॥ ৬ ॥
কেদার পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমাদের হয়ে গেল বিকেল সাড়ে পাঁচটা। তখনও যথেষ্ট আলো রয়েছে, চারদিকের পাহাড়ের চুড়োগুলোয় রোদ ঝলমল করছে।
এতক্ষণ চড়াই-এর পর হঠাৎ সামনে সমতল জমি দেখতে পেলে যে কেমন লাগে তা লিখে বোঝাতে পারব না। এটুকু বলতে পারি যে অবিশ্বাস, আশ্বাস, আনন্দ সব যেন এক সঙ্গে মনের মধ্যে জেগে ওঠে, আর তার সঙ্গে কৃতজ্ঞতা মেশানো একটা অদ্ভুত শান্ত ভাব। সেটাই বোধহয় যাত্রীদের মনে আরো বেশি ভক্তি জাগিয়ে তোলে।
চারিদিকে সব পাথর বাঁধানো জমিতে শুয়ে বসে দাঁড়িয়ে ‘জয় কেদার’ ‘জয় কেদার’ করছে, মন্দিরটা দাঁড়িয়ে রয়েছে তিন দিকে ঘেরা বরফের পাহাড়ের মধ্যে, আমরা তিনজন তারই মধ্যে এগিয়ে গেলাম একটা বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে।
এখানে হোটেল আছে—হোটেল হিমলোক—কিন্তু তাতে জায়গা নেই, বিড়লা রেস্ট হাউসেও জায়গা নেই। এক রাত্রের ব্যাপার যখন, মোটামুটি একটা ব্যবস্থা হলেই হল। তাই শেষ পর্যন্ত কালীকমলীওয়ালির ধরমশালায় উঠলাম আমরা। সামান্য ভাড়ায় গরম লেপ তোষক কম্বল সবই পাওয়া যায়।
কেদারনাথের মন্দির এই কিছুক্ষণ আগে সন্ধ্যা ছ’টায় বন্ধ হয়ে গেছে, আবার খুলবে সেই কাল সকাল আটটায়। তাই লালমোহনবাবুর পুজো দেবার কাজটা আজ স্থগিত থাকবে। আপাতত ঠিক এই মুহূর্তে যেটা দরকার সেটা হল গরম চা। আমাদের থাকার ঘর থেকে নিচে নেমেই চায়ের দোকান পেয়ে গেলাম। এটা হল কাশীর বিশ্বনাথের গলির মতোই কেদারনাথের গলি। দোকানগুলো সবই অস্থায়ী, কারণ নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত বরফের জন্য কেদারনাথে জনপ্রাণী থাকবে না।
আমি ভেবেছিলাম এই ধকলের পর লালমোহনবাবু হয়ত একটু বিশ্রাম নিতে চাইবেন, কিন্তু তিনি বললেন যে তাঁর দেহের রন্ধ্রে রন্ধ্রে নাকি নতুন এনার্জি পাচ্ছেন।—‘তপেশ, এই হল কেদারের মহিমা!’
বিশ্বনাথের মতোই এখানেও কেদারের গলির দোকানগুলোতে বেশিরভাগই পুজোর সামগ্রী বিক্রী হয়। এমন কি বেনারসের সেই অতি চেনা গন্ধটাও যেন এখানে পাওয়া যায়।
আমরা তিনজনে এলাচ দেওয়া গরম চা খাচ্ছি, এমন সময় হঠাৎ চেনা গলায় প্রশ্ন এল—‘উপাধ্যায়ের সন্ধান পেলেন?’
ছোটকুমার পবনদেও সিং। এখনও তার হাতে ক্যামেরা আর বেল্টের সঙ্গে লাগানো সাউণ্ড রেকর্ডিং যন্ত্র।
‘আমরা ত এই মিনিট কুড়ি হল এলাম,’ বলল ফেলুদা।
‘আমি এসেছি আড়াইটে,’ বলল পবনদেও। যেটুকু জেনেছি তিনি এখন পুরোপুরি সাধুই হয়ে গেছেন। চেহারাও সাধুরই মতো। বুঝে দেখুন, এখানে এত সাধুর মধ্যে তাকে খুঁজে বার করা কত কঠিন। একটা ব্যাপার সম্বন্ধে আমি শিওর। তিনি নাম বদলেছেন। উপাধ্যায় বলে এখানে কেউ কাউকে চেনে না।’
দেখুন চেষ্টা করে,’ বলল ফেলুদা, ‘আমরাও খুঁজছি।’
পবনদেও চলে গেলেন। লোকটা আমার কাছে এখনো রহস্য রয়ে গেল।
আমরা চা শেষ করে উঠে কয়েক পা এগিয়েছি, এমন সময় আরেকটা চেনা কণ্ঠে বাংলায় একটা প্রশ্ন এল।
‘এই যে—এসে পড়েছেন? কেমন, আসা সার্থক কিনা বলুন।’
আমাদের ট্রেনের আলাপী মাখনলাল মজুমদার।
‘ষোল আনা সার্থক,’ বলল ফেলুদা, ‘আমাদের ঘোর এখনো কাটেনি।’
‘হরিদ্বারের কাজ হল?’
‘হয়নি বলেই ত এখানে এলাম। একজনের সন্ধান করে বেড়াচ্ছি। আগে ছিলেন হরিদ্বারে। সেখানে গিয়ে শুনি তিনি চলে গেছেন রুদ্রপ্রয়াগ। আবার রুদ্রপ্রয়াগে গিয়ে শুনি কেদারনাথ।’
‘কার কথা বলছেন বলুন ত?’
‘ভবানী উপাধ্যায় বলে এক ভদ্রলোক।’
মাখনবাবুর চোখ কপালে উঠে গেল।
‘ভবানী? ভবানীর খোঁজ করছেন আপনারা? আর সে কথা অ্যাদ্দিন আমাকে বলেননি?’
‘আপনি তাঁকে চেনেন নাকি?’
‘চিনি মানে? সাত বচ্ছর থেকে চিনি। আমার পেটের আলসার সারিয়ে দিয়েছিল এক বড়িতে। তারপর হরিদ্বার ছাড়ার কিছুদিন আগেও আমার সঙ্গে দেখা করেছে। একটা বৈরাগ্য লক্ষ্য করেছিলাম ওর মধ্যে। বললে রুদ্রপ্রয়াগ যাবে। আমি বললাম বাসরুট হয়ে রুদ্রপ্রয়াগ আর এখন সে জিনিস নেই। তুমি জপতপ করতে চাও ত সোজা কেদার চলে যাও। বোধহয় একটা দোটানার মধ্যে পড়েছিল, তাই কিছুদিন রুদ্রপ্রয়াগ থেকে যায়। কিন্তু এখন সে এখানেই।’
‘সে ত বুঝলাম, কিন্তু কোথায়?’
‘শহরের মধ্যে তাকে পাবেন না ভাই। সে এখন গুহাবাসী। চোরাবালিতাল নাম শুনেছেন? যাকে এখন গান্ধী সরোবর বলা হয়?’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, শুনেছি বটে।’
‘ওই চোরাবালিতাল থেকে মন্দাকিনী নদীর উৎপত্তি। কেদারনাথের পিছন দিয়ে পাথর আর বরফের উপর দিয়ে মাইল তিনেক যেতে হবে। হ্রদের ধারে একটা গুহায় বাস করে ভবানী। উপাধ্যায় অংশটা তার নাম থেকে উবে গেছে; এখন সে ভবানীবাবা। একা থাকে, কাছেপিঠে আর কেউ থাকে না। কাল সকালে আপনারা চেষ্টা করে দেখতে পারেন।’
‘আপনার সঙ্গে এবার দেখা হয়েছে?’
‘না, তবে স্থানীয় লোকের কাছে খবর পেয়েছি। ফলমূলের জন্য তাকে বাজারে আসতে হয় মাঝে মাঝে।’
‘আপনি আমাদের অশেষ উপকার করলেন, মিঃ মজুমদার। কিন্তু তাঁর অতীতের ইতিহাস কি এখানে কেউ জানে?’
‘তা তো জানতেই পারে,’ বললেন মাখনবাবু, ‘কারণ সে তো চিকিৎসা এখনো সম্পূর্ণ ছাড়েনি। এই কেদারনাথের মোহান্তই ত বলছিলেন যে ভবানী সম্প্রতি নাকি একটি ছেলের পোলিও সারিয়ে দিয়েছে। তবে আমার ধারণা সে কিছুদিনের মধ্যে আর চিকিৎসা করবে না—পুরোপুরি সন্ন্যাসী বনে যাবে।’
‘একটা শেষ প্রশ্ন,’ বলল ফেলুদা, ‘ভদ্রলোক কোন্ দেশী তা আপনি জানেন?’
‘এ বিষয় ত তাকে কোনোদিন জিগ্যেস করিনি। তবে সে আমার সঙ্গে সব সময় হিন্দিতেই কথা বলেছে। ভালো হিন্দি। তাতে অন্য কোনো প্রদেশের ছাপ পাইনি কখনো।’
মাখনলালবাবু চলে গেলেন।
লালমোহনবাবু ইতিমধ্যে আমাদের দল থেকে একটু দূরে সরে গিয়ে কার সঙ্গে যেন কথা বলছিলেন। এবার এগিয়ে এসে বললেন, ‘বিড়লা গেস্ট হাউস থেকে আমাদের তলব পড়েছে।’
‘কে ডাকছে?’ প্রশ্ন করল ফেলুদা।
একটি বেঁটে ভদ্রলোক এগিয়ে এসে বললেন, ‘মিঃ সিংঘানিয়া।’
ফেলুদার ভুরুটা কুঁচকে গেল। আমাদের দিকে ফিরে চাপা গলায় বলল, ‘মনে হচ্ছে এই সিংঘানিয়াই এক ভদ্রলোককে সঙ্গে নিয়ে হরিদ্বার গিয়েছিলেন উপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা করতে। আমার মনে হয় একে খানিকটা সময় দেওয়া যেতে পারে।—চলিয়ে।’
যদিও চারিদিকে অনেকগুলো বরফের পাহাড়ের চূড়োতে এখনও রোদ রয়েছে—তার কোনোটা সোনালী, কোনোটা লাল, কোনোটা গোলাপী—কেদার শহরের উপর অন্ধকার নেমে এসেছে।
বিড়লা গেস্ট হাউস কেদারনাথের মন্দিরের পাশেই, কাজেই আমরা তিন মিনিটের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম। দেখে মনে হল এখানে হয়ত এটাই থাকবার সবচেয়ে ভালো জায়গা। অন্তত পরিচ্ছন্নতার দিক দিয়ে ত বটেই; খাবারের কথা জানি না। খাবারের ব্যাপারে এমনিতেও শুনছি এখানে আলু ছাড়া আর বিশেষ কিছুই পাওয়া যায় না।
বেঁটে লোকটা আমাদের আগে আগে পথ দেখিয়ে বিড়লা গেস্ট হাউসের দোতলার একটা ঘরে নিয়ে গিয়ে হাজির করল। বেশ বড় ঘর, চারিদিকে চারটে গদি পাতা। মাথার উপর একটা ঝুলন্ত লোহার ডাণ্ডা থেকে বেরোন তিনটে ডালে টিম টিম করে তিনটে বালব্ জ্বলছে। কেদারনাথে ইলেকট্রিসিটি আছে বটে, কিন্তু আলোর কোনো তেজ নেই।
আমরা মিনিট খানেক অপেক্ষা করতেই যিনি আমাদের আহ্বান করেছিলেন তাঁর আবির্ভাব হল।