৪. বৌবাজার স্ট্রিট

॥ ৪ ॥

একশো তেত্রিশের দুই বৌবাজার স্ট্রীট দেড়শো বছরের পুরনো বাড়ি কিনা জানি না। তবে এত পুরনো বাড়িতে এর আগে আমি কখনো যাইনি তাতে কোনো সন্দেহ নেই। দুটো দোকানের মাঝখানে একটা খিলেনের মধ্যে দিয়ে প্যাসেজ পেরিয়ে কাঠের সিঁড়ি। সেই সিঁড়ি দিয়ে তিনতলায় গিয়ে ডান দিকে ঘুরে সামনেই দরজার উপর পিতলের ফলকে লেখা আর ডি পেস্টনজী। কলিং বেল টিপতেই একজন বেয়ারা এসে দরজা খুলল। ফেলুদা তার হাতে তার নিজের নাম আর পেশা লেখা একটা কার্ড দিয়ে দিল।

মিনিট তিনেক পর বেয়ারা এসে বলল, ‘পাঁচ মিনিটের বেশি সময় দিতে পারবেন না বাবু।’

তাই সই। আমরা তিনজন বেয়ারার সঙ্গে গিয়ে একটা ঘরে ঢুকলাম। বিশাল অন্ধকার বৈঠকখানা, তারই এক পাশে দেয়ালের সামনে সোফায় বসে আছেন ভদ্রলোক। সামনে টেবিলে রাখা বোতলে পানীয় ও গেলাস। গায়ের রং ফ্যাকাশে। নাকটা টিয়া পাখির মতো ব্যাঁকা, চওড়া কপাল জুড়ে মেচেতা।

সোনার চশমার মধ্যে দিয়ে ঘোলাটে চোখে আমাদের দিকে চেয়ে কর্কশ গলায় বললেন, ‘বাট ইউ আর নট ওয়ান ম্যান, ইউ আর এ ক্রাউড!’

ফেলুদা ক্ষমা চেয়ে ইংরাজিতে বুঝিয়ে দিল যে তিন জন হলেও, সে একাই কথা বলবে; বাকি দুজনকে ভদ্রলোক অনায়াসে অগ্রাহ্য করতে পারেন।

‘ওয়েল, হোয়াট ডু ইউ ওয়ণ্ট?’

‘আপনি পার্বতী হালদারকে চিনতেন বোধহয়?’

‘মাই গড্‌, এগেন!’

ফেলুদা হাত তুলে ভদ্রলোককে ঠাণ্ডা করার চেষ্টা করে বলল, ‘আমি পুলিশের লোক নই সেটা আমার কার্ড দেখেই নিশ্চয় বুঝেছেন। তবে ঘটনাচক্রে আমি এই খুনের তদন্তে জড়িয়ে পড়েছি; আমি শুধু জানতে চাইছিলাম—এই যে নেপোলিয়নের চিঠিটা চুরি হয়েছে, সেটা সম্বন্ধে আপনার কী মত।’

পেস্টনজী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, ‘তুমি দেখেছ চিঠিটা?’

ফেলুদা বলল, ‘কী করে দেখব, যেদিন ভদ্রলোকের মৃত্যু, সেদিনেই ত আমি প্রথম গেলাম তার বাড়িতে।’

পেস্টনজী বললেন, ‘নেপোলিয়নের বিষয় পড়েছ ত তুমি?’

‘তা কিছু পড়েছি।’

ফেলুদা গত দু’দিনে নেপোলিয়ন সম্বন্ধে আর পুরনো আর্টিস্টিক জিনিস সম্বন্ধে সিধু জ্যাঠার কাছ থেকে বেশ কিছু বই ধার করে এনে পড়েছে সেটা আমি জানি।

‘সেন্ট হেলেনায় তার শেষ নিবার্সনের কথা জান ত?’

‘তা জানি।’

‘কোন্‌ সালে সেটা হয়েছিল মনে আছে?’

‘১৮১৫।’

ভদ্রলোকের ঠোঁটের কোণে হাসি দেখে বুঝলাম তিনি ইম্‌প্রেস্‌ড হয়েছেন। বললেন, ‘এই চিঠি লেখা হয়েছিল ১৮১৪ খৃষ্টাব্দে। সেন্ট হেলেনায় যে ছ’ বছর বেঁচেছিলেন নেপোলিয়ন সেই সময়টা তাঁকে চিঠি লিখতে দেওয়া হয়নি। তার মানে এই চিঠিটা তাঁর শেষ চিঠিগুলির মধ্যে একটা। কাকে লেখা সেটা জানা যায়নি—শুধু ‘মঁশেরামী’—অর্থাৎ “আমার প্রিয় বন্ধ।” চিঠির ভাব ও ভাষা অপূর্ব। সব হারিয়েছেন তিনি, কিন্তু এই অবস্থাতেও তিনি এক বিন্দু আদর্শচ্যুত হননি। এ চিঠি লাখে এক। জুরিখ শহরে এক সর্বস্বান্ত মাতালের কাছ থেকে জলের দরে এ চিঠি কিনেছিলেন পার্বতী হালদার। আর সে জিনিস আমার হাতে চলে আসত মাত্র বিশ হাজার টাকায়।’

‘কি রকম?’—আমরা সকলেই অবাক—’মাত্র বিশ হাজার টাকায় এ চিঠি আপনাকে বিক্রী করতে রাজি ছিলেন মিঃ হালদার?’

পেস্টনজী মাথা নাড়লেন।—’নো নো। হি ডিডন্‌ট ওয়ণ্ট টু সেল ইট। হালদারের গোঁ ছিল সাংঘাতিক। ওঁর এদিকটা আমি খুব শ্রদ্ধা করতাম।’

‘তাহলে?’

পেস্টনজী গেলাসটা তুলে মুখে খানিকটা পানীয় ঢেলে বললেন, ‘তোমাদের কিছু অফার করতে পারি? চা, বিয়ার—?’

‘না না, আমরা এখুনি উঠব।’

‘ব্যাপারটা আর কিছুই না’ বললেন পেস্টনজী, ‘এটা পুলিশকে বলিনি। ওদের জেরার ঠেলায় আমার ব্লাড প্রেসার চড়িয়ে দিয়েছিল সাংঘাতিকভাবে। ইউ লুক লাইক এ জেন্টলম্যান, তাই তোমাকে বলছি। কাল সকালে একটা বেনামী টেলিফোন আসে। লোকটা সরাসরি আমায় জিজ্ঞেস করে আমি বিশ হাজার টাকায় নেপোলিয়নের চিঠিটা কিনতে রাজি আছি কিনা। আমি তাকে গতকাল রাত্রে আসতে বলি। সে বলে সে নিজে আসবে না, লোক পাঠিয়ে দেবে, আমি যেন তার হাতে টাকাটা দিই। সে এও বলে যে আমি যদি পুলিশে খবর দিই তাহলে আমারও দশা হবে পার্বতী হালদারের মতো।

‘এসেছিল সে লোক?’—আমরা তিনজনেই যাকে বলে উদ্‌গ্রীব, উৎকর্ণ।

পেস্টনজী মাথা নাড়লেন। —’নো। নোবডি কেম।’

আমরা তখনই উঠে পড়তাম, কিন্তু ফেলুদার হঠাৎ পেস্টনজীর পিছনের তাকের উপর রাখা একটা জিনিসের দিকে দৃষ্টি গেছে।

‘ওটা মিং যুগের পোর্সিলেন বলে মনে হচ্ছে?’

ভদ্রলোকের দৃষ্টি উদ্ভাসিত।

‘বাঃ, তুমি ত এসব জানটান দেখছি। এক্স্‌কুইজিট জিনিস।’

‘একবার যদি…’

‘নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই। হাতে নিয়ে না দেখলে বুঝতে পারবে না।’

ভদ্রলোক উঠে গিয়ে জিনিসটার দিকে হাত বাড়িয়েই ‘আউচ!’ বলে যন্ত্রণায় কুঁচকে গেলেন।

‘কী হল?’ ফেলুদা গভীর উৎকণ্ঠার সুরে বলল।

‘আর বোল না! বুড়ো বয়সের যত বিদ্‌ঘুটে ব্যারাম। আরথ্রাইটিস। হাতটা কাঁধের উপর তুলতেই পারি না।’

শেষকালে ফেলুদা নিজেই এগিয়ে গিয়ে তাক থেকে চীনে মাটির পাত্রটা নামিয়ে নিয়ে হাতে করে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখে বার দু-এক ‘সুপার্ব’ বলে আবার যথাস্থানে রেখে দিল।

‘ভদ্রলোকের সত্যিই হাত ওঠে কিনা সেটা যাচাই করা দরকার ছিল’, রাস্তায় এসে বলল ফেলুদা।

‘ধন্যি মশাই আপনার মস্তিষ্ক! বলুন, এবার কোন্‌দিকে?’

‘বলতে সংকোচ হচ্ছে। এবার একেবারে কর্ণওয়ালিস স্ট্রীট।’

‘কেন, সংকোচের কী আছে?’

‘যা দাম হয়েছে আজকাল পেট্রোলের।’

‘আরে মশাই, দাম ত সব কিছুরই বেশি। আমার যে বই ছিল পাঁচ টাকা সেটা এখন এইট রুপীজ। অথচ সেল একেবারে স্টেডি। আপনি ওসব সংকোচ-টংকোচের কথা বলবেন না।’

কর্ণওয়ালিস স্ট্রীটের নতুন থিয়েটার নবরঙ্গমঞ্চে গিয়ে হাজির হলাম। প্রোপ্রাইটারের নাম অভিলাষ পোদ্দার। ফেলুদা কার্ড পাঠাতেই তৎক্ষণাৎ আমাদের ডাক পড়ল। দোতলার আপিস ঘরে ঢুকলাম গিয়ে।

‘আসুন আসুন, কী সৌভাগ্য আমার, স্বনামধন্য লোকের পায়ের ধুলো পড়ল এই গরীবের ঘরে!’

নাদুস নুদুস বার্নিশ করা চেহারাটার সঙ্গে এই বাড়িয়ে কথা বলাটা বেশ মানানসই। হাতে সোনার ঘড়ি, ঠোঁট দুটো টুকটুকে লাল—এই সবে একখিলি পান পুরেছেন মুখে, গা থেকে ভুরভুরে আতরের গন্ধ।

ফেলুদা লালমোহনবাবুকে আলাপ করিয়ে দিল ‘গ্রেট থ্রিলার রাইটার’ বলে।

‘বটে?’ বললেন পোদ্দারমশাই।

‘একটা হিন্দি ফিল্ম হয়ে গেছে আমার গল্প থেকে’, বললেন জটায়ু। ‘বোম্বাইয়ের বোম্বেটে। নাটকও হয়েছে একটা গল্প থেকে। গড়পারের রিক্রিয়েশন ক্লাব করেছিল সেভেনটি এইটে।’

ফেলুদা বলল, ‘আপনার জায়ান্ট অমনিবাস একটা পাঠিয়ে দেবেন না মিস্টার পোদ্দারকে।’

‘সার্টেনলি, সার্টেনলি’, বললেন মিঃ পোদ্দার। ‘আমি নিজে অবিশ্যি বই-টই পড়ি না, তবে আমার মাইনে করা লোক আছে। তারা পড়ে ওপিনিয়ন দেয় আমাকে। তা বলুন মিঃ মিত্তির, আপনার কী কাজে লাগতে পারি।’

‘আপনাদের একটি হিরো সম্বন্ধে ইনফরমেশন চাই।’

‘হিরো? মানস ব্যানার্জি?’

‘অচিন্ত্য হালদার।’

‘অচিন্ত্য হালদার? কই সেরকম নামে ত—ও হো, হ্যাঁ হ্যাঁ, ওই নামে একটি ছেলে ঘোরাঘুরি করছে বটে। একটা বইয়ে একটা পার্টও করেছিল। চেহারা মোটামুটি ভালো, তবে ভয়েসে গণ্ডগোল। বরং সিনেমা লাইনে কিছু হতে পারে। আমি সেই কথাই বলেছি তাকে। ইন ফ্যাক্ট, ছেলেটি আমাকে টাকা অফার করেছে।’

‘মানে? হিরোর ,পার্ট পাবার জন্য?’

‘আপনি আকাশ থেকে পড়লেন যে। এরকম হয় মিঃ মিত্তির।’

‘আপনি আমল দেননি?’

‘নো মিঃ মিত্তির। আমাদের নতুন কোম্পানি, এসব ব্যাপার খুব রিস্কি।

এ প্রস্তাবে রাজি হবার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। ইয়ে—চা, কফি…?’

‘নো, থ্যাঙ্কস।’

আমরা উঠে পড়লাম। দেড়টা বাজে, পেটে বেশ চন্‌চনে খিদে।

রয়েল হোটেলে খাবারের অর্ডার দিয়ে ফেলুদা চন্দনা চুরির ব্যাপারে একটা বিজ্ঞাপনের খসড়া করে ফেলল। ওর চেনা আছে খবরের কাগজের আপিসে; সম্ভব হলে কালকে না হয় লেটেস্ট পরশু কাগজে বেরিয়ে যাবে। গত দশ দিনের মধ্যে নিউ মার্কেটে তিনকড়িবাবুর দোকানে কেউ যদি একটা চন্দনা বিক্রী করে থাকেন, তাহলে তিনি যেন নিম্নলিখিত ঠিকানায়, ইত্যাদি।

বিরিয়ানি খেতে খেতে একটা নলী হাড় কামড় দিয়ে ভেঙে ম্যারোটা মুখে পুরে ফেলুদা বলল, ‘রহস্য যেরকম উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে, কোথাকার জল কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় বলা মুশকিল।’

‘দাঁড়ান দাঁড়ান, দেখি গেস্‌ করতে পারি কিনা’, বললেন লালমোহনবাবু, ‘এই নতুন রহস্য হচ্ছে—সেই লোক চিঠি নিয়ে আসবে বলে এল না কেন, এই ত?’

‘ঠিক ধরেছেন। আমার মতে এর মানে একটাই। সে লোক চিঠিটা পাবে বলে আশা করেছিল, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পায়নি।’

আমি বললাম, ‘তার মানে যে চুরি করেছে সে নয়, অন্য লোক।’

‘তাইত মনে হচ্ছে।’

‘ওরেব্বাস’, বললেন লালমোহনবাবু, ‘তার মানে ত একজন ক্রিমিন্যাল বাড়ল।’

‘আচ্ছা ফেলুদা’—এ প্রশ্নটা কদিন থেকেই আমার মাথায় ঘুরছে—’পেপারওয়েট দিয়ে মাথায় মারলে লোক মরবেই এমন কোনো গ্যারান্টি আছে কি?’

‘গুড কোয়েশ্চেন’, বলল ফেলুদা। ‘উত্তর হচ্ছে, না নেই। তবে এক্ষেত্রে যে মেরেছে তার হয়ত ধারণা ছিল মরবেই।’

‘কিম্বা অজ্ঞান করে জিনিসটা নিতে চেয়েছিল; মরে যাবে ভাবেনি।’

‘রয়েলের খাওয়া যে ব্রেন টনিকের কাজ করে সেটাত জানতাম না। তুই ঠিক বলেছিস তোপ্‌সে। সেটাও একটা পসিব্‌ল ব্যাপার। কিন্তু সেগুলো জানলেও যে এ ব্যাপারে খুব হেল্‌প হচ্ছে তা ত নয়। যে লোকটাকে দরকার সে এমন আশ্চর্য ভাবে গা ঢাকা দিয়েছে যে ঘটনাটা প্রায় অসম্ভবের পর্যায়ে পড়ে।’

অবিশ্যি ভ্যানিশ যে করেনি সে লোক সেটা সন্ধেবেলা জানতে পারলাম, আর সেটা ঘটল বেশ নাটকীয় ভাবে।

সেটা বলার আগে জানানো দরকার যে সাড়ে চারটের সময় হাজরা ফোন করে জানালেন বারাসতে সাধন দস্তিদারের কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি।

লালমোহনবাবু হোটেল থেকে আর বাড়ি ফেরেননি। আমাদের পৌঁছে দিয়ে আমাদের এখানেই রয়ে গিয়েছিলেন। সাড়ে সাতটার সময় শ্রীনাথ আমাদের কফি এনে দিয়েছে, এমন সময় কলিং বেল বেজে উঠল। শীতকালের সন্ধে, পাড়াটা এর মধ্যেই নিঝুম, তাই বেলের শব্দে বেশ। চমকে উঠেছিলাম।

দরজা খুলে আরো এক চমক।

এসেছেন হৃষিকেশবাবু।

‘কিছু মনে করবেন না—অসময়ে খবর না দিয়ে এসে পড়লাম—আমাদের টেলিফোনটা ফাঁকা পাওয়া যাচ্ছে না মিঃ হালদারের মৃত্যুর পর থেকেই…’

শ্রীনাথকে বলতে হয় না, সে নতুন লোকের গলা পেয়েই আরেক কাপ কফি দিয়ে গেল।

ফেলুদা বলল, ‘আপনাকে বেশ উত্তেজিত মনে হচ্ছে। বসে ঠাণ্ডা হয়ে কী ঘটনা বলুন।’

হৃষিকেশবাবু কফিতে একটা চুমুক দিয়ে দম নিয়ে বললেন, ‘আপনি আমার একতলার ঘরটা দেখেননি, তবে আমি বলতে পারি ও ঘরটায় থাকতে বেশ সাহসের দরকার হয়। অতবড় বাড়ির একতলায় আমি একমাত্র বাসিন্দা। চাকরদের আলাদা কোয়ার্টারস আছে। এ ক’বছরে অভ্যেস খানিকটা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু পুরোপুরি হয় না। সন্ধে থেকে গাটা কেমন ছমছম করে। যাই হোক, কাল রাত্তিরে, তখন সাড়ে দশটা হবে, আমি খাওয়া সেরে ঘরে এসে দরজা বন্ধ করে মশারিটা ফেলেছি সবে, এমন সময় দরজায় টোকা পড়ল। সত্যি বলতে কি, নক্ করার লোক ও বাড়িতে কেউ নেই। যারা আমাকে চায় তারা বাইরে থেকে হাঁক দেয়—এমন কি চাকর-বাকরও। কাজেই বুঝতেই পারছেন, আমার মনে বেশ একটু খট্‌কা লাগল। খোলার আগে জিজ্ঞেস করলুম, কে? উত্তরের বদলে আবার টোকা পড়ল। একবার ভাবলুম খুলব না। কিন্তু সারারাত যদি ওই ভাবে খট্‌খট্‌ চলে তাহলে ত আরো গণ্ডগোল। তাই কোনোরকমে সাহস সঞ্চয় করে যা থাকে কপালে করে দরজাটা খুললুম; খোলামাত্র একটি লোক ঢুকে এসে দরজাটা বন্ধ করে দিল। তখনও মুখ দেখিনি; তারপর আমার দিকে ফিরতে চাপ দাড়ি দেখে আন্দাজ করলুম কে। ভদ্রলোক আমাকে কোন কথা বলতে না দিয়ে সোজা গড়গড় করে তাঁর কথা বলে গেলেন এবং যতক্ষণ বললেন ততক্ষণ তাঁর ডান হাতে একটি ছোরা সোজা আমার দিকে পয়েন্ট করা।’

বর্ণনা শুনে আমারই ভয় করছিল। লালমোহনবাবুর দেখলাম মুখ হাঁ হয়ে গেছে।

‘কী বললেন সাধন দস্তিদার?’ প্রশ্ন করল ফেলুদা।

‘সাংঘাতিক কথা’, বললেন হৃষিকেশবাবু। ‘মিঃ হালদারের কালেকশনে কী জিনিস আছে তা যেমন মোটামুটি আমি জানি, তেমনি ইনিও জানেন। বললেন বাহাদুর শা-র যে পান্না বসানো সোনার জর্দার কৌটোটা মিঃ হালদারের সংগ্রহে রয়েছে, সেটার একজন ভালো খদ্দের পাওয়া গেছে, সেটা তার চাই। আমি যেন আজ রাত্তিরে এগারোটার সময় মধুমুরলীর দিঘির ধারে ভাঙা নীলকুঠির পাশে শ্যাওড়া গাছটার নিচে ওয়েট করি—ও এসে নিয়ে যাবে।’

‘এই যে কাজটা করতে বলেছে তার জন্য আপনার পারিশ্রমিক কী?’

‘কচু পোড়া। এতো হুমকির ব্যাপার। বললে যদি পুলিশে খবর দিই তাহলে নির্ঘাৎ মৃত্যু।’

‘রাত্তিরে দারোয়ান গেটে থাকে না?’

‘থাকে বৈকি, কিন্তু আমার ধারণা হয়েছে লোকটা পাঁচিল টপকে আসে।’

‘আপনার ঘর চিনল কি করে?’

‘সাধু দস্তিদারও ত ওই ঘরেই থাকত—চিনবে না কেন?’

‘ভদ্রলোকের ডাক নাম সাধু ছিল বুঝি?’

‘মিঃ হালদারকে ত সেই নামই বলতে শুনেছি!’

‘আপনি তাকে কী বললেন?’ জিজ্ঞেস করল ফেলুদা।

‘আমি বললুম, এখন মিঃ হালদারের জিনিসপত্রে কড়া পাহারা, সে কৌটো আমি নেব কি করে? সে বললে, চেষ্টা করলেই পারবে। তুমি মিঃ হালদারের সেক্রেটারি ছিলে; জরুরী কাগজপত্র দেখার জন্য তোমার সে ঘরে ঢোকার সম্পূর্ণ অধিকার আছে; ব্যস্—এই বলেই সে চলে গেল। আমি জানি আপনি ছি ছি করবেন, বলবেন পুলিশে খবর দেওয়া উচিত ছিল, অন্তত বাড়ির লোককে জানানো উচিত ছিল। কিন্তু প্রাণের ভয়ের মতো ভয় আর কী আছে বলুন। আপনার কথাটাই মনে হল। আপনিও যে তদন্ত করছেন সেটা আমার মনে হয় সাধু জানে না।’

‘আপনি তাহলে কৌটো বার করেননি।’

‘পাগল!’

‘আপনি কি প্রস্তাব করছেন যে আমরা সেখানে যাই?’

‘আপনারা যদি একটু আগে গিয়ে গা ঢাকা দিয়ে থাকেন—আমি গেলাম এগারোটায়—তারপর সে এলে যা করার দরকার সে ত আপনিই ভালো বুঝবেন। এইভাবে হাতেনাতে লোকটাকে ধরার সুযোগ ত আর পাবেন না।’

‘পুলিশকে খবর দেব না বলছেন?’

‘অমন সর্বনাশের কথা উচ্চারণ করবেন না, দোহাই। আপনি আসুন, সঙ্গে এঁদেরও নিতে পারেন। তবে সশস্ত্র অবস্থায় যাবেন, কারণ লোকটা ডেঞ্জারাস।’

‘লেগে পড়ুন’, বিনা দ্বিধায় বললেন লালমোহনবাবু। ‘রাজস্থানের ডাকাত যখন আমাদের পেছু হটাতে পারেনি, তখন এর কাছে কী ভয়? এতো নস্যি মশাই।’

‘আমি অবিশ্যি জায়গাটা দেখিয়ে দেব’, বললেন হৃষিকেশবাবু; ‘মেন রোড ছেড়ে খানিকটা ভেতর দিকে যেতে হয়। স্টেশন থেকে মাইল চারেক।’

ফেলুদা রাজি হয়ে গেল। হৃষিকেশবাবু কফি শেষ করে উঠে পড়ে বললেন, ‘দশটা নাগাদ তাহলে আপনারা মীট করছেন আমাকে।’

‘কোথায়?’

‘আমাদের বাড়ি ছাড়িয়ে দু ফার্লং গেলেই একটা তেমাথার মোড় পাবেন। সেখানে দেখবেন একটা মিষ্টির দোকান। সেই দোকানের সামনে থাকব আমি।’