অক্রুরসংবাদ

অক্রুরসংবাদ

নমস্কার মশাই। আপনার পাশে একটু বসবার জায়গা হবে? ঢাকুরে লেকের ধারে একটা বেঞ্চে একলা বসে আছি। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে দেখে ওঠবার উপক্রম করছি এমন সময় আগন্তুক ভদ্রলোকটি উক্ত প্রশ্ন করলেন। আমি উত্তর দিলুম, নিশ্চয় নিশ্চয়, বসবেন বই কি, ঢের জায়গা রয়েছে।

লোকটির বয়স পঞ্চাশ—পঞ্চান্ন, লম্বা রোগা ফরসা, মাথায় কাঁচা—পাকা চুল, সযত্নে সিঁথিকাটা, মওলানা আবুল কালাম আজাদের মতন গোঁফ—দাড়ি। পরনে মিহি ধুতি, গরদের পাঞ্জাবি আর উড়ুনি, হাতে রুপো—বাঁধানো লাঠি। দেখলেই মনে হয় সেকেলে শৌখিন বড়লোক। পকেট থেকে একটা বড় কাগজ বার করে বেঞ্চের এক পাশে বিছিয়ে তার ওপর বসে পড়ে বললেন, আমি হচ্ছি অক্রুর নন্দী। মশায়ের নামটি জানতে পারি কি?

আমি বললুম, নিশ্চয় পারেন, আমার নাম সুশীলচন্দ্র চন্দ্র।

—আপনার কি বাড়ি ফেরবার তাড়া আছে? না থাকে তো খানিকক্ষণ বসুন না, আলাপ করা যাক। দেখুন, আমি হচ্ছি একটু খাপছাড়া ধরনের, লোকের সঙ্গে সহজে মিশতে পারি না, যার তার সঙ্গে বনেও না।

আমি হেসে প্রশ্ন করলুম, তবে আমার সঙ্গে আলাপ করতে চাচ্ছেন কেন? যদি না বনে?

অক্রুর নন্দী ভ্রূ কুঁচকে আমার দিকে চেয়ে বললেন, আমি চেহারা দেখে মানুষ চিনতে পারি। আপনার বয়স চল্লিশের নীচে, কি বলেন?

—আজ্ঞে হাঁ।

—তা হলে বনবে। বুড়োদের সঙ্গে আমার মোটেই বনে না, তাদের হাড় চামড়া মন সব শুকিয়ে শক্ত হয়ে গেছে। ভাবছেন লোকটা বলে কি, নিজেও তো বুড়ো। বয়স হয়েছে বটে, কিন্তু আমার মন শুকিয়ে যায় নি।

—অর্থাৎ আপনি এখনও তরুণ আছেন।

অক্রুরবাবু মাথা নেড়ে বললেন, তরুণ ফরুন নই। আমি হচ্ছি একজন বোদ্ধা অর্থাৎ ফিলসফার, জগৎটাকে হ্যাংলা বোকার মতন গবগব করে গিলতে চাই না, চেখে চেখে চিবিয়ে চিবিয়ে ভোগ করতে চাই। চলুন না আমার বাড়ি, খুব কাছেই। রাত্রের খাবারটা আমার সঙ্গেই খাবেন, আমার জীবনদর্শনও আপনাকে বুঝিয়ে দেব।

ভদ্রলোকের মাথায় একটু গোল আছে তাতে সন্দেহ নেই। বললুম, আজ তো বাড়িতে বলে আসি নি, ফিরতে দেরি হলে সবাই ভাববে যে।

—বেশ কাল এই সময়ে এখানে আসবেন, আমি আপনাকে আমার বাড়ি নিয়ে যাব, সেখানেই আহার করবেন। ভাবছেন লোকটা আবুহোসেন নাকি? কতকটা তাই বটে! একা একা থাকি, কথা কইবার উপযুক্ত মানুষ খুঁজে বেড়াই, কিন্তু লাখে একজনও মেলে না। আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে আপনিও একজন বোদ্ধা। কি করা হয়?

—কলেজে ফিলসফি পড়াই।

—বাহা বাহা! তবেই দেখুন আমি কি রকম মানুষ চিনতে পারি।

সবিনয়ে বললুম, যা ভাবছেন তা নই, আমার বিদ্যা বুদ্ধি অতি সামান্য। পুরুত যেমন করে যজমানদের মন্ত্র পড়ায় আমিও তেমনি করে ছাত্রদের পড়াই। নিজেও কিছু বুঝি না, তারাও কিছু বোঝে না।

—ও কথা বলে আমাকে ভোলাতে পারবেন না। আচ্ছা, এখন আলোচনা থাক, আপনি বোধ হয় ওঠবার জন্য ব্যস্ত হয়েছেন, আপনাকে আর আটকে রাখব না। কাল ঠিক আসবেন তো?

অক্রুর নন্দী বাতিকগ্রস্ত বটে, কিন্তু শেক্সপীয়ার যেমন বলেছেন—এঁর পাগলামিতে শৃঙ্খলা আছে। লোকটিকে ভাল করে জানবার জন্য খুব কৌতূহল হল। বললুম, আজ্ঞে হাঁ, ঠিক আসব।

পরদিন যথাকালে উপস্থিত হয়ে দেখলুম অক্রুরবাবু বেঞ্চে বসে আছেন। আমাকে দেখে উৎফুল্ল হয়ে বললেন, আসুন আসুন সুশীলবাবু। এখানে সময় নষ্ট করে কি হবে, আমার বাড়ি চলুন। খুব কাছেই, এই সাদার্ন অ্যাভিনিউ—এর পাশ থেকে বেরিয়েছে হর্ষবর্ধন রোড, তারই দশ নম্বর হচ্ছে আমার বাড়ি।

যেতে যেতে আমি বললুম, যদি কিছু মনে না করেন তো জিজ্ঞাসা করি—মশায়ের কি করা হয়?

অক্রুরবাবু প্রতিপ্রশ্ন করলেন, আপনি আত্মা মানেন?

—বড় কঠিন প্রশ্ন। আমার একটা আত্মা জন্মাবধি আছে বটে, বয়সের সঙ্গে সঙ্গে বদলেও যাচ্ছে, কিন্তু জন্মের আগেও সেই আত্মাটা ছিল কিনা তা তো জানি না।

—ও, আপনি হচ্ছেন আত্মাবাদী অ্যাগনস্টিক। আপনার বিশ্বাস আপনার থাকুক, তাতে আমার কোনও আপত্তি নেই। কিন্তু আমি জন্মান্তরীণ আত্মা মানি। আমার গত জন্মের আত্মাটি খুব চালাক ছিল মশাই, বেছে—বেছে বড়লোকের বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেছে।

—আপনি ভাগ্যবান লোক।

—তা বলতে পারেন। বাবা এত টাকা রেখে গেছেন যে, রোজগারের কোনও দরকারই নেই। অন্নচিন্তা থাকলে উচ্চচিন্তা করতে পারতুম না। আমি বেকার অলস লোক নই, দিনরাত গবেষণা করি কিসে মানুষের বুদ্ধি বাড়বে, সমাজের সংস্কার হবে। কিন্তু মুশকিল কি জানেন? আমি অন্তত দুশ বৎসর আগে জন্মেছি, এখনকার লোকে আমার থিওরি বুঝতেই পারে না।

—আমিই যে বুঝব সে ভরসা করছেন কেন?

—বুঝবেন, একটু চেষ্টা করলেই বুঝবেন। আপনার দুই কানের ওপরে একটু ঢিপি মতন আছে, ওই হল বোদ্ধার লক্ষণ। আসুন, এই আমার আস্তানা অক্রুরধাম। পৈতৃক বাড়িটি কাকারা পেয়েছেন, এ বাড়ি আমি করেছি।

অক্রুরধাম বিশেষ বড় নয় কিন্তু গড়ন ভাল। বারান্দায় চার—পাঁচ জন দারোয়ান চাকর ইত্যাদি একটা বেঞ্চে বসে গল্প করছিল, মনিবকে দেখে সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়াল। অক্রুরবাবু হাতের ইশারায় তাদের বসতে বলে আমাকে তাঁর বৈঠকখানা ঘরে নিয়ে গেলেন। ঘরটি মাঝারি, আসবাব অল্প, কিন্তু খুব পরিচ্ছন্ন।

ঘরে ঢোকবার সময় দরজার পাশের দেওয়ালে আমার হাত ঠেকে গিয়েছিল। দেখলুম একটু আঁচড়ে গেছে। অক্রুরবাবু তা লক্ষ্য করে বললেন, খোঁচা খেয়েছেন বুঝি? ভয় নেই ওষুধ দিচ্ছি। এই বলে তিনি আমার হাতে বেগনী কালির মতন কি একটা লাগিয়ে দিলেন।

আমি বললুম, আপনি ব্যস্ত হচ্ছেন কেন, ও কিছুই নয়, একটু ছড়ে গেছে। বোধ হয় ওখানে একটা পেরেক আছে।

—একটা নয় মশাই, সারি সারি পিন বসানো আছে, হাত দিলেই ফুটবে। কেন লাগাতে হয়েছে জানেন? ভারতবর্ষ হচ্ছে বাঁকা শ্যাম ত্রিভঙ্গ মুরারির দেশ। এখানকার লোকে খাড়া হয়ে দাঁড়াতে পারে না, চাকর ধোবা গোয়ালা নাপিত যেই হ’ক—এমন কি অনেক শিক্ষিত লোকও—দরজায় বা দেওয়ালে হাতের ভর দিয়ে ত্রিভঙ্গ হয়ে দাঁড়ায়। সে শ্রীকৃষ্ণের আমল থেকে চলে আসছে, অজন্টার ছবিতে আর পুরী মাদুরা রামেশ্বর প্রভৃতির মন্দিরে একটাও সোজা মূর্তি পাবেন না। বাড়ির চাকর আর আগন্তুক লোকদের গা—হাত লেগে দেওয়াল আর দরজা ময়লা হয়, কিছুতেই বদভ্যাস ছাড়াতে পারি না। নিরুপায় হয়ে মেঝে থেকে এক ফুট বাদ দিয়ে দেওয়াল আর দরজার ছ ফুট পর্যন্ত, মায় সিঁড়ির রেলিংএ সারি সারি গ্রামোফোন পিন লাগিয়েছি, প্রায় দু লক্ষ পিন। এখন আর বাছাধনরা অজন্টা প্যাটার্নে ত্রিভঙ্গ হয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়াতে পারে না, দেওয়ালে পিঠ লাগিয়ে বসতেও পারে না।

—বাড়িতে চাকর টিঁকে থাকে কি করে?

—মাইনে আড়াইগুণ করে দিয়েছি। কেউ কেউ ভুলে ঠেস দিয়ে জখম হয়, তাই এক বোতল জেনশ্যান ভায়োলেট লোশন রেখেছি। খুব ভাল আণ্টিসেপটিক আর দাগও তিন—চার দিন থাকে, তা দেখে লোকে সাবধান হয়।

—কিন্তু বাচ্চাদের সামলান কি করে? বাড়িতে ছেলেপিলে আছে তো?

আট্টহাস্য করে অক্রুরবাবু বললেন, ছেলে হচ্ছি আমি, আর পিলে ওই চাকরগুলো।

—সেকি, আপনার সন্তানাদি নেই?

—দেখুন সুশীলবাবু, বিবাহ করব না অথচ সন্তানের জন্ম দেব এমন আহাম্মক আমি নই।

—কেন বিবাহ করেন নি?

—চেষ্টা ঢের করেছি, কিন্তু হয়ে ওঠে নি। তবে ভবিষ্যতের কথা বলা যায় না।

—আপনার মতন লোকের এ পর্যন্ত পত্নীলাভ হয়নি এ বড় আশ্চর্য কথা। আপনি ধনী সুপুরুষ সুশিক্ষিত জ্ঞানী—

—আমার আরও অনেক গুণ আছে। নেশা করি না, পান তামাক চা প্রভৃতি মাদকদ্রব্য স্পর্শ করি না, মাছ মাংস ডিম পেঁয়াজ লঙ্কা হলুদ প্রভৃতি আমার রান্নাঘরে ঢুকতে পায় না। আমি গান্ধীজীর থিওরি মানি, তরকারির খোসা বাদ দেওয়া আর মসলা দিয়ে রাঁধা অত্যন্ত অন্যায়। তিনি রশুন খেতেন, আমি তাও খাই না। নুনও কমিয়ে দিয়েছি, তাতেও ব্লাড—প্রেশার বাড়ে।

—দুধ খান তো?

—তা খাই, কিন্তু বাছুরকে বঞ্চিত করি না। বাড়িতে তিনটে গরু আছে, বাছুরের জন্য যথেষ্ট দুধ রেখে বাকীটা নিজে খাই।

অক্রুরবাবুর কথা শুনে বুঝলুম আজ রাত্রে আমার কপালে উপবাস আছে। মনে পড়ল, বড় রাস্তার মোড়ে সাইনবোর্ড দেখেছি—ঔদরিক এম্পোরিয়াম। ফেরবার সময় সেখানেই ক্ষুন্নিবৃত্তি করা যাবে।

অক্রুরবাবু বললেন, ও ঘরে চলুন, খেতে খেতেই আলাপ করা যাবে। শাস্ত্রে বলে, মৌনী হয়ে খাবে। তা আমি মানি না, বিলিতী পদ্ধতিতে গল্প করতে করতে ধীরে ধীরে খেলেই ভাল হজম হয়।

খাবার এল। অক্রুর নন্দী খেয়ালী লোক হলেও তাঁর কাণ্ডজ্ঞান আছে, আমার জন্য ভাল ভাল খাবারেরই আয়োজন করেছেন। কিন্তু তাঁর নিজের জন্য এল খান কতক মোটা রুটি কিছু সিদ্ধ তরকারি, কিছু কাঁচা তরকারি আর এক বাটি দুধ।

অক্রুরবাবু বললেন, কোনও জন্তু ক্যালরি প্রোটিন ভাইটামিন নিয়ে মাথা ঘামায় না। আমাদের গুহাবাসী পূর্বপুরুষরা জন্তুর মতনই কাঁচা জিনিস খেতেন, তাতেই তাঁদের পুষ্টি হত। সভ্য হয়ে সেই সদভ্যাস আমরা হারিয়ে ফেলেছি। এখন কাঁচা লাউ কুমড়ো অনেকেই হজম করতে পারে না, তাই আপনাকে দিই নি। আমি কিন্তু কাঁচা খাওয়া অভ্যাস করেছি, একটু একটু করে ঘাস খেতেও শিখছি। যাক ও কথা। আপনার মুখের ভাব দেখে মনে হচ্ছে একটা প্রশ্ন আপনার কণ্ঠাগত হয়ে আছে। চক্ষুলজ্জা করবেন না, অসংকোচে বলে ফেলুন।

আমি বললুম, কিছু যদি মনে না করেন তো জিজ্ঞাসা করি—আপনি বলেছেন যে, বিবাহের জন্য ঢের চেষ্টা করেছেন, কিন্তু হয়ে ওঠে নি। কেন হয়ে ওঠে নি বলবেন কি?

—আরে সেই কথা বলতেই তো আপনাকে ডেকে এনেছি। শুনুন। দাম্পত্য হচ্ছে তিন রকম। এক নম্বর যাতে স্বামীর বশে স্ত্রী চলে, যেমন গান্ধী—কস্তুরবা। দু—নম্বর, যাতে স্বামীই হচ্ছে স্ত্রীর বশ, অর্থাৎ স্ত্রৈণ ভেড়ো বা হেনপেক, যেমন জাহাঙ্গীর—নূরজাহান। দুটোই হল ডিক্টেটারী ব্যবস্থা, কিন্তু দুক্ষেত্রেই দম্পতি সুখী হয়। তিন নম্বর হচ্ছে, যাতে স্বামী—স্ত্রী কিছুমাত্র রফা না করে নিজের নিজের মতে চলে, অর্থাৎ দুজনেই একগুঁয়ে। এই হল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য কিছুমাত্র রফা না করে নিজের মতে চলে, অর্থাৎ দুজনেই একগুঁয়ে। এই হল ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য—মূলক আদর্শ দাম্পত্য—সম্বন্ধ কিন্তু এর পদ্ধতি বা টেকনিক লোকে এখনও আয়ত্ত করতে পারে নি।

—আপনি নিজে কিরকম দাম্পত্য পছন্দ করেন?

তিন রকমেরই চেষ্টা করেছি, কিন্তু এ পর্যন্ত কোনওটাই অবলম্বন করতে পারি নি। তার ইতিহাস আপনাকে বলব। যখন বয়স কম ছিল তখন আর পাঁচ জনের মতন এক নম্বর দাম্পত্যই পছন্দ করতুম। যেমন বাঁদর ষাঁড় ছাগল মোরগ প্রভৃতি জন্তু তেমনি মানুষেরও পুংজাতি সাধারণত প্রবল, তারাই স্ত্রীজাতি শাসন করতে চায়। কিন্তু মুশকিল কি হল জানেন? কাকেও পীড়ন করা আমার স্বভাব নয়, কিন্তু আমার সংসারযাত্রার আদর্শ এত বেশী র‌্যাশন্যাল যে কোনও স্ত্রীলোকই তা বরদাস্ত করতে পারেন না।

—পরীক্ষা করে দেখেছিলেন?

—দেখেছিলুম বইকি। আমার বয়স যখন চব্বিশ তখন আমার মেজকাকী তাঁর এক দূর সম্পর্কের বোনঝির সঙ্গে আমার সম্বন্ধ করলেন, আমাদের সমাজে কোর্টশিপের চলন তখনও হয় নি, অভিভাবকরাই সম্বন্ধ স্থির করতেন। আমার বাপ—মা তখন গত হয়েছেন, কাকাদের সঙ্গেই থাকতুম। আমি মেজকাকীকে বললুম বিয়েতে মত দেবার আগে তোমার বোনঝিকে আমার মনের কথা জানাতে চাই। কাকী বললেন, বেশ তো, যত খুশি জানিও, আমি না হয় আড়ালে থাকব। তার পর একদিন মেয়েটিকে আনা হল। আমি তাকে একটি লেকচার দিলুম।—শোন উজ্জ্বলা, আমি স্পষ্টবক্তা লোক, আমার কথায় কিছু মনে ক’রো না যেন। তুমি দেখতে ভালই, ম্যাট্রিক পাশ করেছ, শুনেছি গান বাজনা আর গৃহকর্মও জান। ওতেই আমি তুষ্ট। তুমিও আমাকে বিয়ে করলে ঠকবে না, একটি সুশ্রী বলিষ্ঠ বিদ্বান ধনবান আর অত্যন্ত বুদ্ধিমান স্বামী পাবে আমার নতুন বাড়ির সর্বেসর্বা গিন্নী হবে, বিস্তর টাকা খরচ করতে পারবে। কিন্তু তোমাকে কতকগুলো নিয়ম মেনে চলতে হবে। দু—এক গাছা চুড়ি ছাড়া গহনা পরতে পাবে না, শৃঙ্গী নখী আর দন্তী প্রাণীর মতন সালংকরা স্ত্রীও ডেঞ্জারস। নিমন্ত্রণে গিয়ে যদি নিজের ঐশ্বর্য জাহির করতে চাও তো ব্যাঙ্কের একটা সার্টিফিকেট গলায় ঝুলিয়ে যেতে পার। সাজগোজেও অন্য মেয়ের নকল করবে না, আমি যেমন বলব সেইরকম সাজবে। আর শোন—ছবি টাঙিয়ে দেওয়াল নোংরা করবে না, নতুন নতুন জিনিস আর গল্পের বই কিনে বাড়ির জঞ্জাল বাড়াবে না, গ্রামোফোন আর রেডিও রাখবে না। ইলিশ মাছ কাঁকড়া পেঁয়াজ পেয়ারা আম কাঁঠাল ত্যাগ করতে হবে, ওসবের গন্ধ আমার সয় না। পান খাবে না, রক্তদন্তী স্ত্রী আমি দু চক্ষে দেখতে পারি না। সাবান যত খুশি মাখবে, কিন্তু এসেন্স পাউডার নয়, ওসব হল ফিনাইল জাতীয় জিনিস দুর্গন্ধ চাপা দেবার অসাধু উপায়। এই রকম আরও অনেক বিধিনিষেধের কথা জানিয়ে তাকে বললুম, তুমি বেশ করে ভেবে দেখ, তোমার বাপ—মার সঙ্গে পরামর্শ কর, যদি আমার শর্ত মানতে পার তবে চার—পাঁচ দিনের মধ্যে খবর দিও। কিন্তু এক হপ্তা হয়ে গেল, তবু কোনও খবর এল না।

—বলেন কি!

—অবশেষে আমিই মেজকাকীকে জিজ্ঞাসা করলুম, ব্যাপার কি? তিনি পাত্রীর বাড়িতে তাগাদা পাঠালেন। তারপর আমি একটা পোস্টকার্ড পেলুম। পাত্রীর দাদা ইংরিজীতে লিখেছে—গো টু হেল।

—কন্যাপক্ষ দেখছি অত্যন্ত বোকা, আপনার মত বরের মূল্য বুঝল না।

—হাঁ, বেশীর ভাগই ওই রকম বোকা, তবে গোটাকতক চালাক কন্যাপক্ষও জুটেছিল। তাদের মতলব, ভাঁওতা দিয়ে আমার ঘাড়ে মেয়ে চাপিয়ে দেওয়া। তখন একটা নতুন শর্ত জুড়ে দিলুম—ভবিষ্যতে আমার স্ত্রী যদি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে তবে তখনই তাকে বিদেয় করব। খোরপোষ দেব, কিন্তু আমার সম্পত্তি সে পাবে না। এই কথা শুনে সব ভেগে পড়ল। জ্ঞাতিশত্রুরাও রটাতে লাগল যে আমি একটা উন্মাদ। কিন্তু একটি মেয়ে সত্যই রাজী হয়েছিল। অত্যন্ত গরিবের মেয়ে, দেখতেও তেমন ভাল নয়। আমার সমস্ত কথা মন দিয়ে শুনে তখনই বললে যে, সে রাজী। আমি বললুম, অত তাড়াতাড়ি নয়, তোমার বাপ—মায়ের মত নিয়ে জানিও। পরদিন খবর এল বাপ—মাও খুব রাজী। আমার সন্দেহ হল। খোঁজ নিয়ে জানলুম, রূপ আর টাকার অভাবে তার পাত্র জুটছে না। বাপ—মা অত্যন্ত সেকেলে, মেয়েকে কেবল অভিশাপ দেয়। এখন সে শরৎ চাটুজ্যের অরক্ষণীয়ার মতন মরিয়া হয়ে উঠেছে, নির্বিচারে যার—তার কাছে নিজেকে বলি দিতে প্রস্তুত। মেয়ের বাপের সঙ্গে দেখা করে আমি বললুম, আপনার মেয়ে শুধু আপনাকে কন্যাদায় থেকে উদ্ধার করবার জন্যই আমাকে বিয়ে করতে চেয়েছে, আমার শর্তগুলো মোটেই বিচার করে দেখে নি। এমন বিয়ে হতে পারে না। এই নিন পাঁচ হাজার টাকা, আমি যৌতুক দিলুম, মেয়েকে আপনাদের পছন্দ মত ঘরে বিয়ে দিন। বাপ খুব কৃতজ্ঞ হয়ে বললে, আপনিই খুকীর যথার্থ পিতা, আমি জন্মদাতা মাত্র। মেয়েটি ভাল ঘরেই পড়েছিল, বিয়ের পর বরের সঙ্গে আমাকে প্রণাম করতে এসেছিল।

আমি বললুম, আপনি মহাপ্রাণ দয়ালু ব্যক্তি।

—তা মাঝে মাঝে দয়ালু হতে হয়, টাকা থাকলে দান করায় বাহাদুরি কিছু নেই। তার পর শুনুন। আমার বয়স বেড়ে চলল, পঁয়ত্রিশ পার হয়ে বুঝলুম আমার আদর্শের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে এমন কৃচ্ছ্রসাধিকা নারী কেউ নেই। তখন আমার একটা মানসিক বিপ্লব হল, যাকে বলে রিভলশন। এক নম্বর দাম্পত্য যখন হবার নয়, তখন দু নম্বরের চেষ্টা করলে দোষ কি? আমার অনেক আত্মীয় তো স্ত্রীর বশে বেশ সুখে আছে। স্ত্রৈণতাও সংসারযাত্রার একটি মার্গ। জগতে কর্তাভজা বিস্তর আছে, তারা বিচারের ভার কর্তার ওপর ছেড়ে দিয়ে দিব্যি নিশ্চিন্ত হয়ে থাকে। যা করেন গুরুমহারাজ, যা করেন পণ্ডিতজী, যা করেন কমরেড স্তালিন আর মাও—সে—তুং। তেমনি গিন্নীভজাও অনেক আছে। তারা বলে, আমার মতামতের দরকার কি, যা করেন গিন্নী।

—কিন্তু আপনার স্বভাব যে অন্য রকম আপনার পক্ষে গিন্নীভজা হওয়া অসম্ভব।

—অবস্থাগতিকে বা সাধনার ফলে অসম্ভবও সম্ভব হয়। একটি সার সত্য আপনাকে বলছি শুনুন। যে নারী রাজার রানী হয়, বড়লোকের স্ত্রী হয়, নামজাদা গুণী লোকের গৃহিণী হয়, সে নিজেকে মহাভাগ্যবতী মনে করে, অনেক সময় অহংকারে তার মাটিতে পা পড়ে না। কিন্তু রানীকে বা টাকাওয়ালী মেয়েকে যে বিয়ে করে, কিংবা যার স্ত্রী মস্ত বড় দেশনেত্রী লেখিকা গায়িকা বা নটী, এমন পুরুষ প্রথম প্রথম সংকুচিত হয়ে থাকে। সে স্বনামধন্য নয়, স্ত্রীর নামেই তার পরিচয়, লোকে তাকে একটু অবজ্ঞা করে। কিন্তু কালক্রমে তার সয়ে যায়, ক্ষোভ দূর হয়, সে খাঁটি স্ত্রৈণ হয়ে পড়ে। এর দৃষ্টান্ত জগতে অনেক আছে।

—আপনিও সে রকম হতে চেষ্টা করেছিলেন নাকি?

—করেছিলুম। কুইন ভিক্টোরিয়া, সারা বার্নহার্ড, ভার্জিনিয়া উলফ বা সরোজিনী নাইডুর মতন পত্নী যোগাড় করা অবশ্য আমার সাধ্য নয়, কিন্তু যদি একজন বেশ জবরদস্ত নামজাদা মহিলার কাছে চোখ কান বুজে আত্মসমর্পণ করতে পারি তবে হয়তো দু—নম্বর দাম্পত্যও আমার সয়ে যেতে পারে, আমার মত আর আদর্শও বদলে যেতে পারে।

—আপনার পক্ষে তা অসম্ভব মনে করি।

—আমি কিন্তু চেষ্টার ত্রুটি করি নি। তখন আমার বয়স চল্লিশ পেরিয়েছে, পুরীতে স্বর্গদ্বারের পূব দিকে নিজের জন্য একটি বাড়ি তৈরি করাচ্ছি, ওশন—ভিউ হোটেলে আছি। আমার পুরোনো সহপাঠী ভূপেন সরকারের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সে তখন মস্ত গভর্নমেণ্ট অফিসার, ছুটি নিয়ে এসেছে, সঙ্গে আছে তার বোন সত্যভামা সরকার। দুজনে আমার হোটেলেই উঠল। সত্যভামা বিখ্যাত মহিলা, দু বার বিলাত ঘুরে এসেছে, হুণ্ডাগড়ের রানী সাহেবাকে ইংরিজী পড়ায় আর আদবকায়দা শেখায়, অনেক বইও লিখেছে। নাম আগেই শোনা ছিল, এখন আলাপ হল। বয়স আন্দাজ পঁয়ত্রিশ, দশাসই চেহারা, মুখটি গোবদাগোছের, ড্যাবডেবে চোখ, নীচের ঠোঁট একটু বাইরে ঠেলে আছে। দেখলেই বোঝা যায় ইনি একজন জবরদস্ত মহীয়সী মহিলা, স্বামীকে বশে রাখবার শক্তি এঁর আছে। ভাবলুম, এই সত্যভামার কাছেই আত্মসমর্পণ করলে ক্ষতি কি। দু দিন মিশেই বুঝলুম, আমি যেমন তাকে বাজিয়ে দেখছি, সেও তেমনি আমাকে দেখছে।

—আপনার কথা শুনে মনে হচ্ছে যেন শিকার কাহিনী শুনছি।

—কতকটা সেই রকম বটে। যেন একটা বাঘিনী ওত পেতে আছে, আর একটা বাঘ তার পিছনে ঘুরছে। তার পর একদিন আমার নতুন বাড়ি তদারক করতে গেছি, ভূপেন আর সত্যভামাও সঙ্গে আছে। সত্যভামা বললে, জানেন তো সমস্ত ইট বেশ করে ভিজিয়ে নেওয়া চাই, আর ঠিক তিন ভাগ সুরকির সঙ্গে এক ভাগ চুন মেশানো চাই, নয়তো গাঁথুনি মজবুত হবে না। আমার একটু রাগ হল। সাতটা বাড়ি আমি নিজে তৈরি করিয়েছি, কোনও ওভারশিয়ারের চাইতে আমার জ্ঞান কম নয়, আর আজ এই সত্যভামা আমাকে শেখাতে এসেছে!

—আপনার কিন্তু রাগ হওয়া অন্যায়, আপনি তো আত্মসমর্পণ করতেই চেয়েছিলেন। দু নম্বর দাম্পত্যে স্বামীকে স্ত্রীর উপদেশ শুনতেই হয়।

—তা ঠিক, কিন্তু হঠাৎ অনভ্যস্ত উপদেশ একটু অসহ্য বোধ হয়েছিল। তখনকার মতন সামলে নিলুম, কিন্তু পরে আবার গোল বাধল। রাত্রে হোটেলে এক টেবিলে খেতে বসেছি। সত্যভামা বললে, দেখুন মিস্টার নন্দী, আপনার খাওয়া মোটেই সায়েণ্টিফিক নয়, মাছ মাংস ডিম টোমাটো ক্যারট লেটিস এই সব খাওয়া দরকার, যা খাচ্ছেন তাতে ভাইটামিন কিচ্ছু নেই। এবারে আর চুপ করে থাকতে পারলুম না। ক্যালরি প্রোটিন অ্যামিনোঅ্যাসিড আর ভাইটামিনের হাড় হন্দ আমার জানা আছে, তার বৈজ্ঞানিক তথ্য আমি গুলে খেয়েছি, আর এই মাস্টারনী আমাকে লেকচার দিচ্ছে! রাগের বশে একটা অসত্য কথা বলে ফেললুম—দেখুন মিস সত্যভামা, ভাইটামিন আমার সয় না। সত্যভামা বললেন, সয় না কি রকম! উত্তর দিলুম, না, একদম সয় না, ডাক্তার বারণ করেছে। সত্যভামা ঘাবড়ে গিয়ে চুপ মেরে গেল।

—আপনার ধৈর্য দেখছি বড়ই কম।

—সেই তো হয়েছে বিপদ, উপদেশ আমার বরদাস্ত হয় না। তার চার দিন পরে যা হল একেবারে চূড়ান্ত। বিকেলে সমুদ্রের ধারে বসে সূর্যাস্ত দেখছি, শুধু আমি আর সত্যভামা, ভূপেন বোধ হয় ইচ্ছে করেই আসে নি। সত্যভামা হঠাৎ বললে, ওহে অক্রুর, তুমি গোঁফদাড়ি কালই কামিয়ে ফেল, ওতে তোমাকে মানায় না, জংলী জংলী মনে হয়। কি আস্পর্ধা দেখুন! যার ছাগল—দাড়ি বা ইঁদুরে খাওয়ার মতন বিশ্রী দাড়ি তার অবশ্য না রাখাই উচিত। কিন্তু আমার মতন যার সুন্দর নিরেট দাড়ি সে কামাবে কোন দুঃখে? সত্যভামার কথায় আমার মেজাজ গরম হয়ে উঠল। কোটি কোটি বৎসর ধরে পুরুষত্বের যে বীজ প্রাণিপরম্পরায় সঞ্চারিত হয়ে এসেছে, যার প্রভাবে সিংহের কেশর, ষাঁড়ের ঝুঁটি, ময়ূরের পেখম আর মানুষের দাড়ি—গোঁফ উদভূত হয়েছে, সেই দুর্দান্ত পুং—হরমোন আমার মাংসে মজ্জায় কুপিত হয়ে উঠল, আমি ধমক দিয়ে বললুম, চোপ রও, ও কতা মুখে আনবে না, কামাতে চাও তো নিজের মাথা মুড়িয়ে ফেল। সত্যভামা একবার আমার দিকে কটমট করে তাকাল, তারপর উঠে চলে গেল। রাত্রে খাবার সময় ভাই বোন কাকেও দেখলুম না। পরদিন সকালের ট্রেনে আমি কলকাতা রওনা হলুম।

—তার পর আর কোথাও দু নম্বর দাম্পত্যের চেষ্টা করেছিলেন?

—রাম বল, আবার! বুঝতে পারলুম এক নম্বর দু নম্বর কোনওটাই আমার ধাতে সইবে না। তার পর হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করলুম, দাম্পত্যের তিন নম্বরও আছে, যাতে স্বামী—স্ত্রী নিজের মতে চলে অথচ সংঘর্ষ হয় না। আবিষ্কারটা ঠিক আমি করি নি, রবীন্দ্রনাথই করেছিলেন—

—বলেন কি!

—হ্যাঁ, রবীন্দ্রনাথই করে গেছেন। কিন্তু লোকে তার গুরুত্ব বুঝতে পারে নি, তাঁর লেখা থেকে আমিই পুনরাবিষ্কার করেছি। তিনি কি লিখেছেন শুনতে চান?

অক্রুরবাবু পাশের ঘর থেকে ‘শেষের কবিতা’ এনে পড়তে লাগলেন—

অমিত রায় লাবণ্যকে বলছে—ওপারে তোমার বাড়ি, এপারে আমার।…একটি দীপ আমার বাড়ির চূড়ায় বসিয়ে দেব, মিলনের সন্ধ্যেবেলায় তাতে জ্বলবে লাল আলো, বিচ্ছেদের রাতে নীল।…অনাহুত তোমার বাড়িতে কোনো মতেই যেতে পাব না।…তোমার নিমন্ত্রণ মাসে এক দিন পূর্ণিমার রাতে।…পুজোর সময় অন্তত দু মাসের জন্যে দু জনে বেড়াতে বেরোব। কিন্তু দু জনে দু জায়গায়। তুমি যদি যাও পর্বতে আমি যাব সমুদ্রে। এই তো আমার দাম্পত্যের দ্বৈরাজ্যের নিয়মাবলি তোমার কাছে দাখিল করা গেল। তোমার কি মত? লাবণ্য উত্তর দিচ্ছে—মেনে নিতে রাজী আছি।…আমি জানি আমার মধ্যে এমন কিছুই নেই যা তোমার দৃষ্টিকে বিনা লজ্জায় সইতে পারবে, সেই জন্যে দাম্পত্যে দুই পারে দুই মহল করে দেওয়া আমার পক্ষে নিরাপদ।… তার পর লাবণ্য প্রশ্ন করছে—কিন্তু তোমার নববধূ কি চিরকালই নববধূ থাকবে? টেবিলে প্রবল চাপড় দিতে দিতে উচ্চৈচঃস্বরে অমিত বললে, থাকবে থাকবে থাকবে।

আমি বললুম, অমিত রায় হচ্ছে একটি কথার তুবড়ি। রবীন্দ্রনাথ পরিহাস করে তাকে দিয়ে যা বলিয়েছেন আপনি তা সত্য মনে করছেন কেন?

অক্রুরবাবু টেবিলে কিল মেরে বললেন, মোটেই পরিহাস নয়, একেবারে খাঁটি সত্য। তিনি সর্বদর্শী কবি ছিলেন, দাম্পত্যের যা পরাকাষ্ঠা সেই তিন নম্বরেরই ইঙ্গিত দিয়ে গেছেন। তার ভাবার্থ হচ্ছে—স্বামী—স্ত্রী আলাদা বাড়িতে বাস করবে, কালেভদ্রে দেখা করবে, তবেই তাদের প্রীতি স্থায়ী হবে নববধূ চিরদিন নববধূ থাকবে।

—আপনি এরকম দাম্পত্যের চেষ্টা করেছিলেন?

একবার মাত্র চেষ্টা করেছিলুম, তা বিফল হয়েছে। কিন্তু বিফলতার কারণ এ নয় যে রবীন্দ্রনাথের থিওরি ভুল, আমার নির্বাচনেই গলদ ছিল। যাই হক, আর চেষ্টা করবার প্রবৃত্তি নেই।

—ঘটনাটা বলবেন কি?

—শুনুন। আমার বয়স তখন পঞ্চাশের কাছাকাছি। রবীন্দ্রনাথের ফরমূলাটি হঠাৎ একদিন আবিষ্কার করে মনে হল, বাঃ, এই তো দাম্পত্যের শ্রেষ্ঠ মার্গ, চেষ্টা করে দেখা যাক না। আমার গোটাকতক বাড়ি আছে, ছোট—বড় ফ্ল্যাটে ভাগ করা, সেগুলো ভাড়া দিয়ে থাকি। একদিন একটি মহিলা আমার সঙ্গে দেখা করে একটা ছোট ফ্ল্যাট ভাড়া নিলেন। নাম বাগেশ্রী দত্ত, বয়স আন্দাজ চল্লিশ, কিন্নরবিদ্যাপীঠে গান বাজনা নাচ শেখান। দেখতে মন্দ নয়, আমার পছন্দ হল, ক্রমে ক্রমে আলাপও হল। ভাবলুম, এক নম্বর দাম্পত্যের আশা নেই, দু নম্বরেও রুচি নেই। এই বাগেশ্রীকে নিয়ে তিন নম্বরের চেষ্টা করা যাক। যখন আলাদা আলাদা বাস করব তখন তো আদর্শ আর মতামতের প্রশ্নই ওঠে না। তার সঙ্গে দেখা করে বললুম, শোন বাগেশ্রী, আমাকে বিয়ে করবে? আমি নিজের বসত বাড়িতে থাকব, তোমাকে আমার রসা রোডের বাড়িটা দেব, সেটাও বেশ ভাল বাড়ি। তোমাকে টাকাও প্রচুর দেব। তুমি নিজের বাড়িতে নিজের মত চলবে, আমার পছন্দ অপছন্দ মানতে হবে না। মাসে একদিন আমি তোমার অতিথি হব, আর একদিন তুমি আমার অতিথি হবে। এই শর্তে বিয়ে করতে রাজী আছ? বাগেশ্রী বললে, এক্ষুনি। খাসা হবে, আমার বাড়িতে আমার মা দিদিমা মাসী দুই ভাই আর চার বোনকে এনে রাখব, এই ফ্ল্যাটটায় তো মোটেই কুলয় না। আমি বললুম, তা তো চলবে না, তোমার বাড়িতে আমি গেলে ভিড়ের মধ্যে হাঁপিয়ে উঠব যে। বাগেশ্রী বললে তোমাকে সেখানে যেতে কে বলছে? নিজের বাড়িতেই তুমি থাকবে, আমিও তোমার কাছে থাকব। তুমি যা ন্যালাখ্যাপা মানুষ, আমি না দেখলে চাকর বাকর সর্বস্ব লোপাট করবে, বাপ রে, সে আমি সইতে পারব না। আমার পিশেমশায়ের ভাগনে প্রাণতোষ দাদাও আমার কাছে থাকবে, সেই সব দেখবে শুনবে, তোমাকে কিছুই করতে হবে না। বাগেশ্রীর মতলবটি শুনে আমি তখনই সরে পড়লুম। তার পর সে তিন দিন আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল, আমি হাঁকিয়ে দিয়েছি।

আমি প্রশ্ন করলুম, উকিলের চিঠি পান নি।

অক্রুরবাবু বললেন, পেয়েছিলুম। উত্তরে জানালুম, ব্রীচ অভ প্রমিস হয় নি, আমি খেসারত এক পয়সাও দেব না। তবে বাগেশ্রী যদি দু মাসের মধ্যে তার প্রাণতোষ দাদা বা আর কাকেও বিবাহ করে তবে পাঁচ হাজার টাকা যৌতুক দিতে প্রস্তুত আছি। বাগেশ্রী তাতেই রাজী হয়েছিল।

—সকলকেই যৌতুক দিলেন, শুধু সত্যভামা বেচারী ফাঁকে পড়লেন।

—তিনিও একেবারে বঞ্চিত হন নি। পুরী থেকে চলে আসবার তিন মাস পরে একটা নিমন্ত্রণপত্র পেয়েছিলুম—হুণ্ডাগড়ের খুড়া সাহেবের সঙ্গে সত্যভামার বিবাহ হচ্ছে। আমি একটি ছোট্ট পিকিনীজ কুকুর সত্যভামাকে উপহার পাঠিয়ে দিলুম, খুব খানদানী কুকুর, তার জন্য প্রায় আট শ টাকা খরচ হয়েছিল।

—এক দু তিন নম্বর সবই তো পরীক্ষা করেছেন, আপনার ভবিষ্যৎ প্রোগ্রাম কি?

—কিছুই স্থির করতে পারি নি। আপনি তো বোদ্ধা লোক একটা পরামর্শ দিন না।

—দেখুন অক্রুরবাবু, আপনার ওপর আমার অসীম শ্রদ্ধা হয়েছে। যা বলছি তাতে দোষ নেবেন না। আমি সামান্য লোক, শরীর বা মনের তত্ত্ব কিছুই জানি না। কিন্তু আমার মনে হয় আপনি যে পুং—হরমোনের কথা বলছেন তা হরেক রকম আছে। একটাতে দাড়ি গজায়, আর একটাতে গুঁতিয়ে দেবার অর্থাৎ আক্রমণের শক্তি আসে, আর একটাতে সর্দারি করবার প্রবৃত্তি হয়। তা ছাড়া আরও একটা আছে যা থেকে প্রেমের উৎপত্তি হয়। বোধ হচ্ছে আপনার সেইটের কিঞ্চিৎ অভাব আছে। আপনি কোনও বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের সঙ্গে পরামর্শ করুন।

খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে অক্রুরবাবু বললেন, তাই করা যাবে।

আমি নমস্কার করে বিদায় নিলুম। তার পরে আর অক্রুর নন্দীর সঙ্গে দেখা হয় নি। শুনেছি তিনি সমস্ত সম্পত্তি দান করে দ্বারাকাধামে তপস্বিনী জগদম্বা মাতাজীর আশ্রমে বাস করছেন। ভদ্রলোক শেষকালে আত্মসমর্পণই করলেন। আশা করি তিনি শান্তি পেয়েছেন।

১৩৫৯ (১৯৫২)