০৫. চিত্ৰকলা : আনুমানিক ১০০০—১২৫০ খ্ৰীষ্ট শতক

চিত্ৰকলা : আনুমানিক ১০০০—১২৫০ খ্ৰীষ্ট শতক

প্রাচীন বাঙলার কোনও স্থানেই এ-যাবৎ প্রাক-পালযুগের চিত্রকলার কোনও নিদর্শন আবিষ্কৃত হয় নাই। কিন্তু ফা-হিয়েনের বিবরণীতে একটি ইঙ্গিত আছে যাহাতে মনে হয় খ্রীষ্টোত্তর চতুর্থ শতকে তাম্রলিপ্তিতে (এবং বোধ হয় বাঙলার অন্যত্রও) চিত্রশিল্পরচনার অভ্যাস পরিচিত ও প্রচলিত ছিল। তাহা ছাড়া, সমসাময়িক ভারতবর্ষে অন্যত্র যেমন, বাঙলাদেশেও বোধ হয় তেমনই লোকায়ত সংস্কৃতিতে পটচিত্র, ধুলিচিত্র প্রভৃতি অজ্ঞাত ছিল না। তাহারই ধারা প্রবাহমান দেখিতে পাওয়া যায় অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতকের বাঙলাদেশের জড়ানো পটের ছবিতে, আলপনায়, ফরিদপুর-যশোহর বীরভূম-বাঁকুড়া মেদিনীপুর-কালীঘাটের বিচ্ছিন্ন পটের নানা চিত্রে। যাহাই হউক, প্রাচীন শিল্পশাস্ত্র ও সাহিত্য-গ্ৰস্থাদি হইতে জানা যায়, বিহার-মন্দিরের প্রাচীরগাত্ৰ চিত্ৰশোভিত করার শাস্ত্রীয় নির্দেশ একটা ছিল; কাজেই অনুমান করা কঠিন নয় যে, ভারতের অন্যান্য প্রান্তের মতো প্রাচীন বাঙলার অনেক বিহার-মন্দিরের প্রাচীরগাত্ৰই চিত্রদ্বারা শোভিত ছিল। কিন্তু বিহার-মন্দিরই যেখানে ধ্বংসের হাত এড়াইতে পারে নাই। সেখানে প্রাচীর-চিত্রেরা-নিদর্শন আমাদের কালে আসিয়া পৌঁছিবার কথা নয়। প্রাচীন পটচিত্র বা ধুলিচিত্রের কোনও নিদর্শনও এ-যাবৎ আমরা জানি না।

বাঙলার চিত্রকলার প্রাচীনতম যে-সব নিদর্শন এ-পর্যন্ত জানা গিয়াছে তাহা প্রায় সমস্তই একাদশ ও দ্বাদশ শতকের এবং প্রত্যেকটিই পাণ্ডুলিপি-চিত্র, অর্থাৎ তালপাতায় বা কাগজে হাতের লেখা পুঁথি অলংকরণোদ্দেশ্যে আঁকা ছবি। স্বভাবতই ছবিগুলি স্বল্পায়তন, কিন্তু তৎসত্ত্বেও স্বল্পায়তন পাণ্ডুলিপি-চিত্রের যাহা বিশেষ বিশেষ বৈশিষ্ট্য, অর্থাৎ সূক্ষ্ম রেখার ধীর অথচ তীক্ষ্ণগতি, সূক্ষ্ম ও ঘন কারুকার্য, বিন্যাসের ঘনত্ব ও গভীর ভাবনা-কল্পনার অনুপস্থিতি প্রভৃতি এই পাণ্ডুলিপি-চিত্রগুলিতে নাই। সেই জনাই ইংরাজিতে miniature বলিতে যাহা আমরা বুঝি এই পাণ্ডুলিপি-চিত্রগুলি সেই বস্তু নয়। আয়তন ক্ষুদ্র হওয়া সত্ত্বেও এই পাণ্ডুলিপি-চিত্রগুলির ভাবনা-কল্পনার আকাশ বিস্তৃত ও গভীর, পরিকল্পনা বৃহৎ রেখার ডৌল ও বিস্তার দীর্ঘািয়ত, রঙের বিন্যাস মণ্ডন প্রশস্তায়িত। এই দীর্ঘ, প্রশস্ত ও বৃহৎ বিস্তার একান্তই বৃহদায়তন প্রাচীর-চিত্রের। রাস্তুত, প্রাচীর-চিত্রে লক্ষণই এই পাণ্ডুলিপি-চিত্রগুলিরও লক্ষণ; প্রাচীর-চিত্রই যেন পাণ্ডুলিপি-পত্রের সংকীর্ণ সীমার মধ্যে স্বল্পায়তনে অঙ্কিত। সমসাময়িক বাঙলার, এক কথায় পূর্ব-ভারতের পাণ্ডুলিপি-চিত্রের এই বিশেষ বৈশিষ্ট্য স্মরণ-রাখা প্রয়োজন। ইহারা আকারে ক্ষুদ্র, চরিত্রে বৃহদায়তন; ক্ষুদ্র চিত্রের বৈশিষ্ট্য ইহাদের মধ্যে অনুপস্থিত।

এ-পর্যন্ত চিত্র-সম্বলিত পাণ্ডুলিপি প্রায় কুড়ি-বাইশখন পাওয়া গিয়াছে; ইহাদের মধ্যে মাত্র একখানা কাগজের পাতায় লেখা (আশুতোষ-চিত্রশালা) এবং ছবিও কাগজের পাতায় আঁকা— লেখার মাঝখানে সমান্তরালে; অন্য সব ক’টিই তালপাতার পুঁথি। কাগজের পাতার পুঁথিটি বাঙলাদেশে কাগজ ব্যবহারের সর্বপ্রাচীন নিদর্শন। এই পাণ্ডুলিপিগুলির অধিকাংশই পাওয়া গিয়াছে নেপালে, কয়েকটি বাঙলাদেশে এবং কয়েকটি বাঙলার বাহিরে অন্যত্র (যেমন, কুলু-উপত্যকা-প্রবাসী স্বেতোস্লাভ রোয়েরিক মহাশয়ের সংগ্রহের একটি সুবৃহৎ পাণ্ডুলিপি)। তবে ইহাদের প্রায় প্রত্যেকটিই যে দশম হইতে দ্বাদশ শতকের মধ্যে পূর্ব-ভারতে, বিশেষ ভাবে বাঙলাদেশে লিখিত ও চিত্রিত হইয়াছিল, চিত্ৰশৈলী এবং তারিখ-সম্বলিত কয়েকটি পাণ্ডুলিপিই তাহার প্রমাণ। এ-পর্যন্ত যে ক’টি চিত্র-সম্বলিত পাণ্ডুলিপির খবর আমরা জানি সেগুলি এখানে তালিকাগত করা যাইতে পারে।

চিত্ৰ-সম্বলিত পাণ্ডুলিপির তালিকা

১-২. পালরাজ মহীপালদেবের রাজত্বের পঞ্চম ও ষষ্ঠ বৎসরে অনুলিখিত ও চিত্রিত অষ্টসাহস্ত্ৰিক প্রজ্ঞাপারমিতার দুইটি পাণ্ডুলিপি (কেমব্রিজ-বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের ১৪৬৪ নং এবং কলিকাতা-রয়্যাল-এসিয়াটিক-সোসাইটির ৪৭১৩ নং পাণ্ডুলিপি)।

৩. পালরাজ রামপালের শাসনকালের ৩৯তম বৎসরে অনুলিখিত ও চিত্ৰিত অষ্টসাহিত্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতার একটি পাণ্ডুলিপি (এক সময়ে এই পুঁথিটি ব্ৰেণ্ডেনবুর্গ সাহেবের সংগ্রহে ছিল)।

৪-৫. দুইটি অষ্টসাহস্ত্ৰিকা প্রজ্ঞাপারমিতার পাণ্ডুলিপি (রাজশাহী-বরেন্দ্র-অনুসন্ধান-সমিতির সংগ্ৰহ); ইহার একটি পাণ্ডুলিপি লিখিত ও চিত্রিত হইয়াছিল। বৰ্মণরাজ হরিবর্মার রাজত্বের ১৯তম বৎসরে। অন্যটিতে কোনও তারিখ নাই, তবে চিত্ৰশৈলী-সাক্ষ্যে মনে হয় দ্বাদশ শতকের কোনও সময়ে এই পাণ্ডুলিপিটি লিখিত ও চিত্রিত হইয়াছিল।

৬. কলিকাতা [রয়াল]-এসিয়াটিক-সোসাইটি — গ্রন্থাগারের একটি অষ্টসাহস্ত্ৰিকা প্রজ্ঞাপারমিতার পাণ্ডুলিপি (এ-১৫ নং); খ্রীষ্টোত্তর ১০৭১ অব্দে লিখিত ও চিত্ৰিত।

৭-৮. রাজশাহী-বরেন্দ্ৰ – অনুসন্ধান-সমিতির গ্রন্থাগারে রক্ষিত কারণ্ডবৃহ এবং বোধিচর্যবিতারের দুইটি-পাণ্ডুলিপি। একটিতেও তারিখ নাই, তবে শৈলী-সক্ষ্যে মনে হয় দ্বাদশ শতক।

৯. বোস্টন-চিত্রশালার ২০৫৮৯ নং পাণ্ডুলিপি; পালরাজ (তৃতীয়?) গোপালদেবের চতুর্থ রাজ্যাঙ্কে লিখিত ও চিত্ৰিত।

১০. জাপানের সোয়ামুরা পাণ্ডুলিপি। তারিখ নাই, তবে পালশিল্পের এবং সমসাময়িক নাগরী অক্ষরের স্বাক্ষর সুস্পষ্ট।

১১. লণ্ডন-ব্রিটিশ-মুজিয়ুমের একটি অষ্টসাহফ্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতার পাণ্ডুলিপি পালরাজ (তৃতীয়?) গোপালদেবের পঞ্চদশ রাজ্যাঙ্কে লিখিত ও চিত্রিত (OR 6902)।

১২-১৩. কেমব্রিজ-বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে রক্ষিত পঞ্চরক্ষার একটি পাণ্ডুলিপি; এই পাণ্ডুলিপিটি পাল-রাজ নরপালের চতুর্দশ রাজ্যাঙ্কে লিখিত ও চিত্রিত। আরও একটি অজ্ঞাতনামা-গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি (Add No. 1643)। লিখন ও চিত্রণের তারিখ ১০১৫ খ্রী।

১৪. কলিকাতা রিয়্যাল]-এসিয়াটিক-সোসাইটি গ্রন্থাগারে রক্ষিত ও অষ্টসাহিত্রিকা প্রজ্ঞাপারমিতার একটি পাণ্ডুলিপি (৪২০৩ নং) ২ লিখন ও চিত্রণের তারিখ নেপালী সম্বৎ ২৬৮=১১৪৮ খ্রী।।

১৫. কলিকাতা [রয়্যাল]-এসিয়াটিক-সোসাইটি গ্রন্থাগারে রক্ষিত ৯৭৮৯ নং পাণ্ডুলিপি; পাল-রাজ গোবিন্দপালের অষ্টাদশ রাজ্যাঙ্কে লিখিত ও চিত্ৰিত।

১৬. কলিকাতা অজিত ঘোষ-সংগ্রহের একটি পাণ্ডুলিপি; নাম ও তারিখ অজ্ঞাত; চিত্ৰশৈলীতে পাল-আমলের পূর্ব-ভারতীয় স্বাক্ষর সুস্পষ্ট।

১৭. কুলু-উপত্যকা-প্রবাসী স্বেতোস্লাভ রোয়েরিক মহাশয়ের সংগ্রহে একশত ছাব্বিশটি চিত্রসহ গণ্ডৰূহের একটি সুদীর্ঘ পাণ্ডুলিপি। তারিখ অজ্ঞাত; কিন্তু চিত্রশৈলীতে পোল আমলের পূর্ব ভারতীয় স্বাক্ষর সুস্পষ্ট।

১৮. কলিকাতা রিয়্যাল]-এসিয়াটিক-সোসাইটির গ্রন্থাগারে রক্ষিত শিবপূজা ও শৈবধর্ম সম্বন্ধীয় একাধিক শৈব্যগ্রন্থের পাণ্ডুলিপি; এই পাণ্ডুলিপির কাঠের পটার ভিতরের দিকে আঁকা দশ-বারোটি ছবি। তারিখ অজ্ঞাত, তবে শৈলীসংক্ষ্যে পাল-পর্বের স্বাক্ষর সুস্পষ্ট।

১৯. অক্সফোর্ড বড়লেয়ান গ্রন্থাগারে রক্ষিত একটি পাণ্ডুলিপি এই পাণ্ডুলিপিগুলি ছাড়া আরও দুই চারিখানা চিত্রিত পাণ্ডুলিপি ইতস্তত জ্ঞাত থাকা বিচিত্র নয়। তাহা ছাড়া, মাঝে মাঝে নূতন নূতন চিত্রিত পাণ্ডুলিপির খবরও পাওয়া যায়।।

এ-তথ্য পরিষ্কার যে, একটি মাত্ৰ পাণ্ডুলিপি ছাড়া উপরোও প্রত্যেকটি পাণ্ডুলিপি বৌদ্ধধর্ম সম্বন্ধীয় এবং প্রায় সকল চিত্ৰই মহাযান-বজযান-তন্ত্রযান ধর্মমতসম্মত দিবদেবীর প্রতিকৃতি। একটি মাত্র পাণ্ডুলিপি শৈবধর্ম সম্পর্কিত এবং উহার চিত্রগুলি লিঙ্গ ও ব্রাহ্মণ্যদেবদেবীর প্রতিরূপ। এই পাণ্ডুলিপি-চিত্রগুলি ছাড়া তাম্রপট্টে উৎকীর্ণ স্বল্পায়তন রেখাচিত্রের খবরও আমরা জানি; এই রেখাচিত্র তিনটিও একাদশ-দ্বাদশ শতকীয় চিত্রশিল্পের নিদর্শন হিসাবে গণ্য করা যাইতে পারে। ইহাদের বিষয়বস্তু ব্ৰাহ্মণ্য দেবদেবী।

কয়েকটি সাধারণ মন্তব্য

বলিয়াছি, প্রায় সকল চিত্ৰই মহাযান-বজ্ৰযান-তন্ত্রযান ধৰ্মসম্মত দেবদেবীর প্রতিকৃতি। কায়সাধনের নির্দিষ্ট ধ্যানানুযায়ী বিশেয বিশেষ সম্প্রদায়ের বিভিন্ন দেবদেবী, যথা, লোকনাথ, তারা, মহাকাল, অমিতাভ, অবলোকিত, মৈত্ৰেয়, বজ্ৰপাণি, আকাশগর্ভ প্রভৃতি ও তাঁহাদের সহচর-সহচরীদের প্রতিমাই পাণ্ডুলিপি-পত্রের সীমার মধ্যে রঙে ও রেখায় রূপায়িত। এই চিত্রগুলির সাহায্যে বোজযান-তন্ত্রযান সাধনে বণিতেঁ দেবদেবীদের অনেকের পরিচয় সহজতর হয়; বিশেষত ইহাদের মধ্যে অনেকে আছেন সমসাময়িক ভাস্কর্যে র্যাহাঁদের পরিচয় পাওয়া যায় না। কয়েকটি ছবিতে দেখিতেছি, জাতকের কাহিনী বা বুদ্ধদেবের জীবনকাহিনীও চিত্ররূপ লাভ করিয়াছে। বলা বাহুল্য, সমসাময়িক অভিজাত নায়ক, ধর্মযাজক এবং বিত্তশালী শ্রেণীর লোকদের পৃষ্ঠপোষকতায়ই এই সব পাণ্ডুলিপি অনুলিখিত ও চিত্রগুলি রূপায়িত হইত। সুতরাং সুমকি ভাস্কর্য ও স্থাপত্যকলার যাহা সামাজিক প্রেরণা ও পরিবেশ, চিত্রকলার ক্ষেত্রেও তাহাই।

বর্তমানে বাঙলা ভাষাভাষী লোকদের যে ভৌগোলিক সীমা, সব পাণ্ডুলিপিই যে সেই সীমার মধ্যেই লিখিত ও চিত্রিত হইয়াছিল, এ-কথা জোর করিয়া বলা যায় না। কয়েকটি পাণ্ডুলিপি বিহারে এবং কয়েকটি আবিষ্কৃত হইয়াছে নেপালে; হয়তো লেখা ও আঁকার কাজটাও সেখানেই হইয়া থাকিবে; কিন্তু শৈলী-প্রমাণের দিক হইতে স্বীকার করিতেই হয়, ভৌগোলিক সীমাগত এই পার্থক্য চিত্রশৈলীতে কোনও পার্থক্য রচনা করে নাই। বস্তুত, বাঙলা-বিহার-নেপালের সমসাময়িক চিত্রশিল্প একই শিল্পধারার সৃষ্টি বলিলে অনৈতিহাসিক কিছু বলা হয় না। কয়েকটি পাণ্ডুলিপি তো নিঃসংশয়ে বাঙলাদেশেই লিখিত ও চিত্রিত হইয়াছিল, (যেমন, হরিবর্মার উনবিংশ রাজ্যাঙ্কের পাণ্ডুলিপিটি); ইহাদের চিত্রগুলির সঙ্গে বিহার বা নেপাল বা পূর্ব-ভারতে অন্যত্র আবিষ্কৃত পাণ্ডুলিপি-চিত্রের মূলগত পার্থক্য কোথাও কিছু নাই। এই চিত্রশিল্প একান্তই প্রাচ্য-ভারতীয় চিত্ৰশিল্পধারার সৃষ্টি এবং সে—ধারার কেন্দ্র ছিল পাল-ঐতিহ্যসমৃদ্ধ বাঙলাদেশ এবং কিয়দংশে বিহার।

বলিয়াছি, এই চিত্রগুলিতে পাণ্ডুলিপি-চিত্রণের বিশেষ স্বতন্ত্র কোনও ভঙ্গির পরিচয় নাই। চীন, ইরাণ, মধ্যযুগীয় যুরোপ বা মধ্যযুগীয় ভারতবর্ষে স্বল্পায়তন পুঁথিচিত্রের যে বিশেষ বিশেধ ভঙ্গির সঙ্গে আমাদের পরিচয়, তাহার সঙ্গে এই পাণ্ডুলিপি-চিত্রগুলির কোথাও কোনও মিল নাই। বস্তুত, এই চিত্রগুলি ক্ষুদ্রাকৃতি প্রাচীর-চিত্র; প্রাচীর চিত্রকেই যেন ধরা হইয়াছে পুঁথিচিত্রের সীমার মধ্যে। আর একটি তথ্যও একটু লক্ষণীয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পাণ্ডুলিপির বিষয়বস্তুর সঙ্গে চিত্রগুলির বিষয়বস্তুর বিশেষ কোনও যোগ নাই; চিত্রগুলির সাধারণত কোনও কোনও মন্দিরের অথবা দেবদেবীর অথবা উভয়েই প্রতিরূপ মাত্র। ইহাদের উদ্দেশ্য পুঁথির শোভাবর্ধন করা, বিষয়বস্তুকে উজ্জ্বল করা নয়।

ছবিগুলিতে যে-সব রং ব্যবহার করা হইয়াছে তাহার মধ্যে হরিতালের হলুদ, খড়িমাটির সাদা, গাঢ় নীল (অজস্তার পাথুরে নীল নয়), প্রদীপের শীষের কালো, সিঁদর লাল এবং সবুজ। এই সবুজ অজন্তা-চিত্রে ব্যবহৃত ঘন উজ্জ্বল সবুজ নয়; বোধ হয় হলুদ এবং নীলে মিশ্রিত সবুজ। প্রয়োজনানুযায়ী একই রঙের গাঢ়তার তারতম্য আছে, ভিন্ন রঙের ব্যবহারও আছে; সর্বোচ্চ স্তরে সাদা, সর্বনিন্সে কালো। কিন্তু যত বৈচিত্ৰ্যই থাকুক, দেবদেবীর রং সর্বত্রই সাধনসূত্রানুযায়ী নিয়মিত ও নির্ধারিত। সাধারণ ভাবে রঙের বিন্যাস অজপ্তা-চিত্রের রীতি ও আদর্শনুযায়ী। অজস্তার মতো এ-ক্ষেত্রেও রঙের ব্যবহারে ডোলের আশ্রয় লওয়া হইয়াছে; বস্তুত, মণ্ডনায়িত ডৌল এই চিত্রগুলির অন্যতম বৈশিষ্টা। তবে, অজস্তার রঙের পরিমিত সঙ্গতির কোনও পরিচয় এই চিত্রগুলিতে নাই! বহিরেখা সর্বদাই কালো অথবা লাল রঙে টানা এবং ভারতীয় চিত্রের সাধারণ রীতি অনুযায়ী সর্বত্রই বহিরেখাটি টানা হইয়াছে আগে সরু তুলিতে এবং পরে দেওয়া হইয়াছে ভিতরকার রঙের প্রলেপ স্থূলতার তুলির সাহায্যে।

চিত্র-বিন্যাসের রীতি অনেকটা ভাস্কর্য-বিন্যাসের রীতিই অনুসরণ করিয়াছে। মূল প্রতিমাটি পার্শ্বপ্রতিমাগুলির চেয়ে আকারে বড় এবং সাধারণত অলংকৃত পটভূমি বা দীর্ঘািয়ত বা অর্ধগোলাকৃতি প্রভামণ্ডলের পটে দণ্ডায়মান বা উপবিষ্ট, অথবা মন্দিরের অলিন্দে স্থাপিত। মূল প্রতিমার দেহকাণ্ডের দুই পাশে এক বা দুই সারিতে, সরলরেখায় বা চক্রাকারে মণ্ডলের অন্যান্য দেবদেবীরা বিন্যস্ত। যে-সব ক্ষেত্রে মূল প্রতিমা কাঠামোর এক পার্শ্বে সে-সব ক্ষেত্রে পার্শ্ব-দেবতারা সারি সারিতে বা অর্ধচক্রাকারে অন্য পার্শ্বে বিন্যস্ত। শূন্যস্থান বড় একটা নাই; যে-সব স্থানে আছে সেখানে বিচরমান বা উড়াউীয়মান সহচর-সহচরী, লতাপাতা, অলংকার প্রভৃতির সাহায্যে বৈচিত্র্য রূপায়িত।

তারিখ-সম্বলিত পাণ্ডুলিপিগুলির সাহায্যে এই চিত্রগুলির একটা ধারাবাহিক বিচার চলিতে পারে, কিন্তু তাহাতে চিত্রশৈলীর বিবর্তনের কোনও ইতিহাস উদ্ধার করা কঠিন। মোটামুটি ভাবে একাদশ ও দ্বাদশ শতকের এই সৃষ্টি-প্রচেষ্টার মধ্যে শিল্পের যে-রােপ প্রত্যক্ষ তাহা অবিচল ও নির্দিষ্ট। বিবর্তমান কোনও প্রবাহ ইহাদের মধ্যে ধরা প্ৰায় যায় না বলিলেই চলে। ছবিগুলি দেখিলে এবং একটু বিশ্লেষণ করিলে স্পষ্টই বুঝা যায়, এই চিত্ররীতি ও শৈলী একটি সুপ্রাচীন ঐতিহ্যের বিবর্তিত রূপ এবং বহুদিন সুঅভ্যস্ত। এই সুবিস্তৃত দেশের অন্যত্র, নানাস্থানে যে শিল্পরূপ ও রীতি প্রাচীর-গোত্রে অথবা পাণ্ডুলিপির পৃষ্ঠায় বহুদিন সুঅভ্যস্ত হইয়া গিয়াছে, যে রূপ ও রীতি বাঘ-অজন্তা-এলোরার গুহাগাত্রে স্বাক্ষর রচনা করিয়াছে তাহাই প্রাচীন বাঙলার এই পাণ্ডুলিপি-চিত্রগুলিতেও ধরা পড়িয়াছে। ইহারা চলমান ভারতীয় চিত্রশিল্প-প্রবাহেরই একটা অচ্ছেদ্য ধারা এবং সেই ধারারই অন্যতম নিরবচ্ছিন্ন প্রকাশ। তবে, এ-কথাও সঙ্গে সঙ্গে স্বীকার্য যে, একাদশ-দ্বাদশ শতকে পৌঁছিয়া সে-ধারা স্তিমিত হইয়া আসিয়াছে, নূতন স্রোত সঞ্চার আর কিছু দেখা যাইতেছে না, নূতনতর সৃষ্টির সম্ভাবনা কমিয়া আসিয়াছে; ঐতিহ্যের বাহক হিসাবেই যেন ইহাদের মূল্য!

চিত্রশৈলী

মহীপালের রাজ্যাঙ্কের পঞ্চম ও ষষ্ঠ বৎসরে লিখিত ও চিত্রিত পাণ্ডুলিপি দুইটির ছবিগুলি বিশ্লেষণ করিয়া দেখা যাইতে পারে। ষষ্ঠ বৎসরে চিত্রিত ছবিগুলিতে (কলিকাতা-এসিয়াটিক-সোসাইটি, ৪৭১৩ নং পাণ্ডুলিপি) শিল্পীর দৃষ্টি রঙের ঘন মণ্ডনায়িত ডোলের প্রতি যতটা সজাগ ঠিক ততটাই সজাগ তরঙ্গায়িত ও প্রবাহমান রেখার ভীেলের দিকে। বহিরেখায় সুপূর্ণ ভীেলের প্রতি সঙ্গতি রাখিয়া অন্যান্য রেখাগুলিকে সূক্ষ্ম বা গভীর করা হইয়াছে। দেহ এবং মুখাবয়বে যেখানে প্রয়োজন সেখানে সাদা রঙের সাহায্যে উচ্চতম স্তর দেখান হইয়াছে। কিন্তু সাধারণ ভাবে কোথাও কোনও স্বচ্ছ সূক্ষ্ম মণ্ডন বা ভাব-ব্যঞ্জনার কোনও পরিচয় নাই; মুখ ও দেহভঙ্গি লাবণ্যবিহীন, কঠিন; সমস্ত রূপায়ণই একান্তভাবে রেখানির্ভর। এই রাজারই পঞ্চম বৎসরে চিত্রিত কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছবিগুলিতে রঙের ঘন মণ্ডনায়িত ভৌলের কোনও চেষ্টা প্রায় নাই বলিলেই চলে, থাকিলেও খুব ক্ষীণ; তুলি টানা হইয়াছে কঠিন সমতলে উচ্চবাচ বা নতোন্নত ইঙ্গিীত-রচনার কোনো চেষ্টাই প্রায় করা হয় নাই। প্রতিমার প্রকৃত ভঙ্গি এবং অবস্থান যাহাঁই হউক না কেন, দেহাবয়ব ও মুখমণ্ডল সর্বদাই কঠিন; শুধু রেখা-প্রবাহের সাহায্যে কিছুটা নমনীয়তার ইঙ্গিত দেওয়া হইয়াছে মাত্ৰ! কিন্তু এই প্রথাবদ্ধ, সমতল এবং তরল রঙের প্রলেপ মণ্ডনায়িত ডৌলসমৃদ্ধ রেখার বিন্যাসকে বিশেষ স্পর্শ করে নাই। বস্তুত, এই পাণ্ডুলিপির চিত্রগুলির তরল ও সমতল পটভূমিতে মণ্ডনায়িত রেখাপ্রবাহই একমাত্র আকর্ষণীয় বস্তু।

সদ্যোক্ত কেমব্রিজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পাণ্ডুলিপি-চিত্রগুলি সম্বন্ধে যে-কথা বলা হইল সে-কথা বোস্টন-চিত্রশালার পাণ্ডুলিপি-চিত্র, সোয়ামুরা পাণ্ডুলিপি-চিত্র, ব্ৰেণ্ডেনবুর্গ পাণ্ডুলিপি-চিত্র, অজিত ঘোষ-সংগ্রহের পাণ্ডুলিপি-চিত্র এবং রাজশাহী-চিত্রশালার পাণ্ডুলিপি-চিত্রগুলি সম্বন্ধেও বলা চলে, অবশ্য খুবই সাধারণ ভাবে। দৃষ্টান্ত স্বরূপ বলা যায়, ব্ৰেণ্ডেনবুর্গ-পাণ্ডুলিপির অধিকাংশ চিত্র রঙের মণ্ডন অত্যন্ত ক্ষীণ, প্রলেপ অত্যন্ত তরল। কিন্তু রেখাগুলি পূর্ণ মণ্ডনায়িত এবং অপরূপ মাধুর্য ও সংবেদনশীলতায় জীবন্ত; বিন্যাসও নিখুঁত। অথচ, এই পাণ্ডুলিপিতেই এমন কতকগুলি ছবি আছে যেখানে রঙের মণ্ডনায়িত ভৌল প্রত্যক্ষ এবং সঙ্গে সঙ্গে রেখার ডেলাও। সুতরাং দেখা যাইতেছে, একই পাণ্ডুলিপির চিত্রমালায় রঙের মণ্ডনায়িত ডোল এবং ডৌলবিহীন তরল সমতল রঙের প্রলেপ একই সঙ্গে পাশাপাশি বিদ্যমান; উভয় ক্ষেত্রেই তরঙ্গায়িত ও প্রবহমান রেখার সমৃদ্ধ ডৌল উপস্থিত। এই বৈশিষ্ট্যের সুস্পষ্ট এবং আরো সমৃদ্ধ অভিজ্ঞান দেখা যায় স্বেতোস্লাভ, রোয়েরিক সংগ্রহের গণ্ডবৃহ-পাণ্ডুলিপির অনেকগুলি চিত্রে। কলিকাতা এসিয়াটিক সোসাইটির এ-১৫ নং পাণ্ডুলিপির চিত্রাবলী তুলনায় অনেক বেশি। সমৃদ্ধ এবং উচ্চাঙ্গের। রঙের মণ্ডনায়িত রূপায়ণ রীতি এ-ক্ষেত্রেও উপস্থিত, তবে ক্ষীণ এবং বৈচিত্রবিহীন, কিন্তু যতখানি আছে ততখানি সুবিন্যস্ত এবং মনোরম। রেখার মণ্ডনায়িত গতির প্রবহমানতা পরিপূর্ণ অব্যাহত। ভাব-ব্যঞ্জনায় এবং ভঙ্গির লালিতেও এই চিত্রগুলি সমৃদ্ধ। বস্তুত, প্রবহমান রেখার এই মণ্ডনায়িত গতিই এই ছবিগুলির মেরুদণ্ড। কিন্তু কোনও কোনও পাণ্ডুলিপি-চিত্রে এই রেখাই হইয়া পড়িয়াছে দুর্বল অনিশ্চিত এবং ভঙ্গুর, যেমন, কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৬৪৩ নং পাণ্ডুলিপিতে, কলিকাতা এসিয়াটিক সোসাইটির ৪২০৩ নং পাণ্ডুলিপিতে। পূর্ব-ভারতীয় শিল্পােদশের এবং রীতির স্বাক্ষর উভয় নিদর্শনেই উপস্থিত, কিন্তু তৎসত্ত্বেও রঙের মণ্ডনায়িত ডৌল এবং রেখার সমৃদ্ধ মণ্ডনায়িত গতি দুইই স্তিমিত ও শিথিল হইয়া পড়িয়াছে; রেখা তো ভঙ্গর এবং নিজীবী বলিলেই চলে। প্রতিমার ভঙ্গি কঠিন, বিন্যাস স্বতন্ত্র ও বিচ্ছিন্ন; বস্তুত, একই চিত্রে একটি প্রতিমা আর একটি প্রতিমার সঙ্গে কোনও আত্মিক যোগসূত্ৰে যেন আবদ্ধ নয়। কলিকতা, এসিয়াটিক সোসাইটির ৯৭৮৯ এ-নং পাণ্ডুলিপির চিত্রগুলি কালক্রমের দিক হইতে বোধ হয় সর্বাপেক্ষা অর্বাচীন। শিল্পশৈলীর দিক হইতে এই চিত্রগুলিকে বাঙলার সমসাময়িক প্রস্তুর-প্রতিমাশিল্পের চিত্ৰিত প্ৰতিলিপি বলা যাইতে পারে। রেখা ও রঙের মণ্ডনায়িত ডৌলই এই চিত্রগুলির বৈশিষ্ট্য এবং সেই হিসাবে পূর্বতন ব্লেণ্ডেনবুর্গ ও এসিয়াটিক সোসাইটির এ-১৫ নং পাণ্ডুলিপির চিত্রগুলির সঙ্গে আত্মীয়তাসূত্রে আবদ্ধ।

এ তথ্য সুস্পষ্ট যে, প্রাচ্য-ভারতীয় এই চিত্ৰকলা বহিরঙ্গ এবং অন্তর্নিহিত সত্তার দিক হইতে সমসাময়িক প্রতিমা-শিল্পের চিত্রিত প্ৰতিলিপি মাত্র। প্রস্তর ও ব্রোঞ্জ-প্রতিমায় যেমন, এই যুগের আলোচ্য চিত্রগুলিতেও তেমনই নির্দিষ্ট বঙ্কিম রেখার নিয়ন্ত্রণে মূর্তি মণ্ডনায়িত; রেখার প্রবহমান তরঙ্গ দেহ-কাঠামো, নাভিবৃত্ত এবং করাঙ্গুলিতে সুস্পষ্ট। পাথরে এবং ধাতুতে যে তরঙ্গ সৃষ্টি করা হইয়াছে সুদৃঢ় বস্তু-পদার্থের নমনীয় রূপাস্তরের সাহায্যে, চিত্রে তাহাই সম্ভব হইয়াছে রঙের মণ্ডণের সাহায্যে। চিত্রের প্রতিমাগুলির মুখাবয়ব ও ভঙ্গি, দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সংস্থান ও ভঙ্গি প্রভৃতি একটু যত্নের সঙ্গে বিশ্লেষণ করিলে সহজেই সমসাময়িক প্রস্তর-প্রতিমাশিল্পের সহিত এই চিত্রশিল্পের পারিবারিক সাদৃশ্য ধরা পড়িয়া যায়।

মূলগত আদর্শের দিক হইতে এই চিত্রশিল্প বাঘ-অজস্তা-এলোরা গুহার প্রাচীর চিন্ত্ৰৈতিহ্যের সঙ্গে নিবিড় সম্বন্ধে আবদ্ধ এবং এই ঐতিহ্যের আশ্রযেই রচিত। .এই শিল্পােদশের দুইটি দিক; একটি ক্ল্যাসিক্যাল, অপরটি মধ্যযুগীয়। এই নামকরণ দু’টির অর্থ আজ পরিষ্কার এবং সৰ্ব্বজনগ্রাহ্য। ক্লাসিক আদর্শের প্রধান বৈশিষ্ট্য রং ও রেখায় পরিপূর্ণ মণ্ডনায়িত ডোলে সমৃদ্ধ রূপায়ণ; মধ্যযুগীয় আদর্শের প্রধান নির্ভর তীক্ষ্ণ, ডৌলবিহীন রেখা এবং তরল সমতল রঙের প্রলেপ। এলোরার এই দুই আদর্শই পাশাপাশি সক্রিয়; একাদশ-দ্বাদশ শতকীয় প্রাচ্য-ভারতীয় চিত্রশিল্পেও তাঁহাই। তাহার ফলে আদর্শ ওঁ রীতির একটা সংমিশ্রণও ঘটিয়াছে। এই সংমিশ্রণের ফলে ক্লাসিক আদর্শের দৈহিক কাঠামোর গভীর, সমাহিত ও ব্যঞ্জনাপূর্ণ রেখার বিবর্তন ঘটে এবং অবিচ্ছিন্ন তরঙ্গায়িত প্রবাহে বহুরেখার সামঞ্জস্যে যে-সব ভঙ্গি মূর্ত হইত সে-সব ভঙ্গি দৃঢ়, তীক্ষ্ণ ও কঠিন ভঙ্গিতে রূপান্তর লাভ করে।

মধ্যযুগীয় রীতি ও আদর্শ

এলোরার চিত্রে এবং সমসাময়িক রাজপুতানার ভাস্কর্যে রেখানির্ভর পরিকল্পনার প্রথম সূত্রপাত এবং এই সংমিশ্রণের প্রকাশ দেখা গেল। অষ্টম শতকে। কিন্তু মধ্যযুগীয় আদর্শের সর্বাপেক্ষা ব্যাপক প্রকাশ ধরা পড়ে পশ্চিম-ভারতে, বিশেষ ভাবে গুজরাট অঞ্চলে, দশম একাদশ-দ্বাদশ শতক হইতেই। তবে, মধ্যযুগীয় শিল্পাদর্শের এই গতি একান্ত ভাবে পশ্চিম-ভারতেই সীমাবদ্ধ ছিল না। বাঙলাদেশে সুন্দরবনে ও চট্টগ্রামে দুই তিনটি তাম্রপট্টে উৎকীর্ণ রেখাচিত্র পাওয়া গিয়াছে। এই চিত্রগুলি একান্ত তীক্ষ্ণ, ভোলবিহীন রেখানির্ভর এবং রেখার সঙ্গে রেখার যোজনা তীক্ষ্ম কৌণিক। ইহাদের রেখার চরিত্র এবং বিন্যাসের সঙ্গে এলোরার কোনও কোনও চিত্রের এবং গুজরাটী জৈন পুঁথিচিত্রের আত্মীয়তা ঘনিষ্ঠ। একাদশ-দ্বাদশ শতকের ভাস্কর্যেও কোথাও কোথাও এই ধরনের রেখার বিন্যাস দৃষ্টিগোচর, যেমন ওড়িশায় ও মধ্যভারতে, রাজপুতানা! ও গুজরাটে। এই নূতনতর শিল্পীরীতি ও আদর্শের প্রাচীনতর ইতিহাস যাহাঁই হউক এবং যেখানেই ইহার প্রাথমিক উদ্ভব দেখা দিক না কেন একাদশ-দ্বাদশ-ত্ৰয়োদশ শতকেই ইহা একটি সর্বভারতীয় রীতি ও আদর্শ বলিয়া স্বীকৃত ও অভ্যস্ত হইয়াছিল। সমসাময়িক বাঙলার প্রস্তর ও ধাতব-ভাস্কর-শিল্পে এই নূতন রীতি ও আদর্শের স্পর্শ কিছু লাগে নাই, কিন্তু সমসাময়িক চিত্রকলার পক্ষে ইহার প্রভাব কাটাইয়া চলা সম্ভব হয় নাই। এই প্রভাব যে শুধু সদ্যোক্ত তাম্রপট্টের রেখাচিত্রগুলিতেই তাহা নয়, পূর্বালোচিত কোনও কোনও পুঁথিচিত্রেও সুস্পষ্ট, বিশেষ ভাবে যে পাণ্ডুলিপিগুলির চিত্রণ ও রচনা নেপালে। পূর্ব-ভারত হইতে এই প্রভাব নেপালে এবং ব্ৰহ্মদেশেও বিস্তার লাভ করে।

এই মধ্যযুগচিহ্নিত রেখানির্ভর চিত্র-পরিকল্পনা যে-তিনটি তাম্রপট্রোৎকীর্ণ রেখাচিত্রে পূৰ্ণ-পরিণতরূপে দৃষ্টিগোচর, তাহার একটির কথা উল্লেখ করিয়াছেন আচার্য কুমারস্বামী তাহার Portfolio of Indian Art-গ্রন্থে; ইহার প্রতিচিত্রও তিনি প্রকাশ করিয়াছেন। ইহার তারিখ আনুমানিক একাদশ শতক। দ্বিতীয়টি রাজা ভোম্মানপালের সুন্দরবন-পট্টোলীর পশ্চাদপটে উৎকীর্ণ। তৃতীয়টি চট্টগ্রাম-জেলার মোহার-গ্রামে প্রাপ্ত দেববংশীয় জনৈক রাজার পট্টোলীর উপরিভাগে উৎকীর্ণ। শেষোক্ত দুইটিরই তারিখ দ্বাদশ-ত্ৰয়োদশ শতক এবং দুইটিই অধুনা আশুতোষ-চিত্রশালায় রক্ষিত। উভয় চিত্রেই তীক্ষ রেখার দ্রুত রূপায়ণ, এবং সে-রূপায়ণে সজীব প্রবহমানতা অব্যাহত; অবিচ্ছিন্ন গতিও অক্ষুঃ। তবে, বেশ বুঝা যায়, যেখানেই সামান্য সুযোগও পাইয়াছেন শিল্পী। সেইখনেই চঞ্চল বঙ্কিম রেখাপ্রবাহ সৃষ্টি করিয়া পরিতৃপ্তি লাভ করিয়াছেন। তাহা ছাড়া, অকিঞ্চিৎকর বিষয়বস্তুতেওঁ এমন একটা অহেতুক প্রাণময়তা ও রেখাপ্রাচুর্য পরিস্ফুট বিষয়বস্তুর সঙ্গে যাহার কোনও সঙ্গতি দেখা যায় না। বস্তুত, এই রেখা-পরিকল্পনা কোনও গভীর উপলব্ধি বা প্রেরণা হইতে উদ্ভূত বলিয়াই মনে হয় না। সম্ভবত, এই অস্বাভাবিক ও সঙ্গতিবিহীন প্রাচুর্য ও প্রাণময়তার ফলেই পার্শ্ব হইতে খচিত অর্ধাকৃতি অথবা ত্রি-চতুর্থাংশ চিত্রিত মুখমণ্ডলের রেখা চধুবৎ সুতীক্ষ্ণ নাসিকায় অথবা কৌণিক চিবুকে, তীক্ষ ধনুকাকৃতি ভ্ৰ, অথবা দীর্ঘািয়ত বঙ্কিম উর্ধের্বাষ্ঠে পরিণতি লাভ করিয়াছে। মনে হয়, শিল্পী যেন তীক্ষ দ্রুত রেখার বিলাসে প্রায় আত্মবিস্মৃত হইয়া গিয়াছেন, কারণ রঙের মণ্ডণায়িত রূপায়ণ যেখানে নাই। সেখানে শিল্পীর হাতে রেখাই বিষয়বস্তুর সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশের একমাত্র অবলম্বন। চঞ্চল ও দীর্ঘািয়ত বঙ্কিম রেখা সৃষ্টির প্রচেষ্টার মধ্যে এই কামনা প্রত্যক্ষ। এমন কি প্রতিমার সম্মুখভঙ্গি চিত্রণের সময়ও মুখমণ্ডলকে সম্পূর্ণ রেখানির্ভর করিয়াই আঁকা হইয়াছে এবং শিল্পী যেখানেই তীক্ষ ভাব সঞ্চারের অবকাশ পাইয়াছেন সেখানেই রেখাগুলিতে ভীষণ চাঞ্চল্য ও পুনরাবৃত্তি দেখা দিয়াছে। মেহারে প্রাপ্ত রেখাচিত্রটিতে অবশ্য অধিকতর শক্তির বিকাশ; তাহার প্রধান কারণ, এই চিত্রটির রেখা-রূপায়ণ খানিকটা মণ্ডণায়িত। কিন্তু এ-ক্ষেত্রেও মধ্যযুগীয় শিল্পীরীতি ও আদর্শের স্বাক্ষর সুস্পষ্ট।

আদর্শের সাদৃশ্য অত্যন্ত সুস্পষ্ট! তবে, পার্থক্যও সমান প্রত্যক্ষ। পশ্চিম-ভারতীয় অঙ্কনরীতিতে রেখা অত্যন্ত বেশি তীক্ষ্ণ ও উজ্জ্বল, কোণগুলি প্রায় জ্যামিতিক চিত্রের মতো সূক্ষ্ম, ভগ্ন অথবা ভঙ্গুর রেখা একান্ত প্রাণহীন , আবেগহীন। প্রাচ্য-ভারতীয় পাণ্ডুলিপি-চিত্রগুলির কিংবা তাম্রপট্রোৎকীর্ণ রেখাচিত্রগুলির লালিতাময়, আবেগময় রেখার সংবেদনী ক্ষমতা পশ্চিমী রেখার নাই। পশ্চিমী রেখা কঠিন ও সমতল চিত্ৰভূমিকে তাহার নির্দিষ্ট বন্ধনীর মধ্যে শুধু আবদ্ধ করিয়া রাখে মাত্র; প্রাচ্য-ভারতের আবেগর্মিয় সংবেদনী রেখা বন্ধনীবদ্ধ চিত্ৰভূমির মণ্ডণায়িত রূপটিকে প্রকাশ করে। রেখা-বিন্যাসের এই ঐতিহ্য শুধু যে নেপালে ও ব্রহ্মদেশে বিস্তৃতি লাভ করিয়াছিল তাঁহাই নয়, মধ্যযুগের শেষপাদেও এই ঐতিহ্য বাঙলা-আসাম-ওড়িশায় বাঘ-অজস্তার বিশুদ্ধ আদর্শের পাশাপাশি নিজ অস্তিত্ব বজায় রাখিয়াছিল। আধুনিক কালে কলিকাতার কালীঘাটের পটে অজস্তার রেখা-রচনার রীতি ও আদর্শ উজ্জবীবিত ছিল। বিংশ শতকের প্রথম পাদ পর্যন্ত; আর মধ্যযুগীয় আদর্শ বলবত্তর ছিল ফরিদপুর-যশোহর-মেদিনীপুর-বাঁকুড়া-বীরভূমের জড়ানো পটে। এ-ক্ষেত্রেও বাঙলার চিত্রকলা কোনও বিচ্ছিন্ন স্বতন্ত্র সত্তা নয়, বরং সমসাময়িক সর্বভারতীয় চিত্ররীতি ও আদর্শের স্থানীয় বৈশিষ্ট্যযুক্ত একটি অধ্যায় মাত্ৰ।