অক্টোপাসের লাল মুক্তো – ৮

সাবমেরিনের সামনের কাচের আধার দিয়ে দৃশ্যমান হল সমুদ্রের তলদেশের সব কিছু। এ জায়গা সুদীপ্তদের পরিচিত। এখানে নামত তারা। পায়ের নীচে সাদা ঝিনুকের বিছানা। চারপাশে ডুবো পাহাড়, আধো-অন্ধকারে জেগে থাকা ডুবো পাহাড়ের ছোট-বড় গুহামুখ মাটিতে গাঁথা সেই কঙ্কালটার ছিন্ন শিকলটাও চোখে পড়ল সুদীপ্তদের। সম্ভবত সেটা দেখেই রাইখ বলল, ‘সেই কঙ্কালটাও তবে জলে ভেসে গেছে তাই না?’

সুদীপ্ত প্রত্যুত্তরে ‘হ্যাঁ’ বলাতে রাইখ যেন বিমর্ষভাবে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।

কিন্তু কোনদিকে যাওয়া যায়? চারপাশেই তো পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে ডুবো পাহাড়! বেশ কিছুক্ষণ সে জায়গাতে ছোট জলযানটা ঘুরপাক খাবার পর শেষ পর্যন্ত পথ পাওয়া গেল। দুপাশে প্রবাল প্রাচীর দিয়ে ঘেরা ছাদহীন একটা সুড়ঙ্গ চলে গেছে সামনের দিকে। রাইখের সাবমেরিন সেই সুড়ঙ্গে ঢুকে এগোতে থাকল। রাইখ বলল, ‘এ ধরনের প্রবাল প্রাচীরগুলো সমুদ্রের তলদেশে এক-এক সময় কুড়ি-পঁচিশ মাইলও লম্বা হয়। দেখি এ সুড়ঙ্গ আমাদের কোথায় নিয়ে যায়?’

এঁকেবেঁকে এগিয়েছে প্রবাল প্রাচীর। তার মধ্যে মাঝে মাঝে মাছের বড় বড় ঝাঁক খেলা করছে। সাবমেরিন কাছে আসতেই তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যাচ্ছে। সাবমেরিনটাকে নির্ঘাত কোনো বড় মাছ ভেবেছে তারা। একবার একটা প্রায় সাবমেরিনের আকারেরই বড় হাঙর প্রবাল সুড়ঙ্গে তাদের পথ রোধ করে দাঁড়াল। বারকয়েক সে তার নাক দিয়ে গুঁতো দিল সাবমেরিনের সামনের কাচের দেওয়ালে। ভিতরে বসেও সুদীপ্ত কেঁপে উঠল তার ভয়ংকর মুখগহ্বরে তীক্ষ্ণ দাঁতের সারি দেখে। যদি কাচের দেওয়াল ভেঙে যায় কী হবে? তবে সেসব কিছু ঘটল না। সাবমেরিনটা তার খাদ্যবস্তু নয় বুঝতে পেরে সে অন্য দিকে চলে গেল। এক জায়গাতে বেশ অনেক জায়গা জুড়ে উজ্জ্বল লাল বর্ণের পাথরের মতো কী যেন ছড়িয়ে আছে। রাইখ বলল, ‘এগুলো মৃত প্রবাল কীট। জমে পাথর হয়ে গেছে। যে পাথর রত্ন হিসাবে ব্যবহার করা হয়। কত লক্ষ কোটি টাকার সম্পদ এখানে পড়ে আছে কে জানে!’ আর একবার চারপাশে দেখা গেল প্যারাশুটের মতো জেলিফিশ আর দুষ্প্রাপ্য ‘সি-হর্স’-এর ঝাঁক। এসব দেখে এত বিপদের মধ্যেও মোহিত হয়ে গেল সুদীপ্ত। মনে মনে সে ভাবল, নাইবা তাদের দেখা হল দানব অক্টোপাসের সঙ্গে, কিন্তু এই অজানা পৃথিবীর যে দৃশ্য সে দেখতে পাচ্ছে তা দেখার সৌভাগ্য ক-জন মানুষের ভাগ্যে হয়? রাইখের মুখ কিন্তু গম্ভীর। সে শুধু বলল, ‘সম্ভবত ঠিক পথেই এগোচ্ছি আমরা। সাবমেরিনের মিটার সংকেত দিচ্ছে আমরা ক্রমশ পাড়ের দিকে এগোচ্ছি।’

আরও বেশ কিছুটা পথ চলার পর যাত্রা শুরুতে প্রায় একঘণ্টা পর তারা একটা উন্মুক্ত স্থানে এসে পৌঁছল। তাদের কিছুটা তফাতে শুরু হয়েছে আর একটা টানেল বা সুড়ঙ্গ। সেটা দেখে একটু অবাক হল সুদীপ্তরা। না, সেটা প্রবাল প্রাচীরের সুড়ঙ্গ নয়। মোটা কাচ বা ফাইবার গ্লাস দিয়ে তৈরি বর্তুলাকার ছাদঅলা চারপাশ ঢাকা স্বচ্ছ সুড়ঙ্গ। যে সুড়ঙ্গ দিয়ে “সি-পার্কে” চারপাশের উন্মুক্ত সমুদ্রর তলদেশ দেখানো হয় পর্যটকদের। থাইল্যান্ডে একটা সি-পার্কে বেড়াতে গিয়ে একবার এ ধরনের টানেলে নেমেছিল সুদীপ্ত। টানেলের মাথার ওপরের সামান্য কিছু অংশই জলতলের বাইরে জেগে আছে। সেখান থেকে বাইরের পৃথিবীর আলো প্রবেশ করছে টানেলে। বেশ উজ্জ্বল দেখাচ্ছে টানেলটা। আর এরপরই আরও একটা জিনিস চোখে পড়ল তাদের। টানেলের কিছুটা তফাতে জলতলে সামুদ্রিক উদ্ভিদের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে একটা ছোট্ট সাবমেরিনের মাথা। আকারেও দেখতে সেই জলযানও ঠিক সুদীপ্তদের সাবমেরিনটার মতো। সেটা দেখামাত্রই রাইখ স্বগতোক্তি করল, ‘আমার অনুমান তবে মিথ্যা নয়।’ ‘

কী অনুমান?’

রাইখ বলল, ‘পরে সব বলব। মাস্ক পরে তৈরি হয়ে নাও। জলে নেমে আমরা ওই টানেলে ঢুকব।’ এই বলে সে নিজেও হেরম্যানের দেওয়া মাস্ক, সিলিন্ডার এসব পরতে লাগল। সমুদ্রের তলদেশে ধীরে ধীরে নেমে পড়ল সাবমেরিন। দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল রাইখ আর সুদীপ্ত। চারপাশে খেলে বেড়াচ্ছে রঙিন মাছের ঝাঁক। তার মধ্যে দিয়ে সুদীপ্তরা এগোল টানেলের দিকে। স্টিলের ফ্রেমের খাঁচায় বসানো আছে টানেলটা। সেই খাঁচা বেয়ে টানেলের মাথায় উঠল দুজন। কয়েক মুহূর্তর জন্য তাদের চোখে ধরা দিল সমুদ্রের বাইরের আলোকোজ্জ্বল পৃথিবী। সূর্যের আলোতে ধাঁধিয়ে গেল সুদীপ্তর চোখ। কিন্তু বাইরে তাকিয়ে সে বুঝতে পারল যে জায়গাটা শিকোকু সি-পার্ক। টানেলের মাথার ওপর একটা বৃত্তাকার দরজা পাওয়া গেল ভিতরে নামার জন্য। ম্যানহোলের মতো সেই দরজা দিয়ে টানেলের মধ্যে লাফিয়ে নামল তারা দুজন। তারপর টানেল ধরে এগোল সোজা সামনের দিকে। প্রায় দুশো ফুট লম্বা টানেলের শেষ প্রান্তে একটা কাচের ঘরের ভিতরে উপস্থিত হয়ে দেওয়ালের একপাশে তাকাতেই অবাক হয়ে গেল সুদীপ্ত। কাচের দেওয়ালের ওপাশেই দেখা যাচ্ছে শিকোকু পার্কের সেই দানব অক্টোপাস! বিশাল ঘরের মতো এই নতুন অ্যাকোরিয়ামে স্থানান্তরিত করা হয়েছে প্রাণীটাকে। অ্যাকোরিয়ামের উল্টোদিকের কাচের দেওয়ালের ওপাশে সমুদ্রের তলদেশ দেখা যাচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে সেদিকের দেওয়ালে  মৃদু মৃদু শুঁড়ের ঝাপটা দিচ্ছে ভয়ংকর কুৎসিত প্রাণীটা। কাচের পর্দার ওপাশে সমুদ্র তাকে ডাকছে। প্রাণীটা হয়তো চেষ্টা করছে কাচের পর্দা ভেদ করে সমুদ্রে ফিরে যাবার জন্য। ঠিক যেমন খাঁচার পাখি তাকিয়ে থাকে আকাশের দিকে, ঠিক তেমনই প্রাণীটার ড্যাবড্যাবে চোখ দুটো তাকিয়ে আছে সমুদ্রের দিকে।

হঠাৎ একটা মৃদু শব্দ হল। সুদীপ্তরা দেখতে পেল কাচের একটা দরজা খুলে বেরিয়ে এসে দাঁড়ালেন শিকোকু পার্কের মালিক মিস্টার শিকোকু। সুদীপ্তদের সেখানে দেখে স্পষ্ট বিস্ময় ফুটে উঠল তাঁর চোখে। আর তাঁকে দেখেই চোয়াল শক্ত হয়ে গেল রাইখের। প্রাথমিক বিস্ময়ের ঘোর কাটিয়ে শিকোকু রাইখকে বললেন, ‘তুমি তাহলে এখানে পৌঁছে গেলে!’ রাইখ জবাব দিল, ‘হ্যাঁ, এলাম। আমার জিনিসটা এবার আমাকে ফেরত দিন।’

‘যদি না দিই?’ প্রশ্ন করলেন শিকোকু।

রাইখ এবার সুদীপ্তকে চমকে দিয়ে মুহূর্তের মধ্যে সুদীপ্তর কোমরে গোঁজা লম্বা ছোরাটা টেনে নিয়ে কর্কশভাবে বলল, ‘না দিলে এটা তোমার বুকে ঢুকে যাবে। তোমাকে আমি চিনতে পেরেছি। আমার পূর্বপুরুষদের খুনের বদলা, আমাকে খুনের চেষ্টার বদলা এখনই নেব আমি। জিনিসটা আমাকে দিলে আমি তোমাকে শুধু পুলিশের হাতে তুলে দেব। আইনে তোমার যা বিচার হবার হবে। সেখানে হয়তো আইনের ফাঁক গলে তুমি মুক্ত হতে পারবে। কিন্তু ওটা আমার হাতে না দিলে আর সে সুযোগ তুমি পাবে না।’ এই বলে সে কয়েক পা এগিয়ে গেল শিকোকুর দিকে।

শিকোকু পিছু হটে দেওয়াল ঘেঁষে দাঁড়ালেন। ফ্যাকাশে হয়ে গেছে তাঁর মুখ। একটু চুপ করে থেকে তিনি বললেন, ‘ঠিক আছে ধরাই যখন পড়ে গেছি তখন এত বছর আগলে রাখা জিনিসটা তুলে দিচ্ছি তোমার হাতে। ওটা কোথায় আছে জানো। ওই অক্টোপাসের খাবারের বাক্সের মধ্যে। ওর গায়ে দেখো শিকল লাগানো আছে। অ্যাকোরিয়ামের গায়ের স্টিলের ফ্রেমের গা বেয়ে ওপরে ওঠো। ওর ছাদে একটা গর্ত আছে। ওখান দিয়ে শিকলটা টেনে বাক্সটা তুলে নাও। ওখানে দিয়েই বাক্সটা ওঠানো-নামানো হয়।’

সুদীপ্তরা এবার খেয়াল করল যে সত্যিই একটা সরু শিকল বাক্সটা থেকে উঠে গেছে অ্যাকোরিয়াম ঘরের ছাদের দিকে।

রাইখ বলল, ‘আপনিই ওপরে উঠে তুলে আনুন বাক্সটা।’

শিকোকু এবার বেশ দৃঢ়ভাবে বললেন, ‘যে জিনিসটা আমি এত বছর আগলে রাখলাম, যার জন্য দেশ ছেড়ে এতদূরে আছি, এত বিপদের ঝুঁকি নিয়েছি সেটা আমি কিছুতেই নিজে থেকে তোমার হাতে তুলে দিতে পারব না। তুমি আমাকে খুন করলেও নয়। ওটা তোমাকে নিজের হাতে তুলে নিতে হবে।’

শিকোকুর কথা শুনে যেন ধন্দে পড়ে গেল রাইখ। কয়েক মুহূর্ত ভেবে নিয়ে ছুরিটা সুদীপ্তর হাতে ধরিয়ে দিয়ে সে বলল, ‘এই লোকটা তোমাদের সবাইকেই মারতে চেয়েছিল। ওকে পালাতে দেবে না। দরকার হলে ছুরি বসিয়ে দেবে। আমি জিনিসটা উঠিয়ে আনি।’—এই বলে সে অ্যাকোরিয়ামটার দিকে এগিয়ে গেল। কয়েক মুহূর্তর মধ্যেই সে চড়ে বসল কাচের ঘরটার মাথায়।

রাইখ এরপর সম্ভবত নীচু হয়ে কাচের ঘরের মাথার ফোকর দিয়ে চেন ধরে বাক্সটা টেনে তুলতে যাচ্ছিল। সুদীপ্ত তাকিয়েছিল সেই দিকে। ঠিক সেই সময় শিকোকু অট্টহাস্য করে উঠলেন। তাঁর হাতে কখন যেন উঠে এসেছে একটা রিভলভার। তিনি সুদীপ্তকে বললেন, ‘ছুরিটা ফেলে দিন। নইলে গুলি করে মারব দুজনকে।’

অগত্যা সুদীপ্ত ছুরিটা ফেলে দিল হাত থেকে। শিকোকু কুড়িয়ে নিলেন সেটা। বাঁচবার একটা শেষ চেষ্টা করার জন্য এরপর রাইখ ওপর থেকে শিকোকুর ওপর ঝাঁপ দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু তার আগেই শিকোকু দেওয়ালের গায়ে সম্ভবত একটা বোতাম টিপলেন। রাইখের পায়ের নীচের কাচের পাটাতন সরে গেল! সুদীপ্ত দেখতে পেল রাইখ ওপর থেকে অক্টোপাসের ঘরের নীচে আছড়ে পড়ল। শিকোকু আবার অট্টহাস্য করে বলে উঠলেন, ‘দেখা যাক ও অক্টোপাসের কবল থেকে জিনিসটা ছিনিয়ে আনতে পারে কিনা।’

বিরাট ঘরের মতো কাচের জলাধার। লম্বা-চওড়া দু-দিকেই প্রায় তিরিশ ফুট হবে। উচ্চতা অন্তত পনেরো ফুট। তার মেঝেতে আছড়ে পড়ার পরই উঠে দাঁড়াল রাইখ। কিন্তু সে নিরস্ত্র। অক্টোপাসটা ফিরে তাকিয়েছে তার দিকে। তার শুঁড়গুলোও ধীরে ধীরে রাইখের দিকে ফিরছে। সুদীপ্ত অসহায়। তার দিকে শিকোকুর রিভলভারের নল তাগ করা। প্রথমে অক্টোপাসের একটা বাহু সাপের ফণার মতো এগোল রাইখের দিকে। রাইখ কাচের ঘরের এক কোণে সরে এল। তারপর দানবের আর একটা বাহু একদম তার কাছে চলে এল। হাতের আঘাতে রাইখ সেটা সরিয়ে দিল। এরপর পরপর বেশ কয়েকটা এমন ঘটনা ঘটল। ফাঁদে পড়া ইঁদুরকে যেমন বিড়াল মারার আগে একটু খেলিয়ে নেয়, তেমনই শিকারকে মারার আগে তাকে যেন একটু খেলিয়ে নিচ্ছে অক্টোপাসটা। বহুদিন পর কাউকে সে তার নাগালের মধ্যে পেয়েছে। তাই যেন একটু মজা করছে তাকে নিয়ে। সুদীপ্ত খেয়াল করল রাইখের অঙ্গ সঞ্চালন শ্লথ হয়ে আসছে। পিঠে সিলিন্ডার থাকলেও উত্তেজনায় অক্সিজেন মাস্কটা লাগাতে ভুলে গেছে।

সুদীপ্ত চিৎকার করে উঠল, ‘অক্সিজেন মাস্ক লাগাও! মাস্ক লাগাও!’ কিন্তু তার কণ্ঠস্বর সম্ভবত রাইখের কানে পৌঁছল না। শিকোকু তাই দেখে অট্টহাস্য করে বললেন, ‘অক্টোপাসটা ওকে ধরার পর আপনারও ব্যবস্থা করব। চিন্তা নেই।’ সেই ভয়ংকর প্রাণীটাও মনে হয় এক সময় বুঝতে পারল যে তার শিকার অবসন্ন হয়ে পড়েছে। শিকারকে মরণ আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরার জন্য সে এরপর একসঙ্গে তার চার-পাঁচটা বাহু সাপের ফণার মতো তুলে ধরল রাইখের দিকে। সেই ভয়ংকর দৃশ্য না দেখার জন্য সুদীপ্ত অন্যদিকে মুখ ফেরাতে যাচ্ছিল। ঠিক সেই সময় রাইখ নিজেকে বাঁচাতে একটা শেষ চেষ্টা করল। পিঠ থেকে অক্সিজেন সিলিন্ডারটা খুলে সেটা সজোরে ছুড়ে মারল অক্টোপাসটার দিকে। রাইখ লক্ষ্যভ্রষ্ট হল ঠিকই। কিন্তু কাচের দেওয়ালে সেটা আছড়ে পড়ে একটা ছোট বিস্ফোরণ ঘটাল। হুড়মুড় করে ভেঙে পড়ল কাচের ঘরটা। সমুদ্রর জল মুহূর্তের মধ্যে সুদীপ্তরা যেখানে ছিল সেখানে প্রবেশ করে বাইরের সমুদ্রে ভাসিয়ে নিয়ে গেল সবাইকে।

বেশ কিছুক্ষণ জলের তোড়ে ওলোটপালোট খাবার পর অবশেষে মাটি খুঁজে পেল সুদীপ্ত। সে উঠে দাঁড়িয়ে অক্সিজেনের নল গুঁজে নিল নাকে। চারপাশে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করল রাইখ বা শিকোকু জলের তোড়ে কোনদিকে গেছে। প্রাথমিকভাবে কাউকে সে দেখতে পেল না। তাহলে কি তারা আরও দূরে ভেসে গেল? কাউকে না দেখে এরপর ওপরে ভেসে উঠতে যাচ্ছিল সুদীপ্ত। হয়তো রাইখ আর শিকোকু দুজনেই ওপরে উঠে গেছে। সুদীপ্তর সামনে একটা প্রবাল প্রাচীর। জলের তোড়ে এসে তার গায়েই আটকে গেছে সে। সুদীপ্ত ঠিক যখন ভেসে উঠতে যাচ্ছে তখনই হঠাৎ সেই প্রবাল প্রাচীরের আড়াল থেকে বেরিয়ে এলেন শিকোকু। তিনি তার পথ আটকে দাঁড়ালেন। রিভলভার না থাকলেও তাঁর হাতে ধরা সুদীপ্তর সেই লম্বা ছুরি বা মেরিন নাইফটা। তারা দুজনেই জলতলে থাকলেও শিকোকুর চোখে ফুটে উঠেছে জিঘাংসা। কাছে এসে সুদীপ্তকে লক্ষ্য করে ছুরি চালাতে শুরু করলেন তিনি। সুদীপ্ত এদিক-ওদিক সরে গিয়ে সেই ছুরির আঘাত এড়াবার চেষ্টা করে যেতে লাগল। তবুও শেষরক্ষা হল না। হঠাৎই শিকোকুর লম্বা ছুরির আঘাতে কেটে গেল সুদীপ্তর অক্সিজেনের নলটা। সুদীপ্ত জাপানি ডুবুরি নয়। নলটা কেটে যেতেই তার দমবন্ধ হয়ে আসতে লাগল। ছুরি চালিয়ে যাচ্ছেন শিকোকু। তার আঘাত এড়াতে গিয়ে এক সময় মাটিতে পড়ে গেল সুদীপ্ত। শিকোকু চেপে বসলেন তার বুকের ওপর। অক্সিজেনের অভাবে অবসন্ন হয়ে পড়েছে সুদীপ্ত। শিকোকুকে বাধা দেবার শক্তি তখন আর তার নেই। সুদীপ্ত দেখল তার ওপর বসা শিকোকুর ছুরি-ধরা হাতটা ওপরে উঠল ছুরিটা সুদীপ্তর বুকে আমূল বসিয়ে দেবার জন্য। সুদীপ্ত অসহায়। এই বুঝি ছুরিটা নেমে আসে! ছুরিটা কিছুটা নেমে এল ঠিকই কিন্তু সেটা তার বুক স্পর্শ করার আগেই একটা হাত যেন কোথা থেকে এসে জাপটে ধরল শিকোকুর ছুরি-ধরা হাতসমেত দেহটা। যে হাতটা শিকোকুকে আলিঙ্গন করল সেটা মানুষের হাত নয়, অক্টোপাসের বাহু। সেই দানব ডলফিনি অক্টোপাসটা কোথা থেকে যেন আবির্ভূত হয়ে তার বাহুর আলিঙ্গনে এক ঝটকায় শিকোকুকে সুদীপ্তর বুকের ওপর থেকে তুলে নিয়ে অন্যদিকে এগোল। মৃত্যু আলিঙ্গনে ছটফট করতে লাগলেন শিকোকু। আর এরপরই রাইখ এসে অবসন্ন সুদীপ্তকে মাটিতে উঠিয়ে দাঁড় করাল। রাইখের হাতে ধরা অক্টোপাসের খাঁচার সেই বাক্সটা। ওপরে ভেসে ওঠার আগে তারা একবার তাকাল সামনের দিকে। তারা দেখল সেই দানব অক্টোপাসটা মিস্টার শিকোকুকে মৃত্যু আলিঙ্গনে জড়িয়ে হারিয়ে যাচ্ছে সমুদ্রের গভীরে দূর থেকে দূরে। একটা ক্ষীণ রক্তরেখা সে ছেড়ে রেখে যাচ্ছে সমুদ্রের তলদেশে তার যাত্রাপথে। সেদিকে তাকিয়ে নিয়ে কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সূর্যালোকে ভেসে উঠল রাইখ আর সুদীপ্ত। এই প্রথম সুদীপ্ত অনুভব করল পৃথিবীর বাতাসে বুক ভরে শ্বাস নেওয়াটা কত সৌভাগ্যের! কত আনন্দের!

পরিশিষ্ট: মারমেড বিচের সেই হোটেলের ঘরে একটা টেবিল ঘিরে বসেছিল সুদীপ্ত, হেরম্যান, আকিরা আর রাইখ। বাইরে সকালের সূর্যস্নাতা তটরেখা। সমুদ্রের ঢেউ ভাঙছে সেখানে। নীল আকাশের নীচে সোনালি রোদ গায়ে মেখে সমুদ্রস্নান করছে টুরিস্টরা।

বেশ সুন্দর একটা দিন। আগের দিন বিকালে সরকারি রেসকিউ টিম নিয়ে সমুদ্রের গভীরে সেই ডুবো পাহাড় থেকে হেরম্যান আর আকিরাকে উদ্ধার করে আনা হয়েছে। সুদীপ্তর এক-এক সময় মনে হচ্ছে যে গত কদিনের ঘটনা, সেই ডুবো পাহাড় ঘেরা জায়গা, সমুদ্রর তলদেশের সেই গুহামুখ, সেই গুহা, সেই অক্টোপাস, তার সঙ্গে রাইখের লড়াই, সুদীপ্তর বুকের ওপর বসে থাকা শিকোকুর উদ্যত ছুরি—এ সবই যেন একটা স্বপ্ন ছিল। স্বপ্ন মানে দুঃস্বপ্ন!

টেবিল ঘিরে চেয়ারে বসে কথা চলছিল। বক্তা মূলত রাইখ। শ্রোতা অন্যরা। রাইখ বলল, ‘ওই দানব অক্টোপাস মিস্টার শিকোকুকে টেনে নিয়ে যাওয়ায় যে ঘটনার পরিসমাপ্তি ঘটল তার সূচনা কিন্তু বহু বছর আগে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে জাপান সাগরে। শিকোকুর ঠাকুর্দা আর আমার ঠাকুর্দা তখন একসঙ্গে কাজ করছেন জাপ-সমুদ্রে। হঠাৎ তাঁরা সমুদ্রর তলদেশ থেকে খুঁজে পেলেন এক দুমূর্ল জিনিস। উভয়ের পরিবারের সামান্য ক’জন লোক ছাড়া ব্যাপারটা প্রাথমিকভাবে না জানলেও কীভাবে যেন তা সরকারের কানে পৌঁছে গেল। জার্মান সরকার বলল যে যুদ্ধ মিটে গেলে সেটা সরকারের হাতে তুলে দিতে হবে। প্রমাদ গুনলেন দুই ডুবুরি। কীভাবে রক্ষা করা যায় সেই জিনিসটা? তখনও যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি তাতে জাপ-জার্মান জিততে চলেছে। পরে অবশ্য উল্টো ঘটনা ঘটেছিল। পরাজিত হয়েছিল জার্মানি। যাই হোক, সে সময়ে সেই দুই ডুবুরি মিলে ঠিক করলেন জিনিসটা নিয়ে দূরে পালাতে হবে। পালাতে হবে এমন দেশে যেখানে যুদ্ধ হচ্ছে না। শিকোকুর ঠাকুর্দা ওশাকু আর আমার ঠাকুর্দা পাওয়েল রাইখ মিলে যে দেশটা নির্বাচন করলেন সেটা হল এই অস্ট্রেলিয়া। ওশাকু তার আগে এই অস্ট্রেলিয়ার সমুদ্রতটে এসেছিলেন ডুবুরির কাজে মুক্তো সংগ্রহ করতে। এ জায়গা তাঁর চেনা ছিল। সেসময় জাপান সমুদ্রে মার্কিন বোমারু বিমান আর সাবমেরিনের হানা চলছে। সেই গোলযোগের সুযোগ নিয়ে সে জিনিসটা সঙ্গে করে একটা সাবমেরিনে তাঁরা দুজন পাড়ি দিলেন এই অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে। এখানে তাঁরা পৌঁছেও গেলেন। সামরিক বাহিনী ধারণা করল মার্কিন টর্পেডো হানায় তাঁদের মৃত্যু হয়েছে। আমরা শুধু জানলাম তাঁরা বেঁচে আছেন। এখানে এসে মুক্তো সংগ্রহকারী ডুবুরিদের দলে মিশে গেলেন তাঁরা।’

একটানা কথাগুলো বলে একটু থামল রাইখ। তারপর আবার বলতে শুরু করল—‘কিন্তু এখানে আসার এক বছরের মধ্যেই ঘটনা অন্যদিকে মোড় নিল। শেষ চিঠিতে দাদু আমাদের লিখেছিলেন যে জিনিসটা তাঁরা বিক্রি করার চেষ্টা করছেন। সে কাজ মিটে গেলেই তিনি দেশে ফিরে আসবেন। ততদিনে অবশ্য যুদ্ধ থেমে গেছে। হিটলারের পতন হয়েছে। লাল ফৌজ মুক্ত করেছে জার্মানিকে। শেষ চিঠি তিনি পাঠিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ার এই মারমেড সমুদ্রতট থেকেই। আর এরপর থেকেই ঠাকুর্দার সঙ্গে সব সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল আমাদের। তাঁর খোঁজ আমরা পেলাম না। আমাকে শিশু অবস্থায় রেখে আমার বাবা বছর কুড়ি পর আমার দাদুর সন্ধানে এখানে এসে নিখোঁজ হয়ে গেলেন। এখন বুঝছি হয়তো তাঁকেও খুন করে শিকোকু বা তার বাবা-ঠাকুর্দারা। তবে আমি আমার বাবার সন্ধান না পেলেও ঠাকুর্দার সন্ধান কিন্তু পেয়েছি…’

সুদীপ্ত প্রশ্ন করল, ‘কোথায় পেলে?’

রাইখ জবাব দিল, ‘যে কঙ্কালটা গুহার মুখে ছিল সেটা আমার ঠাকুর্দার কঙ্কাল। ওঁর হাতের আংটিতে অক্টোপাসের ছবি আঁকা ছিল। বাবার মুখে শুনেছি ঠাকুর্দা ওই রকম একটা আংটি পরতেন। ওই কঙ্কালটার প্রতি টান থেকেই মাঝরাতে বোটের কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে ওই কঙ্কালটা দেখতে গেছিলাম আমি। এ প্রসঙ্গে একটা কথা বলি। শিকোকুর লোক মরগ্যান কিন্তু আমি ভেবেই ছুরি মেরেছিল ওই ধীবরকে। তারপর ওই ছুরি কঙ্কালটার হাতে ধরিয়ে ব্যাপারটাকে ভৌতিক প্রমাণের চেষ্টা করা হয়েছিল যাতে আমরা সে জায়গা ছেড়ে চলে আসি। সমুদ্রতলের গুহামুখে ঠাকুর্দার কঙ্কালটা রাখা, বা রোবট অক্টোপাস,—এ সবই ছিল ওই অঞ্চল থেকে ভয় দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে দূরে রাখার চেষ্টা। ওই গুহাতেই তো শিকোকু লুকিয়ে রেখেছিলেন জিনিসটা। মরগ্যানের পিছন পিছন গিয়ে আমি ওই গুহায় এক সিন্দুকের মধ্যে জিনিসটা খুঁজেও পেয়েছিলাম। রোবট অক্টোপাস দিয়ে ধরে আনার পর মুখোশধারী শিকোকু সেটা কেড়ে নেয় ৷ শিকোকু মনে হয় আমাকে আগেই চিনতে পেরেছিল। তার হয়তো ধারণা হয়েছিল যে আমি ওই জিনিসটার খোঁজে এসেছি। তাই সে তার অনুচর মরগ্যানকে পাঠিয়েছিল আমাদের সঙ্গে।’

আকিরা জানতে চাইলেন, ‘আপনাকে কীভাবে চিনল শিকোকু?’

রাইখ বলল, ‘আমি তো আগের দিন গেছিলাম “সি-পার্কে”। সুদীপ্ত, আমি তোমাকে যে পারিবারিক ফোটোগ্রাফি দেখিয়েছিলাম সেটা ভালো করে খেয়াল করলে দেখলে বুঝতে যে আমার দাদুর চেহারার সঙ্গে বেশ মিল আছে আমার। সম্ভবত শিকোকু সেদিন আড়াল থেকে আমাকে দেখেছিল। আমার ঠাকুর্দাকে বা তার ছবিও হয়তো সে তার আগে দেখেছিল অথবা মিস্টার আকিরার কাছ থেকে জেনেছিল আমার নাম, দেশের কথা।’

আকিরা বললেন, হ্যাঁ, আমি তাকে কথাপ্রসঙ্গে আপনাদের সবারই পরিচয় বলেছিলাম। তা শুনেও সন্দেহ হতে পারে তার মনে।’

রাইখ এরপর বলল, ‘যাই হোক, যে-কোনো কারণেই শিকোকুর মনে সন্দেহ হয় আমার প্রতি। তাছাড়া, আপনারা যদি ওই গুহার সন্ধান পান সে ভয়ও কাজ করছিল তার মনে। তাই সে মরগ্যানকে পাঠায় আমাদের সঙ্গে। যেদিন আমরা সমুদ্রে যাত্রা করছি সেদিন ‘সি-পার্কের’ তোরণের সামনে শিকোকুকে দেখেও কেমন যেন চেনা চেনা মনে হয়েছিল। আসলে শিকোকুর ঠাকুর্দার সঙ্গেও তার চেহারার একটা গঠনগত মিল ছিল। সুদীপ্ত, তোমাকে দেখানো ছবিটার মধ্যে ওশাকুও ছিল। মরগ্যানও কিন্তু দেখেছিল ছবিটা। নির্ঘাত সে-ও ছবির কাউকে চিনতে পারে। সেই ডুবুরি ছুরিকাহত হবার পর একটি জিনিস আমার ঘর থেকে খোয়া যায় তা হল ওই ছবি। এমনও হতে পারে যে ওটা দেখার পরই বোটের ওয়ারলেস সিস্টেমের মাধ্যমে মরগ্যান ব্যাপারটা শিকোকুকে জানায়, আর তারপরই শিকোকু সাবমেরিনে করে ওই গুহায় হাজির হয় সেই জিনিসটা সরিয়ে ফেলার জন্য।’

রাইখের কথা শেষ হবার পর সবাই বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল। তারপর হেরম্যান তার উদ্দেশে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনার সেই “জিনিসটা কী বলবেন যদি আপনার আপত্তি না থাকে? শেষপর্যন্ত সে জিনিসটার কী গতি হল বলবেন?’

কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থাকার পর রাইখ বলে, ‘সেটা বর্তমানে আমার হস্তগত। ভাবছি জিনিসটা এশিয়ার কোনো মিউজিয়ামে দান করে দেব আমার বাবা ও ঠাকুর্দার নামে। বহু লোক তবে দেখতে পারবে সেটা। জিনিসটা বিক্রি করলে অবশ্য অনেক টাকা পাওয়া যেত। আমি সমুদ্র-গবেষক। টাকাপয়সার ওপর তেমন লোভ নেই আমার। শিকোকু কিন্তু ওই গুহা থেকে জিনিসটা কেড়ে এনে সত্যি সত্যি ওই দানব অক্টোপাসের খাবারের বাক্সের ভিতর একটা খোপে সেটা লুকিয়ে রেখেছিল। জিনিসটা আপনাদের আমি দেখাচ্ছি।’—এই বলে রাইখ তার ট্রাউজারের পকেট থেকে একটা বাক্স বার করে টেবিলের ওপর রেখে সেটা খুলল। বাক্সর ভিতর লাল ভেলভেটের বিছানার ওপর বসানো আছে কচ্ছপের ডিম বা পিংপং বলের আকৃতির নিটোল গোল একটা জিনিস! জানলা দিয়ে আসা সূর্যালোকে সেই গোলাকার বস্তুর গা-দিয়ে চুঁইয়ে পড়ছে কোমল রক্তিম আভা।

আকিরা প্রথম জিনিসটাকে চিনতে পেরে উত্তেজিতভাবে বলে উঠলেন, ‘আরে এ যে মুক্তো! এত বড় মুক্তো!’

রাইখ মৃদু হেসে বলল, ‘হ্যাঁ, মুক্তো। এই সেই ইতিহাস-বিখ্যাত মুক্তো ‘স্টার অব দি ইস্ট’। জাপানি সমুদ্রতট থেকে যা তোলা হয়েছিল একদিন। তারপর সেটা হারিয়ে যায়…।’

সবাই হতবাক হয়ে চেয়ে রইল সেই আশ্চর্য সুন্দর মুক্তোটার দিকে। এক সময় সুদীপ্ত বলে উঠল, ‘এর একটা নতুন নামও দেওয়া যায়—“অক্টোপাসের মুক্তো”।