অক্টোপাসের লাল মুক্তো – ৫

পরদিন ভোরে ডেকে প্রচণ্ড চিৎকার-চেঁচামেচির শব্দে ঘুম ভাঙল সুদীপ্তর। কিছু একটা নিশ্চয়ই হয়েছে! সেই দানব অক্টোপাস দেখা দিয়েছে নাকি? হেরম্যান বললেন, ‘তাড়াতাড়ি বাইরে চলো!’

সুদীপ্তরা ডেকের যে পাশে আছে তার উল্টোদিকে পরপর ক’টা কেবিন আছে। তার একটা যেটা রাইখের জন্য বরাদ্দ তার দরজার সামনে জড়ো হয়েছে বোটের প্রায় সকলেই। রাইখও আছে তাদের মধ্যে। সবার চোখে-মুখেই উত্তেজনার ভাব। সুদীপ্তরা সেখানে যেতেই আকিরা ইশারায় ঘরের ভিতরটা দেখালেন। খাটের ওপর সাদা চাদর চুড়ি দিয়ে উপুড় হয়ে পড়ে আছে একজন। আর তার পিঠটা রক্তে ভেসে যাচ্ছে। রক্তের উৎসমুখে ছিন্ন চাদর ভেদ করে ক্ষতচিহ্নও দেখা যাচ্ছে। সম্ভবত ছুরিকাঘাত। আকিরা বললেন, ‘ওর নাম সামুরা। মিনিটখানেক আগে বোটেরই একজন ধীবর ওকে ডাকতে এসে এই দৃশ্য দেখতে পেয়েছে।’ মরগ্যান বললেন, ‘কিন্তু ও এঘরে এল কী ভাবে? মিস্টার রাইখ, এটা তো আপনার ঘর?’

রাইখ একটু আমতা আমতা করে বলল, ‘আসলে, আমার ঘরের জানলাটা খুলছিল না। বড্ড গুমোট লাগছিল। তাই রাতে শোবার আগে পাশের ঘর থেকে ওকে ডেকে তুলে আমার শোবার জায়গা বদল করি।’

মরগ্যান তাকে আরও কিছু প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তার আগেই বিছানাতে মৃতবৎ পড়ে থাকা লোকটা ছটফট করে উঠল, সঙ্গে সঙ্গে ওশো ‘ও বেঁচে আছে! বেঁচে আছে!’ বলে চিৎকার করে কেবিনে ডুকে পড়ল। আর তার সঙ্গে সঙ্গে অন্য সবাইও । জ্ঞান ফিরেছে লোকটার। ওশো তার মাথাটা তুলে ধরে বলল, ‘তোমার এ অবস্থা কে করল?’

ধীবর অস্পষ্টভাবে বলল, ‘কাউকে দেখিনি। হঠাৎ ঘুমের মধ্যে পিঠে অসহ্য যন্ত্রণা শুরু হল। তারপর আর কিছু মনে নেই।’ এই বলে আবার অজ্ঞান হলে গেল লোকটা।

আকিরা বলে উঠলেন, ‘ফার্স্ট-এইড বক্স আনো এখনই। আর ডেক থেকে নৌকা নামাও। ক্ষতটা বেশ গভীর। তবে ওকে বন্দরে নিয়ে যেতে পারলে হয়তো বেঁচে যাবে।’ দুজন ধীবর ছুটল নৌকা নামাতে। আর ওশো ফার্স্ট-এড বক্স এনে লোকটার ক্ষতস্থানে ব্যান্ডেজ বাঁধতে শুরু করল। আকিরাও হাত লাগালেন তাতে। মরগ্যান বললেন, ‘কিন্তু এ ঘটনা কে ঘটাল? আমাদেরই কেউ? নাকি বাইরে থেকে কেউ উঠে এসেছিল বোটে?’ আকিরা বললেন, ‘এই জনমানবহীন সমুদ্রে কে বোটে উঠবে?’

ওশো হঠাৎ বলে উঠল, ‘আমি যেন ঘুমের ঘোরে কাল ডেকের ওই কাঠের সিন্দুকটার সামনে কাউকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি।’ তার কথা শোনামাত্র সুদীপ্ত বলে উঠল, ‘আমিও তো একই দৃশ্য দেখেছি। ভেবেছিলাম আমি ভুল দেখছি।’

হেরম্যান সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ‘কেউ মাঝসমুদ্র থেকে বোটে উঠে না আসুক, বোট ডাঙা ছাড়ার আগেই এ বোটে লুকিয়ে উঠে বসে নেই তো? চলুন তো ওই সিন্দুকের ওখানটা আগে দেখি। ওর আড়ালে ঘাপটি মেরে থাকতে পারে কেউ। সারা বোটের চারদিকে ভালো করে খুঁজতে হবে।’

তাঁর কথা শুনে সবাই ছুটল ডেকের একপাশে পড়ে থাকা সিন্দুকটার দিকে। না, তার আড়ালে কেউ নেই। এরপর সবাই বোটের খোলসহ লুকিয়ে থাকার মতো অন্য জায়গাগুলো খুঁজতে যাচ্ছিল, কিন্তু নিছকই কৌতূহলবশত কঙ্কালটা একবার দেখার জন্য কালো কাঠের সিন্দুকের ডালাটা একবার তুলল সুদীপ্ত। অন্য কোনো লোক তার মধ্যে নেই ঠিকই কিন্তু সিন্দুকের ভিতর অন্য একটা দৃশ্য অপেক্ষা করছিল সবার জন্য। শোয়ানো কঙ্কালটা সিন্দুকের গায়ে ঠেস দিয়ে একটু ওপরে উঠে এসেছে। তার একটা হাত কোলের কাছে রাখা। সে হাতে ধরা আছে একটা রক্তমাখা তীক্ষ্ণ ছুরি! প্রাচীন কঙ্কালটার গায়েও লেগে আছে এক বিঘত লম্বা সেই ছুরি থেকে চুঁইয়ে পড়া রক্ত! সে দৃশ্য দেখেই এক ধীবর আতঙ্কে চেঁচিয়ে উঠল, ‘ভূত ভূত! এই ভূতই ছুরি মেরেছে সামুরাকে।’ তার চিৎকার শুনে অন্য ডুবুরিরাও ছুটে এল। মুহূর্তের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল সারা ডেকে। বেগতিক দেখে আকিরা এক ধমকে তাদের থামিয়ে একটা রুমাল দিয়ে সেই ছুরিটা তুলে নিলেন কঙ্কালটার হাত থেকে। ছুরিটা ভালো করে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখে বললেন, বেশ দামি ছুরি। হাতলটা মুক্তোখচিত। সাধারণত পয়সাঅলা মুক্তো ব্যবসায়ীরা এ ছুরি রাখে। মরগ্যান, আপনি আপাতত ছুরিটা আপনার জিম্মায় রাখুন।’

মরগ্যান ছুরিটা হাতে নিলেন। ঠিক এই সময় একজন ডুবুরি বলল, ‘আমরা আর এ বোটে থাকব না। সামুরাকে নিয়ে চলে যাব।’

মরগ্যানও বললেন, ‘আমারও এ জায়গায় থাকা সমীচীন মনে হচ্ছে না। অভিশপ্ত এ জায়গা। আমি বোট নিয়ে ফিরব।

তাঁর কথা শুনে প্রাথমিকভাবে সবাই নিশ্চুপ হয়ে গেলেও রাইখ হঠাৎ নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে বলে উঠল, ‘আমরা ভূতের ভয়ে পালিয়ে যাব? না, আমরা ফিরব না। তাছাড়া আমি অনেক অর্থব্যয় করে এখানে এসেছি।’

হেরম্যানও বেশ দৃঢ়ভাবে বললেন, ‘আমারও এই অভিমত। দানব অক্টোপাসের রহস্য উদ্ঘাটন না করে আমিও ফিরতে চাই না। সামুরাকে খুন করার চেষ্টা করে, কঙ্কালের হাতে ছুরি ধরিয়ে কেউ হয়তো ভয় দেখিয়ে আমাদের এখান থেকে তাড়াবার চেষ্টা করছে।’ মরগ্যান বললেন, ‘কিন্তু আমি যদি বোট থেকে নেমে যাই, তখন আপনারা কী করবেন?’

রাইখ বেশ দৃঢ়ভাবে বলল, ‘সে আপনার ইচ্ছা। তবে তাতে তেমন অসুবিধা হবে না। আমার দুই পুরুষ জার্মান নেভিতে কাজ করেছে। আমিও জার্মান নেভিতে ভলেন্টিয়ার হিসাবে ট্রেনিং নিয়েছি। এই বোট থেকে শুরু করে সাবমেরিনও চালাতে পারি আমি।’ সুদীপ্ত বেশ অবাক হয়ে গেল তার কথা শুনে। আর মরগ্যান কেমন যেন ম্রিয়মাণ হয়ে বললেন, ‘ঠিক আছে তাহলে থাকি।’ কিছুক্ষণের মধ্যেই ওশোর নেতৃত্বে আহত ডুবুরিকে নিয়ে বোট থেকে নেমে তীরের দিকে পাড়ি দিল ডুবুরিরা। প্রায় অর্ধেক লোক খালি হয়ে গেল। বোটে রয়ে গেল সুদীপ্তরা পাঁচজন।

বোট ছেড়ে সবাই চলে যাবার কিছুক্ষণ পর হেরম্যান আকিরাকে বললেন, ‘আমি আর সুদীপ্ত একবার জলের নীচে ঘুরে আসতে চাই। আপনার আপত্তি আছে?’

আকিরা একটু ইতস্তত করে বললেন, ‘আপত্তি নেই। তবে সঙ্গে থাকতে পারব না।

দুজনকে তো ওপরে থাকতে হবে আপনাদের ওপরে টেনে তোলার জন্য।’ মরগ্যান ইতিমধ্যে তাঁর কেবিনে ফিরে গেছেন। রাইখ আকিরাকে বলল, ‘ঠিক আছে আমি টেনে তোলার কাজে সাহায্য করব।’

হেরম্যান বললেন, ‘আমি একটু ঘর থেকে আসছি। তারপর জলে নামব।’ মিনিট তিনেকের মধ্যেই ফিরে এলেন হেরম্যান। তাঁর হাতে একটা ছোট বাক্স। রাইখ জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার হাতে কী?’

হেরম্যান হেসে জবাব দিলেন, ‘বাক্স। ক’টা ঝিনুক সংগ্রহ করব। দেখি যদি মুক্তো পাওয়া যায়।

কিছুক্ষণের মধ্যেই তৈরি হয়ে নিল সুদীপ্তরা। শুধু ঝাঁপ দেবার আগে আকিরা সুদীপ্তর হাতে ওশোর হারপুন গানটা ধরিয়ে তার কার্যকারিতা বুঝিয়ে দিলেন। জিনিসটা লম্বা নলঅলা বন্দুকের মতো। মুখে তিরের ফলার মতো হারপুন গোঁজা। ট্রিগার টিপলেই তা ছিটকে বেরিয়ে যায়। অক্সিজেন সিলিন্ডার পরীক্ষা করার পর প্রথমে হেরম্যান তারপর সুদীপ্ত ঝাঁপ দিল জলে।

আবার সেই আশ্চর্য পৃথিবীতে পৌঁছে গেল তারা। পায়ের নীচে ঝিনুকের বিছানা। চারদিকে ডুবো পাহাড়ের তলদেশের গুহা। হেরম্যান এগোলেন সেই বিশাল গুহাটার দিকে। তাঁর পিছনে তাঁকে অনুসরণ করল সুদীপ্ত। গুহাটার কিছুটা সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়লেন হেরম্যান। আগের দিনের মতোই সুদীপ্তদের মাথার ল্যাম্পের আলো প্রবেশ করছে না বিশাল গুহামুখের ভিতর। গুহার ভিতর জমাটবাঁধা অন্ধকার। যে মাছের দল আগের দিন গুহামুখে খেলা করছিল তারা যেন হঠাৎ কোথাও উধাও হয়ে গেছে। জলতলে সেই গুহার সামনে কেমন যেন একটা থমথমে পরিবেশ! হের গুহার কিছুট তফাতে নিচু হয়ে বসে বাক্সটা খুলে কী একটা ছোট্ট জিনিস যেন মাটিতে বসিয়ে ঝিনুক চাপা দিলেন। তারপর সুদীপ্তকে ইশারা করলেন ওপরে ভেসে ওঠার জন্য।

ওপরে ওঠার পর আকিরা আর রাইখ সাগ্রহে একসঙ্গে জানতে চাইলেন, ‘কী দেখলেন?’

হেরম্যান জবাব দিলেন, ‘তেমন নতুন কিছু চোখে পড়ল না।’

ডুবুরির পোশাক ছেড়ে সুদীপ্তরা কেবিনে ফিরে আসার পর সুদীপ্ত হেরম্যানকে জিজ্ঞেস করল, ‘ওটা কী বসিয়ে এলেন?’ হেরম্যান তাঁর ব্যাগ থেকে একটা ছোট্ট মনিটর স্ক্রিন বার করে সেটা চালু করে বললেন, ‘এই দ্যাখো। ওটা একটা ক্যামেরা। জলতলে অন্ধকারেও ওই ক্যামেরা ছবি তুলে এখানে পাঠাতে পারে।’

সত্যি সত্যিই মনিটরের পর্দায় ফুটে উঠেছে জলতলের ছবি। সেই গুহামুখ! সেদিকেই তাগ করা আছে ক্যামেরা। হেরম্যান আবার বললেন, ‘সব ছবি স্টোর হয়ে থাকবে এতে। ওই দানব অক্টোপাস যদি গুহা ছেড়ে বেরিয়ে আসে তবে সে ধরা পড়বে ক্যামেরাতে। হয়তো সে কাছেই আছে। নিশ্চয়ই খেয়াল করেছ যে মাছের ঝাঁকগুলো আর নেই?’ হেরম্যানের কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই দরজায় টোকা পড়ল। মনিটরটা তাড়াতাড়ি লুকিয়ে ফেললেন হেরম্যান। সুদীপ্ত দরজা খুলল। মরগ্যান দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি বললেন, ‘শুধু একটা কথা জানাতে এলাম। কাল রাতে সিন্দুকের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোককে আমিও দেখেছি। চিনতেও পেরেছি। তিনি হলেন রাইখ। তবে প্রমাণ নেই।’—এই বলে মরগ্যান চলে গেলেন। সুদীপ্ত হেরম্যানকে বলল, ‘আমারও যেন একবার মনে হয়েছিল লোকটা রাইখ!’