‘নরদ্যাম্প্টন ডেলী হেরাল্ড’, ১৬ এপ্রিল, ১৮৯৪
স্বামী বিবেকানন্দ নিশ্চিতরূপে প্রমাণ করিয়া দিয়াছেন যে, সমুদ্রের অপর পারে আমাদের যে-সব প্রতিবেশী আছেন—এমন কি যাঁহারা সুদূরতম অঞ্চলের বাসিন্দা, তাঁহারাও আমাদের নিকট সম্পর্কের আত্মীয়, শুধু বর্ণ ভাষা আচার-ব্যবহার ও ধর্মে সামান্য যা একটু পার্থক্য। এই বাগ্মী হিন্দু সন্ন্যাসী গত শনিবার সন্ধ্যায় সিটি হল-এ তাঁহার বক্তৃতার উপক্রমণিকাস্বরূপ ভারতীয় এবং পৃথিবীর অন্যান্য জাতির উৎপত্তি সম্বন্ধে একটি ঐতিহাসিক চিত্র তুলিয়া ধরেন। উহাতে ইহাই প্রতিপাদিত হয় যে, অনেকে যথেষ্ট না জানিলেও বা অস্বীকার করিলেও জাতিসমূহের পারস্পরিক মিল ও সম্পর্ক একটি সুস্পষ্ট সত্য ঘটনা।
ইহার পর বক্তা মনোজ্ঞ ও প্রাঞ্জল কথোপকথনচ্ছলে হিন্দু জনগণের কতিপয় আচার-ব্যবহার সম্বন্ধে আলোচনা করেন। শ্রোতৃবৃন্দের মধ্যে যাঁহাদের এই আলোচ্য বিষয়টিতে একটি স্বাভাবিক বা অনুশীলিত অনুরাগ আছে, তাঁহারা বক্তা ও তাঁহার চিন্তাধারার প্রতি নানা কারণে বিশেষ আকৃষ্ট হইয়াছিলেন। কিন্তু বক্তা অপরদের নৈরাশ্যই উদ্বুদ্ধ করিয়াছিলেন, কেননা তাঁহার আলোচনার গণ্ডী আরও বিস্তৃত হওয়া উচিত ছিল। আমেরিকার বক্তৃতা-মঞ্চের পক্ষে বক্তৃতাটি অত্যন্ত দীর্ঘ হওয়া সত্ত্বেও হিন্দুদিগের ‘আচার-ব্যবহার’ সম্বন্ধে সামান্যই বলা হইয়াছিল। এই প্রাচীনতম জাতির এমন একজন সুযোগ্য প্রতিনিধির মুখ হইতে ঐ জাতির ব্যক্তিগত, নাগরিক, সামাজিক, পারিবারিক এবং ধর্মসংক্রান্ত আরও অনেক কিছু তথ্য শুনিতে পাইলে সকলেই খুশী হইতেন। মানব প্রকৃতি সম্বন্ধে যাঁহারা জিজ্ঞাসু, তাঁহাদিগের নিকট এই বিষয়টি খুবই চিত্তাকর্ষক, যদিও এই দিকে তাঁহাদের জ্ঞান খুবই সীমাবদ্ধ।
হিন্দু-জীবনের প্রসঙ্গ বক্তা আরম্ভ করেন হিন্দু-বালকের জন্ম হইতে। তারপর বিদ্যারম্ভ ও বিবাহ। হিন্দুর পারিবারিক জীবনের উল্লেখ সামান্য মাত্র করা হয়, যদিও লোকে আরও বেশী শুনিবার আশা করিয়াছিল। বক্তা ঘন ঘন সমাজ, নীতি ও ধর্মের দিক্ দিয়া ভারতীয় জাতির চিন্তা ও কার্যধারার সহিত ইংরেজীভাষী জাতিসমূহের ভাব ও আচরণের তুলনামূলক মন্তব্যে ব্যাপৃত হইতেছিলেন। তাঁহার সিদ্ধান্ত প্রায় সব ক্ষেত্রেই ভারতের অনুকূলে উপস্থাপিত হইতেছিল, তবে তাঁহার প্রকাশভঙ্গী অতি বিনীত, সহৃদয় ও ভদ্র। শ্রোতৃমণ্ডলীর মধ্যে কেহ কেহ ছিলেন, যাঁহারা হিন্দু জাতির সকল শ্রেণীর সামাজিক ও পারিবারিক অবস্থা সম্বন্ধে মোটামুটি পরিচিত। বক্তার আলোচিত অনেকগুলি বিষয়ে তাঁহাকে দু-একটি পাল্টা প্রশ্ন করিবার ইচ্ছা তাঁহাদের পক্ষে স্বাভাবিকই ছিল। উদাহরণ- স্বরূপ বলিতে পারা যায় যে, বক্তা যখন চমৎকার বাগ্মিতার সহিত ‘নারী জাতিকে দিব্য মাতৃত্বের দৃষ্টিতে দেখা’ হিন্দুদের এই ভাবটি বর্ণনা করিতেছিলেন—বলিতেছিলেন, ভারতে নারী চিরদিন শ্রদ্ধার পাত্রী এবং এমন কি কখনও কখনও যে গভীর বিশ্বাস ও ভক্তি সহকারে তিনি পূজিত হন, তাহা স্ত্রীজাতির প্রতি অতিশয় সম্মানসম্পন্ন আমেরিকান পুত্র, স্বামী ও পিতারা কল্পনাও করিতে পারিবেন না—তখন কেহ জিজ্ঞাসা করিতে পারিতেন যে, এই সুন্দর উচ্চ আদর্শটি কার্যতঃ হিন্দুদের গৃহে স্ত্রী, জননী, কন্যা এবং ভগিনীদের প্রতি কতদূর প্রয়োগ করা হইয়া থাকে।
বক্তা শ্বেতকায় ইওরোপীয় ও আমেরিকান জাতিদের বিত্তলোভ, বিলাসব্যসন, স্বার্থপরতা এবং কাঞ্চন-কৌলীন্যের সমালোচনা করিয়া উহাদের বিষময় নৈতিক ও সামাজিক পরিণামের কথা বলেন। তাঁহার এই সমালোচনা সম্পূর্ণ ন্যায্য এবং তিনি উহা অতি সুন্দরভাবে প্রকাশ করিয়াছেন। ধীর, মৃদু, শান্ত, অনুত্তেজিত ও মধুর কণ্ঠে বক্তা তাঁহার চিন্তাগুলিকে যে বাক্যের আকার দিতেছিলেন, উহাদের মধ্যে ছিল প্রচণ্ড ভাষার শক্তি ও আগুন এবং উহা সোজাসুজি তাঁহার অভিপ্রেত বিষয় ব্যক্ত করিতেছিল। য়াহুদীদের প্রতি যীশুখ্রীষ্টের উগ্র কটূক্তির কথা মনে হইতেছিল। কিন্তু অভিজাতকুলোদ্ভব, চরিত্র ও শিক্ষাদীক্ষায় উন্নত ঐ হিন্দু মহোদয় যখন মাঝে মাঝে কতকটা যেন তাঁহার নিজের অজ্ঞাতসারেই মূল বক্তব্য হইতে সরিয়া গিয়া প্রমাণ করিবার চেষ্টা করিতেছিলেন যে, তাঁহার স্বজাতির ধর্ম যাহা স্পষ্টভাবে আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থান্বেষী, প্রধানতঃ নিজেকে বাঁচাইতে ব্যস্ত, নেতিমূলক, নিশ্চেষ্ট ও কর্মবিমুখ—খ্রীষ্টধর্ম নামে পরিচিত প্রাণবন্ত, উদ্যমশীল, আত্মত্যাগী, সর্বদা পরহিতব্রতী, পৃথিবীর সর্বত্র প্রসারশীল, কর্মতৎপর ধর্ম হইতে পৃথিবীতে উপযোগিতার দিক্ দিয়া উৎকৃষ্ট, তখন মনে হয়, তাঁহার এই প্রচেষ্টা একটি বড় রকমের চাল। খ্রীষ্টধর্মাবলম্বী অবিবেচক গোঁড়ারা যতই শোচনীয় ও লজ্জাকর ভুল করিয়া থাকুক না কেন, ইহা তো সত্য যে পৃথিবীতে যত নৈতিক, আধ্যাত্মিক এবং লোকহিতকর কাজ দেখিতে পাওয়া যায়, তাহার নয়-দশমাংশ এই ধর্মের নামেই সম্পন্ন হইয়াছে।
কিন্তু স্বামী বিবে কানন্দকে দেখা ও তাঁহার কথা শুনিবার সুযোগ—কোন বুদ্ধিমান্ ও পক্ষপাতশূন্য আমেরিকানেরই ত্যাগ করা উচিত নয়। যে জাতি উহার আয়ুষ্কাল আমাদের ন্যায় শতাব্দীতে মাপ না করিয়া হাজার হাজার বৎসর দিয়া গণনা করে, সেই জাতির মানসিক, নৈতিক ও আধ্যাত্মিক সংস্কৃতির একটি অত্যুজ্জ্বল নিদর্শন হইলেন স্বামী বিবে কানন্দ। তাঁহার সহিত পরিচয় প্রত্যেকেরই পক্ষে প্রচুর লাভজনক। রবিবার অপরাহ্ণে এই বিশিষ্ট হিন্দু স্মিথ-কলেজের ছাত্রদের নিকট ‘ঈশ্বরের পিতৃভাব এবং মানবের ভ্রাতৃত্ব’ সম্বন্ধে বক্তৃতা করেন। শ্রোতৃবর্গের হৃদয়ে এই ভাষণ গভীর রেখাপাত করিয়াছিল। বক্তার সমগ্র চিন্তাধারায় উদারতম বদান্যতা এবং যথার্থ ধর্মপ্রাণতা যে পরিস্ফুট, ইহা প্রত্যেকেই বলিতেছিলেন।
‘স্মিথ কলেজ মাসিক’, মে, ১৮৯৪
১৫ এপ্রিল রবিবার হিন্দু-সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ—যাঁহার ব্রাহ্মণ্যধর্মের পাণ্ডিত্যপূর্ণ ব্যাখ্যান চিকাগো ধর্ম-মহাসম্মেলনে প্রভূত প্রশংসাসূচক মন্তব্যের সৃষ্টি করিয়াছিল—কলেজের সান্ধ্য উপাসনায় বক্তৃতা দেন। আমরা মানুষের সৌভ্রাত্র এবং ঈশ্বরের পিতৃভাব সম্বন্ধে কত কথাই বলিয়া থাকি, কিন্তু এই শব্দগুলির প্রকৃত তাৎপর্য অল্প লোকেই হৃদয়ঙ্গম করে। মানবাত্মা যখন বিশ্বপিতার এত সন্নিকটে আসে যে, দ্বেষ হিংসা এবং নিজের শ্রেষ্ঠত্বের ক্ষুদ্র দাবীসমূহ তিরোহিত হয় (কেননা মানুষের স্বরূপ—এগুলির অনেক ঊর্ধ্বে), তখনই যথার্থ বিশ্বভ্রাতৃত্ব সম্ভবপর। আমাদের সতর্ক থাকা উচিত—আমরা যেন হিন্দুদের গল্পে বর্ণিত ‘কূপমণ্ডূক’ না হইয়া পড়ি। একটি ব্যাঙ বহু বৎসর ধরিয়া একটি কূপের মধ্যে বাস করিতেছিল। অবশেষে কূপের বাহিরে যে খোলা জায়গা আছে, তাহা সে ভুলিয়া গেল এবং উহার অস্তিত্ব অস্বীকার করিতে লাগিল।