প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

৩৬. ডক্টর দক্ষিণারঞ্জন শাস্ত্রী : লোকায়তর উৎস-প্রসঙ্গে

ডক্টর দক্ষিণারঞ্জন শাস্ত্রী : লোকায়তর উৎস-প্রসঙ্গে

ডক্টর দক্ষিণারঞ্জন শাস্ত্রী মহাশয় ভারতীয় বস্তুবাদের ইতিহাসকে চারটি পর্যায়ে বিভক্ত করতে চেয়েছেন। তার মতে, এই চারটি পর্যায়ের নাম হলো, বাৰ্হস্পত্য, লোকায়ত, চাৰ্বাক ও নাস্তিক। এই পর্যায়-বিভাগ যে কতোখানি তথ্য-সন্মত, এখানে সে-আলোচনা আমরা তুলতে চাই না; পাদটীকায়(৬১৩) আমরা দেখাবার চেষ্টা করবো শাস্ত্রী মহাশয়ের পর্যায়-বিভাগটি বহুলাংশেই কাল্পনিক। তবুও—এবং আমাদের যুক্তির বর্তমান পর্যায়ে এই কথাটিই বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক,—মুখের বিষয় ডক্টর দক্ষিণারঞ্জন শাস্ত্রী, ভারতীয় বস্তুবাদের ইতিহাস আলোচনায় মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী রচিত লোকায়ত নামের ক্ষুদ্র কিন্তু মূল্য পুস্তিকাটিকে উপেক্ষা করেননি। বস্তুত, মহামহোপাধ্যায় লোকায়তিকদের সম্বন্ধে যে অভিনব তথ্যগুলি সংগ্ৰহ করেছিলেন এবং যেগুলির ভিত্তিতে তিনি লোকায়তিকদের সঙ্গে সহজিয়া, কাপালিক প্রভৃতি সম্প্রদায়ের অভেদ প্রদর্শন করলেন সেগুলিকে ডক্টর দক্ষিণারঞ্জন শাস্ত্রী মহাশয় উপযুক্ত গুরুত্ব দিয়েছেন। মহামহোপাধ্যায় বলেছিলেন, সহজিয়া প্রভৃতি এই সম্প্রদায়গুলি অধঃপাতে-যাওয়া বৌদ্ধধর্মের পরিণাম মাত্র। এ-মতবাদ কতোখানি স্বীকারযোগ্য তার আলোচনায় আমরা একটু পরে প্রত্যাবর্তন করবো। আপাতত আমাদের দ্রষ্টব্য হলো, ডক্টর দক্ষিণারঞ্জন শাস্ত্রী মহাশয় কীভাবে মহামহোপাধ্যায়ের এই মতবাদটির উপরই আশ্রয় গ্রহণ করে ভারতীয় বস্তুবাদের ওই তথাকথিত ‘চতুর্থ’ পর্যায়টির ব্যাখ্যা করতে চাইছেন(৬১৪) :

Some of the sects of degenerated Buddhists, in which laxity in sexual morals was one of the features, became gradually affiliated to the Lokayata school. One of these sects was the Kapalika sect, . The Kapalikas are a Yery ancient sect. They drink wine, offer human sacrifices and enjoy women. They strive to attain their religious goal with the help of Human corpses, wine and women. They are dreaded by. all fyrirhunan cruelties. As Kama or the enjoymeạt or sensusi pleasure was the goal of this sect, it came gradually to be affiliated to the Nastika form of the Lokayata school according to which the summum bonum of the human life is…the enjoyment of gross sensual pleasure…Or, it may be, that the followers of the orthodox schools, through bitter contempt, identified the Lokayatikas with the fierce Kapalikas, as in the previous cases the Vedicists used freely the terms of abuse like ‘bastard’, ‘incest’ and ‘monster’ with regard to the Lokayatikas. At the time of Brihaspati, the author of Arthasastra, these Kapalikas were a distinct sect. In Gunaratna’s time we find them identified with the Lokayata school which had already become a hated name in the Country.
অর্থাৎ কিনা, অধঃপাতে-যাওয়া কয়েকটি বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বৈশিষ্ট্য ছিলো যৌনশৈথিল্য; এগুলি ক্রমশ লোকায়ত সম্প্রদায়ের সঙ্গে সংযুক্ত হয়। এগুলির মধ্যে একটি হলো কাপালিক সম্প্রদায়। তারা মদ্যপান করে, নরবলি দেয় এবং নারী উপভোগ করে। তারা শব, মদ্য ও নারীর সাহায্যে ধর্মের আদর্শ লাভ করবার চেষ্টা করে। অমানুষিক নিষ্ঠুরতার জন্য তারা সকলের মধ্যেই আতঙ্ক সঞ্চার করে। যেহেতু এই সম্প্রদায়ের কাছে কামই হলো আদর্শ সেই-হেতু লোকায়ত সম্প্রদায়ের নাস্তিক রূপটির সঙ্গে স্বভাবতই এদের (কাপালিকদের) যোগাযোগ স্থাপিত হয় : নাস্তিক লোকায়তিকেরাও কামকেই পুরুষাৰ্থ মনে করে। কিংবা, এমনও হতে পারে যে, আস্তিক সম্প্রদায়ের অনুগামীরা ঘৃণাভরেই লোকায়তিক ও নিষ্ঠুর কাপালিকদের অভিন্ন বলে উল্লেখ করছেন— যেমন কিনা, অন্যান্য দৃষ্টান্তে দেখা যায়, বৈদিক ঐতিহ্যের বাহকের লোকাতিকদের জারজ, পাষণ্ড ইত্যাদি নানা প্রকার গালিগালাজ করেছেন। অর্থশাস্ত্রপ্রণেতা বৃহস্পতির যুগে কাপালিক একটি স্বতন্ত্র সম্প্রদায় ছিলো; গুণরত্বের সময়ে দেখা যায় লোকায়ত ও কাপালিকদের মধ্যে অভেদ স্বীকৃত হচ্ছে— লোকায়ত শব্দটি তখন ঘূণাসূচক নামে পরিণত হয়েছে।

উদ্ধৃত অংশের তাৎপর্যটুকু বিশ্লেষণ করা যাক।।

মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীকে অমুসরণ করে লেখক ধরেই নিচ্ছেন যে, কাপালিক (তথা তান্ত্রিকাদি) সম্প্রদায়গুলি অধঃপাতে-যাওয়া বৌদ্ধধর্মের নমুনামাত্র। অতএব, তাঁর কাছে প্রশ্ন হলে, এ-হেন অধঃপতিত বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সঙ্গে লোকায়তিকদের যোগাযোগ কী করে সম্ভব হলো। এ-সম্ভাবনার ব্যাখ্যা হিসেবে তিনি আমাদের সামনে দুটি প্রস্তাব রাখছেন। এক, কাপালিকাদি সম্প্রদায় কামাচারী, লোকায়তিকরাও অর্থ ও কামকে পরম পুরুষাৰ্থ মনে করেছে; অতএব কালক্রমে উভয়ের মধ্যে যোগাযোগ স্বাভাবিক ঘটনামাত্র। দুই, কিংবা এমনও হতে পারে যে, বেদপন্থীদের কাছে কাপালিক শব্দটি আরো পাঁচরকম ঝাঁঝালো গালিগালাজের সামিল হয়েছিলো এবং অতএব লোকায়তিকদের প্রতি ঘৃণা প্রদর্শনের জন্যই তারা এদেরও কাপালিক বলে গালাগাল দিতেন।

ডক্টর শাস্ত্রীর এই দুটি প্রস্তাবের মধ্যে কোনোটি কি গ্রহণযোগ্য?

প্রথমটি নয়। এখানে ডক্টর শাস্ত্রীর প্রধান যুক্তি হলো, লোকায়ত-মতে অর্থ ও কাম পরমপুরুষাৰ্থ; কাপালিকাদি সম্প্রদায়গুলিও কামাচারী—অতএব এই কামপরায়ণতাই উভয়ের মধ্যে সেতুবন্ধন করেছিলো। কিন্তু আমরা ইতিপূর্বেই দেখেছি, ভারতীয় সংস্কৃতির ক্ষেত্রে এই কামাচারের পরিচয় শুধুমাত্র কাপালিকাদি আস্তিক-নিন্দিত সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বৈদিক সাহিত্যেও তার প্রভূত স্মারক টিকে থেকেছে। তার থেকে শুধু এই কথাই প্রমাণিত হয় যে, সভ্যতার দিকে অগ্রসর হবার পথে কোনো এক পর্যায়ে এই কামাচার মানব-চেতনার অনিবার্য অঙ্গ ছিলো। প্রসঙ্গত বলে রাখা যায়, ডক্টর শাস্ত্রীর সিদ্ধান্ত অনুসারে এই লোকায়ত-কাপালিক সমন্বয় শুধুমাত্র বৌদ্ধধর্মের অধঃপতনের পরিচায়ক নয়, ভারতীয় বস্তুবাদের অধঃপতনের পরিচায়কও। কেননা ডক্টর শাস্ত্রী রচিত ভারতীয় বস্তুবাদের ইতিহাসের তথাকথিত প্রথম তিনটি পর্যায়ে এই কামপরায়ণ ব্যভিচারের পরিচয় নেই।

ডক্টর শাস্ত্রীর দ্বিতীয় প্রস্তাবটিও গ্রহণযোগ্য নয়। কেননা, এই প্রস্তাব অনুসারে লোকায়ত ও কাপালিকাদি সম্প্রদায়ের মধ্যে মৌলিক সাদৃশ্য অন্বেষণ করা বৃথা; সাদৃশ্য শুধু এইটুকুই যে, উত্তরকালে বেদপন্থীদের কাছে লোকায়তিক ও কাপালিক উভয় নামই জারজ, পাষণ্ড ইত্যাদি ঘূণাসূচক শব্দমাত্রে পরিণত হয়েছিলো। অথচ, এই সম্ভাবনাটির প্রতি উপযুক্ত গুরুত্ব দিতে হলে ডক্টর শাস্ত্রীর পক্ষে স্ববিরোধী উক্তির আশ্রয় গ্রহণ করতেই হবে। কেননা, লোকায়ত্তিক ও কাপালিকাদি সম্প্রদায়ের মধ্যে যে মৌলিক ও তত্ত্বগত সাদৃশ্য আছে সে-কথা ভক্টর শাস্ত্রী স্বীকার করছেন এবং প্রায় হুবহু মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ভাষাতেই স্বীকার করছেন(৬১৫) :

They (Sahajias) believe that deha or the material human boày is all that should be cared for and their religious practices are connected with the union of men and women.

তাহলে ওই সম্প্রদায়গুলির সঙ্গে লোকায়তিকদের সাদৃশ শুধু এইটুকুই নয় যে, বেদপন্থীরা উভয় সম্প্রদায়কেই ঘৃণার চোখে দেখেছেন। ডক্টর দক্ষিণারঞ্জন শাস্ত্রীকেও স্বীকার করতে হচ্ছে যে, মৌলিক তত্ত্বের দিক থেকেও লোকায়তিকদের সঙ্গে কাপালিক, সহজিয়া প্রভৃতি সম্প্রদায়ের সাদৃশ্য রয়েছে।

আমাদের যুক্তি অনুসারে কৃষিকেন্দ্রিক জাদু-অনুষ্ঠানের মধ্যেই এ-জাতীয় ধ্যানধারণার উৎস। কিন্তু কৃষিবিদ্যার প্রাথমিক পর্যায় পার হয়ে উত্তর পর্যায়ে পৌঁছবার পরও ওই প্রাথমিক পর্যায়ের ধ্যানধারণার স্মারক উত্তরকালের ধর্মবিশ্বাস ও আচরণের মধ্যে টিকে থাকতে পারে। এবং এই কারণেই আমাদের দেশের শুধু তান্ত্রিক সাহিত্যেই নয়, মন্দির-ভাস্কর্য ইত্যাদির ক্ষেত্রেও বামাচার বা কামাচারের অজস্র স্মারক চোখে পড়ে। কিন্তু ডক্টর দক্ষিণারঞ্জন শাস্ত্রী কৃষিকেন্দ্রিক জাদু-অনুষ্ঠানের দিক থেকে এ-জাতীয় ধ্যানধারণার আদি-তাৎপর্য অনুসন্ধান করেননি। ফলে, উত্তরযুগে বামাচারী চেতনার ব্যাপক প্রভাব ব্যাখ্যা করবার আশায় তিনি আরো একটি কৃত্রিম প্রকল্প উপস্থাপিত করছেন : লোকায়তর প্রভাবে ভারতীয় ইতিহাসের একটা যুগে ভোগবাহুল্যের প্রবাহে দেশ প্রায় ভেসে গিয়েছিলো(৬১৬) :

The Lokayatikas were a creed of joy, all sunny. Through their influence, at that period of Indian history, the temple and the court, poetry and art, delighted in sensuousness. Eroticism prevailed all over the country. The Brahmin and the Chandala, the king and the beggar, took part with equal enthusiasm in Madanotsava, in which Madana or Kama was worshipped…… As a reaction against this practice of sexual romance, Vaisnavism made its appearance and the Madanotsava festival was replaced by Dolotsava.
অর্থাৎ (সারমর্ম), লোকায়তিকেরা ছিলো আনন্দবাহুল্যের প্রচারক। তাদের প্রভাবে, ভারতীয় ইতিহাসের সেই যুগটিতে মন্দির, রাজদরবার, শিল্প, সাহিত্য সর্বত্রই ভোগবাহুল্য দেখা দিলো। সারা দেশ ভেসে গেলো কামাচারে। ব্ৰাহ্মণ আর চণ্ডাল, রাজা আর ভিখিরি, সকলেই সমান উৎসাহে মদনোৎসবে অংশ গ্রহণ করতে শুরু করলো। এই মদনোৎসবে, মদন বা কাম-এর পুজো হতো।…
এই যৌন আচরণের প্রতিক্রিয়া হিসেবেই আবির্ভাব হলো বৈষ্ণবধর্মের এবং মদনোৎসবের স্থানে এলো দৌলোৎসব।

ভারতীয় ইতিহাসের এটা যে ঠিক কোন যুগের কথা হচ্ছে সে-প্রশ্নের উত্তর দেওয়া ডক্টর শাস্ত্রী অপ্রয়োজন বা হয়তো অস্বস্তিকর মনে করেছেন; তার কারণ লোকায়ত্তর প্রভাবে রাজা থেকে ভিখিরি পর্যন্ত মেতে ওঠবার ওরকম একটা যুগের কথা আসলে কাল্পনিক, ঐতিহাসিক নয়। আপাতত না হয় সে-প্রশ্ন ছেড়েই দেওয়া গেলো। বর্তমানে শুধু মদনোৎসবের কথাই তোলা যাক : গুণরত্নের রচনাতেও লোকায়তিকদের সঙ্গে এই জাতীয় এক উৎসবের যোগাযোগ সূচিত হয়েছে : বর্ষে বর্ষে কস্মিন্নপি দিবসে, ইত্যাদি। কিন্তু প্রশ্ন হলো, মদনোৎসবটি ঠিক কী? ডক্টর শাস্ত্রীর রচনা থেকে এমন কি এ-ধারণাও জন্মাতে পারে যে, আমাদের দেশে লোকায়তিকদের প্রভাবেই এই উৎসব প্রবর্তিত হয়েছিলো, ষে-রকম তিনি কল্পনা করছেন যে, একটা যুগে রাজসভা থেকে পর্ণকুটীর পর্যন্ত লোকায়তিকদের প্রভাবে ভেসে গিয়েছিলো!! কিন্তু এ-ধারণা যে কতোখানি কৃত্রিম তা বিস্তৃতভাবে আলোচনা করবারও প্রয়োজন নেই।

আসল কথা হলো, মদনোৎসবের সঙ্গে লোকায়তিকদের সম্পর্কের ইঙ্গিত দিয়েও ডক্টর দক্ষিণারঞ্জন শাস্ত্রী এই উৎসবটির তাৎপর্য-বিশ্লেষণে বিশেষ কোনো উৎসাহের পরিচয় দেননি। তার বদলে তিনি দীনেশচন্দ্র সেন মহাশয়ের(৬১৭) রচনা থেকে মদনোৎসবের একটি কবিত্বময় ও মনোরম,–কিন্তু একান্তভাবেই আধুনিক কল্পনার পরিণাম-বিশেষ,–বর্ণনার উপর নির্ভর করতে চেয়েছেন : “ফুল আর ফাগ, গান আর নাচ, দোলা আর খেলা—এই সব মিলে একটা হাল্কা আমোদের আবহাওয়া সৃষ্টি করে; সে-আবহাওয়ায় যৌন-নীতি সম্পর্কিত কঠোর নিয়মগুলি শিথিল হয় এবং পুরুষ ও নারী অবাধে মেলামেশা করে।” মদনোৎসবের সংস্কৃত সংস্করণ দোলোৎসবকে হয়তো এই রকম কবিত্ব করে বর্ণনা করা যেতে পারে; কিন্তু মদনোৎসবকে নয়। মদনোৎসবের আদি-ভাৎপর্য অন্বেষণের চেষ্টাটা অন্য রকম হওয়া উচিত।

সে-চেষ্টার পরিচয় পাওয়া যায় ডক্টর উইলিয়াম কুক্‌-এর(৬১৮) রচনায়। লোকায়তিকদের সঙ্গে যদি এ-জাতীয় উৎসবের কোনো সম্পর্ক সত্যিই স্বীকার করতে হয় তাহলে ডক্টর কুক্‌-এর গবেষণা অনুসরণ করলে লোকায়তর উৎসের উপরও আলোকপাত হতে পারে।

উইলিয়াম ক্রুক্‌ প্রশ্ন তুলছেন, ভারতবর্ষের পিছিয়ে-পড়ে-থাকা মানুষদের মধ্যে ওই মদনোৎসব বা হোলির অঙ্গ হিসেবে যে-সব জটিল অনুষ্ঠানাদির পরিচয় পাওয়া যায় সেগুলির বর্ণনা সংগ্রহ করে এ-উৎসবের কোনো সামগ্রিক ব্যাখ্যা দেওয়া সম্ভব কি না? তিনি এই উদ্দেশ্বে যে-তথ্য সংগ্রহ করলেন সেগুলির প্রতি লক্ষ্য রাখলে দেখা যায়, এ-উৎসব অত্যন্ত জটিল এবং এর মধ্যে নানা রকমের অনুষ্ঠান রয়েছে; গাছ পোড়ানো, আগুন জ্বালানে, আগুনের উপর হাঁটা, গাছ পোঁতা, জল ঢালা ইত্যাদি এবং অবশ্যই কামাচারও। অনুষ্ঠানেরর এই বিভিন্ন দিকগুলিকে বিশ্লেষণ করে এবং দেশ-বিদেশের সমতুল্য অনুষ্ঠানের সঙ্গে তুলনা করে, ডক্টর উইলিয়াম ক্রুক দেখাচ্ছেন, আগাগোড়াই এ-উৎসবের উদ্দেশ্য হলো প্রাকৃতির উর্বরতা বাড়ানো। উপসংহারে তিনি বলেছেন(৬১৯),

মোটের উপর এ-কথা মনে করা যায় যে, অনুষ্ঠানগুলির মূলে আছে মানুষ, পশু ও শস্যের উর্বরতা বাড়াবার কামনা। উদ্দেশ্যটা জাদুবিশ্বাস-মূলক; কিন্তু সে-জাদুবিশ্বাসের নানামুখী বিকাশের জট খোলা কঠিন : জাদু-অনুষ্ঠানগুলি কখনো সরাসরি উর্বরতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে, কখনো বা উর্বরতা-বিরোধী কারণগুলির নিরসনপ্রচেষ্টায় নিযুক্ত। কোথাও আবার অনুষ্ঠানের পিছনে আরো বিশিষ্ট উদ্দেশ্য অনুমান করা যায় : যেমন বৃষ্টি-আনা, ঋতুকে আয়ত্ত করা, কোনো নির্দিষ্ট ফসল ফলানো।

আমাদের পক্ষে এখানে ওই মদনোৎসবের পূর্ণাঙ্গ বিশ্লেষণ করবার অবকাশ নেই; এ-উৎসব কোন প্রভাবের ফলে আধুনিক দোলোৎসবে পর্যবসিত হয়েছে তার আলোচনাও স্বতন্ত্র। আমাদের যুক্তির পক্ষে এখানে ছুটি কথা বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক। প্রথমত, গুণরত্নের উক্তি থেকে অনুমান করা যায়, এজাতীয় কোনো উৎসবের সঙ্গে লোকায়তিকদের সম্পর্ক সত্যিই ছিলো। তাই ডক্টর দক্ষিণারঞ্জন শাস্ত্রী লোকায়তিকদের সঙ্গে মদনোৎসবের যে-সম্পর্ক অনুমান করেছেন তা অসঙ্গত নয়। কিন্তু তিনি এই সম্পর্কের যে-ব্যাখ্যা দেবার চেষ্টা করেছেন তাও স্বীকারযোগ্য নয়। কেননা, এই মদনোৎসবের প্রকৃত তাৎপর্য অনুসন্ধান করবার বদলে তিনি একে আধুনিক অর্থে নিছক আমোদপ্রমোদ ও উচ্ছৃঙ্খলতার নিদর্শন বলে গ্রহণ করতে চেয়েছেন। এবং এইখানেই আমাদের দ্বিতীয় বক্তব্যটির শুরু : মদনোৎসব বলে ওই প্রাচীন উৎসবটিকে আধুনিক অর্থে ভোগবাহুল্য বলে মনে করবার কোনো কারণ নেই। প্রাচীন মানুষদের কাছে এ-উৎসব জীবন-সংগ্রামেরই অঙ্গ ছিলো। এ-উৎসবের একটি প্রধান অঙ্গ হলো কামাচার বা বামাচার; তাকে আধুনিক অর্থে কামপরায়ণতা মনে করা ভুল হবে। কেননা, মনে রাখা দরকার, অর্ধ-অসহায় সেই মানুষেরা প্রাকৃতিক নিয়মকানুন বলতে যেটুকু বুঝেছিলো সে-বোধ অনুসারে মানুষের ফলপ্রসূত আর প্রাকৃতিক ফলপ্রসূতার মধ্যে সম্পর্ক আছে। তাই প্রজনন বা প্রজনন-সংক্রান্ত কোনো অনুষ্ঠানের সাহায্যেই তারা ওইভাবে প্রকৃতির ফলপ্রসূতাকেও আয়ত্তে আনবার চেষ্টা করেছে।

এই জাদুবিশ্বাসই যদি মদনোৎসবের প্রাণবস্তু হয় এবং এই মদনোৎসবের সঙ্গে যদি তান্ত্রিকাদি—তথা লোকায়তিক—ধ্যানধারণার যোগাযোগ থাকে, তাহলে একে কোনো একটা মতবাদের অবনত বা পতিত রূপ মনে করবার কারণ নেই। তার বদলে বরং এ-কথাই মনে করা স্বাভাবিক যে, এখানেই সে-ধ্যানধারণার আদিমতম ও প্রাকৃততম রূপটিকে খুঁজে পাওয়া যেতে পারে। তাই, কোনো একটা যুগে দেশগুদ্ধ, লোক লোকায়ত্ব মতবাদের মোহে পড়ে দেশটাকে একেবারে ব্যভিচারের স্রোতে ভাসিয়ে দিয়েছিলো,–এমনতরো সিদ্ধান্ত অবশ্যই কাল্পনিক।

———————-
৬১২. D. R. Shastri SHIMSH 1-3.
৬১৩. প্রথমত, ডক্টর দক্ষিণারঞ্জন শাস্ত্রী এই পর্যায়-বিভাগের সমর্থনে বিশেষ কোনো তথ্য সত্যিই উল্লেখ করেননি, বা করতে সমর্থ হননি। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “As the literature of this school is now entirely lost except what has reached us in fragments, we are quite unable to give here verbetim, all the original sutras of this school that represents its various aspetcs and phases. But there are passages both in sutra and sloka which embody in substance these different stages of the lohayata school (P. 2)”. কিন্তু সূত্র এবং শ্লোকলব্ধ তথ্য ঠিক কী এবং কী ভাবেই বা তা লেখকের পরিকল্পিত পর্যায়-বিভাগকে প্রমাণিত করে—এ-প্রশ্নের সদুত্তর সত্যিই তার গ্রন্থে পাওয়া যায় না। বরং তার পরিবর্তে কষ্ট-কল্পনা এবং পরস্পর-বিরোধী মন্তব্যেরই পরিচয় পাওয়া যায়। এখানে সে-জাতীয় কিছু দৃষ্টান্ত উল্লেখ করাই পর্যাপ্ত হবে। যথা :
তথাকথিত প্রথম পর্যায়ের বর্ণনায় লেখক বলছেন,…”it was a mere tendency to opposition. It called in question all kinds of knowledge, immediate and mediate, and all evidence, perception as well as inference. In that period its name was Barhaspatya (P. I).” লেখকের মতেম যে-বৃহস্পতির নাম থেকে সম্প্রদায়টির প্রথম পর্যায়ের ওই নামকরণ হয়েছিলো তিনি ঐতিহাসিক ব্যক্তিই ছিলেন (P. 3 ) এবং ঋগ্বেদেই তার পরিচয় পাওয়া যায়—অর্থাৎ, ঋগ্বেদের বৃহস্পতিই এ-সম্প্রদায়ের আদিগুরু (P. 9 ) । যদি তাই হয় তাহলে নিশ্চয়ই আশা করা অন্যায় হবে না ষে, লোকায়ত-সম্প্রদায়ের প্রথম পর্যায়টির উপরোদ্ধৃত বর্ণনার সঙ্গে লেখক বৈদিক বৃহস্পতির কোনো যোগাযোগ—বা অন্তত যোগাযোগের কোনো ইংগিত—প্রদর্শন করবার চেষ্টা করবেন। কিন্তু লেখক তা করেননি। এবং ঋগ্বেদের বৃহস্পতি যে সত্যিই called in question all kinds of knowledge, immediate and mediate-এ কথা প্রতিপন্ন করার একান্তই অসম্ভব। অবশ্যই ডক্টর শাস্ত্রী বলছেন, ‘From the earliest Vedic times, there were people who denied the existence of even the Vedic deities. The Vedic hymns pointedly refer to scoffers and unbelievers ( P. 6-7).” কিন্তু প্রশ্ন হলো, এর সঙ্গে বৃহস্পতির সম্পর্ক কী ? বৈদিক সাহিত্যে কি এ-জাতীয় কোনো ইংগিত পাওয়া যায় যে, বৃহস্পতিই so scoffers and unbelievers-দের অগ্রগামী ছিলেন? নিশ্চয়ই তা যায় না। এমনকি ডক্টর শাস্ত্রী নিজেও সে-কথা দাবি করতে পারছেন না। তার বদলে ঋগ্বেদের বৃহস্পতি প্রসঙ্গে তিনি মন্তব্য করছেন, “Some of the verses of the Vedic hymns ascribed to Brihaspati are very noble in thought. Whatever may be said of his followers, his own teachings were of an elevated character. Brihaspati had many followers and all of them were independent thinkers raising objections against the current superstitions. It is perhapes for his freedom of thought that he was regarded as the priest—the adviserthe counsellor of Indra, the king of the gods” (P.9). প্রথমত, এই উক্তির সঙ্গে পুর্বোদ্ধৃত উক্তিগুলির সঙ্গতি নেই। দ্বিতীয়ত, এই উক্তির বিভিন্ন অংশও তথ্য-প্রতিষ্ঠিত নয়। বৈদিক বৃহস্পতির যে সত্যিই বহু অনুগামী ছিলেন এবং তারা সকলেই যে স্বাধীন চিন্তাশীল ছিলেন ও সমসাময়িক কুসংস্কারের বিরুদ্ধে সকলেই যে আপত্তি তুলেছিলেন—এ-বিষয়ে লেখক কোনো প্রমাণই দেননি ; প্রমাণ দেওয়া নিশ্চয়ই সম্ভবও নয়। অতএব বক্তব্যগুলি নেহাতই লেখকের কল্পনাপ্রসূত। দ্বিতীয়ত, স্বাধীন চিন্তার গুণেই যে বৈদিক বৃহস্পতি দেবগুরু বলে স্বীকৃত হয়েছিলেন—এ-জাতীয় মন্তব্যের সমর্থনে অন্তত বৈদিক সাহিত্যের মধ্যে কোনো তথ্যই খুঁজে পাওয়া যায় না। অথচ ডক্টর শাস্ত্রী লোকায়তর ইতিহাসের যে-স্তরবিভাগ করেছেন তা আগাগোড়াই এ জাতীয় ঐতিহাসিক তথ্য নিরপেক্ষ এবং একান্তই কাল্পনিক কয়েকটি theory-র উপর প্রতিষ্ঠিত।
৬১৪. R. Shastri op. cit. 35-6.
৬১৫. Ibid. 39.
৬১৬. Ibid. 36.
৬১৭. Ibid.
৬১৮. W. Crooke in Folk-lore xxv. “The Holi: a Vernal Festival of the Hindus.”
৬১৯. Ibid.