৪২. সূক্ষ্মস্থূল ভূতাদির সৃষ্টিবিস্তার

৪২তম অধ্যায়

সূক্ষ্মস্থূল ভূতাদির সৃষ্টিবিস্তার

“ব্রহ্মা বলিলেন, “হে তপোধনগণ! অহঙ্কার হইতে পৃথিবী, বায়ু, আকাশ, জল ও জ্যোতি এই পঞ্চ মহাভূত সমুৎপন্ন হইয়াছে। প্রাণীগণ ঐ পাঁচ মহাভূতে বিলীন হইয়া থাকে। ঐ মহাভূতসমুদয় নাশ হইতে আরম্ভ হইলেই প্রলয়কাল সমুপস্থিত হয়। ঐ প্রলয়কালে প্রাণীগণের ভয়ের আর পরিসীমা থাকে না। ঐ সময় যে যে মহাভূত যাহা হইতে উৎপন্ন হয়, সেই সেই মহাভূত তৎসমুদয়েই বিলীন হইয়া থাকে। এইরূপে স্থাবর-জঙ্গমাত্মক সমুদয় ভূত বিলীন হইলেও স্মরণজ্ঞানযুক্ত যোগিগণের লয় হয় না। উঁহারা সূক্ষ্মশরীর ধারণপূৰ্ব্বক ব্রহ্মলোকে অবস্থান করিয়া থাকেন। শব্দাদি বিষয়সমুদয় সূক্ষ্ম; এই নিমিত্ত প্রলয়কালে উহাদিগের ধ্বংস হয় না। সুতরাং উহাদিগকে নিত্য আর স্থূলপদার্থসমুদয়কে অনিত্য বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। কৰ্ম্মসমুৎপন্ন, মাংসশোণিতসংযুক্ত, অকিঞ্চিৎকর বাহ্য শরীরসমুদয় স্থূলপদার্থ এবং প্রাণ, অপান, সমান, উদান ও ব্যান এই পঞ্চ বায়ু আর বাক্য, মন ও বুদ্ধি এই কয়েকটি অন্তরস্থিত পদার্থ সূক্ষ্মপদার্থ বলিয়া পরিগণিত হইয়া থাকে। যে ব্যক্তি ঘ্রাণাদি পাঁচ ইন্দ্রিয়, বাক্য, মন ও বুদ্ধিকে বশীভূত করিতে সমর্থ হয়েন, তিনি অনায়াসেই পরাৎপর পরব্রহ্মকে লাভ করিতে পারেন।

‘এক্ষণে অহঙ্কার হইতে সমুৎপন্ন একাদশ ইন্দ্রিয়ের বিষয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা, ত্বক, পাদ, পায়ু, উপস্থ, হস্ত, বাক্য ও মন এই একাদশটিকে ইন্দ্রিয় বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। যিনি এই ইন্দ্রিয়সমুদয়কে পরাজয় করিতে সমর্থ হয়েন, তাঁহার হৃদয়েই পরমপদার্থ পরব্রহ্ম উদ্ভাসিত হইতে থাকেন। ঐ ইন্দ্রিয়সমুদয়ের মধ্যে নেত্ৰ-কৰ্ণাদি পাঁচটিকে জ্ঞানেন্দ্রিয়, পদাদি পাঁচটিকে কৰ্ম্মেন্দ্রিয় ও মনকে জ্ঞানকৰ্ম্মেন্দ্রিয় বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। যেসকল পণ্ডিত এই ইন্দ্রিয়তত্ত্ব সবিশেষ অবগত হইতে পারেন, তাঁহারাই যথার্থ কৃতার্থতালাভে সমর্থ হয়েন।

‘অতঃপর আমি জ্ঞানেন্দ্রিয়সমুদয়ের বিষয় বিশেষরূপে কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। আকাশ প্রথম ভূত; কর্ণ উহার অধ্যাত্ম (ইন্দ্রিয়), শব্দ উহার অধিভূত (বিষয়) এবং দিকসমুদয় উহার অধিদেবতা (অধিষ্ঠাত্রী দেবতা)। বায়ু দ্বিতীয় ভূত; ত্বক্ উহার অধ্যাত্ম, স্পর্শ উহার অধিভূত এবং বিদ্যুৎ উহার অধিদেবতা। তেজ তৃতীয় ভূত; চক্ষু উহার অধ্যাত্ম, রূপ উহার অধিভূত এবং সূৰ্য্য উহার অধিদেবতা। জল চতুর্থ ভূত; জিহ্বা উহার অধ্যাত্ম, রস উহার অধিভূত এবং চন্দ্র উহার অধিদেবতা। পৃথিবী পঞ্চম ভূত; ঘ্রাণ উহার অধ্যাত্ম, গন্ধ উহার অধিভূত এবং বায়ু উহার অধিদেবতা।

‘অতঃপর প্রত্যেক কৰ্ম্মেন্দ্রিয়ের বিষয় বিশেষরূপে নির্দ্দেশ করিতেছি, শ্রবণ কর। চরণ অধ্যাত্ম, গন্তব্য স্থান উহার অধিভূত ও বিষ্ণু উহার অধিদেবতা। পায়ু অধ্যাত্ম, পুরীষপরিত্যাগ উহার অধিভূত ও মিত্র উহার অধিদেবতা। উপস্থ অধ্যাত্ম, শুক্র উহার অধিভূত ও প্রজাপতি উহার অধিদেবতা। হস্ত অধ্যাত্ম, কৰ্ম্ম উহার অধিভূত ও ইন্দ্র উহার অধিদেবতা। বাক্য অধ্যাত্ম, বক্তব্য উহার অধিভূত ও বহ্নি উহার অধিদেবতা। মনঃ অধ্যাত্ম, সঙ্কল্প উহার অধিভূত ও চন্দ্ৰমাঃ উহার অধিদেবতা। অহঙ্কার অধ্যাত্ম, অভিমান উহার অধিভূত ও রুদ্র উহার অধিদেবতা। বুদ্ধি অধ্যাত্ম, মন্তব্য উহার অধিভূত ও ব্রহ্মা উহার অধিদেবতা।

‘জীবগণের জল, স্থল ও আকাশ এই তিন প্রকার ভিন্ন অন্য কোন বাসস্থান নাই। উহারা অণ্ডজ, স্বেদজ, জরায়ুজ ও উদ্ভিজ্জ এই চারি প্রকারে বিভক্ত হইয়াছে। ঐ চারি প্রকার জীবমধ্যে পক্ষী ও সরীসৃপগণ অণ্ডজ, কৃমিগণ স্বেদজ, বৃক্ষলতাদি উদ্ভিজ্জ এবং মনুষ্য ও চতুষ্পদ প্রাণীগণ জরায়ুজ বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হইয়া থাকে। ব্রাহ্মণ দুই প্রকার—তপস্বী ও যাজ্ঞিক। বৃদ্ধজনেরা কহেন যে, ব্রাহ্মণকুলে জন্মগ্রহণ করিয়া বেদাধ্যয়ন, যজ্ঞ ও দান করা সৰ্ব্বতোভাবে কৰ্ত্তব্য। যে ব্যক্তি এই বৃদ্ধানুশাসন বিলক্ষণরূপে অবগত হয়েন, তাঁহার পাপের লেশমাত্র থাকে না।

‘হে ঋষিগণ! এই আমি তোমাদিগের নিকট অধ্যাত্মবিধি সবিশেষ কীৰ্ত্তন করিলাম। জ্ঞানবান্ ব্যক্তিরা এই অধ্যাত্মবিষয় বিশেষরূপে অবগত হইয়া থাকেন। ইন্দ্রিয়, গন্ধাদি বিষয় ও পঞ্চমহাভূতের বিষয় সবিশেষ অনুসন্ধান করিয়া মনোমধ্যে ধারণ করা অবশ্য কর্ত্তব্য। মনঃ নিস্তেজ হইলে কখন জন্মজন্য সুখলাভ হয় না। জ্ঞানবান ব্যক্তিরা অনায়াসেই সেই সুখলাভ করিতে সমর্থ হয়েন।

নিবৃত্তিধৰ্ম্ম-কথন

‘হে ঋষিগণ! অতঃপর আমি তোমাদিগের নিকট নিবৃত্তিবিষয়ক উপদেশ সবিস্তর কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর।

‘পণ্ডিতেরা গুণবিহীন, অভিমানশূন্য, অভেদদর্শী ব্রাহ্মণের সুখকে সৰ্ব্বসুখের আধার বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া থাকেন। কূৰ্ম্ম যেমন দেহমধ্যে স্বীয় অঙ্গসমুদয় সঙ্কুচিত করে, তদ্রূপ যে মহাত্মা রজোগুণ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক স্বীয় কামনাসমুদয়কে সঙ্কুচিত করিয়া বিষয়বাসনা পরিত্যাগ করিতে পারেন, তিনিই যথার্থ সুখী। যে ব্যক্তি বিষয়তৃষ্ণাবিহীন, সমাহিত ও সৰ্ব্বভূতের সুহৃৎ হইয়া কামনাসমুদয় সংযমিত করিতে সমর্থ হয়েন, তিনিই ব্রহ্মের স্বরূপত্ব লাভ করিতে পারেন। ইন্দ্রিয়রোধদ্বারাই নিঃশঙ্ক মহাত্মাদিগের বিজ্ঞানানল প্রজ্বলিত হয়। যেমন কাষ্ঠদ্বারা হুতাশনের জ্যোতি স্পষ্টরূপে প্রকাশিত হয়, তদ্রূপ ইন্দ্রিয়রোধদ্বারা পরমাত্মা প্রকাশ হইয়া থাকে। যোগপরায়ণ মহাত্মা যখন নিৰ্ম্মলচিত্ত হইয়া আত্মহৃদয়ে সৰ্ব্বভূতকে দর্শন করিতে পারেন, তখনই তিনি স্বয়ং জ্যোতিঃস্বরূপ হইয়া সূক্ষ্ম হইতেও সূক্ষ্ম পরব্রহ্মকে লাভ করিতে সমর্থ হয়েন।

মনুষ্যের পাঞ্চভৌতিক স্থূলদেহে অগ্নি বর্ণরূপে, সলিল শোণিতাদিরূপে, বায়ু ত্বকরূপে, পৃথিবী অস্থি ও মাংসাদিরূপে এবং আকাশ শ্রবণরূপে অবস্থান করে। ঐ দেহে রোগ, শোক, পাঁচ ইন্দ্রিয়ের স্রোত, নবদ্বার, ত্রিগুণ ও তিন ধাতু সতত’বিদ্যমান থাকে। জীবাত্মা ও পরমাত্মা ইহার অধিষ্ঠাত্রী দেবতা এবং উহা বিনশ্বর বুদ্ধির অধীন, ব্যাধিসমাক্রান্ত ও মলিন বলিয়া নির্দ্দিষ্ট হইয়া থাকে।

‘অমরগণসম্বলিত [দেবগণের সহিত] সমুদয় জগতের উৎপত্তি, বিনাশ ও রোধের কারণস্বরূপ কালচক্র ঐ শরীরের উদ্দেশেই নিরন্তর পরিভ্রমণ করিতেছে। মনুষ্য ঐ শরীরান্তর্গত ইন্দ্রিয়সমুদয়কে রুদ্ধ করিতে পারিলেই অপরিহার্য্য কাম, ক্রোধ, ভয়, লোভ, অভিদ্রোহ ও মিথ্যাপ্রবৃত্তি পরিত্যাগ করিতে সমর্থ হয়। যে ব্যক্তি ঐ পাঞ্চভৌতিক স্থূলদেহের অভিমান পরিত্যাগ করেন, তিনিই হৃদয়াকাশে পরব্রহ্মের সাক্ষাৎকার লাভ করিতে পারেন। যে ব্যক্তি পঞ্চেন্দ্রিয়রূপ মহাকূলযুক্ত [প্রশস্ত তীরভূমিযুক্ত], মনোবেগরূপ সলিলরাশিদ্বারা সমাকীর্ণ, মোহহ্রদসম্বলিত, ভয়ঙ্কর দেহনদী উত্তীর্ণ হইয়া কামক্রোধ পরাজয় করিতে পারেন, তিনি সৰ্ব্বদোষ হইতে বিমুক্ত হইয়া পরব্রহ্মের সাক্ষাৎকার লাভে সমর্থ হয়েন। যোগশীল ব্যক্তি হৃৎপদ্মে মনকে সংস্থাপিত করিয়া পরমাত্মাকে দর্শন করিয়া থাকেন। যেমন একমাত্র দীপ হইতে শত শত দীপ প্রকাশিত হয়, তদ্রূপ একমাত্র পরব্রহ্মের প্রভাবে তাঁহার হৃদয়ে বিবিধ রূপের আবির্ভাব হইয়া থাকে। ঐ মহাত্মা বিষ্ণু, মিত্র, বরুণ, অগ্নি, প্রজাপতি, ধাতা, বিধাতা, প্রভু, সর্ব্বব্যাপী এবং সৰ্ব্বভূতের হৃদয় ও আত্মা বলিয়া অভিহিত হয়েন। ব্রাহ্মণ, সুর, অসুর, যক্ষ, পিশাচ, পিতৃলোক, পক্ষী, রাক্ষস, ভূত ও মহর্ষিগণ নিরন্তর উহার স্তব করিয়া থাকেন।