॥ ৩ ॥
পথে শ্রীনগরে থেমে চা খেয়ে রুদ্রপ্রয়াগ পৌঁছতে পৌঁছতে হয়ে গেল প্রায় পাঁচটা। ইস্কুল কলেজ হাসপাতাল পোস্টাপিস থানা সব মিলিয়ে রুদ্রপ্রয়াগ বেশ বড় শহর। করবেট যেখানে লেপার্ডটা মেরেছিল সেখানে অনেকদিন পর্যন্ত নাকি একটা সাইনবোর্ড ছিল, কিন্তু যোগীন্দর বলল সেটা নাকি কয়েক বছর হল ভেঙে গেছে।
আমরা সোজা চলে গেলাম গাড়ওয়াল নিগম রেস্ট হাউসে। শহরের একটু বাইরে সুন্দর নিরিবিলি জায়গায় তৈরি রেস্ট হাউসে গিয়ে যে খবরটা প্রথমেই শুনলাম সেটা হল যে কেদারনাথের রাস্তায় এক জায়গায় ধস নামাতে নাকি বাস চলাচল বেশ কয়েকদিন বন্ধ ছিল, আজই আবার নতুন করে শুরু হয়েছে। এতে যে আমাদের একটা বড়রকম সুবিধে হয়েছিল সেটা পরে বুঝেছিলাম।
ম্যানেজার মিঃ গিরিধারী ফেলুদাকে না চিনলেও আমাদের খুব খাতির করলেন। উনি নাকি হিন্দি অনুবাদে বহু বাংলা উপন্যাস পড়ে খুব বাঙালী ভক্ত হয়ে পড়েছেন। ওঁর ফেভারিট অথরস হচ্ছেন বিমল মিত্র আর শংকর।
মিঃ গিরিধারী ছাড়াও আরেকজন ভদ্রলোক ছিলেন রেস্ট হাউসে,তিনি কেদারের পথ বন্ধ বলে আটকা পড়ে গিয়েছিলেন। ইনি কিন্তু ফেলুদাকে দেখে চিনে ফেললেন। বললেন, ‘আমি একজন সাংবাদিক, আমি আপনার অনেক কেসের খবর জানি; সেভেনটি নাইনে এলাহাবাদে সুখতঙ্কর মাডার কেসে আপনার ছবি বেরিয়েছিল নর্দার্ন ইণ্ডিয়া পত্রিকায়। সেই থেকেই আমি আপনাকে চিনেছি। আমার নাম কৃষ্ণকান্ত ভার্গব। আই অ্যাম ভেরি প্রাউড টু মিট ইউ, স্যার।’
ভদ্রলোকের বছর চল্লিশেক বয়স, চাপদাড়ি, মাঝারি গড়ন। মিঃ গিরিধারী স্বভাবতই ফেলুদার পরিচয় পেয়ে ভারী উত্তেজিত হয়ে পড়লেন। —‘দেয়ার ইজ নো ট্রাবল হিয়ার আই হোপ?”
‘ট্রাব্ল সর্বত্রই হতে পারে, মিঃ গিরিধারী, তবে আমরা এসেছি একটা অন্য ব্যাপারে। আপনাদের এখানে ভবানী উপাধ্যায় বলে একজন ভদ্রলোক—’
‘উপাধ্যায় ত এখানে নেই,’ বলে উঠলেন সাংবাদিক মিঃ ভার্গব। ‘আমি ত ওঁকে নিয়েই একটা স্টোরি করব বলে এখানে এসেছি। হরিদ্বারে গিয়ে শুনলাম উনি রুদ্রপ্রয়াগ গেছেন; এখন এখানে এসে শুনছি তিনি খুব সম্ভবত কেদারনাথ গেছেন। আমি তাই কাল সকালে কেদার যাচ্ছি ওঁর খোঁজে। হি ইজ এ মোস্ট ইন্টারেস্টিং ক্যারাকটার, মিঃ মিটার।’
‘আমি অবিশ্যি ওঁর অসুখ সারানোর কথা শুনেছি,’ বলল ফেলুদা। তারপর লালমোহনবাবুর দিকে দেখিয়ে চাপা গলায় বলল, ‘আমার এই বন্ধুটির মাঝে মাঝে একটা মস্তিষ্কের ব্যারামের মতো হয়। ভুল বকেন, সামান্য ভায়োলেন্সও প্রকাশ পায়। তাই একবার ওঁকে দেখাব ভাবছিলাম। কলকাতার অ্যালোপ্যাথি হোমিওপ্যাথিতে কোনো কাজ দেয় নি।’
লালমোহনবাবু প্রথমে কেমন থতমত খেয়ে, তারপর ফেলুদার কথা সত্যি প্রমাণ করার জন্য মুখে একটা হিংস্র ভাব আনার চেষ্টা করলেন যেটা আমাদের একটা নেপালি মুখোশ আছে সেটার মতো দেখাল।
‘তাহলে আপনাদের ওই কেদার-বদ্রী যাওয়া ছাড়া গতি নেই’, বললেন মিঃ ভার্গব। ‘আমি বদ্রী গিয়ে ওঁকে পাইনি। অবিশ্যি উনি নাকি সন্ন্যাসী হয়ে গেছেন, তাই নামও হয়ত বদলে নিয়েছেন।’
এই সময় রেস্টহাউসের গেটের বাইরে একটা আমেরিকান গাড়ি থামল, আর তার থেকে তিনজন ভদ্রলোক নেমে আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। এদের যিনি দলপতি, তাঁকে চিনতে মোটেই অসুবিধা হল না, কারণ তাঁরই রঙীন ছবি রয়েছে ফেলুদার কাছে। ইনি হলেন রূপনারায়ণগড়ের ছোটকুমার বিলিয়ার্ড চ্যাম্পিয়ন পবনদেও সিং। অন্য দুজন নির্ঘাৎ এঁর চামচা।
আমরা পাঁচজন এতক্ষণ বাংলোর সামনের বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিলাম, এবার আরো তিনজন লোক বাড়ল। পবনদেও একটা বেতের চেয়ার দখল করে বললেন, ‘আমরা বদ্রীনাথ থেকে আসছি। নো লাক্। উপাধ্যায় ওখানে নেই।’
মিঃ গিরিধারী বললেন, ‘আশ্চর্য ব্যাপার এই যে, আমার এখানে যতজন অতিথি এসেছেন সকলেই উপাধ্যায়ের খোঁজ করছেন, এবং প্রত্যেকে বিভিন্ন কারণে। আপনি ওঁর ছবি তুলবেন, মিঃ ভার্গব ওঁকে ইন্টারভিউ করবেন, আর মিঃ মিটার তাঁর বন্ধুর চিকিৎসা করাবেন।’
পবনদেও-এর দলের সঙ্গে যে টেলিভিশনের যন্ত্রপাতি রয়েছে। ক্যামেরাটা পবনদেবও-এর নিজের হাতে, আর তাতে লাগানো একটা পেল্লায় লেন্স।
‘ওটা ত আপনার টেলি লেন্স দেখছি,’ ফেলুদা মন্তব্য করল।
পবনদেও ক্যামেরাটা টেবিলের উপর রেখে বলল, ‘হ্যাঁ। সকালের রোদে বদ্রীনাথের চুড়ো থেকে বরফ গলে গলে পড়তে দেখা যায়। অ্যাকচুয়েলি আমার পুরো সরঞ্জাম একজনে হ্যাণ্ডল করতে পারে। ক্যামেরা, সাউণ্ড, সব কিছু। আমার এই দুই বন্ধু থাকবেন গৌরীকুণ্ড পর্যন্ত। বাকিটা আমি একাই তুলব।’
‘তার মানে আপনিও কেদারনাথ যাচ্ছেন?’
‘হ্যাঁ। কাল ভোরেই বেরিয়ে পড়ছি।’
‘আপনি ভবানী উপাধ্যায়কে নিয়ে ফিল্ম তুলছেন?’
‘হ্যাঁ। অস্ট্রেলিয়ান টেলিভিশনের জন্য। উপাধ্যায় মানে, তার সঙ্গে হরিদ্বার-হৃষিকেশ কেদার-বদ্রীও কিছু থাকবে। তবে সেন্ট্রাল ক্যারেকটার হবেন ভবানী উপাধ্যায়। আশ্চর্য চরিত্র। উনি আমার বাবার হাঁপানি যে ভাবে সারিয়েছিলেন সেটা একটা মিরাক্ল।
আমি আড়চোখে পবনদেওকে লক্ষ করে যাচ্ছিলাম। মিঃ উমাশঙ্কর পুরী যে চরিত্র বর্ণনা করেছিলেন তার সঙ্গে কোনো মিল পাচ্ছিলাম না। ফেলুদা দেখলাম উমাশঙ্কর পুরীর কোনো উল্লেখ করল না।
রুদ্রপ্রয়াগে পৌঁছানর সময় একটা হোটেল দেখে রেখেছিলাম, সেইখানেই আমরা তিনজন গিয়ে ডিনার সারলাম। বয় যখন অর্ডার নিতে এল, তখন লালমোহনবাবু হঠাৎ ভীষণ তেজের সঙ্গে টেবিলের উপর একটা ঘুষি মেরে একটা গোলমরিচদান উল্টে দিয়ে বললেন তিনি আরমাডিলোর ডিমের ডালনা খাবেন। তখন ফেলুদার তাঁকে বুঝিয়ে বলতে হল যে যাদের কাছে ওঁর অসুখের কথাটা বলা হয়েছে, শুধু তাদের সামনেই এই ধরনের ব্যবহার চলতে পারে, অন্য সময় নয়। বিশেষ করে ভায়োলেন্সটা যারতার সামনে দেখাতে গেলে হয়ত লালমোহনবাবুকেই প্যাদানি খেতে হবে।
‘তা বটে’; বললেন লালমোহনবাবু। ‘তবে অপরচুনিটি পেলে কিন্তু ছাড়বনা।’
পরদিন ভোরে উঠতে হবে বলে আমরা খাওয়ার পর্ব শেষ করেই রেস্ট হাউসে চলে এলাম। কেউ কোনো হুম্কি চিঠি দিয়ে যায়নি ত এই ফাঁকে? আমাদের আবার এই জিনিসটার একটা ট্র্যাডিশন আছে। কিন্তু না; এদিক ওদিক দেখেও তেমন কিছু পেলাম না।
আমাদের দুটো ঘর পরেই যে পবনদেও তার দুই বন্ধু আর মিঃ গিরিধারীকে নিয়ে পানীয়ের সদ্ব্যবহার করছেন সেটা গেলাসের টুংটাং আর দমকে দমকে হাসি থেকেই বুঝতে পারছিলাম।
লালমোহনবাবু তার বালিশে মাথা দিয়ে বললেন, ‘একটা কথা কিন্তু বলতেই হবে ফেলুবাবু—সেদিন আপনার ঘরে বসে পুরী সাহেব ছোটকুমার সম্বন্ধে যাই বলে থাকুন না কেন, আমার কিন্তু ভদ্রলোককে বেশ মাই ডিয়ার বলেই মনে হচ্ছে।’
ফেলুদা বলল, ‘প্রকৃতি কিন্তু অনেক হিংস্র প্রাণীকেই সুন্দর করে সৃষ্টি করেছে। বাংলার বাঘের চেয়ে সুন্দর কোনো প্রাণী আছে কি? ময়ূরের ঠোকরানিতে যে কী তেজ আছে তা তো আপনি জানেন, জানেন না?’
লালমোহনবাবু তাঁর অ্যালার্ম ক্লকের চাবিটায় একটা মোচড় দিয়ে চোখে একটা হিংস্র উন্মাদ ভাব এনে বললেন, ‘পোপোক্যাটাপেটাপোটোপুলটিশ!’