অক্টোপাসের লাল মুক্তো – ৩

পরদিন সুদীপ্তদের যখন ঘুম ভাঙল তখন খোলা জানলা দিয়ে সমুদ্রতটের প্রথম আলো তাদের ঘরে এসে প্রবেশ করেছে। সবে সূর্যোদয় হয়েছে। প্রভাতী কিরণ এসে ছড়িয়ে পড়েছে উন্মুক্ত তটে। সমুদ্রের ছোট ছোট ঢেউ এসে ভাঙছে পাড়ে। একঝাঁক গাঙচিল সমুদ্রের জল যেখানে পাড় ছুঁচ্ছে সেখানে ঘুরে ঘুরে সমুদ্রের জলে ভেসে আসা শামুক-ঝিনুকের সন্ধান করছে। দূরে ঊর্মিমালার ওপর ভাসছে একটা ছোট নৌকো। হয়তো সে সাগর পাড়ি দিচ্ছে মুক্তোর সন্ধানে। সব মিলিয়ে সমুদ্রতটটা যেন ক্যানভাসে আঁকা ছবির মতো মনে হচ্ছে। ঘুম ভাঙার পর কিছুক্ষণের মধ্যে তৈরি হয়ে হোটেলের বাইরে বেরিয়ে এল তারা দুজন। এর অল্প সময়ের মধ্যেই গাড়ি নিয়ে হাজির হলেন মিস্টার আকিরা। তাঁর সঙ্গে রয়েছে রাইখ। সুদীপ্তরা উঠে বসল গাড়িতে। সমুদ্রকে পাশে রেখে চলতে শুরু করল গাড়ি। হঠাৎ রাইখ তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, ‘ওই দেখুন!’ সমুদ্রতটে কে যেন বানিয়ে রেখেছে একটা বালু-ভাস্কর্য—মারমেড বা মৎস্যকন্যার মূর্তি। হেরম্যান বললেন, ‘এই মৎস্যকন্যাও কিন্তু ক্রিপটিড বা লোকগাথার প্রাণী। যুগ যুগ ধরে বহু গল্পকথা প্রচলিত আছে এদের নিয়ে। বহু নাবিক নাকি এদের দূর থেকে দেখেছেন বলেও দাবি করেন।’

কিছুক্ষণের মধ্যেই গাড়ি এসে থামল সেই ‘শিকোকু সি-পার্কের’ সামনে। জায়গাটা দেখে সুদীপ্ত আকিরাকে বলল, ‘আমরা কাল এসেছিলাম এখানে। পার্কের মালিক মিস্টার শিকোকুর সঙ্গেও পরিচয় হল। উনি আপনার কথাও বললেন।’

গাড়ি থেকে নামতে নামতে আকিরা বললেন, ‘এখন ওঁর কাছেই এসেছি। বোটের ব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত ওঁর মাধ্যমেই হয়েছে। বোটের চালক বা পাইলটও ওঁরই লোক। তবে বোটে বাদবাকি যারা যাচ্ছে তারা আমার নিজস্ব লোক। আর বোটটাও এখানে আছে। সবাইকে এখানে নামতে হবে।’

গাড়ি থেকে সেই অক্টোপাসের মাথাঅলা তোরণের সামনে নামল সবাই। তাদের দেখতে পেয়েই মনে হয় তোরণের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল দুজন লোক। একজন মিস্টার শিকোকু, অন্যজন বেশ শক্তপোক্ত চেহারার একজন মাঝবয়সি অস্ট্রেলিয়ান। তাকে দেখিয়ে আকিরা বললেন, ‘উনি হলেন বোটের পাইলট মরগ্যান।’ তারা দুজন সুদীপ্তদের সামনে এসে দাঁড়াবার পর মিস্টার শিকোকু রাইখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনার সঙ্গে আমার পরিচয়ের সৌভাগ্য হয়নি।’

রাইখ জবাব দিল, ‘আমি কিন্তু আপনার পার্কে এসেছিলাম। স্কুবা ডাইভিং-ও করেছি। আমার নাম ফ্রেডরিখ রাইখ। আমি একজন মুক্তো বিশেষজ্ঞ।’ মিস্টার শিকোকু দু’বার বিড়বিড় করে বললেন, ‘রাইখ, রাইখ!’ তারপর করমর্দনের জন্য তার দিকে হাত বাড়িয়ে বললেন, ‘আপনাদের যাত্রা শুভ হোক।’

মিস্টার শিকোকু তোরণের সামনেই দাঁড়িয়ে রইলেন। পাইলট মরগ্যানকে নিয়ে সবাই এগোল সমুদ্রের দিকে। কিছুটা এগোতেই সুদীপ্তদের চোখে পড়ল বোটটা। বোট মানে ছোটখাট একটা লঞ্চ। তার নাম ‘ব্ল্যাক পার্ল’। হাঁটু-জল ভেঙে সুদীপ্তরা উঠে পড়ল বোটে। তারা ছাড়া চারজন ধীবর আছে বোটে। সব মিলিয়ে লোকসংখ্যা নয়জন। তাদের থাকার জন্য বেশ কয়েকটা ছোট ছোট কেবিনও আছে। ডেকের ওপর রাখা আছে একটা ছোট নৌকো, আর মুক্তো সংগ্রহের নানা সরঞ্জাম। বোটটার বিশেষত্ব হল একটা মাস্তুলে পাল গোটানো আছে। অর্থাৎ ইঞ্জিন বন্ধ হলেও পালের সাহায্যে চলতে পারবে বোট। পাইলট মরগ্যান চালকের আসনে গিয়ে বসলেন। খোলের মধ্যে ইঞ্জিন চালু হল। সুদীপ্তদের নিয়ে সমুদ্রে ভেসে পড়ল ব্ল্যাক পার্ল। ক্রমশ দূরে সরে যেতে লাগল তটরেখা। ডেকে একটা আচ্ছাদনের নীচে চেয়ার পেতে বসল সবাই। হেরম্যান জানতে চাইলেন, ‘পৌঁছতে কত সময় লাগবে?’ আকিরা জবাব দিলেন, ‘এমনিতে এই দূরত্ব অতিক্রম করতে এক ঘণ্টা লাগে। কিন্তু ও জায়গাতে ডুবো পাহাড় আছে বলে সাবধানে খুব শ্লথ গতিতে যেতে হয়। ঘণ্টা তিনেক সময় লাগবে যেতে।’

সুদীপ্ত বলল, ‘কাল আমরা “সি-পার্কে” জলের তলায় যখন নামলাম তখন মনে হচ্ছিল যেন স্বপ্ন দেখছি। অদ্ভুত অভিজ্ঞতা!’

আকিরা বললেন, ‘আপনারা যেখানে নেমেছিলেন সেটা অগভীর জায়গা। গভীর সমুদ্রের তলদেশ আরও সুন্দর। সে সৌন্দর্য দেখার সৌভাগ্য মুক্তো সংগ্রহকারী ডুবুরি ছাড়া অন্যদের সাধারণত হয় না। আপনারা তো নিশ্চয়ই মাস্ক পরে, অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে নীচে নেমেছিলেন। আমার এ বোটে অমন জিনিস কয়েকটা থাকলেও মুক্তো সংগ্রহকারী জাপানি ডুবুরিরা কিন্তু ওসব ব্যবহার করে না। সিলিন্ডার ছাড়া দমবন্ধ করে নীচে নামে। অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে নীচে নামলে অনেকক্ষণ নীচে থাকা যায় ঠিকই কিন্তু যন্ত্রে ত্রুটি হলে বাতাস প্রচণ্ড বেগে ফুসফুসে প্রবেশ করে ফুসফুস ফাটিয়ে মৃত্যু ঘটায় ডুবুরিদের। বিশেষত গভীর সমুদ্রের তলদেশে জলের প্রচণ্ড চাপে অনেক সময় যন্ত্র বিকল হয়ে এই দুর্ঘটনা ঘটে। অস্ট্রেলিয়ার উপকূল ভাগ প্রশান্ত মহাসাগরে প্রায় দু-হাজার মাইল বিস্তৃত। পৃথিবীর আশি শতাংশ ঝিনুক তোলা হয় অস্ট্রেলিয়ার উপকূল থেকে। আর এ কাজের সিংহভাগ করে থাকে অক্সিজেন সিলিন্ডারহীন জাপানিরা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি ধীবররা অস্ট্রেলীয় উপকূল থেকে ১২০০ টন শুক্তি সংগ্রহ করেছিল।’

রাইখ বলল, ‘১৯১৭ সালে এই অস্ট্রেলীয় উপকূল থেকে এক ঐতিহাসিক মুক্তো পাওয়া গেছিল। তার নাম দেওয়া হয় ‘স্টার অব দি ওয়েস্ট।’ সে সময় সেটা এক লক্ষ ডলারে বিক্রি হয়। ভাবতে পারেন!’

আকিরা বললেন, ‘আমি শুনেছি, আমাদের জাপানি সমুদ্রতলে নাকি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় তার থেকে বড় একটা মুক্তো পাওয়া গেছিল। রক্তবর্ণের পিংপং বলের আকারের একটা মুক্তো। তার নাম দেওয়া হয় “স্টার অব দি ইস্ট”। জাপান-জার্মানির যৌথ শুক্তি সংগ্রহকারী দল নাকি সেটা সংগ্রহ করেছিল। কিন্তু ঠিক সেই সময়তেই পতন ঘটে দুই দেশের। সেই গোলযোগের মুহূর্তে সেই মুক্তো কোথায় হারিয়ে যায় ইতিহাস তার খোঁজ রাখেনি। সেই মুক্তো আজ পাওয়া গেলে কয়েক কোটি ডলার দাম হবে তার।’

আকিরার কথা শুনে একটু চুপ করে থেকে রাইখ বলল, ‘হ্যাঁ, আমিও একটা বইতে পড়েছি ‘স্টার অব দি ইস্ট’-এর কথা।’ হেরম্যানের মাথায় সম্ভবত খালি ঘুরপাক খাচ্ছে সেই দানব অক্টোপাসের কথা। তিনি সুদীপ্তর উদ্দেশে বললেন, ‘একটা ব্যাপার বলি, সম্পূর্ণ অন্যরকম দেখতে হলেও অক্টোপাস কিন্তু আদতে শামুক-ঝিনুক গোত্রের অর্থাৎ মোলাস্কা শ্রেণির প্রাণী। স্কুইডও একই গোত্রের।’

আকিরা বললেন, ‘এটা আমার জানা ছিল না। আর দানব অক্টোপাসের গল্প শুনলেও তাতে আমার তেমন বিশ্বাস ছিল না। ওই ভয়ংকর ঘটনা ঘটার পর এখনও মাঝে মাঝে আমার মনে হয় ওটা অন্য কোনো সামুদ্রিক প্রাণী নয় তো? সমুদ্রতলের কত কিছুই তো এখনও আমাদের অজানা। তবে আবার সেই মৃত্যুপথযাত্রী নাবিকের কথাও অবিশ্বাস করি কীভাবে?’ হেরম্যান বললেন, ‘ওই দানবীয় অক্টোপাসের খোঁজ মেলে প্রথম স্ক্যান্ডেনেভিয়ান লোকগাথায়। নরওয়ের উপকথাতে ওই জীবের বর্ণনা আছে। ওখানে ওদের বলে ‘ক্রাকেন’। স্ক্যান্ডেনেভিয়ান ভাষায় ‘ক্রাকেন’ শব্দর অর্থ—ভয়ংকর জন্তু। ‘ক্রাকে’ থেকে ‘ক্রাকেন’ শব্দ এসেছে। ‘ক্রাকে’ শব্দর অর্থ অক্টোপাস। তাদের আকার নাকি ৪০ থেকে ৫০ ফুট। শুঁড়ে জড়িয়ে তারা জাহাজ ডুবিয়ে দেয়। মাছের ঝাঁক পরিবেষ্টিত গভীর সমুদ্রের তলদেশে তারা থাকে। সে মাঝে মাঝে ভেসে ওঠে ও নাসারন্ধ্র থেকে জল ছাড়ে। তখন চারপাশে বৃত্তাকার ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়। এভাবেই বর্ণিত হয়েছে সে।’

কখনো অক্টোপাস, কখনো মুক্তো সংগ্রহের ব্যাপার নিয়ে নানা কথা চলতে থাকল। আর তার সঙ্গে এগিয়ে চলল বোট। ঘণ্টা দুই এগোবার পর বোটের গতি বেশ শ্লথ হয়ে এল। সুদীপ্তরা দেখতে পেল কিছু দূরে জলের মধ্যে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে সার সার ডুবো পাহাড়। পাইলট মরগ্যান অতি সাবধানে এগোতে লাগলেন সেদিকে। মাঝে মাঝে একদম থেমে যাচ্ছে বোট। তারপর আবার এগোচ্ছে ডুবো পাহাড়ের ফাঁক গলে। সবাই চুপচাপ হয়ে গেল। কোথাও সামান্য ধাক্কা খেলেই চুরমার হয়ে যাবে বোট। কখনো ইঞ্জিন বন্ধ করে, কখনো আবার তা চালু করে সেই ডুবো পাহাড়শ্রেণির মধ্যে দিয়ে এগোতে লাগল বোট। আকিরা ইতিমধ্যে ডেক ছেড়ে পাইলট রুমে মরগানের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। তাঁকে পথ চেনাচ্ছেন তিনি। এভাবে প্রায় এক ঘণ্টারও বেশি সময় চলার পর এক জায়গাতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল বোট। পাইলট রুম থেকে আকিরা চিৎকার করে বললেন, ‘আমরা পৌঁছে গেছি। নোঙর ফেলো।’ দুজন ধীবর নোঙর স্তম্ভ বা ক্যাপস্টন থেকে নোঙর খুলে সেটা নামিয়ে দিল জলে। মৃদু ঝাঁকুনি খেয়ে জগদ্দল পাথরের মতো স্থির হয়ে গেল বোটটা। আকিরা আর মরগ্যান দুজনেই এবার পাইলট কেবিন ছেড়ে ডেকে এসে পৌঁছলেন।

তিমির পিঠের মতো জল থেকে উঠে আসা প্রায় কুড়ি ফুট একটা ডুবো পাহাড়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে বোটটা। সুদীপ্ত ভালো করে তাকাল চারদিকে। যেদিকেই চোখ যায় সেদিকেই কিছুটা তফাতে তফাতে জেগে আছে ছোটবড় ডুবো পাহাড়। সমুদ্রের জল এমনিতে স্থির-অচঞ্চল। শুধু জলতলের উপরিভাগ যেখানে পাহাড়ের গায়ে ধাক্কা খাচ্ছে সেখানে মৃদু ঘূর্ণিস্রোত আর দুগ্ধাভ ফেনার সৃষ্টি হচ্ছে। মরগ্যান জলের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, ‘ডুবো পাহাড় থাকলেও এখানে জল কিন্তু খুব গভীর।’

হেরম্যানও তাকালেন জলের দিকে তারপর তাকালের সুদীপ্তর দিকে। তাঁর মনের ভাষা পাঠ করতে পারল সুদীপ্ত। তিনি বলতে চাচ্ছেন, এই অতল জলের গভীরেই হয়তো কোথাও লুকিয়ে আছে সেই দানবীয় অক্টোপাস। যুগ যুগ ধরে যার গল্প করে আসছে প্রাচীন জাহাজিরা। যে জলদানব তার শুঁড়ে পেঁচিয়ে জাহাজ ডুবিয়ে দিতে পারে! সূর্য প্রায় মাথার ওপর। আকিরা বললেন, ‘আমি ঝিনুক সংগ্রহের কাজ করব কাল থেকে। তবে আজ একবার জলের তলাটা দেখে আসা যেতে পারে।’

তাঁর কথায় সহমত পোষণ করে রাইখ বলল, ‘আমারও নীচে নামার ইচ্ছা আছে।’ হেরম্যান বললেন, ‘আমাদেরও নীচে নামার আগ্রহ আছে। কাল তো আমরা প্রাথমিক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি।’ আকিরা তাঁর কথা শুনে বললেন, ‘এখানে সমুদ্রের গভীরতা ও জলের চাপ কিন্তু অনেক বেশি। আপনারা নামলে কিন্তু সিলিন্ডার নিয়েই নামতে হবে। যেতে যখন চাচ্ছেন তখন যান। কিন্তু কোনো অসুবিধা বোধ করলেই দড়ি নাড়িয়ে সংকেত দেবেন। আমরা ওপরে তুলে নেব।’

রাইখ বলল, ‘আমার অবশ্য গভীর জলে নামা অভ্যাস আছে। অসুবিধা হবে না।’ ঠিক হল, হেরম্যান, সুদীপ্ত, রাইখ ও আরও দুজন ডুবুরি নীচে নামবে। ওই দুই ডুবুরির মধ্যে একজনের নাম ওশো। সে আকিরার আগের মুক্তো সংগ্রহের সাথী হয়ে এসেছিল এখানে। বোটের অন্যরা ওপরে থাকবে সুদীপ্তদের টেনে তোলার জন্য। কিছুক্ষণের মধ্যে তৈরি হয়ে গেল সবাই। ডুবুরি দুজন অবশ্য সিলিন্ডার ছাড়াই নামবে। সিলিন্ডার, মাস্ক, ফ্লিপার ছাড়া সুদীপ্তদের তিনজনের ধাতব কোমর-বন্ধনি বা কারসেটে একটা করে বাড়তি জিনিস এবার দেওয়া হল। একটা করে এক বিঘত লম্বা একটা ছুরি। আর ওশো নিল একটা হারপুন গান। সেই জলদানবের মুখোমুখি হলে যাতে লড়াই দেওয়া যায়। প্রথমে ওশো ঝাঁপ দিল। তারপর একে একে সুদীপ্তরা।

ঝাঁপ দেবার পর নীচে নামতে নামতে সুদীপ্তর প্রথমে মনে হল সত্যিই যেন পাতালের দিকে নেমে যাচ্ছে। সত্যিই এখানে সমুদ্র খুব গভীর। অবশেষে একসময় মাটিতে পা ঠেকল তার। জলজ উদ্ভিদ এখানে কম। পায়ের তলায় কেউ যেন ঝিনুকের গালিচা পেতে রেখেছে। নানা আকারের ধবধবে সাদা ঝিনুক ঝিলিক দিচ্ছে সুদীপ্তদের হেলমেটে লাগানো ওয়াটার টর্চের আলোতে। তার ওপর খেলে বেড়াচ্ছে রঙবেরঙের মাছের ঝাঁক ৷

সুদীপ্তরা মাথা এপাশ-ওপাশে ঘোরাতেই আলো গিয়ে পড়তে লাগল ডুবো পাহাড়ের গুহামুখগুলোর গায়ে। তার ভিতর জমাটবাঁধা অন্ধকার। মাঝে মাঝে মাছের ঝাঁক বেরিয়ে আসছে সেখান থেকে। কত অজানা রহস্য সমুদ্রতলের ওই গুহামুখগুলোর ভিতর লুকিয়ে আছে কে জানে!

ওশো সুদীপ্তদের ইশারা করল একটা বেশ বড় গুহা দেখিয়ে। সম্ভবত ওখান থেকেই জলদানব টেনে নিয়ে গেছিল সেই হতভাগ্য ধীবরকে। প্রথমে রাইখ তারপর একে একে অন্যরা এগোল সেদিকে। সতর্কতা অবলম্বন করে গুহার একেবারে সামনে না গিয়ে কিছুটা তফাতে দাঁড়াল তারা। ওশো দম নেবার জন্য একবার ওপরে উঠেই আবার নীচে নেমে এল সঙ্গে সঙ্গে। হারপুনটা সে বাগিয়ে ধরল গুহামুখের দিকে। একসঙ্গে তিনটে ওয়াটার টর্চের আলো পড়ল গুহামুখের ওপর। বেশ বড় গুহামুখ। ছোটখাটো একটা হাতি গলে যেতে পারে তার ভিতর। কিন্তু ভিতরে কী আছে তা এতদূর থেকে বোঝা যাচ্ছে না। সেখানে জমাটবাঁধা অন্ধকার। বেশি কাছে যাওয়া নিরাপদ হবে না। হয়তো প্রাণীটা ওর ভিতর থাকতে পারে। ওশো এবার সবাইকে ওপরে ফেরার ইঙ্গিত করল। ফিরতে যাচ্ছিল সবাই। হঠাৎ হেরম্যানের চোখে পড়ল একটা জিনিস। কিছুটা তফাতেই মাটিতে পড়ে আছে সেটা। গোলাকৃতি ঝিনুক নাকি! ছোট বলের মতো নিটোল একটা ধবধবে কিছু, তিনি সেটা রাইখকে দেখাতেই সে কয়েক পা এগিয়ে জিনিসটার সামনে বসে পড়ল। সে হাত দিয়ে আশেপাশের ঝিনুকগুলো সরাতেই একটা অদ্ভুত জিনিস আত্মপ্রকাশ করল। বলের মতো জিনিসটা আসলে একটা মানুষের মাথার খুলি! তফাত থেকে সেটাকে বল মনে হচ্ছিল। ওটা কি সেই হতভাগ্য ধীবরের মাথার খুলি? ওশোও গিয়ে হাত মেলাল রাইখের সঙ্গে। ঝিনুকের চাদরের আড়াল থেকে বেরিয়ে এল আস্ত একটা কঙ্কাল! আশ্চর্যের ব্যাপার তার পায়ে একটা লোহার শিকল বাঁধা। সেটা আবার বাঁধা আছে তলদেশে প্রোথিত একটা লোহার খুঁটিতে। মাংসহীন কঙ্কাল থেকে অবশ্য সহজেই ছিন্ন করা গেল সেটা। তারপর সেই কঙ্কালটা নিয়ে সবাই ভেসে উঠল ওপরে।