোগমায়া।
ভক্তিরূপা সীতাদেবী অদ্বৈতের জায়া।।
দোলোৎসব দিনে তিঁহো দেখি উপরাগে।
কৃষ্ণলীলা চিন্তা করে গাঢ় অনুরাগে।।
মননে প্রত্যক্ষ দেখে কৃষ্ণ নবদ্বীপে।
প্রকটিলা নিজ অঙ্গ ঢাকি রাধারূপে।।
অপূর্ব্ব নিরখি সীতা প্রেমেতে ডুবিলা।
শক্তি বিস্তারিয়া ঝাট নবদ্বীপে আইলা।।
শ্রীগৌরাঙ্গ দেখি জীবন সার্থক মানিলা।
ধান্য দুৰ্ব্বা দিয়া গৌরে আশির্ব্বাদ কৈলা।।
শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাব নদীয়া নগরে।
শুনি বহুলোক আইলা দেখিবার তরে।।
গৌর অঙ্গে দেখি মহাপুরুষের চিহ্ন।
সেইত ঈশ্বর মানে যেই হয় ধন্য।।
শ্রীশচীনন্দন হয় অয়স্কান্ত সম।
চতুর্দিকের ভক্ত লৌহে কৈলা আকর্ষণ।।
সভে সংকীর্ত্তন করে কুতুহলে।
গৌরের নাম করণ হৈল যথা কালে।।
বিশ্বম্ভর নাম রাখে দ্বিজ নীলাম্বর।
গর্গ সম জ্যোতিষে যাঁহার অধিকার।।
জগন্নাথ পুত্রের দেখি গৌরবর্ণ অঙ্গ।
বাৎসল্যে রাখিলা নাম শ্রীগৌর গৌরাঙ্গ।।
শচীদেবী শুদ্ধ স্নেহে আপন অর্ভকে।
কভু গোরাচাঁদ কভু গোরা বলে ডাকে।।
এক অপরূপ কথা শুন সৰ্ব্বজন।
অলৌকিক লীলা করে শ্রীশচীনন্দন।।
বাল্য স্বভাবেতে যবে করয়ে ক্ৰন্দন।
হরি নাম শুনি হয় সহাস্য বদন।।
তাহা দেখি নদীয়ার কত নর নারী।
কান্দাইয়া শান্ত করে বলি হরি হরি।।
রোদনের ছলে হরিনাম লওয়াইলা।
গোরার নিগুঢ় তত্ত্ব ভকতে বুঝিলা।।
অপূর্ব্ব স্বভাব গৌরের দেখি সভ নারী।
আনন্দে রাখিলা তাঁর নাম গৌর হরি।।
প্রেমানন্দে মত্ত হঞা শুদ্ধ ভক্ত বৃন্দ।
মহাপ্রভুর নাম রাখে শ্রীগৌরগোবিন্দ।।
যথা কালে মিশ্র গৌরের অন্নাশন কৈলা।
বিষ্ণুর প্রসাদ সৰ্ব্বজনে ভুজ্ঞাইলা।।
শ্রীগৌরাঙ্গের বাল্যলীলা অমৃতের সিন্ধু।
মুঞি ছার ছুইতে নারিনু তার বিন্দু।।
গৌরের বয়স যবে পাঁচ বৎসর হইল।
শুভক্ষণে মিশ্র তান হাতে খড়ি দিল।।
লোকে শ্রুতিধর বড় গৌরাঙ্গ শ্রীমান্।
অল্প কালেতে তার হৈল বর্ণ জ্ঞান।।
তবে মিশ্র গঙ্গাদাস পন্ডিতের স্থানে।
পড়িতে দিলেন গৌরে করিয়া যতনে।।
দুই বর্ষে গোরা ব্যাকরণ সমাপিলা।
দেখি পন্ডিতের চিত্ত চমৎকার হৈলা।।
কালে তানে ভারতী দিলেন যজ্ঞসূত্র।
শাস্ত্রমতে মিশ্ররাজ দিলা বিষ্ণুমন্ত্ৰ।।
ক্ষুদ্র মুঞি অপার গৌর-লীলার কিবা জানি।
তার সুত্র লিখি যেই প্ৰভু মুখে শুনি।।
শ্রীচৈতন্য শ্রীঅদ্বৈত পদে যায় আশ।
নাগর ঈশান কহে অদ্বৈত-প্ৰকাশ।।
ইতি শ্রীঅদ্বৈত-প্ৰকাশ দশমোহধ্যায়ঃ।।