[শেক্স্পীয়র ক্লাব, পাসাডেনা, ক্যালিফোর্নিয়া-২ ফেব্রুআরী, ১৯০০, সন্ধ্যা ৮ ঘটিকায় প্রদত্ত বক্তৃতা।]
আজ সন্ধ্যায় বৌদ্ধভারত আমাদের আলোচ্য বিষয়। আপনারা অনেকেই হয়তো এডুইন আর্নল্ডের পদ্যে লিখিত বুদ্ধের জীবনী পাঠ করেছেন। কেউ কেউ হয়তো এ-বিষয়ে আরও বিশদ আলোচনাও করে থাকবেন। কারণ ইংরেজী, ফরাসী, জার্মান প্রভৃতি নানা ভাষায় বৌদ্ধ-সাহিত্যের উপর প্রচুর পুস্তকাদি প্রকাশিত হয়েছে। বৌদ্ধধর্মই জগতের সার্বভৌম ধর্মের প্রথম অভিব্যক্তি। সুতরাং এর অনুশীলন স্বতই বিশেষ আকর্ষণীয়।
বৌদ্ধধর্মের পূর্বেও ভারতে এবং অন্যত্র নানা ধর্মের আবির্ভাব হয়েছে। কিন্তু সেগুলি অল্পবিস্তর নিজ নিজ জাতির পরিধির মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। হিন্দু, য়াহুদী, পারসীক প্রভৃতি প্রাচীন জাতির প্রত্যেকেরই মহান্ ধর্ম ছিল। কিন্তু সে-সবই মোটের উপর জাতি-বিশেষের নিজস্ব ধর্ম—সার্বভৌম ধর্ম নয়। বৌদ্ধধর্মের অভ্যুত্থানের সঙ্গে সঙ্গেই ধর্মের বিশ্ববিজয়রূপ বিচিত্র একটি অভিযানের সূত্রপাত। যে মতবাদ ও বাণী বৌদ্ধধর্মে প্রচারিত হয়েছিল, যে সত্যসমূহ তার শিক্ষার অঙ্গীভূত—সে-সবের কথা বাদ দিলেও ধর্মজগতে সেই প্রথম এক বিপুল বৈপ্লবিক পরিবর্তনের মুখোমুখি আমরা দাঁড়িয়েছিলাম। সে ধর্মের জন্মলগ্নের কয়েক শতাব্দীর মধ্যে বৌদ্ধশ্রমণগণ নগ্নপদে ও মুণ্ডিতমস্তকে তৎকালীন সভ্যজগতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল, এমন কি ল্যাপল্যাণ্ডের এক প্রান্ত থেকে ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জের অপর প্রান্ত অবধি তারা প্রচার করেছিল। এইভাবে বুদ্ধদেবের জন্মের অল্প কয়েক শতাব্দীর মধ্যেই তারা নানাদেশে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং মূল ভারতভূখণ্ডে বৌদ্ধধর্ম এক সময়ে দেশের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ নরনারীকে সম্পূর্ণভাবে প্রভাবিত করেছিল।
তবে ভারতবর্ষ কখনও সমগ্রভাবে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেনি। সে ধর্মের পরিধির বহির্ভাগেই ভারতবর্ষ চিরদিন দণ্ডায়মান ছিল। ফলে খ্রীষ্টধর্ম য়াহুদীদের মধ্যে যে পরিণতি লাভ করেছিল, অর্থাৎ অধিকাংশ য়াহুদী খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ করেনি—বৌদ্ধধর্মও ভারতবর্ষে অনুরূপ পরিণতিই লাভ করেছিল এবং এভাবেই প্রাচীন ভারতীয় ধর্মের ধারা অব্যাহত ছিল।
কিন্তু তুলনাটির পরিসমাপ্তি এখানেই। কারণ খ্রীষ্টধর্ম য়াহুদী জাতিকে নিজ পরিধির মধ্যে গ্রহণ করতে সমর্থ না হলেও সমগ্র দেশকে নিজ প্রভাবের অন্তর্ভুক্ত করেছিল। যে-সব স্থানে প্রাচীন য়াহুদীধর্ম প্রচলিত ছিল—অতি অল্পকাল মধ্যে খ্রীষ্টধর্ম সে-সব স্থানেও প্রবেশ করে তাকে যেন বাতিল করে দিয়েছিল।
সেজন্য প্রাচীন য়াহুদীধর্ম শুধু বিক্ষিপ্তভাবেই পৃথিবীর এখানে সেখানে টিকে থাকল। কিন্তু ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্মরূপী শিশুটিকে তার প্রসূতি নিজেই যেন গ্রাস করে ফেলেছিল এবং আজ বুদ্ধের নামও যেন ভারতবর্ষে প্রায় লুপ্ত হয়ে গেছে। ফলে আজ সে-দেশের অধিকাংশ নরনারী অপেক্ষা আপনারাই হয়তো বৌদ্ধধর্মের কথা বেশী অবগত আছেন। তারা বড়জোর সেই মহাপুরুষের নামটি মাত্র শ্রবণ করেছে। তিনি একজন বিশিষ্ট মহাপুরুষ ছিলেন, ভগবানের অবতার ছিলেন—এই পর্যন্ত সংবাদ তারা হয়তো রাখে, এর অতিরিক্ত আর কিছু নয়।
সিংহল অবশ্য আজও বুদ্ধদেবের সাম্রাজ্য, এবং হিমালয়ের কোন কোন অংশেও বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের সংখ্যা এখনও কিছু আছে। এ-ছাড়া ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্মের আর কিছু অবশিষ্ট নেই। তবে ভারতের বাইরে, এশিয়ার বিভিন্ন অংশে বৌদ্ধধর্ম বিস্তৃতি লাভ করেছিল। বৌদ্ধধর্মের অনুগামীদের সংখ্যাই পৃথিবীতে সর্বাধিক এবং এ-ধর্ম পরোক্ষভাবে অন্যান্য ধর্মের শিক্ষা ও অনুশাসনকে প্রভূত পরিমাণে প্রভাবিতও করেছে।
একদা বৌদ্ধধর্মের অনেক কিছু এশিয়া মাইনরে প্রবেশ করেছিল। খ্রীষ্টধর্মে ও বৌদ্ধধর্মে প্রাধান্য এবং প্রভুত্ব নিয়ে অবিচ্ছিন্ন সংগ্রামও একসময়ে বড় কম ছিল না। খ্রীষ্টধর্মের আদিযুগে নষ্টিক (Gnostics) প্রমুখ যে-সব সম্প্রদায় উদ্ভূত হয়েছিল, তাদের আচার-আচরণ, মতি-গতি বৌদ্ধদেরই অনুরূপ ছিল। আলেকজান্দ্রিয়া নগরীর বিচিত্র আবহাওয়ার মধ্যে রোমক আইনের অধীন যে ধর্মগত সংমিশ্রণ সাধিত হয়েছিল—তারই দানে খ্রীষ্টধর্মের উৎপত্তি হয়।
বৌদ্ধধর্মের রাজনৈতিক এবং সামাজিক দিক্—তার ধর্ম এবং আচার-আচরণাদি অপেক্ষা অধিকতর আকর্ষণীয়। এবং বিপুলশক্তিসম্পন্ন একটি বিশ্ববিজয়ী ধর্মরূপে তার যে প্রথম আত্মপ্রকাশ—তার মাধুর্যও কম নয়।
আজকের ভাষণে আমি মূলতঃ ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্মের প্রভাব সম্বন্ধেই আলোচনা করতে চাই। বস্তুতঃ বৌদ্ধধর্মের উদ্ভব এবং তার প্রসার কতকাংশে অনুধাবন করতে হলেও—সে মহান্ ধর্মগুরুর আবির্ভাবকালে ভারতবর্ষের অবস্থা কেমন ছিল—সে-বিষয়ে কিছুটা ধারণা থাকা প্রয়োজন।
সেদিনের ভারতবর্ষে এক বহুবিস্তৃত বিরাট ধর্ম সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। সে ধর্মের সুসম্বদ্ধ শাস্ত্রগ্রন্থ—বেদ। বেদসমূহ বাইবেলের মত একটি গ্রন্থমাত্র ছিল না। পরন্তু নানা গ্রন্থের সমবায়ে বেদ ছিল একটি সাহিত্য-বিশেষ। অবশ্য বাইবেলও বিভিন্ন যুগের রচনার সমষ্টি, বিভিন্ন লেখকের হাতের সৃষ্ট সম্পদ। কিন্তু বেদ-সংগ্রহ অতি বিশাল। আর তার সব গ্রন্থ পাওয়াই যায় না, এমন কি তাদের সবগুলির নাম পর্যন্ত ভারতবর্ষেও কেউ অবগত নয়। কিন্তু যদি কোন প্রকারে সে-গ্রন্থের সবগুলি সংগ্রহ করা সম্ভব হত, তবে এই প্রশস্ত কক্ষটিতেও তাদের স্থান সঙ্কুলান হত না।
সে এক বিরাট—এক বিপুল সাহিত্য-সংগ্রহ। সেই মহান্ শাস্ত্রকার শ্রীভগবানের কাছ থেকেই এই সাহিত্য বংশ-পরম্পরায় আমাদের হাতে এসে পৌঁছেছে। সেজন্য ভারতবর্ষে শাস্ত্রবিষয়ক ধারণা অত্যন্ত প্রাচীনপন্থী ছিল, গোঁড়ামিতে পূর্ণ ছিল।
আপনারা গ্রন্থপূজার গোঁড়ামি সম্পর্কে অভিযোগ করে থাকেন। কিন্তু এ সম্পর্কে হিন্দুর মনোভাব জানতে পারলে আপনারা কি ভাববেন—কে জানে? হিন্দু বিশ্বাস করে যে, বেদ প্রত্যক্ষভাবে ভগবানের শ্রীমুখ-নিঃসৃত জ্ঞান। বেদসহায়েই এই বিশ্ব-চরাচর সৃষ্ট হয়েছে এবং বেদে নিহিত বলেই তাদের অস্তিত্ব সম্ভব হয়েছে। একটি গাভী এই স্থূল জগতে বিরাজ করছে, কারণ ‘গাভী’ শব্দটি বেদে রয়েছে। একটি মানুষ এই পার্থিব জগতে বিদ্যমান, কারণ ‘মানুষ’ শব্দটি বেদমধ্যে উল্লিখিত আছে। এরই মধ্যে সেই মতবাদের জন্মসূত্র দেখা যায়—যেটি উত্তরকালে খ্রীষ্টধর্মাবলম্বিগণ বর্ধিত করেছিলেন এবং এইভাবে প্রকাশ করেছিলেন—‘সৃষ্টির প্রারম্ভে ছিল শুধু শব্দ এবং শব্দ ঈশ্বর বা ব্রহ্মের সঙ্গে অভিন্ন ছিল।’—এ তত্ত্ব ভারতবর্ষের প্রাচীন তত্ত্ব; এ তত্ত্বের ভিত্তির উপরই শাস্ত্রের শক্তির ভাবরাশি দণ্ডায়মান। অবশ্য এ-কথা স্মরণে রাখা প্রয়োজন যে, শব্দ-মাত্রই ঐশী শক্তির আধার। বহির্বিশ্ব ভাবের মূর্তপ্রকাশ-স্বরূপ। সুতরাং প্রকাশমাত্রেই জাগতিক ক্ষেত্রে স্থূল প্রকাশ এবং শব্দমাত্রেই বেদ, আর সংস্কৃতই দেবভাষা। একদা দেবমুখ থেকে নিঃসৃত হয়েছিল ভাষা। সে-ভাষা সংস্কৃত ভাষা অথবা দেবভাষা। সেজন্য ভারতীয়দের মতে সংস্কৃত ভিন্ন অন্য সকল ভাষাই নিম্নপর্যায়ের পশুকণ্ঠ-নিঃসৃত ভাষার মত। আর সে-সব ভাষাভাষীরাই ‘ম্লেচ্ছ’ শব্দে অভিহিত। গ্রীকদের পরিভাষায় ‘বর্বর’ শব্দটি যেমন, এ ‘ম্লেচ্ছ’ শব্দটিও (সংস্কৃত) সেইরূপ।
বেদসমূহ কোন ব্যক্তিবিশেষের রচনা নয়, দেবতামণ্ডলীর সঙ্গে সমান্তরাল রেখায় তারা বিদ্যমান। ভগবান্ অনন্ত, জ্ঞানও অনন্ত এবং সেই অনন্ত জ্ঞানসহায়েই জগতের সৃষ্টি হয়েছে। ঐ গ্রন্থেই জগতের সবকিছু বিধৃত, তার বাইরে কিছু নেই। মানুষের যত কিছু নীতিজ্ঞান, ভালমন্দ বিচার—সবই ঐ গ্রন্থের অনুশাসনের উপর প্রতিষ্ঠিত। কারণ ঐশ্বরিক জ্ঞানের ঊর্ধ্বে মানুষ উঠতে পারে না।—ভারতীয় গোঁড়ামির এই হল মূলকথা।
বেদের শেষাংশ উচ্চতম আধ্যাত্মিক তত্ত্বে পরিপূর্ণ। আর প্রথমাংশ অপেক্ষাকৃত স্থূল।
বেদগ্রন্থ থেকে অংশবিশেষ উদ্ধৃত করেই ‘এটি ভাল নয়, ওটি ভাল নয়’—এরূপ মন্তব্য আপনারা করে থাকেন। কিন্তু কেন? ‘বহু অনভিপ্রেত এবং মন্দ অনুশাসন এর মধ্যে নিহিত আছে’। এইজন্য? তা হয়তো আছে। কিন্তু ওল্ড টেষ্টামেণ্টেও তো এ-জাতীয় ব্যাপার আছে। প্রাচীন গ্রন্থমাত্রেই এমন বহু বিচিত্র মত, বহু উদ্ভট চিন্তার উল্লেখ আছে, যা আজকের দিনে আমরা পছন্দ করব না।
‘এ মতবাদটি ভাল নয়’, ‘আমার নীতিবোধে এটি বাধে’।
এ-জাতীয় উক্তির ‘কারণ’ সম্বন্ধে প্রশ্ন উত্থাপন করলে. অথবা কেন আপনার নীতিতে বাধে—এ কথা জিজ্ঞাসা করলে, উত্তর আসে—‘না, এর মধ্যে কোন প্রশ্ন বা যুক্তির অবকাশ নেই।’ … এই যদি অবস্থা হয় তবে স্তব্ধ হও, দূরে সরে থাক।
বেদের যে নির্দেশ, সেটি পালন করাই বিধি। বেদ-নির্দিষ্ট ভাল-মন্দই শেষ কথা। সে-বিষয়ে কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা মানুষের অধিকার-বহির্ভূত।
এখন বিপদ তো এইখানেই। বেদ-বিরোধী কোন উক্তির সমর্থনে কোন হিন্দুকে যদি কেউ বলে যে—‘আমাদের বাইবেলে তো এ-কথা নেই।’ তবে তন্মুহূর্তে উত্তর হবে—‘ওঃ, তোমাদের বাইবেল? ও তো সেদিনের একটি অতি-আধুনিক ইতিহাস। বেদ ভিন্ন আবার শাস্ত্র কোথায়? গ্রন্থ কোথায়?’ ভগবানই সর্বজ্ঞানের আকর। কাজেই পুনঃপুনঃ একাধিক বাইবেলের মাধ্যমে তিনি শিক্ষা দেবেন, এটা সম্ভব নয়। বেদগ্রন্থের মধ্য দিয়েই তাঁর শিক্ষার প্রথম প্রকাশ। সে কি তবে ভুল? মিথ্যা? উত্তরকালে উচ্চতর কোন শিক্ষাদানের উদ্দেশ্য নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন জাতির জন্য ভিন্ন ভিন্ন বেদ বা বাইবেল তিনি সৃষ্টি করেছিলেন—এমন ঘটনা কি সম্ভব?
‘বেদগ্রন্থের মত প্রাচীন গ্রন্থ আর নেই। অন্য সকল গ্রন্থই বেদের অনুগামী, বেদের অনুকরণে রচিত।’ আপনাদের কথা তাঁরা গ্রহণ করবেন না। আবার খ্রীষ্টানগণও বাইবেল গ্রন্থটি দেখিয়ে বলবেন, ও-সকল উক্তি প্রতারণামাত্র। ভগবানের উক্তি অভ্রান্ত এবং তা একবার মাত্রই উচ্চারিত হয়ে থাকে।
এখন এ-সবই বিশেষভাবে চিন্তা করবার বিষয়। গোঁড়ামি অবশ্যই অতি বিষম বস্তু।
যদি কোন হিন্দুকে কোন সামাজিক সংস্কার-বিষয়ে আপনারা অনুরোধ করেন, যদি বলেন, ‘এরূপ করা সঙ্গত’ অথবা ’এরূপ করা সঙ্গত নয়’, তবে উত্তরে সে বলবে, ‘এ-সব কি আমাদের প্রাচীন গ্রন্থাদিতে নির্দিষ্ট হয়েছে? যদি না হয়ে থাকে, তবে ও-সবের জন্য আমাদের মাথাব্যথা নেই। কোন পরিবর্তন করবার পক্ষপাতী আমরা নই।’ কয়েক শতাব্দী অপেক্ষা করলেই দেখতে পাবে যে, আমাদের ব্যবস্থাই কল্যাণপ্রদ।
যদি বলা হয়, … ‘তোমাদের সমাজপ্রতিষ্ঠানগুলি উৎকৃষ্ট নয়।’ তবে সঙ্গে সঙ্গে তারও উত্তর আসবে—‘বটে! তুমি সে-কথা জানলে কি ভাবে? তোমার অভিমতের ভিত্তিটি কি?আমাদের বিশ্বাস, আমাদের সমাজ-সংস্থাসমূহ তোমাদের সমাজব্যবস্থার তুলনায় উন্নততর। অপেক্ষা করলে চার-পাঁচ শত বৎসরের মধ্যেই দেখতে পাবে যে, কালকে অতিক্রম করে আমরা দাঁড়িয়ে আছি আর তোমাদের মৃত্যু ঘটেছে।’ … এ-ধরনের কথাই তারা বলবে।
এই হচ্ছে উৎকট গোঁড়ামি আর ভগবানের আশীর্বাদে সে মহাসঙ্কট-সমুদ্র আমি অতিক্রম করেছি।
এই গোঁড়ামি ভারতবর্ষে ছিল। কিন্তু গোঁড়ামি ভিন্ন আর কি ছিল? ছিল— বিচ্ছিন্নভাব ও বিভাগ। সমগ্র সমাজটিই—আজকের মত বহু জাতি ও সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিল। আর সে-সব বিভাগ আজকের তুলনায় কঠোরতর ছিল।
আরও একটি ব্যাপার আছে লক্ষ্য করবার মত। অধুনা নূতন নূতন জাতিগোষ্ঠী সৃষ্টি করবার দিকে একটি প্রবণতা পাশ্চাত্ত্যেও এসেছে।
আমি নিজে অবশ্য জাতির বাইরে। জাতিগত বন্ধন ব্যক্তিগতভাবে আমি বিশ্বাস করি না। সে বন্ধন আমি ছিন্ন করেছি। জাতির ভাল দিকও অবশ্য কিছু আছে, কিন্তু ভগবান্ করুন—আমি যেন জাতিবন্ধনে আবদ্ধ না হই। ‘জাতিগোষ্ঠী’ শব্দে আমি কোন্ বস্তুটি বোঝাতে চাই—তা হয়তো আপনারা উপলব্ধি করতে পারবেন। কারণ মনুষ্যসমাজ অতি দ্রুত একে গ্রহণ করে থাকে। হিন্দুদের মধ্যে বৃত্তির উপরই জাতি নির্ভরশীল। প্রাচীনযুগে হিন্দুদের জীবনলক্ষ্য ছিল সুখ-শান্তিপূর্ণ সাবলীল এক জীবনধারা। কি উপায়ে জীবনের সব কিছু প্রাণময় হয়ে উঠতে পারে—এই প্রশ্ন। আর তার উত্তর—প্রতিযোগিতা। কিন্তু বংশগত বৃত্তি প্রতিযোগিতা নষ্ট করে দেয়। তুমি কাষ্ঠশিল্পী? সূত্রধর? উত্তম। তোমার পুত্র সূত্রধর হবে।
তুমি? তুমি কর্মকার? কর্মকার-বৃত্তি তো একটি জাতিগত বৃত্তি—অতএব তোমার পুত্রও কর্মকার হবে। ভারতবর্ষে এক বৃত্তির মধ্যে অন্য বৃত্তির কাউকে প্রবেশ করতে দেওয়া হয় না। কাজেই নিরুপদ্রবে একটি বৃত্তি নিয়েই মানুষ জীবন-ধারণ করে।
তুমি যুদ্ধব্যবসায়ী, যোদ্ধা? অথবা তুমি পুরোহিত? উত্তম। তোমার বৃত্তির ভিত্তিতে একটি জাতি গড়ে তোল। পৌরোহিত্য বংশানুক্রমিক। অন্যান্য বৃত্তিও তাই। আবার নিরঙ্কুশ উচ্চক্ষমতা বা উচ্চাধিকারের কথা যদি চিন্তা করা যায়, তবে দেখা যাবে যে, তারও একটি বিশেষ দিক্ আছে। সে দিকটি হচ্ছে এই যে, কোন প্রতিযোগিতা সে বরদাস্ত করে না। তবে এরই ফলে এই জাতি-বিভাগের পরিণতিতেই—ভারতবর্ষ মহাকালের প্রভাব অতিক্রম করে বেঁচে রইল, আর অন্যান্য বহু জাতি বিলুপ্ত হয়ে গেল। কিন্তু অন্যভাবে এর একটি মন্দ দিকও আছে। এতে ব্যক্তিত্বের উন্মেষ ব্যাহত।
সূত্রধরের পুত্রকে কাঠের কাজই করতে হবে—তা সে পছন্দ করুক, আর নাই করুক।বুদ্ধদেবের আবির্ভাবের পূর্বেই এ ব্যবস্থা ভারতীয় শাস্ত্রে লিপিবদ্ধ ছিল এবং সেই প্রাক-বৌদ্ধযুগের কথাই আমি এখন বলছি।
আধুনিক যুগের সমাজতন্ত্রবাদ এরই অনুকৃতি। এরও ফল হয়তো পরিণামে ভালই হবে, কিন্তু ক্ষতচিহ্ন একটা থেকে যাবে বৈকি। আমার মতে স্বাধীনতাই মূলকথা। … মুক্ত হও। দেহে মনে ও আত্মায় পূর্ণ মুক্তি, পূর্ণ বন্ধনহীনতা—এই আমার আজীবন কামনা। ব্যক্তিগতভাবে আমি স্বাধীনতার সঙ্গে কোন মন্দ কাজ করতেও রাজী আছি, কিন্তু পরাধীনভাবে কোন সৎকাজ করতেও রাজী নই।
যাই হোক, বর্তমানে যে-সব বস্তুর জন্য পাশ্চাত্য দেশের লোকেরা চীৎকার করছে—ভারতের অসংখ্য নরনারী বহু যুগ পূর্বেই তার অনুশীলন করেছে। ভূমি জাতীয় সম্পদে রূপান্তরিত হয়েছে। দৃঢ়বদ্ধ জাতিবিভাগও ভারতবর্ষে ধিক্কৃত ছিল। ভারতের মানুষ মনে-প্রাণে সমাজতন্ত্রবাদী। কিন্তু এরও ঊর্ধ্বে আর একটি সম্পদ ছিল ভারতবর্ষে; সে সম্পদ ব্যক্তিত্বের। পুঙ্খানুপুঙ্খ বিধিনিষেধ আরোপের পরও তারা প্রচণ্ডভাবে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যে বিশ্বাসী ছিল। সব কিছুর জন্যই অবশ্য তারা নীতি-নিয়ম প্রণয়ন করেছে। পান, আহার, নিদ্রা, মৃত্যু—সবই সেখানে নিয়মে বিধৃত। অতি প্রত্যূষে শয্যাত্যাগ করবার মুহূর্ত থেকে রাত্রিতে নিদ্রিত হবার কাল পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষণ, প্রতিটি কর্ম শাস্ত্রীয় বিধানে নিয়মিত। নিয়ম, নিয়ম, নিয়ম! এ-কথা কি চিন্তা করা যায় যে, একটা জাতি এমনি নিয়ম-শৃঙ্খলার মধ্যে বেঁচে থাকতে পারে? আইন তো প্রাণহীন। যে দেশে আইন যত বেশী সে দেশের অবস্থা তত মন্দ! সেজন্য ব্যক্তিত্বের পূর্ণবিকাশ-কামনায় আমরা পাহাড়ে যাই, পর্বতে আত্মগোপন করি—যেখানে কোন আইন নেই, কোন সরকার নেই। যেখানে যত আইন, সেখানে তত পুলিস—তত দুর্জনের প্রাধান্য। আর দুর্ভাগ্যক্রমে ভারতবর্ষে এই বিধিনিয়মের কড়াকড়ি প্রচণ্ড। যে মুহূর্তে একটি শিশুর জন্ম হল, সেই মুহূর্তে সে প্রথমে বর্ণের দাস হল, তারপর হল জাতির।দাসত্বশৃঙ্খলে সে যেন আষ্টেপৃষ্ঠে আবদ্ধ হয়ে গেল। তার প্রত্যেকটি কাজ, তার আহার-বিহার, ওঠাবসা—সবই নিয়ন্ত্রিত হবে আইনে, নিয়মে।
আহারকালে গ্রাসে গ্রাসে তাকে প্রার্থনা করতে হবে, জল পান করতেও তাই। দিনের পর দিন—জীবনের আদি থেকে অন্ত পর্যন্ত সর্বক্ষণ ও সর্বমুহূর্তে এমনি নিয়মাধীন হয়েই তাকে থাকতে হবে। ভাবতেও আশ্চর্য বোধ হয়। অব্যাহত এই প্রণালী অনন্ত কাল ধরে চলে আসছে।
কিন্তু তাঁরা চিন্তাশীল লোক ছিলেন—সন্দেহ নাই। তাঁরা জানতেন যে, এমন নিয়মাধীনতায় প্রকৃত মহত্ত্ব লাভ হয় না, সেজন্য যথার্থ মুক্তিলাভের একটি ঋজুপথও তাঁরা উন্মুক্ত রেখেছিলেন। মোটের উপর বিধান এই ছিল যে, শুধু জাগতিক ক্ষেত্রে এবং সাংসারিক জীবনেই নিয়মাদি প্রযুক্ত হবে; কিন্তু যে-মুহূর্তে কেউ কাঞ্চনাসক্তি ত্যাগ করবে, জাগতিক সুখ বিসর্জন দেবে, তন্মুহূর্তে সে পূর্ণভাবে স্বাধীন হয়ে যাবে। কোন বিধিনিষেধ আর তার উপর প্রযুক্ত হবে না। এদের নাম সন্ন্যাসী, সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী। তাঁরা অতীতে কিম্বা বর্তমানে—কোন কালেই কোন সঙ্ঘের অন্তর্ভুক্ত হননি। তাঁরা এক অনাসক্ত ও মুক্ত মানবগোষ্ঠী—পুরুষ ও নারী উভয়েই তাঁদের মধ্যে আছেন। তাঁরা কখনও বিবাহ করেন না, বিত্ত আহরণ করেন না। তাঁরা কোন নিয়মের অধীন নন, এমন কি বেদবিধি মেনে চলতেও তাঁরা বাধ্য নন। বেদশীর্ষে তাঁদের স্থান। আমাদের সমাজ-সংস্থার ঠিক বিপরীত বিন্দুতে যেন তাঁরা দণ্ডায়মান। জাতিগত বিধি-নিষেধে তাঁরা আবদ্ধ থাকেন না। তাঁদের নিয়মিত করবার মত কোন শক্তিই বিধি-নিষেধের নেই। তাদের সীমিত গণ্ডীকে অতিক্রম করেই সন্ন্যাসীর জীবন। শুধু দুইটি নিয়ম তাঁদের পক্ষে অবশ্য পালনীয়। তাঁরা চিরনিঃসম্বল থাকবেন, চিরকুমার থাকবেন। অর্থ তাঁদের থাকবে না, বিবাহ তাঁরা করবেন না। এই অবস্থায় সমাজের কোন নিয়ম বা অনুশাসন তাঁদের উপর প্রযুক্ত হবে না। কিন্তু যে মুহূর্তে তাঁরা বিবাহ করবেন অথবা অর্থোপার্জন করবেন—সেই মুহূর্তে সমাজের প্রত্যেকটি নিয়ম তাঁদের পক্ষে বাধ্যতামূলক হবে, অবশ্য পালনীয় হবে। এই সন্ন্যাসীরাই ছিলেন জাতির জীবন্ত দেবতা এবং এঁদের মধ্য থেকেই শতকরা নিরানব্বই জন মহাপুরুষ উদ্ভূত হয়েছিলেন।
যে-কোন দেশেই হোক, আত্মার পূর্ণ মহিমার উপলদ্ধি ব্যক্তিত্বের চরমোৎকর্ষের উপর নির্ভর করে এবং সে উৎকর্ষ সমাজ-বন্ধনের মধ্যে উপলব্ধি করা যায় না। বিকাশোন্মুখ ব্যক্তির সমাজ-বন্ধনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। সেই বন্ধনকে সে ছিন্ন করে ফেলতে চায়। যদি কোন সমাজ বাধাস্বরূপ হয়, তবে তাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে সে নিজেকে বিকশিত করতে চেষ্টা করে।
এই দুই বিপরীত শক্তির মাঝখানেই একটি সহজ পন্থা শেষ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়েছিল। বলা হয়েছিল যে, যদি তুমি সমাজের বাইরে গিয়ে দাঁড়াও, যদি সংসার ত্যাগ কর, তবে তুমি যদৃচ্ছা প্রচার করতে পার, শিক্ষা দিতে পার। দূর থেকে আমরা শুধু তোমাকে শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করব।
ফলে অসাধারণ ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নর ও নারীর উদ্ভব তখন সম্ভব হয়েছিল এবং তাঁরাই সমাজে শীর্ষস্থান অধিকার করেছিলেন। এমন কি সেই মুণ্ডিতমস্তক গৈরিক-বসনধারী সন্ন্যাসী উপস্থিত হলে রাজাও নিজ আসনে উপবিষ্ট থাকতে সাহসী হতেন না। তাঁকে আসন ত্যাগ করে দাঁড়াতে হত। এ যেমন একদিকে, অন্যদিকে, হয়তো আধ-ধণ্টার মধ্যেই সেই সন্ন্যাসী এক অতি দরিদ্রের জীর্ণ কুটীরের সম্মুখে গিয়ে ভিক্ষার্থী হয়ে দণ্ডায়মান হতেন এবং এক টুকরা রুটি ভিক্ষা-স্বরূপ গ্রহণ করে প্রস্থান করতেন।
সমাজের সর্বস্তরের লোকের সঙ্গেই তাঁদের মেলামেশা ছিল। আজ হয়তো এক দরিদ্রের পর্ণকুটীরে সন্ন্যাসীর রাত্রিযাপন, আবার পরদিন রাজপ্রাসাদের মনোরম শয্যায় তাঁর সুখনিদ্রা। একদিন রাজগৃহে স্বর্ণপাত্রে তাঁর ভোজন, অন্যদিন সম্পূর্ণ অনাহারে এবং বৃক্ষতলে দিনযাপন। এই ছিল সন্ন্যাসীর জীবন। সমাজ এঁদের অতিশয় শ্রদ্ধার চক্ষে দেখত। কখনও কখনও নিজের ব্যক্তিত্ব প্রচার করতে গিয়ে কোন সন্ন্যাসী হয়তো উৎকট ধরনের কিছু করেও বসত। কিন্তু বৃহত্তর সমাজ তাতে ক্ষুব্ধ হত না, কিছু মনেই করত না। সে শুধু দেখতে চাইত—সন্ন্যাসীর মূল দুটি ধর্ম—পবিত্রতা ও ত্যাগব্রত অব্যাহত রয়েছে কিনা।
তাঁদের ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য অত্যন্ত প্রবল ছিল বলে তাঁরা নূতন চিন্তা এবং তত্ত্ব আবিষ্কারের জন্য সর্বদা সচেষ্ট থাকতেন। নূতন দেশে তাঁরা যেতেন। পুরাতনের গণ্ডী অতিক্রম করে নূতনের সন্ধান তাঁদের করতে হত। নিয়মাবদ্ধ সমাজে সকলে চাইত পুরাতন গণ্ডীতে আবদ্ধ থাকতে—একই ধরনে চিন্তা করতে। কিন্তু মানুষের নিগূঢ় প্রকৃতি এ ধরনের সংস্কারবদ্ধতা বরদাস্ত করে না। নির্বুদ্ধিতার চেয়ে মানুষের সদ্বুদ্ধি অধিক শক্তিশালী। দুর্বলতার চেয়ে সবলতাই অধিক ক্রিয়াশীল; অসদ্বস্তু থেকে সদ্বস্তু সবলতর। সেইহেতু গণ্ডীবদ্ধ মানুষের একঘেয়েমী বজায় রাখবার চেষ্টা সফল হয়নি। যদি হত, যদি তারা সকল মানুষকে একই ধরনের চিন্তাধারায় গ্রথিত করতে সমর্থ হত, তবে আমরা জড়ত্বপ্রাপ্ত হতাম। চিন্তাজগতে আমাদের মৃত্যু হত।
বস্তুতঃ এখানে এমন একটি সমাজব্যবস্থা প্রচলিত ছিল, যার কোন জীবনীশক্তি ছিল না, যার সদস্যগণ নিয়মের লৌহশৃঙ্খলে আবদ্ধ ছিল। পরস্পরকে সাহায্য করতে তারা বাধ্য ছিল। নিয়ম-বন্ধন এত কঠোর এবং নির্মম ছিল যে, কোন কাজই নিয়ম-বহির্ভূত হবার উপায় ছিল না। কিভাবে নিঃশ্বাস ফেলতে হবে, কিভাবে হাতমুখ প্রক্ষালিত হবে, এক কথায়, জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি—সবই নিয়মশৃঙ্খলে আবদ্ধ ছিল।
আর, এ-সব গণ্ডীবদ্ধতার বাইরে ছিল সন্ন্যাসীর অদ্ভুত ব্যক্তিস্বাধীনতা। আর সেই শক্তিশালী সন্ন্যাসীদের মধ্য থেকেই নিত্যনূতন সম্প্রদায়ের উদ্ভব হচ্ছিল। প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যে এঁদের স্বাতন্ত্র্যের কথা উল্লিখিত হয়েছে। একটি নারীর এরূপ কাহিনী আছে, তিনি বয়স্কা ছিলেন। তাঁর ধরন-ধারণ একটু অস্বাভাবিক রকমের ছিল। কিন্তু নিত্যনূতন চিন্তার অবতারণা তিনি করতে পারতেন। তাঁকে অবশ্য অনেকে অনেক সময় সমালোচনা করত। আবার তাঁকে সমীহও করত, নীরবে তাঁর নির্দেশ পালনও করত। এ-ধরনের নরনারী প্রাচীনযুগে একাধিক ছিলেন।
আবার সেই নিয়মবদ্ধ সমাজে ক্ষমতা ছিল পুরোহিত-শ্রেণীর হস্তে। সমাজের স্তরবিন্যাসে—বর্ণশ্রেষ্ঠ যাঁরা, তাঁদের মধ্য থেকেই পুরোহিত হতেন এবং তাঁদের যে কাজ ছিল—তাতে ‘পুরোহিত’ শব্দ ভিন্ন অন্য শব্দে তাঁদের অভিহিত করা যায় বলেও আমার মনে হয় না। অবশ্য এদেশে যে-অর্থে ‘পুরোহিত’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়, আমাদের দেশে সে অর্থে ব্যবহৃত হত না। পুরোহিতগণ ধর্ম বা দর্শন শিক্ষা দিতেন না। সমাজে নির্দিষ্ট বিধিবিধানসমূহ যথাযথ পালিত হচ্ছে কিনা, সেটি দেখা এবং সে-বিষয়ে সাহায্য করাই তাঁদের কাজ ছিল। বিবাহ দেওয়া, শ্রাদ্ধ-শান্তিতে উপাসনা করাও তাঁদের কাজ ছিল। ফলকথা, সমাজের ক্রিয়াকর্মে, উৎসবানুষ্ঠানে পুরোহিতের প্রয়োজন ছিল অপরিহার্য। সমাজব্যবস্থায় গার্হস্থ্য ছিল শ্রেষ্ঠ আশ্রম। প্রত্যেককেই বিবাহ করতে হবে—এই ছিল অনুশাসন। বিবাহ ভিন্ন কোন ধর্মানুষ্ঠানে অধিকার জন্মাত না। অবিবাহিত পুরুষ বা নারী পূর্ণ মানুষ বলে বিবেচিতই হত না! অবিবাহিত পুরোহিতেরও ক্রিয়াকর্মে অধিকার থাকত না। অবিবাহিত ব্যক্তি সমাজে বেমানান বলেই বিবেচিত হত।
এ-কালে পুরোহিতের ক্ষমতা খুব বেড়েছিল। যাঁরা সমাজপতি, আইন-প্রণয়ন যাঁদের কাজ, তাঁদের নীতিই এমন ছিল, যাতে পুরোহিতগণ সমাজে যথেষ্ট সম্মান লাভ করেন। এদেশেরই মত একটি সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা তাঁদের মধ্যেও ছিল, যার প্রভাব পুরোহিতবর্গের হাতে অধিক অর্থ যেতে পারত না। উদ্দেশ্য ছিল এই যে, পুরোহিতদের, সামাজিক মর্যাদাই বড় হোক, আর্থিক মর্যাদা নয়।
এ-কথা মনে রাখা প্রয়োজন যে, পুরোহিতগণ সব দেশেই মর্যাদা ও সম্মান পেয়ে থাকেন। ভারতবর্ষে আবার সে মর্যাদা এত বেশী ছিল যে, অতি দরিদ্র ব্রাহ্মণও আজন্ম সামাজিক মর্যাদায় রাজা অপেক্ষা উন্নত। সমাজব্যবস্থা তাঁকে চিরদারিদ্র্যে নিষ্পেষিত করবে সত্য, কিন্তু সেই সঙ্গে তাঁকে সম্মান দেবে প্রচুর। তাঁদের জন্য বাধানিষেধ ছিল সহস্র ধরনের। আবার যার বর্ণ যত উচ্চ, তার ভোগ-সুখের পথে বিধিনিষেধ ছিল তত কঠিন। তাছাড়া, উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণদের আহারাদির উপরও প্রচুর নিয়মবিধি আরোপিত ছিল। বর্ণ যত উন্নত হবে, আহারাদির ব্যবস্থা তত কঠোর হবে এবং আহার্য-বস্তুনিচয়ের সংখ্যা তত সীমাবদ্ধ হবে। জীবনধারণের জন্য যে-সকল বৃত্তি তাঁরা অবলম্বন করতে পারবেন, সেগুলিও অতি অল্প কয়েকটি বৃত্তির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। এই ছিল ব্যবস্থা। আপনাদের কাছে তাঁদের জীবন একটি অন্তহীন কঠোরতার নিদর্শন বলে মনে হবে। আহারে, বিহারে, পানে, গ্রহণে—সর্বক্ষেত্রেই অফুরন্ত বিধিনিষেধ।
আবার সে-সব বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করলে যে-সকল শাস্তির ব্যবস্থা ছিল, তাও নিম্নতর বর্ণের থেকে ব্রাহ্মণের পক্ষে বহুগুণ নির্মম ছিল। একজন নিম্নবর্ণের লোকের জন্য মিথ্যাভাষণের দণ্ড যতি হত এক টাকা, তবে ব্রাহ্মণের পক্ষে—তাঁর উচ্চতর জ্ঞানের জন্য দণ্ড হত শতগুণ।
প্রারম্ভিক অবস্থায় অবশ্য ব্যবস্থাটি অতি সুন্দর ছিল। কিন্তু উত্তরকালে এমন একটি সময় উপস্থিত হল, যখন এই পুরোহিত-সম্প্রদায় প্রচুর ক্ষমতার অধিকারী হলেন এবং তখনই তাঁরা এই মূল কথাটি বিস্মৃত হলেন যে, তাঁদের ক্ষমতার রহস্য দারিদ্র্যের মধ্য নিহিত; বিস্মৃত হলেন যে, তাঁরা এমন একটি মানবগোষ্ঠী, যাঁরা গভীরভাবে অধ্যয়ন করবেন, চিন্তা করবেন—এবং সে সুযোগ দানের জন্যই সমাজ তাঁদের আহার, বস্ত্র, বাসস্থান প্রভৃতির যাবতীয় দায়িত্ব বহন করবে। কিন্তু কালক্রমে তাঁদের ভোগ-পিপাসা জাগ্রত হল এবং অর্থলাভের জন্যও তাঁরা হাত বাড়াতে লাগলেন। আপনাদের পরিভাষায় যাদের ‘অর্থগৃধ্নূ’ ‘money-grabbers’ বলে—তাঁরা তাই হয়ে উঠলেন এবং অন্য সব কিছু বিস্মৃত হলেন।
ব্রাহ্মণের পর দ্বিতীয় জাতি হল ক্ষত্রিয়। যুদ্ধ এবং রাজ্যশাসন—এই ছিল তাঁদের কাজ। প্রকৃত ক্ষমতা এঁদেরই হস্তে ন্যস্ত ছিল। আর তাঁদের মধ্য থেকেই আমাদের দেশের শ্রেষ্ঠ মনীষীদের উদ্ভব হয়েছে, ব্রাহ্মণদের মধ্যে থেকে নয়। সেও এক বিচিত্র ব্যাপার। অবতারপুরুষ বলে আমাদের সমাজে যাঁরা পূজিত, তাঁদের সকলেই ক্ষাত্রকুলোদ্ভব, একটিও ব্যতিক্রম নেই। মহামনীষী শ্রীকৃষ্ণের জন্ম ঐ ক্ষত্রিয়কুল থেকে। রামচন্দ্রও ক্ষাত্রকুলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আমাদের দেশের খ্যাতনামা দার্শনিকগণ প্রথমে রাজসিংহাসনে উপবেশন করেছেন এবং রাজসিংহাসন থেকেই ত্যাগব্রতী দার্শনিকদের উদ্ভব হয়েছে। আবার ঐ রাজসিংহাসন থেকেই নিয়ত এ-আহ্বান ধ্বনিত হয়েছে—‘ত্যাগ কর, ত্যাগ কর’।
যুদ্ধব্যবসায়ীরা দেশের শাসনকর্তা, তাঁরাই দার্শনিক, তাঁরাই উপনিষদের প্রবক্তা।চিন্তায়, ধীশক্তিতে পুরোহিতবর্গ অপেক্ষা এঁরা উন্নত ছিলেন। ক্ষমতাও এঁদেরই অধিক ছিল, কারণ এঁরাই ছিলেন রাজা। অথচ আধিপত্য করতেন পুরোহিতগণ এবং ভীতিপ্রদর্শনের চেষ্টাও তাঁরা করতেন। ফলে ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয়—এই দুই বর্ণের মধ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছিল।
আরও একটি ব্যাপার আছে। আপনাদের মধ্যে যাঁরা আমার প্রথম ভাষণটিতে উপস্থিত ছিলেন, তাঁরা অবগত আছেন যে, ভারতবর্ষে দুইটি বৃহৎ মানবগোষ্ঠী বিদ্যমান—একটি আর্য, অপরটি অনার্য। আর্যদের মধ্যে আবার তিনটি বর্ণ আছে—ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য। এই তিন বর্ণের বাহিরে যে জনসমষ্টি, সেটি সমগ্রভাবে ‘শূদ্র’ নামে অভিহিত, আর্যগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তই তারা নয়। বহু বিদেশী পর্যটক বাহির থেকে এসে এই শূদ্রদেরই দেখেছে। তারাই ছিল দেশের আদিবাসী। যাই হোক, কালক্রমে অনার্যগোষ্ঠীর বিপুল জনসমষ্টি এবং আরও যারা নানাজাতির সংমিশ্রণে উদ্ভূত হয়ে অনার্য জাতির দেহে মিশে গেল, তারা সবাই ক্রমশঃ সভ্য হয়ে উঠতে লাগল এবং আর্যদের অনুরূপ অধিকার-লাভের জন্য প্রয়াসী হল।
তারা শিক্ষালাভের জন্য আর্যদের মত বিদ্যায়তনে প্রবেশ করতে চাইল; উপবীত ধারণ করতে চাইল; ক্রিয়া, কর্ম ও উৎসবের অধিকার চাইল। ধর্ম এবং রাজনীতিতেও সমান অধিকার দাবী করল।
অবশ্য পুরোহিতগণ স্বভাবতই এ দাবীর বিরুদ্ধে প্রবল আপত্তি উত্থাপন করলেন। পৃথিবীর সর্বদেশেই পুরোহিতবর্গের এই রীতি। তাঁরা স্বতই অত্যন্ত গোঁড়া হয়ে থাকেন। আর যতদিন পৌরোহিত্য একটি বৃত্তি থাকবে, ততদিন এ গোঁড়ামি থাকবেই। কারণ তাঁদের নিজ স্বার্থের খাতিরেই এ গোঁড়ামির প্রয়োজন রয়েছে। সুতরাং অনার্যগোষ্ঠীর সে দাবী এবং বিক্ষোভ দমন করবার জন্য পুরোহিতগণ সর্বশক্তি নিয়োগ করলেন। আবার আর্যগোষ্ঠীর মধ্যেও প্রবল ধর্মবিক্ষোভ দেখা দিল এবং সে বিক্ষোভ পরিচালনা করলেন ঐ ক্ষত্রিয়গণ।
আরও এক সনাতনপন্থী সম্প্রদায় ছিল ভারতবর্ষে—সে জৈন সম্প্রদায়। সে সম্প্রদায় অত্যন্ত গোঁড়াও বটে, প্রাচীনও বটে। হিন্দুশাস্ত্র বেদের প্রামাণিকতাই এরা অস্বীকার করেছিল। তারা নিজেরা কিছু কিছু ধর্মগ্রন্থ প্রণয়ন করেছিল এবং এ-কথাও ঘোষণা করেছিল যে, তাদের প্রণীত গ্রন্থাদিই যথার্থ বেদ। আর যেগুলি বেদ-নামে প্রচলিত—সেগুলি সর্বসাধারণকে প্রতারিত করবার উদ্দেশ্যে ব্রাহ্মণরা রচনা করেছিল। অবশ্য তাদের কর্মপন্থাও ঐ একই ধরনের ছিল।
এ-কথা মনে রাখতে হবে যে—নিজ ধর্মগ্রন্থ বিষয়ে হিন্দুদের যে যুক্তি, সে যুক্তি নিরসন করা সহজসাধ্য নয় এবং সেজন্য জৈনদের দাবীও হিন্দুদেরই অনুরূপ ছিল। অর্থাৎ তাদের ধর্মগ্রন্থের মাধ্যমেই সৃষ্টির প্রকাশ হয়েছে। আর সর্বসাধারণে প্রচলিত যে ভাষা, শাস্ত্রগ্রন্থগুলিও সেই ভাষাতেই রচিত।
তখনই সংস্কৃত আর কথ্যভাষা ছিল না। তার সঙ্গে তৎকালীন কথ্যভাষার সম্পর্ক অনেকটা সেই রকম হয়ে উঠেছিল, যেমন সম্পর্ক দেখা যায়—বর্তমান ইতালীয় ভাষার সঙ্গে প্রাচীন লাতিন ভাষার। জৈনধর্মাবলম্বিগণ পালিভাষায় নিজ শাস্ত্রগ্রন্থাদি রচনা করেছিল, সংস্কৃত ভাষায় নয়। কারণ তারা বলত সংস্কৃত আর সজীব ভাষা নয়, ওটি মৃতভাষার পর্যায়ভুক্ত।
তাদের আচার-প্রণালীতেও তারা ছিল স্বতন্ত্র। তাদের আচার-পদ্ধতিতেও তারা স্বতন্ত্র ছিল। বস্তুতঃ হিন্দুদের ধর্মশাস্ত্র এই বেদ এক বিশাল শাস্ত্র-সংগ্রহ। এর কতকাংশ একেবারে স্থূল ও অসার, অপরাংশ আধ্যাত্মিক তত্ত্বে পূর্ণ—এ-অংশ থেকেই ধর্মজ্ঞান লাভ হতে পারে। আর এ-সব সম্প্রদায়ের সকলেই বেদের ঐ অংশটুকই প্রচার করে বলে দাবী করে থাকে।
প্রাচীন-বেদে আবার তিনটি স্তরবিভাগ দেখা যায়। প্রথমে কর্ম, দ্বিতীয়তঃ উপাসনা এবং তৃতীয়তঃ জ্ঞান। কর্ম এবং জ্ঞান দ্বারা নিজেকে পরিশুদ্ধ করলেই ভগবান্ মানুষের অন্তরে প্রতিভাত হবেন। তিনি যে নিরন্তর অন্তরেই অধিষ্ঠিত—এ-উপলব্ধিও তখন তার হবে। অন্তরের বিশুদ্ধতার ফলেই এ-উপলব্ধি সম্ভব হয়। শুধু কর্ম এবং উপাসনার দ্বারাই মন পবিত্র হতে পারে। সেই একমাত্র পন্থা। মুক্তি তখন করায়ত্ত হয়। অতএব কর্ম, উপাসনা ও জ্ঞান—এই তিনটি সোপান-বিশেষ। যে সম্প্রদায়ের কথা বলছি, তাঁদের বিচারে কর্মের অর্থই অপরের উপকার-সাধন। এ-কথার তাৎপর্য অবশ্যই একটি আছে। কারণ ব্রাহ্মণদের ক্ষেত্রে কর্মের অর্থই ছিল বিস্তৃত উৎসবানুষ্ঠান—গো, মহিষ, ছাগ প্রভৃতি পশুবলি অথবা অন্যবিধ প্রাণীদের যজ্ঞাগ্নিতে আহুতি-প্রদান।
এখন জৈনধর্মাবলম্বিগণ এ-সব কর্মের বিরুদ্ধে কঠিন মত প্রকাশ করত। তারা বলত যে, এ-সব কর্ম কর্মই নয়। অন্যকে আঘাত দেওয়া কখনও সৎকার্য হতে পারে না। পরন্তু এ-সব কর্মে এ-কথাই প্রমাণ করে যে, ব্রাহ্মণদের বেদ মিথ্যা; সেটি পুরোহিতদের তৈরী একটি পুস্তকমাত্র। কারণ কোন মহৎ গ্রন্থ মানুষকে প্রাণিহত্যা করতে নির্দেশ দেবে—এটা অসম্ভব, এটা অবিশ্বাস্য। অতএব প্রাণিহত্যা, পশুবলি প্রভৃতির যে-সব নির্দেশ বেদে লিপিবদ্ধ রয়েছে, সেগুলি ব্রাহ্মণদেরই রচনা। কারণ সেগুলি তাদেরই স্বার্থের অনুকূল, তাদেরই অর্থাগমের সহায়ক। কাজেই সে-সবই পুরোহিতদের কৌশলমাত্র।
জৈনদের আর একটি মত হচ্ছে এই যে, ভগবানের কোন অস্তিত্ব নেই। সাধারণ মানুষের বিশ্বাস উৎপাদনের জন্য, আর সেই সূত্রে ধনসম্পদ সংগ্রহ করার জন্য পুরোহিতদেরই সৃষ্টি—এই ভগবান্। সবটাই এক বিরাট ধাপ্পা। অস্তিত্ব আছে প্রকৃতির, অস্তিত্ব আছে আত্মার। ব্যস্, আর কিছু নেই, ভগবান্ অবাস্তব—অস্তিত্বহীন।
এ-জীবনটির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী সম্পর্কে আত্মা জড়িয়ে পড়েছে। দেহ যেন একটি বহির্বাসরূপে তাকে আচ্ছাদিত করে রেখেছে। সুতরাং সৎকর্মের অনুষ্ঠান করে যাও। সেটিই পথ।
এদের মতবাদ থেকেই জড়বস্তুর হেয়ত্ব প্রতিপাদিত হয়েছিল। এরাই জগতে কৃচ্ছসাধনার প্রথম শিক্ষক। অপরিশুদ্ধতা থেকেই যদি দেহের জন্ম হয়, তবে দেহটি কোন উৎকৃষ্ট বস্তু নয়। যদি কেউ কিছুকাল এক পায়ে দাঁড়িয়ে থাকে—উত্তম, সেটি তার শাস্তিস্বরূপ হয়ে গেল। যদি অকস্মাৎ দেয়ালে মাথাটি ঠুকে যায়, তবে সেটিও একটি আকাঙ্ক্ষিত শাস্তিমাত্র।
একদা ফ্রান্সিস্কান সম্প্রদায়ের কতিপয় নেতৃস্থানীয় পুরুষ—সেণ্ট ফ্রান্সিস তাঁদের অন্যতম—কোন ব্যক্তি-বিশেষের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে যাত্রা করেছিলেন। সেণ্ট ফ্রান্সিসের সঙ্গে একজন সহযাত্রী পথ চলছিলেন। কথা হচ্ছিল এই নিয়ে যে, যাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে তাঁরা যাচ্ছেন, তিনি তাঁদের অভ্যর্থনা করবেন কিনা, তাঁদের সঙ্গে বাক্যালাপ করবেন কিনা। সহযাত্রীটি বললেন, খুব সম্ভব তিনি আমাদের অভ্যর্থনা করবেন না—প্রত্যাখ্যান করবেন। তদুত্তরে সেণ্ট ফ্রান্সিস বলেছিলেন, ‘তাঁর প্রত্যাখ্যানই আমাদের পক্ষে যথেষ্ট নয়, বন্ধু! যদি দ্বারে আমাদের করাঘাত শুনে তিনি বেরিয়ে আসেন এবং আমাদের দূর করে তাড়িয়ে দেন, তবে সেটাও আমাদের পক্ষে যথেষ্ট হবে না; অথবা তিনি যদি আমাদের হাত-পা বেঁধে নির্মমভাবে বেত্রাঘাত করেন, তাহলে সেটিও পর্যাপ্ত হল বলে আমি মনে করব না; তবে যদি আমাদের হাত-পা সব দৃঢ়ভাবে বেঁধে, বেত্রাঘাতে প্রতি লোমকূপ থেকে রক্তমোক্ষণ করিয়ে তিনি আমাদের ঘরের বাইরে বরফের মধ্যে ফেলে রাখেন, তবে সেটাই আমাদের উদ্দেশ্য- লাভের পক্ষে পর্যাপ্ত হতে পারে।’
এমনি কঠোর কৃচ্ছসাধনার একটি মনোভাব সে-যুগে বিদ্যমান ছিল।
বস্তুতঃ জৈনরাই ছিল কৃচ্ছসাধনার পথিকৃৎ। তবে সেই সঙ্গে তারা কিছু কিছু মহৎকার্যও সম্পন্ন করেছিল। তাদের কথা ছিল—কাউকে আঘাত কর না, দুঃখ দিও না, যথাশক্তি অপরের উপকার সাধন কর। এই কর্ম, এই নীতি ও সদাচার—এ-ছাড়া আর যা কিছু সবই ব্রাহ্মণদের হাতে গড়া বাজে জিনিষ; সেগুলি বর্জন কর।
এই মতবাদের ভিত্তিতেই তারা কর্মে প্রবৃত্ত হয়েছিল এবং এটিকেই নানাভাবে পূর্বাপর তারা বিস্তৃত করেছিল। সে এক বিচিত্র আদর্শ। শুধু অ-বৈরী ও পরোপকারের ভিত্তিতে সকল নৈতিক আদর্শকে দাঁড় করিয়ে দেওয়া—একটি অভিনব আদর্শ বৈকি!
বুদ্ধদেবের অন্ততঃ পাঁচশত বৎসর পূর্বেকার এই সম্প্রদায়। আবার বুদ্ধদেবও খ্রীষ্টের জন্মের সাড়ে-পাঁচশত বৎসর পূর্বে বর্তমান ছিলেন। এরা সমগ্র প্রাণিজগৎকে পাঁচটি ভাগে বিভক্ত করেছিল। তাদের মধ্যে সর্ব নিম্নস্তরের যে জীব, তার মাত্র একটি ইন্দ্রিয় বর্তমান, সেটি স্পর্শেন্দ্রিয়। তার উপরের স্তরে রয়েছে স্পর্শ ও আস্বাদন-ইন্দ্রিয়। তারও উপরে—স্পর্শ-স্বাদ এবং শ্রবণেন্দ্রিয়। চতুর্থ স্তরে আবার—পূর্বের তিনটির সঙ্গে দর্শনেন্দ্রিয় যুক্ত হয়।আর সর্বশেষ স্তরে পঞ্চেন্দ্রিয়ের সবই বর্তমান থাকে।
এক বা দুই ইন্দ্রয়বিশিষ্ট যে-সব প্রাণী—তারা চর্মচক্ষে দৃশ্যমান নয়। তারা জলমধ্যে অবস্থান করে। এদের—এই অতি-নিম্নপর্যায়ের প্রাণীদের হত্যা করা অতি ভয়াবহ কার্য।
এ-যুগে প্রাণিজগতের এ-সকল তত্ত্ব অতি অল্পদিন আগে মাত্র জানা গেছে। তৎপূর্বে এ-সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা ছিল না। জৈনদের মত এই ছিল যে, সর্ব নিম্নস্তরে প্রাণীদের এক স্পর্শানুভূতি ভিন্ন আর কিছু নেই। তার উপরের স্তরের প্রাণীরাও অদৃশ্য। জৈনরা জানত যে, এ-সব প্রাণী শুধু জলেই বাস করে এবং জল ফুটালে এরা মারা যায়। কজেই জৈনসন্ন্যাসীরা তৃষ্ণায় মরে গেলেও নিজেরা জল ফুটিয়ে পান করতেন না। কিন্তু ভিক্ষার্থী হয়ে কোন গৃহে গেলে গৃহস্থ যদি জল পান করতে দিত, তবে সে জল তাঁরা গ্রহণ করতেন। কারণ সেক্ষেত্রে প্রাণিহত্যার দায় ছিল গৃহস্থের, আর জল পানের সুবিধাটুকু মাত্র ছিল তাঁদের নিজেদের।
অহিংসার ধারণাটিকে এরা ক্রমশ এক হাস্যকর পর্যায়ে নিয়ে দাঁড় করিয়েছিল। যেমন—স্নানের সময় শরীর মার্জনা করলে অসংখ্য অদৃশ্য জীবাণু ধ্বংস হয়ে যায় মনে করে এরা স্নানই করত না। এরা নিজেরা মরতে প্রস্তুত ছিল। কারণ মৃত্যু এদের কাছে এক অতি তুচ্ছ পরিণতি ছিল। আর অপর কোন প্রাণীকে হত্যা করে বেঁচে থাকতেও এরা প্রস্তুত ছিল না।
এদেরই সমসাময়িক কালে আরও নানা কৃচ্ছসাধন-পরায়ণ সম্প্রদায় ছিল এবং এই কৃচ্ছসাধনার কালেই পুরোহিত এবং রাজন্যবর্গের মধ্যে রেষারেষি ও রাজনৈতিক বিদ্বেষ দানা বেঁধে উঠেছিল। আর সেই সঙ্গে সঙ্গে নানা বিক্ষুদ্ধ সম্প্রদায়েরও উদ্ভব হয়েছিল।
আরও কঠিন সমস্যা ছিল জনসাধারণকে নিয়ে। কারণ এ-কালেই জনসাধারণ সর্ববিষয়ে আর্যদের সম-অধিকার দাবী করছিল। প্রকৃতির নিত্য-প্রবহমান স্রোতস্বিনীর তীরে দাঁড়িয়ে জল পানের অধিকার থেকে চিরবঞ্চিত হওয়া তাদের পক্ষে যেন ক্রমশঃ অসহনীয় হয়ে উঠেছিল।
এই মহাসন্ধিক্ষণেই সেই বিরাট পুরুষ বুদ্ধদেবের জন্ম হয়েছিল। তাঁর জীবন এবং চরিতকথা আপনারা সকলেই অবগত আছেন। নানা অলৌকিক ঘটনা বা কাহিনীতে মণ্ডিত হওয়া সত্ত্বেও—যা মহাপুরুষ মাত্রেরই জীবনে হয়ে থাকে—বুদ্ধদেব জগতের ইতিহাস-স্বীকৃত মহাপুরুষগণের অন্যতম। বস্তুতঃ এদিক থেকে মাত্র দুজন মহাপুরুষের নামই উল্লেখ করা যেতে পারে, যাঁদের সম্বন্ধে শত্রু-মিত্র উভয়েই একমত, একজন সুপ্রাচীন বুদ্ধদেব, অপরজন হজরত মহম্মদ। সুতরাং এঁদের উভয়ের সম্বন্ধেই আমরা সম্পূর্ণ নিঃসংশয়। অন্যান্য মহাপুরুষ সম্বন্ধে তাঁদের শিষ্য-প্রশিষ্যদের উক্তি ভিন্ন আর বিশেষ কিছু আমাদের হাতে নেই।
আমাদের শ্রীকৃষ্ণের বিষয় আপনারা জানেন। হিন্দু-সম্প্রদায়ের মধ্যে অবতার-পুরুষরূপে তিনি পূজিত। তাঁর কাহিনী বহুলাংশে আখ্যান-চরিত মাত্র।
শুধু তাঁর অনুগামী শিষ্যগণই তাঁর জীবনের অধিকাংশ কথা লিপিবদ্ধ করে গেছেন। এর ফলে, অনেক সময় একই ব্যক্তির মধ্যে যেন একাধিক ব্যক্তি মিশ্রিত হয়ে পড়েছে।বস্তুতঃ বহু অবতারপুরুষ সম্বন্ধেই আমরা খুব বেশী কিছু জানি না। কিন্তু বুদ্ধদেবের ঐতিহাসিকতা সম্বন্ধে আমরা নিঃসন্দেহ। কারণ শত্রু ও মিত্র—উভয়পক্ষই তাঁর কথা লিপিবদ্ধ করে গেছেন। আরও একটি কথাঃ মহাপুরুষদের জীবনের সঙ্গে যত কাহিনী, যত অলৌকিক গল্প ও উপাখ্যান জড়িত হয়, সেগুলি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে, বাহ্য কাহিনীসমূহের অন্তরালে প্রত্যেকেরই একটি নিজস্ব সত্তা, একটি আভ্যন্তরীণ স্বকীয়তা থাকে। কিন্তু এ মহাপুরুষটির জীবনে কোন স্তরে কোন সময়ে স্বকীয় প্রয়োজনে কোন প্রয়াস দেখা যায় না। এর দ্বারা প্রমাণ হচ্ছে এই যে, যখনই কোন মহাপুরুষকে অবলম্বন করে কোন আখ্যায়িকা রচিত হয়, তখনই সেই মহাপুরুষের মাহাত্ম্য ও মহিমায় সেটি অনুরঞ্জিত হয়ে থাকে। বুদ্ধদেবের বেলায়ও তাই হয়েছিল সত্য; কিন্তু তাঁর জীবন বা চরিত্র নিয়ে যত উপাখ্যান রচিত হয়েছে, তার কোনটিতে কোথাও কোন অসদাচরণ বা নীচকার্যের ইঙ্গিত নেই। এমন কি তাঁর বিরুদ্ধবাদীরাও তাঁর প্রশংসাই করেছে।
জন্মলগ্ন থেকেই বুদ্ধ এত পবিত্র ছিলেন, এত নির্মল ছিলেন যে, যে-ই তাঁর শ্রীমুখ দর্শন করেছিল, সে-ই আনুষ্ঠানিক ধর্ম পরিত্যাগ করে সন্ন্যাস-ধর্ম গ্রহণ করেছিল এবং পরিত্রাণ লাভ করেছিল। ফলে দেবতাগণ এক সভা আহ্বান করে নিজেদের অসহায় অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন। কারণ যাগযজ্ঞের উপরই ছিল দেবতাদের নির্ভর, যজ্ঞভাগই ছিল দেবতাদের প্রাপ্য। আর বুদ্ধের প্রভাবে সেই যাগযজ্ঞই বিলুপ্ত হয়েছিল। ফলে একদিকে দেবতাদের আহার যেমন বন্ধ হয়েছিল, অন্যদিকে তাঁদের প্রভাবও তেমনি বিলুপ্ত হয়েছিল। সুতরাং দেবতাগণ তখন এ-কথাই ঘোষণা করেছিলেন, ‘যেমন করেই হোক, বুদ্ধকে পতিত করতে হবে। তাছাড়া আমাদের আর কোন গতি নেই। তার পবিত্রতা আমাদের পক্ষে দুঃসহ।’
এ-সিদ্ধান্তের পরই দেবতামণ্ডলী বুদ্ধের কাছে উপস্থিত হয়ে বললেন, ‘হে সৌম্য, তোমার কাছে আমাদের একটি নিবেদন আছে। আমরা একটি মহাযজ্ঞের সঙ্কল্প করেছি। সেজন্য একটি বিরাট অগ্নিকুণ্ড প্রজ্বলিত করতে হবে। কিন্তু সমস্ত পৃথিবী অনুসন্ধান করেও এমন একটি পবিত্র স্থান আমরা বের করতে পারলাম না, যেখানে সে অগ্নি প্রজ্বলিত করা যায়। তবে এখন সে স্থানের সন্ধান আমরা পেয়েছি। তুমি যদি নিজ বক্ষদেশ উন্মুক্ত করে শয়ন কর, তবে তোমারই বুকের উপর আমরা অগ্নিকুণ্ড স্থাপন করতে পারি।’
বুদ্ধ বললেন, ‘তাই হবে। আপনারা যজ্ঞ আরম্ভ করুন।’ দেবগণ বুদ্ধের বুকের উপর বিশাল অগ্নি প্রজ্বলিত করলেন এবং ভাবলেন যে, অগ্নির উত্তাপে বুদ্ধের মৃত্যু হবে। কিন্তু তা হল না। বুদ্ধ মরলেন না। তখন দেবতাগণ একান্ত হতাশ হলেন এবং তাঁদের হাতাশার ভাব সর্বত্র প্রকাশ করতে লাগলেন। আর সঙ্গে সঙ্গে পুনঃপুনঃ বুদ্ধদেবকে কঠিন আঘাত করতে লাগলেন। কিন্তু তাতেও কোন ফল হল না। বুদ্ধকে হত্যা করা গেল না।
তখন সে অগ্নিকুণ্ডের নীচ থেকে এই প্রশ্ন শব্দিত হলঃ ‘আপনারা এ বৃথা শ্রম করছেন কেন? আপনাদের উদ্দেশ্য কী?’ উত্তর হল, ‘তোমার পবিত্র মুখমণ্ডলের দিকে যে-ই দৃষ্টি নিক্ষেপ করে, সে-ই শুদ্ধ হয়ে যায়, আর কেউ আমাদের উপাসনা করে না, সেজন্য তোমার ধ্বংস আমরা কামনা করছি।’
তদুত্তরে বুদ্ধ বললেন, ‘তাহলে আপনাদের পরিশ্রম বৃথা। পবিত্রতা কখনও ধ্বংস হয় না।’
এই কাহিনী বুদ্ধের বিরুদ্ধবাদীদের রচনা। অথচ এর মধ্যেও বুদ্ধচরিতের প্রতিকূলে শুধু এই দোষটুকুই আরোপিত হয়েছে যে, তিনি এক অদ্ভুত ধরনের পবিত্রতা প্রচার করেছিলেন। আর কিছু নয়। বুদ্ধের মতবাদ সম্বন্ধে আপনাদের অনেকে কিছু কিছু অবগত আছেন।
বর্তমান কালের যে-সব চিন্তাশীল মনীষী অজ্ঞেয়বাদী বলে পরিচিত, তাঁদের কাছে বুদ্ধের মতবাদের বিশেষ একটি আবেদন আছে। বিশ্ব-ভ্রাতৃত্বের মহান্ প্রবক্তা ছিলেন বুদ্ধদেব। তাঁর কথা এই ছিলঃ ‘আর্য-অনার্য-নির্বিশেষে জাতি-সম্প্রদায়-নির্বিশেষে—প্রত্যেক মানুষের অধিকার রয়েছে ধর্মের উপর, অধিকার রয়েছে ঈশ্বরের উপর, স্বাধীনতার উপর।অতএব সে-অধিকারের ক্ষেত্রে সকলকেই আমি আহ্বান করি।’
কিন্তু এ-ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে তিনি ছিলেন কঠোর অজ্ঞেয়বাদী। বাস্তববুদ্ধিসম্পন্ন হতেই তিনি সর্বদা উপদেশ দিতেন। একদা পাঁচজন তরুণ—সকলেই ব্রাহ্মণ—একটি প্রশ্নের উপর তর্ক-বিতর্ক করতে তাঁর কাছে উপস্থিত হয়েছিল। ‘সত্য-লাভের পথ কি?’—এই ছিল তাদের প্রশ্ন। তাদের একজন বলল, ‘আমাদের মতে—এইটি সত্যের পথ। আমার পূর্ব- পুরুষগণ এ-কথাই প্রচার করেছেন।’
আর একজন সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, ‘আমি কিন্তু অন্যরূপ শিক্ষা লাভ করেছি, এবং আমার বিশ্বাস আমাদের নির্দিষ্ট পথটিই সত্যলাভের একমাত্র পথ।’
‘হে আচার্য—এখন এর মধ্যে কোন্টি ঠিক, তাই আমাদের জিজ্ঞাস্য।’
বুদ্ধদেব তখন তাদের প্রত্যেককে স্বতন্ত্রভাবে এই কথা বলেছিলেন, ‘তোমাদের আত্মগোষ্ঠী সবাই সত্যলাভের জন্য এক একটি পথ নির্দেশ করেছেন। উত্তম! কিন্তু তুমি নিজে কি ঈশ্বর দর্শন করেছ? অথবা তোমাদের পিতা কিম্বা পিতামহ কি ঈশ্বর দর্শন করেছেন?’
‘না, তাঁরা কেউ ঈশ্বর দর্শন করেননি. তাঁদের পিতা-পিতামহও ঈশ্বর দর্শন করেননি।’
‘আচ্ছা, তোমাদের আচার্যদের মধ্যে কেউ কি ঈশ্বর দর্শন করেছেন?’
‘না, তাঁরাও ঈশ্বর দর্শন করেননি।’
সকলের মুখেই এক উত্তর। সকলেরই এক কথা। কেউ তারা ঈশ্বর দর্শন করেননি।
তখন বুদ্ধদেব সেই পঞ্চ-তরুণকে একটি উপাখ্যান শুনিয়েছিলেন; বলেছিলেনঃ দেখ, একবার এক গ্রামে হঠাৎ কোথা থেকে একটি যুবক উপস্থিত হয়েছিল। সে কখনও কাঁদছে, কখনও বিলাপ করছে, কখনও চীৎকার করছে। বলছে, ‘আহা আমি তাকে অত্যন্ত ভালবাসি, নিবিড়ভাবে ভালবাসি।’ তার চীৎকারে গ্রামবাসীরা বেরিয়ে এল। তাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘কাকে তুমি ভালবাস? কে সে?’ ‘তা আমি জানি না।’ ‘কোথায় থাকে সে কন্যা? তার চেহারাই বা কেমন?’ ‘হায়, আমি সে-সব কিছুই জানি না। কোন সংবাদ রাখি না। শুধু এইটুকু জানি যে, আমি তাকে অত্যন্ত ভালবাসি।’
এখন এই যুবকটি সম্বন্ধে তোমাদের অভিমত কি—তা আমি জানতে চাই।
তরুণগণ তখন সবাই একযোগে বলে উঠল, ‘কেন মশাই, ও তো একটি আস্ত নির্বোধ! যাকে সে জানে না চেনে না, যাকে কখনও দেখেনি—এমন একটি অবাস্তব মেয়ের জন্য যে চীৎকার করে বেড়াচ্ছে, তাকে একান্ত বেকুব ভিন্ন আর কি বলা যাবে?’
তখন বুদ্ধ বললেন, ‘তাহলে তোমরাও কি অনেকাংশে তাই নও! তোমরা নিজেরাই স্বীকার করছ যে, তোমরা কিম্বা তোমাদের পিতা, পিতামহ কেউ কখনও ঈশ্বর দর্শন করেনি। ঈশ্বর-সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ জ্ঞান বংশ পরম্পরায় তোমাদের কারও নেই। অথচ সেই ঈশ্বর নিয়েই তোমরা তর্ক করছ, পরস্পরের টুঁটি ছিঁড়ে ফেলতে চাইছ। একি পাগলামি নয়?’
তখন তরুণগণ বিব্রত হয়ে বুদ্ধকে প্রশ্ন করল, ‘তাহলে এখন আমাদের কি করা উচিত—তাই বলুন।’ বুদ্ধদেব বললেন, ‘বেশ, তবে শ্রবণ কর। আচ্ছা, তোমাদের পূর্বপুরুষগণ কখনও কি এমন কথা বলছেন যে, ভগবান্ কোপনস্বভাব, ভগবান্ অসৎ?’ ‘আজ্ঞে না, তেমন কথা তাঁরা কখনও বলেননি। তিনি চির-সৎ, চির-পবিত্র—এই তাঁরা বলেছেন।’
‘তাহলে হে তরুণগণ—তোমরা যদি কায়মনোবাক্যে সৎ হও, সর্বভাবে পবিত্র হও, তবেই ভগবানের সান্নিধ্যে পৌঁছতে পারবে। তর্ক-বিতর্ক করে বা পরস্পরকে আক্রমণ করে ভগবান্ লাভ হয় না। অতএব আমার নির্দেশ এই যে—পবিত্র হও, সৎ হও। সর্বান্তঃকরণে অপরকে ভালবাস। ভগবানলাভের এই চিরন্তন পথ, অন্য পথ কিছু নাই।’
বুদ্ধের জন্মকালেই প্রাণিহত্যা না করবার এবং জীবে দয়া প্রদর্শন করবার নীতি আদর্শ রূপে গৃহীত ছিল—এ-কথা আমরা আলোচনা করেছি, সেক্ষেত্রে বুদ্ধদেব নূতন কিছু করেননি; কিন্তু তিনি নূতন যেটি করেছিলেন, সেটি হচ্ছে—জাতিভেদ প্রথা উচ্ছেদের জন্য একটি প্রবল আন্দোলনের সূত্রপাত। তাছাড়া আরও একটি অভিনব কাজ বুদ্ধদেব সম্পন্ন করেছিলেন। তিনি তাঁর চল্লিশ জন শিষ্যকে পৃথিবীর নানা স্থানে প্রেরণ করেছিলেন এই নির্দেশ দিয়েঃ ‘বৎসগণ, তোমরা সকল দেশের সকল মানুষের সঙ্গেই উদার ভাব নিয়ে মিলিত হবে, জাতিধর্মনির্বিশেষে মিলিত হবে, এবং সকলের কল্যাণ-সাধনকল্পে মহাবাণী প্রচার করবে।’
অবশ্য এজন্য হিন্দুরা সৌভাগ্যক্রমে তাঁকে নির্যাতিত করেনি। তিনি পূর্ণবয়সে দেহত্যাগ করেছিলেন। বরাবর তিনি অতি কঠোর জীবনযাপন করেছেন। কোন দুর্বলতা কখনও তাঁকে স্পর্শ করতে পারেনি। তাঁর বহু মতবাদে আমি বিশ্বাস করি না। না, সত্যি বিশ্বাস করি না। আমি বরং বিশ্বাস করি যে, প্রাচীন হিন্দুদের বেদান্তবাদ অনেক বেশী চিন্তাপূর্ণ; বেদান্তের জীবনদর্শন অপূর্ব। বুদ্ধের কর্মপদ্ধতি যে আমি অপচ্ছন্দ করি, তা অবশ্য নয়। তবে তাঁর যে বৈশিষ্ট্য আমাকে সবচেয়ে বেশী আকর্ষণ করে, সেটি হচ্ছে তাঁর দৃঢ়তা তাঁর মহত্ত্ব এবং তাঁর স্বচ্ছ চিন্তাশক্তি। তাঁর মস্তিষ্কে কোন জটিলতা ছিল না। যখন বিশ্বের সকল ঐশ্বর্য তাঁর পাদমূলে এসেছিল, তখনও তাঁর মধ্যে তিলমাত্র পরিবর্তন হয়নি; তখনও তাঁর মধ্যে এই মনোভাব সম্পূর্ণ অব্যাহত ছিল—‘আমি আর দশজনেরই মত একজন সাধারণ মানুষ।’
আপনারা জানেন, হিন্দুরা মানুষ-পূজা করতে ভালবাসে, সেদিকে তাদের আগ্রহ ঐকান্তিক। যদি আপনারা কিছু দীর্ঘকাল বেঁচে থাকেন, তবে দেখতে পাবেন, আমাকেও বহু লোক পূজা করবে। যদি হিন্দুদের মধ্যে কেউ কোন ধর্মপ্রচার করে, তবে জীবিতকালেই তাঁকে তারা পূজা করতে শুরু করে। ফল-কথা, কাউকে পূজা করবার আগ্রহ এবং প্রবণতা তাদের চিরন্তন। অথচ তাদেরই মধ্যে বাস করেও বিশ্ব-বিখ্যাত বুদ্ধদেব আজীবন এ ঘোষণাই করে গেছেন যে, তিনি একজন সাধারণ মানুষ-মাত্র। এ ছাড়া অন্য কোন উক্তি তাঁর কণ্ঠ থেকে তাঁর কোন ভক্ত কখনও বের করতে পারেনি।
তাঁর অন্তিম বাক্যগুলি চিরদিন আমার অন্তরে একটি অব্যক্ত স্পন্দন জাগ্রত করেছে। তিনি তখন বৃদ্ধ, রুগ্ন, মৃত্যুপথযাত্রী; ঠিক সে-সময়ে একজন অস্পৃশ্য অন্ত্যজ ব্যক্তি তাঁর কাছে উপস্থিত হয়েছিল; সে গলিত মাংসভোজী। হিন্দুরা সেই জাতের কাউকে লোকালয়েই প্রবেশ করতে দেয় না। সেই শ্রেণীর একটি লোক সশিষ্য বুদ্ধদেবকে তার গৃহে আহারের নিমন্ত্রণ করেছিল। সে দীন দরিদ্র ব্যক্তিটির নাম চুন্দ। সে তার সাধ্যমত, যুক্তি বিবেচনামত সেই মহান্ আচার্যকে আপ্যায়িত করতে চেয়েছিল। তাই প্রচুর শূকর-মাংস এবং অন্ন প্রস্তুত করে বুদ্ধদেব ও তাঁর শিষ্যগণকে সে পরিবেশন করল। বুদ্ধদেব একবার সেই আহার্যগুলি তাকিয়ে দেখলেন। শিষ্যেরা সবাই ইতস্ততঃ করছিল—তারা সেই ভোজ্যদ্রব্য গ্রহণ করবে কিনা। বুদ্ধদেব তখন তাদের বললেন, ‘এ আহার্য তোমরা কেউ গ্রহণ কর না, তাতে তোমাদের ক্ষতি হবে।’ কিন্তু তিনি নিজে শান্তভাবে আসনে বসে সেই আহার্য গ্রহণ করলেন। তিনি সমদর্শী, তিনি আচার্য; অতএব তিনি চুন্দ-প্রদত্ত খাদ্যও গ্রহণ করবেন— এমন কি শূকরের মাংসও খাবেন! তাই তিনি খেলেন, স্থিরভাবে সেই আহার্য গ্রহণ করলেন।
তিনি তখন মরণাপন্নই ছিলেন। এখন মৃত্যু একেবারে আসন্ন উপলব্ধি করে বললেন, ‘ঐ বৃক্ষের নীচে আমার জন্য শয্যা করে দেওয়া হোক। আমার মনে হচ্ছে—আমার প্রয়াণের সময় উপস্থিত হয়েছে।’
তারপর সেই বৃক্ষমূলেই তিনি শয্যাগ্রহণ করলেন এবং সেখানেই দেহত্যাগ করেন, আর সেই শয্যা ছেড়ে উঠতে পারেননি। ঐ বৃক্ষতলে শুয়ে তিনি প্রথমেই জনৈক শিষ্যকে বলেছিলেন, ‘চুন্দের কাছে গিয়ে তাকে জানিয়ে এস, তার মত উপকারী বন্ধু আমার আর কেউ নেই, কারণ তার দেওয়া খাদ্য গ্রহণ করেই আমি নির্বাণ লাভ করতে চলেছি।’
এর পরও কতক লোক তাঁর কাছে উপদেশ লাভের জন্য এসেছিল। একজন শিষ্য তাদের উদ্দেশ্য করে বলছিল, ‘প্রভুর খুব কাছে তোমরা যেও না। তিনি এখন মহাসমাধিতে নিমগ্ন হতে চলেছেন।’ কিন্তু সে-কথা শোনামাত্র বুদ্ধদেব বলে উঠলেন, ‘না, না, ওদের আসতে দাও।’ আবার কয়েকজন লোক এল, আবার শিষ্যেরা তাদের বাধা দিতে গেল; কিন্তু আবার বুদ্ধদেব তাদের নিকটে আহ্বান করলেন। তারপর তাঁর অন্যতম প্রধান শিষ্য আনন্দকে ডেকে বুদ্ধদেব বললেন, ‘বৎস আনন্দ! আমি চলে যাচ্ছি, সেজন্য শোক কর না। আমার জন্য চিন্তা কর না। মনুষ্যজীবনে মৃত্যু অবধারিত। তোমরা নিজেদের মুক্তির জন্য অধ্যবসায়ের সঙ্গে চেষ্টা কর। তোমরা প্রত্যেকেই সর্বাংশে আমারই মত। আমি তোমাদেরই একজন ছাড়া আর কিছু নই। অশেষ তপস্যায় আমি আমার জীবন গঠিত করেছি, সুতরাং তোমরাও অক্লান্ত চেষ্টা দ্বারা বুদ্ধত্ব লাভ করতে পার।’
বুদ্ধের শেষ অক্ষয় বাণী ছিল এইরূপঃ ‘কোন শাস্ত্রগ্রন্থের প্রামাণ্য, তা সে যত প্রাচীন গ্রন্থই হোক, মেনে নিও না। শুধু পূর্বপুরুষগণের উক্তি বলে কোন কথায় বিশ্বাস কর না, অথবা আর দশজন লোক বিশ্বাস করে বলেও কোন মতবাদ গ্রহণ কর না। প্রতিটি জিনিষ পরীক্ষা কর, যাচাই কর তারপর বিশ্বাস কর। আর যদি কোন কিছু বহুজনের হিতকর হবে বলে মনে কর, তবে সকলের মধ্যে সেটি বিতরণ কর।’—এই শেষ বাণী উচ্চারণ করেই বুদ্ধদেব দেহত্যাগ করেছিলেন।
এই মহতী প্রজ্ঞাবাণী অনুধাবনযোগ্য। তিনি দেবতা নন, দানব নন, দেবদূতও নন। না, সে-সব কিছুই তিনি নন। তিনি শুধু একজন দৃঢ়চিত্ত প্রাজ্ঞ ব্যক্তি—যাঁর মস্তিষ্কের প্রতিটি কোষ নিখুঁত, পরিপুষ্ট এবং জীবনের শেষমুহূর্ত পর্যন্ত সতেজ ও ক্রিয়াশীল। মোহ নেই, ভ্রান্তি নেই—এই বুদ্ধের স্বরূপ। তাঁর অনেক মতবাদের সঙ্গেই আমি একমত নই, আপনাদের অনেকেও হয়তো একমত হবেন না। কিন্তু আমি ভাবি—আহা, তার মহাশক্তির এক কণাও যদি আমার থাকত! পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ প্রজ্ঞাবান দার্শনিক তিনি। প্রবল ব্রাহ্মণ্যশক্তির অত্যাচারের কাছে কখনও তিনি মাথা নত করেননি। না, কখনও না। সর্বত্র সহজ ও ঋজু—এই তাঁর প্রকৃতি ছিল। দুঃখীর দুঃখে তিনি দুঃখী, তাদের সাহায্যে তিনি মুক্তহস্ত। আবার সঙ্গীতসভায় তিনি মহাসঙ্গীতজ্ঞ। শক্তিমানের মধ্যে তিনি মহাশক্তিমান্। কিন্তু সর্বত্রই সেই এক প্রাজ্ঞ মনীষী, সেই সমর্থ শক্তিমান্ পুরুষ।
কিন্তু এ-সব সত্ত্বেও তাঁর মতবাদের সবকিছু আমার বোধগম্য নয়। আপনারা জানেন—হিন্দুমতে মানুষের মধ্যে যে আত্মা বিরাজ করেন, সেই আত্মাকে তিনি স্বীকার করেননি। আর আমরা—হিন্দুরা এ-কথা বিশ্বাস করি যে, মানুষের মধ্যে শাশ্বত একটি পদার্থ আছে—যেটি অপরিবর্তনীয়, যেটি অনন্তকাল স্থায়ী। সেই পদার্থ আত্মা; তার আদি নেই, অন্ত নেই—সে-ই ব্রহ্ম। কিন্তু বুদ্ধদেব এই আত্মা, ব্রহ্ম—দুই-ই অস্বীকার করেছেন। তিনি বলতেন, কোন বস্তুর চিরস্থায়িত্বের কোন প্রমাণ নেই। … সবই নিত্যপরিবর্তনের সমষ্টি মাত্র। নিত্যপরিবর্তনশীল যে চিন্তাস্রোত—তারই সমষ্টিকে ‘মন’ বলে। একটি ঘূর্ণায়মান মশাল যেন এক শোভাযাত্রা পরিচালনা করছে, কিন্তু ঐ ‘অলাতচক্র’টি মায়া। অথবা একটি নদীর উপমা গ্রহণ করা যেতে পারে—একটি নদী যেমন অবিরাম প্রবাহে গতিশীল, প্রতি মুহূর্তে তার মধ্যে নূতন জলরাশি আসছে এবং চলে যাচ্ছে—জীবনও ঠিক তেমনি; দেহ, মনও তেমনি।
কিন্তু আমি তাঁর মতবাদ ঠিক বুঝতে পারি না। হিন্দুরা কখনও বুঝতে পারেনি। তবে তাঁর মতবাদের নিগূঢ় উদ্দেশ্যটি আমি বুঝতে পারি। আহা, সেটি একটি মহান্ উদ্দেশ্য—বিরাট উদ্দেশ্য! বুদ্ধদেব বলতেন, জগতে স্বার্থপরতাই প্রচণ্ড অভিশাপ। আমরা স্বার্থপর, তাই আমরা অভিশপ্ত বটে। স্বার্থপরতার কু-মতলব পরিহার করা কর্তব্য। একটি ঘটনা প্রবাহেরই মত জীবন বয়ে চলেছে। নদীপ্রবাহের সঙ্গেই তুলনা হতে পারে। ঈশ্বর নয়, আত্মা নয়, আত্মশক্তিতে বিশ্বাস নিয়ে নিজের পায়ের উপর দাঁড়াও। সৎকাজের জন্যই সৎকাজের অনুষ্ঠান কর—শাস্তির ভয়ে নয়, কোন আকাঙ্ক্ষিত লোকে যাবার উদ্দেশ্য নিয়েও নয়।
সুবুদ্ধি নিয়ে দাঁড়াও, মতলব ছেড়ে দিয়ে দাঁড়াও। সৎকাজ সৎ বলেই আমি তার অনুষ্ঠান করব, অন্য কোন কারণে নয়—এই হবে উদ্দেশ্য। কি অদ্ভুত, কি বিচিত্র এই মতবাদ! আমি তাঁর দার্শনিক তত্ত্বগুলির সঙ্গে কোন সময়েই একমত নই, এ-কথা পূর্বেই বলেছি; কিন্তু তাঁর নৈতিক প্রভাব আমাকে যেন উৎসাহিত করে তোলে। আপনারা প্রত্যেকে নিজ নিজ অন্তরে প্রবিষ্ট হয়ে প্রশ্ন করুন, দেখুন তাঁর মত নির্ভীকতা নিয়ে, শক্তি নিয়ে-এক ঘণ্টাও নিজের উপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে দাঁড়াতে পারেন কিনা! আমি তো পাঁচ মিনিটেই যেন ভয় পেয়ে যাই, একটি অবলম্বন যেন আমার কাছে অপরিহার্য হয়ে ওঠে। তখন আমি বুঝতে পারি—আমি কত ভীরু, কত দুর্বল! আর সঙ্গে সঙ্গে এই বিরাট মহামানবের কথা চিন্তা করে আমি উদ্দীপ্ত হয়ে উঠি। তাঁর যে প্রচণ্ড মহাশক্তি, তার কাছাকাছি যাওয়াও আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তেমন শক্তি-প্রকাশ জগৎ ইতঃপূর্বে আর কখনও প্রত্যক্ষ করেনি। আমি নিজে তো এরূপ শক্তি এ-পর্যন্ত কোথাও দেখিনি।
বস্তুতঃ আমরা তো ধর্মভীরু। নিজেকে বাঁচাতে আমরা সর্বদা সচেষ্ট, আর সেটি হলেই আমরা তৃপ্ত হয়ে থাকি। প্রচণ্ড ভীতি, নিগূঢ় স্বার্থপরতা সর্বদা আমাদের মধ্যে কাজ করছে; তারই ফলে আমাদের ভীরুতার শেষ নেই, ভয়ের অবধি নেই। অথচ এর মধ্যে দাঁড়িয়েই তাঁর এই ঘোষণা—‘সৎ বলেই সৎকার্য অনুষ্ঠান কর। কোন প্রশ্ন উত্থাপন কর না, সে-সবই নিরর্থক। গল্পে উপাখ্যানে, সংস্কার-সহায়ে মানুষকে সৎকার্যে প্রণোদিত করা হয়ে থাকে। তথাপি সুযোগ পেলেই সে অসৎকার্যে লিপ্ত হয়। শুধু সৎকর্মের জন্যই যে ব্যক্তি সৎ কর্মের অনুষ্ঠান করে থাকে, সে-ই যথার্থ মহৎ। কার্য-মাধ্যমে তার চরিত্রেরই যথার্থ পরিচয় পাওয়া যায়।’
একদা বুদ্ধকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘মৃত্যুর পর মানুষের কী অবশিষ্ট থাকে?’ উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘সবই থাকে, সবই থাকে।’ কিন্তু মানুষের মধ্যে অক্ষয় পদার্থ কোন্টি, সেটি তার চরিত্র—তার দেহ নয়, আত্মা নয়, অন্য কিছুই নয়। আর সেই চরিত্রই কালজয়ী হয়ে জীবিত থাকে। যাঁরা চলে গেছেন, তাঁরা তাঁদের চরিত্ররূপ মহাসম্পদই শুধু রেখে গেছেন, রেখে গেছেন আমাদের জন্য, সমগ্র মানবজাতির জন্য। আর কালে কালে সেই চরিত্র-প্রভাব কাজ করে চলেছে।
বুদ্ধের কথাই বলুন আর যীশুখ্রীষ্টের কথাই বলুন … এ-জগৎ তাঁদের চরিত্র-মহিমায় উদ্ভাসিত! মহাশক্তি-সমন্বিত এই মতবাদ। যা হোক, আসুন আমরা আবার মূল প্রসঙ্গে ফিরে যাই, কারণ সে-প্রসঙ্গে এখনও আমরা পৌঁছাইনি। (সকলের হাস্য।) কাজেই আজ সন্ধ্যায় আরও দু-চারটি কথা আমায় বলতে হবে। … বুদ্ধদেব সম্বন্ধে আর একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে—তাঁর কর্মপন্থা, তাঁর সংগঠন। আজ গীর্জা সম্বন্ধে, ধর্মসংস্থা সম্বন্ধে আপনাদের যে মত ও ধারণা গড়ে উঠেছে—সে-ও তারই চরিত্র থেকে। তিনি মামুলি ধরনের ধর্মসংস্থা পরিত্যাগ করেছিলেন, কিন্তু নিজ সন্ন্যাসী শিষ্যবর্গকে একত্র করে নূতন একটি সঙ্ঘ গঠন করেছিলেন। সেই সঙ্ঘে—যীশুখ্রীষ্টের জন্মের সাড়ে পাঁচ-শ বছরেরও পূর্বে ভোটপত্র-সহায়ে মতামত দেবার প্রথা পর্যন্ত গৃহীত হয়েছিল এবং তাঁর সংগঠনও সর্বাংশে নিখুঁত ছিল।পূর্বতন ধর্মসংস্থার বাইরে—এই নূতন ধর্মসঙ্ঘ অত্যন্ত শক্তিশালী হয়েছিল এবং ভারতবর্ষে ও ভারতের বাইরে প্রভূত সেবামূলক কাজ করেছিল।
এর তিন-শ বছর পরে এবং যীশুখ্রীষ্টের জন্মের দু-শ বছর পূর্বে মহান্ সম্রাট্ অশোকের আবির্ভাব হয়। পাশ্চাত্য দেশের ঐতিহাসিকগণ তাঁকে ‘দেবোপম সম্রাট্’ বলে আখ্যাত করেছিলেন। তিনি সম্পূর্ণরূপে বুদ্ধের মতবাদ গ্রহণ করেছিলেন। তৎকালে সমগ্র পৃথিবীতে তিনিই ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ সম্রাট্। তাঁর পিতামহ ছিলেন আলেকজাণ্ডারের সমসাময়িক এবং সে-সময় থেকেই ভারতবর্ষের সঙ্গে গ্রীসের একটি ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিল।
অধুনা প্রায় প্রত্যহই মধ্য এশিয়ায় কোন শিলালিপি বা ঐ-জাতীয় কিছু আবিষ্কৃত হচ্ছে। ভারতবর্ষ তো বুদ্ধ বা অশোকের কথা ভুলেই গিয়েছিল। অথচ এখানে স্তম্ভগাত্রে বা শিলাখণ্ডে প্রাচীন হরফে বহু বাণী উৎকলিত ছিল। কিন্তু সেগুলির পাঠোদ্ধার করতে কেউ সক্ষম ছিল না। … প্রাচীন মোগল সম্রাটের কেউ কেউ লক্ষ মুদ্রা পারিতোষিক ঘোষণা করেও সেগুলির পাঠোদ্ধারে সক্ষম হননি।
কিন্তু বিগত ত্রিশ বৎসরের মধ্যে সে-সব লিপির পাঠোদ্ধার করা হয়েছে। পালি-ভাষায় সে-সব বাণী লিখিত। প্রথম শিলালিপিটি এইরূপঃ “ …
অতঃপর যুদ্ধের ভয়াবহতা এবং করুণ দুঃখকাহিনী বিস্তারিতভাবে উৎকলিত হয়েছে। এর পরই অশোক বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। শিলালিপিতে লিখেছিলেনঃ ‘অতঃপর, আমার বংশধরগণের মধ্যে কেউ যেন অন্য কোন জাতিকে যুদ্ধে জয় করে যশোলাভের প্রয়াসী না হয়। যদি তারা যশস্বী হতে চায়, তবে অন্য জাতিকে সাহায্য করেই যেন তারা যশ অর্জন করে। জ্ঞান-বিজ্ঞানের যাঁরা শিক্ষক ও আচার্য—বিভিন্ন দেশে যেন তাঁদের প্রেরণ করা হয়। তরবারির সহায়তায় যে যশ অর্জিত হয়, সেটা যশই নয়।’
এর পরেই দেখা যায়—কিভাবে অশোক বিভিন্ন দেশে, এমন কি সুন্দর আলেক-জান্দ্রিয়ায় পর্যন্ত ধর্মপ্রচারক প্রেরণ করেছেন। আর বিস্ময়কর দ্রুততার সঙ্গে ঐ-সব অঞ্চলের সর্বত্র নানা সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়েছিল—থেরাপুত্ত, এসিনি প্রভৃতি নামে যাদের খ্যাতি। এ-সব সম্প্রদায় কঠোর নিরামিষাশী।
মহামতি সম্রাট্ অশোক চিকিৎসালয় স্থাপন করেছিলেন মানুষের জন্য তো বটেই, পশুর জন্যও। নানা শিলালিপিতে এই সব চিকিৎসালয় স্থাপনের নির্দেশ রয়েছে—দেখা যায়।যখন কোন গৃহপালিত পশু বৃদ্ধ ও অকর্মণ্য হয়ে যাবে এবং তার মনিব দারিদ্র্যবশতঃ আর সেটিকে প্রতিপালন করতে সক্ষম হবে না, তখন তাকে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিতে হবে, দয়া করে হত্যা করা হবে না। সে-সব চিকিৎসালয় জনসাধারণের অর্থেই পরিচালিত হত। বহির্বাণিজ্যের ব্যবসায়ীরা বিক্রীত বস্তুর ওজনের উপর হন্দর-হিসাবে যে শুল্ক দিত, সে-সবই ঐ-সকল চিকিৎসালয়ের জন্য ব্যয়িত হত। কাজেই কারও উপর কোন চাপ দেওয়া হত না, অথচ সুব্যবস্থা ছিল সকলের জন্য। তোমার পালিত গাভীটি বৃদ্ধ হয়েছে, তুমি আর রাখতে চাও না, তাকে পশুচিকিৎসালয়ে পাঠিয়ে দাও, তারা রাখবে সেটিকে। এমন কি বিড়াল ইঁদুর প্রভৃতি নিম্নতর প্রাণীদেরও স্থান ছিল সেখানে। মেয়েরা শুধু এগুলিকে মেরে ফেলতে চাইতেন, তাঁরা কখনও কখনও দলবদ্ধ হয়ে নানা বিষাক্ত খাদ্য নিয়ে যেতেন এবং তাই খাইয়ে বহু প্রাণী মেরে ফেলতেন।
কিন্তু অশোকের অভিমত ছিল এই যে, মানুষের জীবন রক্ষা যেমন সরকারের কর্তব্য, প্রাণীদের জীবনরক্ষাও তেমনি সরকারের কর্তব্য হওয়া উচিত। প্রাণিহত্যা করা হবে কেন? কোন্ যুক্তিতে? কোন সঙ্গত যুক্তি নেই তার পশ্চাতে। তবে মানুষের আহারের প্রয়োজনে পশুবধ নিষিদ্ধ করবার পূর্বে সর্বপ্রকার সব্জির ব্যবস্থা করে দিতে হবে। সেইজন্যে নানাদেশ থেকে তরকারির বীজ সংগ্রহ করে দেশে বপন করেছিলেন তিনি এবং সেগুলি আহারোপযোগী হবার সঙ্গে সঙ্গেই আদেশ-পত্র জারি করেছিলেন যে—প্রাণিহত্যামাত্রই দণ্ডনীয় অপরাধ বলে গণ্য হবে। যে-কোন যোগ্য সরকারের পক্ষে প্রাণীদের রক্ষা করাও অবশ্য করণীয় কার্যরূপে গণ্য হওয়া উচিত। নিজের আহারের জন্য গো ছাগ প্রভৃতি প্রাণী হত্যা করবার কি অধিকার মানুষে আছে?
এই ভাবে বৌদ্ধধর্ম রাজনীতি-ক্ষেত্রেও অসাধারণ প্রভাব ও ক্ষমতা বিস্তার করেছিল। কালক্রমে অবশ্য ধর্মপ্রচারকদের নানা অভিযানের সঙ্গে সঙ্গে সে ধর্ম বিপর্যস্ত হয়েছিল। তবে তাদের কৃতিত্বের পরিচায়ক হিসাবে এ-কথা অবশ্য স্বীকার করতে হবে যে, ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে তারা কখনও তরবারির সাহায্য গ্রহণ করেনি। আর সেই সঙ্গে এ-কথাও স্বীকার করতে হবে যে, এক বৌদ্ধধর্ম ভিন্ন জগতের আর কোন ধর্মই রক্তপাত না করে এক পা অগ্রসর হতে সক্ষম হয়নি। মাত্র মস্তিষ্কের শক্তি দিয়ে হাজার হাজার নরনারীকে ধর্মান্তর গ্রহণ করান—অপর কোন ধর্মের পক্ষেই সম্ভব হয়নি। না, কোথাও হয়নি, কোন যুগে হয়নি।
আর আপনারা ঠিক এই জিনিষই করতে চলেছেন ফিলিপাইন দ্বীপপুঞ্জে। তরবারি দিয়ে ধর্ম শেখান—এই তো আপনাদের প্রণালী! এই তো ধর্মযাজকগণ প্রচার করে থাকেন! বলপ্রয়োগে জয় করে, হত্যা করে ধর্মশিক্ষা দেওয়া! ধর্মশিক্ষার এক বিচিত্র প্রণালীই বটে!
আপনারা জানেন—কিভাবে মহামতি সম্রাট্ অশোক বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। যৌবনে তিনি খুব সৎ লোক ছিলেন না। তাঁর এক ভাই ছিল। দুই ভাইয়ের মধ্যে একবার প্রচণ্ড কলহ হয়। অশোক পরাজিত হয়েছিলেন সেই কলহে। সেই প্রতিহিংসায় নিজ ভ্রাতাকে হত্য করবার সঙ্কল্প করেছিলেন অশোক। তাঁর ভ্রাতা তখন আত্মরক্ষার জন্য এক বৌদ্ধ বিহারে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সংবাদ পেয়ে অশোক সেই বিহারে নিজে গিয়ে দাবী করলেন— ভ্রাতাকে তাঁর হাতে সমর্পণ করবার জন্য। তখন মঠাধ্যক্ষ সন্ন্যাসী তাঁর নিকটে এই বাণী প্রচার করেছিলেনঃ ‘প্রতিহিংসা ভাল নয়। প্রেম দ্বারা ক্রোধ জয় কর। ক্রোধ কখনও ক্রোধ দ্বারা শান্ত হয় না, ঘৃণাও ঘৃণা দ্বারা দূরীভূত হয় না। প্রেম দ্বারা ক্রোধ জয় কর—হিংসা জয় কর। হে বন্ধু, একটি অন্যায়ের পরিবর্তে তুমি যদি আর একটি অন্যায় কার্য কর, তবে তার দ্বারা প্রথম অন্যায়টির প্রতিকার হয় না, বরং সংসারে আরও একটি নূতন অন্যায় সাধিত হয়ে থাকে।’ উত্তরে সম্রাট্ বলেছিলেন, ‘ঠিক কথা, ঠিক কথা! কিন্তু তুমি একটি মূর্খ! ঐ ব্যক্তির জীবনরক্ষার জন্য তোমার নিজ জীবনটি বিসর্জন দিতে তুমি প্রস্তুত আছ কি?’
‘হ্যাঁ, আমি প্রস্তুত আছি সম্রাট্।’ এ-কথা বলার সঙ্গে সঙ্গেই সে সন্ন্যাসী সম্রাটের সম্মুখে এসে সোজা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন এবং সম্রাটও তরবারি কোষমুক্ত করে বলেছিলেন— ‘তবে প্রস্তুত হও,’ কিন্তু তরবারির আঘাত আনতে গিয়ে সহসা তিনি সেই সন্ন্যাসীর মুখের দিকে তাকালেন। প্রশান্ত সে মুখমণ্ডল, চোখের পলকটি পর্যন্ত যেন পড়ছে না! সম্রাট্ স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তুমি এ সাহস, এ অকম্পিত ভাব কোথা থেকে আয়ত্ত করলে—ভিক্ষুক সন্ন্যাসী?’
তখন সে সন্ন্যাসী আবার বুদ্ধের বাণী উচ্চারণ করতে লাগলেন এবং সম্রাটও বিস্মিত, মুগ্ধ হয়ে সেই অমৃত বাণী আরও শোনাবার জন্য অনুরোধ জানাতে লাগলেন। এইভাবে বুদ্ধের জীবন ও বাণীর কাছে অশোক আত্মসমর্পণ করেছিলেন।
বৌদ্ধধর্মে তিনটি জিনিষ আছে। স্বয়ং বুদ্ধ, তাঁর ধর্ম ও তাঁর সঙ্ঘ। প্রথমে সেই ধর্ম অত্যন্ত সরল ছিল, অনাড়ম্বর ছিল। তাঁর মৃত্যকালে তদীয় শিষ্যগণ প্রশ্ন করেছিলেন—‘প্রভু, আপনার সম্বন্ধে আমাদের কর্তব্য কি?’ আপনার স্মৃতিরক্ষার জন্য কিরূপ স্মৃতিস্তম্ভ আমরা নির্মাণ করব?’
উত্তরে তিনি বলেছিলেন, ‘আমাকে নিয়ে তোমাদের কিছুই করণীয় নেই। যদি ইচ্ছা হয়, আমার চিতাভস্মের উপর একটি মাটির স্তূপ নির্মাণ কর। অথবা তাও করবার আবশ্যকতা নেই।’ কিন্তু কালক্রমে অবস্থার পরিবর্তন হল। বিশাল মন্দির ও স্তূপাদি বুদ্ধের স্মৃতিচিহ্ন-রূপে নির্মিত হল। বৌদ্ধরাই মূর্তিপূজা প্রচলিত করল, অথচ তার পূর্বে মূর্তিপূজার বিষয় মানুষের জানাই ছিল না, বুদ্ধের নানা অবস্থার মূর্তি, ভোগ-নিবেদন, উপাসনা—সবই এসে গেল। এবং সঙ্ঘের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে এ-সবের জটিলতাও বর্ধিত হতে লাগল। ক্রমে বৌদ্ধমঠগুলি প্রচুর ধন-সম্পদের অধিকারী হল; আর পতনের বীজও উপ্ত হল সেই সঙ্গে।
সন্ন্যাস যদি অল্পসংখ্যক যোগ্য অধিকারীর মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে, তবে সেটি ভাল, কিন্তু যখন সেই সন্ন্যাস এমনভাবে প্রচারিত হতে থাকে যে, যে-কোন পুরুষ বা নারী সামান্য আগ্রহ বা অনুপ্রেরণাবশেই সমাজ ও সংসার ত্যাগ করে সেটি গ্রহণ করতে শুরু করে, তখনই বিপদ; যখন দেখা গেল সারা ভারতবর্ষ জুড়ে অনেক মঠ বা আশ্রম গড়ে উঠেছে এবং এক-একটিতে শত সহস্র সন্ন্যাসী বাস করছে, এমন কি কোন কোন ক্ষেত্রে বিশ হাজার পর্যন্ত ভিক্ষু একই মঠ-বাড়ীতে বাস করছে—বিরাট বিশাল সব পাকা মঠ বা আশ্রমের বাড়ী, অবশ্য জ্ঞানচর্চার কেন্দ্ররূপেই সেগুলি পরিচালিত, তখনই যথার্থ বিপদের কাল—কারণ জাতীয় জীবনস্রোত তখনই ব্যাহত হয়। সৎ গৃহীর অভাবে সৎ পুত্রকন্যা আর সমাজে তখন যথেষ্ট সংখ্যায় জন্মগ্রহণ করত না। সবল ও শক্তিমানগণ চলে গেল সমাজের বাইরে, আর দুর্বলের সংখ্যাধিক্য ঘটল সমাজে। ফলে শক্তি ও বীর্যের অভাবেই জাতি ক্ষয়িষ্ণু হয়ে গেল।
এবার বিচিত্র বৌদ্ধসঙ্ঘের কথা কিছু বলব। বিরাট ছিল সে সঙ্ঘ; তবে চিন্তা এবং মতবাদ এক কথা, আর বাস্তবভূমিতে তার প্রয়োগ সম্পূর্ণ অন্য কথা।
অহিংসা, মৈত্রী—এ সব তত্ত্ব-হিসাবে উত্তম, কিন্তু আমরা সবাই যদি সত্যি সত্যি অহিংস নীতি অবলম্বন করে কর্মক্ষেত্রে গিয়ে দণ্ডায়মান হই, তাহলে এ নগরের আর কিছু অবশিষ্ট থাকবে না। অর্থাৎ তত্ত্ব-হিসাবে ঠিক হলেও বাস্তব ক্ষেত্রে তার সার্থক প্রয়োগের পথ কেউ নির্ধারণ করতে সক্ষম হয়নি। আরও একটি কথা। সেটি বর্ণ বিচার-সম্পর্কে। রক্তের বিশুদ্ধতার দিক্ থেকে বর্ণবিচারের কিছুটা অর্থ আছে। বংশ-ক্রমিকতা অনস্বীকার্য। এদিক থেকে নিগ্রো কিম্বা রেড-ইণ্ডিয়ানদের সঙ্গে আপনারা নিজেরা কেন রক্ত-সম্পর্ক স্থাপন করতে চান না, সেটা হয়তো উপলব্ধি করতে পারবেন। প্রকৃতিই এর প্রতিকূল হয়ে থাকে। প্রকৃতির প্রতিবন্ধকতা-হেতুই এরূপ রক্তের সংমিশ্রণ ঘটতে পারে না। কোন অদৃশ্য শক্তিই যেন এইভাবে বিভিন্ন জাতিকে রক্ষা করে থাকে। বস্তুতঃ এইটিই আর্যদের বর্ণবিভাগ। তার অর্থ এ নয় যে, নিম্নবর্ণের লোকেরা উচ্চবর্ণদের সমপর্যায়ের নয়, কিম্বা বিশেষ সুযোগ সুবিধা থেকে তারা বঞ্চিত থাকবে। তবে এটা আমরা জানি যে, রক্তের অবাধ মিশ্রণে জাতির অবনতি হয়। আর্য এবং অনার্যদের মধ্যে কঠোর জাতিবিচার সত্ত্বেও বর্ণবিভেদের প্রাচীর কতকাংশে তারা অপসারিত করেছিল এবং তারই ফলে একাধিক বহিরাগত জাতি তাদের অদ্ভুত আচার-ব্যবহার এবং পোষাক-পরিচ্ছদ নিয়ে এদের মধ্যে ঢুকে পড়েছিল। পরিচ্ছদে এদের শালীনতা ছিল না, মৃতদেহের গলিত মাংস এরা আহার করত। তথাপি প্রথমাবস্থায় খানিকটা বাহ্য ভব্যতা বজায় ছিল, কিন্তু কয়েক বৎসরের মধ্যেই এদের গোঁড়ামি, কুসংস্কার, নরবলিপ্রথা, গোষ্ঠীগত কদাচার—সবই ধীরে ধীরে এসে মূল সমাজে প্রবেশ করল। প্রথম দিকে খানিকটা প্রচ্ছন্ন থাকলেও পরে ঐ-সব দোষই অত্যন্ত প্রবল হল, প্রকট হয়ে উঠল।তাতে সমগ্র জাতি নীচু হয়ে গেল, অসবর্ণ-বিবাহের মধ্য দিয়ে উচ্চ এবং নিম্নবর্ণের মধ্যে রক্তের সংমিশ্রণ ঘটল এবং জাতি হীনবীর্য হয়ে গেল।
অবশ্য দূর ভবিষ্যতে এটিও শুভ ফলপ্রসূই হয়ে থাকে। ধরুন, আপনারা যদি নিগ্রোদের সঙ্গে কিম্বা রেড-ইণ্ডিয়ানদের সঙ্গে রক্ত-সম্পর্কে মিশ্রিত হন, তবে নিঃসন্দেহ—বর্তমান সভ্যতা নষ্ট হয়ে যাবে। কিন্তু বহু শতাব্দী পরে এই মিশ্রণের ফলেই এক দুর্ধর্ষ জাতির উদ্ভব হবে—যার বলবীর্য হবে অতুলনীয়। কাজেই সাময়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলেও পরে সুফল লাভ হয়ে থাকে।
হিন্দুরা বিশ্বাস করে যে, জগতে মাত্র একটিই সুসভ্য জাতি আছে—সেই জাতি আর্যজাতি। এ একটি বিচিত্র বিশ্বাস সন্দেহ নেই। কিন্তু তবু এ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে আমি কিছু বলতে পারি না, কারণ এর বিরুদ্ধে কোন প্রমাণ আমি পাইনি। এই আর্যজাতির শোণিত-মিশ্রণ লাভ করতে না পারলে নূতন সভ্যজাতির উদ্ভব সম্ভব নয়। কোন প্রকার শিক্ষার দ্বারা সেটি হতে পারে না। আর্যজাতির রক্ত হচ্ছে প্রাথমিক প্রয়োজন, তারপর তার সঙ্গে শিক্ষা—এতেই নূতন সভ্যতা জন্মলাভ করে, কেবলমাত্র শিক্ষায় নয়।
আপনাদের দেশের কথা ধরুন—আপনারা যদি নিগ্রোদের সঙ্গে রক্ত-মিশ্রণে সম্মত হন, তবে নিগ্রোদের মধ্যে উচ্চতর সংস্কৃতি-প্রবেশ করতে পারে। কিন্তু সেরূপ রক্ত-মিশ্রণে কি সম্মত হবেন আপনারা?
হিন্দুরা বর্ণবিভাগ পছন্দ করে। ঠিক বলতে পারি না, তবে হয়তো আমার মধ্যেও সে বর্ণবিভাগের ছোঁয়া লেগে থাকতে পারে। পূবর্গ আচার্যগণের আদর্শে আমি বিশ্বাস করি। সে আদর্শ মহান্ আদর্শ। কিন্তু তার বাস্তব রূপায়ণ খুব সার্থক হয়নি এবং উত্তরকালে ভারতীয় জাতির অধঃপতনের সেটি অন্যতম কারণও হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তবে এর ফলে আবার এক প্রচণ্ড সংমিশ্রণও সঙ্ঘটিত হয়েছিল। যেখানে নানাজাতির রক্ত-সংমিশ্রণ ঘটেছে—কেউ শ্বেত, কেউ পীত, কেউ আমারই মত কৃষ্ণকায়—অর্থাৎ নানা বিপরীত বর্ণের সংমিশ্রণ, অথচ কোন জাতিই নিজ নিজ আচার-ব্যবহার পরিত্যাগ করছে না—সেখানে ধীরে ধীরে এক অভাবিত রক্ত-সংমিশ্রণ ঘটছে এবং তার ফলে যথাকালে এক মহাবিপ্লব অবশ্যম্ভাবী। কিন্তু আপাততঃ সে মহাদৈত্য ঘুমিয়ে থাকবে, তার জাগরণের দেরী আছে। বিভিন্ন জাতির রক্ত-মিশ্রণের এই পরিণাম।
বৌদ্ধধর্মের ক্রম-অবনতির কালে অনিবার্য প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল। সমগ্র জগৎ একটি ঐক্যসূত্রে বিধৃত। এক জ্ঞানই সত্য—বহুজ্ঞান অজ্ঞান; সেটি ভ্রম, সেই একত্বের ধারণা থেকেই দ্বৈতবর্জিত অদ্বৈতবাদের উদ্ভব। ভারতীয় চিন্তায় সেই বিশিষ্টতা। যুগ যুগ ধরেই সেই অদ্বৈত মতবাদ ভারতবর্ষে বর্তমান। জড়বাদের উদ্ভব হলে কিম্বা নাস্তিকতা দেখা দিলেই সেই অদ্বৈততত্ত্ব ক্রিয়াশীল হয়ে ওঠে। বৌদ্ধধর্মের ক্ষেত্রেও তাই হল। বৌদ্ধধর্মের মুক্তদ্বারপথে নানা জাতীয় বর্বর তাদের বিচিত্র রীতিনীতি ও আচার-ব্যবহার নিয়ে ভারতবর্ষে অনুপ্রবেশ করেছিল, আর তারই ফলে এক ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছিল ভারতীয় সমাজে। সেই প্রতিক্রিয়ার নেতৃত্ব গ্রহণ করেছিলেন একজন তরুণ সন্ন্যাসী—তিনি আচার্য শঙ্কর। কোন নূতন মতবাদের প্রচার না করে বা কোন নূতন সম্প্রদায়ের প্রতিষ্ঠা না করে তিনি বৈদিক ধর্মকেই পুনর্বার বাস্তবজীবনে প্রয়োগ করেছিলেন। কাজেই আধুনিক হিন্দুধর্ম—প্রাচীন হিন্দুধর্মের উপাদানেই গঠিত, বেদান্তের প্রভাব ও প্রাধান্য এখানে প্রবল। তবে যে বস্তু একবার লুপ্ত হয়, তা আর পূর্ব জীবনীশক্তি নিয়ে ফিরে আসে না। কাজেই হিন্দুধর্মের পুরাতন উৎসবানুষ্ঠানাদি আর জীবন্ত হয়ে ফিরে এল না। আপনারা শুনলে বিস্মিত হবেন যে, প্রাচীন প্রথানুসারে—যে-হিন্দু গোমাংস ভক্ষণ করে না, সে খাঁটি হিন্দুই নয়। কোন কোন উৎসবে তাকে গোবধ করতেই হত, গোমাংস ভক্ষণ করতেই হত। আর আজ সেই প্রথা একেবারে বীভৎস বলে গণ্য হয়ে থাকে। অন্য সব বিষয়ে সম্প্রদায়ে-সম্প্রদায়ে মত-পার্থক্য থাকলেও এ-বিষয়ে আজ সবাই একমতাবলম্বী। কেই আর এখন গোমাংস ভক্ষণ করে না। প্রাচীন যুগের দেবদেবী, প্রাচীন যুগের পশুবলি সবই লুপ্ত হয়েছে, চিরদিনের মত লুপ্ত হয়েছে। আর বর্তমান ভারতবর্ষ বেদের আধ্যাত্মিক অংশটুকু গ্রহণ করেছে।
বৌদ্ধ সম্প্রদায়ই ভারতের প্রথম ধর্মসম্প্রদায়। এই ধর্মসম্প্রদায়ই এ-কথা প্রথমে প্রচার করেছিল যে, বৌদ্ধধর্মের নির্ধারিত পথই একমাত্র পথ—সেই পথের আশ্রয় ভিন্ন মুক্তির আর কোন পথ নেই—সেই পথই সত্য পথ। কিন্তু হিন্দুরক্ত ধমনীতে প্রবাহিত থাকায় অন্যান্য দেশের গোঁড়া সাম্প্রদায়িকদের মত তত নিষ্ঠুর এরা হতে পারেনি। কাজেই অন্যদেরও মুক্তি হবে, তবে বহু বিলম্বে এবং ধীরে ধীরে সেটি হওয়া সম্ভব—এ-কথাও তারা বলত। হিন্দুরক্তের প্রভাবের ফল ছিল সেটা। খুব বেশী নির্মম হওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। তবু বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করতে হবে—এই ছিল নির্দেশ।
এদিকে হিন্দুদের মতে অন্য সম্প্রদায়ে যোগদান করা ঠিক নয়। যে যেখানে আছ, সেইখানেই থাক—সেই স্থানটি যেন পরিধি, সেখানে থেকেই কেন্দ্রবিন্দুতে যাত্রা করা যেতে পারে। এইটি ঠিক। হিন্দুধর্মের সুবিধা এই যে, মত বা সূত্রের উপর বিশেষ গুরুত্ব হিন্দুধর্ম আরোপ করে না, আরোপ করে জীবনের উপর। জগতের সর্বোত্তম দার্শনিক মতবাদের অনুগামী হয়েও কেউ যদি আচারে-ব্যবহারে মূর্খ হয়—নির্বোধ হয়, তবে তার জ্ঞান ব্যর্থ। আর যদি জীবনে এবং ব্যবহারে কেউ সৎ হয়, তবে তার আশা আছে, তার ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।
এই যদি অবস্থা হয়, তাহলে বৈদান্তিকগণ সকলের জন্যই অপেক্ষা করতে পারেন। বেদান্তের প্রতিপাদ্য বিষয়ই হচ্ছে এই যে, এক অদ্বয় বস্তুই নিত্য সত্যরূপে বিরাজিত—তিনিই ব্রহ্ম। স্থান, কাল, কার্যপরম্পরা প্রভৃতি সব কিছুর ঊর্ধ্বে তাঁর স্থান। কোন সংজ্ঞা দ্বারা তাঁকে প্রকাশ করা যায় না। তিনি সৎ, তিনি চিৎ এবং তিনি আনন্দময়—এ-ছাড়া অন্য কোন ভাবে আর তাঁকে ব্যক্ত করা সম্ভব নয়। তিনি একক সত্য। আমি, তুমি—সজীব, নির্জীব—যেখানে যা কিছু আছে, সব কিছুর মধ্যেই তিনি সত্যরূপে অনুস্যূত। সেই পরজ্ঞানের উপর আমাদের সমুদয় জ্ঞান প্রতিষ্ঠিত, সেই পরমানন্দেই আমাদের সকল আনন্দ বিধৃত। মানুষ যখন এ তত্ত্বটি উপলব্ধি করে, তখন সেই পরম সত্যের সঙ্গে তার সম্পর্ক অচ্ছেদ্য হয়। সে এবং অদ্বৈত সত্য অভিন্ন হয়ে দাঁড়ায়।
অতএব সর্ব মলিনতা অপসারিত হলে, সর্ব স্থূলতা দূরীভূত হলে—সৎ ও পবিত্র স্বভাবের মধ্য দিয়ে মানুষ উপলব্ধি করে—যীশুখ্রীষ্ট যেমন বলেছিলেন—‘আমি এবং আমার পিতা এক ও অভিন্ন।’
বৈদান্তিকগণ সকলের জন্য ধৈর্য ধারণ করে অপেক্ষা করতে পারেন। যেখানে যে অবস্থাতেই আমরা থাকি না কেন, ‘আমি এবং পরমপিতা ঈশ্বর অভিন্ন’—এ উপলব্ধিই শ্রেষ্ঠ উপলব্ধি। এটিকে উপলব্ধি করতে হয়। যদি মূর্তিপূজা এ উপলব্ধির সহায়ক হয়, তবে মূর্তিপূজাই বিধেয়। যদি কোন মহাপুরুষ এ-বিষয়ে সাহায্য করতে সক্ষম হন, তবে তাঁকেই পূজা কর। যদি মহম্মদকে পূজা করলে কাজ হয়, তবে তাই কর। কিন্তু যা-ই করবে, ঐকান্তিক নিষ্ঠার সঙ্গে কর। বেদান্ত-মতে নিষ্ঠাই সিদ্ধির ধ্রুব সহায়ক। কেউ বাদ যাবে না, কেউ প্রত্যাখ্যাত হবে না। তোমার চিত্ত—যেখানে সর্বসত্য নিহিত—ধীরে ধীরে পর্যায়ে পর্যায়ে বিকশিত হবে এবং চরমে এই পরমতত্ত্ব তুমি উপলব্ধি করবে, ‘তুমি ও তোমার পরমপিতা এক ও অভিন্ন।’
মুক্তি কি? ব্রাহ্মী স্থিতিই মুক্তি। কিন্তু কোথায় সেই ব্রাহ্মী স্থিতি? সর্বত্র, সর্বস্থানে ও সর্বকালে যে ব্রাহ্মী স্থিতি, তাকেই ‘মুক্তি’ বলে।
এই যে বর্তমান মুহূর্তটি, বর্তমান ক্ষণটি—মহাকালের বুকে যে-কোন মুহূর্তেরই মত সেটি পরম মূল্যবান এই হচ্ছে প্রাচীন বেদের মহতী বার্তা। বৌদ্ধর্ধমের প্রভাবে এই বার্তা পুনর্জীবিত হয়েছিল। বৌদ্ধধর্ম ভারতবর্ষ থেকে নিশ্চিহ্ন হয়েছিল সত্য, কিন্তু ভারতের জাতীয় জীবনে সে এক অক্ষয় চিহ্ন রেখে গিয়েছে—দাক্ষিণ্যে ও জীবজন্তুর প্রতি অহিংসায়।আর আজ ভারতের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত বৈদান্তিক মতবাদ তার বিজয় অভিযান শুরু