০৫. রিরা মনিটরের সামনে

রিরা মনিটরের সামনে নিঃশব্দে বসে আছে। মহাকাশযানটি একটা নিউট্রন স্টারের গা ঘেঁষে যেতে যেতে গতি সঞ্চয় করছে—দূরে একটা গ্রহাণুপুঞ্জ, তার ভেতর দিয়ে যাবার কথা। রিরা গ্রহাণুপুঞ্জটি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে মহাকাশযানের মূল প্রসেসরকে জিজ্ঞেস করল, এই গ্রহাণুপুঞ্জের সব গ্রহ-উপগ্রহ কি নিখুঁতভাবে ক্যাটালগ করা আছে?

আছে। এটা আমাদের নিয়মিত রুটের মাঝে পড়ে।

তা হলে আমরা এখানকার ভালো দেখে একটা গ্রহে নেমে পড়ি না কেন?

মহাকাশযানের মূল প্রসেসর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে বলল, এটি একটি অত্যন্ত অবাস্তব পরিকল্পনা।

রিরা একটু রেগে উঠে বলল, কেন? অবাস্তব পরিকল্পনা কেন?

এই মহাকাশযানটি খুব খারাপভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে—কোনো গ্রহে নামা বা সেখান থেকে ওঠার ক্ষমতা নেই। নামতে গেলে বিধ্বস্ত হবার আশঙ্কা শতকরা নব্বই ভাগ থেকে বেশি।

রিরা কাঠকাঠ স্বরে হেসে উঠে বলল, মহাকাশে যেতে থাকলে এমনিতেই মহাকাশযান বিধ্বস্ত হয়ে যাবে—তা হলে নামার চেষ্টা করে বিধ্বস্ত হওয়া কি বুদ্ধিমানের কাজ না? যদি বেঁচে যাই, তা হলে কী লাভ হবে বুঝতে পারছ?

না, বুঝতে পারছি না।

তা হলে হয়তো ভবিষ্যতে কখনো কোনো মহাকাশযান এসে আমাদের উদ্ধার করতে পারবে।

তার সম্ভাবনা দশমিক শূন্য শূন্য চার ভাগ।

রিরা মাথা ঝাঁকিয়ে বলল, তুমি তোমার সম্ভাবনা হিসাব করে বের করা একটু বন্ধ করবে?

আমি দুঃখিত রিরা। মূল প্রসেসর তার শুক ধাতবস্বরে বলল, আমি তোমাকে সিদ্ধান্ত নেবার ব্যাপারে সাহায্য করছিলাম।

তোমার যেখানে সাহায্য করার কথা, সেখানে সাহায্য করলেই হবে। সিদ্ধান্ত নেবার ব্যাপারে সাহায্য করতে হবে না।

ঠিক আছে।

এখন ক্যাটালগ দেখে আমাকে জানাও কোন গ্ৰহটাতে নামা সবচেয়ে বেশি বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

মহাকাশযানের মূল প্রসেসর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি সবগুলো গ্রহ পরীক্ষা করে দেখলাম। এর কোনোটাই দীর্ঘ সময় থাকার উপযোগী নয়।

রিরা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তোমাকে খুব সহজ একটা জিনিল বোঝানো যাচ্ছে! আমি আমার গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে এই গ্রহে যাচ্ছি না। আমি এই গ্রহে যাচ্ছি কোনো উপায় না দেখে হয়তো এই গ্রহে কিছুদিন থাকা যাবে—যে সময়ের ভেতরে কোনো উদ্ধারকারী মহাকাশযান আমাদের খুঁজতে আসবে। বুঝেছ?

বুঝেছি।

তা হলে আমাকে বলে কোন গ্রহটা সবচেয়ে কম বিপজ্জনক।

মহাকাশযানের মূল প্রসেসর বলল, প্রথম প্রহটা ছোট–বায়ুমণ্ডল নেই, প্রতিমুহূর্তে উল্কাপাত হচ্ছে–খুব বিপজ্জনক। দ্বিতীয় গ্রহটা এখনো শীতল হয় নি, অসংখ্য আগ্নেয়গিরি ক্রমাগত লাভা বের হচ্ছে, এটাও বিপজ্জনক। তৃতীয় গ্ৰহটাতে একটা বায়ুমণ্ডল আছে, তাপমাত্রাও মোটামুটি আরামদায়ক–তবে গ্রহটা পুরোপুরি অন্ধকার।

রিরা মাথা নেড়ে বলল, উহুঁ, অন্ধকার গ্রহে যাওয়া যাবে না। মহাকাশযানের প্রসেসর বলল, চতুর্থ গ্রহটাকে মনে করা যায় বাসযোগ্য, অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি এর মাধ্যাকর্ষণজনিত ত্বরণ জি-এর কাছাকাছি। গ্রহটি মোটামুটি আলোকিত, একটা কাজ চালানোর মতো বায়ুমণ্ডল আছে, তবে অক্সিজেন সাপ্লাই না নিয়ে তুমি বের হতে পারবে লা।

রিরা টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, চমৎকার!

আগেই চমৎকার বলো না। মানুষ প্রায় অর্ধশতাব্দী আগে এখানে কলোনি করেছিল, কিন্তু–

কিন্তু কী?

কোনো একটি অজ্ঞাত কারণে কলোনির সবাই মারা পড়েছিল। কারণটা বের করতে পারে নি মানুষ আর কখনো ফিরে আসে নি।

রিরা ভুরু কুঁচকে বলল, আমাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করছ?

না রিরা। আমি ভয় দেখানোর চেষ্টা করছি না, তোমাকে শুধু জানিয়ে রাখছি।

অনেক ধন্যবাদ সেজন্য। রির অন্যমনস্কভাবে টেবিলে আঙুল দিয়ে কয়েকবার শব্দ করে বলল, এই গ্রহের সব মানুষ কেন মারা পড়েছিল, সেটা নিয়ে কোনো তথ্য আছে?

না নেই। মহাকাশযানের প্রসেসর তার শুকণ্ঠে বলল, তবে অসমর্থিত একটা তথ্য আছে।

সেটা কী?

এই গ্রহে কোনো এক ধরনের প্রাণের বিকাশ ঘটেছে। বুদ্ধিহীন, ভয়ংকর এবং নৃশংস প্রাণী।

রিরা একটা নিশ্বাস ফেলল, বলল, আমার জীবনে যেন যথেষ্ট উত্তেজনা নেই—এখন। বুদ্ধিহীন ভয়ংকর নৃশংস প্রাণীর সাথে সময় কাটাতে হবে! কপালটা দেখেছ? এর চাইতে ভালো কোনো গ্রহ আছে?

না। অন্য গ্রহগুলো বড় এবং অস্থিতিশীল। জি-এর মান এত বেশি যে নিজের শরীরের ওজনেই মারা পড়বে।

বেশ, তা হলে বুদ্ধিহীন ভয়ংকর এবং নৃশংস প্রাণীর গ্রহটাতেই নামার ব্যবস্থা কর।

কাজটি জটিল এবং বিপজ্জনক।

আমি জানি। রিরা হাসার চেষ্টা করে বলল, বেঁচে থাকার প্রক্রিয়াটাই জটিল এবং বিপজ্জনক। তবুও কি আমরা বেঁচে থাকার চেষ্টা করি না?

মহাকাশযানের কিছু গুরুত্বপূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নষ্ট হয়েছে—অবতরণ করাটি প্রায় দুঃসাধ্য।

তুমি কিছু চিন্তা করো না রিরা মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, আমি তোমাকে সাহায্য করব।

তুমি আমাকে সাহায্য করবে?

হ্যাঁ। এত অবাক হচ্ছ কেন?

মূল প্রসেসর শুষ্ক এবং ভাবলেশহীন কণ্ঠে বলল, আমি অবাক হচ্ছি না। সত্যি কথা বলতে কী, অবাক বা রাগ হওয়ার মতো মানবিক ক্ষমতাগুলো আমাদের নেই। তবে ঘোর অবাস্তব পরিকল্পনা আমরা নিরুৎসাহিত করি।

আমরা করি না। রিরা গলায় খানিকটা উৎফুল্ল ভাব ফুটিয়ে বলল, মহাকাশ একাডেমিতে বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে মহাকাশযান অবতরণের ওপরে আমার একটি কোর্স ছিল। দেখা যাক যেসব বিষয় শিখিয়েছে সেটা সত্যি কি না!

মহাকাশযানের মূল প্রসেসর কোনো কথা না বলে শুধুমাত্র একটা যান্ত্রিক দীর্ঘশ্বাসের মতো শব্দ করল।

 

প্রথমে মহাকাশযানটিকে গ্রহের কক্ষপথে আটকে নিতে হল, পুরো কাজটি ছিল অত্যন্ত বিপজ্জনক। নিউট্রন স্টারের পাশ দিয়ে যাবার সময় এটি যে বিশাল গতিবেগ সঞ্চয় করেছে, তার প্রায় পুরোটুকুই কমিয়ে আনতে হল। ক্ষতিগ্রস্ত ইঞ্জিন দিয়ে সেই কাজটি করা খুব কঠিন। প্রথম কক্ষপথটি হল বিশাল, খুব ধীরে ধীরে সেই কক্ষপথ ছোট করে আনতে শুরু করে। গ্রহের বায়ুমণ্ডলের ঠিক বাইরে পুরোপুরি বৃত্তাকার কক্ষপথে মহাকাশযানটিকে আবদ্ধ করে নেওয়ার পর রিরা গ্রহটির খুঁটিনাটির দিকে নজর দিল। উঁচু-নিচু পাথরে ঢাকা বিশাল একটি গ্রহ, একটা বড় অংশ সাদা বালু দিয়ে ঢাকা। মহাকাশযানটিকে নামানোর জন্য একটা সমতল জায়গা প্রয়োজন। শেষবার মানুষ যেখানে বসতি করেছিল, তার আশপাশে নামতে পারলে সবচেয়ে ভালো, অনেক ভাবনা-চিন্তা করে নিশ্চয়ই জায়গাটা ঠিক করা হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত অবিশ্যি কোনো মানুষই বেঁচে থাকে নি—তবে সেটা ভিন্ন কথা। সেটা নিয়ে পরে দুশ্চিন্তা করলেও হবে।

মহাকাশযানটি প্রতি ঘণ্টায় একবার পুরো গ্রহটি প্রদক্ষিণ করছে শক্তিশালী টেলিস্কোপ দিয়ে রিরা গ্ৰহটাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল। বুদ্ধিহীন ভয়ংকর এবং নৃশংস প্রাণী থাকার কথা কিন্তু মহাকাশ থেকে সেগুলো চোখে পড়ল না।

গ্রহটিতে বেশ লম্বা একটা সমতল জায়গা খুঁজে বের করে রিরা মহাকাশযানের মূল প্রসেসরের সাথে কথা বলতে শুরু করে। বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করার পর প্রচণ্ড ঘর্ষণে মহাকাশযানের বাইরের অংশ ভয়ংকর উত্তপ্ত হয়ে উঠবে, অন্য সময় সেটি একটি বড় সমস্যা, কিন্তু এখন রিরা সেটি নিয়ে মাথা ঘামাল না এই মহাকাশযানটিকে অক্ষত রাখার কোনো কারণ নেই, গতিবেগ কমিয়ে কোনোভাবে গ্রহটির শক্ত মাটিতে নামিয়ে স্থির করতে পারলেই হবে—তার ফলে মহাকাশযানের যে ক্ষতি হয় হোক! বিশাল মহাকাশযানের দুইতিনটি ছোট কেবিন অক্ষত থাকলেই সে দীর্ঘ সময় বেঁচে থাকতে পারবে। এই মহাকাশযানটি নিয়ে সে এমনিতেই আর কখনো মহাকাশে উঠতে পারবে না।

বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করতে শুরু করার পর হঠাৎ রিরার নীলমানবটির কথা মনে পড়ল। পরবর্তী এক ঘণ্টা অত্যন্ত বিপজ্জনক সময় মহাকাশযানের মূল প্রসেসরের হিসেবে ঠিকভাবে অবতরণ করার সম্ভাবনা শতকরা মাত্র দশ ভাগ। এই সময়টিতে মহাকাশযান নানারকম ঝড়-ঝাঁপটার মাঝে পড়বে। মহাকাশচারীদের বিশেষ পোশাক পরে জীবন। সংরক্ষণ মডিউলে বসে থাকার কথা—রিরা নিজেও তার কিছু করে নি। নীলমানবটির অবস্থা আরো খারাপ; একটা ছোট ঘরে তালাবদ্ধ অবস্থায় আছে। যদি বড় দুর্ঘটনা হয়, নীলমানবটি খাচায় আটকে থাকা ইঁদুরের মতো মারা পড়বে। রিরা জোর করে তার মাথা থেকে চিন্তাটি সরিয়ে দিল।

বিশাল মহাকাশযানটি বায়ুমণ্ডলের ভেতরে ঢুকতে শুরু করেছে, বাতাসের ঘর্ষণে মহাকাশযানের বাইরের অংশ উত্তপ্ত হতে শুরু করেছে। রিরা মনিটরে দেখতে পেল, তাপমাত্রা বিপজ্জনক সীমার কাছে পৌঁছে গেছে। বাতাসের ঝাঁপটাটি এসে লাগছে মহাকাশযানের নিচের অংশে—বিশেষ তাপ অপরিরাহী পদার্থ দিয়ে তৈরি অংশটুকু আগুনের মতো গরম হয়ে উঠেও তাপকে ভেতরে যেতে দিচ্ছে না। রিরা মহাকাশযানের ভেতরে এখনো কোনো বাড়তি তাপমাত্রা অনুভব করছে না।

মহাকাশযানটি থরথর কাঁপছে, রিরা মনিটরে দেখতে পায় আগুনের ফুলকির মতো ছোট ছোট ধাতব কণা মহাকাশযানের পাশ দিয়ে ছুটে যাচ্ছে। হঠাৎ একটা বিস্ফোরণের শব্দ হল, ভয়ংকর ঝাকুনি দিয়ে পুরো মহাকাশযানটি প্রায় উল্টে যেতে গিয়ে আবার স্থির হয়ে গেল সম্ভবত একটি এন্টেনা বাতাসের ঝাঁপটায় ভেঙে উড়ে গেছে, খুব সাবধানে সে বুকের ভেতরে চাপা থাকা একটা নিশ্বাস বের করে দেয়।

রিরা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মনিটরের দিকে তাকিয়ে গতিবেগ দেখতে থাকে, ধীরে ধীরে সেটি কমতে শুরু করেছে। ঘণ্টায় হাজার কিলোমিটারে নেমে আসার পর সে মহাকাশযানের দুটি পাখা বের করে দেবার চেষ্টা করবে। যেহেতু এখানে বায়ুমণ্ডল আছে সে সেখানে ভেসে থাকার সুযোগটা নিতে চায়।

আবার একটা ভয়ংকর বিস্ফোরণের শব্দ হল, মহাকাশযানটি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে যেতে শেষমুহূর্তে নিয়ন্ত্রণে চলে এল। ভয়ংকর ঝাঁকুনি দিতে শুরু করেছে, ভেতরে বিকট শব্দ হচ্ছে, মনে হচ্ছে বিশাল এই মহাকাশযানটিকে কেউ যেন দুমড়ে-মুচড়ে ভেঙে টুকরো টুকরো করে ফেলছে। ভেতরের তাপমাত্রা বেড়ে যেতে শুরু করেছে, তার সাথে একটা পোড়া গন্ধ। এভাবে বেশিক্ষণ চলতে থাকলে পুরো মহাকাশযানটি জ্বলেপুড়ে শেষ হয়ে যাবে। রিরা নিশ্বাস বন্ধ করে মহাকাশযানের কন্ট্রোল স্টিয়ারিং ধরে রাখে, খুব ধীরে ধীরে গতিবেগ কমে আসছে, শব্দের গতিবেগের নিচে নেমে আসার পর ভয়ংকর শব্দে সনিক বুমটি শুনতে পেল—রিরা বুকের ভেতর আটকে থাকা নিশ্বাসটি বের করে দেয়, বিপদের প্রথম ধাক্কাটি শেষ হয়েছে বায়ুমণ্ডল ভেদ করে সে মহাকাশযানটিকে গ্রহের ভেতরে নিয়ে এসেছে। এখন দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। মহাকাশযানটিকে শক্ত মাটির উপরে নামানো। একটু ভুল হলেই এটি মুহূর্তের মাঝে বিধ্বস্ত হয়ে যাবে।

রিরা মনিটরের দিকে তাকাল, এটি দ্রুত নিচে নামছে—এই গতিতে নিচে নামতে থাকলে কোনোভাবেই মহাকাশযানটিকে রক্ষা করা যাবে না। রিরা কন্ট্রোলরুমের স্টিয়ারিং টেনে পাখা দুটো বের করার চেষ্টা করল, শক্ত স্টিয়ারিং নড়তে চায় না, পুরো শরীর দিয়ে ধাক্কা দিয়ে শেষ পর্যন্ত টেনে আনতে পারল, প্রায় সাথে সাথে সে ঘরঘর একটা শব্দ শুনতে পায়। মহাকাশযানের মূল ইঞ্জিন তার মোটর চালু করে পাখা দুটো বের করতে শুরু করেছে। রিরা নিশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকে, মোটরের ঘরঘর শব্দ বন্ধ হবার পর সে স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। মহাকাশযানটিকে রক্ষা করার সম্ভাবনা এখন আরো কয়েক গুণ বেড়ে গেছে।

বিশাল পাখা মেলে অতিশয় একটা পাখির মতো এই মহাকাশযানটি নিচে নেমে আসতে শুরু করেছে। পাখার নিচে ছোট ছোট জেট ইঞ্জিন রয়েছে, থেমে যাবার আগের মুহূর্তে সেগুলো চালু হয়ে মহাকাশযানটিকে সাবধানে নিচে নামিয়ে আনার কথা। কতগুলো জেট চালাতে পারবে সেটি রিরা জানে না, নীলমানদের সাথে সংঘর্ষের সময় তাদের অনেক জ্বালানি নষ্ট হয়েছে।

রিরা তীক্ষ্ণ চোখে মনিটরের দিকে তাকিয়ে থাকে—এতক্ষণ পর্যন্ত সবকিছু পরিকল্পনা মতো কাজ করেছে—যদিও একেবারে শেষ অংশটুকু হচ্ছে সবচেয়ে কঠিন এবং সবকিছু পরিকল্পনা মতো কাজ করা পুরোপুরি অর্থহীন হয়ে যাবে, যদি শেষটুকু ঠিকভাবে সমাপ্ত না হয়। রিরা এই দীর্ঘসময় একটিবারও মূল প্রসেসরের সাথে কথা বলে নি—এই প্রথম সে খানিকটা সময় পেয়েছে। চাপা গলায় সে ডাকল, প্রসেসর।

বলো রিরা।

সবকিছু কি ঠিক আছে?

প্রায়।

প্রায় কেন বলছ?

মহাকাশযানের দুটি পাখা অনেকটুকু জায়গা নিয়ে নিয়েছে।

সে তো নেবেই। এত বড় মহাকাশযানকে ভাসিয়ে রাখতে হলে কয়েক কিলোমিটার লম্বা পাখা লাগার কথা।

মূল প্রসেসর শান্ত গলায় বলল, আমি এবোডিনামিক্স নিয়ে প্রশ্ন করছি না।

তা হলে কী নিয়ে প্রশ্ন করছ?

মহাকাশযানটিকে সফলভাবে নামার ব্যাপারে প্রশ্ন করছি।

রিরা নিশ্বাস বন্ধ করে বলল, সফলভাবে নামার ব্যাপারে তোমার কী প্রশ্ন?

এটি একটি পাথুরে গ্রহ। পুরো গ্রহটিতে উঁচু-নিচু পাথর। তার একটা বড় সমস্যা আছে।

রিরা দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে বলল, পাথরের আঘাত খেয়ে পাখা ভেঙে যাবে?

হ্যাঁ।

কত উঁচুতে ভাঙবে?

একেবারে নিখুঁতভাবে বলা যাচ্ছে না। গ্রহটাতে এক ধরনের ঝড়ো হাওয়া বইছে, মহাকাশযানটা ঠিক কোথায় নামবে বলা যাচ্ছে না। রাডার জ্বলেপুড়ে গেছে—কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই নিশ্চয়ই জান।

রিরা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তুমি এটা আমাকে আগে কেন বলো নি?

বলে লাভ কী? শুধু শুধু তুমি পুরো সময়টা দুশ্চিন্তা করতে। এখন দুশ্চিন্তা করবে শেষ কয়েকটি মুহূর্ত।

শেষ মুহূর্ত কি চলে এসেছে?

হ্যাঁ। আমার সুপারিশ হবে তুমি এখন মহাকাশযানের নিরাপত্তা পোশাক পরে নাও। আর সময় নেই।

রিরা উঠে দাঁড়াল। মনিটরের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ সে আতঙ্ক অনুভব করে। গ্রহটির অনেক নিচে নেমে এসেছে। যে গ্ৰহটাকে মহাকাশ থেকে মোটামুটি সমতল মনে হয়েছে মাটির কাছাকাছি এসে দেখা যাচ্ছে সেটা মোটেও সমতল নয় বড় বড় পাথর ছড়িয়েছিটিয়ে আছে। হঠাৎ হঠাৎ অনেক পাথর উঁচু হয়ে আছে। নিয়ন্ত্রণহীন একটা বড় পাখির মতো মহাকাশযানটি নিচে নেমে আসছে। ঠিক সোজাসুজি নামছে না, দুলতে দুলতে নামছে। মহাকাশযানের মাঝে আর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না।

রিরা সাবধানে দেয়াল ধরে অগ্রসর হতে শুরু করে। মূল প্রসেসর বলল, তুমি উল্টোদিকে যাচ্ছ রিরা, নিরাপত্তা পোশাকগুলো অন্যদিকে রাখা।

আমি জানি।

তা হলে?

একটা নীলমাকে একটা ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখা আছে। তালাটা খুলে দিই।

কেন?

মহাকাশযান বিধ্বস্ত হয়ে গেলে সে খাঁচায় আটকে পড়া ইঁদুরের মতো মারা যাবে।

তাতে কী আসে যায়? নীলমানব মানুষ নয়—তাদের জীবন রক্ষা করার দায়িত্ব তোমার নয়। তা ছাড়া–

তা ছাড়া কী?

তা ছাড়া সে মুক্ত হতে পারলে নিশ্চিত তোমাকে হত্যা করবে।

রিরা কয়েক মুহূর্ত দ্বিধা করে বলল, তোমার তা-ই ধারণা?

এটি আমার ধারণা নয়। আমি নিশ্চিতভাবে জানি। আমি চাই তুমি সুযোগ। থাকতেই তাকে গুলি করে হত্যা কর। সরাসরি মস্তিষ্কে আট পয়েন্টের একটি গুলি। করা হলে হত্যাকাণ্ডটি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যাবে। তুমি স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি নিয়ে যাও।

স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটি নিয়ে যাব?

হ্যাঁ। মহাকাশযানের মূল প্রসেসর তার যান্ত্রিক কণ্ঠে খানিকটা ব্যস্ততার ভাব ফুটিয়ে বলল, কোনো একটা উঁচু পাথরে আঘাত লেগে মহাকাশযানটি বিধ্বস্ত হয়ে গেলে বন্দি নীলমানবটির ঘরের দরজা বা দেয়াল ভেঙে যেতে পারে, সে তখন বের হয়ে আসতে পারে।

রিরা দ্বিধান্বিতভাবে বলল, কিন্তু—

কিন্তু কী?

মানুষকে যেসব জিনিস শেখানো হয়, তার একটি হচ্ছে কখনো বন্দি মানুষকে হত্যা না করা। তার চাইতে বড় কোনো কাপুরুষতা হতে পারে না।

নীলমানব মানুষ নয়। তাকে ভিন্ন কোনো প্রাণী হিসেবে বিবেচনা করতে পার।

রিরা মাথা নাড়ল, বলল, বন্দি হচ্ছে বন্দি। মানুষ কিংবা অন্য যে কোনো প্রাণীই হোক কেন।

মহাকাশযানের মূল প্রসেসব কঠোর কণ্ঠে বলল, তোমার এই ছেলেমানুষি যুক্তির কারণে তুমি ভয়ংকর বিপদগ্রস্ত হবে।

রির উত্তরে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু হঠাৎ করে প্রচণ্ড আঘাতে পুরো মহাকাশযানটি কেঁপে উঠল। ভয়ংকর শব্দে তার কানে তালা লেগে যায়, মহাকাশযানটি পাক খেয়ে উল্টে যেতে থাকে প্রচণ্ড আঘাতে রিরা ছিটকে পড়ে। বিকট বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পেল সে—মহাকাশযানটি দুমড়ে-মুচড়ে ভেঙেচুরে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে। রিরার মনে হতে থাকে সে কোথাও পড়ে যাচ্ছে হাত বাড়িয়ে কিছু একটা ধরার চেষ্টা করে কিন্তু কিছুই ধরতে পারে না সে। কেউ একজন চিৎকার করছে অমানুষিক গলায়, কালো ধোঁয়ায় ঢেকে যাচ্ছে মহাকাশযানটি, পোড়া গন্ধে নিশ্বাস নিতে পারছে না রিরা। কিছু একটা প্রচণ্ড শব্দে ভেঙে পড়ল, আগুনের হলকার মতো কিছু একটা অনুভব করল রিরা। ভয়ংকর অমানুষিক যন্ত্রণায় শরীরের ভেতরে কুঁকড়ে উঠতে থাকে। মহাকাশযানের আলো নিভে গেল হঠাৎ রিরা ওঠার চেষ্টা করতে থাকে কিন্তু উঠতে পারে না। কোনো একটা ধাতব বিমের নিচে আটকা পড়ে গেছে। প্রাণপণে বের হতে চেষ্টা করছে কিন্তু বের হতে পারছে না, শরীরের একটা অংশ আটকা পড়ে গেছে তার। ঘুটঘুটে অন্ধকারে দেখার চেষ্টা করছে রিরা কিন্তু সে কিছুই দেখতে পারছে না। খানিকটা বাতাসের জন্য বুকের ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে কিন্তু সে নিশ্বাস নিতে পারছে না। অমানুষিক যন্ত্রণায় চিৎকার করতে চেষ্টা করে কিন্তু তার গলা থেকে কোনো আওয়াজ বের হয় না।

রিরা হঠাৎ করে অনুভব করে, গাঢ় অন্ধকারে সে তলিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। মনে হতে থাকে আর কখনোই সে এই অন্ধকার থেকে বুঝি উঠে আসতে পারবে না।