কৃষি, শিল্প ও ব্যাবসা-বাণিজ্যের আলোচনা শেষ হইল। এগুলি সমস্তই সামাজিক ধনসম্পদের বনিয়াদ; এই তিন উপায়েই দেশের অর্থোৎপাদন হইত। মুদ্রায় এই অর্থের রূপান্তর কিরূপ ছিল দেখা প্রয়োজন।
মুদ্রায় সামাজিক ধনের রূপ
বিনিময়ের জন্য মুদ্রার ব্যবহার অর্থনৈতিক সভ্যতার দ্যোতক। খ্ৰীষ্ট্ৰীয় শতকের আগে হইতেই বাঙলাদেশে মুদ্রার প্রচলন দেখা যায়। মহাস্থানের শিলাখণ্ডের লিপিটিতে গণ্ডক নামে একপ্রকার মুদ্রার প্রচলন দেখিতে পাইতেছি। এই মুদ্রা সোনা রূপার, বলার কোনও উপায় নাই। তবে বহু পূৰ্ববতী কালের ‘গণ্ডা” গণনা রীতির সঙ্গে যে এই গণ্ডক মুদ্রার একটা শব্দতাত্ত্বিক সম্বন্ধ ছিল এ সম্বন্ধে সন্দেহ নাই। এই গণ্ডক মুদ্রার চেহারা যে কিরূপ ছিল তাহাও আমরা কিছু জানি না। কেহ কেহ মনে করেন, মহাস্থান লিপিতে ‘কাকনিক’ নামে আর একপ্রকার মুদ্রারও উল্লেখ আছে। এই মুদ্রারও রূপ, মূল্য বা ওজন সম্বন্ধে আমরা কিছু জানি না। গণ্ডকের সঙ্গে ইহার সম্বন্ধ যে কী ছিল তাহাও বলা যায় না। পেরিপ্লাস-গ্রন্থে খবর পাওয়া যাইতেছে, গঙ্গা-বন্দরে ক্যালটিস (Calitis) নামে একপ্রকার স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন ছিল; ইহা তো খ্ৰীষ্টীয় প্রথম শতকের কথা। কেহ কেহ মনে করেন, Calitis। সংস্কৃত ‘কলিত’ অর্থাৎ সংখ্যাঙ্কিত শব্দেরই রূপান্তর। পেরিপ্লাস-গ্রন্থের সম্পাদক মনে করেন Calitis এবং দক্ষিণ-ভারতের Kalais, একই মুদ্রা। ভিনসেন্ট স্মিথ তো বলেন, Kalais নামেও বাঙলাদেশে একপ্রকার মুদ্রার প্রচলন ছিল। কনকলাল বড়ুয়া মনে করেন, আসামের ‘কলিত বণিকেরা একপ্রকার স্বর্ণমুদ্রা ব্যবহার করিত, তাহার নাম ছিল। Kallis। বোধহয় ইহারও আগে এক ধরনের নানা চিহ্নাঙ্কিত (punch marked) রৌপ্য ও তাম্র-মুদ্রার বিস্তৃত প্রচলন ছিল বাঙলাদেশে। চব্বিশ পরগনার নানা প্রত্নস্থানে, রাজশাহীর ফেটুগ্ৰাম, মৈমনসিংহের ভৈরববাজার, মেদিনীপুরের তমলুক এবং ঢাকার উয়াড়ী প্রভৃতি স্থানে এই ধরনের সীসা, রৌপ্য ও তাম্র-মুদ্রা প্রচুর আবিষ্কৃত হইয়াছে; ইহাদের সঙ্গে ভারতবর্ষের নানাস্থানে প্রাপ্ত এই জাতীয় মুদ্রার নিকট আত্মীয়তা সহজেই ধরা পড়ে। সেই হেতু, সর্বভারতীয় সাধারণ অর্থনৈতিক জীবনের সঙ্গে বাঙলার একটা যোগাযোগ ছিল এই অনুমান হয়তো নিতান্ত মিথ্যা না-ও হইতে পারে। কুষাণ আমলের দুই-চারিটি স্বর্ণমুদ্রাও বাঙলাদেশে পাওয়া গিয়াছে। বাঙলাদেশ কখনও কুষাণ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল না; কাজেই অনুমান হয়, বুকুতুবপদেশে বা অন্য কোনও উপায়ে কিছু কিছু কুষাণ স্বর্ণমুদ্রা বাঙলাদেশে আসিয়া উত্তর-বঙ্গ গুপ্ত-সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল এ তথ্য সুবিদিত। সেই আমলে গুপ্ত মুদ্রারীতি বাঙলাদেশে বহুল প্রচলিত ছিল। এই মুদ্রা ছিল প্রধানতম সুবর্ণ ও রৌপ্যের; স্বন্দগুপ্তের আমলে গুপ্ত স্বর্ণমুদ্রার ওজন ছিল ১৪২ মাষের কাছাকাছি, এবং রৌপ্যমুদ্রার ওজন একটি রৌপ্য কাৰ্যাপণের প্রায় সমান অর্থাৎ ৩৬ মাষ। পূর্ববর্তী সম্রাটদের কালে স্বর্ণমুদ্রা ওজনে আরও কম ছিল। যাহাই হউক, গুপ্ত আমলে এই দুই মুদ্রাই যে বাঙলাদেশে প্রচলিত হইয়াছিল। তাহার লিপি-প্রমাণ প্রচুর; বিনিময়-মুদ্রা হিসাবে এই মুদ্রাই ব্যবহৃত হইত। পঞ্চম হইতে সপ্তম শতক পর্যন্ত ভূমি দান-বিক্রয়ের পট্টোলীগুলিতে ভূমির মূল্য দেওয়া হইয়াছে (স্বর্ণ) দিনারে (denarious aureus)। প্রচলিত স্বর্ণমুদ্রাই যে ছিল দিনার, তাহা ইহাতেই সপ্রমাণ। রৌপ্যমুদ্রার নাম ছিল রূপক। দৃষ্টান্তস্বরূপ বৈগ্রাম পট্টোলীর উল্লেখ করা যাইতে পারে। এই লিপি হইতেই প্রমাণ হয় যে, আটটি রূপক মুদ্রা অর্ধ-দিনারের সমান, অর্থাৎ ষোলোটিতে এক দিনার। প্রথম কুমারগুপ্তের রাজত্বকালে (ধনাইদহ, দামোদরপুর ও বৈগ্রাম পট্টোলীর কালে) এক স্বর্ণ দিনারের ওজন ছিল ১১৭-৮ হইতে ১২৭-৩ মাষ পরিমাণ, এবং এক রূপকের ওজন ছিল ২২•৮ হইতে ৩৬.২ মাষ পরিমাণ। ইহা হইতে সোনার সঙ্গে রূপার আপেক্ষিক সম্বন্ধের যে ইঙ্গিত পাওয়া যায় তাহাতে মনে হয়, রূপার আপেক্ষিক মূল্য সোনা অপেক্ষা অনেক বেশি ছিল। খুবই আশ্চর্য ব্যাপার সন্দেহ নাই, কিন্তু ইহার কারণ বর্তমানে যে ঐতিহাসিক উপাদান আমাদের হাতে আছে তাহার মধ্যে খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। হইতে পারে, দেশে রৌপ্যের অপ্রতুলতাই ইহার কারণ, অথবা কোনও-না-কোনও কারণে দেশে রৌপ্যের আমদানি বন্ধ হইয়া গিয়াছিল, অথবা পট্টোলীগুলির মধ্যে আমরা যে স্বর্ণ দিনারের উল্লেখ দেখিতেছি তাহার যথার্থ স্বর্ণমূল্য (intrinsic value) অনেক কম ছিল, অর্থাৎ সুবর্ণমুদ্রার স্বর্ণগত অবনতি ঘটিয়াছিল। (debasement)। দেখিতেছি, গুপ্ত আমলের অব্যবহিত পরেই বাঙলাদেশে যখন স্ব স্ব প্রধান ছোট ছোট রাজবংশের স্বতন্ত্র আধিপত্য চলিতেছে তখন রৌপ্যমুদ্রার প্রচলন একবারে নাই, অথচ স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন অব্যাহত, এবং এই স্বর্ণমুদ্রার যথার্থ মূল স্বর্ণমূল্য অনেক কম; ইহা অবনত (debased) স্বর্ণমুদ্রা, যদিও ওজনে তাহা কমে নাই। বাঙলাদেশের বহু স্থানে কিছু কিছু গুপ্ত স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া গিয়াছে। তাহার কিছু সাধারণ সরকারী গ্রন্থশালায় রক্ষিত, কিন্তু ব্যক্তিগত সংগ্রহে যাহা আছে তাহার সংখ্যাও কম নয়। ১৭৮৩ খ্ৰীষ্টাব্দে কালীঘাটে প্রায় ২০০ (গুপ্ত?) সুবর্ণমুদ্রা পাওয়া গিয়াছিল। কিন্তু তাহার অধিকাংশই গলাইয়া ফেলা হইয়াছিল। গুপ্ত স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া গিয়াছে যশোহরের মহম্মদপুরে, হুগলিতে ও হুগলি জেলার মহানাদে। গুপ্ত রৌপ্য ও তাম্র-মুদ্রা পাওয়া গিয়াছে। যশোহরের মহম্মদপুরে, বর্ধমান জেলার কাটোয়ায়। ‘নকল গুপ্তমুদ্রা পাওয়া গিয়াছে উপরোক্ত মহম্মদপুরে, ফরিদপুর জেলার কোটালিপাড়ায়, ঢাকা জেলার সাভার গ্রামে এবং রংপুরে। বাঙলাদেশের নানা জায়গায় শশাঙ্ক, জয় (নাগ?), সমাচা (র দেব?) এবং অন্যান্য রাজার নামাঙ্কিত এই ধরনের কিছু কিছু সুবর্ণমুদ্রা পাওয়া গিয়াছে। রৌপ্যমুদ্রা একেবারেই নাই। আশ্চর্যের বিষয় এই গুপ্ত আমলেও, যখন স্বর্ণ, রৌপ্য ও তাম্রমুদ্রা বহুল প্রচলিত, তখনও মুদ্রার নিম্নতম মােন কিন্তু কড়ি। চতুর্থ শতকে ফাহিয়ান বলিতেছেন, লোকে ক্রয়বিক্রয়ে কড়িই ব্যবহার করিত, এবং নিম্নতম মান কড়ি একেবারে উনবিংশ শতক পর্যন্ত কোনও দিনই ব্যবহারের বাইরে চলিয়া যায় নাই। চর্যাপদ (দশম-একাদশ শতকগুলিতে) দেখিতেছি, কবাডি (কড়ি) এবং বোডির (বুড়ি) ব্যবহার। মিনহাজ উদ্দীন তুরস্কাভিযানের বিবরণ দিতে গিয়া বলিয়াছেন, অভিযাত্রী তুরষ্কেরা বাঙলাদেশে কোথাও রৌপ্যমুদ্রার প্রচলন দেখিতে পান নাই; সাধারণ ক্রিয়-বিক্রয়ে লোকে কড়িই ব্যবহার করিত। এমন-কি রাজাও যখন কাহাকেও কিছু দান করিতেন, কড়ি দ্বারাই করিতেন; লক্ষ্মণসেনের নিম্নতম দান ছিল এক লক্ষ কড়ি। ত্ৰয়োদশ শতকেও কড়ির প্রচলনের সাক্ষ্য অন্যত্ৰ পাইতেছি। পঞ্চদশ শতকে মা-হুয়ান একই সাক্ষ্য দিতেছেন, মধ্যযুগের বাঙলা সাহিত্য এবং বিদেশী পর্যটকদের সাক্ষ্যও একই প্রকার। এমন-কি। ১৭৫০ খ্ৰীষ্টাব্দে ইংরাজ বণিকেরাও দেখিয়াছেন, কলিকাতা শহরে কর আদায় হইত। কড়ি দিয়া; বাজারে অনেক ক্ৰয়-বিক্রয়ও কড়ির সাহায্যেই হইত।
যাহাই হউক, মাৎস্যন্যায়-পর্বের শেষে পালরাজারা যখন দেশে প্রতিষ্ঠিত হইলেন এবং শান্তি ও সুশাসন ফিরিয়া আসিল তখন আবার দেশে রৌপ্যমুদ্রার (এবং সঙ্গে সঙ্গে তাম্রমুদ্রার) প্রচলন যেন ফিরিয়া আসিল। কিন্তু সুবর্ণমুদ্রা আর ফিরিল না। সুবর্ণমুদ্রার ক্রমশ অবনতি ঘটিতে ঘটিতে শেষে যেন একেবারে বিলুপ্ত হইয়া গেল। বস্তুত, পালরাজা ও সেনরাজাদের আমলের একটি সুবর্ণমুদ্রাও বাঙলাদেশে কোথাও আবিষ্কৃত হয় নাই, কিংবা সমসাময়িক সাহিত্যে কোথাও তাহার কোনও উল্লেখও নাই। সপ্তম শতকের পর হইতেই সুবর্ণ দিনার বা যে-কোনও প্রকার সুবৰ্ণমুদ্রা একেবারে অনুপস্থিত। বাঙলা ও বিহারের কোথাও কোথাও “শ্ৰী বি (গ্রহ)” নামাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা আবিষ্কৃত হইয়াছে; কোথাও কোথাও ঐ নামাঙ্কিত বা কোনও নামাঙ্কন ছাড়া পালযুগীয় তাম্রমুদ্রাও পাওয়া গিয়াছে (যেমন, পাহাড়পুরে)। “শ্ৰী বি (গ্রহ)” পালরাজ প্রথম বিগ্রহপাল; নিকৃষ্ট তাম্রমুদ্রগুলি দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বিগ্রহপালের আমলেরও হইতে পারে, এমন-কি সমসাময়িক বা পরবর্তী “অন্য কোনও রাজারও হইতে পারে। ঐ নামাঙ্কিত রৌপ্যমুদ্রা সাধারণত দ্রাহ্ম (drachm) নামে অভিহিত হইয়া থাকে। ধর্মপালের মহাবোধি লিপিতে দ্রাহ্ম নামক একপ্রকার মুদ্রার উল্লেখ আছে; এই উল্লেখই পাল আমলে দ্রাহ্মী মুদ্রার প্রচলনের প্রমাণ। উক্ত রাজার রাজত্বের ষোলো বৎসরে কেশর নামক এক ব্যক্তি তিন সহস্র দ্রাহ্ম মুদ্রা খরচ করিয়া (ত্রিতয়েন সহস্ৰেণ দ্রাহ্মাণাং খানিতা) একটি পুকুর খনন করাইয়াছিলেন। সুবর্ণমুদ্রার প্রচলন তো ছিলই না, এবং আবিষ্কৃত মুদ্রগুলি হইতে মনে হয়, রৌপ্যমুদ্রারও যথেষ্ট অবনতি ঘটিয়াছিল। যে অবনতি গুপ্ত-পরবর্তী যুগে দেখা গিয়াছিল, পালরাজারাও সেই অবনতি ঠেকাইতে পারেন। নাই; এমন-কি আবিষ্কৃত তাম্রমুদ্রগুলিও মূল মূল্য বা আকৃতি বা শিল্পীরূপের দিক হইতে অত্যন্ত নিকৃষ্ট। ভাস্করাচার্যের (১০৩৬ শক = ১১১৪ খ্ৰী) লীলাবতী-গ্রন্থে একটি আর্য আছে; কুড়ি কড়া বা কড়িতে এক কাকিনী, চার কাকিনীতে এক পণ, ষোলো পণে এক দ্রাহ্ম (রৌপ্যমুদ্রা), ষোলো দ্রহ্মে এক নিষ্ক। আমরকোষের মতে এক নিষ্ক এক দিনারের সমান, অর্থাৎ ষোলো দ্রহ্মে এক দিনার অর্থাৎ ষোলো দ্রাহ্ম – ষোলো রূপক। দ্রাহ্ম যে রৌপ্যমুদ্রা তাহা হইলে এ সম্বন্ধে আর কোনও সন্দেহ থাকিল না। কিন্তু রৌপ্যমুদ্রা হইলে কী হইবে, পাল রৌপ্যমুদ্রা যাহা পাওয়া গিয়াছে তাহা অত্যন্ত নিকৃষ্ট ধরনের; মূল মূল্য (intrinsic value) এবং বাহ্যরূপ উভয় দিক হইতেই নিকৃষ্ট।
সেন আমলে কিন্তু তাহাও নাই। সুবর্ণমুদ্রা তো দূরের কথা, রৌপ্যমুদ্রাও একেবারে অন্তহিঁত। বস্তুত, ধাতুমুদ্রা প্রচলনের একটা চেষ্টা পাল আমলে যদি বা ছিল, সেন আমলে তাহাও দেখিতেছি না। এই আমলে দেখিতেছি, উর্ধর্বতম মুদ্রামান পুরাণ বা কপর্দক পুরাণ। এই পুরাণ বা কপর্দক পুরাণের একটিও বাঙলাদেশের কোথাও আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয় নাই। সেইজন্যই এই মুদ্রার রূপ ও প্রকৃতি সম্বন্ধে অনুমান ছাড়া আর কোনও উপায় নাই! কেহ কেহ বলেন, যে পুরাণ মুদ্রার আকার ছিল কপর্দক বা কড়ির মতন, সেই মুদ্রাই কপর্দক পুরাণ। দেবদত্ত রামকৃষ্ণ ভাণ্ডারকর মহাশয় এইরূপ মনে করেন এবং বলেন কপৰ্দক পুরাণ রৌপ্যমুদ্রা। এইরূপ মনে করিবার কারণ এই যে, পুরাণ ৩২ রতি বা ৫৮ মাষ পরিমাণের সুবিদিত রৌপ্যমুদ্রা বলিয়া নানা গ্রন্থে কথিত। কিন্তু আশ্চর্য এই যে, প্রায় প্রত্যেকটি লিপিতেই শত শত পুরাণ-মুদ্রার উল্লেখ থাকা সত্ত্বেও আজ পর্যন্ত বাঙলাদেশে একটিও পুরাণ-মুদ্রা পাওয়া গেল না কেন? এবং অন্যদিকে, মিনহাজই বা কেন বলিতেছেন, তুরুষ্কেরা রৌপ্যমুদ্রার প্রচলন দেখে নাই, হাটবাজারে কড়িরই প্রচলন ছিল? এমনকি রাজার দানমুদ্রাও ছিল কড়ি! এ রহস্যের অর্থ কি এই যে, কপর্দক পুরাণ বা পুরাণ বলিয়া যথার্থত কোনও ধাতু-মুদ্রার অস্তিত্বই সেন আমলে ছিল না, আন্তর্দেশিক ব্যাবসা-বাণিজ্যে মুদ্রার উর্ধর্বতম ও নিম্নতম উভয় মানই ছিল কড়ি? অথবা, কপর্দক-পুরাণ ছিল একটা কাল্পনিক রৌপ্যমুদ্রা মান, এবং এক নির্দিষ্ট সংখ্যক কড়ির মূল্য ছিল সেই রৌপ্যমানের সমান? বহির্বাণিজ্য এবং পরদেশের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষার জন্যই কি এইরূপ মান নির্ধারণের প্রয়োজন ছিল? বোধ হয় তাহাই। সুরেন্দ্ৰকিশোর চক্রবর্তী মহাশয় নানা অনুমানসিদ্ধ প্রমাণের সাহায্যে এই ধরনের ইঙ্গিতই করিতেছেন, বলিতেছেন,
“…Payments were made in cowries and a certain number of them came to be equated to the silver coin, the purana, thus linking up all exchange transactions ultimately to silver, just as at present, the silver coin is linked up to gold at a certain ratio.”
গুপ্তযুগের পর অর্থাৎ খ্ৰীষ্ট্ৰীয় ষষ্ঠ-সপ্তম শতক হইতেই মুদ্রার, বিশেষভাবে সুবর্ণ ও রৌপ্য মুদ্রার, এরূপ অবনতি ঘটিল কেন, এই প্রশ্ন অর্থনীতিবিদ এবং ঐতিহাসিক উভয়ের সম্মুখেই উপস্থিত করা যাইতে পারে। প্রথমাবস্থায় সুবর্ণমুদ্রার অবনতি ঘটিল, কিছুদিন গুপ্ত সুবর্ণমুদ্রার নকলও চলিল এবং তারপর একেবারে অন্তৰ্হিত হইয়া গেল! রৌপ্যমুদ্রা সপ্তম শতকেই একবার অন্তহিঁত হইয়া গিয়াছিল, তবে পাল আমলে আবার তাহার পুনরুদ্ধারের চেষ্টা দেখা যায়, কিন্তু সে চেষ্টা সার্থক হয় নাই। সেন আমলে আর তাহা দেখাই গেল না, এমন-কি তাম্রমুদ্রাও নয়। গুপ্ত আমলে স্পষ্টত স্বর্ণই ছিল অর্থমান নির্দেশক, পাল আমলে রৌপ্য; সেন আমলেও স্বীকারত রৌপ্য, কিন্তু সে রৌপ্য দৃশ্যত অনুপস্থিত। নিম্নতম মান কড়ি সব সময়ই ছিল, এবং ছোটখাটো কেনাবেচায় ব্যবহারও হইত, কিন্তু অর্থমান নির্ণীত হইত সোনা বা রূপায়। সেন আমলে কড়িই মনে হইতেছে সর্বেসর্ব। মুদ্রার এই ক্রমাবনতি কি দেশের সাধারণ আর্থিক দুৰ্গতির দিকে ইঙ্গিত করে? না, রাষ্ট্রের স্বর্ণের ও রৌপ্যের গচ্ছিত মূলধনের স্বল্পতার দিকে ইঙ্গিত করে? মুদ্রার প্রচলন কি কমিয়া গিয়াছিল? সুবর্ণমুদ্রার অবনতি এবং বিলুপ্তি হয়তো Gresham Law দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায়; রৌপ্যমুদ্রার অবনতিও কি সেই কারণে? যে ব্যাবসা-বাণিজ্যের উপর, বিশেষ করিয়া বহির্বাণিজ্যের উপর, প্রাচীন বাঙলার সমৃদ্ধি নির্ভর করিত, তাহার অবনতি ঘটিয়াছিল। কি? সোনা ও রূপার অভাব ঘটিয়াছিল কি? রাজকোষে সমস্ত সোনা ও রূপা সঞ্চিত হইতেছিল কি?
সকল প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আজও হয়তো সম্ভব নয়। তবে কিছু কিছু তথ্য ও তথ্যগত অনুমান উল্লেখ করা যাইতে পারে। গুপ্ত রাজাদের আমলের পর হইতেই, এমন-কি শশাঙ্কের আমলেই, বাঙলার রাষ্ট্ৰীয় অবস্থায় গুরুতর চাঞ্চল্য দেখা দিয়াছিল। প্রতিবেশী রাজ্যের সঙ্গে যুদ্ধবিগ্রহ চলিতেছিল। তারপর তো প্রায় সুদীর্ঘ এক শতাব্দীরও উপর দুরন্ত মাৎস্যন্যায়ের অপ্ৰতিহত রাজত্ব চলিয়াছে; অন্তর্বাণিজ্য বহির্বাণিজ্য দুইই খুবই বিচলিত হইয়াছিল সন্দেহ নাই, এবং সমাজের অর্থনৈতিক স্থিতিও খানিকটা শিথিল হইয়াছিল। এই অবস্থায় সুবর্ণমুদ্রার অবনতি ঘটা কিছু অস্বাভাবিক নয়, নকল মুদ্রা চলাও অস্বাভাবিক নয়। আর, রৌপ্যমুদ্রার অবনতিও একই কারণে হইয়া থাকিতে পারে। রূপা বাঙলাদেশের কোথাও পাওয়া যায় না; ইহাও হইতে পারে যে, বিদেশ হইতে রূপার আমদানি কোনও কারণে বন্ধ হইয়া গিয়াছিল। কিন্তু পালসাম্রাজ্য সুপ্রতিষ্ঠিত এবং সুবিস্তৃত হইবার পরও সুবর্ণমুদ্রার প্রচলন ঘটিল না কেন, রৌপ্যমুদ্রাই বা সগৌরবে ও যথার্থ মূল্যে প্রতিষ্ঠিত হইল না কেন, এ তথ্য অন্যতম বিস্ময়কর। পালরাজাদের আদান-প্ৰদান ও যোগাযোগ ছিল উত্তর-ভারত জুড়িয়া এবং হয়তো দক্ষিণ-ভারতেও; সমসাময়িক কালে অন্যান্য প্রতিবেশী রাজ্যগুলিতে সুবর্ণমুদ্রার প্রচলনও ছিল অল্পবিস্তর। আনুমানিক একাদশ শতকে জনৈক বারেন্দ্ৰ ব্ৰাহ্মণ কামরূপের রাজা জয়পালের নিকট হইতে (হোন্নাম শতানি নবী) নয়শত সুবর্ণ (মুদ্রা) দান গ্রহণ করিয়াছিলেন, সিলিমপুর লিপিতে এ তথ্য পাওয়া যাইতেছে। অথচ, বাঙলাদেশে তখন সুবর্ণমুদ্রার প্রচলন একেবারে নাই, পরেও নাই। পাল ও সেনা-বংশের মতন সমৃদ্ধ ও সচেতন রাজবংশ সুবর্ণমুদ্রার প্রচলনে প্ৰয়াসী হইলেন না কেন? বৈদেশিক বাণিজ্যের মধ্যে কি এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাইতে পারে?
খ্রীষ্টীয় অষ্টম শতকের প্রারম্ভেই আরবী মুসলমানেরা সিন্ধুদেশ অধিকার করে। ইহাদের পূর্বদিশাভিযান আগেই আরম্ভ হইয়াছিল এবং সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিমদেশভিযানও চলিয়াছিল। দেখিতে দেখিতে ইহারা একদিকে স্পেন ও অন্যদিকে ভারতবর্ষ পর্যন্ত নিজেদের রাষ্ট্রীয় প্রভুত্ব এবং চীনদেশ পর্যন্ত বাণিজ্যপ্ৰভুত্ব বিস্তার করে। ভূমধ্যসাগর হইতে আরম্ভ করিয়া ভারত-মহাসাগরের দক্ষিণ-পূর্বশায়ী দ্বীপগুলি পর্যন্ত যে সামুদ্রিক বাণিজ্য ছিল একসময় রোম ও মিশর-দেশীয় বণিকদের করতলগত সেই সুবিস্তৃত বাণিজ্য-ভার চলিয়া যায় আরব বণিকদের হাতে। অবশ্য একদিনে তা হয় নাই। সপ্তম শতকের মাঝামাঝি হইতেই এই বিবর্তনের সূত্রপাত এবং দ্বাদশ-ত্ৰয়োদশ শতকে আসিয়া চরম পরিণতি। এই বিবর্তন-ইতিহাসের বিস্তৃত উল্লেখের স্থান। এখানে নয়, কিন্তু সংক্ষেপত এই কথা বলা যায়, এই সুবৃহৎ বাণিজ্যে উত্তর-ভারতীয়দের যে অংশ ছিল তাহা ক্রমশ খর্ব হইতে আরম্ভ করে। প্রথম পশ্চিম-ভারতের বন্দরগুলি চলিয়া যায় আরবদেশীয় বণিকদের হাতে, এবং পরে পূর্ব-ভারতের। দক্ষিণ-ভারতীয় পল্লব, চোল ও অন্য ২/১ টি রাজ্য প্রায় চতুর্দশ শতক পর্যন্ত সামুদ্রিক বাণিজ্যে নিজেদের প্রভাব বজায় রাখিয়াছিল, কিন্তু পরে তাহাও চলিয়া যায়। মুঘল আমলে তো প্রায় সমস্ত ভারতীয় সামুদ্রিক বাণিজ্যটাই আরব ও পারস্যদেশীয় বণিকদের হাতে ছিল; সেই বাণিজ্য লইয়াই তো পরে পর্তুগীজ-ওলন্দাজ-দিনেমার-ফরাসী-ইংরেজে কাড়াকড়ি মারামারি।
যাহাই হউক, আমি আগেই দেখাইতে চেষ্টা করিয়াছি, এই সামুদ্রিক বাণিজ্য হইতে প্রাচীন বাঙলাদেশে প্রচুর অর্থাগম হইত। গঙ্গাবিন্দর ও তাম্রলিপ্তি হইতে জাহাজ বোঝাই হইয়া মাল বিদেশে রপ্তানি হইত, এবং তাহার বদলে দেশে প্রচুর সুবর্ণ ও রৌপ্যমুদ্রা আমদানি হইত।; এই সুবৰ্ণ রোমক দিনার এবং রৌপ্য রোমক দ্রাহ্ম হওয়াই সম্ভব। খ্ৰীষ্টপূর্ব শতক হইতেই এই সমৃদ্ধির সূচনা দেখা দিয়াছিল এবং সমানে চলিয়াছিল। প্রায় খ্ৰীষ্টীয় সপ্তম শতক পর্যন্ত। কিন্তু তারপরেই এই সমৃদ্ধ বাণিজ্যস্রোতে যেন ভাটা পড়িয়া গেল। ভারতীয় দ্রব্যসম্ভারের কাছে পশ্চিমের সুবিস্তৃত হাট বন্ধ হইয়া গেল। যখন আবার সেই হাট খুলিল তখন বাণিজ্যকর্তৃত্ব চলিয়া গিয়াছে আরব বণিকদের হাতে এবং সেই হাটেরও চেহারা বদলাইয়া গিয়াছে। পশ্চিমের বাজারে যে-সব জিনিসের চাহিদা ছিল তাহাও অনেক কমিয়া গিয়াছে। অন্তত এই সুসমৃদ্ধ বাণিজ্যে বাঙলাদেশের যে অংশ ছিল তাহা যে খর্ব হইয়া গিয়াছে, এ সম্বন্ধে কোনও সন্দেহ নাই। বাঙলাদেশের প্রধান বন্দর ছিল তাম্রলিপ্তি; সেই তাম্রলিপ্তির বাণিজ্যসমৃদ্ধির কথা সকলের মুখে মুখে, পুঁথির পাতায় পাতায়। সপ্তম শতকে য়ুয়ান-চোয়াঙ ও ই-ৎসিঙ তাম্রলিপ্তির সমৃদ্ধির বর্ণনা করিয়াছেন। কিন্তু সামুদ্রিক বাণিজ্যকেন্দ্র হিসাবে বা কোনও হিসাবেই তাম্রলিপ্তির উল্লেখ অষ্টম শতকের পর হইতে আর পাইতেছি না। যে নদীর উপরে ছিল তাম্রলিপ্তির অবস্থিতি পলি পড়িয়া পড়িয়া সেই নদীটির মুখ বন্ধ হইয়া গেল অথবা নদীটি খাত পরিবর্তন করিল। তাম্রলিপ্তির সৌভাগ্য-সূর্য অস্তমিত হইল, এবং আশ্চর্য এই, অষ্টম হইতে পঞ্চদশ শতক পর্যন্ত বাঙলাদেশে আর কোথাও সামুদ্রিক বাণিজ্যকেন্দ্র গড়িয়া উঠিল না! চতুৰ্দশ শতকে দেখিতেছি। সরস্বতী-তীরবর্তী সপ্তগ্রাম তাম্রলিপ্তির স্থান অধিকার করিতেছে এবং পূর্ব-দক্ষিণতম বাঙলায় নূতন দুইটি বন্দর বেঙ্গলী ও চট্টগ্রাম গড়িয়া উঠিতেছে। সত্যই এই সুদীর্ঘ ছয়-সাত শত বৎসর সামুদ্রিক বাণিজ্যে বাঙলাদেশের বিশেষ কোনও স্থান নাই। এবং সেই হেতু বাহির হইতে সোনারূপার আমদানিও কম। ভারতের অন্তর্বাণিজ্যে বাঙলার অংশ নিঃসন্দেহে আছে; বাঙলাদেশ বিদেশেও ভারতবর্ষে তাহার বস্ত্ৰসম্ভার, চিনি, গুড়, লবণ, নারিকেল, পান, সুপারি ইত্যাদি রপ্তানি করিতেছে প্রচুর, কিন্তু তাহার নিজস্ব কোনও সামুদ্রিক বন্দর নাই; যেটুকু তাহার অংশ তাহা শুধু আন্তর্দেশিক ব্যাবসা-বাণিজ্যে। সেই সূত্রে সোনারূপার দাম সে পাইতেছে কি না। বলা কঠিন, পাইলেও বোধহয় তাহা আগেকার মতন আর লাভজনক নয়, সুপ্রচুরও নয়। স্বর্ণ-দ্বারা অর্থমান নির্ণয় করিবার মতন ইচ্ছা বা অবস্থা পরবর্তী পাল বা সেন রাষ্ট্রের আর নাই, স্পষ্টতই বোঝা যাইতেছে। অথবা, যেহেতু বৈদেশিক সামুদ্রিক বাণিজ্য র্তাহাদের আর নাই, সেই হেতু স্বর্ণমানের প্রয়োজনও নাই। অথচ পঞ্চম-ষষ্ঠ শতকে দেখিতেছি, সাধারণ গৃহস্থও ভূমি কেনাবেচা করিতেছেন স্বর্ণমুদ্রার সাহায্যে। সেন আমলের শেষ পর্যন্ত অন্তত স্বীকারত রৌপ্যই হয়তো অর্থমন-নিৰ্ণক, কিন্তু তৎসত্ত্বেও পাল আমলে রৌপ্যমুদ্রার অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়, সেন আমলে মৃত। ভিন্ন প্রদেশের সঙ্গে আদানপ্রদানের জন্যই হয়তো রৌপ্যমান বজায় রাখা প্রয়োজন হইয়াছিল। মুদ্রার অবস্থা যাহাই হউক, এ তথ্য অনস্বীকার্য যে, অষ্টম শতক ও তাহার পর হইতেই ভারতীয় সামুদ্রিক বহির্বাণিজ্যে বাঙলাদেশের আর কোনও বিশেষ স্থান ছিল না, এবং অন্তর্বাণিজ্যে অল্পবিস্তর আধিপত্য থাকা সত্ত্বেও সেই হেতু বণিককুল ও ব্যবসায়ীদের সমাজে ও রাষ্ট্রে সে প্রভাব ও প্রতিপত্তি আর থাকে নাই। অষ্টম শতক হইতে দেখা যাইবেপরবর্তী এক অধ্যায়ে আমি তাহা দেখাইতে চেষ্টা করিয়াছি— বঙ্গীয় সমাজ ক্রমশ কৃষি-নির্ভর হইয়া পড়িতে বাধ্য হইয়াছে, এবং কৃষকেরাই সমাজদৃষ্টির সম্মুখে আসিয়া পড়িয়াছে। সঙ্গে সঙ্গে দেখিতেছি, বণিক ও ব্যবসায়ী সমাজের প্রতিপত্তিও হ্রাস পাইয়াছে। রাষ্ট্রের অধিষ্ঠানাধিকরণগুলিতে শ্রেষ্ঠী, সার্থবাহ, কুলিক ও ব্যাপারী প্রভৃতিদের যে আধিপত্য পঞ্চম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শতকে দেখা যায় অষ্টম শতকে ও তাহার পর আর তাহা নাই।
কিন্তু স্বর্ণমুদ্রার অনস্তিত্ব। এবং রৌপ্যমুদ্রার অবনতি ও অনস্তিত্ব শুধু বহির্বাণিজ্যের অবনতি ও বিলুপ্তিদ্বারা সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা করা যায় না। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা পাল ও সেন আমলে খুব যে নামিয়া গিয়াছিল মনে হয় না। এই দুই আমলের লিপিগুলি এবং সমসাময়িক সাহিত্যরামচরিত, পবনদূত, গীতগোবিন্দের মতন কাব্য, সদুক্তিকর্ণামৃতের মতন সংলকন-গ্রন্থে উদ্ধৃত সমসাময়িক বাঙালী কবিদের রচনা— পাঠ করিলে, নানা বিচিত্ৰ অলংকারশোভিত মূর্তিগুলি দেখিলে, অসংখ্য সুদৃশ্য সুউচ্চ মন্দির-রচনার কথা স্মরণ করিলে, যাগযজ্ঞে পূজানুষ্ঠানে রাজারাজড়া এবং অন্যান্য সমৃদ্ধ লোকদের দানধ্যানের কথা স্মরণ করিলে মনে হয় না লোকের, অন্তত সমাজের উচ্চতর আর্থিক শ্রেণীগুলির, ধনসমৃদ্ধির কিছু অভাব ছিল। মণিমুক্তাখচিত সোনারূপার অলংকারের যে-সব পরিচয় লিপিগুলিতে, সমসাময়িক সাহিত্যে এবং শিল্পে পড়া ও দেখা যায় তাহাতে তো মনে হয় সোনারূপাও দেশে যথেষ্ট ছিল। তৎসত্ত্বেও এই দুই রাজবংশ সুবৰ্ণমুদ্রা, এমন-কি সেনরাজারা রৌপ্য-মুদ্রার প্রচলন করিলেন না। আন্তর্ভারতীয় বাণিজ্য এবং অন্যান্য ব্যাপারে কিসের সাহায্যে নিষ্পন্ন হইত? ভিনদেশীরা তো নিশ্চয়ই কড়ি গ্রহণ করিতেন না!! রাষ্ট্রকে বিনিময়ে সোনা ও রূপা নিশ্চয়ই দিতে হইত। সেন আমলে স্বর্ণ বা রৌপ্য-মুদ্রা কিছুই তো ছিল না; তবে কি বিনিময় ব্যাপারটা সােনা বা রূপার তালের সাহায্যে নিষ্পন্ন হইত? রাজকোষে যে অর্থ সঞ্চয় হইত। তাহাও কি সোনা ও রূপার তাল? আন্তর্ভারতীয় বাণিজ্য, ভিনদেশীর সঙ্গে আর্থিক লেনদেন প্রভৃতি কি রাষ্ট্রের মারফতে বা মধ্যবর্তিতায় নিষ্পন্ন হইত?
মুদ্রা-সংক্রান্ত এইসব অত্যন্ত স্বাভাবিক প্রশ্নের উত্তর ঐতিহাসিক গবেষণার বর্তমান অবস্থায় একরূপ অসম্ভব বলিলেই চলে।