সুশান্তদের বাড়ি থেকে স্থানীয় থানার দূরত্বটা একেবারে কম নয়। বেশ কিছুটা পথ। ঘোট শহর।
মিউনিসিপ্যালিটির আলোর ব্যবস্থাও রাস্তায় তেমন যথেষ্ট নয়। তার উপরে রাতটাও ছিল কৃষ্ণপক্ষ।
দূরে দূরে রাস্তার দুপাশে যে কেরেসিনের আলোর ব্যবস্থা, তাতে করে আলোর চাইতে অন্ধকারটাই যেন বেশী জমাট বেঁধে ছিল।
সেই অন্ধকার পথ ধরে দুজনে বাড়ির দিকে মন্থর পদবিক্ষেপে হেঁটে চলেছিল পাশাপাশি।
সহসা কিরীটীই একসময় প্রশ্ন করে, থানা-ইনচার্জ বিমলবাবু তো আপনাদের বন্ধু, তাই সুশান্তবাবু?
হ্যাঁ, একই কলেজে আমরা থার্ড ইয়ারে ও ফোর্থ ইয়ারে পড়েছি।
আচ্ছা সরকার ভিলার দুর্ঘটনা সম্পর্কে আপনাদের বন্ধুর সঙ্গে আপনাদের খোলাখুলি আলাপ কখনও হয়েছে? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।
তা হয়েছে বৈকি।
সারদাচরণের হত্যার ব্যাপারটা সম্পর্কে ওঁর মানে আপনাদের বন্ধুর ঠিক কি ধারণা জানেন কিছু বা বুঝতে পেরেছেন?
কথাটা ঠিক বুঝলাম না। মানে ঠিক আপনি কি জানতে চাইছেন মিঃ রায়?
বলছিলাম হত্যাকারী কে হতে পারে বলে তার ধারণা? জানেন তো, এসব ডিটেকশনের ব্যাপারে প্রবাবিলিটি বলে একটা কথা আছে সেটার কথাই বলছিলাম।
সে সম্পর্কে একদিন আমি জিজ্ঞাসা করেছিলামকরেছিলেন?
তা উনি কি জবাব দিলেন?
ওর ধারণা ঐ বৃন্দাবনবাবুই নাকি তার কাকাকে হত্যা করেছেন।
কিরীটী কথাটা শুনে কিছুক্ষণ কোন জবাবই দিল না, যেমন চলছিল হেঁটে তেমনিই হাঁটতে লাগল। এবং কিছুক্ষণ স্তব্ধতার পর বললে, হুঁ। তা কেন উনি বৃন্দাবনবাবুকে সন্দেহ করছেন কিছু বলেছেন? তার যুক্তি কি?
না, সেরকম কিছু বলেনি।
অবিশ্যি প্রবাবিলিটির দিক দিয়ে বৃন্দাবনবাবুকে যে তার কাকার হত্যাকারী একেবারে ভাবা যায় না তা নয়, কিন্তু কথা হচ্ছে এসব ক্ষেত্রে শুধু সন্দেহটাই তো সব নয়, প্রমাণ এবং উদ্দেশ্য দুই থাকা চাই।
আচ্ছা মিঃ রায়?
বলুন!
এমনও তো হতে পারে, বৃন্দাবনবাবু কৃতদার ছিলেন এবং বয়সও তার এখনও এমন কিছু বেশী নয়
হ্যাঁ হ্যাঁ-বলুন, বলুন? প্রত্যেকেরই চিন্তার একটা মূল্য আছে জানবেন। আপনি কোন পথে চিন্তা করছেন ব্যাপারটা শোনাই যাক না, বলুন?
বলছিলাম শকুন্তলা দেবীর কথা।
খুব স্বাভাবিক সুশান্তবাবু। এই হত্যার ব্যাপারে শকুন্তলা দেবীর উপস্থিতি সরকার ভিলায় বিশেষ একটি সূত্র বা বলতে পারেন পয়েন্ট। কিরীটী বললে।
কিন্তু, কিরীটী একটু থেমে আবার বলে, কি আপনি সঠিক বলতে চাইছেন স্পষ্ট করে বলুন তো সুশান্তবাবু?
বলছিলাম শকুন্তলা দেবী ও বৃন্দাবনবাবুর ঐ ব্যাপারে একটা যোগসাজস তো পরস্পরের মধ্যে থাকতে পারে! সুশান্ত বললে।
আশ্চর্য নয়। তাহলে আপনার ধারণা—
ধারণা আমার কিছুই নয় মিঃ রায়, সব কিছু দেখেশুনে যা মনে হয়েছে তাই বললাম। সুশান্ত কিরীটীকে একপ্রকার বাধা দিয়েই বলে।
তাহলে তো আপনারও সাবধান হওয়া উচিত ছিল সুশান্তবাবু?
আমার সাবধান হওয়া উচিত!
নিশ্চয়। শেষ পর্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে বৃন্দাবনবাবু যদি আপনার সঙ্গেই ধরুন ড়ুয়েল লড়বার জন্য আবার আস্তিন গুটিয়ে এগিয়ে আসেন–
যাঃ, কি যে বলেন! লজ্জিত কণ্ঠে সুশান্ত প্রতিবাদ জানিয়ে ওঠে।
সাধে কি আর বলি—অপর পক্ষও যে আপনার প্রতি মুগ্ধ বলে মনে হল সামান্য সাক্ষাতেই।
কিরীটী হাসতে হাসতে শেষের কথাটা বলে।
না, না—আপনার ওটা ভুল মিঃ রায়!
ভুল! তা হবে। কিন্তু একটা কথা কি জানেন, এক ধরণের নারী আছে যাদের নিজেদের আকর্ষণ দিয়ে পুরুষকে টেনে এনে তাদের নিয়ে খেলাটাই একটা নেশা।
না, আমি কিন্তু ওঁর সম্পর্কে আপনার সঙ্গে একমত হতে পারলাম না মিঃ রায়।
পারবেন না জানি, কারণ আপনি যে সেই অপর পক্ষ!
সত্যি বলুন তো মিঃ রায়, শকুন্তলা দেবীকে আপনি এখুনি যা বললেন—তাকে কি ঠিক তাই মনে হয়?
পালটা প্রশ্ন করল সুশান্ত পরক্ষণেই কিরীটীকে।
সে কথা যাক, কিরীটী বললে, আপনি আমার একটা প্রশ্নের আগে জবাব দিন।
কি?
আপনার পরামর্শেই হোক বা যাই হোক, মধুসূদনবাবু ও তস্য ভ্রাতা বৃন্দাবনবাবু যে তাদের কাকার হত্যার ব্যাপারে আমাকে নিযুক্ত করেছেন, এতে কি ওঁদের উভয়েরই পূর্ণ সমর্থন আছে বলে মনে হয় আপনার?
নিশ্চয়ই।
কিসে বুঝলেন?
এটা তো আপনি স্বীকার করেন, নিজের আত্মীয়ের এভাবে রহস্যজনক মৃত্যু সম্পর্কে সত্যটা জানতে মানুষ মাত্রেরই ইচ্ছা হয়!
তা হয়তো হয়—কিন্তু সেটা কি সর্বক্ষেত্রেই হয়।
তবে কি আপনার ধারণা ধারণা—
আপাততঃ কিছুই নয় আমার সুশান্তবাবু। তবে আমার মনে হয়—
কি?
যাক সে কথা। এখন বলুন শুনি, ঐ কেতু সম্পর্কে আপনার কি ধারণা?
কেতু?
হ্যাঁ-লোকটি মধুসূদনবাবুর মতে অজ্ঞাতকুলশীল এবং যে সারদাচরণের মৃত্যুর মাত্র কয়েক দিন পূর্বে সরকার ভিলায় রহস্যজনক ভাবে আবির্ভূত হয়ে আবার মৃত্যুর পরদিন সকাল থেকে রহস্যজনক ভাবে নিরুদ্দিষ্ট!
কি বলতে চান আপনি মিঃ রায়?
বলছি সে কি সারদাচরণকে মৃত জেনেই গা-ঢাকা দিয়েছে, না ব্যাপারটা না জেনেই নিরুদ্দিষ্ট হয়েছে?
তা কি করে হবে? মৃত্যুর ব্যাপারটা তো পরদিন সকালে শকুন্তলাই প্রথমে জানতে পেরেছে?
এমনও তো হতে পারে, তারও আগে জেনেছিল কেতু? তা কি করে বলি বলুন!
তা বটে। তবে এটা ঠিকই জানবেন, সরকার ভিলার হত্যা-রহস্যের ব্যাপারে শ্রীমান কেতু দ্বিতীয় এবং প্রয়োজনীয় সূত্র। অর্থাৎ প্রথম সূত্র শ্রীমতী শকুন্তলা দেবী, দ্বিতীয় সূত্র শ্রীমান কেতু। আর–
আর?
আর ঐ শকুন্তলা ও কেতু–
কি?
ঐ দুজনের সরকার ভিলায় আবির্ভাবের মূলেই রয়েছে সারদাচরণের মৃত্যুবীজটি নিহিত।
না, না—তা কেমন করে হবে? শকুন্তলার মত একটি মেয়ে-highly cultured–কেতুর মত একটা চাকরের সঙ্গে
কেন, ড্রাইভার বা ভৃত্যের সঙ্গে মনিব-কন্যা গৃহত্যাগিনী হয়েছে এমন নজিরের তো অভাব নেই। পঞ্চাশের ব্যাপার-কে কখন কানা হয় কিছু কি বলা যায় সুশান্তবাবু!
না, কিরীটীবাবু–you are going too far!
সুশান্তবাবু, পৃথিবীটা বড় বিচিত্র। আপনার অভিজ্ঞতা কতটুকু? কিন্তু আমি এই অল্প বয়সেই দেখেছি অনেক।
তাই বলে একটা খোঁড়া কুৎসিত চাকর–
চাকরই বটে। যাক সে কথা। তবে একটা ব্যাপার, আপনার চোখ স্বচ্ছ থাকলে আপনিও দেখতে পেতেন কিছু।
কি?
আজ সকালে শকুন্তলা দেবীর ঘরে—
শকুন্তলা দেবীর ঘরে—কি?
সদ্য-প্রস্ফুটিত গোলাপের গুচ্ছ ও ধূপের প্রজ্বলন্ত কাঠি।
মানে?
মানে সব-সবটাই অভিনয়। কিন্তু কথা হচ্ছে, কার সঙ্গে অভিনয় এবং কেনই বা ঐ অভিনয়টা করলেন শ্ৰীমতী?
মিঃ রায়!
তাই বলছিলাম সুশান্তবাবু, আপনার বয়েসটা বড় risky! ও কেয়ার ঝোপ-গন্ধে মাতাল হয়ে হুট করে হাত বাড়াবেন না-জানেন তো কেয়ার ঝোপের আশেপাশেই আত্মগোপন করে থাকে কালনাগ!
বিস্মিত দৃষ্টি তুলে সুশান্ত আবার অন্ধকারেই পথ চলতে চলতে কিরীটীর মুখের দিকে তাকায়।
কিন্তু অন্ধকারে কিরীটীর মুখটা ভাল করে তার নজরে পড়ে না।
সুশান্তর মনে হয়, কিরীটী যেন রীতিমত হেঁয়ালি করে কথা বলছে। তাই একসময় সে প্রশ্ন করে, আপনি যেন বড্ড হেঁয়ালি করে কথা বলছেন মিঃ রায়।
হেঁয়ালি নয়, সুশান্তবাবু। সহজ সত্যি কথাগুলোই বলছি। এবং আজকের এই হত্যারহস্যের আসল সত্যটা যেদিন আপনার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠবে, দেখবেন মিলিয়ে—আজ যা বলছি মিথ্যা বা অতিশয়োক্তি নয় এর কিছুই। কিন্তু বাড়ির কাছে এসে পড়েছি—চলুন চায়ের পিপাসায় গলাটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে উঠেছে। এক কাপ চায়ের প্রয়োজন বর্তমানে সবচাইতে বেশী।
রাত্রে খাবার টেবিলে বসেও আবার সরকার ভিলার মৃত্যু-রহস্যের আলোচনাতেই ফিরে যায় ওরা।
কিরীটী একসময় কথায় কথায় বলে, সারদাবাবুর উইলটার একটা বিশেষ গুরুত্ব আছে।
জানবেন। তার এই রহস্যজনক হত্যার ব্যাপারে আমার যতদূর ধারণা
উইল তোবোধ হয় কাল-পরশুর মধ্যেই পড়া হবে!
হ্যাঁ—আর উইলের মর্মকথাটা একান্তভাবেই জানা দরকার।
উইল খোলা হলেই তা জানতে পারবেন।
তা জানতে পারব, তবে সে সময় আমি উপস্থিত থাকতে চাই–
সে আর এমন কঠিন ব্যাপার কি? মধুসূদনবাবুকে আপনি বললেই হয়তো রাজী হবেন তিনি।
কাল সকালেই সরকার ভিলায় একবার গিয়ে অনুরোধটা তাকে জানাব ভাবছি।
বেশ তো।
পরের দিন সকালেই কিরীটী সরকার ভিলায় গেল।
বাইরের ঘরে মধুসূদনের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল কিরীটীর।
মধুসূদন ও শকুন্তলা বসে প্রভাতী চা-পান করছিলেন।
এই যে মিঃ রায়, আসুন আসুন-একেবারে সকালেই যে! কোন মীমাংসায় পৌঁছতে পারলেন নাকি? মধুসূদন আহ্বান জানালেন।
না, ব্যাপারটা বড় জটিল বলে মনে হচ্ছে-বলতে বলতে তির্যক দৃষ্টিতে একবার তাকালো কিরীটী মধুসূদনের মুখোমুখি উপবিষ্ট শকুন্তলার দিকে।
তাহলে এখনও কিছু বুঝতে পারেননি?
না। কিন্তু একটা request ছিল—
বলুন?
আপনার কাকার উইল কবে পড়া হচ্ছে?
বোধ হয় তো কালই, কিন্তু কেন বলুন তো?
আমি যদি সে-সময় উপস্থিত থাকি, আপত্তি হবে আপনার?
বিলক্ষণ, আপত্তি কিসের! নিশ্চয়ই থাকবেন।
তাহলে সেই কথাই রইল। আপনি আমাকে একটা খবর পাঠাবেন।
নিশ্চয়ই। কিন্তু এক কাপ চা খাবেন না?
না, এখন একবার থানায় বিমলবাবুর ওখানে যাব ভাবছি। কাল তার ওখানে গিয়ে দেখি উনি থানায় নেই!
বেশ।
কিরীটী সরকার ভিলা থেকে অতঃপর বের হয়ে এল।