কিরীটী এবারে বলে, যান উঠুন টেলিফোনে অশোকবাবুকে ডেকে এখানে এখুনি একবার আসতে বলুন, যদি এখনও আপনার ছেলের মঙ্গল চান!
কিরীটীর কতা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গেই দ্বারপ্রান্তে অকস্মাৎ একটি পরিচিত কণ্ঠস্বরে যুগপৎ আমরা সকলেই ফিরে তাকালাম।
ডাকতে হবে না মিঃ রায়, আমি নিজেই এসেছি।
এবং অশোক রায়ের কণ্ঠস্বর শোনবার সঙ্গে সঙ্গেই সমস্ত সংযম যেন রাধেশ রায়ের মুহূর্তে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল। তিনি স্থান-কাল-পাত্র এমন কি নিজেকে পর্যন্ত ভুলে গিয়ে যেন আর্ত তীক্ষ্ণ কণ্ঠে অস্ফুট একটা চিৎকার করে উঠলেন, অশোক!
ধীর প্রশান্ত পদে আশোক রায় ততক্ষণে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে পূর্ববৎ শাঠেই কিরীটীর দিকে তাকিয়ে বললেন, কি আপনার জিজ্ঞাস্য আছে আমাকে করুন মিঃ রায়। I am ready!
না, না—অশোক-আশোক, বাধা দিয়ে আবার চিৎকার করে উঠলেন হতভাগ্য পিতা।
না, বাবা। আমাকে বাধা দিও না। ওঁকে জিজ্ঞাসা করতে দাও কি উনি জিজ্ঞাসা করবেন? আমি জবাব দেব।
কিন্তু অশোক–অশোক–
না, বাবা। এই আত্মগোপনের পিছনে যে সন্দেহের কালো ছায়া সর্বক্ষণ আমাকে তাড়া করে নিয়ে বেড়াচ্ছে তাকে আর আমি সহ্য করতে পারছি না।এর চাইতে নিশ্চিন্ত মনে জেলের অন্ধকার ঘরে বাস করাও সহজ। মিঃ রায়, বলুন কি আপনি জানতে চান আমার কাছ থেকে?
বসুন অশোকবাবু। এতক্ষণে কিরীটী কথা বলল।
অশোক রায় কিরীটীর নির্দেশে সামনের খালি সোফাটার উপর বসলেন।
কিরীটী কয়েক মুহূর্ত চুপ করে রইল। বুঝতে পারছিলাম অশোক রায়ের ঐ সময় তারই গৃহে অকস্মাৎ আবির্ভাবের ব্যাপারটা সে-ও চিন্তা করতে পারেনি ক্ষণপূর্বেও। তাই সেও বোধ হয় একটু বিহ্বল হয়ে পড়েছিল। এবং সেই কারণেই নিজের মধ্যে সে নিজেকে গুছিয়ে নিচ্ছিল।
আপনি গতকাল রাত্রে বৈকলী সঙ্ঘে গিয়েছিলেন অশোকবাবু? কিরীটী প্রশ্ন করে।
গিয়েছিলাম।
ঠিক কখন গিয়েছিলেন সময়টা মনে আছে?
হ্যাঁ, রাত আটটা বাজতে মিনিট দু-পাঁচ আগেই হবে।
কিন্তু সাধারণত শুনেছি আপনি তো অত আগে কখনও সঙ্ঘে যেতেন না! তাই নয় কি?
হ্যাঁ। কিন্তু কাল একটু আগেই গিয়েছিলাম।
বিশেষ কোন কারণ ছিল কি?
একটু ইতস্তত করে অশোক রায় বললেন, মিত্রা যেতে বলেছিল।
কেন?
তার নাকি বিশেষ কি কথা বলবার ছিল!
কি কথা তা কোনো আভাস তিনি দেননি?
না। তবে বলেছিল বিশেষ জরুরী, প্রয়োজনীয়।
কখন তিনি অ্যাপয়েন্টমেন্ট করেছিলেন?
গতকাল দুপুরের দিকে টেলিফোনে।
কি বলেছিলেন?
বলেছিল ঠিক রাত আটটায় সঙ্ঘের পিছনের বাগানে বকুলবীথির সামনে তার সঙ্গে দেখা করবার জন্য।
অতঃপর কিরীটী কিছুক্ষণ চুপ করে কি যেন ভাবল। তারপর মৃদুকণ্ঠে আবার প্রশ্ন করল, আচ্ছা অশোকবাবু, আপনি স্থিরনিশ্চিত যে টেলিফোনে গতকাল দুপুরে ঠিক মিত্রা দেবীর কণ্ঠস্বরই শুনেছিলেন?
তাহলে আপনাকে কথাটা বলি, গলাটা যেন কেমন ভাঙা-ভাঙা ও একটু চাপা শুনেছিলাম, প্রশ্ন করেছিলাম সে সম্পর্কে, মিত্রা বলেছিল তার নাকি সর্দি হয়েছে হঠাৎ।
তাহলে আপনি সন্দেহ করেছিলেন?
হ্যাঁ।
বেশ। সোজা আপনি গিয়ে হলঘরেই তো প্রবেশ করেন?
হ্যাঁ।
কেউ তখন সেই হলঘরে ছিল?
ছিল।
কে?
তাকে আমি চিনি না। কখনও ইতিপূর্বে দেখিনি।
পুরুষ না নারী?
নারী।
কত বয়স হবে তার?
পঁচিশ-ছাব্বিশের বেশী হবে বলে মনে হয় না।
দেখতে কেমন?
চকিতে এক লহমার জন্য দেখেছিলাম, আমি ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় তিনি তিন নম্বর দরজার পথে হলঘর থেকে বের হয়ে যান। তাই একটু অবাক হয়েই বোধ হয় দাঁড়িয়ে গিয়েছিলাম, এমন সময় বিশাখা এসে ঘরে প্রবেশ করল।
বিশাখা দেবীর সঙ্গে আপনার কোনো কথা হয়েছিল?
না।
কোনো কথাই হয়নি?
না। ইদানীং কিছুদিন থেকে তার সঙ্গে আমার কথাবার্তা বন্ধ ছিল।
কেন?
সে একান্তই আমার personal ব্যাপার। তবে এইটুকু জেনে রাখুন, I hate her!
আপনি তাহলে বিশাখা চৌধুরীর হলঘরে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই বাগানের দিকে যান?
তাই।
বাগানে গিয়ে মিত্রা সেনের সঙ্গে আপনার কোনো কথা হয়েছিল?
না। She– She was then already dead! সে আর তখন বেঁচে নেই—বলতে বলতে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম অশোক রায়ের কণ্ঠস্বরটা যেন জড়িয়ে এল।
কি করে বুঝলেন যে সে বেঁচে নেই?
ডেকে সাড়া না পেয়ে দুবারেও, গায়ে হাত দিয়ে ঠেলতেও যখন নড়ল না বা সাড়া দিল না তখন চমকে উঠি। তারপর ভাল করে দেখতে গিয়ে বুঝি যে—সে তখন মৃত। কিন্তু তখনও তার গা গরম ছিল মিঃ রায়। বোধ হয় আমি সেখানে পৌঁছবার অল্পক্ষণ
আগেই তার মৃত্যু হয়েছিল।
You are right, অশোকবাবু! That was the fact! আমার ধারণা সাড়ে সাতটা থেকে সাতটা পঁয়তাল্লিশের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু হয়েছে। বলেই কিরীটী আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, মিত্রা সেনের ব্যাপারে শশী হাজরার statement correct নয় সুব্রত। ৭-৪৫ মিঃ থেকে ৭-৫০ মিঃ নয়। সন্ধ্যা সাতটা কুড়ি থেকে সাতটা পঁচিশ মিনিটের মধ্যেই মিত্রা সেন গতকাল সঙ্ঘে এসেছিলেন এবং সোজা গিয়ে বাগানে পৌঁছতে তাঁর যদি ৫৬ মিনিট সময় লেগে থাকে তাহলে ৭-৩০ মিঃ থেকে ৩৫ মিনিটের মধ্যেই তাঁর মৃত্যু হয়েছিল। আর তাই যদি হয়ে থাকে তো হত্যাকারী গতকাল যে কোনো সময় সাতটা কুড়ি থেকে সাতটা পঁচিশ মিনিটের পূর্বেই সেখানে গিয়েছিল এবং উপস্থিত ছিল ঐ বৈকালী সঙ্ঘে।
বাধা দিলাম এবারে আমি। তাই যদি হয় তাহলে বুঝতে পেরেছি, তুই কি বলতে চাস! প্রথমত বৈকালী সঙ্ঘের বাড়িতে ঢোকবার একটিমাত্র দ্বারপথ ছাড়া আর দ্বিতীয় দ্বারপথ নেই বলেই আমরা শুনেছি এবং মিত্রা সেনের পূর্বে কেউ আর এসেছিল বলেও শশী হাজরা বলেনি। তাহলে এক্ষেত্রে দুটি কথাই ভাবতে হবে। এক—হয় এই মেইন ডোর ছাড়াও সঙ্ঘের বাড়িতে প্রবেশের দ্বিতীয় কোনো দ্বারপথ আছে নিশ্চয়ই, যে ব্যাপারটা হয়তো মেম্বাদের কাছেও গোপন ছিল। দ্বিতীয় শশী হাজরা সত্য statement দেয়নি। শুধু তাই নয়, আরও একটা ভাববার কথা আছে। অশোকবাবুবৈকালী সঙ্ঘের একজন পুরাতন influential মেম্বার। এবং সঙ্ঘে একমাত্র মেম্বারদের ছাড়া যখন বাইরের কারোরই প্রবেশের কোনোরকম অধিকারই ছিল না, সেক্ষেত্রে এমন কে নারী গত সন্ধ্যায় হলঘরে উপস্থিত ছিলেন যিনি অশোকবাবু ঘরে প্রবেশ করবার সঙ্গে সঙ্গেই তিন নম্বর দ্বারপথ দিয়ে হলঘর থেকে বের হয়ে যান এবং অশোকবাবুও যাঁকে চিনতে পারলেন না! যাক তাহলে আপাতত আমরা একটা ব্যাপারে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারছি যে, মিত্রা সেন নিহত হয়েছেন গতরাত্রে সন্ধ্যা সাতটা ত্রিশ মিনিট থেকে সাতটা পঁয়ত্রিশ মিনিটের মধ্যেই।
তাহলে তো অশোকের উপরে কোন সন্দেহই পড়তে পারে না মিঃ রায়!
এতক্ষণে যেন হালকা হয়ে রাধেশ রায় কিরীটীকে প্রশ্ন করলেন।
না, প্রথম থেকেই আমি স্থিরনিশ্চিত ছিলাম যে অশোকবাবু হত্যা করেননি মিত্রা সেনকে। এবং সেটা সম্পর্কে ডবল করে নিশ্চয় হয়েছি ওঁর একটি মাত্র কথা শুনেই একটু আগে।
কথাটা যে কি, অন্য কেউ না বুঝলেও আমি বুঝতে পেরেছিলাম। মিত্রা সেনের মৃত্যুর কথা বলতে গিয়ে একটু আগে যে অশোক রায়ের গলা ধরে এসেছিল, কিরীটীর নিশ্চয়তার পিছনে তারই ইঙ্গিত ছিল।
কিরীটী অতঃপর তার প্রশ্ন শুরু করেছে তখন।
অশোকবাবু, মিত্রা সেনের মৃতদেহ আবিষ্কৃত হবার পর আপনি যখন বিহ্বল হয়ে পড়েছিলেন তখন কি কেউ আপনাকে তাড়াতাড়ি ওখান থেকে পালিয়ে যেতে বলেছিল?
মৃদুকণ্ঠে অশোক রায় প্রত্যুত্তর দিলেন, হ্যাঁ।
কে সেই নারী?
মহারানী সুচরিতা দেবী বলেই আমার মনে হয়।
মহারানী?
হ্যাঁ। আবছা আলো-অন্ধকারে স্পষ্ট তাঁকে দেখতে পাইনি। তাছাড়া মনের অবস্থাও তখন আমার এমন ছিল না যে তাঁর সম্পর্কে ভাবি। তবে মনে হয় তিনিই।
না অশোকবাবু, মহারানী নন।
তবে? তবে কে তিনি?
এ সেই নারী সম্ভবত যাকে আপনি গতকাল হলঘরে ঢুকেই দেখতে পেয়েছিলেন মুহূর্তের জন্য।
কিন্তু–
আমার মন বলছে তাই। কিন্তু যাক সে কথা। আপনি হঠাৎ আত্মগোপন করেছিলেন কেন?
কারণ তিনিই আমাকে বুঝিয়েছিলেন, আত্মগোপন না করলে মিত্রার হত্যাকারী বলে আমাকেই লোকে ভাববে। আর সেই কথা শুনে আমারও যেন কেমন সব গোলমাল হয়ে গেল, আমি তাড়াতাড়ি পালালাম।
আপনি যাবার সময় নিশ্চয়ই হলঘর দিয়ে যাননি?
না। প্রেসিডেন্টের ঘরের পাশ দিয়ে যে প্যাসেজ, সেই প্যাসেজ দিয়েই বের হয়ে গিয়েছিলাম।
কেউ আপনাকে বের হয়ে যাবার সময় দেখেছিল বলে আপনি জানেন?
অত লক্ষ্য করে দেখিনি।
স্বাভাবিক। বলে একটু থামল কিরীটী। মিনিট দুয়েক স্তব্ধ হয়ে কি যেন ভাবল, তারপর মৃদুকণ্ঠে আবার বললে, অশোকবাবুকে এবারে আমার যা জিজ্ঞাস্য, সেটা আমি রাধেশবাবু আপনার অনুপস্থিতিতেই করতে চাই।
বেশ আমি যাচ্ছি। আমি গাড়িতেই অপেক্ষা করছি। রাধেশ রায় উঠে দাঁড়ালেন।
কিন্তু অশোক রায় বাধা দিলেন, না বাবা, তুমি বাড়ি চলে যাও আমি পরে যাচ্ছি।
রাধেশ রায় ইতস্তত করেন। কিরীটী ব্যাপারটা বুঝে বলে, আপনি যান রাধেশবাবু, উনি পরেই যাবেনখন।
রাধেশ রায় আর দ্বিরুক্তি করলেন না। ঘর থেকে নিঃশব্দে বেরিয়ে গেলেন।