১০. পায়ে পায়ে একসময় কিরীটী

পায়ে পায়ে একসময় কিরীটী তার নির্দিষ্ট ঘরটা থেকে বের হয়ে বাইরের বারান্দা অতিক্রম করে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এলো।

সন্ধ্যা থেকেই সারা আকাশটা জুড়ে মেঘে ছেয়ে গিয়েছিল। শুরু হলো এতক্ষণে বৃষ্টি, সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রবল হাওয়া।

মধ্যে মধ্যে কালো আকাশটার এক প্রান্ত হতে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত বিদ্যুতের নীল আলো যেন চোখ রাঙিয়ে যাচ্ছে। গুরু গুরু মেঘের ডাক থেকে থেকে আকাশটাকে যেন কাঁপিয়ে তুলছে।

বারান্দাটা অতিক্রম করে কিরীটী বাইরের মহলের দিকে অগ্রসর হলো। ইতিমধ্যে বারান্দার ঝোলানো বাতি জেলে দেওয়া হয়েছে। প্রবল বায়ুর ঝাপটায় বাতিটা দুলছে। কাঁপছে বাতির শিখাটা। দেওয়লের গায়ে প্রতিফলিত আলোটাও সেই সঙ্গে কাঁপছে এধার থেকে ওধারে মৃদুমন্দ।

জলের ঝাপটা বারান্দাতেও আসছে—বেশিক্ষণ এই খোলা বারান্দায় থাকলে সর্বাঙ্গ ভিজে যাবে। সামনেই একটা ঘরের খোলা দ্বার দেখতে পেয়ে কিরীটী সেই ঘরের মধ্যেই গিয়ে ঢুকে পড়ে।

সঙ্গে সঙ্গে ভারী গলায় প্রশ্ন এলো, কে?

কণ্ঠস্বরটা অনুসরণ করে সামনের দিকে চোখ তুলে তাকাতেই কিরীটীর সঙ্গে চোখাচোখি হয়ে গেল নায়েব বসন্তবাবুর।

এইমাত্র বোধ হয় সন্ধ্যা-আহ্নিক সমাপ্ত করে বসন্তবাবু, শুধু একটা ধুতি পরিধানে খালিগায়ে ঘরের মধ্যস্থলে দাঁড়িয়ে। দেওয়ালের গায়ে একটা দেওয়ালবাতি জ্বলছে। তারই আলোয় কিরীটী পরিপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকাল বসন্ত বাবুর মুখের দিকে।

বসন্তবাবুর দুচোখের তারায় যেন একটা কঠিন প্রশ্ন ছুরির মত ঝিকিয়ে উঠছে।

নায়েব বসন্ত সেনের দুই চক্ষুর ছুরির ফলার মত ধারালো শাণিত দৃষ্টি যেন কয়েকটি মুহূর্ত কিরীটীর দুই চক্ষুর দৃষ্টির সঙ্গে উদ্ধত স্পর্ধায় মিলিত হয়ে স্থির হয়ে থাকে। পলকহীন, অকম্পিত।

কিন্তু সে মুহূর্তের জন্যই, পরক্ষণেই বসন্ত সেনের চক্ষুর দৃষ্টি ও মুখের একটু আগে কঠিন হয়ে ওঠা সমস্ত রেখাগুলো সহজ ও কোমল হয়ে এলো। বিনীত হাস্যে চোখ-মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো।

কিরীটীবাবু, যে! হঠাৎ কি মনে করে? বসন্তবাবুই প্রথমে প্রশ্ন। করলেন।

কিরীটী স্মিতকণ্ঠে বললে, একা একা ঘরের মধ্যে বসে থাকতে ভাল লাগছিল না, তাই আপনার সঙ্গে একটু আলাপ করতে এলাম। বসতে পারি সেনমশাই?

নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই, বসুন। অভ্যর্থনা জানালেন নায়েব বসন্ত সেন। এবং সমস্ত আবহাওয়াটাকে সহজ ও লঘু করে সম্মুখের একটা খালি চেয়ার চোখের নির্দেশে দেখিয়ে দিলেন বসন্তবাবু কিরীটীকে।

আপনার সময় নষ্ট করছি না তো সেনমশাই? চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসতে বসতে কিরীটী কথাগুলো নায়েবমশাইয়ের মুখের দিকে তাকিয়েই উচ্চারণ করলে।

না, না—সন্ধ্যার পর আমি বিশেষ কোন কাজই করি না। এই সময়টা রাত্রে আহারের আগে পর্যন্ত আমার সম্পূর্ণ বিশ্রামের সময়।

কিরীটী চেয়ারটার উপর নড়েচড়ে একটু আরাম করে বসল এবং পকেট থেকে চামড়ার সিগার কেসটা বের করে কেস থেকে একটা সিগার নিয়ে সেটায় অগ্নিসংযোগ করল।

নায়েব বসন্ত সেনও একটা চেয়ার টেনে নিয়ে উপবেশন করলেন। পরিধেয় ধুতিটার কোছাটা খুলে গায়ের উপর জড়িয়ে নিলেন।

খোলা জানলা-পথে জলসিক্ত ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝাপটা আসছে, বেশ শীতশীত করে।

বৃষ্টিও যেন নেমেছে একেবারে আকাশ ভেঙে।

কয়েকটা মুহূর্ত নিঃশব্দে অতিবাহিত হয়, দুজনের কারো মুখেই কোন কথা নেই। বাইরে শুধু, একটা বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ। টেবিলের উপরে একটা সাদা চিমনি দেওয়া কেরোসিনের টেবিল বাতি জ্বলছে। বাতির আলোয় ঘরটা বেশ আলোকিতই হয়ে উঠেছে।

সহসা এক সময় নায়েব বসন্তবাবুই স্তব্ধতা ভঙ্গ করলেন, তার মৃত্যুর সমস্ত ব্যাপারটাই তো আপনি সত্যজিৎ ও সবিতার মুখে শুনেছেন মিঃ রায়?

হ্যাঁ।

এ সম্পর্কে সত্যজিতের যা ধারণা তাও নিশ্চয়ই শুনেছেন?

শুনেছি। কিরীটী মৃদুকণ্ঠে জবাব দেয়।

কিন্তু ব্যাপারটা আপনার কি মনে হয় মিঃ রায়?

দেখুন ঘটনা সম্পর্কে যতটা শুনেছি তাতে অবশ্য আমার মনে হয় এর পিছনে একটা বিশ্রী চক্রান্ত আছে—

চক্রান্ত! কথাটা উচ্চারণ করে নায়েব বসন্ত সেন তাকালেন কিরীটীর মুখের দিকে বিস্ময়-দৃষ্টিতে।

হ্যাঁ। এবং এও ঠিক, মৃত্যুঞ্জয়বাবুর হত্যা-রহস্যের কিনারা করতে হলে আমাদের দীর্ঘ উনিশ বৎসর আগে তাঁর স্ত্রীর হেমপ্রভা দেবীর মৃত্যুকে সর্বাগ্রে মীমাংসা করতে হবে—

হেমপ্রভার মৃত্যু! সে তো উনিশ বছর আগে ঘটেছে। তাছাড়া হেমপ্রভার মৃত্যুও তো যতদূর জানি স্বাভাবিক ব্যাপার। রোগাক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু ঘটে।

তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে তাকাল কিরীটী বসন্ত সেনের মুখের দিকে। কানাইয়ের মার মুখ থেকে শোনা সত্যজিৎ-বর্ণিত হেমপ্রভার সে মৃত্যু-কাহিনী কি তবে বসন্ত সেনের অজ্ঞাত! সত্যই কি বসন্ত সেন সে ব্যাপারের কিছুই জানেন না? না তিনি স্বীকার করতে চাইছেন না? কিন্তু সত্য হোক মিথ্যা হোক, বেশ ভাল করে যাচাই না করে কিরীটী বসন্ত সেনকে মুক্তি দেবে না। সেই কারণেই ব্যাপারটা যেন আজও বসন্ত সেনের অজ্ঞাতই এইভাবে দ্বিতীয় প্রশ্ন করল কিরীটী, কেন, আপনি কিছুই জানেন না—হেমপ্রভা দেবীর সত্যিকারের মৃত্যুর ব্যাপারটা?

কই না! হেমপ্রভার মৃত্যুর মধ্যেও কোন একটা ব্যাপার ছিল, এ তো কই আমার এতদিন জানা ছিল না! তিনি হঠাৎ একদিন সকালে অসুস্থ অবস্থাতেই বেশী রকম অসুস্থ হয়ে পড়ায় কর্তা রত্রেই তাঁকে নিয়ে চিকিৎসার জন্য কলকাতায় চলে যান এবং কলকাতাতেই তাঁর মৃত্যু হয়।

না, তা বোধ হয় ঠিক নয়। গভীর কণ্ঠে কিরীটী প্রত্যুত্তর দেয়।

কী আপনি বলছেন মিঃ রায়! আমি যে তখন এ বাড়িতেই ছিলাম। আমার চোখের সামনে দিয়ে অসুস্থ হেমপ্রভাকে পাল্কিতে চাপিয়ে কর্তা কলকাতায় চিকিৎসার জন্য নিয়ে যান!

হ্যাঁ, পাল্কি যেতে দেখেছেন বটে তবে তার মধ্যে একটা পাল্কিতে কেউ ছিল না—ছিল খালি। এবং তার আগেই হেমপ্রভা দেবীর মৃত্যু ঘটেছিল।

যত সব আজগুবী ব্যাপার। কে বলেছে আপনাকে এসব কথা শুনি?

আমাকে কেউ বলেনি। বলেছে কানাইয়ের মা সবিতা ও সত্যজিৎবাবুকে।

কানাইয়ের মা বলেছে! দাঁড়ান তো দেখি, হারামজাদীকে একবার ডাকি—

বসন্ত সেন চেয়ার ছেড়ে উঠতে যাচ্ছিলেন কিন্তু কিরীটী তাঁকে বাধা দিল, ব্যস্ত হবেন না বসন্তবাবু, বসুন। আমার কথাটা শেষ করতে দিন আগে। এখনও আমার শেষ হয়নি।

কিন্তু এ যা আপনি বলছেন এ তো একেবারে সম্পূর্ণ আরব্য উপন্যাস। সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য!

উপন্যাসের চেয়েও অবিশ্বাস্য অনেক ঘটনা অনেক সময়েই আমাদের জীবনে ঘটে নায়েব মশাই। অবশ্য আমার ধারণা ছিল ব্যাপারটা আপনার অজ্ঞাত নয়।

না মিঃ রায়, আপনি হয়ত জানেন না। মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর আমি মাইনেকরা ভৃত্য হলেও তাঁর সঙ্গে কোনদিন আমার প্রভু-ভৃত্য সম্পর্ক ছিল না। বন্ধু এবং ভায়ের মতই আমরা পরস্পর পরস্পরের কাছে ছিলাম। তাঁর জীবনের কোন ঘটনাই আমার অজ্ঞাত ছিল না কোন দিন। সেক্ষেত্রে এতবড় একটা ঘটনা তিনি আমার কাছে লুকিয়ে রেখেছেন এ কথা আমি বিশ্বাসই করতে পারি না। সম্পূর্ণ অবিশ্বাস্য।

হয়ত এমনও হতে পারে সর্বদা তিনি সব কথা আপনার কাছে বললেও ঐ ব্যাপারটা কোন বিশেষ কারণেই আপনার কাছ থেকে গোপন করেছিলেন

কারণ বলছেন, কি তার এমন কারণ থাকতে পারে! আর সত্যিই যদি আপনি যা বলছেন তাই হয়ে থাকে, তাহলে তো এত বড় একটা ঘটনা তিনি নিঃশব্দে চাপা দিয়ে যাবেন, তাই বা কেমন করে সম্ভব বা বিশ্বাসযোগ্য বলুন? তারপর একটু থেমে বললেন, আপনি জানেন না মিঃ রায়, কিন্তু আমি জানি, হেমপ্রভাকে তিনি জীবনাধিক ভালবাসতেন। তাঁর পায়ে কাঁটাটি ফুটলেও তিনি বুক পেতে দিতে পারতেন। আর অমনি একটা ব্যাপারকে তিনি নীরবে সহ্য করে যাবেন!

নায়েব মশাই, আপনি অবিবাহিত। বিবাহিত স্বামী-স্ত্রীর প্রেম ও ভালবাসার রাস্তাটা এমন জটিল যে তার অনেক সময় হদিসই পাওয়া যায় না। বিশেষ করে আমাদের এই বাংলাদেশে কোন কোন স্বামী-স্ত্রী জীবনব্যাপী গরমিল অসামঞ্জস্যকে এমনভাবে সহিষ্ণুতা ও সামাজিক নিয়মকানুনের চাপে পড়ে কাটিয়ে দিয়ে যায় যে, জীবিতকালে তো নয়ই মৃত্যুর পরেও সেটার কোন আভাসমাত্রও হয়ত পাওয়া যায় না। অবশ্য আপনি মনে করবেন না যে আমি এমন কিছু বলতে চাইছি স্বর্গীয় মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী ও তাঁর স্ত্রী হেমপ্রভা দেবী সম্পর্কে। এবং এক্ষেত্রে সেটা খুব বড় কথাও আপাতত নয়। আমি যেটা সম্পকে স্থিরনিশ্চিত হতে চাই সেটা হচ্ছে, সত্যি সত্যি হেমপ্রভা দেবীরও এইখানেই মৃত্যু হয়েছিল কিনা এবং তাঁর মৃতদেহ নন্দনকাননের বকুলবৃক্ষের তলেই মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর কলকাতা হতে প্রত্যাবর্তনের পর সাতদিন বাদে তিনিই আবিষ্কার করেছিলেন কিনা।

এসব আপনি কি বলছেন মিঃ রায়? হেমপ্রভার মৃতদেহও সেই বকুল বৃক্ষতলেই কর্তা কলকাতা হতে ফিরে এসে আবিষ্কার করেছিলেন?

হ্যাঁ, তাই। অন্ততঃ কানাইয়ের মার বর্ণিত কাহিনী সেই কথাই বলে।

মিঃ রায়, কানাইয়ের মাকে এ সম্পর্কে ভাল করে জিজ্ঞাসাবাদ করা আমার একান্তই প্রয়োজন।

সে বললাম তো, পরে করলেও আপনার চলবে। তবে আমাকে যদি আপনি বিশ্বাস করেন তবে এইটুকু আপনাকে আমি বলতে পারি, ও সম্পর্কে আমি নিজেও তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলাম এবং আমার ধারণা সে মিথ্যা কিছুই বলেনি। উনিশ বৎসর পূর্বে ঠিক যেমনটি ঘটেছিল এবং যেমনটি সে দেখেছিল ঠিক তেমনটিই সে বলেছে, তার মধ্যে কোন কিছু অত্যুক্তি বা অবোধ্য কিছুই নেই।

কিন্তু তাই যদি হবে কানাইয়ের মার কথা যদি সত্যিই ধরে নেওয়া যায়, তাহলে একটা ব্যাপার আমি আদতেই বুঝে উঠতে পারছি না যে, হেমপ্রভার মৃত্যুর ব্যাপারটা এভাবে গোপন করবার মৃত্যুঞ্জয়ের কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে?

আমার জিজ্ঞাস্যও তাই সেন মশাই। তিনি তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর ব্যাপারটা ঐভাবে আগাগোড়া গোপন করে গেলেন কেন সকলের কাছ থেকে, এমন কি আপনার মত সুহৃদের কাছেও কেন গোপন করে গেলেন? অবশ্য ঘটনা হতে যতটুকু জানা যায়, কানাইয়ের মা একান্তভাবেই দৈবক্রমে ব্যাপারটা দেখে ফেলেছিল বলেই আজ আমরা এতদিন পরে সমস্ত ব্যাপারটা জানতে পেরেছি, নচেৎ সেটা হয়ত কেউ জানতে পারত না। আমি যতদূর শুনেছি এবং এইমাত্র আপনার মুখ থেকেও যতটা জানতে পারলাম, আপনার সঙ্গে স্বর্গীয় মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীর একটা নিকট যোগাযোগ ছিল মনের দিক দিয়ে; তাই জিজ্ঞাসা করছি এমন কোন অতীত কাহিনী বা ঘটনার কথা তাঁর জীবনের আপনি জানেন কি, যার দ্বারা আমরা তাঁর স্ত্রীর রহস্যময় মতুর উপরে কোন অলোকসম্পাত করতে পারি।

কিরীটীর সোজা সরল প্রশ্নে নায়েব বসন্ত সেন কিছুক্ষণের জন্য যেন মাথা নিচু করে স্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন।

কিরীটী তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে নায়েব বসন্ত সেনের দিকে তাকিয়ে বললে, শুনন নায়েবমশাই, এক বিষয়ে আমি অন্ততঃ স্থিরনিশ্চিত যে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরীকে নিঠুরভাবে হত্যা করাই হয়েছে। অবশ্য ঘটনার অনেক পরে আমি অকুস্থানে এসেছি, তাহলেও এ মৃত্যু-রহস্যের মীমাংসা করাটা খুব দুঃসাধ্য ব্যাপার হবে না; কেবল কিছু সময় নেবে। কিন্তু আপনাদের সকলের সাহায্য যদি পাই তাহলে মীমাংসার ব্যাপারটা সহজ হয়ে আসে।

আমি তো আপনাকে প্রথম দিনই বলেছি কিরীটীবাবু, আমার যতটুকু সম্ভব সাহায্য আপনাকে আমি করতে প্রস্তুত। এবং একথাও আপনাকে আমি প্রথম দিনই বলেছি, মৃত্যুঞ্জয়ের মত নির্মল ও সৎ চরিত্রের লোক আমি জীবনে বড় একটা দেখিনি। কোন কলঙ্কই তাঁকে স্পর্শ করেনি। অত্যন্ত দৃঢ় নায়েব বসন্ত সেনের কণ্ঠস্বর।

কিরীটী কিছুক্ষণ নিঃশব্দে চুপ করে বসে রইল এবং মধ্যে মধ্যে হস্তধৃত চুরুটটায় মৃদু মৃদু টান দিয়ে ধুমোদগীরণ করতে লাগল।

ইতিমধ্যে বাইরে বৃষ্টি থেমে গিয়েছে। কেবল বর্ষণ-ক্লান্ত রাত্রির কালো আকাশটার গায়ে বিদ্যুতের চমকানি থেকে থেকে নীল আলোর সঙ্কেত জানিয়ে যাচ্ছে।

কিরীটী আবার নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে কথা বললে, যে রাত্রে মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী মারা যান সেই বিকালে বা সন্ধ্যায় শেষ আপনার সঙ্গে কখন দেখা হয়েছিল সেন মশাই?

রাত দশটায় তিনি আহার করেন, তার আগে পর্যন্ত তাঁর শোবার ঘরেই আমরা দুজনে বসে কথাবার্তা বলছিলাম।

কি ধরনের কথাবাতা সে-রাত্রে আপনাদের মধ্যে হয়েছিল?

সবিতা সম্পর্কেই বিশেষ যা কথাবার্তা হয়েছিল। সত্যজিৎকে তিনি রেঙ্গুন থেকে আসতে লিখেছেন এবং সে এলে উভয়ের যদি উভয়কে পছন্দ হয় তাহলে এই সামনের আষাঢ়েই ওদের বিবাহ দেবেন—এই সবই বলছিলেন।

আর কোন কথা হয়নি আপনাদের মধ্যে, যাতে করে তাঁর অত্যাসন্ন মৃত্যুর ব্যাপারটা সম্পর্কে কোনরুপ ধারণা করা যেতে পারে?

না।

হুঁ। আচ্ছা ইদানীং তাঁর মনের অবস্থা ঠিক কেমন ছিল বলতে পারেন? কোন প্রকার দুশ্চিন্তা বা দুর্ভাবনা

না।

জমিদারীর অবস্থা ও আর্থিক অবস্থা ইদানীং তাঁর ভালই ছিল নিশ্চয়ই?

হ্যাঁ। ব্যাঙ্কে প্রায় লাখ তিনেক টাকা মজুত আছে, কলকাতায় একখানা বাড়ি এবং এখানকার জমিদারী ও কারবারের অবস্থা আশাতীত ভালই বলতে হবে।

তিনি কোন উইল লিখে রেখে গিয়েছেন বলে জানেন কি?

বছর পাঁচেক আগে একটা উইল করেছিলেন। ইদানীং অবশ্য একবার কিছুদিন আগে বলেছিলেন, পূর্বের সেই উইলটার একটু সামান্য অদলবদল করবেন, কিন্তু সেটা আর করা হয়ে ওঠেনি।

সে উইলে কি লেখা আছে জানেন? তাঁর যাবতীয় সম্পত্তিই তাঁর একমাত্র মেয়ে সবিতাই পাবে, কেবল–

কেবল?

হাজার পঞ্চাশ টাকা তিনি আমার নামে দিয়ে গিয়েছেন, প্রয়োজনমত সেটা আমি এবং আমার একান্ত ইচ্ছামত যে কোন কাজে ব্যবহার করতে পারবো।

আর তাঁর কোন নিকট বা দূর-আত্মীয় বা বন্ধুবান্ধবকে কিছুই দিয়ে যাননি?

না। তবে, বসন্তবাবু, একটু ইতস্ততঃ করতে থাকেন। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে কি যেন ভেবে বললেন, ভ্রাতুষ্পুত্র সন্তোষ চৌধুরীর নামে উইলের মধ্যে একটা নির্দেশ আছে—

কিরীটী বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকাল বসন্ত সেনের মুখের দিকে, যিনি আজ সন্ধ্যাবেলা এডেন না কোথা থেকে এলেন, উনিই কি সেই দূরসম্পর্কীয় ভ্রাতুপত্র সন্তোষ চৌধুরী?

বলতে পারি না উনিই সেই মৃত্যুঞ্জয়ের বর্ণিত সন্তোষ চৌধুরী কিনা, যদিও সেই পরিচয় নিয়েই উনি এসে আজ হাজির হয়েছেন

ভদ্রলোককে তাহলে ইতিপূর্বে কখনো আপনি দেখেননি এবং চেনেনও না?

না।

উইলে ওঁর সম্পর্কে কি নির্দেশ আছে বলছিলেন?

ভ্রাতুষ্পত্র সন্তোষ চৌধুরী যদি কোন দিন ফিরে এসে তাঁর পিতৃ-সম্পত্তির দাবী জানান, তাহলে সমস্ত সম্পত্তির ১/৪ অংশ সে পাবে। বাকী ৩/৪ অংশ পাবে কন্যা সবিতা। সবিতা যদি বিবাহ না করে তাহলে অর্ধেক সম্পত্তি ঐ সন্তোষ চৌধুরী পাবেন অথবা সবিতার মৃত্যুর পর যদি তার কোন সন্তানসন্ততি না থাকে তাহলে ঐ সন্তোষ চৌধুরী বা তাঁর বংশধরেরা যদি জীবিত থাকে তাহলে সমস্ত সম্পত্তির ৩/৪ অংশ তারা পাবে এবং বাকী অংশ সবিতার স্বামী পাবে।

সবিতা দেবী তো ঐ সন্তোষ চৌধুরী সম্পর্কে পূর্বে কিছুই জানতেন না, অন্ততঃ গতকালও তাই বলেছেন।

না, সে জানত না। একমাত্র আমিই জানতাম। মৃত্যুঞ্জয় আমাকে উইল করবার সময় একবার মাত্র বলেছিলেন।

ঐ সন্তোষ চৌধুরী কোথায় থাকেন ইত্যাদি বা সে সম্পর্কে কিছুই কি মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরী আপনাকে বলেননি?

হ্যাঁ বলেছিলেন, এডেন না কি কোথায় থাকেন

এডেনের ঠিকানাটা বলেননি?

না।

আজ যে ভদ্রলোক সন্ধ্যাবেলা সন্তোষ চৌধুরীর পরিচয়ে এলেন, একে কি আপনার আসল লোক নয় বলে কোনরূপ সন্দেহ হচ্ছে?

যতক্ষণ না সঠিকভাবে জানতে পারছি ততক্ষণ মেনে নিই বা কেমন করে? যার কেবলমাত্র নামই শুনেছি, অথচ পূর্বে কখনো যাকে চাক্ষুষ দেখিনি তাকে এত সহজে স্বীকার করে নিতে তো পারি না।

উনিই যে আসল সন্তোষ চৌধুরী তার কোন প্রমাণ এখনও দেখেন নি?

না।

আপনি জানতে চাননি?

চেয়েছিলাম, বলেছেন প্রয়োজন হলে সে-সব প্রমাণ নাকি আদালতেই পেশ করবেন। আমাকে কোন প্রমাণ দিতে রাজী নন তিনি।

দেওয়াল-ঘড়িতে ঢং ঢং করে রাত্রি দশটা ঘোষণা করল।

আহারের সময় উপস্থিত—ভৃত্য এসে সংবাদ দিল। কিরীটী উঠে দাঁড়াল।