‘মিনিয়াপলিস্ ষ্টার’ ২৫ নভেম্বর ১৮৯৩
গতকল্য সন্ধ্যায় ফার্ষ্ট ইউনিটেরিয়ান চার্চ-এ (মিনিয়াপলিস্ শহরে) স্বামী বিবে কানন্দ হিন্দুধর্ম সম্বন্ধে ব্যাখান দিয়াছিলেন। ব্রাহ্মণ্যধর্ম চিরন্তন সত্যসমূহের মূর্ত প্রকাশ; সেইজন্য উহা স্বকীয় যাবতীয় সূক্ষ্ম ভাবরাশি দ্বারা সমাগত শ্রোতৃবৃন্দকে বিশেষভাবে অভিনিবিষ্ট করিয়াছিল। শ্রোতাদের মধ্যে অনেক চিন্তাশীল নরনারী ছিলেন, কেননা বক্তাকে আমন্ত্রণ করিয়াছিলেন ‘পেরিপ্যাটেটিকস্’ নামক দার্শনিক সমিতি। নানা খ্রীষ্টান সম্প্রদায়ের ধর্মযাজক, বহু পণ্ডিত ব্যক্তি এবং ছাত্রেরাও সভায় উপস্থিত ছিলেন। বিবে কানন্দ একজন ব্রাহ্মণ ধর্মযাজক। তিনি তাঁহার দেশীয় পোষাকে আসিয়াছিলেন—মাথায় পাগড়ি, কোমরে লাল কটিবন্ধ দিয়া বাঁধা গৈরিক আলখাল্লা এবং অধোদেশেও লাল পরিচ্ছদ।
তিনি তাঁহার ধর্মের শিক্ষাগুলি অত্যন্ত আন্তরিকতার সহিত ধীর এবং স্পষ্টভাবে উপস্থাপিত করিতেছিলেন, ত্বরিত বাগ্বিলাস অপেক্ষা শান্ত বাচনভঙ্গী দ্বারাই যেন তিনি শ্রোতৃমণ্ডলীর মনে দৃঢ় প্রত্যয় লইয়া আসিতেছিলেন। তাঁহার কথাগুলি খুব সাবধানে প্রযুক্ত। উহাদের অর্থও বেশ পরিষ্কার। হিন্দুধর্মের সরলতর সত্যগুলি তিনি তুলিয়া ধরিতেছিলেন। খ্রীষ্টধর্ম সম্বন্ধে তিনি কোন কটূক্তি না করিলেও এমনভাবে উহার প্রসঙ্গ করিতেছিলেন, যাহাতে ব্রাহ্মণ্যধর্মকেই পুরোভাগে রাখা হইতেছিল। হিন্দুধর্মের সর্বাবগাহী চিন্তা এবং মুখ্য ভাব হইল মানবাত্মার স্বাভাবিক দেবত্ব। আত্মা পূর্ণস্বরূপ, ধর্মের লক্ষ্য হইল মানুষের এই সহজাত পূর্ণতাকে বিকাশ করা। বর্তমান শুধু অতীত এবং ভবিষ্যতের মধ্যবর্তী সীমারেখা। মানুষের ভিতর ভাল এবং মন্দ দুই প্রবৃত্তিই রহিয়াছে। সৎ সংস্কার বলবান্ হইলে মানুষ ঊর্ধ্বতর গতি লাভ করে অসৎ সংস্কারের প্রাধান্যে সে নিম্নগামী হয়। এই দুইটি শক্তি অনবরত তাহার মধ্যে ক্রিয়া করিতেছে। ধর্ম মানুষকে উন্নত করে, আর অধর্ম ঘটায় তাহার অধঃপতন।
কানন্দ আগামীকল্য সকালে ফার্ষ্ট ইউনিটেরিয়ান চার্চ-এ বক্তৃতা করিবেন।
‘ডে ময়েন নিউজ’, ২৮ নভেম্বর , ১৮৯৩
সুদূর ভারতবর্ষ হইতে আগত মনীষী পণ্ডিত স্বামী বিবেকানন্দ গত রাত্রে সেণ্ট্রাল চার্চ-এ বক্তৃতা দিয়াছিলেন। চিকাগোর বিশ্বমেলা উপলক্ষে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ধর্ম-মহাসভায় তিনি তাঁহার দেশের ও ধর্মের প্রতিনিধিরূপে আসিয়াছিলেন। রেভারেণ্ড এইচ. ও. ব্রীডেন বক্তাকে শ্রোতৃমণ্ডলীর নিকট পরিচিত করিয়া দেন। বক্তা উঠিয়া সমবেত সকলকে মাথা নীচু করিয়া অভিবাদনের পর তাঁহার ভাষণ আরম্ভ করেন। বিষয় ছিল—হিন্দুধর্ম। তাঁহার বক্তৃতা একটি নির্দিষ্ট চিন্তাধারার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। তাঁহার নিজের ধর্ম এবং অন্যান্য ধর্মমত সম্পর্কে তিনি যে-সব দার্শনিক ধারণা পোষণ করেন, তাহার কিছু কিছু পরিচয় ঐ বক্তৃতাতেই পাওয়া গিয়াছিল। তাঁহার মতে শ্রেষ্ঠ খ্রীষ্টান হইতে গেলে সকল ধর্মের সহিত পরিচয় অত্যাবশ্যক। এক ধর্মে যাহা নাই, অপর ধর্ম হইতে তাহা লওয়া যায়। ইহাতে কোন ক্ষতি নাই। প্রকৃত খ্রীষ্টানের পক্ষে ইহা প্রয়োজনীয়। বিবেকানন্দ বলেন, ‘তোমরা যখন আমাদের দেশে কোন মিশনরীকে পাঠাও, তিনি ‘হিন্দু খ্রীষ্টানে’ পরিণত হন, পক্ষান্তরে আমি তোমাদের দেশে আসিয়া ‘খ্রীষ্টান হিন্দু’ হইয়াছি।’ আমাকে এই দেশে অনেক সময় জিজ্ঞাসা করা হইয়াছে, আমি এখানে লোককে ধর্মান্তরিত করিবার চেষ্টা করিব কিনা। এই প্রশ্ন আমি অপমানজনক বলিয়া মনে করি। আমি ধর্ম পরিবর্তনে বিশ্বাস করি না। আজ কোন ব্যক্তি পাপকার্যে রত আছে, তোমাদের ধারণা—কাল যদি সে খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত হয়, তাহা হইলে ধীরে ধীরে সে সাধুত্ব লাভ করিবে। কিন্তু প্রশ্ন উঠে, এই পরিবর্তন কোথা হইতে আসে? ইহার ব্যাখ্যা কি? ঐ ব্যক্তির তো নূতন একটি আত্মা হয় নাই, কেননা পূর্বের আত্মা মরিলে তবে তো নূতন আত্মার আবির্ভাবের কথা। বলিতে পার, ভগবান্ তাহার ভিতর পরিবর্তন আনিয়াছেন। ভাল, কিন্তু ভগবান্ তো পূর্ণ, সর্বশক্তিমান্ এবং পবিত্রতার স্বরূপ। তাহা হইলে প্রসঙ্গোক্ত ব্যক্তির খ্রীষ্টান হইবার পর ভগবান্ পূর্বের সেই ভগবানই থাকেন, কেবল যে পরিমাণ সাধুতা তিনি ঐ ব্যক্তিকে দিয়াছিলেন, উহা তাঁহাতে ঘাটতি পড়িবে।
আমাদের দেশে দুটি শব্দ আছে যাহার অর্থ এদেশে সম্পূর্ণ আলাদা। শব্দ দুটি হইল ‘ধর্ম’ এবং ‘সম্প্রদায়’। আমাদের ধারণায় ধর্ম হইল সেই সার্বজনীন সত্য, যাহা সকল ধর্মমতের মধ্যেই অনুস্যূত। আমরা পরমত-অসহিষ্ণুতা ছাড়া আর সব কিছুই সহ্য করি। অপর শব্দটি—‘সম্প্রদায়’, তাহার অর্থ একটি সমমতসমর্থক সখ্যবদ্ধ ব্যক্তির দল, যাঁহারা নিজদিগকে ধার্মিকতার আবরণে আষ্টে-পৃষ্ঠে জড়াইয়া বলিতে থাকেন, ‘আমাদের মতই ঠিক, তোমরা ভুলপথে চলিতেছ।’ ইঁহাদের প্রসঙ্গে আমার দুই ব্যাঙের গল্পটি মনে পড়িল।
কোন কুয়ায় একটি ব্যাঙের জন্ম হয়, বেচারা সারাজীবন ওখানেই কাটাইতে থাকে। একদিন সমুদ্রের এক ব্যাঙ ঐ কুয়ায় পড়িয়া যায়। দুইজনের গল্প শুরু হইল সমুদ্র লইয়া। কূপমণ্ডূক ঐ আগন্তুককে জিজ্ঞাসা করিল, ‘সমুদ্র কত বড়?’ সাদাসিধা কোন উত্তর না পাইয়া সে তখন কুয়ার এক কোণ হইতে আর এক কোণে লাফ দিয়া গিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘সাগর অত বড় কিনা।’ আগন্তুক বলিল, ‘তা তো বটেই।’ তখন কুয়ার ব্যাঙ আরও একটু বেশী দূর লাফাইয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘আচ্ছা, তবে এত বড় কি?’ সাগরের ব্যাঙ তখন উত্তর দিল ‘হ্যাঁ’, তখন কূপমণ্ডুক মনে মনে বলিল—‘এই ব্যাঙটি নিশ্চয়ই মিথ্যাবাদী। আমি ওকে আমার কুয়ায় স্থান দিব না।’ সম্প্রদায়গুলিরও এই একই অবস্থা। তাহাদের নিজেদের মত যাহারা বিশ্বাস করে না, তাহাদিগকে তাহারা দূর করিয়া দিতে এবং পদদলিত করিতে চায়।৪