শ্রেণী ও রাষ্ট্র
বর্ণ ও শ্রেণীর পারস্পরিক সম্বন্ধের কথা বর্ণ-বিন্যাস অধ্যায়ে এবং বর্তমান অধ্যায়ে কতকটা সবিস্তারেই বলা হইয়াছে। রাষ্ট্র ও শ্রেণীর পরস্পর সম্বন্ধের ইঙ্গিতও এই অধ্যায়ের ইতস্তত ইতিপূর্বেই প্রসঙ্গক্রমে দেওয়া হইয়াছে। এইখানে সে সব ইঙ্গিত সংক্ষেপে একটু ফুটাইয়া তোলা যাইতে পারে। পঞ্চম শতকের আগে এ-সম্বন্ধে নিশ্চয় করিয়া কিছু বলিবার উপায় নাই। পঞ্চম ও ষষ্ঠ শতকে দেখা যাইতেছে একটি শ্রেণী বরাবর রাষ্ট্রের আনুকূল্য লাভ করিতেছে; রাষ্ট্রযন্ত্রে এই শ্রেণীর প্রভাব অক্ষুঃ— ইহারা শিল্পী, শ্রেষ্ঠী, সার্থিবাহ, ব্যাপারী ইত্যাদি। দেখিয়াছি, ইহারাই ছিলেন সেই যুগের প্রধান ধনোৎপাদক শ্রেণী; কাজেই রাষ্ট্রের পক্ষে ইহাদের আনুকূল্য খুবই স্বাভাবিক। আর একটি শ্রেণীও রাষ্ট্রের আনুকূল্য লাভ করিতে আরম্ভ করিয়াছিল; ইঁহারা জ্ঞান-ধৰ্মজীবী শ্রেণীর জৈন-বৌদ্ধ যতি সম্প্রদায় ও ব্রাহ্মণ। কিন্তু এই শ্রেণী এখনও সম্পূর্ণ গড়িয়া উঠিয়া রাষ্ট্রের সঙ্গে পরস্পর স্বার্থের সম্বন্ধে আবদ্ধ হয় নাই; তাহার সূচনা দেখা যাইতেছে মাত্র।
ষষ্ঠ-সপ্তম শতকে ভূমি-নির্ভর সামন্তপ্রথার স্বীকৃতি ও প্রতিষ্ঠার এবং ব্ৰাহ্মণ্যধর্ম, সংস্কার ও সংস্কৃতির প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে দুইটি শ্রেণীর সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ক অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হইল, একটি বহুস্তরবদ্ধ ভূম্যধিকারী শ্রেণী, এবং আর একটি জ্ঞান-ধৰ্মজীবী শ্রেণীর সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায়, অর্থাৎ ব্রাহ্মণ। সামন্তচক্র ছিল রাষ্ট্রের শক্তি ও নির্ভর; এবং এই সামন্তচক্রকে আশ্রয় করিয়া ভূম্যধিকারী শ্রেণীর অস্তিত্ব। কাজেই এই শ্রেণীর সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্বন্ধ ঘনিষ্ঠ হওয়া কিছু বিচিত্র নয়। জ্ঞান ধৰ্মজীবী ব্ৰাহ্মণদের জীবিকানির্ভর ছিল ধর্মদেয়, ব্ৰহ্মদেয় ভূমি ও দক্ষিণা-পুরস্কারলব্ধ অর্থ। এই ভূমি ও অর্থপ্রাপ্তি নির্ভর করিত একদিকে রাষ্ট্র ও অন্যদিকে অভিজাত ভূম্যধিকারী শ্রেণীর কৃপার উপর। কাজেই ব্ৰাহ্মণেরা এই দুইয়েরই পোষক ও সমর্থক হইবেন, ইহাই তো স্বাভাবিক। তবে এই পর্বের রাষ্ট্রযন্ত্রে ব্ৰাহ্মণদের প্রভুত্ব বা আধিপত্য বড়ো একটা এখনও দেখা যাইতেছে না। ব্ৰাহ্মণের সংখ্যায়। তখনও স্বল্প, দেশে নবাগত অথবা নববর্ধিত; ব্ৰহ্মদেয়, ধর্মদেয় ভূমি লইয়া পূজা, যাজযজ্ঞ, অধ্যয়ন, অধ্যাপনাতেই প্রধানত তাহারা নিযুক্ত; কাজেই প্রভুত্ব বিস্তারের সময় তখনও আসে নাই। পরে সংখ্যা ও ক্ষমতাবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রে ও সমাজে তাঁহাদের আধিপত্য বিস্তৃত হয়, এবং মোটামুটি সপ্তম-অষ্টম শতক হইতেই পীের ও রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে তাহাদের প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়; সঙ্গে সঙ্গে জনসাধারণের ক্ষমতা এবং অধিকারও হ্রাস পাইতে থাকে।
অষ্টম শতক হইতে শিল্প-ব্যাবসা-বাণিজ্যের অবনতির সঙ্গে সঙ্গে ভূম্যধিকারী শ্রেণীর সঙ্গে রাষ্ট্রের পারস্পরিক স্বার্থবিন্ধন আরও ঘনিষ্ঠ হয়; আদিপর্বের শেষ পর্যন্ত এই ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ অটুট ও অক্ষুন্ন ছিল। এই ব্যাপারে পাল-চন্দ্র রাষ্ট্রের সঙ্গে কম্বোজ-বর্মণ-সেন রাষ্ট্রের কোনও পার্থক্য ছিল না! একান্তভাবে সামন্ততন্ত্রনির্ভর রাষ্ট্রে এইরূপ হওয়াই স্বাভাবিক এবং সমাজ-বিবর্তনের ইহাই নিয়ম ৷ পাল ও চন্দ্ৰ বংশ বৌদ্ধরাজবংশ হওয়া সত্ত্বেও, আগেই দেখিয়াছি, এই দুই রাষ্ট্রেই ব্রাহ্মণ-শ্রেণীর প্রাধান্য ছিল; কেন, কী কারণে ছিল তাহা বর্ণ-বিন্যাস, ধর্মকর্ম ও রাজবৃত্ত অধ্যায়ে সবিস্তারেই আলোচনা করিয়াছি। সেন-বৰ্মণ রাষ্ট্রে এই প্রাধান্য ও প্রতিপত্তি বাড়িয়াই গিয়াছিল এবং ভূম্যধিকারীতন্ত্র ও ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রে স্বার্থগ্রন্থিবন্ধন দৃঢ়প্রতিষ্ঠ হইয়াছিল। বস্তুত, সেন ও বর্মণ রাজবংশ যে সমোজাদর্শ ও আবেষ্টনের মধ্যে র্তাহাদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করিতে চাহিয়াছিলেন, যে-আদর্শ ও আবেষ্টনের মধ্যে ভূম্যধিকারতন্ত্র অটুট ও অক্ষুন্ন থাকা সহজ ও সম্ভব সেই আদর্শ ও পরিবেশ রচনা এবং প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব অর্পিত হইয়াছিল জ্ঞান-বুদ্ধিজীবী ব্ৰাহ্মণদের উপর। পরমসুগত বৌদ্ধ পাল ও চন্দ্ররাজবংশের ক্ষেত্রেও ইহার অন্যথা হয় নাই, কারণ অর্থ ও রাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে সমাজপদ্ধতির এই নিয়মই তখন কার্যকরী ছিল। দেশের ভূমিকান বিত্তবান সম্রােন্ত অধিকাংশ লোকই ছিলেন ব্রাহ্মণ্য সংস্কার ও সংস্কৃতি আশ্রয়ী এবং বৌদ্ধ গৃহীরাও তাঁহাই। কাজেই পাল-চন্দ্র যুগে ভূমি-নির্ভর কৃষিতান্ত্রিক সমাজপদ্ধতির কিছু ব্যতিক্রম হয় নাই। তবে, বৌদ্ধ রাষ্ট্রের সামাজিক দৃষ্টি ছিল। উদার এবং সর্বত্র প্রসারী এবং সেই হেতু পরবর্তী সেনা-বর্মণ আমলের মতো পাল-চন্দ্ৰ-আমলে ব্ৰাহ্মণ্যতন্ত্রের প্রভাব ও আধিপত্য এমন দুৰ্জয় ও সর্বগ্রাসী হইয়া উঠিতে পারে নাই। পাল-চন্দ্র ও সেন-বৰ্মণ-আমলে ভূমি-নির্ভর কৃষিতন্ত্রেরই প্রাধান্য অর্থাৎ ভূম্যধিকারী শ্রেণী রাষ্ট্রের প্রধান সহায় ও পোষক, এবং রাষ্ট্রও ইহাদের সহায় ও পোষক। সেনা-বর্মণ রাষ্ট্র উপরন্তু ব্ৰাহ্মণ্যতন্ত্রেরও পোষক ও সহায়ক; পাল-চন্দ্র রাষ্ট্রে উদার সর্বত্রপ্রসারী দৃষ্টিও ইহাদের ছিল না। ইহার ফলেই বোধ হয় সেন-বৰ্মণ রাষ্ট্র সমাজের সকল শ্রেণীর সমর্থন ও পোষকতা লাভ করিতে পারে নাই। সমসাময়িক স্মৃতি, পুরাণ ও পরবর্তীকালের বল্লাল-চরিতের সাক্ষ্য যদি এক্ষেত্রে প্রামাণিক হয় তাহা হইলে অনুমান করা কঠিন নয় যে, শিল্পী বণিক ও ব্যবসায়ী শ্রেণীর একটা বৃহৎ অংশের সমর্থন ও পোষকতা সেনা-বর্মণ রাষ্ট্র লাভ করিতে পারেন নাই। ভূমি নির্ভর কৃষিপ্রধান সমাজে ও রাষ্ট্রে শিল্পী-বণিক-ব্যবসায়ী শ্রেণী অবজ্ঞাত হইবে, ইহা কিছু বিচিত্র নয়। শশাঙ্কের বৌদ্ধ-বিদ্বেষ কাহিনী সম্বন্ধে কোনও বাস্তব, ঐতিহাসিক, অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা উপযুক্ত সাক্ষ্যপ্রমাণের অভাবে নিশ্চয় করিয়া হয়তো দেওয়া কঠিন (রাজবৃত্ত এবং ধর্মকর্ম অধ্যায়ে শশাঙ্ক-প্রসঙ্গ দ্রষ্টব্য); কিন্তু বল্লাল-চরিতে বণিক-সুবর্ণ-বণিকদের সঙ্গে বল্লালসেনের রাষ্ট্রের যে সংঘর্ষের কাহিনী বর্ণিত আছে তাহার পশ্চাতে একদিকে ব্ৰাহ্মণ ও ভূম্যধিকারী শ্রেণী এবং অন্যদিকে বণিক-ব্যবসায়ী শ্রেণী এই দুইয়ের সংঘর্ষের ইঙ্গিত লুকাইয়া নাই, জোর করিয়া এমন কথা বলা যায় না। সংঘর্ষের কারণ যে ছিল তাহা তো সমসাময়িক স্মৃতি ও পুরাণেই জানা যাইতেছে। তাহা ছাড়া অন্ত্যজ ও স্লেচ্ছ পর্যায়ভুক্ত যে সুবৃহৎ নিম্নতম সমাজ-শ্রমিক তাহারাও বোধ হয় সেন-বৰ্মণ রাষ্ট্রের প্রতি প্রসন্ন ছিলেন না। ইহাদের অনেকেই বজ্ৰযান-কালচক্ৰযান -সহযান-মন্ত্রযান তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম, শৈব-তান্ত্রিক ধর্ম, নাথ ধর্ম ইত্যাদির নানা সম্প্রদায়ভুক্ত ছিলেন; সেন-বৰ্মণ রাষ্ট্রের ধর্ম ও সমাজগত আদর্শ এই সব অবৈদিক, অস্মার্ত, অপৌরাণিক ধর্ম ও আচার সুনজরে দেখিত না, এই তথ্য অজানা নয়। ভূম্যধিকারী শ্রেণী:প্রধান, ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রপ্রধান, কৃষিপ্রধান সমাজে এইসব ভূমিবিহীন কৃষক ও অসংখ্য স্লেচ্ছ, অন্ত্যজ সমাজ-শ্রমিকের কোনও অধিকারই যে ছিল না, ইহা অনুমান করিতে কল্পনার আশ্রয় লইবার দরকার হয় না। সমসাময়িক স্মৃতি-পুরাণই তাহার প্রমাণ। কাজেই, সেনা-বর্মণ রাষ্ট্র ও সেই রাষ্ট্রের ধারক ও পোষক সমসাময়িক উচ্চতর শ্রেণীগুলির উপর ইহাদের প্রসন্ন থাকিবার কোনও কারণ নাই।