৩৪৫
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]
আলমোড়া
১৪ জুন, ১৮৯৭
অভিন্নহৃদয়েষু,
চারুর যে পত্র তুমি পাঠাইয়াছ, তাহার বিষয়ে আমার সম্পূর্ণ সহানুভূতি আছে। মহারাণীকে যে Address (মানপত্র) দেওয়া হইবে, তাহাতে এই কথাগুলি থাকা উচিতঃ
১| অতিরঞ্জিত না হয় অর্থাৎ ‘তুমি ঈশ্বরের প্রতিনিধি’ ইত্যাদি nonsense (বাজে কথা), যাহা আমাদের native (নেটিভ)-এর স্বভাব।
২| তাঁহার রাজত্বকালে সকল ধর্মের প্রতিপালন হওয়ার জন্য ভারতবর্ষে ও ইংলণ্ডে আমরা নির্ভয়ে আমাদের বেদান্ত মত প্রচার করিতে সক্ষম হইয়াছি।
৩| তাঁহার দরিদ্র ভারতবাসীর প্রতি দয়া, যথা—দুর্ভিক্ষে স্বয়ং দান দ্বারা ইংরেজদিগকে অপূর্ব দানে উৎসাহিত করা।
৪| তাঁহার দীর্ঘ জীবন প্রার্থনা ও তাঁহার রাজ্যে উত্তরোত্তর প্রজাদের সুখসমৃদ্ধি প্রার্থনা।
শুদ্ধ ইংরেজীতে লিখিয়া আমায় আলমোড়ার ঠিকানায় পাঠাইবে। আমি সই করিয়া সিমলায় পাঠাইব। কাহাকে পাঠাইতে হইবে সিমলায়—লিখিবে। ইতি
বিবেকানন্দ
পুনশ্চ—মঠ হইতে শুদ্ধানন্দ আমায় সাপ্তাহিক পত্র লিখে, তাহার একটা নকল যেন মঠে রাখে। ইতি
—বি
৩৪৬
[স্বামী অখণ্ডানন্দকে লিখিত]
আলমোড়া
১৫ জুন, ১৮৯৭
কল্যাণবরেষু,
তোমার সবিশেষ সংবাদ পাইতেছি ও উত্তরোত্তর আনন্দিত হইতেছি। ঐরূপ কার্যের দ্বারাই জগৎ কিনিতে পারা যায়। মতমতান্তরে আসে যায় কি? সাবাস্—তুমি আমার লক্ষ লক্ষ আলিঙ্গন আশীর্বাদাদি জানিবে। কর্ম কর, কর্ম, হাম আওর কুছ্ নহি মাঙ্গতে হেঁ—কর্ম কর্ম কর্ম even unto death (মৃত্যু পর্যন্ত)। দুর্বলগুলোর কর্মবীর মহাবীর হতে হবে—টাকার জন্য ভয় নাই, টাকা উড়ে আসবে। টাকা, যাদের লইবে, তারা নিজের নামে দিক্, হানি কি? কার নাম—কিসের নাম? কে নাম চায়? দূর কর নামে। ক্ষুধিতের পেটে অন্ন পৌঁছাতে যদি নাম ধাম সব রসাতলেও যায়, অহোভাগ্য-মহোভাগ্যম্। … ভ্যালা মোর ভাইরে, অ্যায়সাই চলো। It is the heart, that conquers, not the brain (হৃদয়, শুধু হৃদয়ই জয়ী হয়ে থাকে—মস্তিষ্ক নয়)। পুঁথিপাতড়া বিদ্যেসিদ্যে, যোগ ধ্যান জ্ঞান—প্রেমের কাছে সব ধূলসমান—প্রেমেই অণিমাদি সিদ্ধি, প্রেমেই ভক্তি, প্রেমেই জ্ঞান, প্রেমেই মুক্তি। এই তো পুজো, নরনারী-শরীরধারী প্রভুর পুজো, আর যা কিছু ‘নেদং যদিদমুপাসতে’। এই তো আরম্ভ ঐরূপে আমরা ভারতবর্ষ—পৃথিবী ছেয়ে ফেলব না? তবে কি প্রভুর মাহাত্ম্য!
লোকে দেখুক, আমাদের প্রভুর পাদস্পর্শে লোকে দেবত্ব পায় কিনা! এরই নাম জীবন্মুক্তি, যখন সমস্ত ‘আমি’—স্বার্থ চলে গেছে।
ওয়া বাহাদুর, গুরুকী ফতে! ক্রমে বিস্তারের চেষ্টা কর। তুমি যদি পার তো কলিকাতায় এসে আরও কতকগুলো ছেলেপুলে নিয়ে একটা ফণ্ড তুলে তাদের দু-একজনকে নিয়ে কাজে লাগিয়ে এক জায়গায়—আবার এক জায়গায় যাও! ঐ রকমে বিস্তার কর আর তাদের তুমি inspect (তত্ত্বাবধান) করে বেড়াও—ক্রমে দেখবে যে, ঐ কার্যটা permanent (স্থায়ী) হবে—সঙ্গে সঙ্গে ধর্ম ও বিদ্যাপ্রচার আপনা-আপনিই হবে। আমিই কলিকাতাতে বিশেষ লিখেছি। ঐ রকম কাজ করলেই আমি মাথায় করে নাচি—ওয়া বাহাদুর! ক্রমে দেখবে এক-একটা ডিষ্ট্রিক্ট (জেলা) এক-একটা centre (কেন্দ্র) হবে—permanent (স্থায়ী)। আমি শীঘ্রই plain-এ (সমতলে) নাবছি। বীর আমি, যুদ্ধক্ষেত্রে মরব, এখানে মেয়েমানুষের মত বসে থাকা কি আমার সাজে? ইতি
তোমাদের চিরপ্রেমাবদ্ধ
বিবেকানন্দ
৩৪৭*
আলমোড়া
২০ জুন, ১৮৯৭
প্রিয় মিস নোব্ল্,
… তোমাকে সরলভাবে জানাচ্ছি যে, তোমার প্রত্যেকটি কথা আমার কাছে মূল্যবান, তোমার প্রত্যেকখানি চিঠি আমাকে খুবই আনন্দ দেয়। যখনই ইচ্ছা ও সুযোগ হবে, তখনই তুমি নিঃসঙ্কোচে লিখো এবং জেনো যে, তোমার একটি কথাও আমি ভুল বুঝব না, একটি কথাও উপেক্ষা করব না। অনেক কাল কাজের কোন খবর পাইনি। তুমি আমায় কিছু জানাতে পার কি? ভারতে আমাকে নিয়ে যতই মাতামাতি করুক না কেন, আমি এখানে কোন সাহায্যের আশা রাখি না। এরা এত দরিদ্র!
তবে আমি নিজেও যেভাবে শিক্ষালাভ করেছিলাম, ঠিক সেইভাবেই গাছের তলা আশ্রয় করে এবং কোনরকমে অন্নবস্ত্রের ব্যবস্থা করে কাজ শুরু করে দিয়েছি। কাজের ধারাও অনেকটা বদলেছে। আমার কয়েকটি ছেলেকে দুর্ভিক্ষ-পীড়িত অঞ্চলে পাঠিয়েছি। এতে যাদুমন্ত্রের মত কাজ হয়েছে। আমি দেখতে পাচ্ছি আর আমার চিরকালের ধারণাও ছিল তাই যে, হৃদয়—শুধু হৃদয়েরই ভেতর দিয়ে সকলের মর্মস্থল স্পর্শ করতে পারা যায়। সুতরাং বর্তমান পরিকল্পনা এই যে, বহু যুবককে গড়ে তুলতে হবে—(উচ্চশ্রেণীকে নিয়েই আরম্ভ করব, নিম্নশ্রেণীকে নিয়ে নয়; ওদের জন্য আমায় একটু অপেক্ষা করতে হবে)—এবং কোন একটি জেলায় তাদের জনকয়েককে পাঠিয়ে দিয়ে আমার প্রথম অভিযান শুরু করব। ধর্মরাজ্যের এই অগ্রগামী কর্মিগণ যখন পথ পরিষ্কার করে ফেলবে, তখন তত্ত্ব ও দর্শন বলার সময় আসবে।
জনকয়েক ছেলে ইতোমধ্যেই শিক্ষা পাচ্ছে; কিন্তু কাজের জন্য যে জীর্ণ আশ্রয়টি১২৩ আমরা পেয়েছিলাম, গত ভূমিকম্পে তা ভেঙে গেছে; তবে বাঁচোয়া একটু যে, এটা ভাড়া-বাড়ী ছিল। যাক, ভাববার কিছু নেই; বিপত্তি ও নিরাশ্রয়তার মধ্যেও কাজ চালিয়ে যেতে হবে। এ পর্যন্ত আমাদের সম্বল শুধু মুণ্ডিত মস্তক, ছেঁড়া কাপড় ও অনিশ্চিত আহার। কিন্তু এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হবেও নিশ্চয়; কারণ আমরা মনে-প্রাণে এই কাজে লেগেছি।
এক হিসাবে এটা সত্য যে, এদেশের লোকের ত্যাগ করবার কিছু নেই বললেই চলে, তবু ত্যাগ আমাদের মজ্জাগত। যে-সব ছেলেরা শিক্ষা পাচ্ছে, তাদের একজন একটি জেলার ভারপ্রাপ্ত একজিকিউটিভ ইঞ্জিনীয়ার (Executive Engineer) ছিল। ভারতে এটি একটি উচ্চ পদ। সে খড়কুটোর মত ঐ পদ ত্যাগ করেছে। … আমার অসীম ভালবাসা জানবে। ইতি
তোমাদের সত্যাবদ্ধ
বিবেকানন্দ
৩৪৮
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]
আলমোড়া
২০ জুন, ১৮৯৭
অভিন্নহৃদয়েষু,
তোমার শরীর পূর্বাপেক্ষা ভাল আছে শুনিয়া সুখী হইলাম। যোগেন ভায়ার কথাবার্তা? তিনি সঠিকে কন না, এজন্য সে-সকল শুনে কোন চিন্তা করিও না। আমি সেরেসুরে গেছি। শরীরে জোরও খুব; তৃষ্ণা নাই, আর রাত্রে উঠিয়া প্রস্রাব বন্ধ। … কোমরে বেদনা-ফেদনা নাই; লিভারও ভাল। শশীর ঔষধে কি ফল হল বুঝতে পারলাম না—কাজেই বন্ধ। আম খুব খাওয়া যাচ্ছে। ঘোড়াচড়াটা বেজায় রপ্ত হচ্ছে—কুড়ি-ত্রিশ মাইল একনাগাড়ে দৌড়ে গিয়েও কিছুমাত্র বেদনা বা exhaustion (অবসাদ) হয় না। দুধ একদম বন্ধ করেছি—পেট মোটার ভয়ে। কাল আলমোড়ায় এসেছি। আর বাগানে যাব না। … বাড়ী ভাড়া-টাড়া যা করতে হয় করবে; এতে আর অত জিজ্ঞাস-পড়া কি করবে!
শুদ্ধানন্দ লিখছে—কি Ruddock’s Practice of Medicine পাঠ হচ্ছে। ও-সব কি nonsense (বাজে জিনিষ) ক্লাসে পড়ান? একসেট Physics (পদার্থবিদ্যা) আর Chemistry-র (রসায়নের) সাধারণ যন্ত্র ও একটা সাধারণ telescope (দূরবীক্ষণ) ও একটা microscope (অণুবীক্ষণ) ১৫০|২০০ টাকার মধ্যে সব হবে। শশীবাবু সপ্তাহে একদিন এসে Chemistry Practical (ফলিত রসায়ন)-এর উপর লেকচার দিতে পারেন ও হরিপ্রসন্ন Physics ইত্যাদির ওপর। আর বাঙলা ভাষায় যে-সকল উত্তম Scientific (বিজ্ঞান-সম্বন্ধীয়) পুস্তক আছে, তা সব কিনবে ও পাঠ করাবে। কিমধিকমিতি
বিবেকানন্দ
৩৪৯
[শ্রীশরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীকে লিখিত]
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
আলমোড়া
৩ জুলাই, ১৮৯৭
যস্য বীর্যেণ কৃতিনো বয়ং চ ভুবনানি চ।
রামকৃষ্ণং সদা বন্দে শর্বং স্বতন্ত্রমীশ্বরম্||
‘প্রভবতি ভগবান্ বিধি’-রিত্যাগমিনঃ অপ্রয়োগনিপুণাঃ প্রয়োগনিপুণাশ্চ পৌরুষং বহুমন্যমানাঃ। তয়োঃ পৌরুষাপৌরুষেয়প্রতীকারবলয়োঃ বিবেকাগ্রহনিবন্ধনঃ কলহ ইতি মত্বা যতস্বায়ুষ্মন্ শরচ্চন্দ্র আক্রমিতুম্ জ্ঞানগিরিগুরোর্গরিষ্ঠং শিখরম্।
যদুক্তং ‘তত্ত্বনিকষগ্রাবা বিপদিতি’ উচ্যেত তদপি শতশঃ; ‘তৎ ত্বমসি’ তত্ত্বাধিকারে। ইদমের তন্নিদানং বৈরাগ্যরুজঃ। ধন্যং কস্যাপি জীবনং তল্লক্ষণাক্রান্তস্য। অরোচিষ্ণু অপি নির্দিশামি পদং প্রাচীনং—‘কালঃ কশ্চিৎ প্রতীক্ষ্যতাম্’ ইতি। সমারূঢ়ক্ষেপণীক্ষেপণশ্রমঃ বিশ্রাম্যতাং তন্নির্ভরঃ। পূর্বাহিতো বেগঃ পারং নেষ্যতি নাবম্। তদেবোক্তং—‘তৎ স্বয়ং যোগসংসিদ্ধঃ কালেনাত্মনি বিন্দতি।’ ‘ন ধনেন ন প্রজয়া ত্যাগেনৈকে অমৃতত্বমানশুঃ’ ইত্যত্র ত্যাগেন বৈরাগ্যমেব লক্ষ্যতে। তদ্বৈরাগ্যং বস্তুশূন্যং বস্তুভূতং বা। প্রথমং যদি, ন তত্র যতেত কোঽপি কীটভক্ষিতমস্তিষ্কে বিনা; যদ্যপরং তদেদম্ আপততি—ত্যাগঃ মনসঃ সঙ্কোচনম্ অন্যস্মাৎ বস্তুনঃ, পিণ্ডীকরণঞ্চ ঈশ্বরে বা আত্মনি। সর্বেশ্বরস্তু ব্যক্তিবিশেষো ভবিতুং নার্হতি, সমষ্টিরিত্যেব গ্রহণীয়ম্। আত্মেতি বৈরাগ্যবতো জীবাত্মা ইতি নাপদ্যতে, পরন্তু সর্বগঃ সর্বান্তর্যামী সর্বস্যাত্মরূপেণাবস্থিতঃ সর্বেশ্বর এব লক্ষ্যীকৃতঃ। স তু সমষ্টীরূপেণ সর্বেষাং প্রত্যক্ষঃ। এবং সতি জীবেশ্বরয়োঃ স্বরূপতঃ অভেদভাবাৎ তয়োঃ সেবাপ্রেমরূপকর্মণোরভেদঃ। অয়মেব বিশেষঃ—জীবে জীববুদ্ধ্যা যা সেবা সমর্পিতা সা দয়া, ন প্রেম; যদাত্মবুদ্ধ্যা জীবঃ সেব্যতে, তৎ প্রেম। আত্মনা হি প্রেমাস্পদত্বং শ্রুতিস্মৃতিপ্রত্যক্ষপ্রসিদ্ধত্বাৎ। তদ্ যুক্তমেব যদবাদীৎ ভগবান্ চৈতন্যঃ, ‘প্রেম ঈশ্বরে, দয়া জীবে’ ইতি। দ্বৈতবাদিত্বাৎ তত্রভগবতঃ সিদ্ধান্তো জীবেশ্বরয়োর্ভেদবিজ্ঞাপকঃ সমীচীনঃ। অস্মাকন্তু অদ্বৈতপরাণাং জীববুদ্ধির্বন্ধনায় ইতি। তদস্মাকং প্রেম এব শরণং, ন দয়া। জীবে প্রযুক্তঃ দয়াশব্দোঽপি সাহসিকজল্পিত ইতি মন্যামহে। বয়ং ন দয়ামহে, অপি তু সেবামহে; নানুকম্পানুভূতিরস্মাকং অপি তু প্রেমানুভবঃ স্বানুভবঃ সর্বস্মিন্।
সৈব সর্ববৈষম্যসাম্যকারী ভবব্যাধি-নীরুজকরী প্রপঞ্চাবশ্যম্ভাব্যত্রিতাপহরণকরী সর্ববস্তুস্বরূপপ্রকাশকরী মায়াধ্বান্তবিধ্বংসকরী আব্রহ্মস্তম্বপর্যন্তস্বাত্মরূপপ্রকটনকরী প্রেমানুভূতির্বৈরাগ্যরূপা ভবতু তে শর্মণে শর্মন্।
ইতানুদিবসং প্রার্থয়তি
ত্বয়ি ধৃতচিরপ্রেমবন্ধ বিবেকানন্দঃ
(বঙ্গানুবাদ)
ঔঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
যাঁহার শক্তিতে আমরা এবং সমুদয় জগৎ কৃতার্থ, সেই শিবস্বরূপ স্বাধীন ঈশ্বর শ্রীরামকৃষ্ণকে আমি সদা বন্দনা করি।
হে আয়ুষ্মন্ শরচ্চন্দ্র, যে-সকল শাস্ত্রকার উদ্যোগশীল নহেন, তাঁহারা বলেন ভগবদ্-বিধিই প্রবল, তিনি যাহা করেন তাহাই হয়; আর যাঁহারা উদ্যোগী ও কর্মকুশল, তাঁহারা পুরুষকারকেই শ্রেষ্ঠ মনে করেন। এই যে কেহ পুরুষকারকে দুঃখ-প্রতীকারের উপায় মনে করিয়া সেই বলের উপর নির্ভর করেন, আবার কেহ কেহ বা দৈববলের উপর নির্ভর করেন, তাঁহাদের বিবাদ কেবল অজ্ঞানজনিত, ইহা জানিয়া তুমি জ্ঞানরূপ গিরিবরের সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণের জন্য যত্ন কর।
‘বিপদই তত্ত্বজ্ঞানের কষ্টিপাথর-স্বরূপ’—নীতিশাস্ত্রে এই যে বাক্য কথিত হইয়াছে, ‘তত্ত্বমসি’-জ্ঞান সম্বন্ধেও সে কথা শত শত বার বলা যাইতে পারে। ইহাই (অর্থাৎ বিপদে অবিচলিত ভাবই) বৈরাগ্যের লক্ষণ।
ধন্য তিনি, যাঁহার জীবনে ইহার লক্ষণসমূহ প্রকাশ পাইয়াছে। তোমার ভাল না লাগিলেও আমি সেই প্রাচীন উক্তি তোমায় বলিতেছি, ‘কিছু সময় অপেক্ষা কর।’ দাঁড় চালাইতে তোমার শ্রম হইয়াছে, এক্ষণে দাঁড়ের উপর নির্ভর করিয়া কিছুক্ষণ বিশ্রাম কর; পূর্বের বেগই নৌকাকে পারে লইয়া যাইবে। এইজন্যই বলা হইয়াছে, ‘যোগে সিদ্ধ হইলে কালে আত্মায় আপনা-আপনি সেই জ্ঞানের প্রকাশ হইয়া থাকে।’ আর এই যে কথিত হইয়াছে, ‘ধন বা সন্তান দ্বারা অমরত্ব লাভ হয় না, কিন্তু একমাত্র ত্যাগ দ্বারাই অমরত্ব লাভ হয়’, এখানে ‘ত্যাগ’ শব্দের দ্বারা বৈরাগ্যকে লক্ষ্য করা হইয়াছে। সেই বৈরাগ্য দুই প্রকার হইতে পারে—হয় বস্তুশূন্য বা অভাবাত্মক, নয় বস্তুভূত বা ভাবাত্মক। যদি বৈরাগ্য অভাবাত্মক হয়, তবে কীটভক্ষিতমস্তিষ্ক ব্যক্তি ভিন্ন কেহই তাহা লাভ করিতে যত্ন করিবে না। আর যদি বৈরাগ্য ভাবাত্মক হয়, তবে ত্যাগের অর্থ অন্যবস্তুসমূহ হইতে মনকে সরাইয়া আনিয়া ঈশ্বর বা আত্মায় সংলগ্ন করা। সর্বেশ্বর যিনি, তিনি ব্যক্তিবিশেষ হইতে পারেন না, তিনি সকলের সমষ্টিস্বরূপ। বৈরাগ্যবান ব্যক্তির নিকট আত্মা বলিতে জীবাত্মা বুঝায় না, কিন্তু সর্বব্যাপী সর্বান্তর্যামী—সকলের আত্মারূপে অবস্থিত সর্বেশ্বরই বুঝিতে হইবে। তিনি সমষ্টিরূপে সকলের প্রত্যক্ষ। অতএব যখন জীব ও ঈশ্বর স্বরূপতঃ অভিন্ন, তখন জীবের সেবা ও ঈশ্বর প্রেম দুই একই। বিশেষ এই, জীবকে জীববুদ্ধিতে যে সেবা করা হয়, তাহা দয়া, প্রেম নহে; আর আত্মবুদ্ধিতে যে জীবের সেবা করা হয় তাহা প্রেম। আত্মা যে সকলেরই প্রেমাস্পদ তাহা শ্রুতি, স্মৃতি, প্রত্যক্ষ—সর্বপ্রকার প্রমাণ দ্বারাই জানা যাইতেছে। এইজন্য ভগবান্ শ্রীচৈতন্য যে ঈশ্বরে প্রেম ও জীবে দয়া করিতে উপদেশ দিয়াছিলেন, তাহা যুক্তিযুক্ত। দ্বৈতবাদী ছিলেন বলিয়া তাঁহার এই সিদ্ধান্ত—যাহা জীব ও ঈশ্বরের ভেদ সূচনা করে—তাহা সমীচীনই হইয়াছে। অদ্বৈতনিষ্ঠ আমাদের কিন্তু জীববুদ্ধি বন্ধনের কারণ। অতএব আমাদের অবলম্বন প্রেম, দয়া নহে। জীবে প্রযুক্ত ‘দয়া’ শব্দও আমাদের বোধ হয় জোর করিয়া বলা মাত্র। আমরা দয়া করি না, সেবা করি। কাহাকেও দয়া করিতেছি, এ অনুভব আমাদের নাই; তৎপরিবর্তে আমরা সকলের মধ্যে প্রেমানুভূতি ও আত্মানুভব করিয়া থাকি।
হে শর্মন্ (ব্রাহ্মণ), সেই বৈরাগ্যরূপ প্রেমানুভব, যাহাতে সমস্ত বৈষম্যের সমতা সাধন করে, যাহা দ্বারা ভবরোগ আরোগ্য হয়, যাহা দ্বারা—এই জগৎপ্রপঞ্চে (মানবজীবনে) অবশ্যম্ভাবী ত্রিতাপ নাশ হয়, যাহা দ্বারা সমুদয় বস্তুর প্রকৃত স্বরূপ বুঝিতে পারা যায়, যাহা দ্বারা মায়ারূপ অন্ধকার একেবারে নাশ হইয়া যায়, যাহা দ্বারা আব্রহ্মস্তম্ব সমুদয় জগৎকেই আত্মস্বরূপ বলিয়া বোধ হয়, তাহাই তোমার কল্যাণের জন্য তোমার হৃদয়ে উদিত হউক। ইহাই তোমার প্রতি চিরপ্রেমে আবদ্ধ বিবেকানন্দ দিবারাত্র প্রার্থনা করিতেছে।
৩৫০*
আলমোড়া
৪ জুলাই, ১৮৯৭
প্রিয় মিস নোব্ল্,
আশ্চর্যের কথা, আজকাল ইংলণ্ড থেকে আমার উপর ভাল ও মন্দ দুই প্রকার প্রভাবেরই ক্রিয়া চলছে; প্রত্যুত তোমার চিঠিগুলি উৎসাহ ও আশার আলোকে পূর্ণ এবং আমার হৃদয়ে বল ও আশার সঞ্চার করে—আর আমার এখন এগুলি বড়ই প্রয়োজন। প্রভুই জানেন।
আমি যদিও এখনও হিমালয়ে আছি এবং আরও অন্ততঃ এক মাস থাকব, আমি আসার আগেই কলিকাতায় কাজ শুরু করে দিয়ে এসেছি এবং প্রতি সপ্তাহে কাজের বিবরণ পাচ্ছি।
এখন আমি দুর্ভিক্ষের কাজে ব্যস্ত আছি, এবং জনকয়েক যুবককে ভাবী কাজের জন্য গড়ে তোলা ছাড়া শিক্ষাকার্যে অধিক শক্তি প্রয়োগ করতে পারিনি। অন্নসংস্থানের ব্যাপারেই আমার সমস্ত শক্তি ও সম্বল নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। যদিও এ পর্যন্ত অতি সামান্য ভাবেই কাজ করতে পেরেছি, তবু অপ্রত্যাশিত ফল দেখা যাচ্ছে। বুদ্ধের পরে এই আবার প্রথম দেখা যাচ্ছে যে, ব্রাহ্মণসন্তানেরা অন্ত্যজ বিসূচিকা-রোগীর শয্যাপার্শ্বে সেবায় নিরত।
ভারতে বক্তৃতা ও অধ্যাপনায় বেশী কাজ হবে না। প্রয়োজন সক্রিয় ধর্মের। আর মুসলমানদের কথায় বলতে গেলে ‘খোদার মর্জি হলে’—আমি তাই দেখাতে বদ্ধপরিকর। … তোমাদের সমিতির কার্য-প্রণালীর সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত; এবং ভবিষ্যতে তুমি যা-ই কর না কেন, তুমি ধরে নিতে পার, তাতে আমার সম্মতি থাকবে। তোমার ক্ষমতা ও সহানুভূতির উপর সম্পূর্ণ বিশ্বাস আছে। এর মধ্যেই আমি তোমার কাছে প্রভূত ঋণে ঋণী, এবং প্রতিদিন আরও অশেষভাবে বাধিত করছ। এইটুকুই আমার সান্ত্বনা যে, এই সমস্তই পরের জন্য। নতুবা উইম্বল্ডনের বন্ধুরা আমার প্রতি যে অপূর্ব অনুগ্রহ প্রকাশ করেছেন, আমি মোটেই তার উপযুক্ত নই। তোমরা ইংরেজরা বড় ভাল, বড় স্থির, বড় খাঁটি—ভগবান্ তোমাদের সর্বদা আশীর্বাদ করুন। আমি দূর থেকে প্রতিদিন তোমার আরও বেশী গুণগ্রাহী হচ্ছি। দয়া করে—কে আমার চির স্নেহ জানাবে এবং সেখানকার সব বন্ধুদের জানাবে। আমার অসীম ভালবাসা জেনো। ইতি
তোমাদের চিরসত্যাবদ্ধ
বিবেকানন্দ
৩৫১*
[মিস মেরী হেলকে লিখিত]
ওঁ তৎ সৎ
আলমোড়া
৯ জুলাই, ১৮৯৭
প্রিয় ভগিনী,
তোমার পত্রখানি পড়ে ও ভিতরে একটি নৈরাশ্যব্যঞ্জক ভাব ফল্গুনদীর মত বইছে দেখে বড় দুঃখিত হলাম, আর তার কারণটা কি তাও আমি বুঝতে পারছি। তুমি যে আমাকে সাবধান করে দিয়েছ, তাঁর জন্য প্রথমেই তোমায় বিশেষ ধন্যবাদ; তোমার ওরূপ লেখার উদ্দেশ্য আমি বেশ বুঝতে পারছি। আমি রাজা অজিত সিংহের সঙ্গে ইংলণ্ডে যাবার বন্দোবস্ত করেছিলাম, কিন্তু ডাক্তাররা অনুমতি দিলে না, কাজেই যাওয়া ঘটল না। হ্যারিয়েটের সঙ্গে তাঁর দেখা হয়েছে জানতে পারলে আমি খুব খুশী হব। তিনিও তোমাদের যার সঙ্গেই হোক না কেন, দেখা হলে খুব আনন্দিত হবেন।
আমি অনেকগুলি আমেরিকান কাগজের টুকরো অংশ (cuttings) পেয়েছি; তাতে দেখলাম মার্কিন মেয়েদের সম্বন্ধে আমার উক্তিসমূহের কঠোর সমালোচনা করা হয়েছে—তাতে আরও এক অদ্ভুত খবর পেলাম যে, আমাকে এখানে জাতিচ্যুত করা হয়েছে! আমার আবার জাত হারাবার ভয়—আমি যে সন্ন্যাসী!
জাত তো কোনরকম যায়ইনি, বরং সমুদ্রযাত্রার উপর সমাজের যে একটা বিরুদ্ধ ভাব ছিল, আমার পাশ্চাত্য দেশে যাওয়ার দরুন তা বহুল পরিমাণে বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। আমাকে যদি জাতিচ্যুত করতে হয়, তাহলে ভারতের অর্ধেক রাজন্যবর্গ ও সমুদয় শিক্ষিত লোকের সঙ্গে আমাকে জাতিচ্যুত করতে হবে। তা তো হয়ইনি, বরং আমি সন্ন্যাস নেবার পূর্বে আমার যে জাতি ছিল, সেই জাতিভুক্ত এক প্রধান রাজা আমাকে সম্মানপ্রদর্শনের জন্য একটি সামাজিক ভোজের আয়োজন করেছিলেন; তাতে ঐ জাতির অধিকাংশ বড় বড় লোক যোগ দিয়েছিলেন। অন্য দিক্ থেকে ধরলে আমরা সন্ন্যাসীরা তো নারায়ণ—দেবতারা সামান্য নরলোকের সঙ্গে একত্র খেলে তাঁদের মর্যাদাহানি হয়। আর প্রিয় মেরী, শত শত রাজার বংশধরেরা এই পা ধুইয়ে মুছিয়ে দিয়েছে, পুজো করেছে—আর সমস্ত দেশের ভিতর যেরূপ আদর অভ্যর্থনা অভিনন্দনের ছড়াছড়ি হয়েছে, ভারতে আর এ রকমটি কারও হয়নি।
এইটুকু বললেই যথেষ্ট হবে যে, রাস্তায় বেরুতে গেলেই এত লোকের ভিড় হত যে, শান্তিরক্ষার জন্য পুলিশের দরকার হত—জাতিচ্যুত করাই বটে! অবশ্য আমার এরূপ অভ্যর্থনায় মিশনরী-ভায়াদের প্রভাব বেশ ক্ষয় করে দিয়েছে। আর তারা এখানে কে? কেউ না। তাদের অস্তিত্ব সম্বন্ধেই আমাদের খেয়াল নেই!
আমি এক বক্তৃতায় এই মিশনরী-ভায়াদের সম্বন্ধে—ইংলিশ চার্চের অন্তর্ভুক্ত ভদ্র মিশনরীগণকে বাদ দিয়ে—সাধারণ মিশনরীর দল কোন্ শ্রেণীর লোক থেকে সংগৃহীত, সে সম্বন্ধে কিছু বলেছিলাম। সেই সঙ্গে আমেরিকার চার্চের অতিরিক্ত গোঁড়া স্ত্রীলোকদের সম্বন্ধে এবং তাদের কুৎসা সৃষ্টি করবার শক্তি সম্বন্ধেও আমায় কিছু বলতে হয়েছিল। মিশনরী-ভায়ারা আমার আমেরিকার কাজটা নষ্ট করবার জন্য এইটিকেই সমগ্র মার্কিন নারীর উপর আক্রমণ বলে ঢাক পেটাচ্ছে—কারণ তারা বেশ জানে, শুধু তাদের (মিশনরীদের) বিরুদ্ধে কেউ কিছু বললে যুক্তরাষ্ট্রের লোকেরা খুশীই হবে। প্রিয় মেরী, ধর যদি ইয়াঙ্কিদের বিরুদ্ধে আমি খুব ভয়ানক কথা বলেই থাকি—তারা আমাদের মা-বোনদের বিরুদ্ধে যে-সব কথা বলে, তাতে কি তার লক্ষ ভাগের এক ভাগেরও প্রতিশোধ হয়? ভারতবাসী ‘হিদেন’দের (বিধর্মী) উপর খ্রীষ্টান ইয়াঙ্কি নরনারী যে ঘৃণা পোষণ করে, তা ধুয়ে ফেলতে বরুণ-দেবতার সব জলেও কুলোবে না। আমরা তাদের কি অনিষ্ট করেছি? অন্যে সমালোচনা করলে ইয়াঙ্কিরা ধৈর্যের সঙ্গে তা সহ্য করতে শিখুক, তারপর তারা অপরের সমালোচনা করুক। এটি একটি মনোবিজ্ঞানসম্মত সর্বজনবিদিত সত্য যে, যারা সর্বদা অপরকে গালিগালাজ করতে উদ্যত, তারা অপরের এতটুকু সমালোচনার ঘা সহ্য করতে পারে না। আর তারপর তাদের আমি কি ধার ধারি? তোমাদের পরিবার, মিসেস বুল, লেগেটরা এবং আর কয়েকজন সমুদয় ব্যক্তি ছাড়া আর কে আমার প্রতি সদয় ব্যবহার করেছে? কে আমার ভাবগুলি কাজে পরিণত করবার সাহায্য করতে এসেছিল? আমায় কিন্তু ক্রমাগত খাটতে হয়েছে, যাতে মার্কিনরা অপেক্ষাকৃত উদার ও ধর্মপ্রাণ হয় তার জন্য আমেরিকায় আমার সমস্ত শক্তি ক্ষয় করে এখন আমি মৃত্যুর দ্বারে উপস্থিত।
ইংলণ্ডে আমি কেবল ছ-মাস কাজ করেছি, একবার ছাড়া কখনও কোন নিন্দার রব ওঠেনি—সে নিন্দা-রটনাও একজন মার্কিন মহিলার কাজ, এই কথা জানতে পেরে আমার ইংরেজ বন্ধুরা বিশেষ আশ্বস্ত হলেন। আক্রমণ তো কোন রকম হয়ইনি বরং অনেকগুলি ভাল ভাল ইংলিশ চার্চের পাদ্রী আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হয়েছিলেন—আর না চেয়েই আমি আমার কাজের জন্য যথেষ্ট সাহায্য পেয়েছি এবং নিশ্চয়ই আরও পাব। ওখানকার একটা সমিতি আমার কাজের প্রসার লক্ষ্য করে আসছে এবং সেজন্য সাহায্যের যোগাড় করছে। ওখানকার চারজন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি আমার কাজে সাহায্যের জন্য সব রকম অসুবিধা সহ্য করেও আমার সঙ্গে সঙ্গে ভারতে এসেছেন। আরও অনেকে আসবার জন্য প্রস্তুত ছিল; এর পর যখন যাব, আরও শত শত লোক প্রস্তুত হবে।
প্রিয় মেরী, আমার জন্য কিছু ভয় করো না। মার্কিনরা বড়—কেবল ইওরোপের হোটেলওয়ালা ও কোটিপতিদের চোখে এবং নিজেদের কাছে। পৃথিবীতে যথেষ্ট জায়গা রয়েছে—ইয়াঙ্কিরা চটলেও আমার জায়গার অভাব হবে না। যাই হোক না কেন, আমি যতটুকু কাজ করেছি, তাতেই আমি সন্তুষ্ট। আমি কখনও কোন জিনিষ মতলব করে করিনি। আপনা-আপনি যেমন যেমন সুযোগ এসেছে, আমি তারই সহায়তা নিয়েছি। কেবল একটা ভাব আমার মাথার ভিতর ঘুরছিল—ভারতবাসী জনসাধারণের উন্নতির জন্য একটা যন্ত্র প্রস্তুত করে চালিয়ে দেওয়া। আমি সে বিষয়ে কতকটা কৃতকার্য হয়েছি। তোমার হৃদয় আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠত, যদি তুমি দেখতে আমার ছেলেরা দুর্ভিক্ষ, ব্যাধি ও দুঃখকষ্টের ভেতর কেমন কাজ করছে, কলেরা-আক্রান্ত ‘পারিয়া’র মাদুরের বিছানার পাশে বসে কেমন তাদের সেবাশুশ্রূষা করছে এবং অনশনক্লিষ্ট চণ্ডালের মুখে কেমন অন্ন তুলে দিচ্ছে—প্রভু আমাকে সাহায্য করছেন, তাদেরও সাহায্য পাঠাচ্ছেন। মানুষের কথা আমি কি গ্রাহ্য করি? সেই প্রেমাস্পদ প্রভু আমার সঙ্গে সঙ্গে রয়েছেন, যেমন আমেরিকায়, যেমন ইংলণ্ডে, যেমন ভারতের রাস্তায় যখন ঘুরে বেড়াতাম—কেউ আমায় চিনত না—তখন যেমন সঙ্গে সঙ্গে ছিলেন। লোকেরা কি বলে না বলে, তাতে আমার কি এসে যায়—ওরা তো ছেলেমানুষ! ওরা আর ওর চেয়ে বেশী বুঝবে কি করে? কি! আমি পরমাত্মাকে সাক্ষাৎ করেছি, সমুদয় পার্থিব বস্তু যে অসার, তা প্রাণে প্রাণে উপলব্ধি করেছি—আমি সামান্য বালকদের কথায় আমার নির্দিষ্ট পথ থেকে চ্যুত হব?—আমাকে দেখে কি তেমনি মনে হয়?
আমাকে আমার নিজের সম্বন্ধে অনেক কথা বলতে হল—কারণ তোমাদের কাছে না বললে যেন আমার কর্তব্য শেষ হত না। আমি বুঝতে পারছি—আমার কাজ শেষ হয়েছে। জোর তিন-চার বছর জীবন অবশিষ্ট আছে। আমার নিজের মুক্তির ইচ্ছা সম্পূর্ণ চলে গেছে। আমি সাংসারিক সুখের প্রার্থনা কখনও করিনি। আমি দেখতে চাই যে, আমার যন্ত্রটা বেশ প্রবলভাবে চালু হয়ে গেছে; আর এটা যখন নিশ্চয় বুঝব যে, সমগ্র মানবজাতির কল্যাণে অন্ততঃ ভারতে এমন একটা যন্ত্র চালিয়ে গেলাম, যাকে কোন শক্তি দাবাতে পারবে না, তখন ভবিষ্যতের চিন্তা ছেড়ে দিয়ে আমি ঘুমাব। আর নিখিল আত্মার সমষ্টিরূপে যে ভগবান্ বিদ্যমান—একমাত্র যে ভগবানে আমি বিশ্বাসী, সেই ভগবানের পূজার জন্য যেন আমি বার বার জন্মগ্রহণ করি এবং সহস্র যন্ত্রণা ভোগ করি; আর সর্বোপরি আমার উপাস্য পাপী-নারায়ণ, তাপী-নারায়ণ, সর্বজাতির দরিদ্রনারায়ণ! এরাই বিশেষভাবে আমার আরাধ্য।
‘যিনি তোমার অন্তরে ও বাহিরে, যিনি সব হাত দিয়ে কাজ করেন ও সব পায়ে চলেন, তুমি যাঁর একাঙ্গ, তাঁরই উপাসনা কর এবং অন্য সব প্রতিমা ভেঙে ফেল।
‘যিনি উচ্চ ও নীচ, সাধু ও পাপী, দেব ও কীট সর্বরূপী, সেই প্রত্যক্ষ জ্ঞেয় সত্য ও সর্বব্যাপীর উপাসনা কর এবং অন্য সব প্রতিমা ভেঙে ফেল।
‘যাতে পূর্বজন্ম নাই, পরজন্ম নাই, বিনাশ নাই, গমনাগমন নাই, যাতে অবস্থিত থেকে আমরা সর্বদা অখণ্ডত্ব লাভ করছি এবং ভবিষ্যতেও করব, তাঁরই উপাসনা কর এবং অন্য সব প্রতিমা ভেঙে ফেল।
‘হে মূর্খগণ, যে-সকল জীবন্ত নারায়ণে ও তাঁর অনন্ত প্রতিবিম্বে জগৎ পরিব্যাপ্ত, তাঁকে ছেড়ে তোমরা কাল্পনিক ছায়ার পেছনে ছুটেছ! তাঁর—সেই প্রত্যক্ষ-দেবতারই—উপাসনা কর এবং আর সব প্রতিমা ভেঙে ফেল।’
আমার সময় অল্প। এখন আমার যা কিছু বলবার আছে, কিছু না চেপে বলে যেতে হবে; ওতে কারও হৃদয় আঘাত লাগবে বা কেউ বিরক্ত হবে—এ বিষয়ে লক্ষ্য করলে চলবে না। অতএব প্রিয় মেরী, আমার মুখ থেকে যাই বের হোক না কেন, কিছুতেই ভয় পেও না। কারণ যে শক্তি আমার পশ্চাতে থেকে কাজ করছে, তা বিবেকানন্দ নয়—তা স্বয়ং প্রভু; কিসে ভাল হয়, তিনিই বেশী বোঝেন। যদি আমায়—জগৎকে সন্তুষ্ট করতে হয়, তাহলে তাতে জগতের অনিষ্টই হবে। অধিকাংশ লোক যা বলে তা ভুল, কারণ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে যে, জগৎ শাসন করছে তারাই, অথচ জগতের অবস্থা অতি শোচনীয়। যে-কোন নূতন ভাব প্রচারিত হবে, তারই বিরুদ্ধে লোকে লাগবে; সভ্য যাঁরা, তাঁরা শিষ্টাচারের সীমা লঙ্ঘন না করে উপহাসের হাসি হাসবেন; আর যারা সভ্য নয়, তারা শিষ্টাচার-বিরুদ্ধ চীৎকার করবে ও কুৎসিত নিন্দা রটাবে।
সংসারের এ-সব কীটদেরও একদিন খাড়া হয়ে দাঁড়াতে হবে—জ্ঞানহীন বালকদেরও একদিন জ্ঞানালোক পেতে হবে। মার্কিনরা অভ্যুদয়ের নূতন সুরাপানে এখন মত্ত। অভ্যুদয়ের শত শত বন্যা আমাদের দেশের উপর এসেছে ও চলে গেছে। তাতে আমরা এমন শিক্ষা পেয়েছি, যা কোন বালকস্বভাব জাতি এখনও বুঝতে অসমর্থ। আমরা জেনেছিঃ এ সবই মিছে; এই বীভৎস জগৎটা মায়ামাত্র। ত্যাগ কর এবং সুখী হও। কামকাঞ্চন ত্যাগ কর। এ ছাড়া অন্য কোন বন্ধন নাই। বিবাহ, স্ত্রীপুরুষ সম্বন্ধ, টাকাকড়ি—এগুলি মূর্তিমান পিশাচস্বরূপ। পার্থিব ভালবাসা দেহ থেকেই প্রসূত—কামকাঞ্চন সম্বন্ধে সব ছেড়ে দাও—ঐগুলি যেমন চলে যাবে, অমনি দিব্যদৃষ্টি খুলে যাবে—তখন আত্মা তাঁর অনন্ত শক্তি ফিরে পাবেন।
আমার বড়ই ইচ্ছা ছিল হ্যারিয়েটের সঙ্গে দেখা করবার জন্য ইংলণ্ডে যাই।—আমার আর একটি মাত্র ইচ্ছা আছে, মৃত্যুর আগে তোমাদের চার বোনের সঙ্গে একবার দেখা করা; আমার সে ইচ্ছা পূর্ণ হবেই হবে। ইতি
তোমাদের চিরস্নেহবদ্ধ
বিবেকানন্দ
৩৫২
[স্বামী ব্রহ্মানন্দকে লিখিত]
ওঁ নমো ভগবতে রামকৃষ্ণায়
আলমোড়া
১০ জুলাই, ১৮৯৭
অভিন্নহৃদয়েষু,
আজ এখান হইতে সভার উদ্দেশ্যের যে proof (প্রুফ) পাঠাইয়াছিলে, তাহা সংশোধন করিয়া পাঠাইলাম। Rules and regulations (নিয়মাবলী)-টুকু—যেটুকু আমাদের meeting hall-এ (সভায়) মশায়রা পড়িয়াছিলেন—ভ্রমপূর্ণ। বিশেষ যত্নের সহিত সংশোধিত করিয়া পুনর্মুদ্রিত করিবে, নইলে লোক হাসিবে।
বহরমপুরে যে প্রকার কার্য১২৪ হইতেছে, তাহা অতীব সুন্দর। ঐ সকল কার্যের দ্বারাই জয় হইবে—মতামত কি অন্তর স্পর্শ করে? কার্য কার্য—জীবন জীবন—মতে-ফতে এসে যায় কি? ফিলসফি, যোগ, তপ, ঠাকুরঘর, আলোচাল, কলা মূলো—এ সব ব্যক্তিগত ধর্ম, দেশগত ধর্ম; পরোপকারই সর্বজনীন মহাব্রত—আবালবৃদ্ধবনিতা, আচণ্ডাল, আপশু সকলেই এ ধর্ম বুঝিতে পারে। শুধু negative (নিষেধাত্মক) ধর্মে কি কাজ হয়? পাথরে ব্যভিচার করে না, গরুতে মিথ্যা কথা কয় না, বৃক্ষেরা চুরি ডাকাতি করে না, তাতে আসে যায় কি? তুমি চুরি কর না, মিথ্যা কথা কও না, ব্যভিচার কর না, চার ঘণ্টা ধ্যান কর, আট ঘণ্টা ঘণ্টা বাজাও—‘মধু, তা কার কি?’ ঐ যে কাজ, অতি অল্প হলেও ওতে বহরমপুর একেবারে কেনা হয়ে গেল—এখন যা বলবে, লোকে তাই শুনবে। এখন ‘রামকৃষ্ণ ভগবান্’ লোককে আর বোঝাতে হবে না। তা নইলে কি লেকচারের কর্ম—কথায় কি চিঁড়ে ভেজে? ঐ রকম যদি দশটা district (জেলায়) পারতে, তাহলে দশটাই কেনা হয়ে যেত। অতএব বুদ্ধিমান, এখন ঐ কর্মবিভাগটার উপরই খুব ঝোঁক, আর ঐটারই উপকারিতা বাড়াতে প্রাণপণে চেষ্টা কর। কতকগুলো ছেলেকে দ্বারে দ্বারে পাঠাও—আলখ জাগিয়ে টাকাপয়সা, ছেঁড়া কাপড়, চালডাল, যা পায় নিয়ে আসুক, তারপর সেগুলো ডিষ্ট্রীবিউট (বিতরণ) করবে। ঐ কাজ, ঐ কাজ। তারপর লোকের বিশ্বাস হবে, তারপর যা বলবে শুনবে।
কলিকাতায় মিটিং-এর খরচ-খরচা বাদে যা বাঁচে, ঐ famine-এতে (দুর্ভিক্ষে) পাঠাও বা কলিকাতার ডোমপাড়া, হাড়িপাড়া বা গলিঘুঁজিতে অনেক গরীব আছে, তাদের সাহায্য কর—হল্-ফল্—ঘোড়ার ডিম থাক্, প্রভু যা করবার তা করবেন। আমার এখন শরীর বেশ সেরে গেছে।
মেটিরিয়াল (মালমসলা) যোগাড় করছ না কেন? আমি এসে নিজেই কাগজ start (আরম্ভ) করব। দয়া আর ভালবাসায় জগৎ কেনা যায়; লেকচার, বই, ফিলসফি—সব তার নীচে। শশীকে ঐ রকম একটা কর্মবিভাগ গরীবদের সাহায্যের জন্য করতে লিখবে। আর ঠাকুরপুজো-ফুজোতে যেন টাকাকড়ি বেশী ব্যয় না করে। … তুমি মঠের ঠাকুরপুজোর খরচ দু-এক টাকা মাসে করে ফেলবে। ঠাকুরের ছেলেপুলে না খেয়ে মারা যাচ্ছে। … শুধু জল-তুলসীর পুজো করে ভোগের পয়সাটা দরিদ্রদের শরীরস্থিত জীবন্ত ঠাকুরকে ভোগ দিবে—তা হলে সব কল্যাণ হবে। যোগেনের শরীর এখানে খারাপ হয়েছিল, সে আজ যাত্রা করিল—কলিকাতায়। আমি কাল পুনশ্চ দেউলধার যাত্রা করিব। আমার ভালবাসা জানিবে ও সকলকে জানাইবে। ইতি
বিবেকানন্দ
৩৫৩*
[মিস ম্যাকলাউডকে লিখিত]
আলমোড়া
১০ জুলাই, ১৮৯৭
প্রিয় জো জো,
তোমার চিঠিগুলি পড়ার ফুরসত আমার আছে, এটা যে তুমি আবিষ্কার করে ফেলেছ, তাতে আমি খুশী।
বক্তৃতা ও বাগ্মিতা করে করে হয়রান হয়ে পড়ায় আমি হিমালয়ে আশ্রয় নিয়েছি। ডাক্তাররা আমায় খেতড়ির রাজার সঙ্গে ইংলণ্ডে যেতে না দেওয়ার আমি বড়ই দুঃখিত; আর স্টার্ডি এতে ক্ষেপে গেছে।
সেভিয়ার-দম্পতি সিমলাতে আছেন, আর মিস মূলার এখানে আলমোড়ায়। প্লেগ কমেছে; কিন্তু দুর্ভিক্ষ এখনও চলছে, তার উপর এ যাবৎ বৃষ্টি না হওয়ায় এ দুর্ভিক্ষ আরও করালরূপ ধারণ করবে বলে মনে হচ্ছে।
আমাদের কর্মীরা দুর্ভিক্ষগ্রস্ত বিভিন্ন জেলায় যে কাজে নেমেছে, এখান থেকে তার পরিচালনায় আমি খুবই ব্যস্ত।
যেমন করেই হোক তুমি এসে পড়; শুধু এইটুকু মনে রেখো—ইওরোপীয়দের ও হিন্দুদের (অর্থাৎ ইওরোপীয়েরা যাদের ‘নেটিভ’ বলেন তাদের) বসবাসের ব্যবস্থা যেন তেল-জলের মত; নেটিভদের সঙ্গে মেলামেশা করা ইওরোপীয়দের পক্ষে সর্বনেশে ব্যাপার। (প্রাদেশিক) রাজধানীগুলোতে পর্যন্ত বলবার মত কোন হোটেল নেই। তোমাকে অনেক চাকর-বাকর সঙ্গে নিয়ে চলা-ফেরা করতে হবে (খরচ হোটেলের চেয়ে কম)। কটিমাত্র-বস্ত্রাবৃত লোকের ছবি তোমায় সয়ে যেতে হবে; আমাকেও তুমি ঐ রূপেই দেখতে পাবে। সর্বত্রই ময়লা ও নোংরা, আর সব ‘কালা আদমী’। কিন্তু তোমার সঙ্গে দার্শনিক আলোচনা করবার মত লোক ঢের পাবে। এখানে যদি ইংরেজদের সঙ্গে বেশী মেলামেশা কর, তবে তুমি আরাম পাবে বেশী; কিন্তু হিন্দুদের ঠিক ঠিক পরিচয় পাবে না। হয়তো আমি তোমার সঙ্গে বসে খেতে পাব না; কিন্তু তোমায় কথা দিচ্ছি যে, আমি তোমার সঙ্গে বহু জায়গায় ভ্রমণ করব এবং তোমার ভ্রমণকে সুখময় করবার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করব। এই সবই তোমার ভাগ্যে জুটবে—যদি কিছু ভাল জুটে যায় তো সে বাড়তির ভাগ। হয়তো মেরী হেল তোমার সঙ্গে এসে পড়তে পারে। অর্চার্ড লেক্, অর্চার্ড দ্বীপ, মিসিগান—এই ঠিকানায় মিস ক্যাম্পবেল নাম্নী একটি সম্ভ্রান্তবংশীয়া কুমারী বাস করেন, তিনি শ্রীকৃষ্ণের বিশেষ ভক্ত, উপবাস ও প্রার্থনাদি অবলম্বন করে এই দ্বীপে নির্জনে বাস করেন, ভারতবর্ষ দর্শন করার জন্য তিনি সর্বস্ব ত্যাগ করতে প্রস্তুত। কিন্তু তিনি বড়ই গরীব। তুমি যদি তাঁকে সঙ্গে করে নিয়ে আস, তবে যেমন করেই হোক, আমি তাঁর খরচ দেব। মিসেস বুল যদি বুড়ো ল্যাণ্ডস্বার্গকে তাঁর সঙ্গে নিয়ে আসতে পারেন, তবে সে বেঁচে যায়!
খুব সম্ভব আমি তোমার সঙ্গে আমেরিকায় ফিরব। হলিস্টার ও শিশুটিকে আমার চুমো দিও। এলবার্টা, লেগেট-দম্পতি ও ম্যাবেলকে আমার ভালবাসা জানিও। ফক্স কি করছে? তার সঙ্গে দেখা হলে তাকে আমার ভালবাসা জানিও। মিসেস বুল ও সারদানন্দকে ভালবাসা জানাচ্ছি। আমি আগেকার মতই সবল আছি; কিন্তু কেমন থাকব, তা নির্ভর করছে ভবিষ্যতে সব ঝামেলা থেকে মুক্ত থাকার উপর। আর দৌড়ঝাঁপ করা চলবে না।
এ বছর তিব্বতে যাবার খুবই ইচ্ছা ছিল, কিন্তু এরা যেতে দিল না; কারণ ঐ পথে চলা ভয়ানক শ্রমসাপেক্ষ। যা হোক আমি খাড়া পাহাড়ের উপর দিয়ে ঊর্ধ্বশ্বাসে পাহাড়ী ঘোড়া ছুটিয়েই সন্তুষ্ট আছি। তোমার বাই-সাইকেলের চেয়ে এটা আরও বেশী উন্মাদনাপূর্ণ; অবশ্য উইম্বল্ডনে আমার সে অভিজ্ঞতাও হয়ে গেছে। মাইলের পর মাইল চড়াই ও মাইলের পর মাইল উতরাই—রাস্তাটা কয়েক ফুট মাত্র চওড়া, খাড়া পাহাড়ের গায়ে যেন ঝুলে আছে, আর বহু সহস্র ফুট নীচে খাদ!
সদা প্রভুপদাশ্রিত
বিবেকানন্দ
পুঃ—ভারতে আসার সবচেয়ে ভাল সময় হচ্ছে—অক্টোবরের মধ্যে বা নভেম্বরের প্রথমে; ডিসেম্বর, জানুআরী ও ফেব্রুআরী তুমি সব দেখবে এবং ফেব্রুআরীর শেষাশেষি ফিরে যাবে। মার্চ থেকে গরম পড়তে শুরু হয়। দক্ষিণ ভারত সব সময়েই গরম।
মান্দ্রাজে শীঘ্রই একখানি পত্রিকা আরম্ভ করা হবে; গুডউইন তারই কাজে সেখানে গেছে।
বি
৩৫৪*
[স্বামী শুদ্ধানন্দকে লিখিত]
আলমোড়া
১১ জুলাই, ১৮৯৭
প্রিয় শুদ্ধানন্দ,
তুমি সম্প্রতি মঠের যে কার্য-বিবরণ পাঠিয়েছ, তা পেয়ে ভারি খুশী হলাম। তোমার রিপোর্ট সম্বন্ধে আমার সমালোচনার বড় কিছু নেই—কেবল বলতে চাই, আর একটু পরিষ্কার করে লিখো।
যতদূর পর্যন্ত কাজ হয়েছে, তাতে আমি খুব সন্তুষ্ট; কিন্তু আরও এগিয়ে যেতে হবে। আগে আমি একবার লিখেছিলাম, পদার্থবিদ্যা ও রসায়নশাস্ত্র সম্বন্ধীয় কতকগুলি যন্ত্র যোগাড় করলে ভাল হয় এবং ক্লাস খুলে পদার্থবিদ্যা ও রসায়ন, বিশেষতঃ শরীরতত্ত্ব সম্বন্ধে সাদাসিদে ও হাতেকলমে শিক্ষা দিলে ভাল হয়; কই, সে-সম্বন্ধে তো কোন উচ্চবাচ্য এ পর্যন্ত শুনিনি।
আর একটা কথা লিখেছিলাম—যে-সব বৈজ্ঞানিক গ্রন্থ বাঙলা ভাষায় অনুবাদ হয়ে গেছে, সেইগুলি কিনে ফেলা উচিত; তার সম্বন্ধেই বা কি হল?
এখন মনে হচ্ছে—মঠে একসঙ্গে অন্ততঃ তিন জন করে মহান্ত নির্বাচন করলে ভাল হয়; একজন বৈষয়িক ব্যাপার চালাবেন, একজন আধ্যাত্মিক দিক্ দেখবেন, আর একজন জ্ঞানার্জনের ব্যবস্থা করবেন।
শিক্ষাবিভাগের উপযুক্ত পরিচালক পাওয়াই দেখছি কঠিন। ব্রহ্মানন্দ ও তুরীয়ানন্দ অনায়াসে অপর দুটি বিভাগের ভার নিতে পারেন। মঠ দর্শন করতে কেবল কলিকাতার বাবুর দল আসছেন জেনে বড় দুঃখিত হলাম। তাঁদের দ্বারা কিছু হবে না। আমরা চাই সাহসী যুবকের দল—যারা কাজ করবে; আহাম্মকের দলকে দিয়ে কি হবে?
ব্রহ্মানন্দকে বলবে, তিনি যেন অভেদানন্দ ও সারদানন্দকে—মঠে তাদের সাপ্তাহিক কার্য-বিবরণী পাঠাতে লেখেন; যেন তা পাঠাতে ত্রুটি না হয়, আর যে বাঙলা কাগজটা বার করবার কথা হচ্ছে, তার জন্য প্রবন্ধ ও প্রয়োজনীয় উপাদান যেন তারা পাঠায়। গিরিশবাবু কি কাগজটার জন্য যোগাড়যন্ত্র করছেন? অদম্য ইচ্ছাশক্তির সঙ্গে কাজ করে যাও ও প্রস্তুত থাক।
অখণ্ডানন্দ মহুলাতে অদ্ভুত কর্ম করছে বটে, কিন্তু কার্য-প্রণালী ভাল বলে বোধ হচ্ছে না। মনে হয়, তারা একটা ছোট গ্রামেই তাদের শক্তিক্ষয় করছে, তাও কেবল চাল-বিতরণের কার্যে। এই চাল দিয়ে সাহায্যের সঙ্গে সঙ্গে কোনরূপ প্রচারকার্যও হচ্ছে—কই, এরূপ তো শুনতে পাচ্ছি না। জনসাধারণকে যদি আত্মনির্ভরশীল হতে শেখান না যায়, তবে জগতের সমগ্র ঐশ্বর্য ভারতের একটা ক্ষুদ্র গ্রামের পক্ষেও পর্যাপ্ত সাহায্য হবে না।
আমাদের কাজ হওয়া উচিত প্রধানতঃ শিক্ষাদান—চরিত্র এবং বুদ্ধিবৃত্তির উৎকর্ষসাধনের জন্য শিক্ষা-বিস্তার। আমি সে-সম্বন্ধে তো কোন কথা শুনছি না—কেবল শুনছি, এতগুলি ভিক্ষুককে সাহায্য দেওয়া হয়েছে! ব্রহ্মানন্দকে বলো, বিভিন্ন জেলায় কেন্দ্র খুলতে, যাতে আমাদের সামান্য সম্বলে যতদূর সম্ভব অধিক জায়গায় কাজ করা যায়। আরও মনে হচ্ছে, এ পর্যন্ত ঐ কার্যে ফল কিছু হয়নি; কারণ তাঁরা এখনও পর্যন্ত স্থানীয় লোকদের মধ্যে তেমন আকাঙ্ক্ষা জাগিয়ে তুলতে পারেননি, যাতে তারা দেশের লোকের শিক্ষার জন্য সভাসমিতি স্থাপন করতে পারে এবং ঐ শিক্ষার ফলে তারা আত্মনির্ভরশীল ও মিতব্যয়ী হতে পারে, বিবাহের দিকে অস্বাভাবিক ঝোঁক না থাকে, এবং এইভাবে ভবিষ্যতে দুর্ভিক্ষের কবল থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারে। দয়ায় লোকের হৃদয় খুলে যায়; কিন্তু সেই দ্বার দিয়ে তার সর্বাঙ্গীণ কল্যাণ যাতে হয়, তার জন্য চেষ্টা করতে হবে।
সবচেয়ে সহজ উপায় এইঃ একটা ছোট কুঁড়ে নিয়ে গুরু-মহারাজের মন্দির কর। গরীবরা সেখানে আসুক, তাদের সাহায্যও করা হোক, তারা সেখানে পূজা-অর্চাও করুক। প্রত্যহ সকাল-সন্ধ্যায় সেখানে ‘কথা’ হোক। ঐ কথার সাহায্যেই তোমরা লোককে যা কিছু শেখাতে ইচ্ছা কর, শেখাতে পারবে। ক্রমে ক্রমে তাদের নিজেদেরই ঐ বিষয়ে একটা আস্থা ও আগ্রহ বাড়তে থাকবে—তখন তারা নিজেরাই সেই মন্দিরের ভার নেবে, আর হতে পারে, কয়েক বৎসরের ভেতর ঐ ছোট মন্দিরটিই একটি প্রকাণ্ড আশ্রমে পরিণত হবে। যাঁরা দুর্ভিক্ষমোচন-কার্যে যাচ্ছেন, তাঁরা প্রথমে প্রত্যেক জেলার কেন্দ্রস্থলে একটা জায়গা নির্বাচন করুন—এইরূপ একটি কুঁড়ে নিয়ে সেখানে ঠাকুরঘর স্থাপন করুন—যেখান থেকে আমাদের অল্প-স্বল্প কাজ আরম্ভ হতে পারে।
মনের মত কাজ পেলে অতি মূর্খও করতে পারে। যে সকল কাজকেই মনের মত করে নিতে পারে, সে-ই বুদ্ধিমান। কোন কাজই ছোট নয়, এ সংসারে যাবতীয় বস্তু বটের বীজের মত, সর্ষপের মত ক্ষুদ্র দেখালেও অতি বৃহৎ কাজকেই মহৎ করে তোলে।১২৫
যাঁরা দুর্ভিক্ষমোচন করছেন, তাঁদের এটিও লক্ষ্য রাখতে হবে যে, জুয়াচোরেরা যেন গরীবের প্রাপ্য নিয়ে যেতে না পারে। ভারতবর্ষ এমন অলস জুয়াচোরে পূর্ণ এবং দেখে আশ্চর্য হবে, তারা কখনও না খেয়ে মরে না—কিছু না কিছু খেতে পায়ই। ব্রহ্মানন্দকে বলো, যাঁরা দুর্ভিক্ষে কাজ করছেন, তাঁদের সকলকে এই কথা লিখতেঃ যাতে কোন ফল নেই, এমন কিছুর জন্য টাকা খরচ করতে তাঁদের কখনই দেওয়া হবে না—আমরা চাই, যতদূর সম্ভব অল্প খরচে যত বেশী সম্ভব স্থায়ী সৎকার্যের প্রতিষ্ঠা।
এখন তোমরা বুঝতে পারছ, তোমাদের নূতন নূতন মৌলিক চিন্তার চেষ্টা করতে হবে—তা না হলে আমি মরে গেলেই গোটা কাজটা চুরমার হয়ে যাবে। এই রকম করতে পারঃ তোমরা সকলে মিলে একটা সভায় এই বিষয় আলোচনা কর, আমাদের হাতে যে অল্পস্বল্প সম্বল আছে, তা থেকে কি করে সবচেয়ে ভাল স্থায়ী কাজ হতে পারে। কিছুদিন আগে থেকে সকলকে এই বিষয়ে খবর দেওয়া হোক, সকলেই নিজের মতামত—বক্তব্য বলুক, সেইগুলি নিয়ে বিচার হোক, বাদপ্রতিবাদ হোক, তারপর আমাকে তার একটা বিবরণ পাঠাও।
উপসংহারে বলি, তোমরা মনে রেখো, আমি আমার গুরুভাইদের চেয়ে আমার সন্তানদের নিকট বেশী আশা করি—আমি চাই, আমার সব ছেলেরা, আমি যত বড় হতে পারতাম, তার চেয়ে শতগুণ বড় হোক। তোমাদের প্রত্যেককেই এক একটা ‘দানা’ হতেই হবে—আমি বলছি—অবশ্যই হতে হবে। আজ্ঞাবহতা, উদ্দেশ্যের উপর অনুরাগ ও সর্বদা প্রস্তুত হয়ে থাকা—এই তিনটি যদি থাকে, কিছুতেই তোমাদের হটাতে পারবে না। আমার ভালবাসা ও আশীর্বাদ জানবে। ইতি
স্নেহাশীর্বাদক
বিবেকানন্দ