সামবেদীয় চূড়াকরণ (১)
অনুবাদ।–কুলাচারানুসারে প্রথম বৎসরে, অথবা তৃতীয় বর্ষে চূড়াকরণ করণীয়। প্রথমতঃ পিতা প্রাতঃকালে স্নান ও বৃদ্ধিশ্রাদ্ধ সম্পাদন পূৰ্ব্বক সত্যনামা অগ্নিকে স্থাপন করিয়া বিরূপাক্ষজপান্তা কুশণ্ডিকা সমাপন করত অগ্নির দক্ষিণে একবিংশতি কুশগুচ্ছ সপ্ত সপ্ত সংখ্যায় একত্র করিয়া কুশান্তর দ্বারা বেষ্টন করিবে এবং উষ্ণোদকসহিত কাংস্যপাত্র, তাম্রনিৰ্ম্মিত ক্ষুর, তদভাবে দর্পণ বা লৌহরহস্ত নাপিতকে; অগ্নির উত্তরদিকে বৃষগোময় ও তিল-তণ্ডুল মাষসিদ্ধ কৃষর আর অগ্নির সম্মুখভাগে মিশ্রিত ব্রীহি যবরিত পাত্ৰত্রয় ও মিশ্রিত তিল তণ্ডুলমাষপূরিত পাত্র স্থাপন করিবে। মাতা কুমারকে পবিত্র বস্ত্র দ্বারা আচ্ছাদন পূৰ্ব্বক অগ্নির পশ্চিমে পতির বামপার্শ্বে উত্তরা কুশোপরি প্রাঙ্খুখী হইয়া উপবেশন করিবেন। অনন্তর পিতা প্রকৃত কৰ্ম্মারম্ভে প্রাদেশ প্রমাণ ঘৃতক্ত সমিধ্ তূষ্ণীভাবে অগ্নিতে আহুতি দিয়া ব্যস্তসমস্তমহাব্যাহৃতি হোম করিবেন। উক্ত হোমের মন্ত্র মূলের মধ্যে লিখিত আছে। তদনন্তর পিতা গাত্রোত্থান পূর্বক কুমারের জননীর পশ্চিমে অবস্থান করত ক্ষুরহস্ত নাপিতকে দর্শন করিয়া তাহাকে সবিতৃরূপ ধ্যানে “হে কুমার! এই নাপিতরূপী সবিতৃদেব ক্ষুরহস্তে আগমন করিয়াছেন।” এই মন্ত্র জপ করিবেন। ১। পরে কাংস্যপিত্রস্থি উষ্ণোদকের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া মনে মনে বায় কে ধ্যান করত “হে বায়ো! তুমিও গৃহীত উষ্ণোদক দ্বারা কুমারের মস্তক অভিষেকাৰ্থ আগমন কর” এই মন্ত্র জপ করিবে। ২। অনন্তর দক্ষিণহস্তগৃহীত কাংস্যপাত্রস্থ উষ্ণোদক দ্বারা “হে কুমার! বায়ু দ্বারা আনীত জলসমূহ জীবনাথ তোমাকে ক্লিন্ন করুন।” এই মন্ত্র দ্বারা কপুষ্টিকা(২) ক্লিন্ন করিবে। ৩। তৎপরে তাম্ৰক্ষুর অথবা তদভাবে দর্পণ দেখাইয়া এই মন্ত্র জপ করিরে যে, “হে ক্ষুর! তুমি বিষ্ণুর দন্তস্বরূপ।”৪। তদনন্তর কুশবদ্ধ সপ্ত দৰ্ভগুচ্ছ লইয়া পূর্বোক্ত ক্লিন্ন-দক্ষিণ-কপুষ্টিকাদেশে “হে দর্ভ! তুমি এই কুমারকে রক্ষা কর” এই মন্ত্রে উর্দ্ধমূলভাবে সেই ভিগুচ্ছ কেশে বন্ধন করিবে। ৫। পরে বামহস্ত-গৃহীতদৰ্ভগুচ্ছসহিতকপুষ্টিকাদেশে দক্ষিণ হস্ত-গৃহীত তাম্ৰক্ষুর অথবা তদভাবে দর্পণ স্থাপন করিবে। “হে ক্ষুর! এই কুমারকে হিংসা করিও না” এই মন্ত্রে ক্ষুর স্থাপন করিবে। ৬। তৎপরে কেশচ্ছেদ না হয়, এরূপ ভাবে তার বা দর্পণ সেই কপুষ্টিকাদেশে প্রেরণ করিতে হয়। যে সুধিতি অথবা ক্ষুরের দ্বারা পূষা সূৰ্য্যদেব) বৃহস্পতির কেশমুণ্ডন (কিরণজাল সংযত করিয়া ছিলেন, যে সুধিতি দ্বারা বায়ু ইন্দ্রের (মেঘবাহনের) কেশমুগুন (মেঘপনয়ন) করিয়াছিলেন, ব্রহ্মরূপী সেই সুধিতি দ্বারা ত্বদীয় কেশ মুণ্ডন করিতেছি, স্বদীয় আয়ু, বল ও তেজ পরিবর্ধিত হউক” এই মন্ত্র দ্বারা প্রেরণ করিবে। ৭। অনন্তর দুইবার তূষ্ণীভারে ক্ষুর প্রেরণ করিতে হয়। তৎপরে লৌহক্ষুর দ্বারা কপুষ্টিকাদেশস্থিত কেশ ছেদন করিয়া আচারানুসারে দর্ভগুচ্ছ সহ বালমিত্রবৃত-পাত্রস্থ বৃষগোময়োপরি নিক্ষেপ করিবে। অনন্তর দক্ষিণ-হস্ত-গৃহীত কাংস্যপাত্রস্থ উষ্ণোদক দ্বারা মূলের লিখিত মন্ত্রে পূর্ববৎ কপুচ্ছলদেশ(৩) ক্লিন্ন করিবে। পরে তাম্ৰক্ষুর বা অদভাবে দর্পণ দেখিয়া মূলের লিখিত মন্ত্র জপ; তৎপরে কুশবন্ধ সপ্তদর্ভপিঞ্জলী লইয়া যথাযথ মন্ত্রে ক্লিনকপুচ্ছলদেশে উহা উৰ্দ্ধমূলভাবে স্থাপন; পরে যথাযথ মন্ত্রে বাম হস্ত-গৃহীত দৰ্ভগুচ্ছ-সহিত-কপুচ্ছলদেশে দক্ষিণ-হস্ত গৃহীত তাম্রক্ষুর বা তদভাবে দর্পণ স্থাপন; অবশেষে কেশচ্ছেদ না হয় এরূপ ভাবে তাক্ষুর বা দর্পণ সেইকপুচ্ছলদেশে মূলের লিখিত মন্ত্রে চালনা করিবে। পরে দুইবার তূষ্ণীভাবে চালনা করিতে হয়। অনন্তর লৌহক্ষুর দ্বারা কপুচ্ছলস্থ কেশ ছেদন পূৰ্ব্বক আচারানুসারে দর্ভগুচ্ছ সহ বালমিত্রাদি-ধৃত-পাত্রস্থ বৃষগোময়োপরি নিক্ষেপ করিবে। তদনন্তর বামকপুষ্টিকা-প্লাবনাদি-চ্ছেদন পূৰ্ব্বক বৃষগোময়োপরি কেশনিক্ষেপ যাবৎ সৰ্ব্বকৰ্ম্ম পূৰ্ব্ববৎ করণীয়। পরে করদ্বয় দ্বারা কুমারের মস্তক ধারণ পূৰ্ব্বক এই মন্ত্র জপ করিবে যে, যমদগ্নির আয়ুত্রিতয় অর্থাৎ বাল্য, যৌবন, জরা (অথবা মধ্যখগোলস্থ নক্ষত্রবিশেষের আয়ুত্রিতয় অর্থাৎ, উদয়, ভোগ, অন্ত) তুমি প্রাপ্ত হও; কশ্যপঋষির আয়ুত্রিতর অর্থাৎ বাল্য, যৌবন, জরা, (অথবা উত্তরখগোলস্থ নক্ষত্র বিশেষের আয়ুত্রিতয় অর্থাৎ উদয়, ভোগ, অত) তুমি প্রাপ্ত হও; অগস্ত্য ঋষির আয়ুতিয় অর্থাৎ বাল্য, যৌবন, জরা (অথবা, দক্ষিণখগোলস্থ নক্ষত্রবিশেষের উদয়, ভোগ, অস্ত) তুমি প্রাপ্ত হও; ইন্দ্রাদি দেবতাদিগের আয়ুতিয় অর্থাৎ বাল্য, যৌবন, জরা (অথবা দ্যুতিশীল নক্ষত্রসমূহের আয়ুত্রিতয় অর্থাৎ উদয়, ভোগ, অস্ত) তুমি প্রাপ্ত হও।৮।(৪) অনন্তর পুষ্পদি অলঙ্কারে অলঙ্কৃত নাপিত কুমারকে অগ্নির উত্তরদিকে লইয়া মুণ্ডন পূৰ্ব্বক সমস্ত কেশ গোময়োপরি স্থাপন করত অরণ্যে বা বংশবিটপে প্রক্ষেপ করিবে। এই সময়েই কর্ণবেধ করণীয়।(৫) তদ-উদীচ্য কৰ্ম্ম সমাধা করিবে। পরে কৰ্ম্মকারয়িতৃ ব্রাহ্মণকে দক্ষিণা দিতে হয়। নাপিতকে কৃষর, যব, ধান্য, তিল, সর্ষপ প্রভৃতি প্রদান করিবে।
ইতি সমবেদীয়-চূড়াকরণ সমাপ্ত।
——–
(১) চূড়াকরণ একটী কৈশোর সংস্কার বলিয়া পরিগণিত। যদিও ইহা বাল্যে নির্বাহ করার রীতি ছিল, কিন্তু এক্ষণে তাহা না হইয়া একেবারে কৈশোরকালেই নির্বাহিত হয়। ইহার মুখ্য কাল একবর্ষ বা তৃতীয় বংদর। কিন্তু পাঁচবৎসর-প্রভৃতি অন্যান্য অযুগ্ম বর্ষেও নিষ্পাদিত হইয়া থাকে। এই সংস্কার দ্বারা অপাত্ৰীকরণ-দোষের বিদুরণ হয়। কেশমুণ্ডনই ইহার প্রধান কাৰ্য। গর্ভাবস্থায় সন্তানের মস্তকে যে কেশ উৎপন্ন হয়, তাহা, নিঃশেষে উন্মলিত করিয়া এই সংস্কার দ্বারা শিশুকে শিক্ষা এবং সংস্কারে পাত্রীভূত করা হইয়া থাকে।
(২) কপুষ্টিকা–শিখাস্থান হইতে উভয় পার্শ্বদিকে অধঃশিরের যে অংশ কর্ণয়াভিমুখে গিয়াছে।
(৩) কপুচ্ছল–শিখাস্থানের পশ্চাদ্ভাগ অর্থাৎ যে অংশ স্কন্ধের দিকে গিয়াছে।
(৪) এই মন্ত্র গুলির তাৎপৰ্য চিন্তা করিলে সহজেই উপলব্ধি হইবে যে, প্রকৃত পক্ষে এই সংস্কারটী শৈশবকালের বলিয়া ইহাতে ব্যসংস্কারের লক্ষণ যেরূপ স্পষ্টীকৃত রহিয়াছে, সেরূপ পুরুষসংস্কারের লক্ষণ সুস্পষ্ট নাই; তথাপি শিশুরূপী ক্ষুদ্ৰব্ৰহ্মাণ্ডটী যে বৃহব্রহ্মাণ্ডের অনুরূপ, মন্ত্রাভারে তাহার স্পষ্ট অভিব্যক্তিই লক্ষিত হইতেছে।
(৫) কর্ণবেধতী কোন সংস্কারের মধ্যেই গণ্য নহে। ইহাতে কোন মন্ত্রপাঠও নাই। তবে শাস্ত্রীয় একটী বচন পাওয়া যায় যে, “কর্ণরন্ধ্রে, রবেশ্ছায়া ন বিশেদগ্রজন্মনঃ। তং দৃষ্ট্বা বিলয়ং যান্তি পুণ্যৌঘাশ্চ পুরাতনাঃ।” অর্থাৎ কর্ণরন্ধ্রে, সূর্যরশ্মি প্রবিষ্ট না হইলে সেই ব্রাহ্মণকে দেখিলে পূৰ্ব্বকৃত পুণ্যরাশি বিনাশ প্রাপ্ত হয়। যাহা হউক, যদি উচিতরূপে এই কাৰ্যটী নিৰ্বাহ হয়, তাহা হইলেও এক প্রকার পৌষ্টিককর্মের মধ্যে ধরা যাইতে পারে। আমাদিগের বিবেচনায় ও যুক্তিতে বর্ষপরিমিত বয়ঃক্রমের মধ্যে এইটী নিৰ্বাহ করিয়া আর চুড়াকরণটাকে তাহার তৃতীয় বর্ষে সম্পাদন পূৰ্ব্বক সর্বোচ্চ সংস্কার উপনয়নকে নির্ব্বিঘ্ন করা কর্তব্য। আমাদিগের এই মধ্যবাঙ্গালায় উপনয়নের সময় নাপিতের দ্বারা উপনেতব্যের কর্ণবেধ করাইয়া পরে উপনয়ন সংস্কার নির্বাহিত হইয়া থাকে। কিন্তু কর্ণবেধ করা নিবন্ধন যে ক্ষতাশৌচ হয়, সেটা কেহ গ্রাহ্যই করেন না। “সঙ্কল্প পূৰ্ব্বক কাৰ্যারম্ভ হইলে কোন অশোঁচবশতঃ আরব্ধ কৰ্ম্মের হানি হয় না” এই প্রমাণ দেখাইয়া তাহার উক্ত কাৰ্য নির্বাহ করেন; কিন্তু এটী কদাচ যুক্তিসঙ্গত নহে। ময়মনসিংহ প্রভৃতি পূর্ববঙ্গে এবং ভার তের দক্ষিণাঞ্চল ও পশ্চিমাঞ্চলে কর্ণবেধ উপনয়নের অঙ্গীভূত নহে।