৫
পরদিন সকালবেলাটা ডাক্তারের রিপোর্টের প্রতীক্ষায় কাটিয়া গেল। কিন্তু রিপোর্ট আসিল না। ব্যোমকেশ ফোন করিয়া থানার খবর লইল, কিন্তু সেখানে কোনও খবর পাওয়া গেল না।
বৈকালে বেলা আন্দাজ সাড়ে চারটার সময় দেবকুমারবাবু আসিলেন। আলাপ না থাকিলেও তাঁহার সহিত মুখচেনা ছিল; আমরা খাতির করিয়া তাঁহাকে বসাইলাম। তিনি হাবুলের টেলিগ্রাম পাইবামাত্র দিল্লী ছাড়িয়া রওনা হইয়াছিলেন, আজ দ্বিপ্রহরে আসিয়া পৌঁছিয়াছেন।
তাঁহার বয়স চল্লিশ কি একচল্লিশ বৎসর; কিন্তু চেহারা দেখিয়া আরও বর্ষীয়ান মনে হয়। মোটাসোটা দেহ, মাথায় টাক, চোখে পুরু কাচের চশমা। তিনি স্বভাবত একটু অন্যমনস্ক প্রকৃতির লোক বলিয়া মনে হয়—অর্থাৎ বাহিরের জগতের চেয়ে অন্তলোকেই বেশি বাস করেন। তাঁহার গলাবন্ধ কোট ও গোল চশমা-পরিহিত পেচকের ন্যায় চেহারা কলিকাতার ছাত্রমহলে কাহারও অপরিচিত ছিল না, প্রতিবেশী বলিয়া আমিও পূর্বে কয়েকবার দেখিয়াছি। কিন্তু এখন দেখিলাম, তাঁহার চেহারা কেমন যেন শুকাইয়া উঠিয়াছে। চোখের কোলে গভীর কালির দাগ, গালের মাংস চুপসিয়া গিয়াছে, পূর্বের সেই পরিপুষ্ট ভাব আর নাই।
চশমার কাচের ভিতর দিয়া আমার পানে দৃষ্টি প্রেরণ করিয়া তিনি বলিলেন, ‘আপনিই ব্যোমকেশবাবু?’
আমি ব্যোমকেশকে দেখাইয়া দিলাম। তিনি ব্যোমকেশের দিকে ফিরিয়া বলিলেন, ‘ও।’—বলিয়া হাতের লাঠিটা টেবিলের উপর রাখিলেন।
ব্যোমকেশ অস্ফুটস্বরে মামুলি দু’একটা সহানুভূতির কথা বলিল; দেবকুমারবাবু বোধ হয় তাহা শুনিতে পাইলেন না। তাঁহার ক্ষীণদৃষ্টি চক্ষু একবার ঘরের চারিদিক পরিভ্রমণ করিল, তারপর তিনি ক্লান্তিশিথিল স্বরে বলিলেন, ‘কাল বেলা দশটায় দিল্লী থেকে বেরিয়ে আজ আড়াইটার সময় এসে পৌঁছেছি। প্রায় ত্রিশ ঘণ্টা ট্রেনে—’
আমরা চুপ করিয়া রহিলাম; দৈহিক শ্রান্তির পরিচয় তাঁহার প্রতি অঙ্গে ফুটিয়া উঠিতেছিল।
দেবকুমার অতঃপর ব্যোমকেশের দিকে চক্ষু ফিরাইয়া বলিলেন, ‘হাবুলের মুখে আপনার কথা শুনেছি—বিপদের সময় সাহায্য করেছেন, আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ।’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘সে কি কথা, যদি একটু সাহায্য করতে পেরে থাকি, সে তো প্রতিবেশীর কর্তব্য।’
‘তা বটে; কিন্তু আপনি কাজের লোক—’ তারপর হঠাৎ জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কি হয়েছিল মেয়েটার? কিছু বুঝতে পেরেছেন কি? বাড়িতে ভাল করে কেউ কিছু বলতে পারলে না।’
ব্যোমকেশ তখন যতখানি দেখিয়াছিল ও বুঝিয়াছিল, দেবকুমারবাবুকে বিবৃত করিল। শুনিতে শুনিতে দেবকুমারবাবু অন্যমনস্কভাবে পকেট হইতে সিগার বাহির করিলেন, সিগার মুখে ধরিয়া তারপর আবার কি মনে করিয়া সেটি টেবিলের উপর রাখিয়া দিলেন। আমি তাঁহার মুখের দিকে তাকাইয়াছিলাম, দেখিলাম, ব্যোমকেশের কথা শুনিতে শুনিতে তিনি এত তন্ময় হইয়া গিয়াছেন যে, স্নায়বিক উত্তেজনার বশে তাঁহার অস্থির হাত দু’টা যে কি করিতেছে, সে দিকে লক্ষ্য নাই। একবার তিনি চশমা খুলিয়া বড় বড় চোখ দু’টা নিষ্পলকভাবে প্রায় দু’মিনিট আমার মুখের উপর নিবদ্ধ করিয়া রাখিলেন; তারপর আবার চশমা পরিয়া চক্ষু মুদিত করিয়া রহিলেন।
ব্যোমকেশের বিবরণ শেষ হইলে দেবকুমারবাবু অনেকক্ষণ নীরব হইয়া থাকিয়া হঠাৎ বলিয়া উঠিলেন, ‘হুঁ, ঐ ডাক্তার রুদ্রটা আমার বাড়িতে ঢুকেছিল! চামার! চণ্ডাল! টাকার জন্য ও পারে না, এমন কাজ নেই। একটা জীবন্ত পিশাচ!’ উত্তেজনার বশে তিনি লাঠিটা মুঠি করিয়া ধরিয়া একেবারে উঠিয়া দাঁড়াইলেন; তাঁহার মুখ হঠাৎ ভীষণ হিংস্রভাব ধারণ করিল।
কয়েক মুহূর্ত পরেই কিন্তু আবার তাঁহার মুখ স্বাভাবিক অবস্থা প্রাপ্ত হইল। আমাদের চোখে বিস্ময়ের চিহ্ন দেখিয়া বোধ হয় মনে মনে একটু অপ্রতিভ হইলেন। গলা ঝাড়িয়া বলিলেন, ‘আমি যাই। ব্যোমকেশবাবু, আর একবার আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।’ বলিয়া দ্বারের দিকে অগ্রসর হইলেন।
দ্বার পর্যন্ত গিয়া তিনি থমকিয়া দাঁড়াইলেন, ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া কি চিন্তা করিলেন; তারপর ফিরিয়া বলিলেন, ‘আমার পয়সা থাকলে এ ব্যাপারের অনুসন্ধানে আপনাকে নিযুক্ত করতুম। কিন্তু আমি গরীব—আমার পয়সা নেই।’ ব্যোমকেশ কি একটা বলিতে চাহিলে তিনি লাঠি নাড়িয়া তাহাকে বাধা দিয়া বলিলেন, ‘বিনা পারিশ্রমিকে আমি কারুর সাহায্য গ্রহণ করতে পারব না। পুলিস অনুসন্ধান করছে, তারাই যা পারে করুক। আর, অনুসন্ধান করবার আছেই বা কি? হাজার অনুসন্ধান করলেও আমার মেয়ে তো আর আমি ফিরিয়ে পাব না।’ বলিয়া কোনও প্রকার অভিবাদন না করিয়া প্রস্থান করিলেন।
এই অদ্ভুত মনুষ্যটি চলিয়া যাইবার পর দীর্ঘকাল আমরা হতবাক হইয়া বসিয়া রহিলাম। শেষে সুদীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়িয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘একটা ভ্রম সংশোধন হল। আমরা ধারণা হয়েছিল, দেবকুমারবাবু প্রথম পক্ষের ছেলেমেয়েদের ভালবাসেন না—সেটা ভুল। অন্তত মেয়েকে তিনি খুব বেশি ভালবাসেন।’
সিগারটা দেবকুমারবাবু ফেলিয়া গিয়াছিলেন, সেটার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘আশ্চর্য অন্যমনস্ক লোক।’ বলিয়া ধীরে ধীরে পায়চারি করিতে লাগিল।
আমি বলিলাম, ‘ডাক্তার রুদ্র’র ওপর ভয়ঙ্কর রাগ দেখলুম।’
ব্যোমকেশ উত্তর দিল না।
সন্ধ্যার পর দারোগা বীরেনবাবু স্বয়ং ডাক্তারের রিপোর্ট লইয়া আসিলেন। বলিলেন, ‘রিপোর্ট বড় disappointing, বারবার পরীক্ষা করেও মৃত্যুর কারণ ধরতে পারা যায়নি।’
রিপোর্ট পড়িয়া দেখিলাম, ডাক্তার লিখিয়াছেন, দেহের কোথাও ক্ষতচিহ্ন নাই; শরীরের অভ্যন্তরেও কোনও বিষ পাওয়া যায় নাই। হৃদযন্ত্র সবল ও স্বাভাবিক, সুতরাং হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হওয়ার জন্য মৃত্যু হয় নাই। যতদূর বুঝিতে পারা যায়, অকস্মাৎ স্নায়ুমণ্ডলীর পক্ষাঘাত হওয়ায় মৃত্যু ঘটিয়াছে। কিন্তু কি করিয়া স্নায়ুমণ্ডলীর পক্ষাঘাত ঘটিল, তাহা বলিতে ডাক্তার অক্ষম। এরূপ অদ্ভুত লক্ষণহীন মৃত্যু তিনি পূর্বে কখনও দেখেন নাই।
ব্যোমকেশ কাগজখানা হাতে লইয়া, ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া চিন্তিতমুখে বসিয়া রহিল।
বীরেনবাবু বলিলেন, ‘এ কেস অবশ্য করোনারের কোর্টে যাবে; সেখানে ‘অজ্ঞাত কারণে মৃত্যু’ রায় বেরুবে। তারপর আমরা—অর্থাৎ পুলিস—ইচ্ছে করলে অনুসন্ধান চালাতে পারি, আবার না-ও চালাতে পারি। ব্যোমকেশবাবু, আপনি কি বলেন? এই রিপোর্টের পর অনুসন্ধান করলে কোনও ফল হবে কি?’
ব্যোমকেশ বলিল, ‘ফল হবে কি না বলতে পারি না; কিন্তু অনুসন্ধান চালানো উচিত।’
বীরেনবাবু উৎসুকভাবে বলিলেন, ‘কেন বলুন দেখি? আপনি কি কাউকে সন্দেহ করেন?’
‘ঠিক যে কোনও ব্যক্তিবিশেষকে সন্দেহ করি, তা নয়। তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এর মধ্যে গোলমাল আছে।’
বীরেনবাবু ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, ‘আমারও তাই মনে হয়। আচ্ছা, দেবকুমারবাবুর স্ত্রীকে আপনার কি রকম মনে হল?’
ব্যোমকেশ কিছুক্ষণ নীরব হইয়া রহিল। তারপর ধীরে ধীরে বলিল, ‘দেখুন, আমার মনে হয়, ও-পথে গেলে হবে না। এ মৃত্যু-রহস্যের জট ছাড়াতে হলে সর্বপ্রথম জানতে হবে—কি উপায়ে মৃত্যু হয়েছিল। এটা যতক্ষণ না জানতে পারছেন, ততক্ষণ একে ওকে সন্দেহ করে কোনও ফল হবে না। অবশ্য এ কথাও স্মরণ রাখতে হবে যে, মেয়েটির মৃত্যুর সময় তার সৎমা আর সহোদর ভাই ছাড়া বাড়িতে আর কেউ ছিল না। কিন্তু তাই বলে আসল জিনিসটিকে দৃষ্টির বাইরে যেতে দিলে চলবে না।’
‘কিন্তু ডাক্তার যে-কথা বলতে পারছে না—’
‘ডাক্তার কেবল শব পরীক্ষা করেছেন, আমরা শব ছাড়া আরও অনেক কিছু দেখেছি। সুতরাং ডাক্তার যা পারেননি আমরাও তা পারব না, এমন কোনও কথা নেই।’
দ্বিধাপূর্ণস্বরে বীরেনবাবু বলিলেন, ‘তা বটে—কিন্তু; যা হোক, আপনি তো দেবকুমারবাবুর পক্ষ থেকে গোড়া থেকেই আছেন, শেষ পর্যন্ত নিশ্চয় থাকবেন—দু’জনে পরামর্শ করে চলা যাবে।’
মৃদু হাসিয়া ব্যোমকেশ বলিল, ‘উঁহু। এই খানিক আগে দেবকুমারবাবু এসেছিলেন—তিনি আমাকে বরখাস্ত করে গেছেন।’
বিস্মিত বীরেনবাবু বলিলেন, ‘সে কি?’
‘হ্যাঁ। আমার অবৈতনিক সাহায্য তিনি চান না—আর টাকা দিয়ে আমাকে নিয়োগ করতে তিনি অক্ষম।’
‘বটে! তিনি অক্ষম কিসে? তিনি তো মোটা মাইনের চাকরি করেন, সাত আটশ’ টাকা মাইনে পান শুনেছি।
‘তা হবে।’
বীরেনবাবুর ললাট মেঘাচ্ছন্ন হইয়া উঠিল, তিনি বলিলেন, ‘হুঁ, দেবকুমারবাবুর আর্থিক অবস্থা সম্বন্ধে খোঁজ নিতে হচ্ছে। কিন্তু আপনার সাহায্য প্রত্যাখ্যান করবার কি কারণ থাকতে পারে? তিনি কাউকে আড়াল করবার চেষ্টা করছেন না তো?’
আমি হাসিয়া ফেলিলাম। দেবকুমারবাবু অপরাধীকে আড়াল করিবার জন্য কৌশলে ব্যোমকেশের সাহায্য প্রত্যাখ্যান করিয়াছেন এ কথা শুনিতে যেমন অদ্ভুত, তেমনিই হাস্যকর।
বীরেনবাবু ঈষৎ তীক্ষ্ণস্বরে বলিলেন, ‘হাসছেন যে?’
আমি অপ্রস্তুত হইয়া বলিলাম, ‘আপনি দেবকুমারবাবুকে দেখেছেন?’
‘না।’
‘তাকে দেখলেই বুঝবেন, কেন হাসছি।’
অতঃপর বীরেনবাবু উঠিলেন। বিদায়কালে ব্যোমকেশকে বলিলেন, ‘আমি এ ব্যাপারের তল পর্যন্ত অনুসন্ধান করে দেখব, যদি কিনারা করতে পারি।—আপনি কিন্তু ছাড়া পাবেন না। দেবকুমারবাবু আপনাকে বরখাস্ত করেছেন বটে, কিন্তু দরকার হলে আমি আপনার কাছে আসব মনে রাখবেন।’
ব্যোমকেশ খুশি হইয়া বলিল, ‘সে তো খুব ভাল কথা। আমার যতদূর সাধ্য আপনাকে সাহায্য করব। হাবুলের সম্পর্কে এ ব্যাপারে আমার একটা ব্যক্তিগত আকর্ষণও রয়েছে।’
বীরেনবাবু বলিলেন, ‘বেশ বেশ। আচ্ছা, উপস্থিত কোন্ পথে চললে ভাল হয়, কিছু ইঙ্গিত দিতে পারেন কি? যা হোক একটা সূত্র ধরে কাজ আরম্ভ করতে হবে তো।’
ব্যোমকেশ ঈষৎ চিন্তা করিয়া বলিল, ‘ডাক্তার রুদ্র’র দিক থেকে কাজ আরম্ভ করুন; এ গোলক-ধাঁধার সত্যিকার পথ হয়তো ঐ দিকেই আছে।’
বীরেনবাবু চকিতভাবে চাহিলেন, ‘ও—আচ্ছা—’
তিনি নতমস্তকে ভাবিতে ভাবিতে প্রস্থান করিলেন।