অক্টোপাসের লাল মুক্তো – ৬

সারা দুপুর নিজেদের কেবিনেই কাটিয়ে দিল সুদীপ্ত আর হেরম্যান। মাঝে মাঝে অবশ্য মনিটরটা খুলছিলেন হেরম্যান। সেই গুহামুখের একই ছবি বারবার ধরা দিচ্ছে। অন্ধকার পাতালপুরীর গুহামুখ। বৈচিত্র্য কিছু নেই। একবার শুধু দেখা গেল একটা ছোট হাঙর কোথা থেকে যেন এসে একবার সেই গুহামুখে ঢুকেই আবার বাইরে বেরিয়ে অন্য দিকে চলে গেল। এছাড়া নতুন কিছু চোখে পড়ল না সুদীপ্তদের।

বিকালবেলা আলো একটু নরম হতেই ডেকে এসে দাঁড়াল তারা দুজন। সকালবেলা থেকেই কেমন যেন থমথমে হয়ে আছে জাহাজের পরিবেশ। আকিরা একবার তাঁর কেবিন ছেড়ে সুদীপ্তদের পাশে এসে দাঁড়ালেন। কিছুক্ষণ জলের দিকে তাকিয়ে থাকার পর তিনি বললেন, ‘কেন জানি আমার এ পরিবেশ ভালো লাগছে না। ভূতের ভয় নয়। আমার মনে হচ্ছে অশুভ কিছু যেন ঘটতে চলেছে। হয়তো আমাদের ফিরে যাওয়াই ভালো। ব্যাপারটা আপনারা ভাববেন।’ হেরম্যান আনমনাভাবে দূরে সূর্যাস্তের দিকে চেয়ে বললেন, ‘আর একটা দিন দেখি। তারপর ভাব ফিরব কিনা।’ আকিরা আর কোনো কথা না বলে নিজের কেবিনে চলে গেলেন।

এর ঠিক পরপরই একটু হন্তদন্ত হয়ে কেবিন ছেড়ে সুদীপ্তদের কাছে উপস্থিত হল রাইখ। সে সুদীপ্তকে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, কাল আমার কেবিনে তোমাকে আর মরগ্যানকে আমি যে ফোটোগ্রাফটা দেখালাম, সেটা তোমরা দেখার পর আমাকে তুমি ফেরত দিয়েছিলে তো?’

সুদীপ্ত দিল, ‘হ্যাঁ। তুমি সেটা তোমার ব্যাগে রাখলে। কেন কী হয়েছে?’ রাইখ জবাব দিল, ‘ওটা খুঁজে পাচ্ছি না।’—এই বলে সে আবার দ্রুত ফিরে গেল তার কেবিনে।

সে চলে যাবার পর ফোটোগ্রাফের ব্যাপারটা সুদীপ্ত হেরম্যানকে বলল। হেরম্যান বললেন, ‘রাইখের আচরণ সত্যিই একটু অদ্ভুত। ওই কি ছুরি মারল ডুবুরিটাকে? কিন্তু তার কী কারণ?’

সূর্য ডুবে গেল একসময়। তারপর চাঁদও উঠল। এ দিনের চাঁদটা কেমন যেন ফ্যাকাশে ম্রিয়মাণ। অস্পষ্ট চাঁদের আলোতে আশেপাশে জেগে থাকা ডুবো পাহাড়গুলোকে কেমন যেন ভূতুড়ে মনে হচ্ছে। যেন এরা সব এক একটা জলদানব। জল থেকে মাথা তুলে দেখছে সুদীপ্তদের। ডেক ছেড়ে এক সময় নিজেদের কেবিনে ফিরে এল তারা। হেরম্যান বললেন, ‘আজকের রাতটা সতর্ক থাকতে হবে।’

আকিরা এসে রাতের খাবার দিয়ে গেলেন। থমথমে মুখ। কিছু বললেন না তিনি। খাওয়া সেরে কাচের জানলার সামনে রাত পাহারায় বসল তারা দুজন।

তখন শেষ রাত হবে। ডেকের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে একটু তন্দ্রা এসে গেছিল সুদীপ্তর। হেরম্যানের মৃদু ধাক্কায় হুঁশ ফিরল তার। হেরম্যান চাপা স্বরে বললেন, ‘ওই দ্যাখো!’

তাকাল সুদীপ্ত। আলো-আঁধারি খেলা করছে ডেকে। আকাশে মনে হয় মেঘ জমেছে। সুদীপ্ত দেখল একটা লোক সন্তর্পণে এগোচ্ছে রেলিং-এর দিকে! তার পরনে ডুবুরির পোশাক। পিঠে অক্সিজেন সিলিন্ডার। মুখে মাস্ক থাকায় তাকে অবশ্য চেনা যাচ্ছে না। কে লোকটা? সে রেলিং-এর ধারে এসে দাঁড়াল। তারপর রেলিং টপকে জলে নেমে গেল। হেরম্যান বললেন, ‘সিলিন্ডার নিয়ে যখন নামল তখন বেশি সময়ের জন্যই নামল ৷ মনিটরটা চালু করি। দেখি লোকটাকে ক্যামেরায় ধরা যায় কিনা।’

সুদীপ্ত টেবিল থেকে মনিটরটা নিতে যাচ্ছিল ঠিক সেই সময় তাদের অবাক করে দিয়ে আরও একজন হাজির হল ডেকে। তার পরনেও ডুবুরির পোশাক। মুখে মাস্ক। পিঠে সিলিন্ডার। লোকটা ডেকে এসে চারপাশে একবার ভালো করে দেখল। তারপর রেলিং-এর কাছে গিয়ে প্রথমজনের মতোই রেলিং টপকে সমুদ্রে নেমে গেল! উত্তেজিত হেরম্যান নিজেই টেবিলের কাছে গিয়ে মনিটরটা নিয়ে সেটা চালু করে দিলেন। পর্দায় ভেসে উঠল সমুদ্রতলের সেই গুহামুখের প্রতিচ্ছবি।

কিছুক্ষণের মধ্যেই এক ডুবুরি ধরা দিল ক্যামেরাতে। গুহার সামনে এসে দাঁড়াল সে। তারপর একটা টর্চ জ্বালিয়ে আলো ফেলল গুহার ভিতর। সুদীপ্তরা অবশ্য দেখতে পেল না গুহার ভিতরটা। ভাসতে ভাসতে ডুবুরি ঢুকে পড়ল গুহার ভিতরে। অদৃশ্য হয়ে গেল সে! এর কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে হাজির হল দ্বিতীয় ডুবুরি। সে যেন বেশ কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়াল গুহার সামনে। তারপর গুহায় ঢুকে পড়ল। উত্তেজিত সুদীপ্তরা চেয়ে রইল মনিটরের দিকে। মিনিটের পর মিনিট কেটে যেতে লাগল…

মিনিট পনেরো পর একজন ডুবুরি বেরিয়ে এল গুহা থেকে। সাঁতরে ক্যামেরার বাইরে

চলে গেল সে। হেরম্যান বললেন, ‘বাইরে নজর রাখো। নিশ্চয়ই সে এবার বোটে এসে উঠবে। আর একজন দেখি গুহা ছেড়ে কখন বেরোয়? তবে ও গুহায় অক্টোপাস নেই বলেই মনে হয়। থাকলে ওরা ভিতরে ঢুকত না।’ শেষ কথাটা বেশ বিমর্ষভাবে হেরম্যান বললেন ঠিকই, কিন্তু এরপরই মনিটর স্ক্রিনে যা ফুটে উঠল তা দেখে চমকে উঠলেন হেরম্যান আর সুদীপ্ত। হেরম্যানের আশঙ্কাকে মিথ্যা প্রমাণিত করে সেই গুহার ভিতর থেকে বাইরে আবির্ভূত হল সত্যিই এক দানবাকৃতি অক্টোপাস! তার বাহু বা শুঁড়গুলো প্রায় তিরিশ ফুট লম্বা হবে! মাথাটা সত্যি একটা ছোটখাটো হাতির মতন! ভয়ংকর কুৎসিত এক প্রাণী! ঠিক যেমন অক্টোপাসের ছবি আঁকত প্রাচীন নাবিকরা। সুদীপ্তদের বোট বা ছোটখাটো জাহাজকে সে শুঁড়ে পেঁচিয়ে অনায়াসে ডুবিয়ে দিতে পারে। এর সঙ্গে সাক্ষাতের জন্যই তো এতদূর ছুটে এসেছে হেরম্যান আর সুদীপ্ত। প্রাণীটা গুহা ছেড়ে বেরোতেই একটা ঘূর্ণি শুরু হল জলতলে। সব কিছু কেমন যেন অস্পষ্ট হয়ে গেল! সে অস্পষ্টতা যখন কাটল তখন প্রাণীটা আর সেখানে নেই। হেরম্যান বললেন, ‘প্রাণীটা কি পিছু ধাওয়া করল লোকটার?’ তাঁর কথা শেষ হবার কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই মৃদু কেঁপে উঠল বোটটা। সুদীপ্তরা তাকাল ভেকের দিকে। যেখান থেকে নোঙর নামানো হয়েছে সেখান থেকে নোঙর বেয়ে ওপরে উঠে আসছে একজন। সম্ভবত সেজন্যই মৃদু কেঁপে উঠল বোটটা। লোকটা সবে ডেকের রেলিং টপকে ভিতরে নামতে যাচ্ছে, ঠিক সেই সময় বোটের গায়ের জলোচ্ছ্বাসের মধ্যে থেকে উঠে এল দুটো বিশাল শুঁড়। মুহূর্তর মধ্যে তারা ডুবুরিকে পেঁচিয়ে ধরে রেলিং থেকে টেনে নামিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেল সমুদ্রের মধ্যে। সুদীপ্তরা ঘটনার আকস্মিকতায় এতটাই বিহ্বল হয়ে গেল যে কিছু সময় কী করবে তা বুঝে উঠতে পারল না। মনিটরের পর্দার্টার দিকে তাকিয়ে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। সেটা কালো হয়ে গেছে। সম্ভবত অক্টোপাসের শুঁড়ের দাপাদাপিতে কোনো কিছু চাপা পড়েছে ক্যামেরার ওপর।

কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় আরও কিছু সময় কেটে গেল। হঠাৎ আবারও মৃদু দুলে উঠল বোট। কোথায় যেন একটা ধপ করে শব্দ হল! সম্বিত ফিরে পেয়ে হেরম্যান বললেন, ‘চলো, বাইরে চলো। সবাইকে ডাকি। দেখি কাকে নিয়ে গেল অক্টোপাস?’ দরজা খুলে ডেকের দিকে ছুটে রাইখ, আকিরা আর মরগ্যানের নাম ধরে ডাকতে শুরু করল সুদীপ্ত আর হেরম্যান। আকিরা প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই বেরিয়ে এসে বললেন, ‘কী হয়েছে? বোটের দুলুনিটা আমিও টের পেয়েছি। তাতেই আমার ঘুম ভাঙল। তারপর শুনলাম আপনাদের চিৎকার!’

হেরম্যান তাঁর কথার জবাব না দিয়ে প্রথমে ছুটলেন রাইখের কেবিনের দিকে। কেবিনের দরজা ধাক্কা দিতেই খুলে গেল। কিন্তু কেবিনের ভিতর কেউ নেই। হেরম্যান তারপর ছুটলেন ডেকের উল্টোপ্রান্তে মরগ্যানের কেবিনের দিকে। বেশ কয়েকবার তাঁর নাম ধরে ডাকার পর দরজা খুললেন তিনি। ঘুমচোখে ঈষৎ জড়ানো গলায় তিনি জানতে চাইলেন, ‘কী হয়েছে??

হেরম্যান জবাব দিলেন, ‘বোট থেকে একজন জলে নেমেছিল। কেবিন থেকে আমরা দেখতে পেলাম সে জল থেকে ডেকে ওঠার সময় একজোড়া অক্টোপাসের শুঁড় তাকে জলে টেনে নিল!’ তাঁরা যে দুজন লোককে পরপর জলে নামতে দেখেছিলেন বা মনিটরে দেখা দৃশ্যর কথা অবশ্য বললেন না হেরম্যান। মরগ্যান বিস্মিতভাবে বললেন, ‘ও কাকে টেনে নিল?’

সুদীপ্ত জবাব দিল, ‘সম্ভবত রাইখকে। কারণ সে কেবিনে নেই!’

আকিরার মুখ যেন ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। তিনি শুধু বললেন, ‘উনি রাতে কেন জলে নামলেন?’

মরগ্যান বললেন, ‘ও লোকটা বরাবরই সন্দেহজনক বলে মনে হয়েছে আমার। চলুন জলে আলো ফেলে দেখি।’ বেশ কয়েকটা জোরালো টর্চ নিয়ে সবাই মিলে যাওয়া হল ভেকের সেই জায়গাটাতে রেলিং-এর ধারে। আলো ফোলা হল জলে। নিস্তরঙ্গ কালো জল। কোথাও কিছুর চিহ্নমাত্র নেই। বোটের চারপাশের সমুদ্রে বেশ কিছুক্ষণ আলো ফেলে রাইখকে খোঁজার পর আকিরা বললেন, ‘আলো না ফুটলে কিছু হবে না। এভাবে ভেকের ধারে দাঁড়ানো নিরাপদ নয়। আবার সেই দানবের শুঁড় যে-কোনো মুহূর্তে উঠে এসে আমাদের কাউকে টেনে নিয়ে যেতে পারে! আমরা বরং কেবিনে ফিরে আলো ফোটার অপেক্ষা করি।’ আকিরার গলায় এবার স্পষ্টই ভয়ের আভাস ধরা দিল। ধীর পায়ে নিজেদের কেবিনে ফিরে গেল সবাই। কেবিনে ফিরে হেরম্যান বললেন, ‘জলের তলায় যত বিপদই আমাদের জন্য অপেক্ষা করে থাকুক কাল আমি জলে নামবই। দেখি যদি রাইখের খোঁজ মেলে? তাছাড়া দ্বিতীয় লোকটা কে ছিল? সে কি গুহার মধ্যেই আছে? একটা কথা আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না যে, ওই গুহাটা দানব অক্টোপাসের বাসস্থান হতে পারে বুঝেও রাইখ কেন ভিতরে ঢুকেছিল? তুমি আমার সঙ্গে জলে নেমে ক্যামেরাটা তুলে এনো। ওতেই তো ছবি তোলা হয়েছে দানব প্রাণীটার। সভ্য পৃথিবীর পণ্ডিত বিজ্ঞানীরা কিন্তু নানাভাবে ব্যাপারটাকে মিথ্যা প্রমাণ করতে চাইবে। ক্যামেরাটাও পরীক্ষা করবে। আমার কিছু হলে তুমি রয়ে যাবে ব্যাপারটা প্রমাণ করার জন্য।

, তাঁর কথা শুনে বিস্মিত সুদীপ্ত প্রথমে বলে উঠল, ‘আপনি অক্টোপাসের গুহায় হানা দেবেন?’ তারপর বলল, ‘তবে আমিও আপনার সঙ্গী হব।’

বাকি রাতটা তারা জেগেই কাটিয়ে দিল। এক সময় ভোরের আলো ফুটল।

আকাশ সম্পূর্ণ পরিষ্কার হতেই সুদীপ্ত-হেরম্যানসহ ডেকে বেরিয়ে এল সকলে। ভালো করে একবার বোটের চারপাশ খুঁজে দেখা হল। রাইখ যদি ভেসে ওঠে। কিন্তু তার চিহ্ন মিলল না কোথাও। হেরম্যান আকিরাকে বললেন, ‘আমরা কিন্তু একবার জ্বলে নামব। দেখি রাইখের কোনো সন্ধান মেলে কিনা।’

আকিরা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘না, জলে নামার দরকার নেই। যে গেছে সে গেছে। তার আর ফেরার সম্ভাবনা নেই। আপনারা নামলে হয়তো আপনারাও ফিরবেন না।’

মরগ্যান বললেন, ‘আমি আর এখানে থাকব না। বোট ছেড়ে দেব।’

হেরম্যান বললেন, ‘রাইখের সঙ্গে অক্সিজেন সিলিভার ছিল। হয়তো সে অক্টোপাসের কবল থেকে মুক্তি পেয়ে আহত হয়ে পড়ে আছে।’ মরগ্যান কথাটা শুনে কী যেন ভেবে নিয়ে বললেন, ‘তবে তাড়াতাড়ি নামুন। আপনি ফিরলেই আমি রওনা দেব।’