অদল বদল

অদল বদল

কালিদাসের মেঘদূত ব্যাপারটা কি বোধ হয় আপনারা জানেন। যদি ভুলে গিয়ে থাকেন তাই একটু মনে করিয়ে দিচ্ছি। কুবেরের অনুচর এক যক্ষ কাজে ফাঁকি দিত, সেজন্য প্রভুর শাপে তাকে এক বৎসর নির্বাসনে থাকতে হয়। সে রামগিরিতে আশ্রম তৈরি করে বাস করতে লাগল। আষাঢ়ের প্রথম দিনে যক্ষ দেখল, পাহাড়ের মাথায় মেঘের উদয় হয়েছে, দেখাচ্ছে যেন একটি হস্তী বপ্রক্রীড়া করছে। অঞ্জলিতে সদ্য ফোটা কুড়চি ফুল নিয়ে সে মেঘকে অর্ঘ্য দিল এবং মন্দাক্রান্তা ছন্দে একটি সুদীর্ঘ অভিভাষণ পাঠ করল। তার সারমর্ম এই। —ভাই মেঘ, তোমাকে একবার অলকাপুরী যেতে হচ্ছে। ধীরে সুস্থে যেয়ো, পথে কিঞ্চিৎ ফুর্তি করতে গিয়ে যদি একটু দেরি হয়ে যায় তাতে ক্ষতি হবে না। অলকায় তোমার বউদিদি আমার বিরহিণী প্রিয়া আছেন, তাঁকে আমার বার্তা জানিয়ে আশ্বস্ত ক’রো। ব’লো আমার শরীর ভালোই আছে, কিন্তু চিত্ত তাঁর জন্য ছটফট করছে। নারায়ণ অনন্তশয্যা থেকে উঠলেই অর্থাৎ কার্তিক মাস নাগাদ শাপের অবসান হবে, তারপরেই আমরা পুনর্মিলিত হব।

কালিদাস তাঁর যক্ষের নাম প্রকাশ করেন নি, শাপের এক বৎসর শেষ হলে সে নিরাপদে ফিরতে পেরেছিল কিনা তাও লেখেন নি। মহাভারতে উদ্যোগপর্বে এক বনবাসী যক্ষের কথা আছে, তার নাম স্থূণাকর্ণ। সেই যক্ষ আর মেঘদূতের যক্ষ একই লোক তাতে সন্দেহ নেই। কালিদাস তাঁর কাব্যের উপসংহার লেখেন নি, মহাভারতেও যক্ষের প্রকৃত ইতিহাস নেই। কালিদাস আর ব্যাসদেব যা অনুক্ত রেখেছেন সেই বিচিত্র রহস্য এখন উদঘাটন করছি।

যক্ষপত্নীকে যক্ষিণী বলব, কারণ তার নাম জানা নেই। পতির বিরহে অত্যন্ত কাতর হয়ে যক্ষিণী দিনযাপন করছিল। একটা বেদীর উপর সে প্রতিদিন একটি করে ফুল রাখত আর মাঝে মাঝে গুনে দেখত ৩৬৫ পূরণের কত বাকী। অবশেষে এক বৎসর পূর্ণ হল, কার্তিক মাসও শেষ হল, কিন্তু যক্ষের দেখা নেই। যক্ষিণী উৎকণ্ঠিত হয়ে আরও কিছুদিন প্রতীক্ষা করল, তারপর আর থাকতে না পেরে কুবেরের কাছে গিয়ে তাঁর পায়ে লুটিয়ে পড়ল।

কুবের বললেন, কে গা তুমি? খুব সুন্দরী দেখছি, কিন্তু কেশ অত রুক্ষ কেন? বসন অত মলিন কেন? একটি মাত্র বেণী কেন?

যক্ষিণী সরোদনে বলল, মহারাজ, আপনার সেই কিংকর যাকে এক বৎসরের জন্য নির্বাসনদণ্ড দিয়েছিলেন, আমি তারই দুঃখিনী ভার্যা। আজ দশ দিন হল এক বৎসর উত্তীর্ণ হয়েছে, কিন্তু এখনও আমার স্বামী ফিরে এলেন না কেন?

কুবের বললেন, ব্যস্ত হচ্ছ কেন, ধৈর্য ধর, নিশ্চয় সে ফিরে আসবে। হয়তো কোথাও আটকে পড়েছে। তার জোয়ান বয়েস, এখানে শুধু নাক—থেবড়া যক্ষিণী আর কিন্নরীই দেখেছে, বিদেশে হয়তো কোনও রূপবতী মানবীকে দেখে তার প্রেমে পড়েছে। তুমি ভেবো না, মানবীতে অরুচি হলেই সে ফিরে আসবে।

সজোরে মাথা নেড়ে যক্ষিণী বলল, না না, আমার স্বামী তেমন নন, অন্য নারীর দিকে তিনি ফিরেও তাকাবেন না। এই সেদিন একটি মেঘ এসে তাঁর আকুল প্রেমের বার্তা আমাকে জানিয়ে গেছে। প্রভু, আপনি দয়া করে অনুসন্ধান করুন, নিশ্চয় তাঁর কোনও বিপদ হয়েছে, হয়তো সিংহব্যাঘ্রাদি তাঁকে বধ করেছে।

কুবের বললেন, তুমি অত উতলা হচ্ছ কেন? তোমার স্বামী যদি ফিরে নাই আসে তবু তুমি অনাথা হবে না। আমার অন্তঃপুরে স্বচ্ছন্দে থাকতে পারবে, আমি তোমাকে খুব সুখে রাখব।

যক্ষিণী বলল, ও কথা বলবেন না প্রভু, আপনি আমার পিতৃস্থানীয়। আপনার আজ্ঞায় আমার স্বামী নির্বাসনে গিয়েছিলেন, এখন তাঁর দণ্ডকাল উত্তীর্ণ হয়েছে, তাঁকে ফিরিয়ে আনা আপনারই কর্তব্য। যদি তিনি বিপদাপন্ন হন তবে তাঁকে উদ্ধার করুন, যদি মৃত হন তবে নিশ্চিত সংবাদ আমাকে এনে দিন, আমি অগ্নিপ্রবেশ করে স্বর্গে তাঁর সঙ্গে মিলিত হব।

বিব্রত হয়ে কুবের বললেন, আঃ তুমি আমাকে জ্বালিয়ে মারলে। বেশ, এখনই আমি তোমার স্বামীর সন্ধানে যাচ্ছি, রামগিরি জায়গাটা দেখবার ইচ্ছাও আমার আছে। তুমিও আমার সঙ্গে চল। ওরে, শীঘ্র পুষ্পক রথ জুততে বলে দে। আর তোরা দুজন তৈরি হয়ে নে, আমার সঙ্গে যাবি।

রামগিরি প্রদেশে একটি ছোট পাহাড়ের উপর যক্ষ তার আশ্রম বানিয়েছিল। সেখানে পৌঁছে কুবের দেখলেন, বাড়িটি বেশ সুন্দর, দরজা জানালাও আছে, কিন্তু সবই বন্ধ। কুবেবের আদেশে তাঁর এক অনুচর দরজায় ধাক্কা দিয়ে চেঁচিয়ে বলল, ওহে স্থূণাকর্ণ, এখনই বেরিয়ে এস, মহামহিম রাজরাজ কুবের স্বয়ং এসেছেন, তোমার বউও এসেছে।

কোনও সাড়া পাওয়া গেল না। কুবের বললেন, বাড়িতে কেউ নেই মনে হচ্ছে। আগুন লাগিয়ে দেওয়া যাক।

যক্ষিণী বলল, অমন কাজ করবেন না মহারাজ। আমার স্বামী এই বাড়িতেই আছেন, আমি মাছ ভাজার গন্ধ পাচ্ছি, নিশ্চয় উনি রান্নায় ব্যস্ত আছেন, কেউ তো সাহায্য করবার লোক নেই। আমিই ওঁকে ডাকছি। ওগো, শুনতে পাচ্ছ? আমি এসেছি, মহারাজও এসেছেন। রান্না ফেলে রেখে চট করে বেরিয়ে এসো।

একটি জানালা ঈষৎ ফাঁক হল। ভিতর থেকে নারীকণ্ঠে উত্তর এলো, অ্যাঁ, প্রিয়ে তুমি এসেছ, প্রভু এসেছেন? কি সর্বনাশ, তাঁর সামনে আমি বেরুব কি করে?

আশ্চর্য হয়ে কুবের বললেন, কে গো তুমি? এখনই বেরিয়ে এসো নয় তো বাড়িতে আগুন লাগাব।

তখন দরজা খুলে একটি অবগুণ্ঠিতা নারীমূর্তি বেরিয়ে এল। কুবের ধমক দিয়ে বললেন, আর ন্যাকামি করতে হবে না, তোমার ঘোমটা খোল।

মাথা নীচু করে ঘোমটাবতী উত্তর দিল, প্রভু, এ মুখ দেখাব কি করে?

কুবের বললেন, পুড়িয়েছ নাকি? ভেবো না, শিব যাতে চড়েন সেই বৃষভের সদ্যোজাত গোময় লেপন করলেই সেরে যাবে।

যক্ষিণী হঠাৎ এগিয়ে গিয়ে এক টানে ঘোমটা খুলে ফেলল। মাথা চাপড়ে নারীমূর্তি বলল, হায় হায়, এর চাইতে আমার মরণই ভাল ছিল।

কুবের প্রশ্ন করলেন, কে তুমি? সেই স্থূণাকর্ণ যক্ষটা কোথায় গেল? তুমি তার রক্ষিতা নাকি?

—মহারাজ, আমিই আপনার হতভাগ্য কিংকর স্থূণাকর্ণ, দৈবদুর্বিপাকে এই দশা হয়েছে, কিন্তু আমার কোনও অপরাধ নেই। প্রিয়ে, আমরা নিতান্তই হতভাগ্য, শাপান্ত হলেও আমাদের মিলন হবার উপায় নেই।

যক্ষিণী বলল, মহারাজ, ইনিই আমার স্বামী, ওই যে, জোড়া ভুরু রয়েছে, নাকের ডগায় সেই তিলটিও দেখা যাচ্ছে। হা নাথ, তোমার এমন দশা হল কেন? কোন দেবতাকে চটিয়েছিলে?

যক্ষ বলল, পরের উপকার করতে গিয়ে আমার এই দুরবস্থা হয়েছে। এই জগতে কৃতজ্ঞতা নেই, সত্যপালন নেই।

যক্ষিণী বলল, তুমি মেয়েমানুষ হয়ে গেলে কি করে?

কুবের বললেন, এ রকম হয়ে থাকে। বুধপত্নী ইলা আগে পুরুষ ছিলেন, হরপার্বতীর নিভৃত স্থানে প্রবেশের ফলে স্ত্রী হয়ে যান। বালী—সুগ্রীবের বাপ ঋক্ষরজা এক সরোবরে স্নান করে বানরী হয়ে গিয়েছিলেন। যাই হক, স্থূণাকর্ণ, তুমি সমস্ত ঘটনা প্রকাশ করে বল।

যক্ষ বলতে লাগল। —মহারাজ, প্রায় তিন মাস হল কিছু শুনো কাঠ সংগ্রহের জন্য আমি নিকটবর্তী ওই অরণ্যে গিয়েছিলাম। দেখলাম, গাছের তলায় একটি ললনা বসে আছে আর আকুল হয়ে অশ্রুপাত করছে।

যক্ষিণী প্রশ্ন করল, মাগী দেখতে কেমন?

—সুন্দরী বলা চলে, তবে তোমার কাছে লাগে না। কাটখোট্টা গড়ন, মুখে লাবণ্যেরও অভাব আছে। মহারাজ, তারপর শুনুন। আমি সেই নারীকে জিজ্ঞাসা করলাম, ভদ্রে, তোমার কি হয়েছে? যদি বিপদে পড়ে থাক তবে আমি যথাসাধ্য প্রতিকারের চেষ্টা করব।

সে এই আশ্চর্য বিবরণ দিল। —মহাশয়, আমি পঞ্চালরাজ দ্রুপদের কন্যা শিখণ্ডিনী, কিন্তু লোকে আমাকে রাজপুত্র শিখণ্ডী বলেই জানে। পূর্বজন্মে আমি ছিলাম কাশীরাজের জ্যেষ্ঠা কন্যা অম্বা। স্বয়ংবরসভা থেকে ভীষ্ম আমাদের তিন ভগিনীকে হরণ করেছিলেন, তাঁর বৈমাত্র ভাই বিচিত্রবীর্যের সঙ্গে বিবাহ দেবার জন্য। আমি শাল্বরাজের প্রতি অনুরক্তা জেনে ভীষ্ম আমাকে তাঁর কাছে পাঠিয়ে দিলেন। শাল্ব বললেন, রাজকন্যা, আমি তোমাকে নিতে পারি না, কারণ ভীষ্ম তোমাকে হরণ করেছিলেন, তাঁর স্পর্শ নিশ্চয়ই তোমাকে পুলকিত করেছিল। তখন আমি ভগবান পরশুরামের শরণ নিলাম। তিনি ভীষ্মকে বললেন, তোমারই কর্তব্য অম্বাকে বিবাহ করা। ভীষ্ম সম্মত হলেন না। পরশুরাম তাঁর সঙ্গে যুদ্ধ করলেন, কিন্তু কোনও ফল হল না। ভীষ্মের জন্যই আমার নারীজন্ম বিফল হল এই কারণে ভীষ্মের বধকামনায় আমি কঠোর তপস্যা করলাম। তাতে মহাদেব প্রীত হয়ে বর দিলেন—তুমি পরজন্মে দ্রুপদকন্যা রূপে ভূমিষ্ঠ হবে, কিন্তু পরে পুরুষ হয়ে ভীষ্মকে বধ করবে। মহাদেবের বরে দ্রুপদ গৃহে আমার জন্ম হল। কন্যা হলেও রাজপুত্র শিখণ্ডী রূপেই আমি পালিত হয়েছি, অস্ত্রবিদ্যাও শিখেছি। যৌবনকাল উপস্থিত হলে দশার্ণরাজ হিরণ্যবর্মার কন্যার সঙ্গে আমার বিবাহ হল। কিন্তু কিছুদিন পরেই ধরা পড়ে গেলাম। আমার পত্নী দাসীকে দিয়ে তার মায়ের কাছে বলে পাঠাল—মাগো, তোমাদের ভীষণ ঠকিয়েছে, যার সঙ্গে আমার বিয়ে দিয়েছ সে পুরুষ নয়, মেয়ে।

এই দুঃসংবাদ শুনে আমার শ্বশুর হিরণ্যবর্মা ক্রোধে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন। তিনি দূত পাঠিয়ে আমার পিতা দ্রুপদকে জানালেন, দুর্মতি, তুমি আমাকে প্রতারিত করেছ। আমি সসৈন্যে তোমার রাজ্যে যাচ্ছি, চারজন চতুরা যুবতীও আমার সঙ্গে যাচ্ছে, তারা আমার জামাতা শিখণ্ডীকে পরীক্ষা করবে। যদি দেখা যায় যে সে পুরুষ নয় তবে তোমাকে আমি অমাত্যপরিজনসহ বিনষ্ট করব।

পিতার এই দারুণ বিপদ দেখে আমি গৃহত্যাগ করে এই বনে পালিয়ে এসেছি। আমার জন্যই স্বজনবর্গ বিপন্ন হয়েছেন, আমার আর জীবনে প্রয়োজন কি। আমি এখানেই অনাহারে জীবন বিসর্জন দেব।

যক্ষরাজ, শিখণ্ডিনীর এই ইতিহাস শুনে আমার অত্যন্ত অনুকম্পা হল। আমি তাকে বললাম, তুমি কি চাও বল। আমি ধনপতি কুবেবের অনুচর, অদেয় বস্তুও দিতে পারি।

শিখণ্ডিনী বলল, যক্ষ, আমায় পুরুষ করে দাও।

আমি বললাম, রাজকন্যা, আমার পুরুষত্ব কয়েক দিনের জন্য তোমাকে ধার দেব, তাতে তুমি তোমার পিতা ও আত্মীয়বর্গকে দশার্ণরাজের ক্রোধ থেকে রক্ষা করতে পারবে। কিন্তু পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েই তুমি এখানে এসে আমার পুরুষত্ব ফিরিয়ে দেবে। আমার শাপান্ত হতে আর বিলম্ব নেই, প্রিয়ার সঙ্গে মিলনের জন্য আমি অধীর হয়ে আছি, অতএব তুমি সত্বর ফিরে এসো।

মহারাজ, শিখণ্ডিনী সেই যে চলে গেল তারপর আর আসে নি। সেই মিথ্যাবাদিনী দ্রুপদনন্দিনী ধাপ্পা দিয়ে আমার পুরুষত্ব আদায় করে পালিয়েছে, তার বদলে দিয়ে গেছে তার তুচ্ছ নারীত্ব।

যক্ষের কথা শুনে যক্ষিণী বলল, একটা অজানা মেয়ের কান্নায় ভুলে গিয়ে তোমার অমূল্য সম্পদ তাকে দিয়ে দিলে! নাথ, তুমি কি বোকা, কি বোকা!

কুবের বললেন, তুমি একটি গজমূর্খ গর্দভ গাড়ল। যাই হক, এখনই আমি তোমার পুরুষত্ব উদ্ধার করে দেব। চল আমার সঙ্গে।

সকলে পঞ্চাল রাজ্যে উপস্থিত হলেন। রাজধানী থেকে কিছুদূরে এক নির্জন বনে পুষ্পক রথ রেখে কুবের তাঁর এক অনুচরকে বললেন, দ্রুপদপুত্র শিখণ্ডীকে সংবাদ দাও—বিশেষ প্রয়োজনে ধনেশ্বর কুবের তোমাকে ডেকেছেন, যদি না আস তবে পঞ্চাল রাজ্যের সর্বনাশ হবে।

শিখণ্ডী ব্যস্ত হয়ে তখনই এসে প্রণাম করে বললেন, যক্ষরাজ, আমার প্রতি কি আজ্ঞা হয়?

কুবের বললেন, শিখণ্ডী, তুমি আমার কিংকর এই স্থূণাকর্ণকে প্রতারিত করেছ, এর প্রিয়ার সঙ্গে মিলনে বাধা ঘটিয়েছ, যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে তা রক্ষা কর নি। যদি মঙ্গল চাও তবে এখনই এর পুরুষত্ব প্রত্যর্পণ কর।

শিখণ্ডী বললেন, ধনেশ্বর, আমি অবশ্যই প্রতিশ্রুতি পালন করব, আমার বিলম্ব হয়ে গেছে তার জন্য ক্ষমা চাচ্ছি। এই যক্ষ আমার মহোপকার করেছেন, কৃপা করে আরও কিছুদিন আমায় সময় দিন।

কুবের বললেন কেন, তোমার অভীষ্ট সিদ্ধ হয়নি?

—যক্ষরাজ, যে বিপদ আসন্ন ছিল তা কেটে গেছে। দশার্ণরাজ হিরণ্যবর্মার সঙ্গে যে যুবতীরা এসেছিল তারা আমাকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পরীক্ষা করে তাঁকে বলেছে, আপনার জামাতা পূর্ণমাত্রায় পুরুষ এবং ষোল আনার জায়গায় আঠারো আনা। এই কথা শুনে শ্বশুর মহাশয় অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে আমার পিতার কাছে ক্ষমা চেয়েছেন এবং বিস্তর উপঢৌকন দিয়ে সদলবলে প্রস্থান করেছেন। যাবার সময় তাঁর কন্যাকে বোকা মেয়ে বলে ধমক দিয়ে গেছেন। আমি এই যক্ষ মহাশয়ের কাছে আর এক মাস সময় ভিক্ষা চাচ্ছি, তার মধ্যেই কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ সমাপ্ত হবে। ভীষ্মকে বধ করেই আমি স্থূণাকর্ণের ঋণ শোধ করব।

কুবের বললেন, মহারথ ভীষ্মকে তুমি বধ করবে এ কথা অবিশ্বাস্য। তিনিই তোমাকে বধ করবেন, সেই সঙ্গে তোমার পুরুষত্বও বিনষ্ট হবে। ও সব চলবে না, তুমি এই মুহূর্তে স্থূণাকর্ণের পুরুষত্ব প্রত্যর্পণ কর এবং তোমার স্ত্রীত্ব ফিরিয়ে নাও। নতুবা আমি সাক্ষীপ্রমাণ নিয়ে এখনই তোমার শ্বশুরের কাছে যাব। তোমার প্রতারণার কথা জানলেই তিনি সসৈন্যে এসে পঞ্চাল রাজ্য ধ্বংস করবেন।

ব্যাকুল হয়ে শিখণ্ডী বললেন, হা, আমার গতি কি হবে!

কুবের বললেন, ভাবছ কেন, তোমার ভ্রাতা ধৃষ্টদ্যুম্ন আছেন, পঞ্চপাণ্ডব ভগিনীপতি আছেন, পাণ্ডবসখা কৃষ্ণ আছেন। তাঁরাই ভীষ্মবধের ব্যবস্থা করবেন।

শিখণ্ডী বললেন, তা হবার জো নেই। ভীষ্ম পাণ্ডবদের পিতামহ, আর দ্রোণ তাঁদের আচার্য। এই দুই গুরুজনকে তাঁরা বধ করবেন না, এই কারণে ভীষ্মবধের ভার আমার উপর আর দ্রোণবধের ভার ধৃষ্টদ্যুম্নের উপর পড়েছে।

কুবের কোনও আপত্তি শুনলেন না। অবশেষে নিরুপায় হয়ে শিখণ্ডী যক্ষকে পুরুষত্ব প্রত্যর্পণ করে নিজের স্ত্রীত্ব ফিরিয়ে নিলেন। তখন কুবেরের সঙ্গে যক্ষ আর যক্ষিণী পরমানন্দে অকালপুরীতে চলে গেল।

বিষণ্ণমনে অনেকক্ষণ চিন্তা করে শিখণ্ডী (এখন শিখণ্ডিণী) কৃষ্ণসকাশে এলেন। দৈবক্রমে দেবর্ষি নারদও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। কৃষ্ণ বললেন, একি শিখণ্ডী, তোমাকে এমন অবসন্ন দেখছি কেন? দুদিন আগেও তোমার বীরোচিত তেজস্বী মূর্তি দেখেছিলাম এখন আবার কোমল স্ত্রীভাব দেখছি কেন?

শিখণ্ডী বললেন, বাসুদেব, আমার বিপদের অন্ত নেই।

নারদ বললেন তোমরা বিশ্রম্ভালাপ কর, আমি এখন উঠি।

শিখণ্ডী বললেন, না না দেবর্ষি, উঠবেন না। আপনি তো আমার ইতিহাস সবই জানেন, আপনার কাছে গোপনীয় কিছু নেই।

সমস্ত ঘটনা বিবৃত করে শিখণ্ডী বললেন কৃষ্ণ, তুমি পাণ্ডব আর পাঞ্চালদের সুহৃদ, আমার ভগিনী কৃষ্ণা তোমার সখী। আমাকে সংকট হতে উদ্ধার কর। বিগত জন্ম থেকেই আমার সংকল্প আছে যে ভীষ্মকে বধ করব, মহাদেবের বরও আমি পেয়েছি। কিন্তু পুরুষত্ব না পেলে আমি যুদ্ধ করব কি করে?

কৃষ্ণ বললেন, তোমার সংকল্প ধর্মসংগত নয়। নারী হয়ে জন্মেছ, অলৌকিক উপায়ে পুরুষ হতে চাও কেন? ভীষ্মকে বধ করবার ভার অন্য লোকের উপর ছেড়ে দাও। দেবর্ষি কি বলেন?

নারদ বললেন, ওহে শিখণ্ডী, কৃষ্ণ ভালই বলেছেন। শাল্বরাজ আর ভীষ্ম তোমাকে প্রত্যাখ্যান করেছেন তাতে হয়েছে কি? পৃথিবীতে আরও পুরুষ আছে। তুমি যদি সম্মত হও তবে আমি তোমার পিতাকে বলব, তিনি যেন কোন সৎপাত্রে তোমাকে অর্পণ করেন। তাতেই তোমার নারীজন্ম সার্থক হবে। তোমার পত্নীরও একটা গতি হয়ে যাবে সে তোমার সপত্নী হয়ে সুখে থাকবে।

শিখণ্ডী বললেন, অমন কথা বলবেন না দেবর্ষি। মহাদেব আমাকে যে বর দিয়েছেন তা অবশ্যই সফল হবে। কৃষ্ণ, তোমার অসাধ্য কিছু নেই, তুমি আমাকে পুরুষ করে দাও।

কৃষ্ণ বললেন, আমি বিধাতা নই যে অঘটন ঘটাব। সেই যক্ষের মতন কেউ যদি স্বেচ্ছায় তোমার সঙ্গে অঙ্গ বিনিময় করে তবেই তুমি পুরুষ হতে পারবে। কিন্তু সেরকম নির্বোধ আর কেউ আছে বলে মনে হয় না। দেবর্ষি, আপনি তো বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ঘুরে বেড়ান, আপনার জানা আছে?

নারদ বললেন, আছে, তুমিও তাঁকে জান। শোন শিখণ্ডী, বৃন্দাবন ধামে কৃষ্ণের এক দূর সম্পর্কের মাতুল আছেন। তিনি গোপবংশীয়, নাম আয়ান ঘোষ। অতি সদাশয় পরোপকারী লোক, কিন্তু বড়ই মনঃকষ্টে আছেন, ধর্মকর্ম নিয়েই থাকেন, সংসারে আসক্তি নেই। তুমি তাঁর শরণাপন্ন হও।

শিখণ্ডী বললেন, বাসুদেব, তুমি আমার জন্য সনির্বন্ধ অনুরোধ করে শ্রীআয়ানকে একটি পত্র দাও, তাই নিয়ে আমি তাঁর কাছে যাব।

কৃষ্ণ বললেন, পাগল হয়েছ? আমার নাম যদি ঘুণাক্ষরে উল্লেখ কর তবে তখনই তিনি তোমাকে বিতাড়িত করবেন। দেখ শিখণ্ডী, আমার অদৃষ্ট বড় মন্দ, অকারণে আমি কয়েকজনের বিরাগভাজন হয়েছি—কংস, শিশুপাল, আর আমার পূজ্যপাদ মাতুল এই আয়ান ঘোষ। এমন কি, আমার পুত্র শাম্বের শ্বশুর দুর্যোধনও আমার শত্রু হয়েছেন।

শিখণ্ডী বললেন, তবে উপায়?

নারদ বললেন, উপায় তোমারই হাতে আছে। নারীর ছলাকলা আর পুরুষের কূটবুদ্ধি দুটিই তোমার স্বভাবসিদ্ধ, তাই দিয়েই কাজ উদ্ধার করতে পারবে। চল আমার সঙ্গে, শ্রীআয়ানের সঙ্গে তোমার আলাপ করিয়ে দেব।

বৃন্দাবনের এক প্রান্তে লোকালয় হতে বহু দূরে যমুনাতীরে একটি কুটীর নির্মাণ করে আয়ান ঘোষ সেখানে বাস করেন। বিকাল বেলা নদীপুলিনে বসে তিনি রাবণরচিত শিবতাণ্ডব স্তোত্র আবৃত্তি করছিলেন, এমন সময় শিখণ্ডীর সঙ্গে নারদ সেখানে উপস্থিত হলেন।

সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে আয়ান বললেন, দেবর্ষি, আমি ধন্য যে আপনার দর্শন পেলাম। এই সুন্দরীকে তো চিনতে পারছি না।

নারদ বললেন, ইনি পঞ্চালরাজ দ্রুপদের কন্যা শিখণ্ডিনী। ভগবান শূলপাণি একটি কঠোর ব্রত পালনের ভার এঁর উপর দিয়েছেন। সেই ব্রত উদযাপিত না হওয়া পর্যন্ত এঁকে অনূঢ়া থাকতে হবে। কিন্তু কোনও সদাশয় ধর্মপ্রাণ পুরুষের সাহায্য ভিন্ন এঁর সংকল্প পূর্ণ হবে না। মহামতি আয়ান, আমি দিব্যচক্ষুতে দেখছি তুমিই সেই ভাগ্যবান পুরুষ। এঁর অনুরোধ রক্ষা কর, ব্রত সমাপ্ত হলেই এই অশেষ গুণবতী ললনা তোমাকে পতিত্বে বরণ করবেন, তোমার জীবন ধন্য হবে।

একটি সুদীর্ঘ নিশ্বাস ত্যাগ করে আয়ান বললেন, হা দেবর্ষি, আমার জীবন কি করে ধন্য হবে? আমার সংসার থাকতেও নেই, গৃহ শূন্য। লোকে আমাকে অবজ্ঞা করে, অপদার্থ কাপুরুষ বলে, অন্তরালে ধিককার দেয়। তাই জনসংস্রব বর্জন করে এই নিভৃত স্থানে বাস করছি। এই বরবর্ণিনী রাজকন্যা আমার ন্যায় হতভাগ্যের কাছে কেন এসেছেন?

শিখণ্ডী মধুর কণ্ঠে বললেন, গোপশ্রেষ্ঠ মহাত্মা আয়ান, আপনার গুণরাশি শুনে দূর থেকেই আমি মোহিত হয়েছিলাম, এখন আপনাকে দেখে আমি অভিভূত হয়েছি, আপনার চরণে মনঃপ্রাণ সমর্পণ করেছি।

আয়ান বললেন, আমার বঞ্চিত ধিককৃত জীবনে এমন সৌভাগ্যের উদয় হবে তা আমি স্বপ্নেও আশা করি নি। মনোহারিণী শিখণ্ডিনী, তোমাকে অদেয় আমার কিছুই নেই। আমার কাছে তুমি কি চাও বল।

শিখণ্ডী বললেন, দেবর্ষি, আপনিই এঁকে বুঝিয়ে দিন।

ব্রতের কথা সংক্ষেপে জানিয়ে নারদ বললেন, গোপেশ্বর আয়ান, মহাদেবের বরে শিখণ্ডিনী অবশ্যই সিদ্ধিলাভ করবেন, তোমাকে কেবল এক মাসের জন্য এঁকে তোমার পুরুষত্ব দান করতে হবে। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ তার মধ্যেই সমাপ্ত হবে, ভীষ্মও স্বর্গলাভ করবেন, তার পরেই রাজা দ্রুপদ তাঁর এই কন্যাকে তোমার হস্তে সম্প্রদান করবেন, পঞ্চাল রাজ্যের অর্ধ অংশ ও বিস্তর সবৎসা ধেনুও যৌতুক স্বরূপ দেবেন। বৃন্দাবনের অপ্রিয় স্মৃতি পশ্চাতে ফেলে রেখে তুমি নূতন পত্নীসহ নতুন দেশে পরম সুখে রাজত্ব করবে।

ক্ষণকাল চিন্তার পর আয়ানের দ্বৈধ দূর হল, তিনি তাঁর ভাবী বধূর প্রার্থনা পূর্ণ করলেন। পুনর্বার পুরুষত্ব লাভ করে শিখণ্ডী হৃষ্টচিত্তে নারদের সঙ্গে চলে গেলেন। আর স্ত্রীরূপী আয়ান কুটীরের দ্বার রুদ্ধ করে অসূর্যম্পশ্যা হয়ে শিখণ্ডিনীর প্রত্যাশায় দিন যাপন করতে লাগলেন।

কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের দশম দিনে শিখণ্ডীর বাণে জর্জরিত হয়ে ভীষ্ম শরশয্যায় শয়ন করলেন। তার আটদিন পরে যুদ্ধ সমাপ্ত হল। কিন্তু শিখণ্ডী আয়ানের কাছে এলেন না, তাঁর আসবার উপায়ও ছিল না। অশ্বত্থামা গভীর নিশীথে পাণ্ডবশিবিরে প্রবেশ করে যাঁদের হত্যা করেছিলেন তাঁদের মধ্যে শিখণ্ডীও ছিলেন।

আয়ানের ভাগ্যে রাজকন্যা আর অর্ধেক রাজত্ব লাভ হল না, তাঁর পুরুষত্বও শিখণ্ডীর সঙ্গে ধ্বংস হয়ে গেল। কিন্তু তাঁর জীবন বিফল হল এমন কথা বলা যায় না। কালক্রমে আয়ানের এক অপূর্ব আধ্যাত্মিক পরিবর্তন হল। তিনি মনঃপ্রাণ শ্রীকৃষ্ণে অর্পণ করে আয়ানী নামে খ্যাত হলেন, শ্রীখোল বাজাতে শিখলেন, এবং ব্রজমণ্ডলে যে ষোলো হাজার গোপিনী বাস করত তাদের নেত্রী হয়ে নিরন্তর কৃষ্ণকীর্তন করতে লাগলেন।

১৮৭৯ শক (১৯৫৭)