জলে নামার জন্য তৈরি হয়ে নিল সুদীপ্তরা। ডুবুরির পোশাক পরার পর সুদীপ্ত কোমরে গুঁজে নিল একটা লম্বা ছুরি। আর হেরম্যানের হাতে ওশোর সেই হারপুন গানটা ধরিয়ে দিয়ে আকিরা বললেন, ‘আশা করি আপনারা ঠিক মতো ফিরবেন।’ তাঁর কথার জবাবে মৃদু হাসলেন হেরম্যান। তারপর ঝাঁপ দিলেন জলে। পরমুহূর্তে সুদীপ্তও তাঁকে অনুসরণ করল।
গভীর জলতল। পায়ের নীচে ঝিনুকের বিছানা পাতা। মাটিতে পা ঠেকার পর চারপাশে ভালো করে একবার তাকাল। আধো-অন্ধকারের মধ্যে জেগে আছে ডুবো পাহাড়ের তলদেশের গুহাগুলো। একটাও মাছের ঝাঁক কোথাও নেই। কেমন যেন থমথমে পরিবেশ বিরাজ করছে পাতালপুরীতে। হেরম্যান প্রথমে কোমরবন্ধনী থেকে দড়িটা খুলে ফেললেন। তাঁর দেখাদেখি সুদীপ্তও খুলে ফেলল সেটা। দড়ি এত লম্বা নয় যে তা নিয়ে গুহার ভিতর প্রবেশ করা যাবে। দুজনে মুক্ত হয়ে যাবার পর তারা এগোল সেই গুহাটার দিকে। গুহামুখের কিছুটা তফাতে এসে থমকে দাঁড়াল তারা। হেরম্যান ক্যামেরাটা তুলে নিলেন। সেটা অক্ষতই আছে। সম্ভবত অক্টোপাসের শুঁড়ের দাপটেই একরাশ ঝিনুক চাপা পড়ে গেছিল তার ওপর। ক্যামেরাটা তুলে নেবার পর হেরম্যান সুদীপ্তর উদ্দেশে ইশারা করলেন। অর্থাৎ ‘এবার গুহায় ঢুকব।’
এক পা-এক পা করে তারা এগোতে যাচ্ছিল সেদিকে। ঠিক সেই মুহূর্তে তাদের পিছনে একটা মৃদু জলোচ্ছ্বাস হল। চমকে উঠে পিছনে তাকিয়েই তারা দেখতে পেল ওপর থেকে একজন নীচে এসে পড়ল। তার পড়ার ভঙ্গি বলে দিল যে লোকটার সম্ভবত কোনো চেতনা নেই। হাত-পা ছড়িয়ে পড়ে সে আর নড়ছে না! সুদীপ্তরা এরপর চিনতে পারল লোকটাকে। আকিরা! যত দ্রুত সম্ভব তাঁর কাছে পৌঁছে গেল তারা। অনুমান সত্যি। আকিরা অচেতন! তিনি এভাবে নীচে নেমে এসে পড়লেন কীভাবে? সুদীপ্তরা মুহূর্তর মধ্যে নিজেদের কর্তব্য স্থির করে নিল। আকিরাকে জাপটে ধরে তারা যখন ভেসে উঠতে যাচ্ছে তখন তাদের মাথার ওপরের জলে একটা আলোড়ন তৈরি হল। সুদীপ্তদের বোটের প্রপেলার চালু হয়ে গেছে! তার জন্যই জলে ওই আলোড়ন! যথাসম্ভব দ্রুত ভেসে উঠলেও বোট তখন ধীরে ধীরে সরে যেতে শুরু করেছে। যে ডুবো পাহাড়টার গায়ে বোটটা লাগানো ছিল তার থেকে অন্তত পঞ্চাশ হাত সরে গেছে বোট। ওপরে ভেসে উঠে কোনোরকমে ডুবো পাহাড়ের একটা খাঁজের মধ্যে আকিরার অচৈতন্য দেহটা গুঁজে হেরম্যান চিৎকার করে বলে উঠলেন, ‘মরগ্যান, আমাদের ফেলে কোথায় যাচ্ছেন?? পাইলট কেবিন থেকে ভেসে এল মরগ্যানের অট্টহাসি।
ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছে বোটটা। হঠাৎ সুদীপ্তর নজরে পড়ল বোটের সঙ্গে বাঁধা সেই লম্বা দড়ি দুটো। যা বাঁধা ছিল সুদীপ্তদের কোমরে, ভারহীন অবস্থায় সেগুলো জলের ওপর ভেসে উঠেছে। সুদীপ্ত সেই দড়ি লক্ষ করে আবার ঝাঁপ দিল জলে। তারপর দ্রুত সেই দড়ি ধরে এগোতে লাগল বোটের দিকে। চারপাশে ডুবো পাহাড় থাকায় এখনও বোট তেমন গতি পায়নি। অবশেষে সুদীপ্ত দড়ি ধরে উঠে এল বোটে। তারপর ছুটল পাইলট কেবিনের দিকে।
সুদীপ্ত যে এভাবে বোটে উঠে আসতে পারে তা মরগ্যানের ধারণা ছিল না। তাকে দেখামাত্রই তার হাসি মিলিয়ে গেল। বোটের গতি বাড়িয়ে দিল সে। এক হাতে হুইল ধরে অন্য হাতে কোমর থেকে একটা লম্বা জাহাজি পিস্তল বার করে সেটা সুদীপ্তর দিকে উঁচিয়ে লোকটা বলল, ‘আমাকে বাধা দিলেই গুলি চালাব। প্রাণে বাঁচতে চাইলে জলে ঝাঁপ দাও।’
থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সুদীপ্ত। মরগ্যান আবার চিৎকার করে উঠল, ‘ঝাঁপ দাও । নইলে গুলি চালাব।’
সুদীপ্ত বলল, ‘না, আমি যাব না। আপনি আমাদের রেখে পালাচ্ছেন কেন?’ মরগ্যান বোটের গতি আরো বাড়িয়ে হিংস্রভাবে বলল, ‘আমি কোনো কথার জবাব দেব না। দশ পর্যন্ত গুনব। তারপর গুলি চালাব। এক, দুই, তিন…’
সুদীপ্ত কি করবে তা বুঝতে পারছে না। মরগ্যান কি সত্যি গুলি চালাবে? মুহূর্ত কেটে চলেছে। মরগ্যান গুনে চলেছে—ছয়, সাত…
সে সাত পর্যন্ত গোনার পর হঠাৎই সুদীপ্তর নজর পড়ল বাইরে। সুদীপ্তর দিকে তাকিয়ে থাকার ফলে মরগ্যানের খেয়াল নেই তার বোট দ্রুতগতিতে ছুটে চলেছে এক বিশাল ডুবো পাহাড়ের দিকে!
আর এক মুহূর্ত সময় নষ্ট করল না সুদীপ্ত। একলাফে পাইলট কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে ডেক টপকে সে ঝাঁপ দিল জলে। শেষ মুহূর্তেও জলে ঝাঁপ দেবার সময়ও মরগ্যানের অট্টহাস্য শুনল সুদীপ্ত। মরগ্যান ভাবল সুদীপ্ত ভয়ে পালাল। কিন্তু মরগ্যান যখন সামনে তাকাল তখন তার অনেক দেরি হয়ে গেছে। আপ্রাণ চেষ্টা করেও সে বোটকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারল না। জলে ভাসতে ভাসতে সুদীপ্ত দেখল বোটটা উল্কার গতিতে ছুটে গিয়ে পাঁচশো ফুট দূরে ডুবো পাহাড়টার গায়ে সজোরে ধাক্কা মেরে প্রথমে ছিটকে শূন্যে উঠে গেল। আর তারপরই তেলের ট্যাঙ্কে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ হয়ে অত বড় বোটটা টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ল সমুদ্রে। বিস্ফোরণের অভিঘাত মনে হয় সমুদ্রের তলদেশেও পৌঁছেছিল। একঝাঁক মরা মাছ ভেসে উঠল ওপরে। চারপাশ শান্ত হবার পর সুদীপ্ত দেখার চেষ্টা করল মরগ্যানকে কোথাও দেখা যায় কিনা। না, তাকে দেখা গেল না। বিস্ফোরণে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে তার দেহ। শুধু তার বুট জুতোর একটা পাটি ভাসতে দেখল সে। অগত্যা সে এরপর সাঁতরে ফিরে চলল সেই ডুবো পাহাড়ের শীর্ষদেশের দিকে যেখানে রয়েছেন হেরম্যান আর আকিরা। হেরম্যান ইতিমধ্যে আকিরাকে টেনে পাহাড়টার নিরাপদ জায়গাতে উঠিয়ে ফেলেছেন। সুদীপ্ত সাঁতরে
পাহাড়টার গায়ে উঠতেই উল্লাসে চিৎকার করে উঠলেন হেরম্যান—’তুমি বেঁচে আছ!’ সুদীপ্ত জবাব দিল, ‘বোটটা ধাক্কা খাবার আগেই জলে ঝাঁপ দিয়েছিলাম। তবে মরগ্যান সম্ভবত বেঁচে নেই।’ সংক্ষেপে ব্যাপারটা হেরম্যানকে বলল সুদীপ্ত। ঠিক এই সময় হুঁশ ফিরল আকিরার। একরাশ নোনা জল বমি করে আকিরা উঠে বসলেন। তিনি একটু ধাতস্থ হবার পর সুদীপ্ত বলল, ‘আপনি জলে পড়লেন কীভাবে?’
আকিরা জবাব দিলেন, ‘বোটের রেলিং ধরে ঝুঁকে আমি আপনাদের ভেসে ওঠার অপেক্ষা করছিলাম। হঠাৎ মাথায় প্রচণ্ড আঘাত পেয়ে ছিটকে জলে পড়লাম। সম্ভবত মরগ্যান কিছু দিয়ে আঘাত করেছিল মাথায়।’
সুদীপ্ত এরপর সব ঘটনা ব্যক্ত করল আকিরাকে। তিনি শুনে বললেন, ‘মরগ্যান হঠাৎ আমাদের মারার চেষ্টা করল কেন বোধগম্য হচ্ছে না!’
হেরম্যান বললেন, ‘আপাতত আমাদের এই ডুবো পাহাড়ের মাথাতেই থাকতে হবে। যদি কোনো মুক্তো সংগ্রহকারী জাহাজ আমাদের উদ্ধার করে তো ভালো, নইলে ভাঙা বোটের ভাসতে থাকা কাঠগুলো দিয়ে একটা ভেলা বানিয়ে ভেসে পড়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এ দুটোই বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তবে ডুবো পাহাড়বেষ্টিত বলে কাঠগুলো বেশি দূর ভেসে যাবে না। আকিরা বললেন, ‘ভেলা তৈরি হলে আমি আপনাদের পাড়ে নিয়ে যেতে পারব আশা করি। ভেলা তৈরির কাজ একটু বিশ্রাম নিয়ে শুরু করব। জ্বলে নামার কাছিগুলো হয়তো খুঁজলে জলে পাওয়া যাবে।’
হেরম্যানের হঠাৎ নজরে পড়ল একটা জিনিসের ওপর। বিস্ফোরণে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া জাহাজের মাস্তলটা ভাসতে ভাসতে তাদের ডুবো পাহাড়টার কাছে এসে পড়েছে। হেরম্যান বললেন, ‘মাস্তুলটা টেনে তুলে ওর মাথায় আকিরার গায়ের লাল জামাটা বেঁধে নিশান বানিয়ে এই পাহাড়ের মাথার খাঁজে বসিয়ে দেই। যদি দূর থেকে সেটা অন্য কোনো বোটের নজরে পড়ে তারা আমাদের উদ্ধার করতে আসে। জামাটা দিতে আকিরা আপনার কোনো আপত্তি নেই তো?’
আকিরা সঙ্গে সঙ্গে জামা খুলে ফেললেন। তারপর তিনজন মিলে জলে নেমে মাস্তুল দণ্ডটাকে ওপরে টেনে তোলা হল। আকিরার জামা বাঁধা হল মাস্তুলের মাথায়। সমুদ্রর ওপর জেগে থাকা ডুবো পাহাড়টার পরিধি আনুমানিক একশো ফুট হবে। উচ্চতা কুড়ি ফুট মতো। মাস্তুলটা নিয়ে একেবারে মাথায় উঠে এল সকলে। মাথাটায় একটু সমতল মতো জায়গা। উল্টোদিকের ঢাল ঘেঁষে একটা ছিদ্র মতো জায়গা নজরে এল সুদীপ্তদের। তার গায়ে একটা বেশ বড়ো গোলাকার পাথরও আছে। হেরম্যান বললেন, ‘চলো ওই ফোকরে মাস্তুলের গোড়াটা ঢুকিয়ে পাথরটার গায়ে মাস্তুলটা হেলান দিয়ে দাঁড় করাই।’
পরিকল্পনা মতো পাথরটার কাছে গিয়ে তিনজন মিলে মাস্তুলটা বসানো হল সেই গর্ভে। সেটাকে ভালো করে গর্তে গাঁথার জন্য চাপ দিতেই এরপর একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। মাস্তুলটা হঠাৎই যেন অনেক গভীরে ঢুকে গেল, আর তার চাড় খেতে গর্তর গায়ের বিরাট পাথরটা ঢাল বেয়ে গড়িয়ে সমুদ্রের জলে ছিটকে পড়ল। সেই পাথরের আড়াল থেকে উন্মোচিত হল এক বিরাট গহ্বর। সুদীপ্তরা যেটাকে ছিদ্র মতো ভেবেছিল সেটা গহ্বরেরই অংশ। পাথর চাপা দেওয়া ছিল তার মুখে। মাথার ওপর থেকে সূর্যের আলো ঢুকছে গুহার মুখে। সেই আলোতে সুদীপ্তরা স্পষ্ট দেখতে পেল গুহার মুখ থেকে মানুষের হাতে তৈরি খাঁজকটা সিঁড়ির ধাপ নেমে গেছে নীচের দিকে। কী আছে এই গুহার ভিতর? প্রাচীন কোনো জলদস্যুর লুকিয়ে রাখা গুপ্তধন? নীচে নামার পথে দেওয়ালের খাঁজে একজোড়া ডুবুরির ফ্লিপারও ওপর থেকে দেখতে পেল তারা। অর্থাৎ এ পথে মানুষের যাওয়া-আসা আছে!
একটু ভেবে নিয়ে হেরম্যান বললেন, ‘চলো, দেখা যাক নীচে কী আছে।’
প্রথমে হেরম্যান, তারপর সুদীপ্ত, সবশেষে আকিরা। ধীরে ধীরে সবাই সে গুহায় প্রবেশ করে নীচে নামতে শুরু করল। অন্ধকার দূর করার জন্য মাথায় আটকানো ওয়াটার ল্যাম্প জ্বালিয়ে নিল সুদীপ্ত আর হেরম্যান। ডুবুরির পোশাক। সিলিভার খোলার সুযোগ তাদের হয়নি। শুধু ডুবো পাহাড়ে উঠে পায়ের ফ্লিপার খুলেছিল তারা। বেশ অনেকটা নীচে নামার পর হেরম্যান বললেন, ‘আমরা প্রায় সমুদ্রতলে পৌঁছে গেছি।’
আর এই কিছুক্ষণের মধ্যেই বিরাট বড় একটা হলঘরের মতো জায়গাতে তারা প্রবেশ করল। তাদের পায়ের নীচে ভেজা পাথর, দেওয়ালের গায়ে পুরু লবণের প্রলেপ। বোঝাই যাচ্ছে এ জায়গাতে জল ঢোকে। এ জায়গা সমুদ্রের তলদেশে ডুবো পাহাড়ের প্রাকৃতিক গুহা। পায়ের দিকের পাথুরে মাটি একদিকে বেশ ঢালু। সুদীপ্তরা দেখতে পেল, নানা অদ্ভুত যন্ত্রপাতি রাখা আছে গুহার মধ্যে। আর ঢালু দিকের অংশে রাখা আছে পনেরো ফুট মতো লম্বা একটা ছোট্ট সাবমেরিন।
হঠাৎ একটা অস্পষ্ট শব্দ শোনা গেল কাছ থেকে। সুদীপ্ত সে দিকে মাথাটা ঘোরাতেই তার মাথায় বাঁধা টর্চের আলোতে সে দেখতে পেল একটা মানুষ জলকাদা মাখা অবস্থায় মাটিতে পড়ে আছে। কোমর থেকে ছুরিটা খুলে সে ছুটে গেল লোকটার কাছে। আরে এ যে রাইখ! দড়িবাঁধা অবস্থায় মেঝেতে পড়ে আছে! হেরম্যান আর আকিরাও এসে দাঁড়ালেন সে জায়গাতে। সুদীপ্ত দড়ির বাঁধন কেটে দিতেই রাইখ উঠে বসল। সুদীপ্তদের দেখে সে বলল, ‘ও তোমরা! আমি ভাবলাম তারা আবার ফিরে এসেছে আমাকে শিকল বেঁধে ওই কঙ্কালটার মতো ওই গুহামুখে বসাবার জন্য।’
সুদীপ্ত প্রশ্ন করল, ‘তারা কারা?’
রাইখ জবাব দিল, ‘মরগ্যান আর তার এক মুখোশধারী সঙ্গী।’
হেরম্যান বললেন, ‘তোমাকে ডেকের রেলিং থেকে সেই দানব অক্টোপাস টেনে নিয়ে গেল দেখেছি। তার কবল থেকে তুমি মুক্ত হলে কীভাবে?’ রাইখ একটু অদ্ভুতভাবে হেসে বলল, ‘সেই অক্টোপাসটাই তো আমাকে এখানে টেনে আনল ডুবো পাহাড়ের সেই গুহার মধ্যে দিয়ে এ জায়গাতে। এটাই তো সেই দানব অক্টোপাসের বাসা।’ এই বলে সুদীপ্তর হাত ধরে উঠে দাঁড়াল রাইখ।
হেরম্যান বললেন, ‘এটা অক্টোপাসের বাসা?’
রাইখ বলল, ‘হ্যাঁ। চলুন, সে এই গুহাতেই আছে। তবে তাকে দেখার পর আপনি কী বলবেন জানি না।’—এই বলে রাইখ এগোল গুহাটার অন্যপ্রান্তে। তার পিছন পিছন কিছুটা এগোবার পর টর্চের আলোতে তারা যা দেখতে পেল তাতে থমকে গেল সবাই। মেঝের এক জায়গাতে একটা বিরাট জলকুণ্ডের মতো জায়গাতে পড়ে আছে একটা অক্টোপাস। দেহটা তার কুণ্ডের ভিতর। শুঁড়গুলো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে বাইরে। এক একটা শুঁড়ের দৈর্ঘ্য অন্তত কুড়ি ফুট হবে। কুৎসিত-কদাকার এক প্রাণী! হেরম্যান তার দিকে হারপুন গানটা তাগ করে বললেন, ‘ও কি মরে গেছে?’
রাইখ বলল, ‘ও জীবিত বা মৃত কোনোটাই নয়।’ রাইখ এগিয়ে গিয়ে মাটিতে পড়ে থাকা একটা শুঁড় তুলে ধরে বলল, ‘এটা ধরে দেখুন।’
সুদীপ্ত আর হেরম্যান গিয়ে শুঁড়টাতে হাত দিয়েই বিস্মিত হয়ে গেল। আকিরাও হাত দিলেন তাতে।
রাইখ হেরম্যানের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনাকে আশাহত করলাম বলে দুঃখিত। আসলে আপনার ওই দানব অক্টোপাস কৃত্রিম। পাম্পের সাহায্যে এর মধ্যে বাতাস ভরে একে জলতলের ওপরে তোলা হয়। তারপর যন্ত্রের সাহায্যে একে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। বাতাস বার করে আবার নীচে নামানো হয়।’
রাইখের কথা শুনে আকিরা বলে উঠলেন, ‘এই রোবট অক্টোপাস আমি আগে জাপানের “সি-পার্কে” দেখেছি। এক দুটো বাহু মাত্র কাজ করে। যার সাহায্যে রাইখকে এখানে ধরে আনা হয়েছে। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন জাপানিরা রোবট টেকনোলজিতে পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ?’ রাইখ বলল, ‘ঠিক তাই। ওর দুটো বাহু আমাকে এখানে ধরে আনল। তারপর মরগ্যান আর সেই মুখোশধারী আমাকে বাঁধল।’ সুদীপ্ত দেখতে পেল গুহার অভ্যন্তরে অস্পষ্ট আলোতেও একটা আশাহত ভাব ফুটে উঠল হেরম্যানের মুখে। যার খোঁজে এত দূর আসা সে শেষে একটা রোবট!
ব্যাপারটা দেখে সুদীপ্তরও কম কষ্ট হল না। সে রাইখকে বলল, ‘তুমি কি ব্যাপারটা জানতে? মাঝরাতে তুমিই বা জলে নেমে এই গুহাতে ঢুকেছিলে কেন? জলের নীচে ক্যামেরা পাতা হয়েছিল। আমরা সব দেখেছি।’
রাইখ জবাব দিল, ‘গুহার ভিতর কিছু আছে তো কঙ্কালটা দেখে আমি অনুমান করেছিলাম। মরগ্যানকে জলে নামতে দেখে তার পিছু পিছু আমি নীচে নেমে গুহায় ঢুকলাম। ভিতরে ঢুকে অবশ্য তাকে দেখতে পাইনি। এই গুহাটা দেখে আমি যখন বোটে উঠতে যাচ্ছি তখনই অক্টোপাসের জালে পড়লম। সে আমাকে এখানে আনার পর অবশ্য মরগ্যান আর সেই মুখোশধারীর সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হল। আমাকে এখানে বেঁধে তোমরা যে পথ বেয়ে নীচে নামলে সে পথ দিয়ে মরগ্যান ওপরে উঠে গেল, আর এখানে আর একটা ছোট সাবমেরিন ছিল। সেটা ঠেলে নিয়ে গুহার বাইরে সম্ভবত সমুদ্রে ভেসে গেল মুখোশধারী। এর চেয়ে বেশি যা বলার তা পরে বলব তোমাদের।’
সুদীপ্ত বলল, ‘তোমাকে রোবট অক্টোপাসটা ধরার কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা ধপ্ করে শব্দ হয়েছিল বোটে। এখন বুঝতে পারছি ব্যাপারটা। এই ডুবো পাহাড়ের গায়েই লাগানো ছিল আমাদের বোট। মরগ্যান এই গহ্বর থেকে ওপরে উঠে সম্ভবত পাহাড় থেকে লাফ দিয়ে বোটে নেমে নিজের কেবিনে ঢুকেছিলেন। ওটা তারই শব্দ!
হেরম্যান বেশ বিমর্ষ স্বরে বললেন, ‘কিন্তু এখন কী করণীয় আমাদের? আমাদের তো এ জায়গা থেকে মুক্তি পেতে হবে। পাহাড়ে ধাক্কা লেগে বোটে বিস্ফোরণ হয়েছে। মরগ্যান মারা গেছে।’
রাইখ প্রথমে হেরম্যানের প্রশ্নের জবাব না দিয়ে এগিয়ে গেল সাবমেরিনের কাছে। সাবমেরিনের খাঁজ থেকে একটা ঢালু খাঁজ নেমে গেছে। ইস্পাতের তৈরি একটা বন্ধ দরজার দিকে। সেটা সম্ভবত একটা ‘লক গেট’। তার ওপাশেই আর একটা টানেল আছে। তার ওপাশে আছে আর একটা লক গেট সেই গুহামুখের কিছুটা ভিতরে। প্রথমে এ গুহার লক গেট খুলে সুড়ঙ্গে প্রবেশ করে এই গেটটা আবার বন্ধ করে দেওয়া হয় যাতে এখানে জল না ঢোকে। তারপর গুহামুখের লক গেট খুলে বাইরে বার হয় লোক, ওই দূর নিয়ন্ত্রিত দানব অক্টোপাস বা সাবমেরিন। রাইখ জানাল এসব কথা।
এরপর রাইখ হেরম্যানের মাথার আলোটা নিয়ে সাবমেরিনের গেটটা খুলে ভিতরে ঢুকে কিছুক্ষণ কী সব পরীক্ষা করল। যান্ত্রিক শব্দও শোনা গেল জলযানটার ভিতর থেকে। সাবমেরিন থেকে নেমে এসে রাইখ বলল, ‘এগুলো হল “স্পাই সাবমেরিন”। সমুদ্রের নীচে ছোট খাঁড়িতেও ঢুকতে পারে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জার্মান নৌসেনারা ব্যবহার করত। এই সাবমেরিন আমি চালাতে পারি।’
এরপর সে হেরম্যানের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘এটা নিয়ে আমি বেরোব। মাত্র দুজন লোক বসতে পারে এই জলযানে। আমি বেরোবার পর এই লক গেট বন্ধ করে আপনারা ডুবো পাহাড়ের মাথায় অপেক্ষা করবেন। পাড় থেকে বোট নিয়ে এসে আমি উদ্ধার করে নিয়ে যাব। আশা করি সন্ধ্যার মধ্যেই সব মিটে যাবে। আমার সঙ্গে একজন সঙ্গী হতে পারেন। কে যাবেন বলুন?’
সুদীপ্ত হেরম্যানকে বলল, ‘আপনি অনুমতি দিলে আমি যেতে পারি ওর সঙ্গে।’ হেরম্যান বললেন, ‘যাও। আমরা অপেক্ষা করছি তোমাদের জন্য।’ রাইখ সুদীপ্তকে বলল, ‘ডুবুরির পোশাকগুলো সঙ্গেই নাও। আর হেরম্যান, আপনি আপনার সিলিন্ডার আর মাস্কটা আমাকে দিন।’
মিনিট খানেকের মধ্যেই যাত্রা শুরু করার প্রস্তুতি নিয়ে ফেলল রাইখ আর সুদীপ্ত। হাতল ঘুরিয়ে লক গেট ওপরে টেনে তোলা হল। সুড়ঙ্গটা ঢালু হয়ে নেমেছে ওপাশে, তার মাথায় আর একটা লক গেট। সুদীপ্তকে নিয়ে সাবমেরিনে উঠে বসার আগে রাইখ হেরম্যানকে বলল, ‘আমরা এই গেটটা দিয়ে বেরোবার সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু গেটটা বন্ধ করে দেবেন, নইলে দ্বিতীয় গেটটা খোলার সঙ্গে সঙ্গেই সমুদ্রের জল গ্রাস করে নেবে এ জায়গা। আপনারা বাঁচবেন না।’ আকিরা আর হেরম্যান বললেন, ‘আচ্ছা’।
ডুবো জাহাজের ঢাকনা বন্ধ করে ইঞ্জিন চালু করতেই ঢাল বেয়ে সেটা সুড়ঙ্গে নেমে এগিয়ে গেল দ্বিতীয় লক গেটের দিকে। হেরম্যান আর আকিরা সঙ্গে সঙ্গে সুদীপ্তদের পিছনের গেটটা বন্ধ করে দিলেন। সঙ্গে সঙ্গেই কিন্তু সুদীপ্তদের সামনের লক গেটটা খুলে গেল। তারা বুঝতে পারল আসলে পিছনের গেটটা বন্ধ করলেই সামনেরটা আপনা থেকেই খুলে যায়। সেটা খুলতেই প্রচণ্ড বেগে জল গ্রাস করে নিল সুড়ঙ্গ। ঢালু পথ বেয়ে সুদীপ্তদের দেখা সেই গুহামুখ দিয়ে বাইরে সমুদ্রতলে বেরিয়ে এল সাবমেরিন।