এক
প্রকৃতির অলঙ্ঘনীয় বিধানে ব্যোমকেশের সহিত যখন সত্যবতীর দাম্পত্য কলহ বাধিয়া যাইত, তখন আমি নিরপেক্ষভাবে বসিয়া তাহা উপভোগ করিতাম। কিন্তু দাম্পত্য কলহে যখন স্ত্রীজাতি এবং পুরুষজাতির আপেক্ষিক উৎকর্ষের প্রসঙ্গ আসিয়া পড়িত তখন বাধ্য হইয়া আমাকে ব্যোমকেশের পক্ষ অবলম্বন করিতে হইত। তবু দুই বন্ধু একজোট হইয়াও সব সময় সত্যবতীর সহিত আঁটিয়া উঠিতাম না। বস্তুত মানুষের ইতিহাসে পুরুষজাতির দুষ্কৃতির নজির এত অপর্যাপ্ত লিপিবদ্ধ হইয়া আছে যে, তাহা খণ্ডন করা এক প্রকার অসম্ভব। শেষ পর্যন্ত আমাদের রণে ভঙ্গ দিতে হইত।
কিছুকাল হইতে কলিকাতা শহরে এক নূতন উৎপাতের প্রাদুর্ভাব হইয়াছে, একদিন শীতের সকালবেলা সংবাদপত্র সহযোগে চা পান করিতে করিতে ব্যোমকেশ ও আমি তাহাই আলোচনা করিতেছিলাম। যে ব্যাপার ঘটিতে আরম্ভ করিয়াছে তাহার প্রক্রিয়া মোটামুটি এইরূপ: কখনও একটি, কখনও বা একাধিক ভদ্ৰশ্রেণীর যুবতী তাক্ বুঝিয়া দুপুরবেলা বাহির হয়। পুরুষেরা তখন কাজে গিয়াছে, বাড়িতে মেয়েরা আহারাদি সম্পন্ন করিয়া দিবানিদ্রার উদ্যোগ করিতেছে। এই সময় যুবতীরা গিয়া দরজায় টোকা মারে। বাড়ির গৃহিণী যদি সতর্ক হন, তিনি দ্বার না খুলিয়াই জিজ্ঞাসা করেন, ‘কে?’ একটি যুবতী বাহির হইতে বলে, ‘চিকনের কাজ করা ভাল সায়া-ব্লাউজ এনেছি, দাম খুব সস্তা—কিনবেন?’ গৃহিণী ভাবেন ফেরিওয়ালী, তিনি দ্বার খুলিয়া দেন। অমনি যুবতীরা ঘরে ঢুকিয়া পড়ে, ছুরি বা পিস্তল দেখাইয়া টাকাকড়ি গহনাপত্র কাড়িয়া লইয়া প্রস্থান করে।
এই ধরনের ঘটনা পূর্বে কয়েকবার ঘটিয়া গিয়াছে, আসামীরা ধরা পড়ে নাই। সেদিন কাগজ খুলিয়া দেখি অনুরূপ ব্যাপার ঘটিয়াছে আগের দিন দুপুরবেলা কাশীপুরের একটি গৃহস্থের বাড়িতে। ব্যোমকেশকে খবরটি পড়িয়া শুনাইলাম। সে একটু বঙ্কিম হাসিয়া বলিল, ‘এতে আশ্চর্য হবার কী আছে! মেয়েরা তো দুপুরে ডাকাতি করেই থাকে।’
এই সময় সত্যবতী ঘরে প্রবেশ করিল। দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া ব্যোমকেশের পানে কুটিল কটাক্ষপাত করিয়া বলিল, ‘আহা! মেয়েরা দুপুরে ডাকাতি করে, আর তোমরা সব সাধুপুরুষ।’
ব্যোমকেশ সত্যবতীকে শুনাইবার জন্য কথাটা বলে নাই; কিন্তু সত্যবতী যখন শুনিয়া ফেলিয়াছে এবং জবাব দিয়াছে তখন আর পশ্চাৎপদ হওয়া চলে না। ব্যোমকেশ বলিল, ‘আমরা সবাই সাধুপুরুষ এমন কথা বলিনি। কিন্তু তোমরাও কম যাও না।’
সুতরাং তর্ক আরম্ভ হইয়া গেল। সত্যবতী তক্তপোশের কিনারায় বসিল, বলিল, ‘মেয়েদের নিন্দে করা তোমাদের স্বভাব। মেয়েরা কী করেছে শুনি?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘বেশি কিছু নয়, দুপুরে ডাকাতি।’
আমি খবরের কাগজ হইতে দুপুরে ডাকাতির অংশটা পড়িয়া শুনাইলাম। সত্যবতী বলিল, বেশ, মেনে নিলাম, ওরা দোষ করেছে, পেটের দায়ে অন্যায় করেছে। কিন্তু তোমরা যে খুন-জখম করছ, যুদ্ধ বাধিয়ে হাজার হাজার লোক মারছ, তার বেলা কিছু নয়? তোমাদের তুলনায় মেয়েরা ক’টা খুন করেছে!’
বেগতিক দেখিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘তোমরা এতদিন ঘরের মধ্যে বন্ধ ছিলে তাই বিশেষ সুবিধে করতে পারনি; এখন স্বাধীনতা পেয়ে তোমাদের বিক্রম বেড়েছে, ক্রমে আরো বাড়বে। বঙ্কিমচন্দ্র কতকাল আগে দেবী চৌধুরানীর কথা লিখে গেছেন। দেবী চৌধুরানী সেকেলে মেয়ে ছিল, তাতেই এই। যদি একালের মেয়ে হত তাহলে কী কাণ্ডটা হত ভেবে দেখ অজিত!’
সত্যবতী হাত নাড়িয়া বলিল, ‘ওসব বাজে কথা বলে আমার চোখে ধুলো দিতে পারবে না। সত্যিকার ক’টা দৃষ্টান্ত দেখাতে পারো যেখানে মেয়েমানুষ খুন করেছে?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘সত্যিকারের দৃষ্টান্ত চাও! আরে এই তো সেদিন—বড়জোর মাস দুই হবে—জেনানা ফাটকের এক বন্দিনী জেলখানার গার্ডকে খুন করে নিরুদ্দেশ হয়েছে।’
সত্যবতী হাসিয়া উঠিল, ‘দু’মাস আগে একটা মেয়ে একটা খুন করেছিল। এই দু’ মাসের মধ্যে তোমরা ক’টা খুন করেছ তার হিসেব দাও দেখি।’
আজিকার কাগজেও একটা পুরুষ-কৃত খুনের খবর ছিল কিন্তু আমি তাহা চাপিয়া গেলাম: তৎপরিবর্তে বলিলাম, ‘আজকের কাগজে স্ত্রীজাতির নৃশংতার একটা গুরুতর দৃষ্টান্ত রয়েছে। একটা ধোপা এক মহিলার দামী সিল্কের শাড়িতে খোঁচ লাগিয়েছিল, মহিলাটি বঁটি দিয়ে তার নাক কেটে নিয়েছেন। ধোপার অবস্থা শোচনীয়, হাসপাতালে আছে, বাঁচবে কিনা সন্দেহ।’
সত্যবতী নির্দয় হাসিয়া বলিল, ‘মিছে কথা বলতেও তোমাদের জোড়া নেই। তোমরা সবাই মিথ্যেবাদী চোর ডাকাত খুনী—’
আমাদের তর্ক কতদূর গড়াইত বলা যায় না, কিন্তু এই সময় বহিদ্বারের কড়া খটখট শব্দে নড়িয়া উঠিল। সত্যবতী বিজয়িনীর ন্যায় উন্নত মস্তকে ভিতরে চলিয়া গেল। আমি দ্বার খুলিয়া দেখিলাম, ডাকপিওন; একটা পুরুষ্টুগোছের লম্বা খাম দিয়া চলিয়া গেল।
ব্যোমকেশের নামে খাম, প্রেরকের উল্লেখ নাই। তাহাকে খাম আনিয়া দিলে সে শঙ্কিতভাবে উহা টিপিয়া-টুপিয়া বলিল, ‘নবীন লেখকের পাণ্ডুলিপি মনে হচ্ছে। প্রভাতের কাছে পাঠিয়ে দাও।’
আমরা পুস্তক প্রকাশকের ব্যবসায় শরিক হইয়া পড়িবার পর হইতে উৎসাহশীল নবীন লেখকেরা প্রায়ই আমাদের কাছে পাণ্ডুলিপি পাঠাইয়া থাকেন, তাই ব্যোমকেশ মোটা খামের চিঠি দেখিলেই তটস্থ হইয়া ওঠে।
বলিলাম, ‘পাণ্ডুলিপি নাও হতে পারে। খুলেই দেখ না।’
সে বলিল, ‘তুমি খুলে দেখ।’
খাম খুলিলাম। পাণ্ডুলিপি নয় বটে, কিন্তু ব্যোমকেশকে কেহ লম্বা চিঠি লিখিয়াছে; প্রায় একটা ছোটগল্পের শামিল। ব্যোমকেশ অনেকটা আশ্বস্ত হইয়া তক্তপোশের উপর লম্বা হইল, বলিল, ‘প্রেমপত্র নয় নিশ্চয়। সুতরাং তুমি পড়, আমি শুনি।’
তক্তপোশের পাশে চেয়ার টানিয়া আমি চিঠি পড়িতে আরম্ভ করিলাম। হাতের লেখা খুব স্পষ্ট নয়, একটু কষ্ট করিয়া পড়িতে হয়; কিন্তু ভাষা বেশ ঝরঝরে—
শ্রীব্যোমকেশ বক্সী মহাশয় সমীপে
সবিনয় নমস্কারপূর্বক নিবেদন,
আমার নাম শ্ৰীচিন্তামণি কুণ্ডু। পুলিস আমাকে খুনের মামলায় জড়াইবার চেষ্টা করিতেছে, তাই নিরুপায় হইয়া আপনার শরণ লইয়াছি। শক্তি থাকিলে আমি আপনার সঙ্গে দেখা করিতাম, আমার বক্তব্য মুখে বলিলে আরও পরিষ্কার হইত। কিন্তু কয়েক বৎসর যাবৎ আমি পক্ষাঘাত রোগে পঙ্গু হইয়াছি, আমার বাম অঙ্গ অচল হইয়া পড়িয়াছে; ঘরের মধ্যে অল্প চলা ফেরা করিতে পারি মাত্র। তাই বাধ্য হইয়া পত্র লিখিতেছি।
যে গুরুতর ব্যাপার ঘটিয়াছে তাহা বিবৃত করিবার পূর্বে আমার নিজের পরিচয় কিছু জানাইতে ইচ্ছা করি। আমার বয়স এখন সাতান্ন বৎসর; স্ত্রী-পুত্র নাই, কেবল তিনটি বাড়ি আছে। বাড়িগুলি ভাড়া দিয়াছি, তন্মধ্যে একটি বাড়ির দ্বিতলে দুইটি ঘর লইয়া আমি থাকি। ভৃত্য রামাধীন আমার পরিচর্যা করে।
শিরোনামায় ঠিকানা দেখিয়া বুঝিবেন আমি কলিকাতার পূর্ব-দক্ষিণ অঞ্চলে থাকি। রাস্তাটি বেশ চওড়া; যে-বাড়িতে আমি থাকি সেটি রাস্তার এক দিকে, আমার অন্য বাড়ি দু’টি প্রায় তাহার সামনাসামনি, রাস্তার অপর দিকে। এই বাড়ি দু’টি অপেক্ষাকৃত ছোট এবং একতলা; ইহাদের যমজ বাড়ি বলিতে পারেন। দু’টি বাড়ির মাঝখান দিয়া খিড়কির দিকে যাইবার সরু গলি আছে।
আমি রোগে পঙ্গু, দু’টি ঘরের মধ্যেই আমার জীবন। পক্ষাঘাত হওয়ার আগে আমি দালালি করিতাম, অনেক ছুটাছুটি করিয়াছি; ছুটাছুটি করিতেই আমি অভ্যস্ত। তাই এখন সারা বেলা জানালার সামনে বসিয়া থাকি, রাস্তার লোক চলাচল দেখি। একটি বাইনোকুলার কিনিয়াছি, তাহাই চোখে দিয়া দূরের দৃশ্য দেখি। বাইনোকুলার দিয়া অনেক বাড়ির ভিতরের দৃশ্যও দেখা যায়; আমার যমজ বাড়ির ভাড়াটেদের উপর নজর রাখিতে পারি। যাহাদের ক্ষমতা আছে তাহারা সিনেমা থিয়েটার দেখে; আমি জানালায় বসিয়া সাদা চোখে প্রবহমান জীবনস্রোত দেখি এবং চোখে দূরবীন লাগাইয়া নেপথ্যদৃশ্য দেখি। কত বিচিত্র দৃশ্য যে দেখিয়াছি শুনিলে আশ্চর্য হইয়া যাইবেন। কিন্তু সে-কথা যাক।
মাস দেড়েক আগে পৌষ মাসের মাঝামাঝি একটি ছোকরা আমার সঙ্গে দেখা করিতে আসিল। বেঁটে-খাটো চেহারা, ঘাড়ে-ছাঁটা তামাটে রঙের চুল, তরতরে মুখ, নাকের নীচে ছোট্ট একটি প্রজাপতি-গোঁফ আছে। পরিধানে দামী বিলাতি পোশাক, তাহার উপর ক্যামেলহেয়ার কাপড়ের ওভারকোট। দ্বারের কাছে দাঁড়াইয়া সসম্ভ্রমে বলিল, ‘আমার নাম তপন সেন। আসতে পারি?’
আমি তখন জানালার কাছে বসিয়া খবরের কাগজ পড়িতেছিলাম, মুখ তুলিয়া বলিলাম, ‘আসুন।’
তপন সেন আসিয়া একটা চেয়ার টানিয়া আমার সম্মুখে বসিল। আমি বলিলাম, ‘কি দরকার বলুন তো?’
সে জানালার বাহিরে আঙুল দেখাইয়া বলিল, ‘আপনার জোড়া-বাড়ির একটা বাড়ি খালি হয়েছে। তাই এলাম, যদি আমাকে ভাড়া দেন।’
বাড়িটা কিছুদিন হইতে খালি পড়িয়া ছিল। আগের ভাড়াটে বাড়ি তছনছ করিয়া দিয়াছিল, আবার তাহা মেরামত ও চুনকাম করাইয়া রাখিয়াছিলাম; ঠিক করিয়াছিলাম ভাল ভাড়াটে না পাইলে ভাড়া দিব না। ছোকরাকে দেখিয়া শুনিয়া ভালই মনে হইল, সাজপোশাক হইতে অবস্থাপন্ন বলিয়া মনে হয়। জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘আপনার কি করা হয়?’
সে ওভারকোটের পকেট হইতে সিগারেটের কৌটা বাহির করিয়া আবার রাখিয়া দিল; বোধ হয় আমার ন্যায় বয়োবৃদ্ধের প্রতি সম্ভ্রমবশতই সিগারেট ধরাইল না। বলিল, ‘খবরের কাগজের অফিসে চাকরি করি। নাইট এডিটার। সারা রাত কাজ করি আর সারা দিন ঘুমোই।’ বলিয়া একটু হাসিল।
প্রশ্ন করিলাম, ‘সংসারে কে কে আছে?’
সে স্মিতমুখে বলিল, ‘সবেমাত্র সংসার আরম্ভ করেছি। আমি আর আমার স্ত্রী। আর কেউ নেই।’
মনে মনে খুশি হইলাম। ছেলেপিলে থাকিলে বাড়ি নষ্ট করে, দেয়ালে কালি দিয়া ছবি আঁকে। বলিলাম, ‘বেশ, আপনাকে ভাড়া দেব। দেড় শো টাকা ভাড়া।’
সে ইতস্তত করিয়া বলিল, ‘আমার পক্ষে একটু বেশি হয়ে যায়—’
বলিলাম, ‘সাজানো বাড়ি। খাট-বিছানা টেবিল-চেয়ার কাবার্ড সব পাবেন।’
‘আচ্ছা, তাহলে রাজী। বাড়িটা একবার দেখতে পারি কি?’
চাবি দিলাম, তপন সেন গিয়া বাড়ি দেখিয়া আসিল। তারপর দেড় শো টাকা বাহির করিয়া দিয়া বলিল, ‘এই নিন এক মাসের ভাড়া।’
আমি টাকার রসিদ লিখিয়া দিয়া বলিলাম, ‘কবে থেকে বাড়িতে আসবেন?’
সে বলিল, ‘কাল ইংরেজি মাসের পয়লা। বাড়ি তো খালিই পড়ে আছে, যদি অনুমতি দেন আজই কোনো সময় আসতে পারি।’
বলিলাম, ‘বেশ, যখন ইচ্ছে আসবেন।’
তপন সেন চাবি লইয়া চলিয়া গেল। ভাল ভাড়াটে পাইয়াছি ভাবিয়া মনে মনে উৎফুল্ল হইলাম।
সেদিন সারা বিকালবেলা জানালায় বসিয়া বাড়ির দিকে তাকাইয়া রহিলাম, কিন্তু তপন তাহার স্ত্রীকে লইয়া আসিল না।
সকালবেলা জানালা খুলিয়া দেখি উহারা আসিয়াছে। সদর দরজা খোলা। নিশ্চয় রাত্রে কোনো সময় মালপত্র লইয়া আসিয়াছে।
আমার কৌতূহলী চক্ষু ওই দিকেই যাতায়াত করিতে লাগিল। বেলা সাড়ে ন’টার সময় একটি যুবতী আসিয়া ভিতর দিক হইতে সদর দরজা বন্ধ করিয়া দিল। তারপর কয়েক মিনিট গত হইলে খিড়কি দরজার গলি দিয়া সে বাহির হইয়া আসিল।
তখন তাহাকে ভাল করিয়া দেখিলাম। লম্বা ছিমছাম চেহারা, মাথায় একমাথা চুল এলো খোঁপার আকারে ঘাড়ের উপর বিন্যস্ত, হাতে একটি ছোট অ্যাটাচি-কেস। ভাবিলাম, সারা রাত কাজ করিয়া তখন ঘুমাইতেছে, তাই তার বউ বাজার করিতে চলিয়াছে।
কিন্তু দুপুর কাটিয়া গেল সে ফিরিয়া আসিল না। একেবারে ফিরিল অপরাহ্ণে আন্দাজ চারটার সময়। সদর দরজার কড়া নাড়িল না, গলি দিয়া খিড়কির দিকে চলিয়া গেল। বোধ হয় স্বামী মহাশয়ের নিদ্রাভঙ্গ করিতে চায় না।
কিছুক্ষণ পরে আমি রামাধীনকে পাঠাইলাম। নূতন ভাড়াটে, তাহাদের সুবিধা অসুবিধার খোঁজ-খবর লওয়া দরকার। জানালায় বসিয়া দেখিলাম রামাধীন গিয়া দ্বারের কড়া নাড়িল। মেয়েটি দ্বার খুলিয়া দিল। রামাধীনের সহিত কথা বলিয়া মেয়েটি একবার চোখ তুলিয়া আমার জানালার পানে চাহিল, তারপর রামাধীনের সঙ্গে দ্বিতলে আমার কাছে উঠিয়া আসিল।
দূর হইতে তাহাকে দেখিয়াছিলাম, এখন কাছে হইতে দেখিলাম। ভারী সুশ্রী চেহারা, লম্বা একহারা, মেদ-গ্রন্থির বাহুল্য নাই; বাঁ গালের উপর মসুরের মত একটি লাল তিল, তাহাতে মুখের লালিত্য আরও বাড়িয়াছে। একটি বিষয় লক্ষ্য করিলাম, স্বামী-স্ত্রীর বয়স প্রায় একই রকম—তেইশ-চব্বিশ। হয়তো প্রেমে পড়িয়া বিবাহ করিয়াছে। আজকাল তো কতই এমন দেখা যায়।
ছোট্ট নমস্কার করিয়া বলিল, ‘আমার নাম শান্তা। আমাদের কোনো অসুবিধে নেই; খুব সুন্দর বাড়ি পেয়েছি।’ তাহার কথা বলিবার ভঙ্গী যেমন মিষ্ট, গলার স্বরও তেমনি নরম।
বলিলাম, ‘বসুন। আপনি—’
সে মাথা নাড়িয়া বলিল, ‘আমাকে ‘আপনি’ বলবেন না। আমি আপনার মেয়ের বয়সী।’
বলিলাম, ‘তা—আচ্ছা। তোমাদের ঝি-চাকর যদি দরকার থাকে, নতুন পাড়ায় এসেছ—’
সে বলিল, ‘ঝি-চাকরের দরকার নেই। দু’জনের সংসার, আমি একাই সব কাজ সামলে নিতে পারব।’
বলিলাম, ‘বেশ বেশ। তা—আজ তুমি সকালবেলা বেরিয়েছিলে, এখন ফিরলে। সারা দিন কোথায় ছিলে?’
সে বলিল, ‘আমি স্কুলে পড়াই। চেতলার দিকে একটা ছোট মেয়েদের স্কুল আছে, সেখানে শিক্ষয়িত্রীর কাজ করি। —আচ্ছা, আজ যাই, ওর খাবার তৈরি করতে হবে। সন্ধ্যার পর ও কাজে বেরুবে।’ শান্তা একটু হাসিয়া ঘাড় হেলাইয়া চলিয়া গেল।
ইহাদের দু’জনকেই আমার ভাল লাগিয়াছে। বর্তমানে ভাড়াটেদের লইয়াই আমার জীবন। তাহারা আমার বাড়িতে বাস করে, ভাড়া দেয়, নিজের ধান্দায় থাকে; মেলামেশা নাই। জোড়া-বাড়ির অন্য অংশে একটি মাদ্রাজী পরিবার থাকে; তাহারা আমার ভাষা বোঝে না, কেবল মাসান্তে ভাড়া দিয়া রসিদ লইয়া যায়। ইহাদের সহিত আমার হৃদয়ের কোনও যোগ নাই। কিন্তু এই নবীন বাঙালী দম্পতি আমার হৃদয় আকর্ষণ করিয়াছে।
জানালায় বসিয়া দেখিলাম, সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হইবার পর তপন কোট প্যান্ট ও ওভারকোট চড়াইয়া খিড়কির গলি দিয়া বাহির হইল, বাড়ির সামনে ল্যাম্পের নীচে দাঁড়াইয়া সিগারেট ধরাইল, তারপর বাস্-রাস্তার দিকে চলিয়া গেল। সারা রাত বাহিরে থাকিবে, ভোরের দিকে কাজ শেষ করিয়া ফিরিবে।
অতঃপর উহাদের নিয়ম-বাঁধা জীবনযাত্রা চলিতে লাগিল। সকালে সাড়ে ন’টার সময় শান্তা স্কুলে পড়াইতে চলিয়া যায়, বিকালে ফিরিয়া আসে। তপন সন্ধ্যার পর বাহির হয়, রাত্রে কখন ফেরে জানি না। উহাদের জীবনযাত্রা অতি শান্ত; বাড়িতে অতিথি আসে না, হয়তো বন্ধুবান্ধব চেনা-পরিচিত কেহ কাছাকাছি নাই। তপন বাড়ি হইতে রাত্রে বাহির হইবার পর বাড়ির ইলেকট্রিক বাতি নিবিয়া যায়, কেবল সামনের ঘরে মৃদু মোমবাতি জ্বলে। তাহাও আটটা বাজিতে না বাজিতে নিবিয়া যায়। শান্তা বোধ হয় সারা দিনের ক্লান্তির পর তাড়াতাড়ি শুইয়া পড়ে।
উহাদের বিষয়ে আমার মনে যথেষ্ট কৌতূহল আছে, তাই যখন তখন চোখে দূরবীন লাগাইয়া বাড়িটা দেখি। কিন্তু বাহির হইতে বাড়ির অভ্যন্তর কিছুই দেখা যায় না; সদর দরজা যেমন বন্ধ থাকে, সদরের জানালায় তেমনি পর্দা টানা থাকে। কেবল রাত্রিকালে পর্দার ভিতর দিয়া মোমবাতির মোলায়েম আলো দেখা যায়।
একদিন রবিবার সকালবেলা শান্তা আসিয়া খানিকক্ষণ আমার সঙ্গে গল্পসল্প করিল। আমি রহস্যচ্ছলে জিজ্ঞাসা করিলাম, ‘তোমার কর্তাটি এখনো ঘুমোচ্ছেন বুঝি?’
সে সলজ্জভাবে বলিল, ‘হ্যাঁ, সারা রাত ঘুমোতে পায় না, তাই—’
আমি বলিলাম, ‘তুমি রাত্রে ইলেকট্রিক বাতি জ্বালাও না দেখেছি। কেন বল দেখি?’
শান্তা সচকিত হইয়া বলিল, ‘আমার চোখ ভাল নয়, উজ্জ্বল আলো বেশিক্ষণ সহ্য হয় না। ও আবার কম আলোয় দেখতে পায় না। তাই ও চলে গেলেই ইলেকট্রিক নিবিয়ে পিদ্দিম জ্বালি। আপনি লক্ষ্য করেছেন বুঝি?’
‘হ্যাঁ। আমি তো সকাল থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত এই জানালার ধারেই বসে থাকি।’
শান্তা সহানুভূতিপূর্ণ স্বরে বলিল, ‘সত্যি, আপনার তো কোথাও যাবার উপায় নেই। তা আমি মাঝে মাঝে আসব, ওকেও পাঠিয়ে দেব।’
এইভাবে চলিতেছে। একদিন সন্ধ্যার পর তপনও কাজে যাইবার পথে আমার কাছে আসিয়া দুই চারিটা কথা বলিয়া গেল।
তারপর একদিন গভীর রাত্রে একটি ব্যাপার লক্ষ্য করিলাম।
আমি সাধারণত রাত্রি সাড়ে ন’টার সময় শয়ন করি। কিন্তু আমার অনিদ্রা রোগ আছে, মাঝে মাঝে রাত্রে ঘুম হয় না, তখন প্রায় সারা রাত জাগিয়া থাকি। দুই হপ্তা আগে রাত্রে যথাসময় শয়ন করিলাম কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসিল না। বারোটা পর্যন্ত সাধ্যসাধনা করিয়া উঠিয়া পড়িলাম; ভাবিলাম এক পেয়ালা গরম কোকো পান করিলে ঘুম আসিতে পারে। স্টোভ জ্বালিয়া জল চড়াইয়া দিলাম। রামাধীন আমার ঘরের বাহির দ্বারের সম্মুখে শয়ন করে, তাহাকে আর জাগাইলাম না।
শীতের রাত্রি, জানালা বন্ধ আছে। হঠাৎ কি মনে হইল, জানালার খড়খড়ি তুলিয়া বাহিরে তাকাইলাম। নিষুতি রাত্রে রাস্তায় জনমানব নাই; জোড়া-বাড়ির সামনে রাস্তার আলোটা জ্বলিতেছে। বাড়ি দু’টার ভিতরে অন্ধকার।
একটা লোক ওদিকের ফুটপাথ দিয়া আসিতেছে। তাহার মাথা হইতে হাঁটু পর্যন্ত কালো র্যাপারে ঢাকা; জোড়া- বাড়ির বরাবর আসিয়া সে থামিল, ঘাড় ফিরাইয়া পিছনে ও আশেপাশে দেখিল, তারপর সুট্ করিয়া দুই বাড়ির মাঝখানে গলির মধ্যে ঢুকিয়া পড়িল। আর তাহাকে দেখিতে পাইলাম না। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে তপনের ঘরে বিদ্যুৎবাতি জ্বলিয়া উঠিয়া আবার নিবিয়া গেল।
কোকো প্রস্তুত করিয়া পান করিতে করিতে চিন্তা করিলাম। কে লোকটা? তাহার ভাবভঙ্গীতে যেন সতর্ক সাবধানতা রহিয়াছে। ওই গলি গিয়া মাদ্রাজীদের খিড়কি দরজাতেও যাওয়া যায়। কিন্তু মাদ্রাজীরা সংখ্যায় অনেকগুলি, সন্ধ্যার পর দোর তালাবন্ধ করিয়া ঘুমাইয়া পড়ে; এই লোকটা নিঃসন্দেহে তপনের ঘরে গিয়াছে। তপন রাত্রে বাড়ি থাকে না, শান্তা একলা থাকে; এই সময় লোকটা চুপিচুপি আসিয়াছে। কী ব্যাপার!
গভীর রাত্রি, স্বামী অনুপস্থিত, বাড়িতে একটি যুবতী ছাড়া অন্য কেহ নাই; এই সময় র্যাপার মুড়ি দিয়া লোক আসে। অর্থাৎ—?
মনটা খারাপ হইয়া গেল। শান্তাকে ভাল মেয়ে বলিয়াই মনে হইয়াছিল; কিন্তু আজকাল মুখ দেখিয়া স্ত্রী-চরিত্র বোঝা দুষ্কর। —মরুক গে, আমার কি! ভাড়াটেদের স্ত্রী কী করিতেছে তাহার খোঁজে আমার প্রয়োজন কি? আমার যথাসময়ে ভাড়া পাইলেই হইল।
একবার ভাবিলাম জানালায় দাঁড়াইয়া দেখি লোকটা কতক্ষণে বাহির হয়। কিন্তু কোকো পান করিয়া একটু ঘুমের আমেজ আসিতেছিল, আমি শুইয়া পড়িলাম। আসন্ন ঘুমকে খোঁচা দিয়া তাড়াইলে হয়তো সারা রাত জাগিয়া থাকিতে হইবে।
এই ঘটনার পর দুই হপ্তা কাটিয়া গিয়াছে। গত রবিবার তপন আসিয়া বাড়িভাড়া দিয়া গিয়াছে, উল্লেখযোগ্য আর কিছু ঘটে নাই। তপনকে নৈশ আগন্তুকের কথা বলি নাই। কী দরকার আমার?
তারপর হঠাৎ পরশু রাত্রির ব্যাপার!
পরশু রাত্রেও আমাকে অনিদ্রা রাগে ধরিয়াছিল। বারোটা পর্যন্ত বিছানায় এ-পাশ ও-পাশ করিয়া উঠিয়া পড়িলাম; স্টোভে কোকোর জল চড়াইয়া দিয়া জানলার খড়খড়ি তুলিয়া উঁকি মারিলাম। লোকটা যেন আমার উঁকি মারার জন্যই অপেক্ষা করিতেছিল—সেই র্যাপার-ঢাকা লোকটা। সে ফুটপাথ দিয়া দ্রুতপদে আসিয়া গলির ঠিক মুখের কাছে একটু ভিতর দিকে লুকাইয়া পড়িল। তারপর একই দিক হইতে আর একটা লোক আসিতেছে দেখিলাম; গলায় কম্ফর্টার-জড়ানো লোকটা গলির মুখ পর্যন্ত আসিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল, অনিশ্চিতভাবে এদিক-ওদিক চাহিতে লাগিল। মনে হইল সে র্যাপার-ঢাকা লোকটাকে অনুসরণ করিয়াছিল, এখন আর তাহাকে খুঁজিয়া পাইতেছে না।
এই সময় র্যাপার-ঢাকা লোকটা মুখ হইতে র্যাপার সরাইল। সবিস্ময়ে চিনিলাম—তপন! তারপর মুহূর্তে মধ্যে একটা ভয়ঙ্কর ব্যাপার ঘটিয়া গেল। তপনের হাতে একটি ছুরি ঝলকাইয়া উঠিল, সে এক লাফে সামনে আসিয়া কম্ফর্টার-জড়ানো লোকটার বুকে ছুরি বিঁধিয়া দিল। লোকটা ফুটপাথের উপর পড়িয়া গেল। তপন বিদ্যুৎবেগে আবার গলির মধ্যে ঢুকিয়া পড়িল।
আমি হতভম্বভাবে চাহিয়া রহিলাম। লোকটা ফুটপাথের উপর নিশ্চল হইয়া পড়িয়া আছে, একটা কাকুতি পর্যন্ত তাহার মুখ দিয়া বাহির হইতেছে না। নিশ্চয় মরিয়া গিয়াছে—
আমার ঘরে টেলিফোন আছে। এই ঘটনার ধাক্কা সামালাইয়া আমি থানায় ফোন করিলাম। আমাদের থানা কাছেই, পাঁচ মিনিটের মধ্যে পুলিস আসিয়া পড়িল। দারোগাবাবু আমার বয়ান শুনিয়া তপনের বাসা ঘেরাও করিলেন।
তপনকে কিন্তু বাড়িতে পাওয়া গেল না। শান্তা ঘুমাইতেছিল, সে কিছু জানিতে পারে নাই। তপন খিড়কির দরজা খুলিয়া বাড়িতে আসিয়াছিল তাহাতে সন্দেহ নাই; সে বাসায় বস্ত্রাদি বদল করিয়া শান্তাকে না জাগাইয়া চুপিচুপি পলায়ন করিয়াছে।
সে-রাত্রে মৃতদেহ সনাক্ত হয় নাই; পরে জানা গিয়াছে মৃত ব্যক্তির নাম বিধুভূষণ আইচ, বর্ধমানের পুলিসের কর্মচারী ছিল, সম্প্রতি ছুটি লইয়া কলিকাতায় আসিয়াছিল।
তপনের বাসায় পুলিসের পাহারা কায়েম আছে। তপন এখনও ধরা পড়ে নাই। দারোগাবাবু ক্রমাগত শান্তাকে জেরা করিয়া চলিয়াছেন। অথচ সে বেচারী নির্দোষ। আমি তাহার প্রতি অন্যায় সন্দেহ করিয়াছিলাম সেজন্য লজ্জিত আছি। এখন বুঝিয়াছি তপনই মধ্যরাত্রে র্যাপার মুড়ি দিয়া বাসায় ফিরিয়া আসিত।
এদিকে আমার অবস্থা শোচনীয় হইয়া উঠিয়াছে। তপন কেন খুন করিয়াছে আমি কিছুই জানি না, অথচ ঘণ্টায় ঘণ্টায় নূতন পুলিস অফিসার আসিয়া আমাকে জেরা করিয়া যাইতেছেন। আমি চলচ্ছক্তিহীন পঙ্গু মানুষ কিন্তু পুলিস বোধ হয় সন্দেহ করে যে খুনের জন্য আমি দায়ী। আমার অপরাধ এই যে, তপন আমার ভাড়াটে এবং আমি হত্যাকাণ্ড প্রত্যক্ষ করিয়াছি।
এখন আপনার কাছে বিনীত অনুরোধ, আপনি আমাকে উদ্ধার করুন; আমার প্রাণ অতিষ্ঠ হইয়া উঠিয়াছে। পুলিস হয়তো সন্দেহের উপর আমাকে ধরিয়া লইয়া গিয়া হাজতে পুরিবে; তাহা হইলে আমি মরিয়া যাইব। আমার টাকা আছে; আপনি যদি আমাকে উদ্ধার করিতে পারেন আমি আপনাকে খুশি করিয়া দিব।
আর অধিক কি। যত শীঘ্র পাবেন আমাকে পুলিসের ঝামেলা হইতে রক্ষা করুন। আমি আপনার নিকট চিরকৃতজ্ঞ থাকিব।
বশংবদ
শ্ৰীচিন্তামণি কুণ্ডু