২.১৫ কিরীটীর ডাইরী

কিরীটীর ডাইরী

সুব্রতর ইচ্ছা, এখানে আমার ডাইরীর কয়েকটা পৃষ্ঠা পড়ে দেখুন, তাই সে আমার ডাইরী। থেকে খুব যত্ন সহকারে নকল করে দিয়েছে।

১৩ই ফেব্রুয়ারী…

কলকাতা শহরে শীতটা কি এবারে কিছুতেই যাবে না নাকি! ফেব্রুয়ারী মাসের মাঝামাঝি, এসময়টা কলকাতায় তেমন শীত থাকে না। কেবল একটা কোমল ঠাণ্ডার আমেজ থাকে মাত্র। শেষরাত্রের দিকে গায়ে চাদরটা টেনে দিতে বেশ আরাম লাগে। গতকাল সুরেন চৌধুরীকে সঙ্গে করে নিয়ে কলকাতায় ফিরে এসেছি। দীর্ঘকাল ধরে অন্ধকার পাতালঘরের মধ্যে একাকী বন্দী থেকে থেকে ভদ্রলোকের মাথার একটু গোলমাল হয়েছে যে সে বিষয়ে সন্দেহই নেই। মাথাখারাপের আর দোষ কি! ঐভাবে ছাব্বিশ বছর আমাকেও যদি কেউ আটকে রাখত, তবে আমিও নির্ঘাৎ পাগল হয়েই যেতাম। সুব্রতকে সুহাসিনী দেবীর কাছে পাঠিয়েছি। বলেছি কোন কথাই যেন সে আগে সুহাসিনী দেবীকে না বলে। কে জানে, এত বড় আনন্দ তিনি। সহ্য যদি না করতে পরেন!

১৪ই ফেব্রুয়ারী…

কথাগুলো আমি হুবহু তুলে দিচ্ছি।

রাত্রি নটা।

সুহাসিনী দেবী ধীর শান্ত পদে ঘরে এসে প্রবেশ করলেন, আমাকে আপনি ডেকেছেন মিঃ রায়?

বসুন, মা। আপনার সঙ্গে আমার প্রয়োজনীয় কয়েকটা কথা আছে। সেদিন রাত্রে আচমকা যখন আপনি আমার এখানে এসে আপনার একমাত্র ছেলেকে উদ্ধারের জন্য অনুরোধ করলেন, তখন অপনার মুখে সমস্ত কাহিনী শুনে কেমন যেন আমার একটা ধারণা হয়েছিল, বোধ হয় সত্যিই আপনার পুত্র নিদোষ!

তবে কি–

ভয় নেই মা, সত্যিই আপনার ছেলে সম্পূর্ণ নির্দোষ। আপনার হয়ত মনে থাকতে পারে, সেরাত্রে বিদায়ের পূর্বমুহূর্তে আপনাকে আমি কোন আশ্বাস দিইনি, কেবলমাত্র এইটুকুই বলেছিলাম, সত্যিই যদি আপনার ছেলে নিদোষ হয়, তবে যেমন করেই হোক তাকে আমি মুক্ত করে আনব। এবং তা যদি না পারি তাহলে জানবেন, সে কাজ স্বয়ং কিরীটীরও সাধ্যাতীত ছিল। যা হোক, প্রমাণ পেয়েছি আপনার ছেলে সত্যিই নির্দোষ। কেবল তার স্বকীয় মৃতার জন্যই এ দুভোগ তাকে ভুগতে হল।

ভদ্রমহিলা উঠে দাঁড়িয়ে আমার হাত চেপে ধরলেন, সত্যি! সত্যি বলছ বাবা সে নির্দোষ? তাকে তুমি বাঁচাতে পারবে তাহলে?

সে যে নিদোষ সেটা আমি প্রমাণ করব, তবে আসলে তাকে মুক্তি দিতে পারেন তাঁরাই, যাঁরা তার একদিন বিচার করেছিলেন। যাঁদের হাতে আইনের ক্ষমতা দেওয়া আছে, একমাত্র তারাই। তবে সে ব্যবস্থাও আমি করেছি।

ভদ্রমহিলার দুটি চক্ষু দিয়ে দরদর ধারায় অশ্রু গড়িয়ে পড়তে লাগল, বাবা, কি বলে যে তোমায় আশীবাদ করব জানি না। ভগবান তোমার মঙ্গল করবেন।

কিন্তু মা, যেজন্য আজ রাত্রে এখানে আপনাকে কষ্ট করে আসতে বলেছি, সে কথা এখনও আমার বলা হয়নি। সত্যিই এতকাল পরে ভগবান আপনার দিকে মুখ তুলে চেয়েছেন। কিন্তু অভাবনীয়কে সহ্য করবার মত,অচিন্তনীয় আনন্দকে সহ্য করবার মত সাহস ও ক্ষমতা এখন আপনার চাই। এমন একটি মুহূর্ত আজ এতদিন পরে আপনার জীবনে এসেছে, যেটা আপনার কল্পনারও অতীত ছিল।

তুমি যে কী বলছ বাবা, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না!

মা, তবে শুনুন, এতক্ষণ আপনাকে বৃথা স্তোকবাক্য দিয়ে এসেছি। আমার অক্ষমতার জন্য সত্যিই আমি নিজে অত্যন্ত লজ্জিত। আমাকে ক্ষমা করতে পারবেন কিনা জানি না, আপনার ছেলেকে বাঁচাতে পারলাম না। সে গতকাল আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল লজ্জায় ঘৃণায়, জেলের মধ্যেই।

অ্যাঁ, সে কি!

বসুন মা, ব্যস্ত হবেন না, এখনও সে বেঁচে আছে।

তবে–

তবে জন্ম-মৃত্যুর কথা তো কেউ বলতে পারে না। কিন্তু তার এ অবস্থার জন্য দায়ী কতকটা আপনিই।

তার এ অবস্থার জন্য দায়ী আমি!

হ্যাঁ। কেন আপনি এতদিন ধরে তার সঙ্গে একটিবারও দেখা করেননি? কেন? চুপ করে রইলেন কেন, বলুন? আপনি তাকে তার কৃতকর্মের জন্য ক্ষমা করতে পারেননি, এইজন্যই না? আপনার অজ্ঞাতে সে সুহাসদের ওখানে গিয়েছিল এবং সুহাসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা করেছিল, এইজন্যই না? আপনি না মা! সন্তানের এ সামান্য অপরাধটুকুও ক্ষমার চোখে দেখতে পারেননি?

না না, সেজন্য নয়, কোন্ মুখ নিয়ে আবার আমি তার সঙ্গে গিয়ে দেখা করব? চিরজীবনের জন্য কারাগারের অন্তরালে দিন কাটাতে চলেছে, মা হয়ে কেমন করে তার সে ব্যােকাতর মুখখানি দেখব, শুধু এইজন্য তার সঙ্গে আমি দেখা করিনি। মা হয়ে সন্তানকে চিরবিদায় দিতে পারিনি। কিন্তু সেও আমায় বুঝল না! ঠিক আছে, আমি যাব—তার সঙ্গে আমি দেখা করতে যাব।

সুব্রত নিয়ে এস ওঁকে।

সুব্রতর সঙ্গে সঙ্গে সুরেন চৌধুরী এসে প্রবেশ করলেন।

সুরেন চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে সুহাসিনী কিংকর্তব্যবিমূঢ়। যেন তিনি ভূত দেখবার মতই। চমকে ওঠেন, কে! কে! তুমি কে!

সুহাসিনী, আমায় চিনতে পারছ না? আমি সুরেন।

তুমি—তুমি বংশপত্রের মতন সুহাসিনী কাঁপছেন।

আমি মরিনি সুহাস! বেঁচে আছি!

বসুন মা, সোফাটার ওপরে বসুন।

এ কি আমি স্বপ্ন দেখছি! সুহাসিনী ধপ্ করে সামনের সোফার ওপর বসে চোখ বুজলেন।

আরও আধ ঘণ্টা পরে।

মা, এত বড় আনন্দটাকে আপনি হঠাৎ যদি সহ্য করতে না পারেন, তাই আপনার ছেলে সম্পর্কে একটা মিথ্যা কথা বলে আপনাকে আঘাত দিয়েছিলাম। আপনার পুত্র সম্পূর্ণ সুস্থ।

সন্তানের অপরাধ নেবেন না মা।

নাটক যদি এখানেই শেষ হত!

বাইরে কার মৃদু পায়ের শব্দ শোনা গেল, কে?

রাণী মালতী দেবী নিঃশব্দে এসে ঘরে প্রবেশ করলেন।

রাণীমা! আসুন। আমি আহ্বান জানালাম, বসুন।

রাণীমা নির্দেশমত সোফার ওপরে উপবেশন করলেন।

লক্ষ্য করেছিলাম, রাণীমা ঘরে প্রবেশ করবার সঙ্গে সঙ্গেই সুহাসিনী দেবী মুখটা ফিরিয়ে নিলেন। সুহাসিনী দেবীর মনের মধ্যে তখনও আলোড়ন চলছে।

মা, এদিকে ফিরে তাকান। মুখ ফিরিয়ে থাকলে চলবে না। এঁকে আপনি চেনেন কিনা জানি না, হয়তো চেনেন, ইনিই মৃত সুহাসের জননী, রায়পুরের রাণীমা মালতী দেবী। ভাগ্যবিড়ম্বনায় আজ এঁরই একমাত্র পুত্রহন্তারূপে আপনার একমাত্র পুত্র যাবজ্জীবন দ্বীপান্তরে দণ্ডিত। অথচ যাদের কেন্দ্র করে এত বড় নির্মম ঘটনাটা গড়ে উঠল, তাদের সৌহার্দ্য ও প্রীতি অতুলনীয়। তাদের মধ্যে একজন আজ মৃত। সেইজন্যই আমার আজ অনুরোধ, আপনারা পরস্পর পরস্পরের দোষ-ত্রুটি ভুলে গিয়ে আপনাদের পুত্রের পরস্পরের ভালবাসার স্মৃতিকে চিরদিন বাঁচিয়ে রাখুন।

ইনি কে কিরীটীবাবু? মালতী দেবী সুরেন্দ্র চৌধুরীকে নির্দেশ করে প্রশ্ন করলেন।

এঁর পরিচয় আপনাকে দেওয়া হয়নি রাণীমা, ইনি ডাঃ সুধীন চৌধুরীর পিতা সুরেন্দ্র চৌধুরী।

সে কি! তবে যে শুনেছিলাম—

হ্যাঁ, লোকে এতকাল তাই জানত বটে। ইনি আজও জীবিতই আছেন। এঁকে নৃসিংহগ্রামের পাতালঘরে গুম করে রাখা হয়েছিল।

মালতী দেবীর দু চোখের কোণ বেয়ে ঝরঝর করে অশ্রু নেমে এল।

আর আমার কোন দুঃখ রইল না কিরীটীবাবু। গরীব বাপের অনেকগুলো সন্তানের মধ্যে আমি একজন। রূপ ছিল বলেই রাজবাড়িতে আমি স্থান পেয়েছিলাম। ভেবেছিলাম দুঃখের বুঝি আমার অবসান হল। কিন্তু বিধাতা যার কপালে সুখ লেখেননি, তাকে সুখী কেউ করতে পারে না। আমাদের দেশে একটা প্রবাদ আছে কিরীটীবাবু, বেটে দিলেও চটে যায়—আমার কপালেও ঠিক তাই হল। সুখের চন্দনপ্রলেপ আমার কপাল থেকে শুকিয়ে ঝরে পড়ে গেল। কিন্তু সে কথা থাক। আমার সুহাস যে নিজের জীবন দিয়ে তার পিতা-প্রপিতামহের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করে গেল এবং সমস্ত অন্যায়ের মীমাংসা এমনি করে দিয়ে গেল, আজকের আমার এতবড় দুঃখেও সেইটাই সবচেয়ে বড় সান্ত্বনা হয়ে রইল। বলতে বলতে সুহাস-জননী এগিয়ে এসে সুহাসিনীর হাত দুটি চেপে ধরলেন, সত্যিই এতদিনে আমার মুক্তি মিলল দিদি। তোমার স্বামীকে তুমি ফিরে পেয়েছ। তোমার ছেলেও তোমার বুকে ফিরে আসুক। আমার উপরে এবং আমার মৃত স্বামীর উপরে আর কোন ক্ষোভ রেখো না। বল রায়পুরের রাজগোষ্ঠীর সকল অপরাধই তুমি ক্ষমা করলে!

নীরবে সুহাস-জননী মালতী দেবীকে বুকের মধ্যে টেনে নিলেন।

তাঁর কণ্ঠে ভাষা ছিল না। শুধু চোখে ছিল নীরব অশ্রু। বুকের সমস্ত অকথিত ভাষাই আজ অশ্রু হয়ে ঝরে পড়তে লাগল।

এরপর মালতী দেবী আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, কিরীটীবাবু, রাত্রি অনেক হল, আমাকে আপনি কেন ডেকেছিলেন, তা তো কই বললেন না?

এইজন্যই আপনাকে ডেকেছিলাম রাণীমা।

তাহলে এবারে আমি যাই!

মালতী দেবী ঘরে হতে নিষ্ক্রান্ত হয়ে গেলেন, রাণীর মতই মাথা উঁচু করে, মর্যাদার গৌরবে।