ভূমি স্বত্বাধিকারী কে?
রাজা ও প্রজার অধিকার । খাস ও নিম্ন প্রজা
ভূমি সম্পৃক্ত ব্যাপারে প্রজার দায় যাহা কিছু, তাহার কতকটা পরিচয় পাওয়া গেল। এই ব্যাপারে প্রজার অধিকার কী ছিল, তাহার আলোচনা করা যাইতে পারে। কিন্তু সে আলোচনা করিতে হইলে ভূমি স্বত্বাধিকারী কে, তাহার আলোচনা অনিবার্য। রাজা বা রাষ্ট্রের মধ্যে মধ্য-স্বত্বাধিকারী ও প্রজার সম্বন্ধ কী, সে বিচারও প্রসঙ্গত আসিয়া পড়িবে।
ভূমির যথার্থ মূল অধিকারী রাজা, না জনসাধারণ, ইহা লইয়া বহু তর্কবিতর্ক হইয়া গিয়াছে; অতীত কালেও হইয়াছে, এই একান্ত আধুনিক কালেও হইতেছে। ভারতবর্ষেও হইয়াছে, ভারতের বাহিরে অন্যান্য দেশেও হইয়াছে। আমাদের প্রাচীন অর্থশাস্ত্র ও স্মৃতিশাস্ত্ৰে এই তর্কের দুই পক্ষেরই বিস্তৃত মতামত পাওয়া খুব কষ্টসাধ্য ব্যাপার নয়। কিন্তু এ তুর্ক আমাদের আলোচনায় নিরর্থক। ইহার সন্দেহহীন সুমীমাংসাও কিছু নাই। কাজেই এই বিতর্কের মধ্যে -ঢুকিয়া পড়ার আমার কোনও প্রয়োজন নাই। আমাদের প্রশ্ন, ভূমির মূল অধিকারী কে, এ সম্বন্ধে নয়; ভূমি স্বত্বাধিকারী কে, সেই প্রশ্নই আমাদের বিচার্য। কারণ, ভূমির মূল অধিকারী কে, এ প্রশ্ন লইয়া যত তৰ্কই থাকুক, তাহা জিজ্ঞাসু মনের অনুসন্ধান মাত্র, ঐতিহাসিক যুগে। ইতিহাসের বাস্তব ক্ষেত্রে তাহার প্রয়োগ না-ও থাকিতে পারে। ভূমি-স্বত্বের অধিকারী হইতেছেন কে, এ প্রশ্নের উত্তর পাইলেই ঐতিহাসিকের প্রয়োজন মিটিয়া যায়। যুক্তির দিক হইতে ভূমির ( মূল অধিকারী কে ছিলেন, তাহা জানিবার কৌতুহল স্বাভাবিক, কিন্তু মূল অধিকারী যিনি বা যাঁহারাই হউন, ইতিহাসের বাস্তব ক্ষেত্রে তিনি বা তাহারাই যে ভূমি স্বত্বাধিকারী হইবেন, এমন না-ও হতে পারে।
ভারতবর্ষে সমাজ বিবর্তনের স্বাভাবিক ঐতিহাসিক নিয়ম অনুমান করা চলে, অতি প্রাচীন কালে লোকসংখ্যা যখন খুব বেশি ছিল না, এবং ভূমি ছিল প্রচুর, তখন ভূমির অধিকারী কে, এ ( প্রশ্ন উঠিবার কোনও অবকাশই ছিল না। লোকের যখন ভূমির প্রয়োজন হইত, তখন সে জঙ্গল কাটিয়া, মাটি ভরাট কইরায় নিজের প্রয়োজনমত ভূমি তৈয়ারি করিয়া লইত। পরের ভূমি লোভ করিবার প্রয়োজন হইত না, ভূমি লইয়া বিবাদেরও কোনও অবকাশ হইত না; হইলেও গ্রামবাসীরাই পরামর্শ করিয়া তাহা মিটাইয়া ফেলিত। তার পর জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে, কৃষিবিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে ভূমির চাহিদা যতই বাড়িতে লাগিল, ভূমি লইয়া বিবাদ-বিসংবাদও ততই বাড়িবার দিকে চলিল। এদিকে রাজা ও রাষ্ট্রযন্ত্রের একটা বিবর্তন ঘটিতে লাগিল; রাজা ও রাষ্ট্রযন্ত্রের সঙ্গে সমাজ যন্ত্রের একটা ঘনিষ্ঠ যোগ প্রতিষ্ঠিত আরম্ভ করিল। সমাজের। রক্ষক ও পালক হইলেনু রাজা; সে রাজা নররূপী দেবতাই হউন্ন বা প্রকৃতিপুঞ্জ দ্বারা নির্বাচিতই তি হউন, তাহাতে কিছু আসিয়া যায় না। শান্তিরক্ষার মূল দায়িত্ব তাঁহার, সমস্ত বিবাদ-বিসংবাদের মূল মীমাংসক তিনি, সকলের শ্রদ্ধা ও বিশ্বাসের পাত্র তিনি, সকল ক্ষমতা, দায়িত্ব ও অধিকারের মূল উৎস তিনি। সমাজ বিবর্তনের যে স্তরে এই নীতি স্বীকৃত হইল, সেই স্তরে.এ কথাও সমাজের অন্তরে স্বীকৃত হইয়া গেল, ভূমির উপর অধিকারের উৎসও রাজা এবং তিনিই ভূমি সম্পর্কিত বাদ-বিসংবাদের শেষ মীমাংসক। কিন্তু রাজা বা রাষ্ট্র তাই বলিয়া ভূমির মূল। অধিকারী রূপে নিজেদের দাবি করিলেন না, কারণ, আদি প্রাচীন কালেও যেমন, এ ক্ষেত্রেও তেমনই, এ প্রশ্ন উঠিবার কোনও অবকাশই ছিল না। রাজা বা রাষ্ট্র ভূমির এবং ভূমি সংলগ্ন প্রজার ধারক রক্ষক ও পালক হিসাবে ধারণ, রক্ষণ ও পালনের পরিবর্তে শুধু ভূমিস্বত্বের অধিকারিত্বের দাবি করিলেন। কিন্তু বিবর্তনের প্রথমাবস্থায় স্বভাবতই এই দাবিও সর্বজনগ্রাহ্য ছিল না, কিংবা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিচারও এ সম্বন্ধে ছিল না। ভূমি তখনও খুব দুর্লভ নয়; তাহা। ছাড়া গ্রামে গ্রামবাসীদের অনেকটা স্বরাজ্য তো ছিলই। যে পরিমাণ ভূমি ব্যক্তিগত ভাবে * লোকেরা ভোগ করিত, তাহার পরিবর্তে গ্রামের সমাজযন্ত্রকে কিছু উপস্বত্ব দিতেই হইত, সেই সমাজযন্ত্র পরিচালনার জন্য; আর যে সমস্ত ভূমি সমস্ত গ্রামবাসীদেরই প্রয়োজন হইত, যেমন পথ, ঘাট, গোবাট, গোচর ইত্যাদি, তাহা সমগ্র গ্রামেরই যৌথ সম্পত্তি বলিয়া সহজেই লোকেরা মনে করিতে পারিত। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও মূল অধিকারিত্বের কোনও প্রশ্ন উঠিবার অবকাশ নাই। বাস্তব ক্ষেত্রে যাহা প্রয়োজিত হইত, তাহাই কালক্রমে প্রয়োগ-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ হইয়া জনসাধারণদ্বারা স্বীকৃত হইত। মূল অধিকারিত্বের দাবি যাহা কিছু হইয়াছে, তাহা পরবতী কালে ঠো রাষ্ট্রযন্ত্রের এবং সমাজযন্ত্রের বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে। আমাদের দেশে মোটামুটিভাবে প্রক মৌর্যসম্রাটদের আমল হইতেই এই বিবর্তন দেখা দিয়াছিল। মৌর্য আমলেই ভারতবর্ষের একটা বশিষ্ট * কেন্দ্রীকৃত কর্মচারিতন্ত্র শাসনব্যবস্থা গড়িয়া উঠে ক্ষমতাসম্পন্ন চক্রবর্তী সম্রাটদের চেষ্টায় ও প্রেরণায়, এবং সমাজযন্ত্রের সঙ্গে এই রাষ্ট্রযন্ত্রের অতি ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ স্বীকৃত হয়। ভারতবর্ষের সর্বত্রই একই সঙ্গে ইহা হইয়াছিল, তাহা অবশ্য বলা চলে না; তবে, এই বিবর্তন মৌর্য আমলের টু পরে উত্তরভারতে সর্বত্রই স্তরে স্তরে ক্রমে ক্রমে দেখা দিতে আরম্ভ করে এবং ক্রমশ সর্বত্র স্বীকৃত হয়। সমাজযন্ত্রের মধ্যে রাষ্ট্রযন্ত্রের পক্ষবিস্তৃতির সঙ্গে সঙ্গে এই চেতনা জনসাধারণকে অধিকার করিতে আরম্ভ করে যে, রাজা এবং রাষ্ট্রই সমাজব্যবস্থার ধারক ও নিয়ামক। এই সমাজ-ব্যবস্থার মধ্যে ভূমি-ব্যবস্থা অন্যতম প্রধান উপকরণ। বিবর্তনের যে স্তরে স্বীকৃত হইল যে, রাজা এবং রাষ্ট্রই ভূমির উপর অধিকারের উৎস এবং তিনিই ভূমি সম্পর্কিত বাদ-বিসংবাদের শেষ মীমাংসক, তাহার পর হইতেই ক্রমশ ধীরে ধীরে এই চেতনা গড়িয়া উঠতে আরম্ভ করিল। যে, রাজা ও রাষ্ট্র শুধু ভূমি ব্যবস্থার নিয়ামক নহেন, দেশের ভূসম্পত্তির মালিকও। ইহার প্তে অন্যতম কারণ বোধ হয়, সেচন ব্যবস্থায় রাজার বা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। আমাদের দেশ নদীমাতৃক হইলেও কৃষিকর্মবহুল পরিমাণে বারিনির্ভর। এই যে লিপিগুলিতে প্রচুর খাটা, খাড়িকা, খাল ইত্যাদির উল্লেখ পাওয়া যায়, তাহার অধিকাংশ ভূমির উর্বরতা বিধানের জন্য রাষ্ট্রকর্তৃক খনিত, এ অনুমান বোধ হয় করা চলে। তাহা ছাড়া এই প্লাবনের দেশে বাঁধ, আলি ইত্যাদির বিস্তৃত উল্লেখও রাষ্ট্র সহায়তার দিকেই ইঙ্গিত করে বলিয়া মনে হয়। রাজারা যে এই সেচন ব্যবস্থার দায়িত্ব পালন করিতেন, তাহার দু-একটি প্রমাণও আছে; যেমন, বাণগড় লিপিতে রাজ্যপাল সম্বন্ধে বলা হইয়াছে, তিনি অনেক বড় বড় দীঘিকা খনন করাইয়াছিলেন; রামচরিতে রামপাল সম্বন্ধে বলা হইয়াছে, তিনি নানাপ্রকার জনহিতকর পূর্তকার্য করিয়াছিলেন, খুব বড় বড় পুষ্করিণী খনন করাইয়া দুই ধারে তালগাছ লাগাইয়া পাহাড়ের মতন উচু করিয়া বাধাইয়া দিয়াছিলেন, দেখিলে মনে হইত, বুঝিবা সমুদ্র।
“স বিশালশৈলুমালাতালবন্ধসম্বুধিং সাক্ষাৎ।
অপি পূর্তং পুষ্করিণীভুতং রচাম্বভূব ভূপালঃ ৷।“ (৩।৪২)
পালরাজাদের লিপিমালায় রাজা বা রাষ্ট্র কর্তৃক খনিত বহু দিঘির উল্লেখ দেখিতে পাওয়া যায়। এই ধরনের সুদীর্ঘ বিশালকায় হ্রদোপম পুকুরের চিহ্ন বাঁকুড়া, বীরভূম অঞ্চলে, ত্রিপুরা জেলায়, উত্তরবঙ্গের প্রায় প্রত্যেক জেলায় এখনও প্রচুর দেখিতে পাওয়া যায়। এইসব পুকুরের জল যে চাষ-আবাদের কাজেই ব্যবহৃত হইত, এবং রাজকীয় অথবা রাষ্ট্রের সাহায্যেই যে এগুলির খনিত হইত, সে স্মৃতি উত্তর-রাঢ়ে এবং বরেন্দ্রভূমিতে এখনও বিলুপ্ত হইয়া যায় না। , গঙ্গা-যমুনা-সরস্বতী সংগমে কোথাও একটি সুবৃহৎ বাঁধ নির্মাণ করাইয়াছিলেন; বঁধটি তাঁহারই নামের সঙ্গে জড়িত ছিল, এই ইঙ্গিত দিতেও কবি বিস্মৃত হন নাই। যাহাই হউক, মৌর্যযুগের ও পরবর্তী কালের অর্থশাস্ত্র ও স্মৃতিশাস্ত্ররচয়িতারাও রাজা ও রাষ্ট্রই যে ভূসম্পত্তির মালিক তাহা প্রতিষ্ঠিত করিতে প্রয়াস পাইতে লাগিলেন। কিন্তু এক সময় সমাজই যে ভূমি ব্যবস্থার নিয়ামক ছিল, সে স্মৃতিও একেবারে বিলুপ্ত হইয়া গেল না; থাকিয়া থাকিয়া সে স্মৃতি স্মৃতিশাস্ত্রের পাতায়, টীকাকারের ব্যাখ্যায়, প্রচলিত ব্যবহারের মধ্যে উকিঝুকি মারিত্বে লাগিল। সাধারণভাবে! এই কথা কয়টি মনের পটভূমিতে রাখিয়া, আমাদের প্রাচীন বাঙলার লিপিগুলি বিশ্লেষণ করিয়া, তাহাদের সাক্ষ্যপ্রমাণ কী, দেখা যাইতে পারে।
গুপ্ত আমলের যে কয়টি লিপি বাঙলাদেশে পাওয়া গিয়াছে, তাহার প্রত্যেকটিতেই দেখিতেছি, ভূমি বিক্রেতা হইতেছেন রাজা বা রাষ্ট্র, এবং বিক্ৰীত ভূমি ধর্মাচরণোদ্দেশ্যে দত্ত হইতেছে বলিয়া রাজা দানপুণ্যের এক-ষষ্ঠ ভাগের অধিকারীও হইতেছেন। বস্তুত প্রত্যেকটি লিপিতেই ভূমি বিক্রয়ের আবেদন জানানো হইতেছে রাজা বা রাষ্ট্রযন্ত্রকে; দু-এক ক্ষেত্রে রাজা কর্তৃক বিক্ৰীত ভূমি দানও করিতেছেন রাজা স্বয়ং, ক্রেতার পক্ষ হইতে। তাহা ছাড়া রাজা অনুরুদ্ধ হইয়া অথবা আত্মপ্রেরণায় নিজেও ভূমি দান করিতেন। এই লিপিগুলি ভালো করিয়া বিশ্লেষণ করিলে স্বতই মনে হয়, রাজা বা রাষ্ট্র শুধু ভূমি স্বত্বেরই অধিকারী নহেন, ভূমির মূল অধিকারীও। এই স্বত্বাধিকারতত্ত্ব বাঙলাদেশে বোধহয় গুপ্ত আমলের পূর্বেই নির্ধারিত ও স্বীকৃত হইয়া গিয়াছিল, এবং আমরা যে যুগের লিপিগুলির কথা বলিতেছি, সে যুগে এ সম্বন্ধে কোনও স্ট্রি প্রশ্ন আর ছিল না। তবে, তিনি অধিকারী ছিলেন বলিয়াই ভূমি দান-বিক্রয়ে যথেচ্ছাচরণ করিতে পারিতেন না, দেখিতে হইত, প্রস্তাবিত ভূমি দত্ত বা বিক্ৰীত হইলে গ্রামবাসীদের কৃষি ও অন্যান্য কর্মের কোনও অসুবিধা হইবে কি না, অন্য কাহারও ভূমিস্বত্ব আহত হইবে কি না। শুধু রাজা অথবা রাষ্ট্রই যে দেখিতেন, তাহা নয়, গ্রামের প্রধান প্রধান ব্যক্তিরা, কখনও কখনও সাধারণ ব্যক্তিরাও তাহা দেখিতেন। লিপিগুলিতে যে বার বার ভূমিদানি-বিক্রয় স্থানীয় মহত্তর, কুটুম্ব, প্রতিবাসী এবং প্রাকৃতজনকে বিজ্ঞাপিত করা হইতেছে, তাহা প্রধানত এই উদ্দেশ্যেই বহু ক্ষেত্রে ইহারাই ভূমি অন্য ভূমি হইতে পৃথক করিয়া সীমা নির্দেশ করিয়া দিতেন। প্রশ্ন উঠিতে পারে, যে সমস্ত সাক্ষ্যপ্রমাণ লিপিগুলিতে পাইতেছি, সে সমস্ত ভূমিই রাজার অথবা রাষ্ট্রের নিজস্ব ভূ-সম্পত্তি অর্থাৎ খাসমহল, এবং সে খাসমহল দান-বিক্রয়ের অধিকার রাজা বা রাষ্ট্রেরই হইবে, তাহাতে আর আশ্চর্য কি? এ প্রশ্নের সুযোগ হয়তো আছে, কিন্তু যখন দেখা যায়, সর্বত্রই সকল লিপিতেই রাজা হইতেছেন বিক্রেতা বা দাতা, তখন এই অনুমোনই মনকে অধিকার করে। যে, রাজ্যের সকল ভূমিরই স্বত্বাধিকারী এবং মূল মালিক, দুই-ই ছিলেন রাজা বা রাষ্ট্র। তাহা ছাড়া, লিপিগুলিতে এমন একটি দৃষ্টান্তও পাইতেছি না; যেখানে রাজা বা রাষ্ট্র মূল অধিকারিত্ব ছাড়িয়া দিতেছেন; যাহা পাইতেছি, তাহা তাহার স্বত্বাধিকার। ভূমি যখন শুধু বিক্রয় করিতেছেন, তখন স্বত্বাধিকারের দাবি বজায় রাখিতেছেন কর গ্রহণের ভিতর দিয়া; আর যখন শুধু বিক্রয় নয়, সঙ্গে সঙ্গে ভূমি নিষ্কর করিয়া দান করিয়া দিতেছেন, তখন সেখানে স্বত্বাধিকারিত্বের দাবিও ছাড়িয়া দিতেছেন, কিন্তু সেখানেও তাহার মূল আধিকারিত্ব চলিয়া যাইতেছে না। আমার এই মন্তব্যগুলির সুস্পষ্ট সবিশেষ প্রমাণ অষ্টমশতকপূর্ব বাঙলার অন্তত দুই-তিনটি লিপিতে পাওয়া যাইবে। ফরিদপুর জেলায় প্রাপ্ত গোপচন্দ্রের পট্টোলীতে খবর পাওয়া যায় যে, বৎসপাল স্বামী নামে এক ব্ৰাহ্মণ এক কুল্যবাপ ভূমি ক্রয় করিয়াছিলেন। লিপিটির অনেক স্থান অবলুপ্ত হইয়া যাওয়ায় পাঠ নিঃসন্দেহ নয়; কিন্তু যাহা আছে, তাহাতে নিঃসংশয়ে বুঝা যায়, যে এক কুল্যবাপ ভূমি বৎসপাল স্বামী কিনিয়াছিলেন তাহা মহাকোট্টিক.নামীয় কোনও ব্যক্তির বা একাধিক ব্যক্তির ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল, কিন্তু এই ব্যক্তিগত সম্পত্তি ক্ৰয়ের এবং দানের আবেদনও জানাইতে হইয়াছিল স্থানীয় রাষ্ট্র-প্রতিনিধি এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের নায়কদের। রাজা বা রাষ্ট্র যে ভূমির মূল অধিকারী বলিয়া স্বীকৃত হইতেন, এ সম্বন্ধে তাহা হইলে আর কোনও সন্দেহ রহিল না। সঙ্গে সঙ্গে আমরা ইহাও জানিলাম যে ভূসম্পত্তির? ব্যক্তিগত অধিকারও ছিল; কিন্তু সে অধিকার রাষ্ট্রের সুনির্দিষ্ট নিয়ম দ্বারা শাসিত ছিল। ব্যক্তিগত সম্পত্তি ছিল বলিয়াই কোনও ব্যক্তি যে কোনও শর্তে যে-কোেনও ক্রেতার কাছে ভূমি বিক্রয় করিতে পারিতেন না, কিংবা দানও করিতে পারিতেন না। এই বিক্রয় অথবা দানকর্মের প্রয়োজন হইলে প্রস্তাবিত ক্রেতা বা দানগ্রহীতা রাষ্ট্রের কাছে অর্থাৎ রাষ্ট্রের স্থানীয় অধিকরণ ও প্রধান প্রধান লোকদের কাছে আবেদন করিতেন, এবং তাহারাই বিক্রয় ও দানের ব্যবস্থা করিতেন। বস্তুত, কোনও গ্রামে কোনও ক্রেতা বা দানগ্রহীতা ব্যক্তির নবাগমন গ্রামবাসীদের অগোচরে হইতে পারে না; এ ব্যাপারে রাষ্ট্র অপেক্ষা গ্রামের সমষ্টিগত স্বার্থই অধিকতর বিবেচ্য। এই কারণেই সর্বত্র এই দান-বিক্রয়ের ব্যাপার গ্রামবাসীদের গোচরে ও সাক্ষাতে হওয়াই প্রয়োজন বলিয়া বিবেচিত হইয়াছে। দেবখড়েগব আম্রফপুর পট্টোলীতেও আমার পূর্বোক্ত মন্তব্যগুলির প্রমাণ পাওয়া যাইবে। রাজা দেবখড়গ বৌদ্ধ আচার্য সঙ্ঘমিত্রের বিহারে প্রথম দফায় ৯ পাটক ১০ দ্ৰোণ ভূমি দান করিয়াছিলেন এবং দ্বিতীয় দফায় দান করিয়াছিলেন ৬ পাটক ১০ দ্রোণ। এই ভূমির অধিকাংশই ছিল ব্যক্তিগত অধিকারে, এবং দানের পূর্বাহু পর্যন্ত বিভিন্ন লোকেরা নিজেদের সম্পত্তি ভোগ করিতেছিলেন।
১) ২ পাটক … ভোগ করিতেছিলেন রাজমহিষী শ্ৰীপ্ৰভাবতী।
২) ১/২ পাটক … ভোগ করিতেছিলেন শুভংসুকা নামে এক মহিলা।
৩) ১ পাটক … মিত্রাবলি নামক জনৈক ব্যক্তির ভূমি, কিন্তু ভোগ করিতেছিলেন সামন্ত বর্ণটিয়োক নামক এক ব্যক্তি।
8) ১ পাটক … ভোগ করিতেছিলেন শ্ৰীনেত্ৰভট।
৫) ১ পাটক … ভোগ করিতেছিলেন শর্বাস্তর নামক এক ব্যক্তি, কিন্তু চাষ করিতেছিলেন মহত্তর, শিখর প্রভৃতি কৰ্ষকেরা (শ্ৰীশৰ্বন্তরেণ ভুজ্যমানক মহত্তরশিখরাদিভিঃ কৃষ্যমান-[কঃ])!
৬) ১ পাটক … ভোগ করিতেছিলেন বন্দ্য জ্ঞানমতি।
৭) ১ পাটক … ভোগ করিতেছিলেন দ্রোণমথিকা নামক জনৈক ব্যক্তির ভূমি।
8) ১/২ পাটক … ভোগ করিতেছিলেন শত্রুক নামক ব্যক্তি। (ইঁহার এক পাটক ভূমির সবটুকু রাজা গ্রহণ করেন নাই; যে অর্ধপাটকে দুইটি সুপারিবাগান ছিল, সেইটুকু শুধু লইয়া দান করিয়াছিলেন)।
৯) ২০ দ্রোণবাপ অর্থাৎ ১/২ পাটক … আগে ছিল উপাসক নামক জনৈক ব্যক্তির, অধুনা ভোগ করিতেছিলেন স্বস্তিয়োক নামীয় জনৈক গৃহস্থ (অর্ধপাটক উপাসকেন ভুক্তকাধুনা স্বস্তিয়োকেন ভূজ্যমানক)।
১০) ২৭ দ্রোণবাপ … ভোগ করিতেছিলেন সুলব্ধ এবং অন্যান্য ব্যক্তিরা।
১১) ১৩ দ্রোণবাপ … চাষ করিতেছিলেন রাজদাস এবং দুগ্গট নামক দুই ব্যক্তি।
১২) ১ পাটক … [এক সময়ে] বৃহৎপরমেশ্বর নামক জনৈক ব্যক্তি দান – করিয়াছিলেন, কিন্তু কাহাকে এবং কী উদ্দেশ্যে দান করিয়াছিলেন, তাহার উল্লেখ নাই।
১৩) ১ পাটক … [এক সময়ে] শ্ৰীউদীর্ণখড়্গ দান করিয়াছিলেন এবং অধুনা ভোগ করিতেছিলেন শক্ৰক নামক জনৈক ব্যক্তি। এই শত্ৰুক এবং পূর্বোক্ত ৮ নম্বরের শক্ৰক যে একই ব্যক্তি, এই অনুমান সহজেই করা যাইতে পারে।
এই সুদীর্ঘ ও সুবিস্তৃত সাক্ষ্যপ্রমাণ হইতে ভূমি ব্যবস্থা সম্বন্ধে অনেকগুলি প্রয়োজনীয় তথ্য জানা যাইতেছে। একটি একটি করিয়া তাহা উল্লেখ করা যাইতে পারে। প্রথম, রাজা যে কোনও ব্যক্তিগত সম্পত্তি তাহার ইচ্ছামত এবং প্রয়োজনমত কড়িয়া লইতে পারিতেন। ২নং পট্টোলীটিতে পরিষ্কার বলা হইয়াছে, ৬ পাটক ১০ দ্ৰোণ ভূমি ব্যক্তিগত অধিকার হইতে কাড়িয়া লইয়া (যথাভুঞ্জনাদাপনীয়) সঙ্ঘমিত্রের বিহারে দেওয়া হইতেছে। ইহার পরিবর্তে, অধিকারী ব্যক্তিদের যথােচিত মূল্য বা ক্ষতিপূরণ কিছু দেওয়া হইয়াছিল কি না, তাহার উল্লেখ লিপিতে নাই; হইলে তাহার উল্লেখ থাকাটাই বোধ হয় স্বাভাবিক ছিল। রাজা বা রাষ্ট্র যদি ভূমির মূল অধিকারী না হইতেন তাহা হইলে এই জাতীয় অধিকারের প্রয়োগ তিনি কিছুতেই করিতে পারিতেন না। দ্বিতীয়ত, মহিলারাও ব্যক্তিগত সম্পত্তি ভোগ করিতে পারিতেন (১ ও ২)। তৃতীয়ত, মধ্যস্বত্বাধিকারীর নীচে নিম্নাধিকারী প্রজার একটি স্তর ছিল (৩ ও ৫)। ইহাদের অধিকারের স্বরূপ কী ছিল বলা কঠিন। ৩ নম্বরের মিত্রাবলি ভূমিস্বত্বাধিকারী ছিলেন বুঝা যাইতেছে, কিন্তু ভূমির উপস্বত্ব বোধ হয় ভোগ করিতেছিলেন বর্ণটিয়োক। নিম্নপ্রজারূপে এ সম্পর্কে তাহার কী কী দায় ও মিত্রাবলিঙ্কে কী কী দেয় ছিল, তাহা অনুমান হয়তো করা যাইতে পারে, কিন্তু নিশ্চিতভাবে বলিবার কোনও উপায় নাই। ৫ নম্বরের শর্বােস্তর ভূমিস্বত্বাধিকারী ছিলেন, ইহা তো পরিষ্কার, কিন্তু মহত্তর, শিখর প্রভৃতি কৃষক, যাহারা শর্বাস্তরের এক পাটক ভূমি চাষ করিতেন, তাহাদের দায় ও অধিকার কী ছিল? ইহারা কি বর্তমান কালের ভাগচাষীদের মতন ছিলেন, না কোনও প্রকার করের বিনিময়ে চাষবাস করিতেন? তবে, এইটুকু বুঝা যাইতেছে, মহত্তর, শিখর প্রভৃতি কৃষকদের সেই এক পাটক ভূমির উপর কোনও অধিকার ছিল না। চতুর্থত, ব্যক্তিগত অধিকারের ভূমি হস্তান্তরিত হইত, দানেই হউক আর বিক্ৰয়েই হউক (৯, ১২ ও ১৩)। এই হস্তান্তরের জন্য রাষ্ট্রের অনুমোদন প্রয়োজন হইত কি না, বলিবার উপায় এ ক্ষেত্রে নাই; তবে পূর্বোক্ত গোপচন্দ্রের পট্টোলীর সাক্ষ্য যদি এ ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হয়, তাহা হইলে রাষ্ট্রানুমোদন ছাড়া এই ধরনের হস্তান্তর সম্ভব ছিল না। পঞ্চমত, একাধিক (দুই বা ততোধিক) ব্যক্তি ব্যক্তিগতভাবে একই ভূখণ্ডের অধিকারী হইতে পারিতেন (১০ ও ১১)
অষ্টম শতক পরবর্তী পাল ও সেন আমলের লিপিগুলি এইবার বিশ্লেষণ করা যাইতে পারে। আগেই বলিয়াছি, পাল আমলের প্রায় সব লিপিই সমগ্র গ্রামদানের পট্টোলী সেন-আমলেরও কয়েকটি পট্টোলী তাঁহাই। এই গ্রামগুলির সমস্তই রাষ্ট্রের ‘খাসমহল ছিল এ অনুমান খুব স্বাভাবিক নয়; বরং ভূমির মূল অধিকারী হিসাবে রাষ্ট্র, রাজ্যের যে কোনও ভূমি, তাহা গ্রাম বা যে-কোনও ভূমিখণ্ড বা জনপদখণ্ডই হোক, দান-বিক্রয় করিতে পারিতেন, এই মন্তব্যই যুক্তিসঙ্গত, এবং দান যখন করিতেছেন, তখন সেই গ্রামবাসী ব্যক্তিদের ব্যক্তিগত ভূসম্পত্তি যাহা আছে তাহা সমেতই দান করিতেছেন; ইহার পর রাজা বা রাষ্ট্রকে যাহা কিছু দেয়, ব্যক্তিগত ভূসম্পত্তির অধিকারীরা তাহা দানগ্রহীতাকে দিবেন, রাষ্ট্রকে আর নয়। কিন্তু এই যে রাজা ইচ্ছা! ও প্রয়োজনমত ব্যক্তিগত ভূসম্পত্তিও দান করিয়া দিতেছেন, ইহাও রাষ্ট্রের মূল অধিকারিত্বের দিকেই ইঙ্গিত করে। ভূমির অধিকার ইত্যাদি সম্বন্ধে এ পর্যন্ত যাহা বলা হইয়াছে, সেন আমলের লিপিগুলিও তাঁহাই সমর্থন করে। বিশ্বরূপসেনের সাহিত্য-পরিষৎ-লিপিতে একসঙ্গে এইজাতীয় অনেক তথ্য পাওয়া যায়। সেই হেতু এই লিপিটিই একটু বিস্তৃতভাবে বিশ্লেষণ করা যাইতে পারে। রাজা বিশ্বরূপসেন জনৈক আবল্লিক পণ্ডিত হলায়ুধ শৰ্মাকে ১১টি ভূখণ্ডে সর্বসুদ্ধ ৩৩৬৪ উন্মান ভূমি দান করিয়াছিলেন; এই ভূখণ্ড কয়টি হলায়ুধ শৰ্মা কর্তৃক নানা উপায়ে সংগৃহীত হইয়াছিল।
১. দুইটি ভূখণ্ডে ৬৭ ৩/৭ উন্মান ভূমি উত্তরায়ণ সংক্রান্তি উপলক্ষে রাজা?] হলায়ুধকে দান করিয়াছিলেন।
২. ১৬৫ উন্মান ভূমি পূর্বে কোনও সময়ে হলায়ুধ কিনিয়াছিলেন। কাহার নিকট হইতে কিনিয়াছিলেন বলা হয় নাই, তবে ব্যক্তিগত ভূম্যধিকারীর নিকট হইতেই কিনিয়াছিলেন বলিয়া অনুমান করা যায়। পরে এই ১৬৫ উন্মান, এবং অন্য দুইটি ভূখণ্ডে ৫০ উন্মান। হল্যায়ুধ শৰ্মা চন্দ্ৰগ্ৰহণ উপলক্ষে রাজমাতার নিকট হইতে দান গ্ৰহণ করিয়াছিলেন।
৩. দুইটি ভূখণ্ডে ৩৫ উন্মান পূর্বে কোনও সময়ে হলায়ুধ কিনিয়াছিলেন; পরে কুমার সূর্যসেন এই ভূমিখণ্ড দুইটি জন্মদিন উপলক্ষে হলায়ুধকে দান করিয়াছিলেন।
৪. দুইটি ভূখণ্ডে ৭ উন্মান পূর্বে কোনও সময়ে হলায়ুধ কিনিয়াছিলেন; পরে সান্ধিবিগ্রহিক নাঞীসিংহ সেই ভূখণ্ড দুইটি হলায়ুধকে দান করিয়াছিলেন।
৫. ১২ ৩/৪ উন্মান হলায়ুধ শৰ্মা রাজপণ্ডিত মহেশ্বরের নিকট হইতে কিনিয়াছিলেন।
৬. ২৪ উন্মান কুমার পুরুষোত্তম সেন উত্থানদ্বাদশী তিথি উপলক্ষে হলায়ুধকে দান করিয়াছিলেন।
পূর্বোক্ত বিশ্লেষণ হইতে কয়েকটি প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া যাইতেছে। প্রথমত, ক্ৰীত ভূমি ও পরে কাহারও নিকট হইতে দানস্বরূপ গ্রহণ করা যাইত (২, ৩, ৪)। কী উপায়ে তাহা করা হইত লিপিতে বলা হয় নাই, তবে অনুমান হয়, হলায়ুধ কোনও সময়ে মূল্য দিয়া ভূমি কিনিয়াছিলেন, পরে দাতা ক্ৰীত ভূমির মূল্য হলায়ুধকে অর্পণ করিয়াছিলেন, এবং হলায়ুধ ক্ৰীত ভূমি দানস্বরূপ স্বীকার করিয়া লইয়াছিলেন। দ্বিতীয়ত, এইসব ভূমি ব্যক্তিগত অধিকারেই ছিল, এবং ব্যক্তিগত অধিকারের বলেই বিক্ৰীতও হইয়াছিল (২, ৩, ৪, ৫)!! তৃতীয়ত, ভূমির ব্যক্তিগত অধিকারীরা ভূমি দানও করিতে পারিতেন এবং করিতেনও (২, ৩, ৪, ৫, ৬)। কিন্তু এই দান রাজা যে অর্থে ভূমি দান করেন, সেই অর্থে নয়; নিষ্কর করিয়া দিবার ক্ষমতা এই ব্যক্তিগত অধিকারীদের নাই, ইহারা শুধু ভূমির মধ্যস্বত্বাধিকার অর্থাৎ তাহাদের ব্যক্তিগত অধিকার দান করেন, রাজার স্বত্বাধিকার অর্থাৎ করগ্রহণের অধিকার দান করিবার ক্ষমতা ইহাদের ছিল না। সেই জন্যই হল্যায়ুধ যখন সমগ্র ৩৩৬ই উন্মান ভূমিই নিষ্কর ভাবে, কোনও দায় ঘাড়ে না লইয়া ভোগ করিতে চাহিলেন, তখন রাজার শরণাপন্ন হইলেন এবং রাজাও তাঁহাকে নিষ্কর করিয়া দিয়া সমস্ত ভূমি দান করিলেন, অর্থাৎ, হলায়ুধ শুধু তখনই রাজার ভূমিস্বত্বাধিকার লাভ করিলেন। এখানেও রাজা যে তাহার মূল অধিকার ছাড়িয়া দিলেন, এ কথা বলা যায় না। লক্ষ্মণসেনের শক্তিপুর শাসনে দেখিতেছি, সূর্যগ্ৰহণ উপলক্ষে স্নান করিয়া রাজা ব্রাহ্মণ কুবেরকে ৮৯, দ্ৰোণ ভূমি দান করিয়াছিলেন; এই সমুদয় জমির আয় ছিল ৫০০ কপর্দক পুরাণ। এই দান করা হইয়াছিল ক্ষেত্রপাটকের বিনিময়ে; কারণ শেষোক্ত গ্রামটি পিতা বল্লালসেনকর্তৃক জনৈক ব্ৰাহ্মণ হরিদাসকে দান করা হইয়াছিল। কিন্তু ভুল ধরা পড়িলে রাজা তাহা কোষস্থ অর্থাৎ বাজেয়াপ্ত করিয়াছিলেন, এবং তৎপরিবর্তে কুবেরকে উক্ত গ্রাম দান করিয়াছিলেন। লক্ষণীয় এই যে, ভুল ধরা পড়িলে রাজা দত্তভূমি রাজকোষে বাজেয়াপ্ত করিতেন। এক্ষেত্রেও ভূমির মূল অধিকার যে রাজার তাহাই যেন ইঙ্গিত।
পাল আমলের শাসনগুলিতে দেখা যাইতেছে, প্রস্তাবিত ভূমিদানের সময় রাজা স্থানীয় প্রধান প্রধান লোকদের কুটুম্ব, প্রতিবাসী, এক কথায় প্রকৃতিপুঞ্জকে লক্ষ্য করিয়া বলিতেছেন, “মতমস্তু ভবাতম্”। [আমি এই ভূমি দান করিতেছি], আপনাদের সকলের অনুমোদন হউক। কেহ কেই মনে করেন, গ্রামগোষ্ঠী ভূমির মালিক ছিলেন বলিয়া রাজাকে এই ধরনের অনুমতি লইতে হইত। এ অনুমান কিছুতেই সত্য হইতে পারে না। গ্রামগোষ্ঠী ভূমির মালিক হইলে রাজা সেই ভূমি ক্রয় না করিয়া দান কী ভাবে করিতে পারেন? তবে, এ যুক্তি হয়তো কতকটা সার্থক যে, এই ‘মতামস্তু ভবতাম্” প্রাচীন গোষ্ঠী অধিকারের সুদূর স্মৃতি বহন করিতেছে; কিন্তু তাহাও সম্পূর্ণ সার্থক বলিয়া মনে হয় না, যখন দেখা যায়, পরবর্তী কালের শাসনগুলিতে একই প্রসঙ্গে বলা হইয়াছে, “বিদিতমস্তু ভবতাম্”, ‘আপনারা বিজ্ঞাপিত হউন’, অর্থাৎ ভূমি-দানের ব্যাপারটি গ্রামবাসীদের বিজ্ঞাপিত করা হইতেছে মাত্র। এই বিজ্ঞাপন করা কেন প্রয়োজন হইত, তাহা তো আগেই সবিস্তারে উল্লেখ করা হইয়াছে। আসল কথা, “মতমস্তু ভবতাম” এবং “বিদিতমস্তু ভবতাম” এই দুইয়ের মধ্যে বিশেষ কিছু পার্থক্য ছিল বলিয়া মনে করিবার কোনো কারণ নাই। : সেন আমলে বিজ্ঞাপিত করিবার প্রয়োজনে যে প্রসঙ্গে বলা হইয়াছে “বিদিতমস্তু”, পাল আমলে সেই প্রসঙ্গেই সৌজন্য প্রকাশ করিয়া বলা হইত “মতমস্তু”।