৬. এ বি সি ডি – এশিয়া’জ বেস্ট ক্রাইম ডিটেক্টর

॥ ৬ ॥

অনিরুদ্ধ সকালে স্কুলে যায়, তাই চা খাবার আগেই ফেলুদা ওর সঙ্গে দেখা করে নিল।

চোর ঢোকার কথাটা আজ শুনে মনে হল ছেলেটি বেশিরকম কল্পনাপ্রবণ। পরপর দুবার! একটু বাড়াবাড়ি বলে মনে হল। ফেলুদা বলল, ‘তুমি যে বন্দুকটা দিয়ে চোরকে মারবে ঠিক করেছিলে সেটাত আমাকে দেখালে না। শুনলাম তোমার ছোটকাকাকে দেখিয়েছ।’

অনিরুদ্ধ বন্দুকটা বার করে ফেলুদার হাতে দিয়ে বলল, ‘এটা থেকে আগুনের ফুলকি বেরোয়।’

লাল প্লাস্টিকের তৈরি মেশিনগান, ট্রিগার টিপলে মেশিনগানের মতো শব্দের সঙ্গে নলের মুখ দিয়ে সত্যিই স্পার্ক বেরোয়।

ফেলুদা বন্দুকটা নিয়ে নেড়ে চেড়ে দেখে সেটার খুব তারিফ করে ফেরত দিয়ে বলল, ‘তোমার যে ঘুমের ব্যাঘাত হচ্ছে, দেখা যাক সেটা বন্ধ করা যায় কিনা।’

‘তুমি চোর ধরে দেবে?’

‘গোয়েন্দার ত ওই কাজ।’

‘আর আমার চন্দনা যে চুরি করেছে সেই চোর?’

‘সেটারও চেষ্টা চলেছে, তবে কাজটা খুব সহজ নয়।’

‘খুব শক্ত?’

‘খুব শক্ত।’

‘দারুণ রহস্য?’

‘দারুণ রহস্য।’

‘আর সেদিন যে বললে খাঁচার দরজায় রক্ত লেগে আছে?’

‘ওটাইত ভরসা। ওটাইত ক্লু।’

‘ক্লু মানে?’

‘ক্লু হল যার সাহায্যে গোয়েন্দা দুষ্ট লোককে জব্দ করে।’

লালমোহনবাবু হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, ‘আচ্ছা, তোমার পাখিকে কথা বলতে শুনেছ?

‘হ্যাঁ,’ বলল অনিরুদ্ধ। ‘আমি ঘরে ছিলাম, আর শুনলাম পাখিটা কথা বলছে।’

‘কী কথা?’

‘বলছে ‘দাদু ভাত খান, দাদু ভাত খান।’ আমি তক্ষুণি বেরিয়ে এলাম কিন্তু তারপর আর কিছু বলল না।’

লালমোহনবাবুর মুখে হাসি। অনিরুদ্ধ শুনেছে দাদু ভাত খান আর লালমোহনবাবু শুনেছেন বাবু সাবধান। মানতেই হয় দুটো খুব কাছাকাছি। পাখি নিশ্চয়ই ওই ধরনেরই কিছু বলছিল।

‘আপনার এখানে পাখি ধরতে পারে এমন কেউ আছে?’ ফেলুদা অমিতাভবাবুকে জিজ্ঞেস করল।

‘আমাদের মালির ছেলে আছে, শঙ্কর’, বললেন অমিতাভবাবু। ‘এর আগে দু-একবার ধরেছে পাখি। খুব চালাকচতুর ছেলে।’

‘তাকে বলবেন একটু চোখ রাখতে। খুব সম্ভব চন্দনাটা আপনাদের বাগানেই রয়েছে।’

বারাসতে থাকতেই দেখেছিলাম যে খবরের কাগজে চন্দনার বিষয় বিজ্ঞাপনটা বেরিয়েছে। সেটার কাজ যে এত তাড়াতাড়ি হবে তা ভাবতে পারিনি।

বারোটা নাগাদ একটি বছর পঁচিশের ছেলে আমাদের বাড়িতে এসে হাজির। বেশ চোখাচোখা চেহারা, পরনে জীন্‌স আর মাথার চুলের কপাল-ঢাকা কায়দা দেখলেই বোঝা যায় ইনি হালফ্যাসানের তরুণ।

ফেলুদা বসতে বুলাতে ভদ্রলোক মাথা নেড়ে বললেন, ‘বসব না। আজ একটা ইন্টারভিউ আছে। ইয়ে, আমি আসছি ঐ পাখির ব্যাপারে কাগজে যে বিজ্ঞাপনটা দিয়েছেন সেইটে দেখে।’

‘ওটা আপনাদের পাখি ছিল?’

‘আমাদের মানে আমার দাদুর। দাদু মারা গেছেন লাস্ট মান্‌থ। তাই বাবা ওটাকে বেচে দিলেন। ওটার দেখাশুনা দাদুই করতেন। বাবা কোর্ট কাচারি করেন, মা বাতে ভোগেন, আর আমার ওসবে ইন্টারেস্ট নেই।’

‘কদ্দিন ছিল আপনাদের বাড়ি?’

‘তা বছর দশেক। দাদুর খুব পিয়ারের চন্দনা ছিল।’

‘কথা বলত?’

‘হ্যাঁ। দাদুই শিখিয়েছিলেন। খুব রসিক মানুষ ছিলেন। অদ্ভুত অদ্ভুত কথা শিখিয়েছিলেন।’

‘অদ্ভুত মানে?’

‘এই যেমন—দাদুর পাশার নেশা ছিল; পাখিটাকে শিখিয়েছিলেন “কচে বারো” বলতে। তারপর ব্রিজও খেলতেন দাদু। খেলার সময় অপোনেন্টের তাস ভালো বুঝতে পারলে পার্টনারকে একটা কথা খুব বলতেন। সেটা পাখিটা তুলে নিয়েছিল।’

‘কী কথা?’

‘সাধু সাবধান।’

‘ঠিক আছে। অনেক ধন্যবাদ।’

‘আর কিছু—?’

‘না, আর কিছু জানার নেই।’

‘ইয়ে, বিজ্ঞাপন দেখে বুঝতে পারিনি এটা আপনার বাড়ি।’

‘সেটা না বোঝারই কথা।’

‘আপনাকে মীট করে খুব ইয়ে হলাম।’

ঝাড়া পাঁচ ঘণ্টা তার ঘরের দরজা বন্ধ করে বসে থেকে বিকেলে চা খেতে বেরিয়ে এসে ফেলুদা হাজরাকে একটা টেলিফোন করল;

‘কাল সকালে কী করছেন?’

‘কেন বলুন ত?’

‘হালদার বাড়িতে আসতে পারবেন—ন’টা নাগাদ? মনে হচ্ছে রহস্যের কিনারা হয়েছে। তৈরি হয়ে আসবেন।’

লালমোহনবাবুকে টেলিফোনে বলে দেওয়া হল আমরা ট্যাক্সি করে চলে যাব তাঁর বাড়ি সাড়ে আটটায়। সেখান থেকে তাঁর গাড়িতে বারাসত।

‘রহস্য আরো বৃদ্ধি পেল নাকি?’

‘না। সম্পূর্ণ উদঘাটিত।’

সব শেষে অমিতাভবাবুকে ফোন করা হল।

‘আপনাদের বাড়িতে কাল সকালে একটা ছোটখাটো মিটিং করব ভাবছি।’

‘মিটিং?’

‘আপনাদের পুরুষ মেমবার যে কজন আছেন তাঁরা যেন থাকেন। আর হাজরাকে থাকতে বলেছি।’

‘কটায় করতে চাইছেন?’

‘নটায় হাজিরা। আপনার কাজের হয়ত একটু দেরি হতে পারে, কিন্তু ব্যাপারটা জরুরী।’

অমিতাভবাবু রাজি হয়ে গেলেন। —’পুরুষ মেমবার মানে কি অনুকেও চাইছেন?’

‘না। সে না থাকাটাই বাঞ্ছনীয়। এটা শুধু প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য।’

আমরা যখন পৌঁছলাম, তার আগেই হাজরার দল হাজির। ফেলুদা এরকম ধরনের মিটিং এর আগেও করেছে। প্রত্যেকবারই আমার মনের মধ্যে একটা চনমনে ভাব, কারণ জানি না কী হতে চলেছে, কার ভাগ্যে হাতকড়া আছে, কী ভাবে ফেলুদা রহস্যের সমাধান করেছে। লালমোহনবাবু আমাকে বললেন, ‘আমি চিন্তাটাকে স্রেফ অন্য পথে ঘুরিয়ে নিয়েছি। এ ব্যাপারে ব্রেন খাটিয়ে কোনো লাভ নেই, কারণ আমার ঘিলুতে অনেক ভেজাল, তোমার দাদারটা পিওর। নিজের তৈরি রহস্যের সমাধান এক জিনিস, আর অ্যাকচুয়েল লাইফে সমাধান আরেক জিনিস।’

নীচের বৈঠকখানা ঘরে জমায়েত হয়েছি। হৃষিকেশবাবুর দিল্লী যাবার সময় হয়ে এসেছে। বললেন, ‘এ বাড়ি ছেড়ে যেতে পারলে বাঁচি মশাই। কাজ থাকলে তবু একটা কথা। এখন প্রাণ হাঁপিয়ে ওঠে।’

অচিন্ত্যবাবুর সঙ্গে ভালো করে আলাপ হয়নি। তিনি আপত্তি করেছিলেন এই মিটিং-এ উপস্থিত থাকার ব্যাপারে। তাঁর নাকি একটা বড় পার্ট নিয়ে খুব পরিশ্রম করতে হচ্ছে। কালই নাকি নাটকটার প্রথম শো। ভদ্রলোক ফেলুদাকে বললেন, ‘আপনার এ ব্যাপারটা কতক্ষণ চলবে?’

ফেলুদা বলল, ‘খুব বেশি ত আধ ঘণ্টা।’

ভদ্রলোক তাও গজগজ করতে লাগলেন।

কফি খাবার পর ফেলুদা উঠে দাঁড়াল। কালসিটে ঢাকার জন্য ও আজ কালো চশমা পরেছে। এটা ওর একেবারে নতুন চেহারা। হাত দুটোকে প্যান্টের পকেটে পুরে সে আরম্ভ করল তার কথা।

‘পার্বতীচরণের খুনের ব্যাপারে আমাদের যেটা সবচেয়ে অবাক করেছিল সেটা হল সাধন দস্তিদারের অন্তর্ধান। দশটা থেকে সাড়ে দশটার মধ্যে খুনটা হয়। সাধন দস্তিদার পার্বতীবাবুর ঘরে ছিলেন সোয়া দশটা থেকে সাড়ে দশটা পর্যন্ত। সাড়ে দশটায় তাঁকে আমরা ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ির দিকে যেতে দেখেছি; দশটা পঁয়ত্রিশে অনিরুদ্ধর সঙ্গে কথা বলে পার্বতীবাবুর ঘরে গিয়ে আমরা তাঁকে মৃত অবস্থায় দেখি। তৎক্ষণাৎ সাধন দস্তিদারকে খোঁজা হয়, কিন্তু পাওয়া যায় না। দারোয়ান বলে তাঁকে গেট থেকে বেরোতে দেখেনি। বাগানে খোঁজা হয়, সেখানেও পাওয়া যায়নি। কম্পাউণ্ডের যে পাঁচিল, সেটা আট ফুট উঁচু। সেটা টপকানো সহজ নয়, বিশেষ করে হাতে একটা ব্রীফ কেস থাকলে। আমরা—’

এখানে অচিন্ত্যবাবু ফেলুদাকে বাধা দিলেন।

‘সাধনবাবুর আগে যিনি এসেছিলেন তাকে কি আপনি বাদ দিচ্ছেন?’

‘আপনার বাবাকে যেভাবে আঘাত করা হয়েছিল, সেটা শক্ত সমর্থ লোকের পক্ষেই সম্ভব। পেস্টনজীর আরথ্রাইটিস আছে, তিনি ডান হাত কাঁধের উপর তুলতে পারেন না। অবিশ্যি পেস্টনজী ছাড়াও একজন তৃতীয় ব্যক্তি ছিলেন যিনি পেস্টনজী ও সাধনবাবুর ফাঁকে পার্বতীবাবুর ঘরে গিয়ে থাকতে পারেন।’

‘তিনি কে?’

‘আপনি।’

অচিন্ত্যবাবু সোফা ছেড়ে উঠে পড়েছেন।

‘আ—আপনার কি ধারণা আমি—?’

‘আমি শুধু বলেছি আপনার সুযোগ ছিল। আপনি খুন করেছেন সে কথাত বলিনি।’

‘তাও ভালো।’

‘যাই হোক—সাধনবাবুর অন্তর্ধান বিশ্বাসযোগ্য হয় এক যদি দারোয়ান ভুল বা মিথ্যে বলে থাকে। আর দুই, যদি সাধনবাবু এ বাড়ি থেকে না বেরিয়ে থাকেন।’

‘কোনো চোরাকুঠুরিতে আত্মগোপন করার কথা বলছেন?’ হৃষিকেশবাবু প্রশ্ন করলেন।

অমিতাভবাবু বললেন, ‘সে রকম লুকনোর কোনো জায়গা এ বাড়িতে নেই। একতলার অধিকাংশ ঘরই তালাচাবি বন্ধ। এক বৈঠকখানা খোলা, রান্নাঘর ভাঁড়ার ঘর খোলা আর হৃষিকেশবাবুর ঘর খোলা।’

‘এবং সে ঘরে তাকে আমি আশ্রয় দিইনি সেটা আমি বলতে পারি’, বললেন হৃষিকেশবাবু। ‘শুধু তাই নয়, সাধনবাবু যখন আসেন তখন আমি ছিলাম না।’

‘আমরা পোস্টাপিসে খোঁজ নিয়েছি’, বলল ফেলুদা। ‘আপনি টেলিগ্রাম পাঠিয়েছেন পোস্টাপিস খোলার সঙ্গে সঙ্গে। তখন দশটা। পাঁচ মিনিট লেগেছে আপনার টেলিগ্রাম করতে। তারপরেই আপনি—’

‘তারপর আমি যাই ঘড়ির ব্যাণ্ড কিনতে।’

‘দুঃখের বিষয় দোকানের লোক আপনাকে মনে করতে পারছে না।’

‘মিঃ মিত্তির, দোকানের লোকের স্মরণশক্তির উপর নির্ভর করেই কি আপনি গোয়েন্দাগিরি করেন?’

‘না, তা করি না। এবং তাদের কথায় আমরা খুব আমল দিইনি। আর আপনিও যে সত্যি কথা বলছেন সেটা আমরা মানতে বাধ্য নই।’

‘কেন, আমি মিথ্যে বলব কেন?’

‘কারণ সোয়া দশটার সময় আপনারও ত পার্বতীচরণের ঘরে যাবার প্রয়োজন হয়ে থাকতে পারে!’

‘এসব কী বলছেন আপনি? আপনি নিজেই বলছেন সাধনবাবুকে বেরোতে দেখেছেন, আবার বলছেন আমি গিয়েছি?

‘ধরুন সাধন দস্তিদার যদি নাই এসে থাকেন। তার জায়গায় আপনি গেলেন।’

আমার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। ঘরে সবাই চুপ, তারই মধ্যে হৃষিকেশবাবু হো হো করে হেসে উঠলেন।

‘মিঃ হালদার কি উন্মাদ না জরাগ্রস্ত, যে আমি দাড়ি গোঁফ লাগিয়ে তাঁর ঘরে ঢুকব আর তিনি আমাকে চিনবেন না?’

‘কী করে চিনবেন, হৃষিকেশবাবু? আপনি যদি গোঁফ দাড়ি লাগিয়ে চোখের চশমাটা খুলে পোশাক বদলে তাঁর ঘরে ঢোকেন, তাহলে আপনাকে সাত বছর আগের সাধন দস্তিদার বলে কেন মনে করবেন না পার্বতীবাবু? আপনি আর সাধন দস্তিদার যে আসলে একই লোক! প্রতিশোধ নেবার জন্য চেহারা পাল্টে নাম পাল্টে সেই একই লোক যে আবার সেক্রেটারি হয়ে ফিরে এসেছে সেটা ত আর বোঝেননি পার্বতীচরণ!’

হৃষিকেশবাবুর মুখের ভাব একদম পালটে গেছে। তাঁর ঠোঁট নড়ছে কিন্তু মুখ দিয়ে কথা বেরোচ্ছে না। দুজন কনস্টেবল এগিয়ে গেল তাঁর দিকে।

ফেলুদার কথা এখনো শেষ হয়নি।

‘খুনের পর কি আপনার ভাড়া করা কোটের পকেটে পেপার ওয়েট পুরে তার ওজন বাড়িয়ে আপনি পুকুরের জলে ফেলে দেননি? তারপর নিজের ঘরে গিয়ে আবার হৃষিকেশ দত্ত সেজে বেরিয়ে আসেননি?’

এই শীতকালেও হৃষিকেশবাবুর সার্টের কলার ভিজে গেছে।

‘আরো একটা কথা’, বলে চলল ফেলুদা। ‘সাধু সাবধান কথাটা কি চেনা চেনা লাগছে? অনিরুদ্ধের জন্য কেনা চন্দনার মুখে কি কথাটা শোনেননি আপনি সম্প্রতি? আর শুনে আপনার কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনে কি বিশ্বাস ঢোকেনি যে কথাটা আপনাকে উদ্দেশ্য করেই বলছে? আপনি সাধু সেজে মনিবের সর্বনাশ করতে যাচ্ছেন জেনেই পাখি এই সাবধানবাণী উচ্চারণ করছে? আপনিই কি এই পাখিকে খাঁচা থেকে বার করে বাগানে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেননি? এবং এই কাজটা করার সময় আপনাকেই কি পাখি জখম করেনি?’

হৃষিকেশবাবু এবার লাফিয়ে উঠলেন চেয়ার থেকে।

‘অ্যাবসার্ড! অ্যাবসার্ড! কোথায় জখম করেছে? কোথায়?’

‘ইনস্পেক্টর হাজরা, আপনার লোককে বলুন ত ওঁর ডান হাত থেকে ঘড়িটা খুলে নিতে।’

প্রচণ্ড বাধা সত্ত্বেও ঘড়ি খুলে এল।

কজিতে প্রায় এক ইঞ্চি লম্বা একটা আঁচড়ের দাগ, সেটা দিব্যি ঘড়ির ব্যাণ্ডের তলায় লুকিয়ে ছিল।

‘আমি খুন করতে যাইনি—দোহাই আপনার—বিশ্বাস করুন!’

হৃষিকেশবাবুর অবস্থা শোচনীয়।

‘সেটা অবিশ্বাস্য নয়’, বলল ফেলুদা, ‘কারণ আপনার আসল উদ্দেশ্য ছিল নেপোলিয়নের চিঠিটা নেওয়া। পেস্টনজী বড় রকম দর দিয়েছেন সেটা আপনি জানতেন। মিঃ হালদার বেচবেন না সেটাও আপনি পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে জানতেন। কিন্তু জিনিসটা চুরি করে ত পেস্টনজীর কাছে বিক্রী করা যায়! তাই—’

‘আমি না, আমি না!’ মরিয়া হয়ে প্রতিবাদ জানালেন হৃষিকেশবাবু।

‘আগে আমার কথা শেষ করতে দিন। ফেলু মিত্তির আধাখাঁচড়া ভাবে সমস্যার সমাধান করে না। এ ব্যাপারে আপনি একা নন সেটা আমি জানি। চিঠিটা বার করে এনে নিজের ঘরে গিয়ে মেক-আপ বদলে আপনি যান আরেকজনের কাছে চিঠিটা দিতে। কিন্তু বাড়িতে খুন হয়েছে, খানাতল্লাসী হবে, সেটা জেনে এই দ্বিতীয় ব্যক্তিও সাময়িকভাবে চিঠিটাকে অন্য জায়গায় চালান দেন। তাই নয়, অচিন্ত্যবাবু?’

প্রশ্নটা একেবারে বুলেটের মতো। কিন্তু লোকটার আশ্চর্য নার্ভ। অচিন্ত্যবাবু ঠোঁটের কোণে হাসি নিয়ে দিব্যি বসে আছেন সোফায়।’

‘বলুন বলুন কী বলবেন’, বললেন ভদ্রলোক, ‘আপনি ত দেখছি সবই জেনে বসে আছেন।’

‘আপনি সাড়ে দশটার একটু পরে একবার আপনার ভাইপোর ঘরে জাননি?’

‘গিয়েছিলাম বৈকি। আমার ভাইপোর ঘরে যাওয়ায় ত কোনো বাধা নেই। সে কদিন থেকেই বলছে তার নতুন খেলনা দেখাবে, তাই গিয়েছিলাম।’

‘আপনার ভাইপোর ঘরে গতকাল এবং তার আগের রাত্রে একজন চোর ঢুকেছিল। সে যা খুঁজছিল তা পায়নি। আপনি কি অস্বীকার করতে পারেন যে সে চোর আপনিই এবং আপনি খুঁজতে গিয়েছিলেন নেপোলিয়নের চিঠি— যেটা আপনিই তার ঘরে লুকিয়ে রেখেছিলেন? চিঠিটা পাবেন এই বিশ্বাসে আপনিই পেস্টনজীকে ফোন করে অফার দিয়েছিলেন, তারপর সেটা না পেয়ে আর পেস্টনজীর ওখানে যেতে পারেননি?’

‘আমিই যখন লুকিয়েছিলাম, তখন সেটা আমি কেন পাব না সেটা বলতে পারেন?’

‘কারণ যাতে লুকিয়েছিলেন সেটা ছিল খোকার বালিশের তলায়। এই যে।’

ফেলুদা মিঃ হাজরার দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। হবি সেন্টার থেকে কেনা লাল প্লাস্টিকের মেশিনগান চলে এল ফেলুদার হাতে। তার নলের ভিতরে আঙুল ঢুকিয়ে টান দিতে বেরিয়ে এল গোল করে পাকানো নেপোলিয়নের চিঠি।

‘হৃষিকেশবাবুর মেক-আপের ব্যাপারে আপনিই মালমশলা সাপ্লাই করেছিলেন বোধহয়? প্রশ্ন করল ফেলুদা, ‘ভাগ বাঁটোয়ারা কিরকম হত? ফিফ্‌টি ফিফ্‌টি?’

*

মালির ছেলে শঙ্কর চন্দনাটা ধরতে পেরেছিল ঠিকই, যদিও পাখি ফেরত পাওয়ার পুরো ক্রেডিটটা তার খুদে মক্কেলের কাছে ফেলুদাই পেল।

অমিতাভবাবু ফেলুদাকে অফার করেছিলেন পার্বতীচরণের কালেকশন থেকে একটা কোনো জিনিস বেছে নিতে। ফেলুদা রাজি হল না। বলল, ‘এই কেসটায় আমার জড়িয়ে পড়াটা একটা আকস্মিক ঘটনা। আসলে আমি এসেছিলাম আপনার ছেলের ডাকে। তার কাছ থেকে ত আর ফী নেওয়া যায় না!’

ঘটনার দু’দিন পরে শনিবার সকালে লালমোহনবাবু এসে বললেন, ‘জলের তল পাওয়া যায়, মনের তল পাওয়া দায়। আপনার অতলস্পর্শী চিন্তাশক্তির জন্য আপনাকে একটি অনরারি টাইটেলে ভূষিত করা গেল।

—এ বি সি ডি।’

‘এ বি সি ডি?’

‘এশিয়াজ বেস্ট ক্রাইম ডিটেক্টর।’

————

|| সমাপ্ত ||