দুই
চিঠি পড়া শেষ হইলে ব্যোমকেশ আমার হাত হইতে চিঠি লইয়া মনে মনে পড়িতে আরম্ভ করিল। আমি আর এক পেয়ালা চা সংগ্রহের উদ্দেশ্যে রান্নাঘরের অভিমুখে যাত্রা করিলাম। সত্যবতী হয়তো রাগিয়া আছে, তাহাকে ঠাণ্ডা করাও দরকার।
আধ ঘন্টা পরে ফিরিয়া আসিয়া দেখি ব্যোমকেশ চিঠি কোলে লইয়া বসিয়া আছে এবং আপন মনে হাসিতেছে। জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘হাসি কিসের?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘ব্যাপারটাই হাসির। চিন্তামণি কুণ্ডু মশায় কিন্তু একটি বিষয়ে ভুল করেছেন, তপনের বাড়িতে বিদ্যুৎবাতি নিবে যাওয়ার সময়টা তিনি ভাল করে লক্ষ্য করেননি।’
‘তুমি কি করে তা জানলে?’
‘আমার অনুমান যদি সত্যি হয় তাহলে তিনি নিশ্চয় ভুল করেছেন। আর একটা ভুল করেছেন, সেটা অবশ্য স্বাভাবিক।’ ব্যোমকেশ আবার মৃদু বঙ্কিম হাসিতে লাগিল। তারপর গম্ভীর হইয়া বলিল, ‘অজিত, চিন্তামণিবাবুর ঘরে টেলিফোন আছে, তুমি তাঁর নম্বর খুঁজে তাঁকে ফোন কর। একটা জরুরী প্রশ্নের উত্তর দরকার। তাঁকে জিজ্ঞেস কর তপনের গলার আওয়াজ কি রকম।’
‘নিশ্চয় খুব জরুরী প্রশ্ন। আর কিছু জানতে চাও?’
‘আর কিছু না। তাঁকে বোলো, ভাবনার কিছু নেই, আমি অবিলম্বে যাচ্ছি।’
চিন্তামণিবাবুকে ফোন করিলাম, তারপর ফিরিয়া আসিয়া বলিলাম, ‘তপনের গলার আওয়াজ চেরা-চেরা।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘চেরা-চেরা! তাহলে ঠিক ধরেছি, আর কোন সন্দেহ নেই।’
বলিলাম, ‘কি ধরেছ তুমিই জান। কিন্তু চিন্তামণিবাবুর গলাও চেরা-চেরা মনে হল।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘তাতে আর আশ্চর্য কি। একে পক্ষাঘাত, তার ওপর পুলিসের আতঙ্ক—চল, বেরিয়ে পড়া যাক। কাজ সেরে ফিরে এসে মধ্যাহ্ন ভোজন করা যাবে।’
চিন্তামণিবাবুর বাড়ির রাস্তাটা বেশ চওড়া নূতন রাস্তা; শহরের অন্তিম প্রান্তে বলিয়া অপেক্ষাকৃত নির্জন। তপন সেনের বাসা পুলিসের পাহারা দেখিয়া সহজেই সনাক্ত করা গেল। তাহার উল্টাদিকে চিন্তামণিবাবুর দ্বিতল বাড়ি। আমরা উপরে উঠিয়া গেলাম।
আমরা দ্বারের কড়া নাড়িবার পূর্বেই হিন্দুস্থানী ভৃত্য রামাধীন দ্বার খুলিয়া পাশে সরিয়া দাঁড়াইল। আমরা প্রবেশ করিলাম। খোলা জানালার পাশে চিন্তামণিবাবু চেয়ারে বসিয়া ছিলেন, সাগ্রহে গলা বাড়াইয়া বলিলেন, ‘ব্যোমকেশবাবু। রাস্তায় আসতে দেখেই চিনেছি। আসুন।’
রামাধীন দু’টি চেয়ার আগাইয়া দিল, আমরা বসিলাম। টেলিফোনে গলার আওয়াজ শুনিয়া চিন্তামণিবাবুর চেহারা যেমন আন্দাজ করিয়াছিলাম আসলে তেমন নয়; কৃষ্ণবর্ণ মোটাসোটা মানুষ, উপবিষ্ট অবস্থায় দেখিয়া পক্ষাঘাতগ্রস্ত বলিয়া মনে হয় না। তাঁহার পাশে টিপাই-এর উপর একটি দামী বাইনোকুলার রাখা রহিয়াছে।
চিন্তামণিবাবু বলিলেন, ‘আগে কি খাবেন বলুন। —চা—কোকো—ওভাল্টিন—’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘এখন কিছু দরকার নেই।—পুলিস আজ আপনার কাছে এসেছিল নাকি?’
চিন্তামণিবাবু বলিলেন, ‘আসেনি আবার! দারোগা একবার আমার দিকে তেড়ে আসছে, একবার ও বাড়িতে শান্তার দিকে তেড়ে যাচ্ছে। কী যে চায় ওরা বুঝি না। একই প্রশ্ন পঞ্চাশবার! আমার পক্ষাঘাত হয়েছে, সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে পারি কিনা, বাইনোকুলার রেখেছি কেন, তপন সেনকে বাড়ি ভাড়া দিয়েছি কেন? বলুন দেখি ব্যোমকেশবাবু, এ সব প্রশ্নের কী জবাব দেব? জবাব দিতে দিতে আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়েছে। এখন আপনি আমাকে বাঁচান!’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘ভাববেন না, সব ঠিক হয়ে যাবে। এখন দারোগাবাবুর সঙ্গে একবার দেখা করা দরকার। তিনি কি—’
বলিতে বলিতে দারোগাবাবু দ্বারের সামনে আসিয়া দাঁড়াইলেন।
দশ বারো বছর আগে বিজয় ভাদুড়ী যখন ছোট দারোগা ছিলেন তখন তাঁহার সহিত পরিচয় হইয়াছিল। রোগা লম্বা বেউড় বাঁশের মত চেহারা, কিন্তু অত্যন্ত কর্মতৎপর ও সন্দিগ্ধচিত্ত ব্যক্তি। দশ বছরে তিনি বড় দারোগা হইয়াছেন কিন্তু চেহারার তিলমাত্র পরিবর্তন ঘটে নাই। এবং মনও যে পূর্ববৎ সন্দেহপরায়ণ আছে তাহা তাঁহার চোখের দৃষ্টি হইতে অনুমান করা যায়।
দ্বারের নিকট হইতে প্রখর চক্ষে আমাদের নিরীক্ষণ করিয়া তিনি ঘরে প্রবেশ করিলেন, শুষ্কস্বরে বলিলেন, ‘ব্যোমকেশবাবু যে!’
ব্যোমকেশ হাসিয়া বলিল, ‘চিনতে পেরেছেন দেখছি। তা—আপনার আসামী, মানে, তপন সেন ধরা পড়ল?’
বিজয় ভাদুড়ী একবার চিন্তামণিবাবুকে বক্রদৃষ্টিতে বিদ্ধ করিয়া বলিলেন, ‘ধরা পড়েনি এখনো, কিন্তু যাবে কোথায়? আপনি হঠাৎ এখানে কী উদ্দেশ্যে, ব্যোমকেশবাবু?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘চিন্তামণিবাবু আমার মক্কেল। ওঁর বাড়িতে খুন হয়েছে, ওঁর ভাড়াটে খুন করেছে, আপনারা ওঁকে বিরক্ত করছেন। তাই নিজের স্বার্থরক্ষার জন্যে উনি আমাকে নিযুক্ত করেছেন।’
বিজয় ভাদুড়ী কুটিল-কুঞ্চিত চক্ষে ব্যোমকেশের পানে চাহিয়া রহিলেন, বোধ করি মনে মনে বিবেচনা করিলেন ব্যোমকেশকে গলা-ধাক্কা দিবেন কি না। তারপর তিনি যখন কথা বলিলেন তখন তাঁহার সুর একেবারে বদলাইয়া গিয়াছে। তিনি ব্যোমকেশের দিকে ঝুঁকিয়া ঈষৎ হ্রস্বকণ্ঠে বলিলেন, ‘একবার বাইরে আসবেন? দুটো কথা আছে।’
‘চলুন।’
আমরা ঘরের বাহিরে লম্বা বারান্দার এক কোণে গিয়া দাঁড়াইলাম। বিজয়বাবু মুখে একটা জোর করা হাসি টানিয়া আনিয়া বলিলেন, ‘দেখুন ব্যোমকেশবাবু, উঁচু মহলে আপনার প্রতিপত্তি আছে, আপনি যদি এ মামলায় মাথা গলাতে চান আমি আপনাকে আটকাতে পারব না। কিন্তু আমি অনুরোধ করছি আপনি চিন্তামণি কুণ্ডুকে সাহায্য করবেন না। আমার বিশ্বাস, ও আর ঐ খোট্টা চাকরটা তলে তলে এই ব্যাপারের সঙ্গে জড়িত আছে।’
ব্যোমকেশ স্থির হইয়া বিজয়বাবুর কথা শুনিল, তারপর বলিল, ‘কে খুন করেছে আপনি জানেন?’
বিজয়বাবু বলিলেন, ‘অবশ্য খুন করেছে তপন সেন, কিন্তু বুড়োটাও এর মধ্যে আছে।’
‘বুড়োটাও যদি এর মধ্যে থাকতো তাহলে তপনের নামে খুনের অভিযোগ আনতো কি?’
‘ঐখানেই চালাকি। তপনকে ধরিয়ে দিয়ে বুড়ো নিজেকে বাঁচাতে চায়।’
ব্যোমকেশ বিরক্ত স্বরে বলিল, ‘মাপ করবেন বিজয়বাবু, আপনি এ মামলার কিছুই বুঝতে পারেননি।’
ভ্রূকুটি করিয়া বিজয়বাবু বলিলেন, ‘তার মানে?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘মানে পরে বলব। আগে আপনি আমার কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দিন দেখি। —যে ছুরি দিয়ে খুন হয়েছিল সেটা পাওয়া গেছে কি?’
‘না। তপন সেটা নিয়ে পালিয়েছে।’
‘তপনের বাড়ি তল্লাশ করে কিছু পেয়েছেন?’
‘না, এমন কিছু পাইনি যাতে হদিস পাওয়া যায়। তবে সিন্দুকটা এখনো খোলা হয়নি, তার চাবি তপনের কাছে।’
‘শান্তাকে জেরা করে কিছু পেয়েছেন?’
‘কাজের কথা কিছু পাইনি। মাস চারেক আগে ওদের বিয়ে হয়েছে; স্বামীর কাজকর্মের কথা শান্তা কিছুই জানে না।’
‘হুঁ। আমি কিন্তু সব জানি। কে খুন করেছে জানি, এমন কি আসামী কোথায় আছে তাও জানি—’
বিজয়বাবু লাফাইয়া উঠিলেন, ‘জানেন তবে এতক্ষণ বলেননি কেন?’
ব্যোমকেশ হাসিল, ‘সময় হলেই বলব। তার আগে আমি তপনের বাসাটা একবার ঘুরে ফিরে দেখতে চাই। আর শান্তাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই। আপনি অবশ্য তাকে যথেষ্ট জেরা করেছেন এবং সন্তোষজনক উত্তরও পেয়েছেন। আমি কেবল দু’চারটে প্রশ্ন করব।’
বিজয়বাবু বলিলেন, ‘তা বেশ। কিন্তু আসামী—’
‘আসামীকেও পাবেন।’
‘কোথায়? ওই বাড়িতে? আপনি কী বলছেন কিছুই বুঝতে পারছি না।’
‘পারবেন। আগে চলুন ওই বাড়িতে। আসামীকে ধরার জন্যে প্রস্তুত থাকবেন।’
‘তার মানে—আপনি বলতে চান তপন সেন বাসায় ফিরে আসবে, কিম্বা বাসাতেই লুকিয়ে আছে—?’
‘আসুন আসুন—’ ব্যোমকেশ অগ্রগামী হইয়া সিঁড়ির দিকে চলিল, চিন্তামণিবাবুর দ্বারের সম্মুখে দাঁড়াইয়া বলিল, ‘চিন্তামণিবাবু, আপনি নির্ভয়ে থাকুন। আমরা একবার ও বাড়িতে যাচ্ছি, ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই খুনের কিনারা হয়ে যাবে।’
তারপর আমরা সিঁড়ি দিয়ে নামিয়া গেলাম।
তপনের বাসার বুকে-পিঠে পুলিস পাহারা। একটি বিচিত্র ব্যাপার লক্ষ্য করিয়াছি, চোর পালাইলে পুলিসের বুদ্ধি বাড়ে। অপরাধী যখন অপরাধ করিয়া চম্পট দিয়াছে তখন অকুস্থলের চারিপাশে কড়া পাহারা বসাইয়া কী লাভ হয় আমি আজ পর্যন্ত বুঝিয়া উঠিতে পারি নাই। ব্যোমকেশ গলি দিয়া খিড়কির দরজার দিকে যাইতে বলিল, ‘সদর আর খিড়কির দরজা ছাড়া বাড়ি থেকে পালাবার আর কোনো রাস্তা নেই? পাঁচিল ডিঙিয়ে পালানো যায় না?’
দারোগা বিজয়বাবু বলিলেন, ‘না।’
খিড়কির দরজায় একজন পাহারাওলা দাঁড়াইয়া আছে, উপরন্তু দরজায় তালা লাগানো। বিজয়বাবুর হুকুমে পাহারাওলা তালা খুলিয়া দিল, আমরা ভিতরে গেলাম।
ছোট্ট এক টুকরা উঠানের গায়ে দু’টি ঘর, পাশে রান্নাঘর ও স্নানের ঘর। ব্যোমকেশ বলিল, বিজয়বাবু, আপনি আর অজিত শান্তার কাছে গিয়ে বসুন, আমি স্নানের ঘর আর রান্নাঘর এক নজর দেখে যাই।’ বলিয়া সে পাশের দিকে চলিল।
আমরা সামনের ঘরে প্রবেশ করিলাম। এটি বসিবার ঘর। বেতের আসবাব দিয়া সাজানো। একটি বেতের চেয়ারে শান্তা উদাস অসহায়ভাবে বসিয়া আছে। চিন্তামণি কুণ্ডু তাহার চেহারার যে বর্ণনা দিয়াছিলেন তাহা সত্য; বর্তমানে তাহার মাথার চুলগুলি অবিন্যস্ত; চোখ দুটিও ফুলোফুলো। বোধহয় কান্নাকাটি করিয়াছে।
আমরা ঘরে প্রবেশ করিলে সে মুখ তুলিল। আমাকে লক্ষ্যই করিল না, বিজয়বাবুর দিকে সপ্রশ্ন চক্ষে চাহিল। বিজয়বাবু কিছু বলিলেন না, একটা চেয়ারে উপবেশন করিলেন। আমিও বসিলাম।
তিনজনে নির্বাক বসিয়া আছি। আমি চিন্তা করিতেছি—পুলিসের জেরা শুনিয়া শুনিয়া মেয়েটা ক্লান্ত হইয়া পড়িয়াছে। সে যদি নির্দোষ হয়, স্বামীর অপরাধের সহিত তাহার যদি কোনও সংযোগ না থাকে, তবু তাহার নিষ্কৃতি নাই। কিন্তু তপন ওই লোকটাকে খুন করিল কেন? যৌন ঈর্ষা? শান্তার সঙ্গে ঐ লোকটার কি—?
ব্যোমকেশ শয়নকক্ষ হইতে প্রবেশ করিল; তাহার মুখ হাসি হাসি। সে শান্তার সম্মুখে চেয়ার টানিয়া বসিয়া স্মিতমুখে তাহার পানে চাহিয়া রহিল।
শান্তাও ক্লান্তভাবে তাহার পানে চাহিল, তারপর ধীরে ধীরে তাহার চোখে শঙ্কা ও সতর্কতা ফুটিয়া উঠিল। সে সোজা হইয়া বসিয়া একটু বিহ্বলভাবে বলিল, ‘কী—কী—?’
ব্যোমকেশ প্রফুল্ল স্বরে বলিল, ‘আপনার শোবার ঘরে একটা ছোট লোহার সিন্দুক রয়েছে দেখলাম। ওতে কী আছে?’
শান্তা বলিল, ‘দারোগাবাবুকে তো বলেছি, কি আছে আমি জানি না। আমার স্বামী সিন্দুকের চাবি নিজের কাছে রাখতেন।’
বিজয়বাবু বলিলেন, ‘সিন্দুকের তালা ভাঙবার ব্যবস্থা করেছি।’
‘বেশ বেশ, ওতে অনেক মাল পাবেন; চোরাই মাল, দুপুরে ডাকাতির গয়নাপত্র।’—ব্যোমকেশ শান্তার দিকে ফিরিল, ‘আচ্ছা, বলুন দেখি, আপনার স্বামী কি দাড়ি কামাতেন না? বাড়িতে দাড়ি কামানোর সরঞ্জাম নেই।’
শান্তার মুখ ফ্যাকাসে হইয়া গিয়াছিল, সে অস্পষ্ট স্বরে বলিল, ‘তিনি সেলুনে দাড়ি কামাতেন।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘ও। আপনার স্বামী দেখছি অসামান্য লোক ছিলেন। তিনি সেলুনে দাড়ি কামাতেন, কিন্তু বাড়িতে চটি জুতো পরতেন না। কোনো কারণ ছিল কি?’
শান্তা চক্ষু নত করিয়া বলিল, ‘ওঁর চটি ছিঁড়ে গিয়েছিল, নতুন চটি কেনা হয়নি। যখন বাড়িতে থাকতেন আমার চটি পরতেন।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘তাই নাকি। আপনাদের দু’জনের পায়ের মাপ তাহলে সমান?’
শান্তা বলিল, ‘প্রায় সমান।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘বাঃ! কত সুবিধে! আপনাদের স্বামী-স্ত্রীর দেখছি প্রায় সবই সমান, কেবল চুলের রঙ আলাদা। চিন্তামণিবাবু জানিয়েছিলেন তপনের চুলের রঙ তামাটে। ঠিক তো?’
শান্তা ঢোক গিলিয়া বলিল, ‘হ্যাঁ।’
বিজয়বাবু এতক্ষণ চোখ বাহির করিয়া প্রশ্নোত্তর শুনিতেছিলেন, হঠাৎ উঠিয়া দাঁড়াইয়া তীব্র উত্তেজনার কণ্ঠে বলিলেন, ‘ব্যোমকেশবাবু—!’
ব্যোমকেশ হাত তুলিয়া বলিল, ‘দাঁড়ান। তৈরি থাকুন, এবার আমার শেষ প্রশ্ন। —শান্তা দেবি, চিন্তামণিবাবু দেখেছিলেন আপনার গালে মসুরের মত লাল তিল আছে, সে তিলটা গেল কোথায়?’
শান্তা চকিতে নিজের বাঁ গালে হাত দিল, তারপর সামলাইয়া লইয়া বলিল, ‘তিল! আমার গালে তো তিল নেই, চিন্তামণিবাবু ভুল দেখেছেন। হয়তো লাল কালির ছিটে লেগেছিল—’
ব্যোমকেশের মুখে হিংস্র হাসি ফুটিয়া উঠিল, সে বলিল, ‘সব প্রশ্নেরই জবাব তৈরি করে রেখেছেন দেখছি। কিন্তু এ প্রশ্নের কি জবাব দেবেন!’ ক্ষিপ্রহস্তে সে শান্তার চুল ধরিয়া টান দিল, সঙ্গে সঙ্গে পরচুলা খসিয়া আসিল, ভিতর হইতে ঘাড়ে-ছাঁটা তামাটে রঙের চুল বাহির হইয়া পড়িল।
শান্তাও বিদ্যুৎবেগে জবাব দিল। একটু অবনত হইয়া সে নিজের ডান পা হইতে শাড়ির প্রান্ত তুলিল। পায়ের সঙ্গে রবারের গার্টার দিয়া আটকানো ছিল একটা লিকলিকে ছুরি। ক্ষিপ্রহস্তে ছুরি মুষ্টিতে লইয়া শান্তা ব্যোমকেশের কণ্ঠ লক্ষ্য করিয়া ছুরি চালাইল। আমি ভয়ার্ত সম্মোহিতভাবে শুধু চাহিয়া রহিলাম; একটি স্ত্রীলোকের সুশ্রী কোমল মুখ যে চক্ষের নিমেষে এমন কুশ্রী ও কঠিন হইয়া উঠিতে পারে তাহা কল্পনা করা যায় না।
দারোগা বিজয়বাবু যদি প্রস্তুত না থাকিতেন তাহা হইলে ব্যোমকেশের প্রাণ বাঁচিত কিনা সন্দেহ। তিনি বাঘের মত লাফাইয়া পড়িয়া শান্তার কব্জি ধরিয়া ফেলিলেন; ছুরি শান্তার মুষ্টি হইতে স্খলিত হইয়া মাটিতে পড়িল। সে বিষাক্ত চক্ষে ব্যোমকেশের পানে চাহিয়া সর্প-তর্জনের মত নিশ্বাস ফেলিতে লাগিল।
ব্যোমকেশ হাসিমুখে উঠিয়া দাঁড়াইল, ‘বিজয়বাবু, এই নিন আপনার খুনী আসামী, আর এই নিন খুনের অস্ত্র!’
বিজয়বাবু একটু দ্বিধাগ্রস্তভাবে বলিলেন, ‘কিন্তু চিন্তামণিবাবু বলেছিলেন তপন সেন—’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘তপন সেনের অস্তিত্ব নেই, বিজয়বাবু। আছেন কেবল অদ্বিতীয় শান্তা সেন; ইনিই রাত্রে তপন সেন, দিনে শান্তা সেন—সাক্ষাৎ অর্ধ-নারীশ্বর মূর্তি। মহীয়সী মহিলা ইনি। ভাববেন না যে, বিধূভূষণ আইচকে খুন করাই এঁর একমাত্র কীর্তি। মাস দুই আগে ইনি বর্ধমান জেলের এক গার্ডকে খুন করে জেল থেকে পালিয়েছিলেন। এঁর আসল নাম আমার জানা নেই; আপনি পুলিসের লোক, ফেরারী কয়েদীর নাম জানতে পারেন।’
বিজয়বাবু শান্তার হাত বজ্রমুষ্টিতে ধরিয়া সুবর্তুল চোখে তাহার পানে চাহিয়া রহিলেন, চিবাইয়া চিবাইয়া বলিলেন, ‘প্রমীলা পাল। এবার সব বুঝেছি। স্বামীকে বিষ খাওয়ানোর জন্যে তোমার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল। দু’বছর জেল খাটবার পর তুমি জেলের গার্ডকে খুন করে পালিয়েছিলে। পালিয়ে এখানে এসে একাই স্বামী-স্ত্রী সেজে লুকিয়েছিলে। তারপর সে-রাত্রে বিধুভূষণ তোমাকে দেখতে পায়। বিধুভূষণ তোমাকে চিনতে পেরে তোমার পিছু নিয়েছিল। এইখানে বাড়ির সামনে এসে তুমি তাকে খুন করেছ।’ ব্যোমকেশের দিকে চক্ষু ফিরাইয়া বিজয়বাবু বলিলেন, ‘কেমন—এই তো?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘মোট কথা এই বটে।’
বিজয়বাবু হুঙ্কার ছাড়িলেন, ‘জমাদার।’
জমাদার ঘরের বাহিরেই ছিল, প্রবেশ করিল। বিজয়বাবু বলিলেন, ‘হাতকড়া লাগাও।’
চিন্তামণিবাবুর ঘরে বসিয়া চা পান করিতে করিতে ব্যোমকেশ বলিল, ‘আপনার চিঠি পড়ে খটকা লেগেছিল, চিন্তামণিবাবু। আপনি ওদের দু’জনকে একসঙ্গে কখনো দেখেননি, দূরবীন লাগিয়েও ওদের ব্যুহ ভেদ করতে পারেননি। কেন? পুরুষটা বেঁটে, মেয়েটা লম্বা; হরে দরে হাঁটু জল। ওরা সদর দরজা দিয়ে যাতায়াত করে না, খিড়কি দিয়ে আসে যায়; পুরুষটা চেরা-চেরা গলায় কথা বলে। কেন? সন্দেহ হয় যে কোথাও লুকোচুরি চলছে।
‘কিন্তু বেশি ফলাও করে সব কথা বলবার দরকার নেই। স্থূলভাবে ব্যাপারটা এই—জেল ভেঙে পালাবার পর প্রমীলা পালের দুটো জিনিস দরকার হয়েছিল; ছদ্মবেশ আর রোজগার। তার মাথার চুল তামাটে রঙের, সহজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে; তাই তাকে চুল ছেঁটে পুরুষ সাজতে হল। কিন্তু দুপুরে ডাকাতি করে রোজগার করার জন্য তার মেয়েমানুষ সাজা দরকার, তাই সে একটি সুন্দর বিলিতি পরচুলো যোগাড় করল। কোথায় চুল ছেঁটেছিল, কোথা থেকে পরচুলো যোগাড় করল আমি জানি না; কিন্তু তার দ্বৈত-জীবন আরম্ভ হল। এখন শীতকাল চলছে, স্ত্রীলোকের পক্ষে পুরুষ সাজার খুব সুবিধা। সে নাকের নীচে একটি ছোট্ট প্রজাপতি-গোঁফ লাগালো, গায়ে কোট-প্যান্টের ওপর ওভারকোট চড়ালো, তারপর আপনার কাছে বাড়ি ভাড়া নিতে এল; পাছে মেয়েলি গলা ধরা পড়ে তাই আপনার সঙ্গে চেরা-চেরা গলায় কথা কইল। কলকাতা শহরে ছদ্মবেশে থাকার খুব সুবিধা, পাড়াপড়শী কেউ কারুর খবর রাখে না। কিন্তু সে লক্ষ্য করল আপনি সারাক্ষণ জানালার কাছে বসে থাকেন, আপনার বাইনোকুলার আছে। তাকে সাবধান থাকতে হবে।
‘সে-রাত্রে আপনি শুয়ে পড়বার পর সে নিজের জিনিসপত্র নিয়ে বাড়ি দখল করতে এল। কেউ জানতে পারল না যে মাত্র একজন লোক এসেছে, দু’জন নয়। তার সঙ্গে একটা ছোট্ট লোহার সিন্দুক ছিল, সেটা সে শোবার ঘরে রাখল।
‘তারপর তার দৈনন্দিন জীবনযাত্রা আরম্ভ হল। সকালবেলা সে স্কুলে পড়াবার নাম করে বেরিয়ে যায়, দুপুরবেলা ‘দুপুর ডাকাতি’ করার মতলবে ঘুরে বেড়ায়, বিকেলবেলা ফিরে আসে। আবার সন্ধ্যের পর পুরুষ সেজে বেরোয় আপনাকে ধাপ্পা দেবার জন্যে। ঘরের বিদ্যুৎবাতি নিবিয়ে পিদ্দিম জ্বেলে রেখে বেরোয়; তেল ফুরোলে পিদ্দিম নিবে যায়, আপনি ভাবেন শান্তা আলো নিবিয়ে শুয়ে পড়ল। আপনি কেবল একটা ভুল করেছিলেন; ইলেকট্রিক বাতি যে তপন বাড়ি থেকে বেরুবার আগে নেবে সেটা লক্ষ্য করেননি। আপনার মনে সন্দেহ ছিল না তাই লক্ষ্য করেননি।
‘যাক, আপনি শুয়ে পড়বার পর সে আবার বাড়িতে ফিরে আসে এবং ঘুমোয়। একটা আলোয়ান সে সম্ভবত ওভারকোটের নীচে কোমরে জড়িয়ে নিয়ে বেরুতো, ফেরবার সময় সেটা গায়ে জড়িয়ে নিত। তাই প্রথম যে-রাত্রে আপনি খড়খড়ি তুলে তাকে ফিরতে দেখলেন, আপনি ভাবলেন সে শান্তার গুপ্ত প্রণয়ী।
‘এইভাবে চলছিল। তারপর প্রমীলার হঠাৎ ভীষণ বিপদ উপস্থিত হল। বিধুভূষণ আইচ পুলিসের কর্মচারী, প্রমীলাকে আগে দেখেছিল, ছুটিতে কলকাতায় এসে সে প্রমীলাকে দেখতে পেল এবং পুরুষের ছদ্মবেশ সত্ত্বেও চিনতে পারল। সে প্রমীলার পিছু নিল। হয়তো কোনো হোটেলে দু’জনের দেখা হয়েছিল। প্রমীলা নিশ্চয় তাকে ঝেড়ে ফেলবার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু যখন পারল না, তখন—’
বাক্য অসমাপ্ত রাখিয়া ব্যোমকেশ থামিল, সিগারেট বাহির করিয়া ধরাইল।
আমি বলিলাম, ‘একটা কথা। বিধুভূষণকে খুন করে প্রমীলা বাড়ি ছেড়ে পালাল না কেন?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘পালাবার সময় পেল না। সে তো জানত না যে চিন্তামণিবাবু খড়খড়ি তুলে হত্যাকাণ্ডটা দেখে নিয়েছেন। তাই তার বিশেষ তাড়া ছিল না; ভেবেছিল দামী জিনিসপত্র গয়নাগাঁটি নিয়ে ধীরে সুস্থে পালাবে। কারণ ও বাড়িতে থাকা আর তার পক্ষে নিরাপদ নয়; বাড়ির সামনে লাশ পড়ে আছে, পুলিস নিশ্চয় তাকে জেরা করতে আসবে। প্রমীলা পাল জেল-ভাঙা খুনী আসামী, যদি পুলিসের মধ্যে কেউ তাকে চিনতে পারে? সুতরাং নিশ্চয় সে পালাতো। কিন্তু হঠাৎ পাঁচ মিনিটের মধ্যে পুলিস এসে বাড়ি ঘেরাও করে ফেলল। তখন আর পালাবার রাস্তা নেই, প্রমীলা তাড়াতাড়ি পরচুলোটা পরে নিয়ে মেয়ে সাজল। কিন্তু তাড়াতাড়িতে গালের তিলটা আঁকতে ভুলে গেল।’
‘গালে তিল আঁকতো কেন?’
‘দুটো চেহারায় রকমফের আনবার জন্যে। পুরুষবেশে নাকের নীচে গোঁফ লাগাতো, আর স্ত্রীবেশে পরচুলো ছাড়াও গালে তিল আঁকত। বুঝেছ?—আজ তাহলে উঠি, চিন্তামণিবাবু।’
চিন্তামণিবাবু গদগদ ধন্যবাদ সহ একটি দুইশত টাকার চেক লিখিয়া দিলেন। আমরা ফিরিয়া চলিলাম।
বেলা দু’টা বাজিতে বিলম্ব নাই। পুলিস আসামীকে লইয়া অন্তর্হিত হইয়াছে। এখানে তাহাদের আর প্রয়োজন নাই। শ্রীযুক্ত বিজয় ভাদুড়ী মহাশয় খুনী আসামীকে গ্রেপ্তার করিয়া নিশ্চয় প্রচুর প্রশংসা অর্জন করিবেন।
বাসায় পৌঁছিয়া দেখি সত্যবতী দরজার কাছে উৎকণ্ঠিতভাবে দাঁড়াইয়া আছে, আমাদের দেখিয়া ভ্রূ তুলিয়া সপ্রশ্ন নেত্রে চাহিল। অর্থাৎ—এত দেরি যে!
ব্যোমকেশ হঠাৎ হো হো শব্দে হাসিয়া উঠিল। তারপর হাত বাড়াইয়া সত্যবতীর চিবুক একটু নাড়িয়া দিয়া বলিল, ‘তোমরাও কম যাও না।’