‘মর্নিং হেরাল্ড’, ২২ অক্টোবর, ১৮৯৪
গত রাত্রে ভ্রূম্যান ভ্রাতৃমণ্ডলী কর্তৃক আয়োজিত ‘প্রাণবন্ত ধর্ম’ পর্যায়ের দ্বিতীয় বক্তৃতায় লাইসিয়াম থিয়েটার লোকের ভিড়ে পুরাপুরি ভরিয়া গিয়াছিল। শ্রোতাদের সংখ্যা তিন হাজার হইবে … বক্তৃতা করেন রেভারেণ্ড হিরাম ভ্রূম্যান, রেভারেণ্ড ওয়াল্টার ভ্রূম্যান এবং এই শহরে (বাল্টিমোর) সম্প্রতি আগত ব্রাহ্মণ ধর্মযাজক রেভারেণ্ড স্বামী বিবেকানন্দ। বক্তারা সকলেই ষ্টেজের উপর বসিয়াছিলেন। রেভারেণ্ড বিবেকানন্দ সকলেরই বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করিতেছিলেন।
তিনি একটি হলুদ রঙের পাগড়ি এবং লাল রঙের আলখাল্লা পরিয়াছিলেন। আলখাল্লার কটিবন্ধটিও লাল রঙের। এই পোষাক তাঁহার প্রাচ্য চেহারার মর্যাদা বাড়াইয়াছিল এবং তাঁহার প্রতি একটি অদ্ভুত আকর্ষণ সৃষ্টি করিয়াছিল। তাঁহার ব্যক্তিত্বই গতরাত্রের অনুষ্ঠানটিকে যেন জমাইয়া রাখিয়াছিল। সহজভাবে একটুও বিব্রত বোধ না করিয়া তিনি ভাষণটি বলিয়া গেলেন। উহার ভাষা নিখুঁত, উচ্চারণ—ইংরেজী ভাষা-জানা কোন সুশিক্ষিত ল্যাটিন-জাতীয় ব্যক্তির ন্যায়। তাঁহার বক্তৃতার কিয়দংশ দেওয়া হইতেছেঃ
খ্রীষ্টের জন্মের ৬০০ বৎসর আগে বুদ্ধ তাঁহার ধর্মপ্রচার আরম্ভ করেন। তিনি দেখিলেন, ভারতবর্ষে তখন ধর্ম প্রধানতঃ মানুষের আত্মার প্রকৃতি লইয়া অন্তহীন বাদ-বিতণ্ডায় ব্যাপৃত। ধর্মজীবনের প্রত্যবায়সমূহের অপনোদনের জন্য তদানীন্তন ধর্মের শিক্ষায় প্রাণিহত্যা যাগযজ্ঞ এবং অনুরূপ প্রণালীগুলির উপরই নির্ভর করা হইত।
বৌদ্ধধর্মের যিনি প্রতিষ্ঠাতা, তিনি এইরূপ ধর্মব্যবস্থার মধ্যে একটি অভিজাত বংশে জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। প্রথম কথা এই যে, তিনি কোন নূতন ধর্ম প্রচলিত করেন নাই, তাঁহার আন্দোলন ছিল সংস্কারমূলক। সকলের হিত-কামনা ছিল তাঁহার লক্ষ্য। তাঁহার উপদিষ্ট ধর্ম তিনটি আবিষ্কারের মধ্যে নিহিত। প্রথম—অশুভ আছে। দ্বিতীয়—এই অশুভের কারণ কি? বুদ্ধ বলিলেন, অশুভের কারণ মানুষের অপরের উপর প্রাধান্য-লাভের কামনা। তৃতীয়—নিঃস্বার্থপরতা দ্বারা এই দোষ দূর করা যাইতে পারে। বুদ্ধের মতে—বল প্রকাশ করিয়া ইহার প্রতিরোধ সম্ভবপর নয়। ময়লা দিয়া ময়লা ধোয়া যায় না; ঘৃণার দ্বারা ঘৃণা নিবারিত হয় না।
ইহাই হইল বুদ্ধের ধর্মের ভিত্তি। যতক্ষণ সমাজ মানুষের স্বার্থপরতা এমন সব আইন-কানুন ও সংস্থার মাধ্যমে প্রতিবিধান করিবার চেষ্টা করে, যেগুলির লক্ষ্য হইল জোর করিয়া মানুষকে প্রতিবেশীদের হিতসাধনে প্রযোজিত করা, ততক্ষণ কোন সুফল হইবার নয়। কৌশলের বিরুদ্ধে কৌশলকে, হিংসার বিরুদ্ধে হিংসাকে না লাগানই হইল কার্যকর পন্থা। নিঃস্বার্থ নরনারী সৃষ্টি করাই হইল একমাত্র প্রতীকার। বর্তমানের অশুভগুলি দূর করিবার জন্য আইন চালু করা যাইতে পারে, কিন্তু উহাতে বিশেষ কোন ফল হইবে না।
বুদ্ধ দেখিয়াছিলেন, ভারতে ঈশ্বর এবং তাঁহার স্বরূপ লইয়া অত্যধিক জল্পনা চলে, কিন্তু প্রকৃত কাজ হয় অতি সামান্য। এই মুখ্য সত্যটির উপর তিনি সর্বদা জোর দিতেনঃ আমাদিগকে সৎ এবং পবিত্র হইতে হইবে এবং অপরকে পবিত্র হইবার জন্য সাহায্য করিতে হইবে। তিনি বিশ্বাস করিতেন, মানুষকে উদ্যমশীল হইয়া অপরের উপকার সাধনে লাগিতে হইবে, অন্যের মধ্যে নিজের আত্মাকে, অন্যের ভিতর নিজের জীবনকে খুঁজিয়া পাইতে হইবে। অপরের কল্যাণ-সাধনের দ্বারাই আমরা নিজেদের মঙ্গল বিধান করি। বুদ্ধ বুঝিয়াছিলেন, জগতে সর্বদাই অত্যধিক পরিমাণে মতবাদ চলিতে থাকে, তদনুপাতে কার্যতঃ অভ্যাস দেখা যায় খুব কম। বর্তমানকালে বুদ্ধের মত ১২ জন লোক যদি ভারতে থাকেন তো ঐ দেশের পক্ষে পর্যাপ্ত। এই দেশে একজন বুদ্ধ পাওয়া গেলে প্রভূত কল্যাণ হইবে।
ধর্মীয় মতবাদ যখন বৃদ্ধি পায়, পিতৃপুরুষের ধর্মে অন্ধবিশ্বাস যখন প্রবল হয় এবং কুসংস্কারকে যখন যুক্তি দ্বারা সমর্থনের চেষ্টা চলে, তখন একটি পরিবর্তনের প্রয়োজন হইয়া পড়ে। কেননা ঐ-সকলের দ্বারা মানুষের অনিষ্টই বাড়িতে থাকে, উহাদের শোষণ না হইলে মানুষের কল্যাণ নাই।
মিঃ বিবেকানন্দের বক্তৃতার শেষে শ্রোতৃবৃন্দ স্বতঃস্ফূর্ত হর্ষধ্বনি দ্বারা তাঁহাকে অভিনন্দিত করেন।
‘বাল্টিমোর আমেরিকান’, ২২ অক্টোবর, ১৮৯৪
‘প্রাণবন্ত ধর্ম’ সম্বন্ধে ভ্রূম্যান ভ্রাতৃমণ্ডলী যে বক্তৃতামালার ব্যবস্থা করিয়াছেন, তাহার দ্বিতীয়টি শুনিবার জন্য গত রাত্রে লাইসিয়াম থিয়েটার গৃহ লোকে সম্পূর্ণ ভরিয়া গিয়াছিল। প্রধান বক্তা ছিলেন ভারতের স্বামী বিবেকানন্দ। তিনি বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধে বলেন এবং বুদ্ধের জন্মের সময় ভারতবাসীর মধ্যে যে-সব দোষ ছিল, তাহার উল্লেখ করেন। ঐসময়ে ভারতে সামাজিক অসাম্য পৃথিবীর অন্য যে-কোন অঞ্চল অপেক্ষা হাজার গুণ বেশী ছিল। খ্রীষ্টের জন্মের ছয়শত বৎসর পূর্বে ভারতীয় জনগণের মনে পুরোহিত সম্প্রদায়ের খুব প্রভাব ছিল। বুদ্ধি-বিচার এবং বিদ্যাবত্তা—পেষণযন্ত্রের এই দুই পাথরের মধ্যে পড়িয়া জনসাধারণ নিষ্পিষ্ট হইতেছিল।
বৌদ্ধধর্ম একটি নূতন ধর্মরূপে স্থাপিত হয় নাই; বরং উহার উৎপত্তি হইয়াছিল সেই সময়কার ধর্মের অবনতির সংশোধকরূপে। বুদ্ধই বোধ করি একমাত্র মহাপুরুষ, যিনি নিজের দিকে বিন্দুমাত্র না তাকাইয়া সকল উদ্যম পরহিতে নিয়োগ করিয়াছিলেন। মানুষের দুঃখকষ্ট-রূপ ভীষণ ব্যাধির ঔষধ অন্বেষণের জন্য তিনি গৃহ এবং জীবনের সকল ভোগসুখ বিসর্জন দিয়াছিলেন। যে যুগে পণ্ডিত এবং পুরোহিতকুল ঈশ্বরের স্বরূপ লইয়া বৃথা তর্ক-বিতর্কে ব্যস্ত, বুদ্ধ সেই সময়ে মানুষ যাহা খেয়াল করে না, জীবনের সেই একটি বিপুল বাস্তব সত্য আবিষ্কার করিলেন—দুঃখের অস্তিত্ব। আমরা অপরকে ডিঙাইয়া যাইতে চাই এবং আমরা স্বার্থপর বলিয়াই পৃথিবীতে এত অনিষ্ট ঘটে। যে মুহূর্তে জগতের সকলে নিঃস্বার্থ হইতে পারিবে, সেই মুহূর্তে সকল অশুভ তিরোহিত হইবে। সমাজ যতদিন আইন-কানুন এবং সংস্থাসমূহের মাধ্যমে অকল্যাণের প্রতীকার করিতে সচেষ্ট, ততদিন ঐ প্রতিকার অসম্ভব। হাজার হাজার বৎসর ধরিয়া জগৎ ঐ প্রণালী অবলম্বন করিয়া দেখিয়াছে; কোন ফল হয় নাই। হিংসা দ্বারা হিংসা জয় করা যায় না। নিঃস্বার্থপরতা দ্বারাই সকল অশুভ নিবারিত হয়। নূতন নূতন নিয়ম না করিয়া মানুষকে পুরাতন নিয়মগুলি পালন করিবার শিক্ষা দিতে হইবে। বৌদ্ধধর্ম পৃথিবীর প্রথম প্রচারশীল ধর্ম, তবে অপর কোন ধর্মের প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করা বৌদ্ধধর্মের অন্যতম শিক্ষা। সাম্প্রদায়িকতা মানবগোষ্ঠীর ভিতর পারস্পরিক সংঘর্ষ আনিয়া কল্যাণশক্তি হারাইয়া ফেলে।